• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৪৮ | মে ২০১১ | প্রবন্ধ
    Share
  • ফিনল্যাণ্ডের চিঠি (অমিয় চক্রবর্তীর একটি অসংকলিত রচনা) : সুমিতা চক্রবর্তী


    ।। ফিনল্যাণ্ডের চিঠি ।।


    ..... উড়ো জাহাজ এইমাত্র ফিনল্যাণ্ডের [১] ঘাটে এসে পৌঁছল । বাল্‌টিক [২] সাগরের জল রোদ্দুরে ঝলমল করছে, এখন সকাল আটটা । ওবো [৩] - শহরে নেমেছি - ঘন্টা-কয়েক থাক্‌ব । তার পর ট্রেনে ক'রে হেলসিংফোরস্‌ [৪] যাব । কি সুন্দর দেশ ! হাওয়া আলো এখন ঠিক আমাদের দেশের মত - ঠিক রকমের ঠাণ্ডার স্পর্শ, আকাশ নির্মল নীল ট্রামে ক'রে শহরের বাগানে একটা কাফেতে এসে বসেছি - সাম্‌নে ছোট্ট অরা নদী, ছোট্ট ছোট্ট নৌকো, মোটর-বোট ভাস্‌ছে, ওপারে বাগানবাড়ী, এপারে ঘাসের তট, বাগানে ফুল ফুটেছে । এখনও কেউ আসে নি এই কাফেতে খেতে - ভাষা তো বোঝা অসাধ্য, তাই হাত পা নেড়ে বোঝালাম, কফি আর প্রাতরাশ চাই । এখনই আনবে । তার পর ছোট্ট শহর ঘুরে দেখব । এখানকার বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিদ্যার্থী - পরিষদে খবর দিয়েছে সুইডেন [৫] থেকে, তাদের প্রতিনিধি দুপুরবেলা আমাকে নিয়ে ঘুরবে, আতিথ্য দেবে ।

    বহুকাল থেকে মনে স্বপ্ন ছিল ফিনল্যাণ্ড দেখব - এত দিনে সার্থক হ'ল । অরণ্য, হ্রদ এবং দ্বীপের এই দেশ - নানা জাতি নানা ভাষার আদিম মিশ্রণ এখানে, শীতকালে বরফে সমস্ত জীবন-সংসার বন্দী হয়ে থাকে, তখন ধূসর-শুভ্র মেরুর প্রকাশ পাইন-বন থেকে সমুদ্র পর্য্যন্ত । বাকী সময় প্রাণের উচ্ছ্বসিত প্রাচুর্য্য, গ্রামে শহরে নূতন কালের আনন্দিত আত্মপ্রকাশ । রাশিয়া [৬] এবং সুইডেনের দুই প্রান্ত এসে ঠেকেছে ফিনল্যাণ্ডের সীমানায়, এদের সভ্যতায় তার পরিচয় । অথচ ভাষায় ব্যবহারে শিল্পে এদের সম্পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য এবং আধুনিক কালে এরা দ্রুত এগিয়ে গেছে । জীবনযাত্রার ব্যবস্থায় এরা কারও চেয়ে কম নয় - সুইডেনের মত এখানেও ইলেকট্রিসিটি যুগান্তর এনেছে; এদের মাছের ব্যবসা, কারুশিল্পের প্রচলন বিজ্ঞানকে ব্যবহারে লাগিয়েছে । হায় রে ভারতবর্ষ ! এখনও দেশে বহু লোক ভাবছে বিদেশী তাড়িয়ে কোন মতে পাড়াগাঁর ডোবায়, মন্দিরে, ম্যালেরিয়ায় অভিভূত হয়ে থাকতে পারলেই মোক্ষলাভ হবে । বিদেশীর হাত হ'তে নিষ্কৃতি যে-প্রবল জাগ্রত বুদ্ধির যোগে সম্ভবপর হবে সেই বুদ্ধি জ্ঞান-বিজ্ঞানকে দূরে রাখে না, সে-বুদ্ধি পাণ্ডা পুরোহিতকে দূর ক'রে পঞ্জিকা পুড়িয়ে জ্ঞানের উন্নত গগনে নূতন কালে আপনাকে জানতে চায় । হয়ত সেই চেতনা আমাদের দেশে আজ সক্রিয় হয়ে উঠছে, কিন্তু দেশের কাগজে তার তেমন পরিচয় পাই না, দেশের সাহিত্যেও তার সহজ আগ্রহ দেখি না । ফিনল্যাণ্ডের সামান্য সাধারণ কাঠুরে বা মাঝি যে-স্বাধীনতাকে প্রাত্যহিক অভ্যাসে, চিন্তায় স্বীকার করতে চায়, আমাদের দেশী বহু নেতা বা শিষ্যদল তাকে অস্বীকার ক'রে চক্রান্ত এবং মিথ্যা আন্দোলনের যোগে রাষ্ট্রিক মুক্তি কামনা করছেন ।

