• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৪৮ | মে ২০১১ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • পৃথিবীর শেষ প্রান্তে : ছন্দা চট্টোপাধ্যায় বিউট্রা

    পাখিদের কথা বলতে গেলে প্রথমেই পেঙ্গুইনের নাম করতে হয়। নানা ধরনের পেঙ্গুইন আছে। সবাই কিন্তু দক্ষিণ মেরুর আশেপাশেই থাকে। উত্তর গোলার্ধে পেঙ্গুইন নেই।

    ড্রেক-প্যাসেজ পার হয়ে তৃতীয় দিন দুপুরে আমরা মহাদেশটির প্রথম সাক্ষাৎ পেলাম। সবাই খুব উত্তেজিত। জোডিয়াক-এ ওঠার আগেই জলের মধ্যে পেঙ্গুইনদের সাঁতরাতে দেখেছি। সবাই ফটাফট ছবি তুলছে। আগের দিনই জাহাজের পক্ষীবিদরা পেঙ্গুইন সম্বন্ধে লেকচার দিয়েছেন। আমাদের প্রথম পদার্পণ হল মহাদেশের উত্তর-পশ্চিম কোণে Shetland দ্বীপের দক্ষিণে Aicho নামে একটি ছোট্ট দ্বীপে, রীতি অনুযায়ী যার ঠিকানা ৬২ ডিগ্রি দক্ষিণ ও ৫৯ ডিগ্রি পশ্চিম।

    জোডিয়াক থেকে ডাঙায় নেমে দেখলাম বরফ বিশেষ নেই কিন্তু শ'খানেক পেঙ্গুইনের কোলাহলে কানে তালা লাগায়। এরা মানুষ দেখে ভয় পায় না। আমরা যখন গেছিলাম তখন এরা জোড়ায় জোড়ায় প্রেম করতে, বাসা বাঁধতে ও ডিম পাড়তে ব্যস্ত। তাই বাচ্চা পেঙ্গুইন দেখা হয়নি। এদের মধ্যে বেশিরভাগই দুটি জাতের--জেনটু ও চিন স্ট্র্যাপ। মাঝে মধ্যে অ্যাভেলা পেঙ্গুইনও দেখা যায়। জেনটুদের টুকটুকে লাল ঠোঁট এবং ডাকটা হেঁড়ে গলায় গাধার মতো। এদের আরেকটা নাম Jackass পেঙ্গুইন। চিনস্ট্র্যাপদের মাথায় কালো টুপি ও চিবুকের নীচে ফিতে দেওয়া। এরা তিন জাতি, ওজনে প্রায় ১০-১২ পাউণ্ড আর উচ্চতায় ২-৩ ফুট।

    সবথেকে বড় হলো Emperor পেঙ্গুইন। এরাই March of the penguin সিনেমায় অভিনয় করে খ্যাতিলাভ করেছে। এরা ওজনে ৪৫-৯০ পাউণ্ড আর লম্বায় ৪ থেকে ৫ ফুট। আমরা একটি অল্পবয়সী এমপেরর দেখেছিলাম। এদের বেশিরভাগই দেশের পূর্বপ্রান্তে থাকে।


    Gentoo দম্পতি

    অ্যান্টার্কটিকায় গাছপালা, খড়কুটো বা ঘাস না-থাকার দরুণ পেঙ্গুইনরা মাটিতেই বাসা বাঁধে। পুরুষ পাখিরা বেছে বেছে পাথরের নুড়ি মুখে করে নিয়ে আসে এবং একটা পছন্দসই জায়গায় সেগুলো জড়ো করে। মেয়ে পাখিরা আসে পর্যবেক্ষণ করতে। পছন্দ হলে দুজনে মিলে জোড় বাঁধে। মেয়েপাখিরা মাটিতেই সেই পাথরের ঢিবির ওপর ডিম পাড়ে। পুরুষ ও মেয়ে দুই-ই পালা করে তা দেয়।

    পেঙ্গুইন বরফ আর জল ভালোবাসে। হেলতে দুলতে গভীর বরফের মধ্যে এরা রাস্তা বানিয়ে নেয়। বরফের ঢাল বেয়ে নামার সময়ে এরা বুকে ভর দিয়ে স্লেড করে--অনেকটা বাচ্চাদের toboggan-এর মতোই। দেখতে খুব মজার।

    জলই পেঙ্গুইনদের সব থেকে স্বাভাবিক বাতাবরণ। তীরবেগে মাছের মতো ডুব-সাঁতার দেওয়া, বা ডলফিনের মতো জলে লাফ দেওয়া, এসবে এরা ওস্তাদ। মাছ ও কুচো-চিংড়ির মতো krill এদের প্রধান খাদ্য।


