১. মৃত্যু ও অস্তিত্ব
ঠিক পাঁচটা তখন
কাঁটায় কাঁটায় বিকেল পাঁচটা
শাদা চাদরটা নিয়ে এলো একটি ছেলে
বিকেল পাঁচটায়
চুন ভরা ঝুড়িটা তৈরী
বিকেল পাঁচটায়
আর বাকীটুকু শুধু মৃত্যু, নিঃসঙ্গ মৃত্যু একা
বিকেল পাঁচটায়।
বাতাসে উড়িয়ে নেয় তুলো বীজ
বিকেল পাঁচটা তখন
তখন ঘুঘুর সঙ্গে চিতার লড়াই
বিকেল পাঁচটা তখন,
একটি মানুষের উরুতে নিরালায় বিঁধে ছিলো পশুর শিং
বিকেল পাঁচটা তখন।
তারের বাজনায় খাদের সুর
বিকেল পাঁচটা তখন
আর্সেনিক ঘন্টা আর ধোঁয়া
বিকেল পাঁচটা তখন
মোড়ে মোড়ে নিশ্চুপ জটলা
বিকেল পাঁচটা তখন
একটা উঁচু মনের ষাঁড় তার হৃদয় নিয়ে একা!
বিকেল পাঁচটা তখন,
যখন পৃথিবীতে তুষারের ঘাম
বিকেল পাঁচটা তখন
যখন ষাঁড় লড়াইয়ের আখড়ায় আয়োডিনের দাগ
বিকেল পাঁচটা তখন
ক্ষতস্থানে ডিম পাড়লো মৃত্যু
বিকেল পাঁচটা তখন
বিকেল পাঁচটা তখন
কাঁটায় কাঁটায় বিকেল পাঁচটা।
চাকার গাড়ীতে, শবাধারে তার শয্যা
কাঁটায় কাঁটায় বিকেল পাঁচটা বাজে।
কানে পৌঁছয় হাড়ের, বাঁশীর শব্দ
কাঁটায় কাঁটায় বিকেল পাঁচটা বাজে।
কপালটা তার ফুঁড়েছে ষাঁডের গর্জন
কাঁটায় কাঁটায় বিকেল পাঁচটা বাজে।
ঘরটা আজকে অগোছালো তার দুঃখে
কাঁটায় কাঁটায় বিকেল পাঁচটা বাজে।
কিছু দূরে আজ পচন ধ'রেছে শবে
কাঁটায় কাঁটায় বিকেল পাঁচটা বাজে।
ফুলেদের শিং ফোঁড়ে খিলানের গ্রন্থি
কাঁটায় কাঁটায় বিকেল পাঁচটা বাজে।
কাঁটায় কাঁটায় বিকেল পাঁচটা বাজে
এক ভয়ানক বিকেল পাঁচটা এটা
সমস্ত ঘড়ি জানালো এখন পাঁচটা
ছায়ায় বিকেলে এখন পাঁচটা বাজে।
২. ঝরে পড়া রক্ত
না আমি দেখবো না!
চাঁদকে আসতে বলো
বালির ওপরে ইগ্নাশিওর রক্ত
আমি দেখতে চাই না।
না আমি দেখবো না!
হাট ক'রে খোলা আজ চাঁদ
মেঘের ঘোড়াগুলো শান্ত,
ষাঁড় লড়াইয়ের ধূসর আখড়াটা স্বপ্নের মতো
তার চারপাশের উইলো গাছের পাঁচিল নিয়ে।
না আমি দেখবো না!
জ্বলে উঠুক আমার স্মৃতি!
নিটোল শুভ্রতার জন্য
সতর্ক ক'রুক জুঁইফুলদের!
না আমি দেখবো না !
প্রাচীন পৃথিবী থেকে উঠে আসে গাভী
তার বেদনার্ত জিহ্বায়
বালিতে বিস্তৃত রক্ত
লেহন করে;
আর গর্জন করে গুইসাণ্ডোর ক্ষিপ্ত ষাঁড়েরা
আংশিক মৃত্যু তারা, আংশিক প্রস্তর
দু দুটো শতাব্দী ধরে পৃথিবীকে
ধ্বংস ক'রে তৃপ্ত
না আমি দেখবো না!
সারাক্ষণ মৃত্যুকে কাঁধে ক'রে
অনেক উঁচুতে উঠেছিলো ইগ্নাশিও
ছেয়েছিলো প্রভাত আসুক
তাকে সে পায়নি।
খুঁজেছিলো নিজের আত্মবিশ্বাসী প্রতিকৃতি,
স্বপ্ন তাকে হতবুদ্ধি ক'রেছিলো
প্রার্থনা ছিলো নিজের কান্তিমান দেহটাকে নিয়ে,
আর সম্মুখীন হ'ইয়েছিলো উন্মুক্ত রক্তের।
না আমি দেখবো না!
