সকালটা তার এভাবেই হয়। বেশ একটা মোলায়েম অন্ধকার, আবার পুরো অন্ধকারও নয়, খানিকটা আলোর রেশ আছে তার সঙ্গে এবং আলোকিত হয়ে ওঠার আকাঙ্খা। অস্তিত্বের এই আলো-আঁধারি তার বড় ভালো লাগে, নেশা জাগায়।
সে প্রতিদিন জেগে ওঠার এই মুহূর্তটিতে ঠিক বুঝে নিতে পারে না সঠিক সময় ও স্থানের জাগতিক অবস্থান। সে এই পৃথিবীতে না অন্য কোনও গ্রহে? দেশে না বিদেশে? ভোর হ'ল না এখনও রাত কাটেনি? যেহেতু এই মুহূর্তে ঠিক এখনও কেউ জাগেনি, তাই এই মুহূর্তটি তার একান্তই নিজস্ব! ফ্ল্যাটের এই পর্দাটানা ঘরখানা তাকে আরও নিস্তব্ধতা দিয়েছে!
ভোরে ওঠা তার অনেকদিনের অভ্যাস! ছাত্রাবস্থায় ভোরে উঠতে তাকে প্রথম প্রথম বিশেষ বেগ পেতে হত ঘুমের জড়তা চোখ থেকে কাটতে চাইত না! পরে ক্রমশ অভ্যাসে পরিণত হয় এবং ভোরের আলো ফুটলেই সে উঠে পড়ে পাঠাভ্যাস করেছে। না, বিজলী বাতি জ্বালিয়ে ভোরের লাঞ্ছনা সে কোনওদিনই করেনি, অপেক্ষা করেছে আলো ফোটার, তারপর পাঠ্যপুস্তক নিয়ে সে বসেছে। এমনকি শীতকালেও কখনো ভোরবেলায় উঠে ইলেকট্রিক লাইট জ্বালায়নি! কুয়াশামাখা আধো অন্ধকারেও সে চাদর মুড়ি দিয়ে প্রথমে বাইরে বেরিয়ে মাথায় নিয়েছে আলোর স্পর্শ তারপর ক্রমশ আলো আরও চওড়া হ'তে সে মন দিয়েছে দৈনন্দিন কাজে। ক্বচিৎ-কদাচিৎ কখনও কেউ ঘরে ঢুকে ইলেকট্রিক বাতি জ্বালালে সে নিষেধ করেছে তীব্রস্বরে বা প্রতিবাদ করেছে মাথা ধরার অজুহাত দিয়ে। জাগরণ এবং আলো-অন্ধকার তার কাছে সমার্থক! যেমন জীবনযাপন আর তার অস্পষ্টতা!
ভোরের অনুষঙ্গে শুধু প্রাকৃতিক আবহই নয় কিছু মানুষও অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে। যেমন তার মা, খুব যে ভোরে উঠতেন তা নয়, তবে ভোরের আলো বেশ খানিকটা ফুটে উঠবার পর চা নিয়ে তিনি আসবেনই। ভোরের আলোর রেশ ছড়াচ্ছে, ধোঁয়াওঠা চাও তার গরিমা ব্যক্ত করছে, এইরকমভাবেই ভোরের অঞ্জলি দিত সে প্রথম চায়ে চুমুক দিয়ে। এবং সমস্ত পরিবেশটাই থাকত অসম্ভব রকমের নিস্তব্ধ যেহেতু মা একটিও কথা না বলে চায়ের কাপ এগিয়ে দিত বা ঠক্ করে কোথাও রেখে চলে যেত। ঐ 'ঠক' শব্দটাও নিস্তব্ধতার অঙ্গীভূত হয়ে থাকত।
পরবর্তী জীবনেও স্ত্রী ক্যাথরিন এই সকালবেলার চায়ের অনুষঙ্গে জড়িয়ে পড়ল। বিদেশী নারী, ভোর-ভোর গরম চা খাওয়ার বাতিক নেই, এমনকী খুব প্রয়োজন না থাকলে, এই প্রাতঃকালে বালিশ মুখে গুঁজে ঘুমোতেই তার চূড়ান্ত বিলাসিতা, অথচ ভোর হ'লেই তার চোখ চ'লে যেত ক্যাথরিনের ঘুমন্ত শরীরটার দিকে। খানিকক্ষণ ঐভাবে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার উপলব্ধি হত, অন্ধকার দূরে চলে যাচ্ছে, ছায়া ছায়া শরীরটা ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে, যেমন প্রকাশ্য হচ্ছে বাইরের পৃথিবী! এমনকী ক্যাথরিন অন্য ঘরে কোনোকোনোদিন ঘুমিয়ে থাকলেও সে একবার বাথরুম যাবার অছিলায় খানিকক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে দেখত তার ঘুমন্ত অবয়ব, ধীরে ধীরে ক্রমশ প্রকাশ্য হওয়া উন্মোচন!
এই এতসব ব্যাখ্যার কারণ সত্যব্রত ইন্সম্নিয়ার রোগী। সারারাত এপাশ ওপাশ করে ভোরের আলো ফুটলেই আস্তে আস্তে ক্লান্তি জড়িয়ে আসতে থাকে। আর তখনই শুরু হয়ে যায় অস্তিত্বরক্ষার এই দোলাচল।
সুমনা চা নিয়ে ঘরে ঢোকে। কিভাবে সে বুঝে যায় যে সত্যব্রতর এখন চায়ের দরকার। সারারাত না ঘুমোনোর জন্যে বিস্বাদ মুখে শুধুই চা খায় সত্যব্রত বিস্কুট ইত্যাদি ছাড়াই। চিবোতে ইচ্ছা করেনা কোনো কিছুই, জাগরণ -আধো ঘুমের ক্লান্তিতে তখন তরল ছাড়া আর কিছুই মুখে রুচতে চায়না। এরপর সত্যব্রত আস্তে আস্তে এলিয়ে পড়বে আর তার ঠিক আগেই তার জুটবে সুমনার নিজ হাতে তৈরি আর একটি তরল পদার্থ, তবে বেশ পুষ্টিকর। চিবোতে ইচ্ছে করে না বলে জিনিষটা ঘোল কিম্বা লস্যির কাছাকাছি। সঙ্গে কখনও থাকে তুলতুলে চিড়ের বা সাবুর মণ্ড ওই ঘোলজাতীয় পদার্থটার মধ্যে। পুরো একটি গ্লাস পেটে পড়ামাত্র আস্তে আস্তে চোখ বুজে আসবে সত্যব্রতর। তারপর ধীরে ধীরে খানিকক্ষণের মধ্যে মুছে যাবে এই অস্তিত্বের দোলাচল, পরবর্তী ভোরের অপেক্ষায়।
কে এই সুমনা? আরেকটি প্রশ্নের দোদুল্যমানতায় মাতায় সত্যব্রতকে! সুমনা এই বাড়িতেই থাকে, সব কাজকর্ম দেখে, তার সেবাযত্ন বা তদারকি করে। এই পর্যন্ত ঠিকই আছে। সত্যব্রত বিদেশ থেকে দেশে থিতু হবার পর, বিদেশী স্ত্রী ক্যাথরিনের সঙ্গে দাম্পত্য সম্পর্ক থেকে বিচ্ছিন্ন হবার পর, সে খোঁজ পায় সুমনার, এবং তার প্রাত্যহিক দিনযাপনের ভার সে নিয়ে নেয়। কিভাবে সুমনা তার কাছে এসে পৌঁছেছে, এ কথা পরিষ্কারভাবে মনে না পড়লেও সত্যব্রতর স্মৃতিতে আছে এক নিকট সম্পর্কীয় বন্ধুই জোগাড় করে দিয়েছিল সুমনাকে! এবং এ ব্যাপারে বন্ধুপত্নীর তাগিদই ছিল বেশি। সুমনা গ্রামাঞ্চলের মেয়ে, বোঝাই যায় লেখাপড়া বেশিদূর করেনি, তবু বোঝাই যায় অনুভূতি আছে এবং সর্বোপরি যেটা আছে সেটা হল ভয়ানক ভাবে পরিস্থিতি সচেতনতা, ঠিক বুঝে যায় কী ঘটতে চলেছে বা ঘটছে এই বিশেষ পরিস্থিতিতে; সত্যব্রতর মতো দোলাচলে ভোগে না সুমনা! শক্ত-পোক্ত মাটির উপর দাঁড়ানো আধা-শহুরে মেয়ে সুমনা!
সুমনা মা অথবা ক্যাথরিনের মতো নিস্তব্ধতার তোয়াক্কা করে না। ঠক্ করে চায়ের কাপটা রেখে তীক্ষ্ণ চোখে তাকায় সত্যব্রতর দিকে। পরিষ্কার বুঝতে পারে এই দোলাচল আসলে নিস্তব্ধতারই তৈরি! সেটাকে খুব শক্ত হাতে ভেঙে দিতে হবে; সত্যব্রতকে পাঠাতে হবে ঘুমের জগতে, তৈরি করে দিতে হবে চিঁড়ের মণ্ড দিয়ে তৈরি ঘোল! পেটে পড়লে ঘুমে চোখ টানতে বাধ্য। একদম সোজা হিসাব!
সত্যব্রত খানিক চমকে খানিক অসহায়ের ভঙ্গিতে তাকায় সুমনার দিকে। আচমকাই প্রশ্ন করে তোমার ভোর ভালো লাগে সুমনা? সুমনা চলে যাচ্ছিল, ফিরে তাকায়, সপাটে জবাব দেয় : না তেমন ভাবে নয়!
- কেন? ভোরের পবিত্রতা তোমাকে টানে না সুমনা? মনে হয়না কেমন নতুন করে শুরু হচ্ছে সব! একটা শান্ত অস্থিরতা ....
- না বাপু, ভোরবেলায় আমার এতসব কথা মনে হয়না; ভোর হ'লেই তোমাকে ভাবি! চা করে দিতে হবে, কিছু খাবার ...
- আমাকেই মনে হয় তোমার ভোরের বেলায়! আমাকেই প্রথম ভাবো তুমি ভোরের আকাশে! আর কী আশ্চর্য দেখো, আমি কিনা আছি কি না আছি, নিজেকেই প্রশ্ন করি ভোরের এই সময়টায়!
খানিকক্ষণ চুপ থাকার পর আবার প্রশ্ন ছোঁড়ে সত্যব্রত :
- তবে তোমার প্রিয় সময় কোনটা? দুপুরবেলা? ভাতঘুম দেবার আগে?
- না বাপু, আমার ভালো লাগে সাঁঝেরবেলা! সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালাতাম তো গাঁয়ের বাড়িতে! আর মাথার উপর জ্বলে উঠত ছোট্ট ছোট্ট কত তারা! দেখেছ কোনোদিন গাঁয়ের মাটিতে সাঁঝবেলার আকাশ?
- না তেমনভাবে দেখিনি! আর কী আশ্চর্য দেখো আমরা দুজনে একই ছাদের তলায় আছি, অথচ কী আশ্চর্য মিলন আমাদের ভোরের থেকে সন্ধ্যার! শুরু থেকে শেষ আবার শেষ থেকে শুরুর দিকে যাওয়ার!
সুমনা সবটা বুঝল কি? তবে দরজার দিকে চলে যায় কেন? অধীর গলায় ডাকে সত্যব্রত - সুমনা?
সুমনা পুরোটা না ফিরেও ঘাড় হেলিয়ে তাকায় - কী?
এবার মোক্ষম প্রশ্নটা করে সত্যব্রত ঘুমিয়ে পড়বার আগে!
- এখানে থাকতে তোমার ভালো লাগে সুমনা? এই বাড়িতে? আমি তো এখানে একা! তুমিই আছ শুধু! আমার বৌ বিলেতে থাকে, তবে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে! থাকবে তুমি আমার সঙ্গে বাকিটা জীবন?
সুমনা হাসে : অদ্ভুতভাবে বলে, আমার স্বামীও আমাকে ফেলে চলে গেছে! রাত্রে নেশা করে বাড়ি ফিরত। ভয় করত তখন! মারধর করত কি না! লুকিয়ে মদ রেখে দিতাম, বাড়ি ফিরলে আরও খাইয়ে অজ্ঞান করে দিতাম।
- আর আমি? কেমন মনে হয় আমাকে?
- তোমাকেও বাপু ভয় করে! ভূতের ভয়! কেমন ড্যাবডেবে চোখে তাকাও, কী বল যে কিছুই বুঝতে পারিনা! মাঝে মাঝে মনে হয় তুমি বেঁচে আছো তো! না কী সব ভরটর করেছে তোমায়!
সত্যব্রত অনুভব করে মোক্ষম জায়গায় ধরেছে সুমনা!
- হ্যাঁ সুমনা, আমি আমার অস্তিত্ব নিয়েই সন্দিহান! ভোরবেলা তাই আমার এত প্রিয়। পারবো তো আমি আবার সবকিছু ছন্দে শুরু করতে - এই ভোরবেলার মতো?
- এইজন্যেই তো বাপু ভয় করে তোমায়। কী সব যে আবোল-তাবোল বকো। পাগল নাকি কিছু ভর করেছে তোমায়? বেশ কাছে এগিয়ে আসে সুমনা।
- থাক তোমায় আর ভোর দেখাতে হবে না। এই শুরু তোমার জন্য ভালো নয় - এসো ঘুম পাড়িয়ে দিই তোমায়। এই প্রথম সুমনা তাকে আন্তরিক স্পর্শ করে। কপালে হাত রাখে। চোখ বুজিয়ে দেয়। ফিসফিস করে বলে : চোখ বন্ধ করে থাকো। এক্ষুনি ঘুমপাড়ানি খাবার নিয়ে আসছি। আর ভয় নেই কোনও - তোমাকে আর জাগতে হবেনা।
গভীর নিস্তব্ধতার অতলে তলিয়ে যেতে যেতে সত্যব্রতর চেতনায় ভাসে সন্ধ্যার অন্ধকার, টিপ্টিপ্ করছে দুই একটি তারা, বন্ধ চোখের মাঝখানে। ধীরে ধীরে দু'হাত দিয়ে জাপটে ধরে সুমনাকে, পুরো দেহটা টেনে আনে নিজের দেহের ওপরে। কী ভারি। দমবন্ধ অন্ধকারে মনে হয় মরেই যাবে বুঝি সে। ভূত হয়ে যাবে। এই ভালো। ভূতের তো আর অস্তিত্বের সমস্যা থাকে না।
মাটির কাছাকাছি দাঁড়িয়ে একটি মেয়ে দেখতে পায় কীভাবে সে তার মাতাল স্বামীকে আরও ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে। ঘুম পাড়িয়ে দিতে অভ্যস্ত সুমনা আরও বেশি করে জাপটে ধরে সত্যব্রতর শরীর।