    "মাফিয়া পাখি" স্কুয়া


    অ্যান্টার্কটিকার দ্বীপগুলিতে পেঙ্গুইন ছাড়াও আরো পাখি দেখা যায়--টার্ন, নীল-চোখ পানকৌড়ি, sheathbill, স্কুয়া (skua) ইত্যাদিরা পেঙ্গুইন কলোনির আশেপাশে ওড়াউড়ি করে। স্কুয়ারা হলো 'মাফিয়া পাখি'। বিরাট চিলের মতো পাখিগুলি পেঙ্গুইন কলোনির ওপর যথেচ্ছ আক্রমণ চালায় ও অনায়াসে ডিম বা বাচ্চা চুরি করে পালায়। বেচারা পেঙ্গুইনরা ডাঙায় বসে চেঁচামেচি করে শুধু।

    অ্যান্টার্কটিকায় পেঙ্গুইন দেখার জন্য ট্যুরিস্টদের সংখ্যা ইদানীং বেশ বেড়েছে। ভয় ছিলো যে এতে হয়তো পেঙ্গুইনদের ক্ষতিই হবে। কিন্তু গবেষণা করে দেখা গেছে যে ফল হয়েছে ঠিক উলটো। পেঙ্গুইনদের সংখ্যা বেড়েছে বই কমেনি। বিশেষজ্ঞদের ধারণা স্কুয়ারা মানুষ দেখে ভয় পেয়ে পালায়, তাই পেঙ্গুইনরা ওদের হাত থেকে রক্ষা পায়। কিন্তু আমার মত এতে স্কুয়াদের নিশ্চয়ই ক্ষতি হচ্ছে। এ-সম্বন্ধে কিন্তু এখনো কোনো গবেষণা হয়নি।

    প্রাণভরে পেঙ্গুইনদের ছবি তুলে জাহাজে ফিরলাম। পরদিন আমাদের প্রথম আইসবার্গ দর্শন। এই অতিকায় বরফখণ্ডগুলি অ্যান্টার্কটিকার তীরভূমির খাঁজে খাঁজে শান্ত সমুদ্রের জলে ভেসে থাকে। অগুনতি হিমবাহ থেকে এদের জন্ম। ছোট্ট মুঠো সাইজ থেকে বহুতল অট্টালিকার মতো আয়তন এগুলির। আর তাদের গড়নই বা কতো অদ্ভুত রকমের। কোনোটা যেন পালতোলা নৌকা, কোনোটা গলাউঁচু রাজহাঁস বা পাখা-তোলা ময়ূর। বড়ো আইসবার্গগুলো বছরের পর বছর একই জায়গায় ভেসে থাকে। গ্রীষ্মে একটু যা গলে তা শীতে বাড়তি বরফ পড়ায় পুষিয়ে যায়। আইসবার্গের দশ-ভাগের নয়ভাগই জলের নীচে। পুরো সাইজটা কল্পনাও করা যায় না।


    কোনো কোনো আইসবার্গের ফাটলে হাওয়া ঢুকে অপূর্ব নীল রঙ..


    সমুদ্রের খাঁড়ির মধ্যে একেকটা জায়গায় যেন আইসবার্গের বাগান। ছোট্ট নৌকায় (kayak) বা জোডিয়াক-এ চড়ে এই বাগানে 'বেড়ানো' যায়। খুব কাছে গিয়ে এই দানবদের হাতে ছোঁয়া যায়। অ্যান্টার্কটিকার জলহাওয়া দূষণ-বিহীন। সমুদ্রের জল স্বচ্ছ ও বরফ একেবারে দুধ-সাদা। কোনো কোনো আইসবার্গের ফাটলে হাওয়া ঢুকে অপূর্ব নীল রঙ তৈরি করে। কোনো কোনো আইসবার্গ থেকে ঝোলে লম্বা icicle । আমরা 'বাগান' থেকে ছোটো ছোটো আইসবার্গের টুকরো নিয়ে আসতাম জাহাজে। সহস্র বছরের পুরোনো এই বরফ মিশিয়ে মার্গারিটায় চুমুক দেওয়া--বেশ রোমাঞ্চকর।


    লিওপার্ড সীলের বাচ্চা


    পাটাতনের মতো আইসবার্গের ওপর শুয়ে রোদ পোহায় নানা রকমের সীল। Wedell সীল ও Crabeater সীলরাই সংখ্যায় বেশি। এ-ছাড়াও আছে বিশালকায় Elephant সীল আর সরীসৃপের মতো লম্বা মাথার Leopard সীল। এরা সবাই পেঙ্গুইন খেতে ভালোবাসে। গ্রীষ্মের শুরুতে অনেকেই বাচ্চাদের জন্ম দিয়েছে। অনেক আইসবার্গের ওপর আমরা মা ও বাচ্চা সীলদের আরাম করতে দেখেছি। চার-পাঁচটা নৌকো ওদের ঘিরে ছবি তুলছে কিন্তু তাতে তাদের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। চোখ বুজে সমুদ্রের মৃদুমন্দ দুলুনিটা উপভোগ করছে।


    শিকারী তিমি, Orca


    সমুদ্রে সীল ছাড়াও আছে তিমি মাছ। ঋতু অনুযায়ী নানা ধরনের তিমি দেখা যায়। আমরা বেশিরভাগই দেখেছিলাম Humpback তিমি ও killer তিমি বা Orca. ক্রীলই এদের প্রধান খাদ্য। কিন্তু killer whale-রা পেঙ্গুইন শিকারেও ওস্তাদ। ১৮-১৯ শতকে অতিমাত্রায় শিকারের জন্য এদের সংখ্যা খুব কমে গিয়েছিলো। ইদানীং আন্তর্জাতিক চুক্তির দ্বারা এরা সংরক্ষিত।


    কায়াক-এ করে আইসবার্গ-বাগান ছুঁয়ে আসা যায়


    এভাবেই আমরা অ্যান্টার্কটিকার তীর ঘেঁষে চলেছি। ছোটোখাটো দ্বীপ, আইসবার্গ-উদ্যান ইত্যাদি দেখছি। কোনো কোনো জায়গায় সমুদ্রের জল জমে বরফ হয়ে আছে। কিন্তু গ্রীষ্মের সময় তার সম্ভাবনা কম। দুপুরবেলা, হাওয়া কম থাকলে, খটখটে রোদ্দুরে বেশ আরামই লাগে। একদিন তো আবহাওয়া এত সুন্দর ছিলো যে আমরা খোলা ডেক-এ পিকনিক করলাম। চারদিকে বিরাট আইসবার্গ, তার মাঝে আমরা বার-বি-কিউ করছি। বেশ মজার ব্যাপার।


    পোর্ট লকরয়


    একদিন দুপুরে আমরা পোর্ট লকরয় নামে একটি জায়গায় (ঠিকানাঃ ৬৪ ডিগ্রি দক্ষিণ, ৬৩ ডিগ্রি পশ্চিম) নোঙর ফেললাম। এটা একটা ব্রিটিশ কলোনি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ ও ফকল্যাণ্ডের যুদ্ধের সময় ব্যবহার করা হয়েছিলো। এখন দুটি ছোট্ট কুটিরে একটা পোস্ট-অফিস আর একটায় ছোট্ট একটি মিউজিয়াম। পোস্ট অফিস থেকে অ্যান্টার্কটিকা্র টিকিট মারা চিঠি পাঠানো যায় আপনার কোনো স্ট্যাম্প-কালেক্টর বন্ধু বা আত্মীয়কে খুশি করতে। মিউজিয়ামটায় আছে পুরোনো জমানার আবিষ্কারক ও অভিযাত্রীদের আসবাব, পোশাক, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি। কতো কষ্ট করে এরা শীত কাটাতো--আমাদের বিলাসবহুল জাহাজে বসে ভাবাও যায় না।


    ডিসেপশন আইল্যাণ্ড


    বরফ-জমা অ্যান্টার্কটিকাতেও যে জীবন্ত আগ্নেয়গিরি আছে তা হয়তো অনেকেই জানেন না। Deception Island (ঠিকানাঃ ৬২ ডিগ্রি দক্ষিণ, ৬০-ডিগ্রি পশ্চিম) এমনই একটি দ্বীপ। বাঁকা C-এর আকারের দ্বীপটি আসলে আগ্নেয়গিরির চূড়া। এবং ভেতরে সমুদ্রটি Calder-টিকে ভরে রেখেছে। আগ্নেয়গিরিটির সাম্প্রতিক বিস্ফোরণ হয়েছিলো ১৯৬৭ ও ১৯৬৯ সালে। তীরে চিলের একটি এবং একটি ব্রিটিশ ঘাঁটি পুড়ে ছাই করে দিয়েছিলো। এখনোও তীরে তাদের কঙ্কাল দেখা যায়। Caldera-র ভেতরে ঢুকে দ্বীপের তীরে নামা যায়। তটটি কালো বালিতে ভর্তি। এবং সারা জায়গা জুড়ে গরম ধোঁয়া ও গন্ধকের গন্ধ। সমুদ্রের জলও এখানে উষ্ণ, কিন্তু সেটা ওই ওপরের এক ইঞ্চি জলই। তার নীচের জল সেই বরফ-শীতল। আমাদের দলের কয়েকজন গরম জল ভেবে চান করতে নামলেন। পরমুহূর্তেই শীতের চোটে কাহিল। এইজন্যেই বোধহয় দ্বীপের নাম Deception!

    জাহাজে চড়ার আগেই আমাদের বলে দেওয়া হয়েছিলো যে আবহাওয়া অনুকূল থাকলে একদিন বরফের ওপর ক্যাম্পিং করতে পারি। হুজুগে পড়ে আমরা পনেরো-কুড়িজন নাম লেখালাম। সঙ্গে দুটি গাইড। আমাদের প্ল্যান শুনে অন্যান্য যাত্রীদের চোখ কপালে, "পাগল নাকি? এই ঠাণ্ডায় কেউ বাইরে রাত কাটায়?" শুনে একটু দমে গেলাম। হয়তো আরও একটু ভেবে দেখা উচিত ছিলো। ততক্ষণে গোছগাছ শুরু হয়ে গেছে। অ্যান্টার্কটিকায় আবহাওয়া মুহূর্তে মুহূর্তে বদলায়। একবার সুযোগ পেলে ছাড়া উচিত নয়।

    পোর্ট লকরয় থেকে মাইলখানেক দূরে শান্ত সমুদ্রের তীরে এক বিকেলে আমাদের ক্যাম্পগ্রাউণ্ড ঠিক হলো। দেখলাম অ্যান্টার্কটিকার ভাষায় অনুকূল আবহাওয়া বলতে বোঝায় তুষার-ঝড় বা blizzard না-হলেই হলো--কনকনে ঠাণ্ডা আর ছুরি-ধারালো হাওয়া এখানে জলভাত। বিকেলে খাওয়ার পর আমাদের প্রত্যেককে একটি স্লিপিং ব্যাগ, দুজনের ছোট্ট পাপ-টেন্ট ও একটি শাবল হাতে ধরিয়ে কুড়ি-ফুট গভীর বরফ ঢাকা একটি টিলায় নামিয়ে দিয়ে বললো "গুড নাইট"! দিনের আলো অবশ্য ছিলো রাত দুটো পর্যন্ত। কিন্তু গণ্ডমূর্খ আমি তো অবাক। আমি সত্যিই ভেবেছিলাম এরা সব টেন্ট খাটিয়ে বিছানা-টিছানা পেতে দেবে আর আমি আরাম করে অ্যান্টার্কটিকার নৈঃশব্দ উপভোগ করবো। কিন্তু কোথায় কি! মালপত্র সব টেনে হিঁচড়ে টিলার ওপর ওঠালাম। কিন্তু কোথায় টেন্ট খাটাতে হয় তার সম্বন্ধে আমার অভিজ্ঞতা খুবই কম। শেষবার টেন্ট পেতেছিলাম কুড়ি বছর আগে, গরমের আগে ব্লু-রিজ ক্যাম্পগ্রাউণ্ডে। তার সঙ্গে এর তুলনাই হয় না। ভাগ্যিস দলে কয়েকজন এক্সপার্ট ছিলো। তাদের উপদেশ ও সাহায্য না পেলে আমরা আনাড়িরা খুবই মুশকিলে পড়তাম।


    দক্ষিণ মেরুতে ক্যাম্পিং


    প্রথমে একটা সমতল জায়গা খুঁজে বার করলাম; তারপর শাবল ও পা দিয়ে ছ'ফুট মতো জায়গায় শক্ত বরফ পিটিয়ে আরো শক্ত করতে হলো। নইলে তাঁবুই ডুবে যাবে বরফে। তারপর তাঁবু খাটানো। খুঁটি তো একেবারেই বেকার। বরফে পোঁতাই যায় না। আশেপাশে জেনটু পেঙ্গুইনের দল আমাদের আবির্ভাবে হেঁড়ে গলায় কোরাস শুরু করে দিলো।

    তাঁবুর মেঝেতে একটা পাতলা ফোম রবারের টুকরো হলো বিছানা। তারই ওপর আমাদের polar স্লীপিং ব্যাগ, যা মাইনাস ৩০ ডিগ্রি পর্যন্ত ঠাণ্ডা ঠেকিয়ে রাখতে পারে।

    টেন্ট-এ দু'জনে চেপেচুপে শোয়া যায়। হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে বেরোতে হয়। একবার স্লীপিং-ব্যাগের জিপার বন্ধ করলে তবেই হাত-পা গরম হতে শুরু করে। ব্যাগটা খুবই আঁটোসাটো। চার-প্রস্থের তিনভাগ জামাকাপড় ছেড়ে তবেই না ঢোকা যায়। আমার আশা ছিলো অ্যান্টার্কটিকায় রাতের ছবি তুলবো। নিঃশব্দ, তারাভর্তি আকাশ দেখবো। সে-সব গুড়ে বালি। বাইরে ফটফটে আলো, পেঙ্গুইনদের চেঁচামেচি--আর ঠাণ্ডার চোটে তাঁবু থেকে বেরোনোই মুশকিল।

    ক্যাম্পে খাবারের কোনো ব্যবস্থা ছিলো না। পরিবেশ দূষণ না করার জন্য কোনো স্ন্যাক্সও আনা বারণ ছিলো। আর বাথরুমের জন্য ছিলো একটা গর্ত-বসানো বাক্স। ব্যস! বাথরুমের চেহারা দেখে যাবার ইচ্ছাই উবে গেলো।

    রাত চারটে নাগাদ একটু তন্দ্রা এসেছিলো। ভেঙে গেলো জোর হাওয়ায়। বাইরে শোঁ শোঁ শব্দ, তাঁবুর কাপড় ফটাফট উড়ছে। খুঁটিগুলো তো একেবারেই উপড়ানো। আমরা শুয়ে না থাকলে পুরো তাঁবুটাই উড়ে যেতো। আবহাওয়া খারাপ হচ্ছে বলে আমাদের চটপট তাঁবু গুটিয়ে জাহাজে ফেরার নির্দেশ দেওয়া হলো। কিন্তু ওই ঠাণ্ডার মধ্যে হাত-পায়ের জড়তা ভেঙে বরফ-ঠাণ্ডা জামাজুতো পরা তারপর ঝোড়ো হাওয়ার মধ্যে তাঁবু গুটিয়ে প্যাক করা সহজ ব্যাপার নয়। তবু প্রাণের দায়ে পাঁচটার মধ্যেই জাহাজে ফিরলাম। তারপর গ্যালন-খানেক গরম কফি খেয়ে হাতেপায়ে সাড় ফিরে পেলাম।

    জাহাজে অন্যান্য যাত্রীরা আমাদের "বীরত্বে" মুগ্ধ! বীরত্ব কতোটা আর কতোটাই বা বোকামি জানি না তবে একশ' বছর আগে Shakleton আর Amundsen-এর সঙ্গীরা কীভাবে মাসের পর মাস এই বরফের রাজ্যে কাটিয়েছিলেন সেটা ভেবে অবাক না-হয়ে পারি না। তাঁদের তো এরকম তাঁবু, স্লীপিং-ব্যাগ বা সেল-ফোন সহ গাইড সঙ্গে ছিলো না। ছিলো না কোনো জাহাজ অদূরে অপেক্ষায়।

    সত্যি বলতে কি আমি খুশি যে আমি রাতটা কাটাতে পেরেছি। কিন্তু এটাও সত্যি যে সুযোগ পেলেও কক্ষনো আর বরফে ক্যাম্পিং করতে যাবো না। একবারই যথেষ্ট। এই বুড়ো বয়সে এসব আর পোষায় না।

    Deception দ্বীপটাই আমাদের শেষ স্টপ। আমি আর Caldera-র "গরম" জলে নামিনি। ভাবলাম কাজ নেই। ক্যাম্পিং করেই যথেষ্ট বীরত্ব দেখিয়েছি।

    এরপর ফেরার পালা। আবার ড্রেক-প্যাসেজ পার হওয়া। এবার আবহাওয়া ভালো বলে আমাদের ক্যাপ্টেন সমুদ্র থেকে কেপ হর্ন দেখালেন। মহাদেশের শেষ ভূমি। বিরাট কালো পাহাড় খাড়া উঠে গেছে সমুদ্র থেকে। কোনো বালুতট নেই। চারিদিকে শুধু উত্তাল ঢেউ ও হাওয়ার গর্জন। এমন দৃশ্যে সেকেলে পালতোলা নৌকার নাবিকদের কীরকম বুক কাঁপতো তা সহজেই আন্দাজ করা যায়। ওই পাহাড়ের কতো শত নৌকাডুবি হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। আমরা সাবধানে পাশ কাটিয়ে বীগল চ্যানেলে ঢুকলাম। সামনেই উশুহাইয়া।

    এবার ঘরে ফেরার পালা।



    অলংকরণ (Artwork) : ছবিঃ লেখক
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments