অনেক কথা বলেছিলেম কবে তোমার কানে, কত গোপন অন্ধকারে ... আমাদের গলি উপগলিতে ছিল বারুদের গন্ধ ...... বুলেটের ফাঁক-ফোকড় দিয়ে আমরা পেরিয়ে আসছিলাম সত্তর দশক। গাঢ় কুয়াশার মধ্যে আমরা ঈশ্বরের সমাধিভূমির কাছে চলে আসি। সে সময় শতাব্দীর বৃক্ষসকল ম্লান, আমরা খুঁজে পেতে থাকি আমাদের দেবতা: কাফকা, ব্রেশট, লোরকা, গোদার, জীবনানন্দ বা ঋত্বিক।
আজ ছাত্রদের পত্রিকা যখন দেখি কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে, বিষণ্ণ হই : বাংলা কি তবে লুপ্ত ভাষা হয়ে গেল! কোনো নবীন চিন্তা ডালপালা মেলছে না। যা মুদ্রিত হচ্ছে তা উদ্বৃত্ত এন. আর. আই - দের অপদার্থ ইংরেজীর স্থূল চর্চা। অথচ ঠিক পঞ্চাশ বছর আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে 'একতা' নামে ছাত্র-মুখপত্র ছিল। দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় তারা রবীন্দ্র-শতবর্ষ সংখ্যা করেছিলেন। কি সে তরুণ প্রাণের ঐশ্বর্য। তার পাশাপাশি হাঁটতে পারে এমন আর একটি ছাত্র পত্রিকাই আমার স্মৃতিতে আছে । তা ১৯৭৪-৭৫ সালের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র পরিচালিত শিল্প ও সাহিত্য সংসদের মুখপত্র, সম্পাদক ছিলেন ধাতুপ্রযুক্তিবিদ্যার ছাত্র নিরুপম চক্রবর্তী, এও প্রায় অলৌকিক সমাপতন যে ওই সংখ্যায় আমার লেখা, বাংলা ভাষায় প্রথম, চলচ্চিত্রে যাকে নাশকতার দেবদূত বলা হয়, সেই জঁ-লুক গোদারের অন্যতম কাহিনীচিত্র 'ম্যাস্কুলাঁ-ফেমিনাঁ' র পূর্ণাঙ্গ ভাষান্তর ছাপা হয়; সটীক ও সভাষ্য, আর গত শতাব্দীর কবিতার অন্যতম শাসক ফেদেরিকো গার্থিয়া লোরকার দীর্ঘ কবিতা ইগনাশিও সাঙ্কেজ মেইয়াজের জন্য শোকগাথা অনুবাদ করেন নিরুপম। না আমি, না নিরুপম কেউই তখন জানতাম না গোদার মধ্যষাটে তার 'পিয়েরো ল্যোফু' (ক্ষ্যাপাটে পিয়েরো) ছবিতে ব্যবহার করেন ওই কবিতার অমর চরণ - "ঘড়িতে তখন কাটায় কাটায় বিকেল পাঁচটা বাজে ... কি মারাত্মক পাঁচটা বাজল তখন!" যে মাতাদর লোরকার ব্যক্তিগত জীবনের বন্ধু, ষাঁড়ের লড়াইয়ে তার মৃত্যু শুধু এক বিধুর প্রয়াণকাব্য নয়, লোরকার কৃতিত্ব যে একটি ব্যক্তিগত শোক ও জনপ্রিয় ষণ্ডক্রীড়ার করুণ পরিণামকে তিনি জাতির বেদনাঘন মুহূর্তের সঙ্গে জুড়ে দিতে পেরেছেন। এ যেন স্পেনের বাইশে শ্রাবণ - এক উপমারহিত জাতীয় ব্যালাড। আজ ইতালীয় মার্কসবাদী মনস্বী আন্তোনিও গ্রামশ্চির সৌজন্যে বুঝতে পারি লোক নায়ক সৃষ্টি করে লোরকা ক্রমেই এগিয়ে যেতে চান 'জাতীয়-জনপ্রিয়' চৈতন্যের উদ্বোধনে এ ধরনের প্রয়াস ফরাসী কবি পল এলুয়ার তার 'এলসার চোখ' জাতীয় কবিতায় বা বিষ্ণু দে 'জন্মাষ্টমী'তে নিয়েছেন, পাবলো নেরুদাও। তবে লোরকাই প্রথম পুরুষ; পথিকৃৎ।
নিরুপমের দিকে ফিরে তাকালে, আশ্চর্য পশ্চাদ্ভ্রমণে, সে অনুবাদে কিন্তু মূল কাব্যের সংহত ধ্রুপদীআনা বজায় আছে, পরাবাস্তবতার কোনো গহন হাতছানি নিরুপমকে বিশৃঙ্খল করতে পারেনি। বহুস্তর ও বহুস্বরে প্রবহিত এই কাব্য অন্দরমহলে যতটা অন্তর্ঘাতনা চালায় ততটা কিন্তু সদরে নয়। লোরকা অনেকটাই আমাদের জীবনানন্দের মতো। সাতটি তারার তিমির ও নিউইয়র্কের কবিতায় এসে পৌঁছতে প্রায় তাদের জীবনে বিকেল গড়িয়ে যায়। নিরুপমের ভাষান্তরের বনেদী মনোভাব এই অর্থে যে তার ফ্রেম সুচিহ্নিত ও সুনিয়ন্ত্রিত। তৎসম শব্দকে পরিহার করায় তার মোটেও উৎসাহ নেই বরং সে কবিতাটিকে দেখতে চেয়েছে কিমিতিপুরাণ হিসেবেই। আমার গর্ব হয় বছর চল্লিশেক আগেও আমাদের আত্মা কি থরে থরে সাংস্কৃতিক সম্পদ চিনে নিতে ও চিনিয়ে দিতে পারতো।
২.
মার্কিনী মেয়েরা বয়ে চলে শিশু ও মুদ্রা তাদের জঠরে। বি-মুভির অরণ্যদেব ডায়াল করে। ডাউনিং স্ট্রীটের ডায়ানা উত্তর দেয়। রাষ্ট্রপুঞ্জে চাঁদ ওঠে : পেট্রোডলারের বিষাদ প্রতিমা। হার্লেমের রাজা আমার! এখন রয়েছে শুধু নক্ষত্রের ফেনা। শর্বরী ও সমুদ্রের কৃষ্ণনীল ঘুম, ছদ্মবেশী হার্লেম, তোমার কল্লোল ভেসে আসে ধূসর ধাতুর পাত বেয়ে। তোমার কল্লোল ভাসিয়ে দেয় যন্ত্রগণক ও সাঁজোয়া গাড়ির সামান্য তটরেখা। তোমার কল্লোল অষ্টম গর্ভের রূপকথা শোনায় মায়েদের। তোমার কল্লোল ঐশ্বর্যে ঝলমল করে ওঠে মাতাল নিগ্রো গায়কের কণ্ঠে। এরকম হিরণ্ময় রাত্রি জীবনানন্দ দেখেন বেন্টিঙ্ক স্ট্রীটে আর লোরকা ম্যাডিসন অ্যাভিনিউতে ৷ এইসব রাত্রি ছাড়া ইতিহাস আর কিছু রেখেছে কি মনে?
৩.
পৃথিবীতে একদিন কার্তিকের জ্যোৎস্না এসে মহীনের আস্তাবল আলো করে দিলে সিরানোর কফিঘরে ব্রেতোঁ, এলুয়ার, বুনুত্রল, লোরকা, দালি, আরাগঁ প্রমুখ কিন্নরদলকে ক্রীড়ারত দেখা যায়। যখন সর্বস্ব যায় বস্তুকামে, গৃধ্নুতায়, নানাবিধ কাজে তখন এই যুবাদল স্নায়ুর নীল নক্শা অনুযায়ী বাস্তবের শহরতলীতে বসবাসের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তখন ১৯২৪ সালে তরুণ চিকিৎসক, কবি ও দেবতাদের বন্ধুদের মতো সুদর্শন আঁদ্রে ব্রেতোঁ প্রকাশ করলেন পরাবাস্তবতার প্রথম ইস্তাহার। হে নক্ষত্র, হে কুসুম, হে সৌন্দর্যের নগ্ন ওষ্ঠদ্বয়, রাত্রির উৎসপথ খুলে দাও।
সিদ্ধার্থ যেভাবে বাসনার চিহ্নগুলিকে পরিত্যাগ করেছিলেন বোধি অর্জনের পথে, ব্রেতোঁ ও তাঁর বন্ধুদল ছেড়ে এলেন চেতনার নিশানাসমূহ। ১৯২৯ সালে দ্বিতীয় ইস্তাহার প্রকাশের পর জানা গেল পরাবাস্তব আসলে বাস্তবের বিচারালয় ও শাস্তিদানের সমারোহ। পাখীটি যখন তার আঙুল দিয়ে গান গায় তখন আকাশে আলো ফোটে। সেই আলোতে আমরা রোজনামচার পরপারের শহর, পানশালা ও উদ্যানগুলিকে সনাক্ত করি। বাস্তবিক পরাবাস্তবতাই বুর্জোয়াদের শেষ নান্দনিক উত্থান। রাজনৈতিকভাবে দেখলে প্রথার বিরুদ্ধে এই সর্বতোমুখী অসহযোগকে আমরা সর্বাত্মক সাধারণ ধর্মঘটের সঙ্গে তুলনা করতে পারি। প্রতিটি আন্দোলনেরই যা মুদ্রাদোষ, পরচুলা প্রসাধন - যথাকালে সুররেয়ালিস্তরাও পৌঁছে গেলেন সংসদীয় ভোজসভায়, আকাদেমি ও পুরস্কার প্রাপ্তিতে। তবু শুরুর গল্প অন্যরকম। আপলিনেয়ার ও লোরকার মধ্যে দিয়ে কাব্যে পশ্চিম ভূবলয়ে যুক্তিবাদের সমাধি। আমরা যখন কিউবিজমের বহুদৃষ্টি সমন্বয় প্রত্যক্ষ করি, যেমন ব্রাকের কোন নারী বা পিকাসোর বেহালাবাদক অথবা লোরকা বা দালির সান্নিধ্যে সরোবর ও ঘড়ির লাজুক কটাক্ষ তখন আমাদের বোঝা উচিত এ শুধু সুররেয়ালিস্তদের আবিষ্কার করা 'স্বপ্নের তাৎপর্য' নয়, দাদা ও ঘনবাদীরা কোনো আলপটকা দেবদূত নন, বরং সমগ্র আধুনিকতাই সমতলীয় ও রৈখিক জ্যামিতির নকলনবিশী প্রত্যাখ্যানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
যেমন লোরকা ক্রমশ আমার কাছে 'বিবেকের অভিভাবক' তুল্য হয়ে উঠলেন। তার কবিতায় নিসর্গ ও শব্দ গোঙায়। স্পেনের গ্রানাদা প্রদেশের সোনালি সমতল থেকে পাওয়া সুর যদি নারীর স্তনদ্বয়ের মতো প্রলয়তুল্য হয়, ইতিহাসের ঘর সে রাতে ঝড়ে ভেঙে পড়ে, বিপর্যয় যদি ধাবমান মহিষের শিং-এ নটরাজ হয়ে দেখা দেয়, তবে ও তৎক্ষণাৎ ইগনাশিওর জন্য শোকগাথা বেজে ওঠে। ১৯২৯-এর গরমে খ্রীস্টীয় সমাধিভূমির মতো পড়ে থাকা নিউইয়র্ক তার কাছে 'অতিমানবিক স্থাপত্য এবং ক্ষিপ্ত ছন্দ, জ্যামিতি ও যন্ত্রণার শহর।' যেমন মধ্যকলকাতা জীবনানন্দের কাছে। লোরকা ও জীবনানন্দ, দুজনের কাছেই রাত্রি মানে আত্মার উন্মোচন, রক্তের শিরা-উপশিরা ও স্নায়ুতন্ত্রের কোলাহলমুখর চত্বর। কি দেখছিলেন লোরকা: হারলেমের আতঙ্ক নিশীথ ও লোল নিগ্রো। কি দেখছিলেন জীবনানন্দ টেরিটি বাজারে - 'থামে ঠেস দিয়ে এক লোল নিগ্রো হাসে। সারা পশ্চিমী দুনিয়া তখন কি দেখছিল? লণ্ডনসেতু নিম্নগামী। প্যারিসের লোকালয়গুলিতে একাকী বিভাবরী। রোমশহর জুড়ে প্রমত্ত গণিকার ঊরুবিস্তার। যে সমাজ তার আভিজাত্য হারিয়ে ফেলেছে সেখানে অসন্তোষ উৎপাদনই কবির আভিজাত্য, বোদলেয়ার যাকে বলতেন অ্যারিসটোক্র্যাটিক প্লেজার অব ডিসপ্লিজিং। সুতরাং পরাবাস্তবতা বাস্তবের থেকে, বাজারের থেকে, সচিব ও সেনাপতিদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। কবি তো এমন এক সভ্যতার পক্ষপাতী যা অন্ত্রের চাইতে মুখমণ্ডলকে আদরণীয় ভাবে। বাস্তবের রাস্তাঘাট যখন ভয়প্রদ, অলীক, রক্তধারা যখন সীমান্ত সমূহকে ভাসিয়ে দিয়েছে তখন 'অচেতন' বা 'নির্জ্ঞান' সেই আদিপ্রদেশ যা গোপন, যেখানে ভাষার কৌমার্য। লোরকার কবিতা ছিল সেরকমই: শৃঙ্খলমুক্তির দিন।