    জহরলালের [৭] মত মনস্বী নেতা দুর্লভ, আশা করা যায় তিনি কিছু পরিমাণে দেশের মন বদলাতে পারবেন । সুভাষ বাবুকে ত শাসনতন্ত্র বন্দী ক'রেই রাখ্‌ল । [৮] বাংলা দেশে নূতন মননের নেতা আজ কোথায় ? হয়ত কলেজ স্কোয়ারে বাংলার গ্রামের কোণায় এখানে-ওখানে তাঁরা জাগছেন - তাঁরা যেন ফিনল্যাণ্ডকে মনে রাখেন । অর্থাৎ আগামী ভারত - সভ্যতাকে নূতন যুগের চোখে, পৃথিবীর মানুষ জাতির আত্মীয় রূপে চেয়ে দেখেন । তবেই ভারতবর্ষ রাষ্ট্রে, লোক-ব্যবহারে, আধ্যাত্মিক সত্যবোধে জীবন-কর্মে মুক্ত হবে ।

    আমার এই পশ্চিম-ভ্রমণ তীর্থযাত্রা হয়ে দাঁড়িয়েছে - তীর্থযাত্রা, কিন্তু আপন আত্মীয়মণ্ডলীর মহলে মহলে আনাগোনা । যে-অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করলাম তাতে জীবন সার্থক হ'ল, জানলাম, স্বীকার করলাম, মানুষের পৃথিবীতে এসে প্রাণকে ভালোবাসলাম । প্রাণের জয়গান শুন্‌লাম দ্বীপে দ্বীপে, বন্দরে বন্দরে, কত নিভৃত সুদূর লোকালয়ে । দুঃখ, অন্যায় অসত্যকে ছিন্ন ক'রে দেশে দেশে এই ওঙ্কার উঠেছে জীবনযাত্রার - কত সন্ধ্যায় কত লোকের বাড়ীতে, উৎসবে, নিভৃত আলাপে মনে মনে বলেছি এই তো পেয়েছি ! আজ স্বদেশে ফেরার কালে ভাবছি, কি ভাবে দেশের আলোয় লোকালয়ে পুনর্মিলনের সুরে শুন্‌ব প্রাণের এই আহ্বান, প্রাণের এই স্বীকৃতি । আর কিছু নয়, জীবন থেকে বিদায় নেবার আগে দেশে শুনতে চাই সত্যের সুরে স্বাধীনতার সঙ্গীত, যেন দেখতে পাই এখনকার নবীন বাঙালীর জীবনে মানব-সংসারের বিশ্বভূমিকা ।

    অনেক সময়েই ভিড়ের মধ্যে থাকি, হোটেলে, মিটিঙে নিমন্ত্রণ পর্বে, অল্প সময়ে অনেক কিছু কর্‌তে হয়, তাই হুড়োহুড়ি অনিবার্য্য । ..... সুইডেনে আশ্চর্য্য সমাদর পেয়েছি; হামবুর্গের [৯] প্রকাণ্ড কন্‌ফারেন্সের কাগজপত্র ছবি হয়ত এত দিনে পৌঁছেছে । কি বিরাট আয়োজন - একমাত্র জার্মান জাতিই এমন নিপুণ, সুন্দর ব্যবস্থা করতে পারে । জার্মানদের আধুনিক রাষ্ট্রিক ব্যবহারে বহু অন্যায় প্রবল হয়ে রয়েছে, কিন্তু ওদের ভিতরকার বীর্য্য মরে নি - কন্‌ফারেন্সের প্রতি পালায় তার পরিচয় পেয়েছি ওদের অকৃত্রিম সৌজন্যে, বুদ্ধির প্রসন্ন নির্মল প্রকাশে, জ্ঞানের গভীরতায় । সমস্ত শহর জুড়ে এই Welt Congress [১০]]- এর উৎসব - সে যে কি প্রকাণ্ড ব্যাপার তা আরও বই ছবি যখন বেরবে তখন জানা যাবে ।

    সময় পেলে উড়োপথের বিবরণ লিখব - আকাশযাত্রীর ভারতীয় চোখে পশ্চিমদেশ দর্শন । কি আরামে ঘুরেছিলাম কি বল্‌ব ! এখন এই বাল্টিকের ছোট্ট জাহাজও বেশ লাগছে - এর কবিত্ব অন্য রকম । এক পৃথিবীর জীবনে কতখানি ধরে !


    প্রবন্ধ - পরিচিতি

    প্রবন্ধ : ফিনল্যাণ্ডের চিঠি


    অমিয় চক্রবর্তী (১৯০১-১৯৮৬) ছিলেন রবীন্দ্রনাথের বিশেষ ঘনিষ্ঠ অনুজ কবি । অনেকদিন - ১৯২৫ থেকে ১৯৩৩ পর্যন্ত কাজ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য-সচিব রূপে । অমিয় চক্রবর্তী ১৯৩৩ সালে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সচিবের দায়িত্ব ছেড়ে অক্‌স্‌ফোর্ড-এ চলে যান ইংরেজি সাহিত্য বিষয়ে গবেষণা করবার জন্য । অক্‌স্‌ফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বৃত্তি পেয়েছিলেন । প্রথম মহাযুদ্ধ-উত্তর ইউরোপীয় কবিতা নিয়ে গবেষণা করবার ইচ্ছা ছিল তাঁর । তিনি প্রখ্যাত অধ্যাপক ও সমালোচক ল্যাসেলেস অ্যাবারক্রম্‌বি (Lascelles Aburcrombie, 1881-1938)-র তত্ত্বাবধানে কাজ শুরু করেন । তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল টমাস হার্ডি (Thomas Hardy, 1840-1928) রচিত, নেপোলিয়ন-এর যুদ্ধ অবলম্বন করে লেখা কাব্যনাট্য 'দ্য ডাইনাস্ট্‌স্‌' (প্রথম খণ্ড ১৯০৪, দ্বিতীয় খণ্ড ১৯০৬, তৃতীয় খণ্ড ১৯০৮) এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে মহাযুদ্ধোত্তর ইউরোপীয় কবিতার গতি-প্রকৃতি । গবেষণা-সন্দর্ভের শিরোনাম ছিল 'দ্য ডাইনাস্ট্‌স অ্যাণ্ড দ্য পোস্ট ওয়র এজ ইন পোয়েট্রি' (The Dynasts and the Post War Age in Poetry) । তাঁর গবেষণা সমাপ্ত হয় ১৯৩৭ সালে; ঐ সালেই মার্চ মাসে অমিয় চক্রবর্তী ডক্টরেট উপাধি অর্জন করেন ।

    অক্‌স্‌ফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পূর্বোক্ত শিরোনামে তাঁর গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৩৮ সালে ।

    অমিয় চক্রবর্তী ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত টানা অক্‌স্‌ফোর্ড-এ ছিলেন । এই সময়ে তাঁর ভ্রামণিক বৃত্তি বিশেষভাবে সজীব ও সক্রিয় হয়ে উঠেছিল । ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে প্রচুর ভ্রমণ করেছিলেন তিনি । তার কিছু কিছু উল্লেখ ও সংক্ষিপ্ত বিবরণ পাওয়া যাবে রবীন্দ্রনাথকে লেখা তাঁর বিভিন্ন চিঠিপত্রে (দ্রষ্টব্য 'কবির চিঠি কবিকে', ভূমিকা - টীকা-সম্পাদনা নরেশ গুহ, প্যাপিরাস, কলকাতা, ১৯৯৫) ।