না আমি শুনবো না ছলকে পড়া
রক্তের শব্দ
ক্রমশঃ ক্ষীণ হ'য়ে আসে যার বেগ
যে শব্দ আলোকিত করে
অসংখ্য দর্শকের আসন
ছলকে পড়ে
তৃষ্ণার্ত জনতার পরিচ্ছদে।
ওরা চীৎকার ক'রে আমাকে
কাছে আসতে বলে!
আমি আসতে পারবো না!
আতঙ্কিত মায়েরা তাঁদের
মুখ তুলেছিলেন
উদ্যত শিং দুটোকে কাছিয়ে আসতে দেখেও
সে চোখ বোজেনি।
আর চারণ ভূমি পার হ'য়ে
কোন এক গুপ্ত কণ্ঠস্বর
আর্তনাদ ক'রেছিলো
ওই সব স্বর্গীয় ষাঁড়
আর বিবর্ণ রহস্য ঘেরা পশুপালকদের উদ্দেশ্যে।
সমগ্র সেভিলিতে জানি তার মতো কোন যুবরাজ নেই
কিংবা তার তরবারির মতো তরবারি
অথবা তার বিশ্বস্ত হৃদয়ের মতো হৃদয়।
অযুত সিংহের মতো তার আশ্চর্য শক্তি
আত্মসংযম প্রস্তর মূর্তির মতো,
আন্দাল্যুসীয় রোমের আবহাওয়া
তার মস্তকে জ্বলজ্বল করে
হাসিতে ছড়িয়ে দেয়
বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার সুগন্ধি।
পাহাড়ী জমিতে সে যেন এক দক্ষ কৃষক :
ফসলের কাছে নম্র,
পাহাড়ের কাছে নির্মম,
শিশিরের কাছে কোমল
আর উজ্জ্বল হ'য়ে ওঠে উৎসবের দিনে।
অথচ এখন তার নিদ্রা সমাপ্তিহীন
এখন শেওলা আর ঘাস
নিশ্চিত আঙুলে
তার করোটির পুষ্প উন্মোচিত করে।
এখন গান গায় তার প্রবহমান রক্ত
গান গায় সবুজ মাঠ আর জলাভূমি পেরিয়ে
গড়িয়ে যায় পশুর নিশ্চল শিং এ
কুয়াশায় বিচরণ করে আত্মাহীন স্খলিত চরণে,
হোঁচট খায় সহস্র খুরে,
যেন এক দীর্ঘ, বিষণ্ণ, তমিস্র জিহ্বা
নির্মাণ করে বেদনার সমুদ্র
নক্ষত্র খচিত গুয়াদ্যাল ক্যুইভারের অত্যন্ত সমীপে।
ওঃ স্পেনের শুভ্র দেওয়াল!
ওঃ যাতনায় কৃষ্ণ ষণ্ড!
ওঃ সুহৃদের কঠিন শোণিত!
ওঃ তার শিরা উপশিরার বুলবুল!
না আমি দেখবো না!
কোনো পান পাত্র তা' ধারণ করে না
কোনো দোয়েল তা' পান করে না
কোনো কাচ আনেনা তাতে রজত শুভ্রতা
তা' শীতল হয় না কোনো আলোকের কুয়াশায়
গভীর সংগীত অথবা পুষ্পের প্লাবনে।
না আমি দেখবো না!
৩. বিস্তৃত শবদেহ
শোকের প্রতীক তথা বিসর্পিল জলস্রোত বিনা
প্রস্তর-কপালে আহা স্বপ্নগুলি অশ্রুপাত করে
প্রস্তর তাহার স্কন্ধ বহিবে এ করাল সময়
মাল্য, গ্রহ, অশ্রুময় - যাহা আজ বৃক্ষের প্রতিম।
কোমল বিচ্ছিন্ন বাহু উর্ধ্বে তুলি প্রস্তর সংঘাত
এড়ায় ধূসর বৃষ্টি যাহা ধায় ঢেউয়ের সমীপে;
দেখিয়াছি বারবার, বুঝিয়াছি প্রস্তর আঘাতে
প্রত্যঙ্গ বিচ্ছিন্ন হয়, তথাপি তা' শোণিতে ঢাকে না।
কেননা প্রস্তর করে বীজ তথা জলদ সংগ্রহ
পাখীর কঙ্কাল আর ব্যাঘ্রময় উপচ্ছায়া শুধু
তথাপি তা' শব্দহীন - অগ্নিহীন, কেলাস বিহীন
-দেওয়াল বিহীন সব মল্লভূমি আমাকে ঘিরিয়া ।
সুজাত সুহৃদ মোর বুঝি আজ পাথরে শয়ান,
এখন সমাপ্ত সব - ভাবো তার মুখশ্রীকে ভাবো
মৃত্যু তারে ঘিরিয়াছে গন্ধকের বিবর্ণ প্রলেপে
তমিস্র দানব শির স্কন্ধে তার ক'রেছে স্থাপন।
এখন সমাপ্ত সব । বৃষ্টি আজ তার মুখে বেঁধে
উন্মাদ প্রতিম বায়ু ত্যাগ করে তার ভগ্ন বুক
ভালোবাসা আর্দ্র হয় অশ্রুময় তুষার সংঘাতে
নিজেকে কবোষ্ণ করে জনতার সর্বোচ্চ চূড়ায়।
কি তাহারা বলিতেছে ? -ক্রমশ জমিয়া ওঠে নৈশব্দ্য : যা পুতিগন্ধময়
আমরা এখানে এক বিস্তৃত শবের সকাশে
ক্রমশঃ তা' ম্লায়মান, পাখীর মতোন তার বিশুদ্ধ গড়ন
অগভীর ছিদ্রে ভরে আমাদের দৃষ্টির সম্মুখে।
শবের চাদরখানি ভাঁজ করে কেবা পরিপাটি
সে যাহা বলিতে চায় কদাপি তা' সত্য নয় জানি!
এখানে ক্রন্দন নাই, নাই কোনো সংগীতের স্বর
নখর বিঁধানো নাই - চমকিত হয় না সাপিনী
আমারও প্রত্যাশা নাই গোলাকার নয়ন ব্যতীত;
আবার দেখিতে চাহি তার দেহ বিশ্রাম বিহীন।
এখানে বলুক কথা তাহারাই আজ দৃঢ় স্বরে
যাহারা ছুটায় ঘোড়া - পরাজিত ক'রিবে নদীরে
কঙ্কাল ধ্বননশীল, তাহাদের গানে আমি শুনি
সূর্যের দীপ্রতা আর প্রভাময় প্রোজ্জ্বল অরণি।
এখানে আসুক আজ তাহারাই - প্রস্তর উপরে
এখানে শায়িত শব - ভগ্নকটি নির্বাক নায়ক
মৃত্যুর বন্ধনে বদ্ধ - কোন পথ খোলা তার তরে?
- উত্তর তাহারা দিক, বলে দিক কর্তব্য সকল।
নদীর সদৃশ শোক সেও তারা দেখাক আমারে
সুমিষ্ট কুয়াশাময় যে নদীর সুগভীর কূল,
যেখানে হারাতে পারে ইগ্নাশিও শবদেহ তার
ষণ্ডের প্রশ্বাস-শব্দ জাগে না যে নদীর কিনারে।
চন্দ্রের কিরণে অহো আলোকিত দেখো মল্লভূমি
দুঃখিত প্রশান্ত ষণ্ড যৌবনে তা' করে উদ্ভাবন
তুষ্ণীম্ভূত মৎসকূল, অদ্য রাত্রে গাহিবে না গান
তথায় হারাক সখা - রজনীতে, শুভ্র কুয়াশায়।
এখন তাহার মুখে কেন ওগো রুমাল বিছাও?
আমি তা' চাহি না বলি ইগ্নাশিও যাও তুমি যাও;
হও তুমি নিদ্রামগ্ন - এ সময় বিশ্রামের তরে
শুনো না ষণ্ডের শ্বাস, জানো না কি সমুদ্রও মরে!
৪. অনুপস্থিত আত্মা
ষাঁড়টা তোমায় চেনেনা জানি তা', চেনেনা ডুমুর গাছ
ঘোড়ারাও নয়, এমন কি ওই পিঁপড়ে তোমার ঘরে
চেনেনা ত' সেও - বিকেল কিংবা শিশুরা তোমরা নাম
শোনেনি কখনো যেহেতু আজকে মৃত তুমি চিরতরে
পিঠের পাথর চেনেনা তোমায়, কিংবা কৃষ্ণ সাটিন
যেখানে আজকে বিচূর্ণ হও তুমি।
তোমার স্মৃতিরা নির্বাক আজ, তারাও চেনেনা জানি
সকলের কাছে চিরতরে তুমি মৃত।
শরৎ আসবে, ছোট শাদা শামুকেরা
আবার ফিরবে পাহাড় আঙুরে ভরা
অথচ সেদিন কে আর রাখবে চোখ
তোমার দু'চোখে ? তুমি মৃত চিরতরে।
যেহেতু আজকে মৃত তুমি চিরতরে
তুমি পৃথিবীর সব মৃতদের মতো,
সময়ের সাথে যারা আজ বিস্মৃত
হাজার হাজার মরা কুকুরের ভিড়ে।
তোমাকে চেনেনা কেউ, একা আমি গানে গানে আজ
উত্তরকালের জন্য এঁকে যাই মাধুর্য তোমার,
আমার সংগীতে তুমি প্রজ্ঞাবান - পূর্ণ যার বোধ
অসীম মৃত্যুর ক্ষুধা - তৃপ্ত হয় মৃত্যু আস্বাদনে;
বেদনা বিধুর যার শৌর্যময় উচ্ছলতা, তাই
এখানে একাকী আমি তোমাকেই সংগীতে ফোটাই।
অনেক অনেকদিন কেটে যাবে, জন্ম নেবে হয়তো আবারও
কোনো এক আন্দাল্যুসী, বীর্যবান, এরকমই দুঃসাহসে দৃঢ়।
আমার গানের সুরে আঁকি তার রোচিষ্ণুতা, গান আজ শব্দের গোঙানি
এখন বাতাস বয় জলপাই বনে বনে আমি তার বিষণ্ণতা জানি।