দয়াময়ীর কথা: সুনন্দা সিকদার, গাঙচিল, কলকাতা ২০০৮; ISBN: 978-81-89834-37-1
"স্মৃতির পটে জীবনের ছবি কে আঁকিয়া যায় জানি না। কিন্তু যেই আঁকুক সে ছবিই আঁকে। অর্থাৎ, যাহা-কিছু ঘটিতেছে তাহার অবিকল নকল রাখিবার জন্য সে তুলি হাতে বসিয়া নাই। সে আপনার অভিরুচি-অনুসারে কত কী বাদ দেয়, কত কী রাখে। কত বড়োকে ছোটো করে, ছোটোকে বড়ো করিয়া তোলে।... বস্তুত, তাহার কাজই ছবি আঁকা, ইতিহাস লেখা নয়।"
জীবনস্মৃতির অবিস্মরণীয় সেই প্রারম্ভিক কটি পংক্তিকে স্মৃতির পর্দায় ফিরিয়ে আনলো আপাতসাধারণ এই বইটি। দয়াময়ীর কথা নাম হলেও একে আত্মজীবনী বলা যাবে না; স্মৃতিকথা বলা চলতে পারেঃ ষাটের কোঠায় বয়স ঢুকে পড়লে পরে যে-ধরণের রচনা স্বাভাবিকভাবেই মনকে টানে। যে কারণে আমার গ্রন্থসংগ্রহের একটি অংশ জুড়ে রয়ে যায় নীরেন চক্রবর্তীর নীরবিন্দু, তারাপদ রায়ের চারাবাড়ি পোড়াবাড়ি, প্রতিভা বসুর জীবনের জলছবি, সুবোধ সেনগুপ্তের তে হি নো দিবসাঃ এরকম ছোটোবড় আরও বেশ কিছু বই।
শুধু জীবনস্মৃতির লাইন কয়েকটাকে ফিরিয়ে আনা নয়, দয়াময়ীর কথা আমাকে নিয়ে গিয়েছে কিছুটা মডার্ন আর্টের বারান্দায়, যেখানে 'কোলাজ' বা খণ্ডচিত্রের সমাহারে একটি সুসংবদ্ধ 'থিম' বা বিষয়ের নিঃসংশয় আভাস ফুটে ওঠে, ছোটো ছোটো টুকরোর মধ্যে সামঞ্জস্য বা সাযুজ্য থাকুক বা না থাকুক। অথবা metallic micro-structure এর মতো, যেখানে প্রতিটি grain boundary সুস্পষ্ট এবং প্রতিটি গ্রেইন অন্যটির থেকে আলাদা হয়েও সামগ্রিক একটা পরিষ্কার চরিত্র-চিত্র ফুটিয়ে তোলে।
দেশবিভাগ শুধু দুইবাংলাকে খণ্ডিত করে গিয়েছে তা নয়, শত শত ধারণা, সহস্র সংসার, লক্ষ লক্ষ মানুষকে সর্বার্থে ছিন্নমূল করেছে। সেই ক্ষত থেকে আজ আর রক্ত পড়ে না বটে, কিন্তু সেই বেদনা আজও অশ্রুপাত ঘটায়, তার থেকেই জন্ম হয় দয়াময়ীর কথার মতো অবিস্মরণীয় সাহিত্যকীর্তির।
দয়া নামের যে ছোট্ট মেয়েটি পূর্ববঙ্গের একটি গ্রামে তার পিসিমার কাছে মানুষ হয়ে উঠছিল, মা-বাবা দূরে থাকলেও তার শৈশবে স্নেহ-প্রীতি বা আদর-ভালোবাসার কোনো অভাব তার হয়নি। পালিকা মা-কেই সে মা বলে জেনেছে ও মেনেছে। বাবাকে দেখেছে কম, ভয় করেছে তাই বেশি। ভাই বোনদেরও চিনেছে খুবই কম। কিন্তু কী এক জাদুবলে চিনেছে ভুলি পিসীমা, মাজমদাদা, আজমদাদা, মোদিভাবি, পিরবাবা-দের। চিনেছে গরুবাছুর, মাছ, গাছগাছালি, পাখপাখালিকে। তথাকথিত পুঁথিগত বিদ্যা তার হয়নি, শুধু অক্ষর-পরিচয়টুকু সম্বল করে এক অসামান্য স্মৃতিসম্ভারের ঝাঁপি উপুড় করে দিয়েছে ছোটোবেলার দয়াময়ী, পরে প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত সুনন্দা সিকদার; অথচ জীবনের প্রথম দশবছরের স্মৃতিকে যে গভীর অভিমানে কিন্তু পরম যত্নে সরিয়ে রেখেছিল তার দ্বিতীয় জীবন থেকে।
দয়াময়ীর কোলাজের টুকরোগুলোর দিকে একটু তাকানো যাক : এ'বইয়ের বিভিন্ন পরিচ্ছেদের শীর্ষকগুলির কয়েকটি এইরকম:
* যেন পূর্বজন্মের স্মৃতি * যেতে না চাওয়া, যাওয়ার প্রস্তুতি * স্মরণীয় দিনগুলি * দূরের মানুষ কাছে * গোরু-বলদের কথা * শেষ মচ্ছব * পরিত্যক্ত ভিটে * পুরোনো দুঃখের গল্প
* দেশে বাবার শেষবার আসা
- শুধু এই বিষয়গুলির মধ্যে দিয়েই যেন এক তার-ছিঁড়ে-যাওয়া হাহা-রব শুনতে পাই। অথবা শুনি সেই অমোঘ উচ্চারণ "ভাসান, ভাসান সারা বেলা।" যে-জাতীয় শীর্ষক ওপরের তালিকায় নেই, তাদের অধিকাংশই এক বা একাধিক ব্যক্তি-বিশেষকে নিয়ে রচিত: যেমন 'মেজভাবির করাচি যাত্রা', 'অমু-দার দরাজ দিল', 'মাইগা সুধীর দাদা', 'দাদার কথা' বা 'মোদিভাবির কথা'। এইসব চরিত-কথা বইটিকে সমৃদ্ধ করেছে স্মৃতির দ্যুতিতে, কখনও উদারতায়, কখনও অন্ধ প্রেমের উন্মাদনায়, কখনও সংস্কার-মুক্তির আলোয়, আবার কখনও বড়ো বেদনায়। নিজের মেয়েবেলার আরও অনুপুঙ্খ, আরও সত্যনিষ্ঠ বিবরণ বাঙালি পাঠক এতদিনে পড়ে ফেলেছেন জনপ্রিয়তর কোনও লেখিকার কলমে, যেখানে জীবনের কদর্যতর রূপ বিবমিষা উদ্রেক করায়। কিন্তু দয়াময়ীর কথায় সেই কালোদাগগুলো ছবির কোলাজে সামান্য contrast বাড়িয়ে মিশে গিয়েছে - কোথাও কোনও ধাক্কা লাগেনি।
এ' বইয়ের ভাষায় পূর্ববঙ্গীয় শব্দবন্ধ ও বাক্যাংশের ব্যবহার অনেক পাঠকের পক্ষে পর্যাপ্তের অধিক, সন্দেহ নেই। সব জায়গায় তাদের ব্যাখ্যা বা অর্থও দেওয়া নেই, যার ফলে বইটির গ্রহণযোগ্যতা যদি বা কমে থাকে, এর একটা স্বকীয় চরিত্র সৃষ্টি হয়েছে, যা ভীষণভাবে ethnic, কম্পাঙ্ক মিলে গেলে যেখানে resonance অবশ্যম্ভাবী। ভাষার নিরাভরণতা, কাব্যিক উপমা-অলঙ্কারের সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি, জায়গায় জায়গায় নিরাবরণ স্বীকারোক্তি একবারের জন্য হলেও মোহনদাস করমচাঁদের My Early Life কে মনে পড়ায়। আর চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় সমাজের শূন্যগর্ভ সংস্কারের অর্থহীনতাকে। বার বার। তা সে বিধবা বিবাহের বেলাতেই হোক, হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ছোঁয়াছুয়ির বিচারেই হোক, বা সামাজিক বয়কটের ঘটনাতেই হোক। নিরক্ষর হতদরিদ্র অথচ ধর্মনিষ্ঠ সৎসঙ্গে মেয়েটি বেড়ে উঠেছে, তাতে মনুষ্যত্বের যে মৌলিক মূল্যবোধ তার গভীরে প্রোথিত হয়েছে, বারবার তার পরিচয় আমরা পেয়েছি:
(ক) "মানুষের তৈরি কুপ্রথার জন্যে জীবনে এত বঞ্চিত হয়েও মানুষের প্রতি এই বিশ্বাস অটুট রইল কী করে ভেবে যেন কূল পাইনা। .................... কত ধনী ছিলেন আমার পিসিমা, আজ মানুষের মনের দৈন্য দেখলে বারবার মনে হয়।"
(খ) "দাদার যা- আমি নিতে পারিনি ও পারব না তার মধ্যে একটা হল তার ধর্মবিশ্বাস। সে ছিল খুব নিষ্ঠাবান মুসলমান। আমি এখনও মুসলমান, হিন্দু, খ্রিষ্টান কিছু হতে পারিনি, সম্ভবত হতে চাইওনি।"
(গ) "যাঁরা মনের গতিবিধি নিয়ে কাজ করেন, তাঁরাই বলতে পারবেন, আমি কেন শৈশবের দশটা বছর এমন যক্ষের ধনের মতো আগলে রেখেছি এত কাল। ... আর এই গোপন শৈশবজীবন গভীরে লুকিয়ে থেকে আমাকে করে তুলেছে এক ময়ূরপুচ্ছধারী কাক।"
এই বইয়ের থেকে সব থেকে বড় প্রাপ্তি পাঠকের তৃপ্তি। সঙ্গে উপরি পাওনা নিপুণ এক সমাজচিত্র। দারিদ্র্য, দেশভাগ, লোকাচার, খাদ্যাভ্যাস, রাজনীতির পট পরিবর্তন এই সবকেই ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় কথাচিত্রগুলি। মনে হয় কোনও সমাজতত্ত্ব-গবেষকের আকর-গ্রন্থ তালিকায় স্থান পেলেও পেয়ে যেতে পারে স্মৃতির এই দলিল-পত্রটি।
স্মৃতি কি সততই সুখের? না কি সে বড় দায়, বড় অত্যাচার? গাঙ্চিল প্রকাশিত (২০০৮) এই সুঠাম গ্রন্থটি বিবেকানন্দ সাঁতরার অনুচ্চারিত অলঙ্করণে বোধহয় দু'রকম অনুভবেরই আস্বাদ দেয়। লেখিকার লেখনী দীর্ঘজীবী হোক, আমাদের মধ্যে কিছু লোককে অন্ততঃ ফিরিয়ে নিয়ে যাক শিকড়ের দিকে, মাটির কাছাকাছি।