    জার্মানির হামবুর্গ শহরে ১৯৩৬ সালের ২৩ জুলাই থেকে ৩০ জুলাই একটি আন্তর্জাতিক আলোচনা-চক্র অনুষ্ঠিত হয়েছিল । আলোচনা-চক্রের বিষয় ছিল 'অবসর, সময় এবং সৃষ্টিমূলক উপভোগ' (Leisure, Time and Recreation) । অমিয় চক্রবর্তী সেই সম্মেলনে একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন । প্রবন্ধটির নাম ছিল 'লিজার অ্যাণ্ড দি মডার্ন ইয়ুথ ইন্‌ দ্য ওয়েস্ট অ্যাণ্ড দ্য ইস্ট' (Leisure and the Modern Youth in the West and the East) । এই প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল 'বিশ্বভারতী কোয়ার্টারলি' পত্রিকার ১৯৩৬-৩৭ সালের নভেম্বর-জানুয়ারি সংখ্যায় । প্রবন্ধের সঙ্গে পাদটীকায় উল্লেখিত হয়েছিল হামবুর্গ-এর সম্মেলন ও তাতে অমিয় চক্রবর্তীর অংশ গ্রহণের কথা ।

    এই আলোচনা-চক্রের শেষে অমিয় চক্রবর্তী এক দিনের জন্য বেড়াতে গিয়েছিলেন ফিনল্যাণ্ড । তারিখটি ছিল ৫ অগাস্ট ১৯৩৬ । ঐ তারিখে লেখা চিঠিতে তিনি রবীন্দ্রনাথকে জানাচ্ছেন - "এখানে আমাদের Conference হয়ে গেল - আজ Finland -এ যাচ্চি, সেখান থেকে লিখব ।" (কবির চিঠি কবিকে, ভূমিকা-টীকা-সম্পাদনা নরেশ গুহ, প্যাপিরাস, কলকাতা, ১৯৯৫, পৃ. ১৬৪) ।

    সেই পর্যটনের সংক্ষিপ্ত এই বিবরণী প্রকাশিত হয়েছিল 'প্রবাসী' পত্রিকার কার্তিক ১৩৪৩ (১৯৩৬) সংখ্যায় । পত্র-রীতিতে রচিত এই বিবরণী । তবে লেখার ভঙ্গি থেকে মনে হয় কোনো বন্ধুকে প্রকৃতই পত্র লিখেছিলেন । ব্যক্তিগত সম্পর্কের একটা সুর আছে লেখাটির শেষের দিকে । পত্রিকায় প্রকাশকালে চিঠির প্রথমাংশ বর্জিত হয়েছিল বলে পত্রের প্রাপক কে তা নিঃসংশয়ে জানা যাচ্ছে না । রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের পুত্র কেদারনাথ চট্টোপাধ্যায় হওয়া অসম্ভব নয় । কেদারনাথের সঙ্গে অমিয় চক্রবর্তীর বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল । রবীন্দ্রনাথ যখন ১৯৩২ সালের এপ্রিল-মে মাসে ইরান ও ইরাক ভ্রমণে গিয়েছিলেন তখন প্রতিমা দেবী ছাড়া অমিয় চক্রবর্তী ও কেদারনাথ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন তাঁর সঙ্গী । সংক্ষিপ্ত লেখাটিতে জার্মান, ফিনল্যাণ্ড ও ভারতের প্রসঙ্গ মিশে আছে । কোথাও এই লেখাটি সংকলিত হয়নি । অমিয় চক্রবর্তীর প্রবাসী কন্যা শ্রীমতী সেমন্তী ভট্টাচার্য পিতার যাবতীয় অসংকলিত রচনা ব্যবহার করবার অনুমতি আমাকে দিয়েছেন । তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানাই । অমিয় চক্রবর্তীর ভ্রমণ নিবন্ধটি সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদত্ত হল ।


    টীকা :

    [১] ফিনল্যাণ্ড (Finland) - 'রিপাবলিক অভ্‌ ফিনল্যাণ্ড' উত্তর ইউরোপের নাতিবৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ । উত্তরে নরওয়ে, উত্তর পশ্চিমে সুইডেন, পূর্বে রাশিয়া, দক্ষিণ-পশ্চিমে খাঁড়ি । স্ক্যানডিনেভীয় ও বল্‌টিক জাতি-গোষ্ঠীর মানুষের বসবাস । নদী পাহাড় হ্রদ সহ প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ দেশটির মানুষের জীবিকা প্রধানত ছিল মৎস্য ব্যবসায় । জলপথে পরিবহন-ব্যবসায়ের কাজেও ফিনল্যাণ্ড গুরুত্বপূর্ণ । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে এখানে শিল্প গড়ে উঠেছে । মিশ্র অর্থনীতির দেশে রাষ্ট্রায়ত্ত ও ব্যক্তিগত উদ্যোগ - দুইই আছে । দেশের অর্থনীতি সুদৃঢ়, একশো শতাংশ মানুষই সাক্ষর । ফিনিশ ও সুইডিশ - দুটি ভাষাই প্রচলিত । রাজধানী হেলসিংকি ।

    [২] বল্‌টিক (Baltic) - স্ক্যানডিনেভীয় পেনিনসুলা এবং ডেনমার্ক সংলগ্ন যে অঞ্চলটিতে আটলান্টিক মহাসাগরের একটি অংশ ঢুকে গেছে - সেই জলরাশিকেই বলে বলটিক সাগর ।

    [৩]ওবো (Obo ?) - বলটিক সাগর সংলগ্ন, ফিনল্যাণ্ড-এর একটি ছোটো শহর ।

    [৪]হেলসিংফোর্‌স (Helsingfors) - দক্ষিণ সুইডেন-এর নগর ও বন্দর । ঠিক বিপরীত দিকে এলসিনোর, মধ্যে জলপথ । স্থলপথও আছে । ইউরোপের উত্তরাঞ্চলের সর্বত্র যোগাযোগ ব্যবস্থা ও পরিবহনের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ শহর ।

    [৫]সুইডেন (Sweden) [৫]সুইডেন (Sweden)

    [৬]রাশিয়া (Russia) - পৃথিবীর বৃহত্তম দেশ । ১৭২১ থেকে ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত ছিল । রাশিয়ার সম্রাটের অভিধা ছিল জার । ১৯১৭ সালে বলশেভিক কমিউনিস্ট পার্টির বিপ্লব সফল হবার পর কমিউনিস্ট শাসন প্রবর্তিত হলে সংলগ্ন ক্ষুদ্রতর দেশগুলি সহ নাম হয় 'ইউনাইটেড সোভিয়েট সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক' (United Soviet Socialist Republic) । এশিয়া মহাদেশের উত্তর-শীর্ষে রাশিয়া; পশ্চিমে ফিনল্যাণ্ড, এসতোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, বেলারুস, উক্রেইন প্রভৃতি দেশ এবং বল্‌টিক ও কৃষ্ণ সাগর । দক্ষিণে জর্জিয়া, আজেরবাইজান, কাজাখ্‌স্তান, মঙ্গোলিয়া, চীন, উত্তর কোরিয়া । পূর্বে ও উত্তর-পূর্বে প্রশান্ত মহাসাগর ও আর্কটিক সাগর । রাজধানী মস্কো । স্লাভিক জাতি-গোষ্ঠীর ও ভাষা-গোষ্ঠীর মানুষই প্রধান । অন্যান্য ভাষাও আছে । অধিবাসীরা প্রধানত অর্থডক্‌স্‌ খ্রিস্টধর্মাবলম্বী । তার পরেই ইসলাম ধর্মের মানুষ ও কিছু বৌদ্ধ । রাশিয়ার প্রাচীন লোক-সংস্কৃতি এবং নৃত্যকলা, শিল্প ও সাহিত্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ । জারতন্ত্রে শ্রেণীশোষণ ছিল তীব্র মাত্রায় । সমাজতন্ত্রবাদী শাসন-ব্যবস্থায় রাশিয়ায় সর্বশ্রেণীর মানুষের অনেকটা অর্থনৈতিক উন্নতি হয় । দেশটি সব দিকেই দ্রুত অগ্রসর হয় ও একটা সময়ে বিশ্বশক্তিতে পরিণত হয় । ১৯৯১ সালে সমাজতন্ত্রবাদী প্রশাসন-কাঠামো নানা কারণে ভেঙে পড়ায় 'সংযুক্ত সোভিয়েত সমাজবাদী সাধারণতন্ত্র' ভেঙে গেছে । বর্তমানে রাশিয়ায় ডুমা (Duma - অর্থ পার্লামেন্ট) নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রপতির শাসন প্রচলিত ।

    [৭]"জহরলালের মত মনস্বী নেতা দুর্লভ, ...." (Jawaharlal Nehru, 1889 - 1964) - ভারতের জাতীয় কংগ্রেস-এর বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব । মতিলাল নেহরু (১৮৬১ - ১৯৩২)-র পুত্র জওহরলাল নেহরু অল্প বয়সেই রাজনীতিতে আসেন । ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় কংগ্রেস দলের সদস্যদের মধ্যে সুশিক্ষিত, মেধাবী ও মননশীল নেতারূপে অল্পদিনের মধ্যেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন তিনি । গান্ধীজির বিশ্বাসভাজন, ঘনিষ্ট ও প্রিয়পাত্র ছিলেন । ১৯৩৬ সালের মধ্যেই দুবার তিনি কংগ্রেস-এর সভাপতি পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন । অমিয় চক্রবর্তীর সঙ্গে জওহরলাল নেহরুর সুসম্পর্ক ছিল ১৯৩০ সাল থেকেই । ক্রমে তা হৃদ্যতায় পরিণত হয় । স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু-র সঙ্গে শেষ পর্যন্ত তাঁর প্রীতি-সম্পর্ক বজায় ছিল ।

    [৮]"সুভাষবাবুকে ত শাসনতন্ত্র বন্দী করেই রাখল ।" (Subhash Chandra Bose, 1897 - ?) - সুভাষচন্দ্র ছিলেন মেধাবী ও উজ্জ্বল ছাত্র । দেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন নিয়ে যোগ দিয়েছিলেন কংগ্রেস-এ । ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের জোরে তিনি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন । অমিয় চক্রবর্তীর এই ভ্রমণ বিবরণীটি রচনাকালে সুভাষচন্দ্র কোনো স্বতন্ত্র রাজনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ না করলেও কংগ্রেস দলের সংখ্যাগরিষ্ঠের সঙ্গে তাঁর অনুগত একটি গোষ্ঠীর মতপার্থক্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল । কিছুকাল পরেই তিনি গান্ধীজি-র মনোনীত প্রার্থী পট্টভি সীতারামাইয়াকে পরাস্ত করে কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হন । তারপরে সে পদ তিনি ত্যাগ করেছিলেন (১৯৩৮) । সুভাষচন্দ্রের গতিবিধির উপর ব্রিটিশ সরকারের নজর ছিল । উদ্ধৃত বাক্যে এই ইঙ্গিতই আছে বলে মনে হয় । কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দের অনেকের সঙ্গেই অমিয় চক্রবর্তীর পরিচয় ছিল । তিনি সুভাষচন্দ্রকে ১৯৩২ সাল থেকে চিনতেন । সুভাষচন্দ্র ১৯৩৩ সালে চিকিৎসার জন্যে ইউরোপে যান । জার্মানিতে থাকাকালীন ১৯৩৪ - ৩৫ এ তাঁর সঙ্গে অমিয় চক্রবর্তী-র পুনরায় সংযোগ স্থাপিত হয় । সুভাষচন্দ্রের নাটকীয় দেশত্যাগ (১৯৪১) এবং আজাদ হিন্দ ফৌজ-এর সর্বাধিনায়ক 'নেতাজি' রূপে তাঁর পুনরাবির্ভাব ঘটেছিল আরও পরে ১৯৪৪-৪৬ সালে । অতঃপর তিনি দেশের বাইরে চলে যান এবং তাঁর মৃত্যু হয় । কোথায়, কিভাবে এবং কবে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল তার কোনো নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায়নি ।

    [৯]হামবুর্গ (Hamburg) - উত্তর জার্মানির এক প্রধান নগর ও বন্দর । ইউরোপের বৃহত্তম সমুদ্র-বন্দরগুলির একটি । সমৃদ্ধ নগরী, জার্মানির একটি প্রধান ব্যবসায় কেন্দ্র । শিক্ষা-শিল্প-সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রেও অগ্রগণ্য । হামবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতি বহু বিস্তৃত ।

    [১০]Welt Congress - জার্মান ভাষায় 'ওয়েল্ট' (Welt) শব্দের অর্থ 'বিশ্ব' (World) । হামবুর্গ শহরে যে আন্তর্জাতিক বিশ্ব-সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল (দ্রষ্টব্য প্রবন্ধ-পরিচিতি অংশ) তার কথাই এখানে বলা হয়েছে ।

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments