• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৪৮ | মে ২০১১ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • কূর্মাচলে ক'দিন : রাহুল মজুমদার


    ২৪.১০.২০১০ - বেলা পৌনে দশটা :

    আজ সকাল থেকেই পূষণের প্রসন্নবদন দেখার সৌভাগ্য হলো। If morning shows the day - দিনটা আজ দারুণ যাবে। আজ থেকে প্রমোদতরণীতে সফর। এবার নৈনিদেবীকে মুক্তি দিয়ে মুক্তেশ্বর।

    ঠিক দুক্কুরবেলা -

    অপরূপ পথ ধরে গাগর। দিগন্ত জুড়ে হিমানী পরিবার। চা আর প্রকৃতির রূপসুধা একসঙ্গে পান করা গেল।

    বেলা একটা -


    মুক্তেশ্বরের বাংলো। জিম করবেট এখানে এসেছিলেন


    ২৯৯০ মি. উঁচুতে বনানীঘেরা মুক্তেশ্বর বাংলো। চমৎকার জায়গা বললে কম বলা হয়। নির্জনতা আর নিস্তব্ধতা এর সম্পদ। রডোডেনড্রন, পাইন ইত্যাদির ঠাসাঠাসি, পাখিদের কাকলি, সামনে পাহাড় ঢেউয়ের পর ঢেউ তুলে আছড়ে পড়েছে নন্দাদেবী, ত্রিশূলের পায়ে। কেদার, চৌখাম্বা, নীলকণ্ঠ, নন্দাঘুন্টি, ত্রিশূল, মাইকতোলি, মৃগুথুনি, নন্দাদেবী, নন্দাকোট, নন্দাখাত, পঞ্চচুলি, ধৌলাগিরি - এ যেন দেবসভা! এসবের মাঝে KMVN-এর বাংলো আর মান্ধাতার আমলের PWD বাংলো চুপটি করে বসে আছে।

    সন্ধে ছ-টা -

    শেষ বিকেলে পায়ে পায়ে আনন্দের সন্ধানে PWD-র বুড়ো বাংলোর চত্বরে। জিম করবেটের ছোঁয়ামাখা এই বাংলোর সামনে বসে ফুলেদের সাক্ষী রেখে দেবসভাদর্শন। ডুব দেবার আগে সূর্যদেব জানান দিলেন, এবার ঘরে ফেরার পালা। ফেরার পথে কয়েকজন রামভক্ত দেখা দিয়ে গেলেন। তাঁদের ল্যাজের বহর দেখে অবাক মানতে হয়! ঠাণ্ডা দাদাগিরি ফলাতে শুরু করেছে - দশ ছুঁই ছুঁই।

    ২৫.১০.২০১০ - ভোর সাড়ে ছ-টা -

    দোর খুলতেই চাঁদমামা। এদিকে পুবের আকাশ লজ্জায় লাল। খানিকক্ষণ পর নন্দাদেবী কপালের প্রথম আলোর টিপ পরলেন - দেখাদেখি বাকি সকলে। দিগন্তজুড়ে এখন সাজবদলের পালা।

    সকাল সাতটা -

    পায়ে পায়ে পাথুরে পথে উঠে পাথরের মঞ্চ থেকে আরেকবার শৃঙ্গদর্শন।

    বেলা একটা -

    প্রমোদ-তরীতে সওয়ার হয়ে বনজঙ্গলের দঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পাখির কূজন আর ঝিঁঝির ভজন শুনতে শুনতে পাড়ি দিচ্ছি আলমোড়ার উদ্দেশে। সর্বক্ষণ আমাদের নজরে রেখেছেন নগাধিরাজ। শীতলায় এসে হিমবন্তের অবারিত রূপ দেখে চক্ষু শীতল হলো। শুধুই সুখ। দুঃখ এখানে লেপ মুড়ি দিয়েছে।

    দুঃখ খানিক আড়মোড়া ভাঙলো আলমোড়ায় (১৬৪৬ মি.) এসে। সামনে স্বর্গের সিঁড়ি ধাপে ধাপে উঠে গেছে আমাদের চাপে ফেলতে। চাপ সরলো বাংলোর বাগানে পৌঁছে। ফুলবাহারের রঙিন ছবি বলল, 'কষ্ট না করলে কি কেষ্ট মেলে?' গাছের আড়াল থেকে উঁকি মারছেন নন্দাদেবী, ত্রিশূল, নীলকণ্ঠ, চৌখাম্বা।

    'রাত' (সন্ধে) সাতটা -


    আলমোড়া


    আলমোড়া ভারি শহর। মানুষজনে, গাড়িতে বেশ ওজনদার। সরু সরু পথে কিলবিল করছে সব। ভাগ্যিস প্রমোদে ঢালিয়াছিনু মন, তাই বাঁচোয়া। শহর ছাড়িয়ে এমন জায়গায় এলাম, যেখান থেকে বেলাশেষের হোলিখেলার ছবি দেখে - হারিয়ে গেল মন। তারপর আঁধার ঘনাতে আকাশে তারা পাহাড়ে তারা - আলমোড়া যেন ঝকমকে নীহারিকা!

    ২৬.১০.২০১০ - সকাল সাড়ে ছ-টা-

    সূর্যের প্রথম কিরণে প্রথমে প্রসাধন সারলেন নন্দাদেবী, তারপর ত্রিশূলে সিঁদুর লেপন। তাই দেখে দূরে চৌখাম্বা আর নীলকণ্ঠ লজ্জায় লাল। শাখামৃগের দল মহাউত্তেজিত - পাখিরা জানান দিল - দিন আগত।

    বেলা এগারোটা -

    সাড়ে দশটায় আলমোড়া ত্যাগের আগে তার বিখ্যাত 'চকোলেট' আর 'বালমিঠাই' বাক্সবন্দী করা গেল। চিতইতে গোলুদেবতার মন্দিরের ঘন্টাবলী দেখে গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল। মন্দিরের সর্বাঙ্গে নামাবলীর মতো ঘন্টার ঘনঘটা। কত মানুষ যে ঘন্টার সঙ্গে আর্জি বেঁধে গেছে - অনেকে তো স্ট্যাম্প পেপারে! মানত পূর্ণ হলে আবার ঘন্টাদান। সারা ভারত থেকে আর্জি এসেছে - না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না!

    বেলা সাড়ে বারোটা -

    লাখুডিয়ার। নিস্তব্ধ বিস্তৃত প্রকৃতি পাহাড়ের পাহারায় ধ্যানমগ্ন। তারই মাঝে প্রাগৈতিহাসিক মানুষদের শিল্পকীর্তি - গুহাচিত্র। যদিও জায়গাটাকে গুহা না বলে Rock shelter বলাই উচিত। মুহূর্তে হাজার হাজার বছর পিছিয়ে গেলাম। বর্তমানকালে ফিরে আবার অগ্রগতি। বন ফুঁড়ে বনের মাঝে ১৮৭০ মি. উঁচু যাগেশ্বর বা জাগেশ্বর। দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের অন্যতম শঙ্করাচার্য প্রতিষ্ঠিত এই মন্দিররাজি দেবদারুবনে ঘেরা। এর নির্জনতা (যদিও মোটেই জনহীন নয়) বর্ণনাতীত। শান্তি জাগেশ্বরের মূল সম্পদ। ৭ম থেকে ৯ম শতাব্দীতে তৈরি এই মন্দিরগুলোর মধ্যমণি স্বয়ং জাগেশ্বর। জাগেশ্বরের জ্যোতির্লিঙ্গ রুদ্রাক্ষের আকারে অর্ধনারীশ্বর। নাগর শৈলীর অপূর্ব নিদর্শন এই মন্দিরগুলো। তাদের ঘিরে আকাশছোঁয়া দেবদারুবন। পাখপাখালি, জন্তুজানোয়ারের অবাধ বিচরণস্থল। পূজারীরা পুণ্যার্থীদের বাঁধাগৎ শোনায় - ভগবানের মহিমা কীর্তন করে, কেউ পুজো দিলে পুজো করে, না-হলে বসে লুডো খেলে। তাদের মুখে তখন 'ছক্কা-পুট'য়ের বুলি।

    শেষবেলায় দেখে এলাম ১১শ শতাব্দীর 'দণ্ডেশ্বর' শিবের মন্দির। সন্ধ্যা নামতে জাগেশ্বর মন্দিরে শুরু হলো সন্ধ্যারতি। ঘন আঁধারের মাকে গর্ভগৃহে আলো, আরতির ছন্দ - অসাধারণ অনুভূতি।

    ২৭.১০.২০১০ - সকাল সাতটা -


    জাগেশ্বর


    তাপমাত্রা এখনও দশ ছুঁই ছুঁই। ভোরে তো নিঃশ্বাসের সঙ্গে বিনা সিগারেটে ধোঁয়া ছাড়া। ভোরের ঠাণ্ডা আর শিশিরমাখা জাগেশ্বর (যোগেশ্বর থেকে যাগেশ্বর হয়ে জাগেশ্বর) তার নিঃশব্দ রূপে মজালো। ছোট নদীর এক বাঁকে জাগেশ্বর মন্দির, পরের বাঁকে কুবের মন্দির। পাখিদের কাকলি ছাড়া শব্দ বলতে নদীর কলকলানি।

    সকাল আটটা -

    দেবদারুবনের মাথা পেরিয়ে সূর্যদেব তাঁর কিরণ দিয়ে মন্দিরচূড়ার কলস স্পর্শ করলেন। উষ্ণ পবিত্রতা ছড়িয়ে পড়ল সারা জাগেশ্বরে।

    বেলা সাড়ে দশটা -

    বিদায় বনমণ্ডিত জাগেশ্বর। এবার পাড়ি বনের গভীরে বিনসরে। দিনমণি তাঁর অভয়স্পর্শে জানিয়ে দিলেন - মা ভৈ। আলোছায়ার লুকোচুরির সঙ্গী হয়ে পাড়ি দিলাম নতুন পথে।

    বেলা সাড়ে বারোটা -

    পাহাড়ের গায়ে নিস্তব্ধ অরণ্য। করবেট ব্যাঘ্র উদ্যানের প্রবেশপথে মানানসই অফিসঘর। গাড়ির জন্য ২৫০ টাকা, আর মাথাপিছু ১৫০ টাকা সংরক্ষণ মূল্য দিয়ে উদ্যানপ্রবেশ। দু-চারটে বাঁকের পরেই আহ্বান জানালো গভীরগহন অরণ্য। সবুজের ঘনঘটার ফাঁকে ফাঁকে নীলাকাশ। সেখানে মেঘের ফাঁকে ফাঁকে তুষারশৃঙ্গদের উঁকিঝুঁকি।

    বেলা সোয়া একটা -


    বিনসর


    এঁকেবেঁকে চড়তে চড়তে, গাড়ির চাকার আর ঝিঁঝিঁর ডাকের শব্দ শুনতে শুনতে দেখলাম খানিক তফাতে ধ্যানমগ্ন বিনেশ্বর বা বিনসর মহাদেবের মন্দির। তাঁকে ঘিরে শ্রদ্ধাবনত গহীন অরণ্য। ২৪১২ মি. উঁচু বিনসর বাংলো আর চার কি. মি.।

    বেলা দেড়টা -

    বন ফুঁড়ে হঠাৎ উদয় বিনসরের KMVN-য়ের ট্যুরিস্ট রেস্টহাউসের। জঙ্গল এখানে খানিক থমকে তাকে জায়গা করে দিয়েছে। অতীতের ছোট কুটির আজ বিশাল প্রাসাদ। ওদিকে দিগন্তজুড়ে শৃঙ্গরাজি মেঘমুড়ি দিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। মাঝে মাঝে মেঘের লেপ সরে গেলে তাঁদের দর্শন হচ্ছে ।

    'রাত' সোয়া ছ-টা -


    মুক্তেশ্বরের ট্যুরিস্ট রেস্টহাউস


    ঘরের মাথাতেই বিশাল ভিউপয়েন্ট। শেষবেলায় মেঘের লেপ সরিয়ে একে একে প্রায় সবাই দেখা দিলেন। আর এতগুলো দুপেয়েকে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকতে দেখে লজ্জায় লাল হলেন। আকাশ তার নীল ওড়নাটা বদলে কালো আলোয়ানটা গায়ে দিতেই ডাকাতে ঠাণ্ডা রে রে করে ঝাঁপিয়ে পড়ে সকলকে ঘরে ঠেলে দিল। সংরক্ষিত অরণ্যে বিদ্যুতের প্রবেশ নিষেধ। নিষেধ বৃক্ষনিধনও। তাই সূর্যের থেকে ধার করা আলোয় ঘর আলোকিত।

    রাত সাড়ে সাতটা -

    বাইরের জমাট আঁধারে তাপমাত্রা সাড়ে সাতের নীচে। অখণ্ড নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে জানালার নিচ থেকে শেয়ালবাবাজি খোঁজ নিলেন, 'হুক্কা হুয়া, কেয়া হুয়া?'

    রাত আটটা -

    ভালুক সেজে ডিনার সেরে কুমায়ুনের বিখ্যাত চিতাবাঘের প্রতিমূর্তিকে বিদায় জানিয়ে আবার ঘরের আরামে।

    ২৮.১০.২০১০ - ভোর সাড়ে পাঁচটা -

    আঁধার আকাশে তারারা বিদায় জানাচ্ছে। তাপমাত্রা চারের ঘরে নিচে।

    ভোর সাড়ে ছ-টা -


    নন্দাঘুন্টি, ত্রিশূল


    হিমমাখা প্রকৃতির টানে টেরাসে। পুব আকাশের আলো আঁধার তাড়াতে ব্যস্ত। দিগন্তজুড়ে তুষারমৌলিরা ধ্যানমগ্ন। মেঘের দল সব নিচের অরণ্যে ঘুমে মগন। সেই অরণ্য আড়মোড়া ভাঙছে। পাখিদের কিচিমিচি তারই প্রমাণ। হঠাৎই বোধহয় আকাশের খেয়াল হলো, পঁয়ষট্টি জোড়া মানবচক্ষু তার আলস্য নির্লজ্জচোখে গিলছে। তাই লজ্জায় সে লাল হলো। সেই লালিমার প্রথম টিপ পড়লো নন্দাদেবীর কপালে, তারপর একে একে ত্রিশূল, পঞ্চচুলি, চৌখাম্বা, অন্নপূর্ণা, ধৌলাগিরি সকলেই সেই আলো গায়ে মেখে নিল। গোটা হিমালয়কে কে যেন সোনায় মুড়ে দিল। আমরা জনা ষাটেক নশ্বর মুগ্ধনয়নে সেই অবিনশ্বর দৃশ্য দেখতে লাগলাম। সোনা থেকে কমলা পেরিয়ে শ্বেতশুভ্র এই সাজবদল মানসপটে চিরস্থায়ী ছবি এঁকে দিল।

    সকাল আটটা -

    রামের অনুচরদের ব্রেকফাস্ট দেখে পেটবাবাজী জানান দিলেন, তাঁর বিদ্রোহ করার ক্ষণ এগিয়ে আসছে। হনুমানের ফলফুলমূল খাচ্ছে, প্রজাপতিরা ঝাঁকে ঝাঁকে ফুলের মধু খাচ্ছে - তাহলে আমরাই বা খাবো না কেন? অতএব কুইক মার্চ টু ডাইনিং রুম।

    বেলা একটা -

    বিনসরের বনাবাস ছেড়ে, বিনসর মহাদেবকে দূর থেকেই প্রণাম ঠুকে, কালচে সবুজে বনের ফাঁকে ফাঁকে হিমালয়ের রূপ আর পাহাড়ের গায়ে রোদ্দুরের সোনালী আলপনা দেখতে দেখতে এঁকে বেঁকে খানিকটা উঠে নেমে পৌঁছে গেলাম গান্ধীজির প্রিয় শৈলাবাস কৌশানিতে (১৮৯০ মি.) । হিমালয়ের অবারিত রূপ বোধহয় এখান থেকেই সবথেকে সুন্দর। জনপ্রিয় শৈলশহর হয়েও কৌশানি শান্ত, স্নিগ্ধ। প্রকৃতির রূপসুধা পান করাই এখানে মূল কাজ। মানুষ থেকে কুকুর, এখানে সবাই শান্ত।

    সন্ধ্যা ছ-টা -

    অনাসক্তি আশ্রমের চত্বর থেকে গান্ধীজিকে সাক্ষী রেখে, হিমালয়ের শেষবেলার হোলিখেলায় সামিল হলাম। একসময় প্রকৃতি ধীরে ধীরে সব রং মুছে নিল; তবু চোখের ভেতর হোলিখেলা চলতেই থাকল। সেই রং চোখে মেখে ফিরে এলাম আস্তানায়।

    ২৯.১০.২০১০ - বেলা দুটো -


    শীতলাক্ষেত


    কৌশানির শান্তি ছেড়ে নানান পাহাড়, জনপদ পেরিয়ে, প্রকৃতির রূপে মুগ্ধ হতে হতে এসে পড়লাম এক আরও শান্ত, শীতল জগতে - শীতলাক্ষেতে (১৮৫০ মি.)। আক্ষরিক অর্থেই নির্জন শীতলাক্ষেত বাংলো। ছোট্ট জনপদ থমকে থেমে গিয়েছে একটু নিচে। বনের আড়ালে উন্মুক্ত দিগন্তের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সুপ্রাচীন বনবাংলো, আর তার গা ঘেঁষে প্রাচীন পর্যটকাবাস, যাকে সামনে রেখে গড়ে উঠেছে তার নবীন বংশজ। আমার দেখা অন্যতম সুন্দর পর্যটক পান্থশালা। এখানে সঙ্গী শুধুই প্রকৃতি। এর পবিত্রতার ওপর নজর রেখে চলেছেন স্বয়ং হিমালয়।

    সন্ধ্যা ছ-টা -

    বিকেল থেকেই মেঘেরা হিমশৃঙ্গদের ঘেরাও করতে শুরু করেছে। তাতে অবশ্য শীতলাক্ষেতের সৌন্দর্য এতটুকু টসকায়নি। অরণ্যের সবুজ ঢেউ গিয়ে ঠেকেছে নগরাজের পায়ে।

    রাত সাড়ে সাতটা -

    আঁধারের মাঝে বাংলোর গুটিকতক আলো অদ্ভুত এক মায়াময় পরিবেশ তৈরি করেছে। শান্তি মনকে আরও শান্ত করেছে।

    ৩০.১০.২০১০ - ভোর সাড়ে ছ-টা -

    পাখিদের গানে ঘুম ভেঙেছে খানিক আগেই। এখন নিচে মেঘসমুদ্দুরে আবির গোলার খেলা চলছে, আর আকাশের মেঘে আগুন লেগেছে। তাঁর ছোঁয়া বনবাংলোর সবুজ চালে। দিনমণি তাঁর পবিত্র কিরণ দিয়ে ধুইয়ে দিচ্ছেন নীরব শীতলাক্ষেতকে।

    সকাল ন-টা -

    মেঘের চাদর ফুঁড়ে দেখা দিচ্ছেন তুষারমণ্ডিত রথী মহারথীরা। শীতলাক্ষেত এখন মুক্তো, পান্না আর নীলার জড়োয়া গয়না।

    বেলা সাড়ে বারোটা -

    পরম শান্তি থেকে এসে পড়েছি অস্থির অশান্তির আঁচে। শীতলাক্ষেত ছেড়ে নয়নমনোহর প্রকৃতির বুক চিরে এসেছি। পথে অবাক করা নির্জনতা আর নয়নসুখকর দৃশ্য নিয়ে ডেকেছিল মাঝখালি। সময় আর প্রস্তুতির অভাবে তার ডাকে সাড়া দেওয়া গেল না। এসে পড়লাম কালিকায়। বন ফুঁড়ে একটু চড়াই ভাঙলেই মা-কালীর অবস্থান।

    বেলা দেড়টা -

    বিখ্যাত গল্‌ফ কোর্সের সঙ্গে আলাপ করে রাণীক্ষেতকে চেটেপুটে এসে পড়েছি ঝুলাদেবীর মন্দিরে। এখানেও ঘন্টাপর্ব। যে বাঘের হাত থেকে ঝুলাদেবী স্থানীয় মানুষদের রক্ষা করেছিলেন, সে বেচারি এখন কাঠের পুতুল হয়ে এক কোণায়।

    বেলা দু-টো -

    এসে পড়লাম চিলিয়ানওলা (১৮২৯ মি.) - বাবা হ্যায়ড়াখানের আধুনিক মন্দিরের উলটোদিকে সুন্দর পর্যটকাবাস। উন্মুক্ত শিখররাজির সামনে ফুলের বাহার - চোখ জুড়িয়ে যায়। তবে, এখন শহর খুব দ্রুত ঢুকে পড়ছে চিলিয়ানওলার শান্ত গ্রাম্য অন্দরমহলে তার সমস্ত অশান্তি নিয়ে।

    সন্ধ্যা ছ-টা -

    মেঘবালিকারা বিকেলেই দস্যুরাণীর রূপ ধরে হিমাদ্রিকে কবজা করে ফেলল। শেষবেলার সমস্ত আবির তারাই মেখে নিল। তাই গৃহস্থ হওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় রইল না।

    ৩১.১০.২০১০ - সকাল আটটা -

    আজ স্বর্গ থেকে বিদায়।

    বেলা একটা -

    আর একবার নৈনিতাল ছুঁয়ে গহন প্রকৃতির মাঝে চন্দন সিংয়ের ঝুপড়ি হোটেলে মাংস ভাত - অপূর্ব!

    বেলা চারটে -

    কাঠগোদাম। প্রমোদ সঙ্গের অদ্য শেষ রজনী। এই স্মৃতি মুছবার নয়। কূর্মাচলে ক-দিন, চিরদিন মনে থাকবে।


    পাথারিয়া


    [শেষ]



    অলংকরণ (Artwork) : স্কেচঃ রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments