সমাজ মার্কসতত্ত্ব ও সমকাল : শোভনলাল দত্তগুপ্ত, সেরিবান
শোভনলাল দত্তগুপ্ত-র সমাজ, মার্কসতত্ত্ব ও সমকাল বইটি হাতে নিয়েছিলাম নিতান্ত বদভ্যাসবশতঃ। কিন্তু বইটির রিভিউ করবার যোগ্য ব্যক্তি আমি নই। তাঁর বহুখ্যাত পাণ্ডিত্যের ধারে কাছে নই, মার্কসবাদ সম্পর্কে পড়াশুনা একেবারেই প্রাথমিক, অবশ্য সমকালে চলে ফিরে বেড়াই, কাগজপত্র যা পাই বুঝি না বুঝি উল্টেপালটে দেখি। অতএব, আলোচ্য বইটির একজন আনট্রেনড্ পাঠক হিসেবে পরিচয় দান করতে পারি মাত্র। যোগ্য ব্যক্তি এ বইয়ের যোগ্য মূল্যায়ন করে শোভন বাবুর যথাযোগ্য মর্যাদা দান করতে পারবেন।
বইটি তিনটি পর্বে বিভক্ত। ১ম পর্বে আছে আমাদের ভারতবর্ষের মার্কসবাদ প্রয়োগগত কিছু কথাবার্তা। ২য় পর্বে আছে মার্কসীয় তত্ত্বকথার ঐতিহ্যগত কিছু বহির্গত প্রসঙ্গের আলোচনা। তৃতীয় পর্বে মার্কসবাদী তত্ত্ব ও প্রয়োগের বিচার করা হয়েছে য়ুরোপের কিছু ঘটনার আলোকে। বিচার্য হয়েছে মার্কসবাদ ও উত্তর আধুনিকতার সম্পর্ক নিয়ে। এই তিনটি পর্বের মধ্যে যোগ আছে, মার্কসবাদের সীমাবদ্ধতা ও তার থেকে মুক্তির কথা আছে। যে পাঠক এসব বিষয়ে ভাবনা চিন্তা করেন তিনি যে আগ্রহবোধ করবেন এটা স্বাভাবিক।
প্রথম পর্বের প্রথম প্রবন্ধটি অবশ্য ঠিক মার্কসীয় প্রসঙ্গের কথা নয়। তিনি কতকগুলো চলতি ধারণার পুনর্বিচার করেছেন। সেগুলো হল বাঙালি কি সত্যই আন্তর্জাতিক, না কি কূপমণ্ডুক। বাঙালি কি যথার্থই প্রগতিশীল ও যুক্তিবাদী এবং ধর্মীয় সংকীর্ণতামুক্ত। বাঙালি কি আত্মমর্যাদা ও অধিকারবোধ সম্পন্ন। বাঙালি কি নানা ধর্ম, জাতি, গোষ্ঠী বিষয়ে উদার। বাঙালি কি সত্যই র্যাডিক্যাল। এ বিষয়গুলির গভীরে যাবার চেষ্টা করেছেন লেখক এবং বাঙালি মানসিকতায় এই পাঁচটি বিষয়েই দ্বিচারিতা লক্ষ করেছেন। দ্বিতীয় প্রবন্ধে শোভনবাবু জানান বাঙালি জীবনে আছে কেজো রাজনীতি এবং স্বপ্ন দেখানোর রাজনীতি। ১৯৬৭-পরবর্তী পশ্চিমবঙ্গীয় বামফ্রন্ট অনেক সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছিল কিন্তু সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম কাণ্ডে, নিজেদের মধ্যকার অনৈক্যে, স্বার্থ সংকীর্ণতায় দ্বিতীয় ধাঁচের রাজনীতি সক্রিয় হয়ে গেছে। এই প্রবন্ধটি নিতান্তই অগভীর, কারণ ইতিমধ্যে বহু বই, পুস্তিকা বেরিয়ে গেছে যার ভিত্তিতে বামফ্রন্টের জনবিরোধী ভূমিকা, মার্কসবাদ বিরোধী ভূমিকা, বিদেশী মূলধনের সামীপ্য, আখের গুছানোর সমাজ সৃষ্টি প্রভৃতি তথ্য সহযোগে জনসমক্ষে হাজির করেছেন বিশেষজ্ঞগণ, তাঁদের মধ্যে সমাজতাত্ত্বিক, সমাজবিজ্ঞানী, প্রশাসক, মানবাধিকার কর্মী, অ্যাক্টিভিস্ট অনেকেই আছেন। ২০০৮-এর বক্তৃতাকে তিনি যদি সংস্কার করতেন তাহলে পাঠক উপকৃত হত। 'মার্কসবাদচর্চা ও বর্তমান সময়ের ভারতবর্ষ' প্রবন্ধে তিনি বিস্মিত হয়েছেন মার্কসবাদীদের দাপট থাকলেও বৌদ্ধিক চিন্তার জগতে ক্রমদৈন্য কেন এ বিষয়ে। এর কারণ তিনিই বলেছেন আলোচনা চলে কেবল পার্টির কর্মসূচি ও সাংগঠনিক বিষয়ে। তিনি লক্ষ্ করেছেন কিনা জানি না, তাতে মার্কসবাদের প্রসঙ্গ উল্লেখ থাকলেও মার্কসবাদ নেই, আছে অসংখ্য স্ববিরোধিতা, মিথ্যাচার। ভারতবর্ষের মার্কসবাদ নামাবলী গায়ে দেওয়া পার্টিগুলো অমার্ক্সীয় যাবতীয়তায় নিপুণ, তারপর ভুল করা, ঝপাট করে ভুল স্বীকার করেই, ঠাণ্ডা ঘরে পালায়। শোভনবাবু মানবেন কি না জানিনা, মার্কসবাদীদের বড়ো তরফের 'দাপট' ক্ষমতার, ছোট মেজ তরফ বড়োর তোষামোদেই ব্যয়িত। উত্তর আধুনিকতা ব্যাপারটা কি পশ্চিমবঙ্গের অনেক মার্কসবাদী বুদ্ধিজীবীই জানে না। তবে তাদের যান্ত্রিকতা, আত্মতুষ্টি নয় আত্মগর্ব আছে। সমাজতন্ত্রের অনেক জটিল প্রশ্ন, তিনি ঠিকই বলেছেন এড়িয়ে যাওয়া হয়। সমাজতন্ত্রই পরিবর্তনের দিশা দেখাতে পারে লেখক একথা বলেছেন (পৃ. ৪৯) কিন্তু বামপন্থী নেতা ও বুদ্ধিজীবীরা আখের গুছাতে ব্যস্ত, সমাজতন্ত্র নিয়ে মাথাব্যথা নেই, পুঁজিবাদের সঙ্গে দোস্তিতেই তারা মনোযোগী। সিভিল সোসাইটি নিয়ে দুটি প্রবন্ধ আছে। লেখক সিভিল সোসাইটি চিন্তার উদ্ভব, মার্কসবাদীদের বক্তব্য, গ্রামশির ধারণা, সমাজতন্ত্রে ও সিভিল সোসাইটির প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি নিয়ে যে আলোচনা করেছেন তা যথেষ্ট পরিমাণে অ্যাকাডেমিক। কিন্তু নন্দীগ্রাম পর্বে সিভিল সোসাইটি কথাটি এক ছদ্মশব্দ হিসেবেই মার্কসবাদী অমার্কসবাদী জোট গঠনে ব্যবহৃত হয়েছিল বলে মনে হয়। প্রবক্তরা সিভিল সোসাইটির ব্যাপার জেনে বুঝে গ্রহণ করেছেন এমন মনে হয় না। তবে এখানের বামফ্রন্ট বিরোধী জোট যে যথেষ্ট পরিমাণে চাপ সৃষ্টি করতে পেরেছিল তা পশ্চিমবঙ্গবাসী মাত্রেই জানেন। মার্কসাবাদের ভবিষ্যৎ বিষয়ক প্রবন্ধে লেখক দেখান মতান্ধতা, যান্ত্রিকতা, সংগঠন সর্বস্বতা, বিশ্বায়নের জোয়ারে ভাসা প্রভৃতি মার্কসবাদের সর্বনাশ ডেকে এনেছে। পার্টির মতান্ধতার কারণেই হিল, ফিশার, গারোদি, টমসন, কর্নফোর্থ সরে গেছেন। ভারতে যেমন - কোশাম্বী। তার অবশ্য উল্লেখ নেই। কিন্তু বড়ো মাপের মার্ক্সীয় চিন্তাবিদ গত ত্রিশ চল্লিশ বছরে এদেশে দেখা যায়নি। লুকসেমবুর্গ, ট্রটস্কি, বুখারিন, গ্রামশি চর্চাও সৌখিন সীমিত চর্চায় সীমায়িত। কিছু মার্কসবাদী তাত্ত্বিক মার্কসীয় এবং অমার্কসীয় তত্ত্বে সহাবস্থানী, অনেকে এমন ভঙ্গিতে বিষয় উপস্থাপন করেন যা অধিকাংশতঃ দুর্বোধ্য। (সৌভাগ্যবশতঃ শোভনবাবুর লেখা যথেষ্ট পরিমাণে প্রাঞ্জল।) জোট সরকার এবং কমিউনিস্ট পার্টির অবস্থান প্রসঙ্গে ডিমিট্রভের অবদান আলোকিত হয়েছে। ভারতবর্ষে জোট সরকার মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গল আই পি এল ক্রিকেট টিমের মতো - কে যে কখন কোথায়, কেন সেখানে - তার কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা নেই, এক প্রদেশে যিনি জোটসঙ্গী অন্যপ্রদেশে তিনি জোটবিরোধী এমন দৃষ্টান্তও আছে। অধিকাংশ বামপন্থী পার্টি দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদকে বিসর্জন দিয়ে ধান্দামূলক বস্তুবাদের ভক্ত হয়েছে, মার্কস ও মার্কসবাদ পোশাকি উত্তরীয় মাত্র। বামফ্রন্ট 'উন্নতমানের স্বচ্ছ প্রশাসন' কায়েমের ঘোষণা করলেও মোটেই তা করতে পারেনি - এ নিয়ে বিস্তর লেখা আছে। তিনি অস্বীকার করতে পারবেন না 'স্থিতাবস্থার দৌরাত্ম্য' (মিল্টন ফ্রিডম্যান), পার্টিকংগ্রেসে মোচ্ছব, বিদেশ যাবার দৌড়, ব্যাক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির নানা ধুরন্ধর কৌশল। শোভনবাবু দুঃখের কথা এসব একেবারেই এড়িয়ে গেছেন। বর্তমান প্রজন্মের কাছে মার্কসবাদ - সারা পৃথিবীতেই দূরে সরে গেছে, তার জন্য ইলেকট্রনিক মিডিয়ার দাপট, মার্কিন সংস্কৃতির মদতপুষ্ট নয়া জীবনবোধ (পৃ. ৮১) ছাড়াও আরো অনেক কিছু আছে। চীন, রাশিয়া, কিউবার নেতৃবৃন্দ যেসব বাণী দিচ্ছেন তা বিপজ্জনক। শোভনবাবু বলেছেন, প্রথাগত মার্কসীয় চিন্তার বাইরের তাত্ত্বিকদের লেখা পড়তে হবে। ঠিকই, কিন্তু প্রথাগত মার্কসীয় চিন্তার বই সম্পর্কে তরুণ ও যুবকদের পড়াশুনোর দৈন্য যথেষ্ট, শিক্ষক হিসেবে এ তাঁর জানার কথা। লেখক ঠিকই বলেছেন (৮৭-৯৭ পৃষ্ঠা) ভারতে বামপন্থার সংকট নিয়ে ভাবনা প্রয়োজন। পার্টি চিন্তার পুনর্মূল্যায়ন দরকার, অন্যমতের প্রতি সহিষ্ণুতা প্রয়োজন। এককথায় বামপন্থী চিন্তার আমূল পরিবর্তন দরকার (পৃ. ৯৪)। এতো শ্রীযুক্ত দত্তগুপ্তের সদিচ্ছার কথা। কিন্তু বামপন্থী নামধারীরা যদি আমূল পরিবর্তনে আগ্রহী না হয়, তাহলে কি করা হবে, সেটা কারা করবে এসব কথায় তিনি যাননি। ভারতবর্ষে মার্কসবাদী পার্টিগুলি যারা জোট বাঁধা জোট ভাঙার খেলা খেলছে বহুবছর ধরে, তার বাইরেও কিন্তু বেশ কিছু লোক আছে। লেখক তাদের সম্পর্কে নীরব কেন বোঝা গেল না। আমি মেধা পাটকর, অরুন্ধতী রায়, মহাশ্বেতা দেবী, বিনায়ক সেন প্রভৃতি সক্রিয় মানুষদের কথা বলছি।
২য় পর্বের প্রথম লেখাটি হল - কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো বিষয়ক। আমার সীমিত পড়াশুনো সত্ত্বেও, প্রবন্ধটির কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ দিক জানতে পেরে্ একজন পাঠক হিসেবে প্রথম আগ্রহ থাকবে এখানে যে আলোচ্য বইটির গুরুত্ব কোথায় সে বিষয় জানার প্রশ্নে। আমরা শুধু এটুকু জানি যে ১৮৪৮-এ কম্যুনিস্ট লিগ গঠনের প্রাক্কালে এটি রচিত, যা আন্তর্জাতিক সংগঠন হিসেবে কম্যুনিস্ট পার্টির গুরুত্ব রচনায় ভূমিকা নেয়, যার প্রথমাংশে আছে মার্কসের ইতিহাস বিষয়ক ধারণা, পুঁজিবাদের কালে উৎপাদক শক্তির বিকাশগত কথাবার্তা, সামন্ত সম্পর্ক গুলোর ধ্বংসবিষয়ক প্রসঙ্গ, জাতীয় সীমানা, সনাতন ব্যবসা, জীবন, চেতনা প্রসঙ্গ। আসে নগরের সর্বহারার উত্থানের কথা। বাদবাকি অংশে কম্যুনিস্ট পার্টির সর্বহারা সমর্থনে প্রস্তাব বিষয়ক আলোচনা। সেখানেও আছে বুর্জোয়া সম্পত্তি বিলোপের, ব্যক্তিগত সম্পত্তিধারীদের সর্বহারা বিরোধের কথা। সবশেষে সমাজ পরিবর্তনে সর্বজনীন মালিকানার কথা। ম্যানিফেস্টো রচনাটি বুর্জোয়া আইন, শিক্ষা, পরিবার বিরোধিতা, এবং পুঁজির কেন্দ্রকরণ, রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের কথা বলে। সবশেষে আছে তৎকালে প্রচলিত নানাবিধ সমাজতন্ত্রের কথা। এই ভাবেই বইটির 'তাৎপর্য' ও 'প্রাসঙ্গিকতা' বুঝতে হয়, যা প্রবন্ধে নেই। ম্যানিফেস্টো আর যুক্তি বিশ্লেষক আলোচনা এক নয়। 'একের পর এক বিপর্যয়' কিন্তু বইটির অনুধাবনগত গুরুত্ব কমায় না। মার্জনা চেয়ে বলি এভাবে দেখলে বইটি কিন্তু মোটেই জটিল মনে হয় না, প্রাসঙ্গিক পরিপ্রেক্ষিত মাথায় রাখলে পাঠ সহজ হয়ে আসে। (পৃ. ১১১) তা না হলে শোভনবাবুর মতো অনেকেই মনে করবেন বইটি scientific নয়, বইটি 'provided no thorough theoretical basis for revolution and the end of capitalism.'
এই বইতে যদিও তিনি বলেছেন - 'মার্কসবাদের শক্তিটা এখানেই যে এটি তত্ত্ব ও প্রয়োগের একটি যথার্থ সমন্বয়কারী দর্শন।' (পৃ. ১১৪) কিন্তু প্রয়োগমুখ্য মার্কসবাদকে গুরুত্বের সঙ্গে আলোচ্য মনে করেননি। মার্কসবাদ সংক্রান্ত বৌদ্ধিক ইতিহাসের পুনর্বিচার এই বইয়ের মুখ্যপ্রসঙ্গ এবং তিনি পাঠককে বারে বারে লুক্সেমবুর্গ, ট্রটস্কি, গ্রামশি, বুখারিন পাঠের ব্যাপারটা সহজ করে বোঝাবার চেষ্টা করেছেন। এই সূত্রে বুখারিন চিন্তার স্বাতন্ত্র্য, লেনিনের দর্শনগত নোটবুকের বুখারিনকৃত গুরুত্বদান, চেতনা ও আত্মবাদের গুরুত্ব প্রভৃতির কথা বলেছেন। কিন্তু বুখারিন চিন্তা বেরিয়ে এসেছিল লেনিনের সঙ্গে মত বিনিময়ে, বুখারিনের Imperialism and World Economy র (১৯১৫) ভূমিকা লেখেন লেনিন, যেখানে বুখারিন বলতে চেয়েছিলেন internal capitalist competitions was being replaced more and more by the struggle between 'state capitalist trusts'. ১৯১৬ তে বুখারিন পরিবর্তমান সর্বহারা রাষ্ট্র বিষয়ে বলতে গিয়ে imperialist robber state কে আক্রমণ করেন, যার কিছু কথা লেনিনের 'রাষ্ট্র ও বিপ্লব' এর মধ্যে পরে মিলবে। বুখারিনের বৌদ্ধিক চিন্তার বিস্তারী আলোচনা শোভনবাবুর মতো প্রাজ্ঞ ব্যক্তিদের কাছে আমরা শুনতে চাই, তাঁর দর্শন, উপন্যাস, কবিতা নিয়েও তিনি কিছু বলবেন ভবিষ্যতে অনুরোধ রাখি। শোভনবাবু বলেছেন সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে অনেক অপকর্ম, বিকৃতি ও মিথ্যাচার উদ্ঘাটিত হওয়ায় তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নকে সমর্থনের 'নীতিগত দায়' থেকে মুক্ত হয়েছেন। (পৃ. ১২৮) তিনি কি সি. পি. আই. এর সমর্থক, পার্টিজান, না হলে নীতিগত দায়ের প্রশ্ন কেন? যা হোক রোজা লুক্সেমবুর্গ বিষয়ক আলোচনায় যতটা ইদানীংকালের সম্মেলন তালিকা প্রদান, নারিহিকো ইতোর গুরুত্ব, তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ, চিনে রোজা চিন্তার সমর্থন প্রভৃতির কথা আছে, তাঁর অবদান ও গুরুত্ব নিয়ে কথা নেই। তাঁর মতো বুদ্ধিজীবিরা যদি এ বিষয়ে আলোচনা না করেন তাহলে ভারতে তাঁর চিন্তাভাবনার প্রতি আগ্রহ সঞ্চারে অনাগ্রহ নিয়ে দুঃখ করা অনর্থক। লুক্সেমবুর্গ তত্ত্বগত মাকর্সবাদকে জনসংকল্পের সঙ্গে মেশাতে চেয়েছিলেন, লেনিনের অগ্রগামী শক্তির অত্যাচারমনস্কতার সমালোচনা করেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য শুধু পুঁজিবাদ তার বিকাশের পরিস্থিতি সৃষ্টি করে না। চাহিদার তুলনায় পুঁজির সঞ্চয় বেশী হলে পুঁজিবাদ অনুন্নত উৎপাদন ক্ষেত্রে পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদের জন্ম দিতে পারে। লিয়েবনেখট সহ তিনি রুশ সাম্যবাদের পদক্ষেপ অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। চীনা সাম্যবাদ তাঁর চিন্তার কোন্ দিকটা গ্রহণ করল, একালে তাঁর গুরুত্ব কেন বাড়ল সেসব নিয়ে জানার আগ্রহ অস্বাভাবিক নয়। লুক্সেমবুর্গ সম্পর্কে আলোচনা পাঠে যে আক্ষেপের কথা বলেছি তা বুখারিন বিষয়ক আলোচনায় খানিকটা প্রশমিত হয়। বুখারিনের চিন্তার গুরুত্ব সম্পর্কে সুন্দর সংক্ষিপ্ত আলোচনা আছে ১৪২-৪৩ পৃষ্ঠায়। তারপর কারা-পাণ্ডুলিপির ১২টি অধ্যায়ের পরিচিতি। দ্বিতীয় কারা-পাণ্ডুলিপির পরিচয় সংক্ষিপ্ত হলেও একটা ধারণা করা যায়। মার্কসবাদী তত্ত্ব এবং পূর্ব ইউরোপের ঘটনাবলি একালের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য, কিন্তু লেখক পূর্ব ইউরোপীয় ঘটনাবলি-নিঃসৃত সংকটকে আলোচনা না করেই মন্তব্য করেন ওখানে যা ঘটেছে 'তা গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের মধ্যে সামঞ্জস্যর অভাবেরই ফলশ্রুতি যদিও মার্কসবাদ রাজনৈতিক দর্শন হিসেবে ব্যর্থ নয়।' এ হল অতি সরলীকৃত সিদ্ধান্ত, উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটি উপস্থিত না করায় তা চাপিয়ে দেওয়া মনে হতে পারে। গর্বাচেভ, ব্রেজনেভ পর্বের অধঃপতন সম্পর্কে তিনি নীরব। এখানেও তিনি মার্কসবাদে বিকল্প পথের নিদান দিয়েছেন, নতুন ভাবনা চিন্তার সুযোগের কথা বলেছেন কিন্তু সেই চিন্তা কোন পথে, কিভাবে, তা বলা দরকার। একুশ শতকে মার্কসবাদ বিষয়ক আলোচনায় তাঁর বক্তব্য, মার্কসবাদের বৌদ্ধিক প্রসারে ক্ষতি হয়ে গেছে (এ আক্ষেপ সর্বত্র), মার্কসবাদ একরৈখিক হয়ে গেছে, মার্কসবাদকে সূত্রবদ্ধ করার ফলে নিয়মবদ্ধতা এসেছে, তা বৈজ্ঞানিক কি না এটা সংশয়ের ব্যাপার। সোভিয়েত সমাজতন্ত্র শ্রেষ্ঠতর গণতন্ত্র ও মানবতাবাদের জন্ম দিয়েছিল এ ধারণাটিও তাঁর ভ্রান্ত মনে হয়। (পৃ. ১৬৯) এ আলোচনাও আরও বিস্তারের দাবী রাখে। তা না হলে তাঁর ব্যাখ্যাও মন্তব্য মাত্র মনে হতে পারে। দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে তিনি মার্কসবাদে আস্থা ও অনাস্থার মাঝখানে আছেন। মার্কসবাদে আস্থা ও পার্টিতে আস্থা এ দুটোর মধ্যে যোগ আছে, কিন্তু এক ব্যাপার নয়। রুশ বিপ্লবের পরের কয়েকটি দশক সম্পর্কে রুশ ও অন্যান্য দেশের পর্যবেক্ষণ, রবীন্দ্রনাথ, এইচ. জি. ওয়েলস, রোঁলা প্রভৃতিদের অবলোকন, অনেক দৃষ্টান্তও, সৃজনশীল রচনা যা তরুণ বয়সে লেখক দেখেছেন, আমরাও সে বয়সে দু চার পাতা দেখেছি, সেই দেখাটা শুধুমাত্র আবেগময় মুগ্ধতা বলা ঠিক হবে না। এই কথাটি লেখক পৃ. ১৭৩- এ নিজেই তুলেছেন। তিনি একথাও মানেন সমাজতন্ত্রের কর্মসূচি রূপায়িত করতে গিয়ে সোভিয়েত রাষ্ট্রকে যে দায়ভার নিতে হয়েছিল তার চরিত্রের মধ্যে ছিল নৈতিকতার ভাবনা। (পৃ. ১৭৭) কাজে নামলে যে কোনো মানুষই বোঝেন, একরৈখিকতা দরকার-ও বটে, সমস্যা সৃষ্টি করেও বটে। এর সমাধান কোন পথে তার কিছু হদিশ চীনা মডেলে আছে, সেটা লেখক নিশ্চয়ই জানেন। মার্কসবাদ তার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে একথা প্রয়োগবিহীন বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর একাংশের আবিষ্কার। মনে পড়ছে সেকালে হীরেন মুখার্জী ও একালে রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের সোচ্চার ঘোষণা - মার্কসবাদী হিসেবে নিজেকে ঘোষণা করতে লজ্জা পাই না। (মননের মূর্তি, ভূমিকা) উত্তর আধুনিকতার দর্শন আশির দশকে কেন প্রসারিত হল, তা অন্যত্র বিস্তৃত আলোচিত হয়েছে। উত্তর আধুনিকতা কখনই মার্কসবাদের বিকল্প হতে পারে না, কারণ তা মার্কসবাদের মৌল বৈশিষ্ট্যগুলিকেই আক্রমণ করে বসে। উত্তর-আধুনিকতা মেহনতী মানুষের সতত সক্রিয় বুদ্ধিজীবির হাতিয়ার হতে পারে না। তাই এই polemics এর বিরোধিতা প্রয়োজন। উত্তর-আধুনিকতা এবং মার্কসবাদের সম্পর্ক নিয়ে বেশ কিছু কথা একটি প্রবন্ধে এবং অন্যত্র ছড়িয়ে আছে যদিও স্পষ্টতা অনেকক্ষেত্রেই আসে না। ১৯০-১৯১ পৃষ্ঠায় যে বিচার আছে তার সঙ্গে মার্কসবাদের বিকল্প ভাষ্যের সওয়াল (পৃ. ১৯২) গুলিয়ে যায়। একুশ শতক ও মার্কসবাদ, কার্ল পপার ও মার্কসবাদ এই দুটি প্রবন্ধও লেখকের খোলা মনের এবং ব্যাপক পাঠের পরিচায়ক। শেষ প্রবন্ধেও উত্তর আধুনিকতা নিয়ে কিছু কথা আছে। কিন্তু তিনি যদি উত্তর আধুনিকতার আলোচনাকে সংহত করতেন, মার্কসবাদের সঙ্গে তার তফাৎ, বিভ্রান্তির জায়গাটা তুলে ধরতে পারতেন তাহলে অ্যাকাডেমিসিয়ানদের উত্তর আধুনিকতা চর্চার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সংযোজন হত। বামপন্থীদের এ নিয়ে বিভ্রান্তির ব্যাপারটাও স্পষ্ট হত। এ কাজ তাঁর মতো সুধী ব্যক্তিদেরই হাতে নেবার কথা। নইলে আমরা কাদের সাহায্যে মতামত গড়ে তুলতে পারব?
Rupert Woodfin এবং Oscar Zarate তাঁদের বইতে (Introducing Marxism) মার্কসবাদের বিরুদ্ধে ১০ দফা আপত্তি তুলেছেন। তাঁরা ধরেই নিয়েছেন এ এক পোস্টমডার্ন পৃথিবী। এরকম আরো হাজারটা বই আছে। এরাও alternative Marxist approach এ বড়ই আগ্রহী। এ হল মার্কসবাদকে মান্য করে মার্কসবাদ বিরোধিতার চাতুর্য। মার্কস থেকে স্ট্যালিন পর্যন্ত বক্তব্যচর্চা বড় ডগম্যাটিক, বড় ভালগার এমন কথাও ওঠে, সোভিয়েত মার্কসবাদ, পশ্চিমা মার্কসবাদ, তৃতীয় বিশ্বের মার্কসবাদ প্রভৃতি বিভক্তিকরণের কথাও বহুদিন ধরে আলোচিত হচ্ছে। কিন্তু মার্কসবাদ যদি প্রয়োগবিদ্যা হয় তাহলে ভারতবর্ষে আমরা কোন মার্কসবাদের চর্চা করব - বর্তমান অবস্থা (সর্ব অর্থে) উন্নয়নের প্রশ্নে? এই প্রশ্ন মাথায় রেখেই মার্কসবাদ চর্চা হওয়া উচিত বলে আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে মনে হয়। ভারতবর্ষের মতো বিচিত্র দেশে মার্কসবাদ চর্চার ইতিহাস বড়ো বিচিত্র, মার্কসবাদীদের কর্মচর্চাও বিচিত্র, শাসন ক্ষমতায় অংশগ্রহণ সেটাও অদ্ভুত। লেনিন যে 'শূয়োরের খোঁয়াড়' এর কথা বলেছিলেন তা বিধানসভার অধিবেশনে দেখেছি, নির্বাচন বক্তৃতায় কুৎসিত আক্রমণেও তার পরিচয় আছে। এখানে বড়ো মাপের দূরের কথা ছোটমাপের মার্কসবাদী তাত্ত্বিকও নেই। এখানে মার্কসবাদের আলোচনা এবং মার্কসবাদীদের লড়াইয়ের মধ্যে কোনো যোগ নেই, পার্টি জার্নালে কিছু উদ্ধৃতি শোভা পায় মাত্র। শোভনলালবাবু পণ্ডিত মানুষ, তাঁর মার্কসবাদ বিষয়ক বইপত্র পড়ে আমরা বড়ো হয়েছি। (বড়ো মানে বয়স্ক।) কিন্তু তিনি ভারতীয় মার্কসবাদীদের মূল্যায়ন, প্রশাসনে অংশগ্রহণ, প্রগতিশীলতার মুখোশে প্রতিক্রিয়ার আচরণ নিয়ে একটি কথাও বলেননি। ফলে আলোচনা হয়ে ওঠে শৌখীন, বিদ্যাবত্তার উদাহরণ মাত্র। আমাদের প্রয়োজন অবস্থার উন্নয়নে মার্কসবাদের সহায়তা, মানসিকতার উন্নয়নে মার্কসীয় তত্ত্বের সহায়তা, সে কাজে গুলিয়ে যাবার হাত থেকে বাঁচাতে হবে, সঠিক চিন্তাগুলোকে তুলে ধরতে হবে, যা গ্রামশি করেছেন, বুখারিন করেছেন, লুক্সেমবুর্গ করেছেন-- বিপদ মাথার ওপর জেনেও করেছেন। ভারতীয় context এর বিস্তৃত উপস্থাপন এবং বিরুদ্ধ প্রবণতার বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা একান্তই প্রয়োজন। সেই approach থাকলে আগ্রহী পাঠক অনেক উপকৃত হত।