কলেজ স্ট্রীটে সত্তর বছর (তৃতীয় খণ্ড); সবিতেন্দ্রনাথ রায়; দীপশিখা প্রকাশন; কলকাতা-৫২; ISBN-978-81-7293-947-2
পঞ্চদশ বর্ষীয় এক কিশোর। গরীব ঘরের ছেলে। প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেছে (সেকালে এ'বড় কম কৃতিত্ব ছিল না)। 'পেটের দায়ে' চাকুরি করতে ঢুকল বইয়ের দোকানে। পাশে পাশে সান্ধ্য কলেজও চলতে লাগল। সালটা ১৯৪৯। এর পর এক নয় দুই নয়, নয় নয় করে ছ’-ছ’টা দশক কোথা দিয়ে কেটে গেছে। সেকালের বিভূতি-তারাশংকর-প্রবোধকুমার দীপ্ত বাঙলার সাহিত্যাকাশে উতর-চড়াইও কম আসে-যায় নি। কিন্তু কলেজ স্ট্রিটের সেই 'মিত্র-ঘোষ' দোকান ছেড়ে সেই কিশোর কিন্তু আর কোথাও চলে যায় নি। তার ফসল আজ পাই 'বই-পাড়ার প্রথমপুরুষ' ভানুবাবুর মধ্যে দিয়ে, পোশাকি নাম যাঁর সবিতেন্দ্রনাথ। ১৯৯৭-র আকস্মিক অগ্নিকাণ্ডে 'কলকাতা বই মেলা' পুড়ে ছাই হয়ে গেলে যাঁর নেতৃত্বে মাত্র তিন দিনের মধ্যে ফের ঘুরে দাঁড়িয়েছিল মেলা! তাই, সাহিত্য নয়, কোনো ম্যানেজমেন্ট স্কুলের পাঠ্য হওয়া উচিত ভানুবাবুর এ' কর্মকাণ্ড, এ' নেতৃত্ব! বর্তমান নিবন্ধের উদ্দেশ্য অবিশ্যি একটু অন্য, তাঁর অনবদ্য জীবনালেখ্যখানির আলোচনা।
১৯৪৯-এ যেদিন কিশোর ভানুর লেখা 'আনন্দমেলা'-এ বেরিয়েছিল, বিভূতিভূষণ সস্নেহ ঠাট্টায় বলেছিলেন, "ভানুও তো দেখি লেখক হয়ে গেল!" বিভূতিভূষণ আজ বেঁচে থাকলে দু'হাত তুলে আশীর্বাদ করতেন স্নেহের ভানুকে, তার এ' অনবদ্য ট্রিলজি পড়ে। সবিতেন্দ্রনাথের 'কলেজস্ট্রিটে সত্তর বছর' কি এক ইতিহাস, না এ' এক রম্যরচনা, না কোনো জীবনকথা? না, একাধারে এ' তিনেরই সমাহার? বাঙলা প্রকাশনা জগত নিয়ে এ'হেন লেখা ইতোপূর্বে হয়নি। তাই এ' এক অনবদ্য ইতিহাস, এক প্রামাণিক দলিল। আর লিখনভঙ্গি? পড়তে পড়তে মনে হয় নিজেই যেন সেই কবিশেখর-সুনীতিকুমার-বিভূতি দীপ্ত আড্ডায় বসে আছি। এ'অঙ্গে তাই এ'গ্রন্থ আলী সাহেবের রম্যরচনার গা ঘেঁষে গেছে। আর, অশোক মিত্রের 'তিন কুড়ি দশ' বা ভবতোষ দত্তের 'আট দশক'-এর পরে কোন্ জীবনীগ্রন্থ পড়ে এতো আনন্দ পেয়েছি, ভাবতে বসতে হবে। অনবদ্য রচনাভঙ্গি এ'গ্রন্থের। 'মিত্র-ঘোষ'-এর আড্ডার টানে প’ড়ে ভানুর আর সরকারী চাকুরি করতে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। পাঠকেরও হয়ে উঠবে না এ'বই-এর পাতা মুড়ে দু'-দণ্ড টি.ভি. সিরিয়াল দেখে নেবার। এমনই সাবলীল, স্বচ্ছতোয়া লিখন এ’। ঘটনাগুলো যেন চলচ্চিত্রের মত একের পর এক ভেসে ভেসে ওঠে পাঠকের চোখের সম্মুখে। সত্যি, 'আন্পুটডাউনেব্ল্'!
গ্রন্থের এই গতি, এই আকর্ষণ, এই গ্রহণযোগ্যতা না থাকলে কোনো প্রতিষ্ঠিত লেখক না হয়েও গত দু’বছরের মধ্যে গড়ে আড়াইশ’ পৃষ্ঠার এমন তিন-তিনখানি কেতাব লিখে ফেলতে পারেন সবিতেন্দ্রনাথ, বাজারে যা 'বেস্ট সেলার'?! কত না ঘটনার সমারোহ এ'গ্রন্থত্রয়ে---দেশবিভাগের ঘটনাবলী থেকে বিভূতিভূষণের শেষদিনগুলি থেকে একেক মহান লেখকের মর্মকথা! হ্যাঁ, আমি এই তৃতীয় খণ্ডের সৈয়দ মুজতবা আলী সাহেবের প্রসঙ্গটিই টানছি। নিপুণ শিল্পীর মত মাত্র দু'-একটি তুলির আঁচড়ে আকাশ-হৃদয় আলীসাহেবের অন্তঃস্থলের কথা সবিতেন্দ্রনাথ যে দক্ষতায় তুলে এনেছেন---এক কথায়, অনবদ্য!
আর আড্ডা, চুট্কিলে? সব ক'টা জড়ো করলে আলাদা একটা পুস্তিকাই হয়ে যায় তার। সজনীকান্ত-প্রমথ বিশী ছিলেন সে-সবের মুখ্য চরিত্র! তবে, সবক'টার মধ্যেও প্রমথ বিশীর সেই থার্ড বা ফিফ্থ্, সেভেন্থ বা নাইন্থ্ গেইসার কাছে যাবার প্রস্তাবেরটিই সেরা, যদিও একটু 'ইসের' কান ঘেঁষে বেরিয়ে গেছে। এই 'সাহিত্যিক আড্ডা'-ই বই তিনটির মূল সুর, যা ট্রিলজিতে ফল্গুধারার মত বয়ে গেছে।
আরেকটি বিষয় হল, তথ্য। বই-বাজার সংক্রান্ত এমন তথ্যের সহজলভ্যতা এক-বইয়ের মধ্যে ---ভাবা যায় না!
সবিতেন্দ্রনাথের মুন্সিয়ানা হল এক ইতিহাসকারের মত তাঁর নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি। নিজে সাহিত্যিক নন, কিন্তু তাবড়-তাবড় সাহিত্যিককুলের সঙ্গে ওঠা-বসা---যাঁদের সম্বন্ধে তিনি লিখতে বসেছেন---এই কুন্ঠা যেন এক আলাদা দৃষ্টিকোণের জন্ম দিয়েছে---যার দ্বারা তিনি 'পাঁকাল মাছের মত সংসারে' রয়ে গেছেন। এই নির্মোহত্ব গ্রন্থটিকে এক উচ্চতর কোটীতে উন্নীত করে। শ্রীম যেমন পরমভক্ত হয়েও ভাষ্যকারের কলমে 'কথামৃত' লিখে গেছেন, শ্রীভানু তেমনই নির্মোহ ধারাভাষ্য দিয়ে গেছেন কলকাতার বইপাড়ার।
প্রথম দু'টি খণ্ডে লেখার ফাঁকে ফাঁকে বা কোনো অধ্যায় শুরুর মুখে সাদাকালো ছবিগুলির অবস্থান বেখাপ্পা ঠেকেছিল। এই তৃতীয় খণ্ডে এসেও ছবির মান তেমন উচ্চাঙ্গের না হলেও, এই দোলাচলটুকু গেছে। চিত্র হিসেবে বই-পাড়ার পাঁচ-সাতখানি ছবিই বারংবার ঘুরেফিরে আসায় নান্দনিক দৈন্য ঘটেছে। আর কলেজ স্ট্রিট পাড়ায় মাঝ-ষাট থেকে মাঝ-সত্তরে থেকেও সে-সময়কার অতি-বামপন্থী আন্দোলনের কোনো উল্লেখ নেই দেখে এটাই মনে হয়েছে, যে নিজে রাজনীতির জগতের মানুষ নন বলে অচেনা এলাকায় পা রাখেননি ভানুবাবু। তা বেশ করেছেন। এ'সব যদিও সামান্য অনুষঙ্গ মাত্র। বইপাড়ার এ' প্রামাণ্য দলিল বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাসে পাকা ঠাঁই করে নেবে --- কোনো সন্দেহ নেই তাতে।
একটাই আক্ষেপ, ভানুবাবু আর কয়েক বছর আগে কলম ধরলে বাঙালি পাঠক ওনার হাত থেকে কিছু উঁচুদরের রম্যরচনা উপহার পেতে পারত!
গুপ্তধন আবিষ্কার ও অন্যান্য গল্প; গৌর বৈরাগী; প্রতিক্ষণ পাবলিকেশন; কলকাতা-১৩; ISBN No. নেই
নীল আকাশ যেখানে ঝুঁকে আছে সবুজ মাঠের প্রান্তে, ঝিল্মিল্ তেচোকো মাছের দল যে-জলাশয়ে অনায়াস খেলে বেড়ায়, যে-দেশের রাজা মশায় তেল-ধুতি পরে রাজ্যপাট দেখতে বেরোন--- সে-দেশের গল্পমালা এ’খানি। লেখক বৈরেগী মানুষ কিনা, তাই একতারাখান্ তাঁর বড় সুরে বেজেছে... “বসন্তে কী শুধু কেবল....”
না, এখানে ভোটে হারজিৎ নেই, হঠাৎ বে-তানে মোবাইল ফোন এখানে বেজে ওঠে না, ক্লাসে ওঠার পরীক্ষায় কেউ এখানে ফেল করে না--- বেশ দেশ, নয়? তা’লে বসে কেন? চলো সেই গুপ্তধন খুঁজে আনি। নাঃ, কিচ্ছু লাগবে না দড়িদড়া-ম্যাপ-কাফিলা। সে-মোহর ঘড়া রাখাই আছে। কেবল তুলে আনার ওয়াস্তা।
ঊনিশটি কিশোর গল্পের সংকলন এ’খানি--- তাতেও চমক। বিশ হলেই যেন কোনো নিয়মের নিগড়ে বাঁধা পড়ে যেতে হত। আর কে নেই এ’সব গল্পে? রবিউল পালিশওলা থেকে ও.সি. হিমশৈল চাকলাদার থেকে নিরীহ সুকান্ত থেকে ‘একটা বিচ্ছিরি ভালো ছেলে’ অবদি! দীপাকে তো আমরা সবাই চিনি। আর-সকলকে চেনো না? নিদ্রালু রাজামশায়, পাশের বাড়ির ডাব্লু বা নিমাই ভবঘুরে? পাবে, পাবে, সক্কলকে পাবে। মাউস ক্লিক করে নয়, এক-সকালে বোঁ করে মেচেদা লোকাল ধরে কোলাঘাটে নেমে বা শিলিগুড়ি থেকে মাথাভাঙার বাস ধরলে। আমার ঘরে প্রতি রোববার ধূপ বেচতে আসে যে-ছেলেটি, তাকেই কি চিনি? সে কি ‘ঘটনার নায়ক’ হতে পারে না?
এ’রকম শত-চরিত্র-ছোঁয়া স্নিগ্ধ মায়াকাজলের গল্পমালা গৌর বৈরাগীর “গুপ্তধন আবিষ্কার ও অন্যান্য গল্প”। এ’ গল্প যার ভালো লাগেনি তার কান থেকে মোবাইলের লেজ খুলে ফেলতে হবে, আই-পডের নাম না শোনাই ভালো, আর রিবক শ্যু? অঃ, দিলে সব মাটি করে!
‘প্রতিক্ষণ’-এর কাজ। চমৎকার ছাপাই-বাঁধাই ও অনুপম প্রচ্ছদ! অলংকরণ? যুধাজিৎ অনবদ্য (কিন্তু গোড়ায় নামখানি ‘যুধজিৎ’ ছাপা হয়ে গেছে যে! শুধরে নিও।)
এ’ বোতামবিহীন ছেঁড়া শার্ট ছেলেপুলেদের চেয়ে তাদের বাপ-মায়েরা বেশি করে পরলে ( বা, পড়লে) বেচারাদের ওপর সবেতে ফার্স্ট্ হবার চাপটা কিছু কমবে।
সুরসাগর হিমাংশু দত্ত; সম্পা. অশোক দাশগুপ্ত; আজকাল; কলকাতা-৯১; ISBN 978-81-7990-073-4
সপ্তদশ শতকে দিল্লির মসনদ দখলের লড়াইয়ে ভ্রাতা আওরঙ্গজেবের কাছে পরাস্ত হয়ে শাহ্ সুজা আরাকানে পালিয়ে যান। পথে ত্রিপুরা রাজ্যের কমলাঙ্কপুরীতে তিনি কিছুদিনে কাটিয়ে গিয়েছিলেন। ত্রিপুরা রাজের সঙ্গে তাঁর সখ্যতা গড়ে ওঠে, যিনি শাহ্জাদার জন্য ‘সুজা-মসজিদ’ গড়ে দেন। উত্তরভারতের ধ্রুপদী সঙ্গীতের পুব-বাঙলায় আগমনের সেই শুরু বলে মনে করেন পণ্ডিতগণ, কারণ, পুব-বাঙলায় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের চর্চা প্রথম এই কমলাঙ্কপুরী শহরেই শুরু হয়েছিল---নাম-ভেঙে ‘কুমিল্লা’ শহর বলে আজ যা পরিচিত।
আধুনিক কুমিল্লায় এ’সঙ্গীত ধারার উদ্গাতা ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর কিংবদন্তী ধ্রুপদীয়া শ্যামাচরণ দত্ত মশাই (হিমাংশুর ধ্রুপদ-গুরু)। এনার কন্যা মায়াদেবী এককালে প্রথম বাঙালি মহিলা খেয়ালিয়া হিসেবে সারা ভারতে প্রতিষ্ঠা পান। আর ছিলেন কিংবদন্তীর খেয়ালিয়া খস্রু মিঞা, হিমাংশুর জ্যেষ্ঠভ্রাতা শচীন্দ্র (পরে লক্ষ্মৌর ম্যারিস কলেজের অধ্যাপক), ‘সুধাসাগর তীরে’-র লেখক সুরেশ চক্রবর্তী, ত্রিপুরার প্রখ্যাত বাঁশের বাঁশি ‘টিপেরা ফ্লুট’-এর প্রণেতা শচীনকর্তার পিতা নবদ্বীপচন্দ্র, কবি ও গীতিকার অজয় ভট্টাচার্য-সুবোধ পুরকায়স্থ-সঞ্জয় ভট্টাচার্য প্রমুখ।
এই সঙ্গীত-পরিমণ্ডলে কুমিল্লা শহরে হিমাংশুকুমার দত্তের জন্ম, ১৯০৮-এ’, যিনি মাত্র বাইশ বছর বয়সে কলকাতার ‘সারস্বত মহামণ্ডল’ (সভাপতিঃ শোভাবাজারের রাজা গোপেন্দ্রকৃষ্ণ দেব!) থেকে ‘সুরসাগর’ উপাধিতে ভূষিত হন! এই উপাধি কি আর কেউ পান নি? তবে ‘সুরসাগর’ বলতে শুধু ‘হিমাংশু দত্ত’-কেই মনে পড়ে কেন? এ’যেন ‘বিদ্যাসাগর’-উপাধির মত, অনেকে পেয়ে থাকলেও, আমাদের চক্ষে সেই ‘ঈশ্বরচন্দ্র শর্ম্মণঃ’-ই ভেসে ওঠেন!
তিরিশ-চল্লিশের দশকে তখন কলকাতা-বোম্বাইয়ে রাইচাঁদ, সুধীরলাল, ভীষ্মদেব থেকে ক্ষেমচন্দ, শচীনদেব--- এমন সুর-জ্যোতিষ্কের সংখ্যা কম নয়। যে-সে নয়, সুপ্রভা সরকারের মত সঙ্গীতপ্রতিভাকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, “গুরুদেবকে আলাদা স্থান দিয়ে বলুন, সে-কালের ‘সর্বশ্রেষ্ঠ’ সুরকার কে ছিলেন”? উনি ভাবতে এক মিনিটেরও কম সময় নিয়েছিলেন। ‘গানের জগৎ’-পত্রিকায় সেই সাক্ষাৎকারের বর্ণনা এইভাবে বিধৃত আছে, “ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ, সর্বশ্রেষ্ঠ বললেও অত্যুক্তি হবে না,.......সেই সুরস্রষ্টা.....সেই মহাগুণী পুরুষটির নাম হিমাংশু দত্ত সুরসাগর”!
মাত্র ছত্রিশ বছরের জীবন। তারই মধ্যে কঠিন ব্যাধি, ব্যর্থ প্রেম, মানুষটাকে যেন কুরেকুরে খেয়ে নিয়েছিল। তুলনা চলে আসে মোজার্টের সঙ্গে, যিনিও ঠিক ছত্রিশ বছর বেঁচে ছিলেন। যে-পাঠকের কাছে এ’-তুলনা অতি-প্রলম্বিত লাগছে, তাঁর তরে নিবেদন, ঢাকায় পনের বছরের তরুণ হিমাংশুর গান শুনে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ মোহিত হয়ে পড়ছেন, পরে ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায় তাঁর সঙ্গীতভাবনা-সম্বলিত প্রবন্ধ পড়ে কবি তাঁর সেক্রেটারি অমিয় চক্রবর্তীকে তাঁর বাড়ি পাঠিয়ে ডেকে আনাচ্ছেন ও তাঁর সুরে মোহিত হয়ে কবি নিজেই গেয়ে উঠছেন! কোন্ আন্তরিক ‘জোর’ থাকলে এটা সম্ভব? তবু, দেখুন, তাঁর আরেক সমসাময়িক প্রতিভা ও তাঁর সুহৃদ কুমার শচীনদেবের সিকি প্রচার ও জনপ্রিয়তাও হিমাংশুর ভাগ্যে জোটেনি---সেটা যত না তাঁর স্বল্পায়ুর জন্য, তার চেয়ে বেশি বম্বেতে পাকাপাকি বাস না গাড়ার জন্যে। নাঃ, কুমিল্লায় না জন্মে অস্ট্রিয়াতে জন্মালে হিমাংশুকে নিয়ে আজ এই নিবন্ধ লেখার প্রয়োজন হত না।
কী ছিল হিমাংশুর সুরে?
প্রধানতম যেগুলি ছিল, তা তাঁর স্বকীয়তা, মৌলিকতা ও অনন্য আত্মীকরণের ক্ষমতা! নৈলে, ভাবুন না, ’৩০-’৪০-এর দশকে বাঙলা কাব্যসঙ্গীত নিয়ে কাজ করে গেছেন হিমাংশুকুমার রবীন্দ্রনাথের কোনো রকম প্রভাব ছাড়াই! ভাবা যায়? তাঁর কোনো একটিমাত্র গান শুনে কি কখনো কারও মনে হয়েছে যে তাতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সামান্যতম প্রভাবও পড়েছে? যদিও হিমাংশুর মনে কবিগুরুর প্রতি উচ্চতম শ্রদ্ধা সদাই বজায় ছিল। বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’-পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর এ’-সংক্রান্ত প্রবন্ধটিই তার শ্রেষ্ঠ সাক্ষ্য বহন করে। হ্যাঁ, হিন্দোস্তানি রাগসঙ্গীতের প্রভাব অবশ্যই পড়েছিল, ব্যাপকভাবে পড়েছিল। কিন্তু কী অনায়াসে তা ভেঙে-গড়ে নব নব রূপ দিয়ে গেছেন সে-সব রাগসঙ্গীতকে নিজসুরে! এ-ই তো আত্মীকরণ! ওনার এক অতি জনপ্রিয় “ফাগুনের বাঁশিখানি.....” গানখানি ভাবুন তো? গানের বাণী যেখানে বসন্তের, ‘বাহার’-রাগ তো সেখানে যেন আগে থেকেই খাপ খেয়ে বসে আছে। কিন্তু না, তিনি যে ‘সুরসাগর’। কী অনায়াসে ওই গানে আবাহনের রাগ দুর্গা-র ছোঁয়া টুকু দিয়ে চলে গেলেন! অন্য এক স্তরে উঠে গেল গানখানি। কী মুন্সীয়ানা! আবার “বাদলের ধারা ঝরে.....” গানখানি ‘মল্লার’ নয়, ‘দেশ’-রাগে করার ভাবনাটার মধ্যেই অনন্যতা, স্বকীয়তার ছোঁয়া রয়ে গেছে। আবার ওনার সবচেয়ে জনপ্রিয় “প্রেমের সমাধিতীরে....” (শচীনদেব বর্মণ) বা, “চাঁদ কহে চামেলী গো.....” (উমা বসু) কোন্ রাগাশ্রয়ী গান? কোনো রাগাশ্রয়ী কী আদৌ? কে বলে দেবে? রোম্যান্টিসিজ্মের চূড়ান্ত! আবার আরেক অতি জনপ্রিয় “তোমারই পথ পানে চাহি......” শুনলে মনে হয় না পিছনে অর্গ্যান বাজছে? স্পষ্টতঃ পশ্চিমা প্রভাব! কী অনায়াস খেলা খেলে গেছেন!
হ্যাঁ, এই ছিলেন ‘সুরসাগর’ হিমাংশু দত্ত! আর এ’সবই তিনি করে গেছেন তাঁর মাত্র ছত্রিশ বছরের জীবনের মধ্যে! ‘প্রতিভা’ আর কাকে বলে?!
এ’বার সুরসাগরকে নিয়ে এক সু-সম্পাদিত বৃহৎ গ্রন্থ প্রকাশ করলে এ’-দোষের স্খালন হয়।
Longitude---The Story of a Lone Genius Who Solved the Greatest Scientific Problem of His Time; Dava Sobel; Harper Perennial; London; ISBN 978—00-721422-8
ইয়র্কশায়ারের এক প্রত্যন্ত গ্রাম ফুলবি। তার এক স্বল্পশিক্ষিত বা স্বশিক্ষিত ছুতোর মিস্ত্রি, কোনক্রমে দাঁড়ি-কমা-সেমিকোলন ছাড়া মাতৃভাষা ইংরিজিটা লিখতে পারে। দরিদ্র, অত্যন্তই দরিদ্র; কোনোক্রমে দিন গুজরান। সেই ছুতোরের ‘লড়াই’ কার সাথে? না, বিজ্ঞানীশ্রেষ্ঠ গ্যালিলিও-নিউটন-হ্যালির সঙ্গে!!! আর ‘কী’ নিয়ে? না, অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত অমীমাংসিত ‘দ্রাঘিমা’ সমস্যা নিয়ে। কিন্তু কী অপরিসীম অনুসন্ধিৎসা, অধ্যবসায় ও কায়মনোবাক্য-সংগ্রাম নিয়ে অবশেষে তাঁর এই জয়, কত বঞ্চনা, কত অপমান সয়ে, কত অন্যায়ের পর্বত ডিঙিয়ে তাঁর উত্তরণ সেই সাধনপীঠে, তারই ইতিহাস বিধৃত রয়েছে দাবা সোবেলের এই অনবদ্য কাহিনিতে। তাই, ইতিহাস নয়, এ’ যেন এক ধর্মগ্রন্থ---যা মানুষকে বার বার প’ড়ে গিয়েও ভেঙে না-পড়ে মানুষের মত উঠে দাঁড়াতে প্রেরণা যোগায়। তাই, ‘টাইম’-ম্যাগাজিনের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ‘নন্ফিকশন’-এর তালিকায় দাবা সোবেলের এই “Longitude…..” নিজগুণেই স্থান করে নিয়েছে।
দ্রাঘিমা সমস্যাটা আসলে কী? কী এমন সমস্যা, যাকে নিউটনের মত বিজ্ঞান-সাধকও ‘এলকেমিস্ট্রি’ বা ‘পারপেচুয়াল মোশান’-এর মত চিরকালের ‘অ-সমাধানযোগ্য’ সমস্যার দলে ফেলে দিয়েছিলেন?
অক্ষাংশ তো প্রকৃতি নির্ধারিত। সূর্যরশ্মি ঠিক-দুপুরে সরাসরি প’ড়ে বিষুবরেখা চিনিয়ে দেয়। কিন্তু দ্রাঘিমা? সে-তো মনুষ্য-নির্ধারিত। তাই বিতর্কিত। তাই, তার শুরুয়াৎ লণ্ডন থেকে হবে না প্যারিস বা আমস্টার্ডাম থেকে--- এ’বিবাদ চলতেই থাকছিল। অক্ষাংশের চেয়ে দ্রাঘিমার সঠিক নির্ণয় আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ, পুব থেকে পশ্চিমে সরণের (বা, পশ্চিম থেকে পুবে) এই কাল্পনিক রেখার অব্যর্থ গণনাই ছিল সেই কলম্বাসী-কাল থেকে বাঘা বাঘা নৌ-শক্তিধর দেশের ব্যবসা ও রাজ্যবিস্তারে সাফল্যের চাবিকাঠি। আর এ’টাই সঠিক নির্ণয় করা যেত না এই জন হ্যারিসনের ঘড়ি (ক্রনোমিটার) আবিষ্কারের আগে পর্যন্ত।
কী করে মাঝদরিয়ায় সঠিক দ্রাঘিমা নির্ণয় করা যায়? চন্দ্র–সুর্য-ধ্রুবতারকা দেখে দ্রাঘিমা নির্ণয়ের এক প্রাচীন প্রচেষ্টা তো সেই অনাদিকাল থেকে চালু ছিল। কিন্তু মেঘলা রাতে বা দক্ষিণ গোলার্ধে কী হবে? এই lunar distance method-ই হয়ে দাঁড়ালো হ্যারিসনের ‘যান্ত্রিক পদ্ধতি’ marine chronometer-এর প্রধান প্রতিদ্বন্দী! সবচে’ মজার কথা হল, তাবড় তাবড় জ্যোতির্বিদ-গণিতজ্ঞ-দার্শনিক-রাজনীতিবিদগণ এই ‘চান্দ্র পদ্ধতি’-কে-ই দ্রাঘিমা নির্ণয়ের একমাত্র পথ বলে মেনে নিয়েছিলন। হ্যারিসনের ঘড়ি তাই তাঁদের কাছে খিলৌনা মাত্র ছিল। শেষ হাসিটি কিন্তু সেই ছুতোর জন হ্যারিসনের জন্যই বরাদ্দ ছিল! কারণ, অশিক্ষিত জন ছিলেন যান্ত্রিক পদ্ধতির একমাত্র উদ্গাতা। এই পদ্ধতির শেষ জয় সম্বন্ধে যাঁর বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না। থাকলে এক নয় দুই নয় চার-চারটি দশক ধরে একটা মানুষ এক এবং একমাত্র কাজে সমর্পিত থাকতে পারে? চার দশক ধরে তিনি একে একে H-1, H-2 করে H-5 পর্যন্ত পাঁচখানি ঘড়ি নির্মাণ করেন, যা রৌদ্রে-তাপে-জলে-ঝড়ে-শৈত্যে অনলস নির্ভুল সময় দেখিয়ে যাবে মাঝ-দরিয়ার উথাল-পাথাল জাহাজে, যার সঙ্গে জাহাজের রাখা দৈনিক ঘড়িটির সময় (যা প্রতিদিন মাঝ-দুপুরের সূর্যের সঙ্গে মিলিয়ে ঠিক রাখা হয়) যোগ-বিয়োগ করে নির্ণীত হবে তার সঠিক দ্রাঘিমা।
যা অতি সহজে দু’টি বাক্যে বলে দেওয়া গেল, তা যে আদৌ অত সহজ ছিল না, তা’ বৃটিশ পার্লামেন্টের Longitude Act 1714- প্রনয়ণ ও বিশ-বিশটি হাজার পাউণ্ড পুরষ্কার অর্থ ঘোষণার মধ্য দিয়েই প্রমাণিত। সবচেয়ে দুঃখের কথা, এ’ পুরষ্কারের বিচারক ছিলেন যাঁরা, সেই ন্যাথনিয়েল ব্লিস বা নেভিল ম্যাসকেলিনের মত রাজজ্যোতিষিরা নিজেরাই ছিলেন মনে মনে এই পুরষ্কারের দাবিদার ও চান্দ্র-পদ্ধতিতে গভীর বিশ্বাসী! তাই অপরিসীম কষ্ট দিয়ে, বঞ্চনা-অপমান-বদনাম দিয়ে হ্যারিসনকে হেয় করতে চেয়েছিলেন তাঁরা। শেষটার স্বয়ং সম্রাট ৩য় জর্জের পৃষ্ঠপোষকতার স্বীকৃতি পান জন।
পরতে পরতে কাহিনির ডানা যে-ভাবে মেলে ধরেছেন সোবেল, কোনো গোয়েন্দা-উপন্যাসকে হার মানায়! সঙ্গে আছে তাঁর কঠিন বিজ্ঞান সহজ করে বলার ক্ষমতা, যেটা অনিসন্ধিৎসু গবেষণার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এ’কাহিনির তুলনা তাই মেলা ভার।
সামান্য অন্য প্রসঙ্গে হলেও তাই মনে পড়ে ভক্ত কবীরের গানঃ “যঁহা কাম আঁবে সুই, বঁহা ক্যা করে তলবার?” যে-কাজ ছুঁচের, তলোয়ার তথায় কী করতে পারে? যে-ঘড়ি (মেরিন ক্রনোমিটার) এক অশিক্ষিত ছুতোর বানিয়ে সেকালের সর্ব-কঠিন বিজ্ঞান-প্রহেলিকার সমাধান করতে পারে, গ্যালিলিও-নিউটনের ভারিভুরি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব সেখানে কী করতে পারবে?
এ’ও বড় কম শিক্ষা নয়।