• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৪৯ | অক্টোবর ২০১১ | গল্প
    Share
  • কিন্নরী : আইভি চট্টোপাধ্যায়


    ‘কেঁন্দ পিয়াল শেষেঁই ভেল .. মহুল কুসুম কাটি লেল ..
    ফরেষ্টারে ফরেষ্টারে টাকাই দলান দেলে ..’

    পাহাড়ুর বাড়ির মাটির বারান্দায় বসে গান শুনছিল অভি। কথাগুলো ঠিক ধরতে না পারলেও কেমন একটা আবছা ছবি।

    ‘আকাশমনি সোনাঝুরি .. তর ল্যাগে গড় করি .. মরি গেলা ..
    মরি গেলা গে ধনী .. ছেড়ি কেরীঘাস .. সে তো মরি গেলা ..’

    জঙ্গলে নতুন গাছের নতুন আইন হয়েছে। ইউক্যালিপ্টাস আর সোনাঝুরি। সোনার গাছ। পাঁচবছরের মধ্যে সাইজ করে কেটে শহরের কাগজকলগুলোয় পাঠানো যায়। জঙ্গল-ব্যবসায়ীদের কাছে এ গাছগুলো ‘সোনার গাছ’। জঙ্গলের মানুষের কাছে এ গাছের কোনোই দাম নেই। এইসব গাছে মৌমাছি বসে না, পাখি বাসা বাঁধে না, পাতাগুলো থেকে ভালো করে জ্বালানিও হয় না। দ্রুত বেড়ে ওঠা ইউক্যালিপ্টাস আর সোনাঝুরি আসলে মরুভূমির গাছ। সামান্য জল পেলেই শুষে নিয়ে বড় হয়ে ওঠে, মাটির সামান্যতম আর্দ্রতাও শুষে নেয় তারা। কাছাকাছি কোনো গাছ বাঁচে না। গাছের পায়ের কাছে ঘাসও জন্মায় না।

    শাল পিয়াল মহুয়া হরিতকী বহড়া আমলকি করঞ্জ নিম প্রায় শেষ। গাছ শুধু তো গাছ নয়, প্রকৃতির সন্তানরা এসব গাছ সঙ্গে নিয়েই বাঁচে। কত কাজে লাগে। খাবার দাবার থেকে পুজো-পার্বণ। ঘরের চাল ছাইতে, পোষাক হিসেবে কোমরে বাঁধতে, পাতা পেড়ে খেতে বসতে লাগে। লাগে অসুখ-বিসুখ ওষুধ-পালায়। শালপাতা, শালধুনো, শাল-দাঁতন, শাল-ফুল, শাল-ফল সবই নিত্য প্রয়োজনে লাগে। লাগে কেঁদুপাতা, কেঁদুফুল। গতকালই এ-নিয়ে আক্ষেপ শুনেছে অভি। সব আক্ষেপ, সব না-পাওয়া গানের কথায়। এখানে গান মানেই প্রাণের আকুতি। শুনতে শুনতে এমনটাই মনে হচ্ছে অভির।


    প্রিয়রঞ্জনদা একটা জায়গা খুঁজছিলেন। আদিবাসী গ্রাম। জঙ্গল। একটা জংলা নদী পেলে মন্দ হয় না। নিদেনপক্ষে ঝরনা। শালগাছ। পলাশ ফুল।

    বেশ কয়েকটা ছবি হয়েছে শহুরে জীবন নিয়ে, সামাজিক সমস্যা নিয়ে -- বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। মূলত নারীকেন্দ্রিক ছবি তৈরি করেন প্রিয়দা, মহিলাকুলের প্রিয় পরিচালক। চমৎকার সেসব ছবির সঙ্গে একাত্মবোধ করে পুরুষও। প্রিয়রঞ্জন লোকরঞ্জন জিনিসটা ভালই বোঝেন। নিন্দুকেরা অবশ্য নানা কথা বলে। শহুরে সমস্যা মানেই দাম্পত্য সমস্যা কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। আর দাম্পত্য সমস্যা মানেই কিছু পরকীয়া ব্যাপার স্যাপার। রগরগে শারীরিক দৃশ্য। বাঙালির নিন্দুক স্বভাব। একদিকে নিন্দে করবে, আবার তারাই ডিভিডি চালিয়ে সে দৃশ্যগুলো বারবার দেখবে। নিন্দুকের মুখে কালি দিয়ে প্রিয়রঞ্জনের সব ছবিগুলোই হিট ছবি।

    ইদানিং ওঁর ছবিতে কাজ করার জন্যে বলিউড তারকারাও উৎসাহ দেখাচ্ছেন। প্রিয়রঞ্জনের শেষ পাঁচখানা ছবিতে মুম্বই থেকে নায়ক নায়িকা এসে কাজ করে গেছেন। প্রিয়রঞ্জনদার ছবি মানেই ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড, দেশ বিদেশে আলোচনা, সেমিনার। শেষের ছবিটায় নগর-নন্দিনী নারীর যন্ত্রণার সঙ্গে নর্মদা-আন্দোলনের মিশেল দিয়ে পেশাদারিত্বে বাজিমাত করেছেন প্রিয়রঞ্জন। ছবিটা শিল্পমহলে রীতিমতো ঝড় তুলেছে। পত্র পত্রিকায় সমালোচকদের ক্রিটিকাল রিভিউ। টিভির চ্যানেলে চ্যানেলে বিশেষ আলোচনা-সভা। ইন্টারনেটে ব্লগের পর ব্লগ।

    প্রোডিউসার খুশ। দিলদরিয়া হয়ে বলে দিয়েছেন আগামী ছবি নিয়ে প্রিয়রঞ্জনের কথাই শেষ কথা। তিনি যা চাইবেন তাই হবে।


    এদিকে একটা কাণ্ড ঘটে গেছে। সেলিব্রিটি হবার দায় কম নয়। মানুষের হয়ে কথা বলার জন্যে ডাক পড়ছে মাঝে মাঝেই। নানান মিছিলে হাঁটতে হচ্ছে। টিভির ক্যামেরার সামনে স্পষ্ট কথা বলার দায় নিতে হচ্ছে। প্রগতিশীল তকমা ছাড়া এ লাইনে টিকে থাকা মুশকিল। দলিত আদিবাসী সমাজের হয়ে কথা বলতে গিয়ে এই আইডিয়াটা মাথায় এসেছিল। আর নগরকেন্দ্রিক ছবি নয়, প্রিয়রঞ্জন এবার আদিবাসী-জীবন নিয়ে ছবি করবেন। সেই ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র পর আর বলার মতো জঙ্গলের ছবি কই! সে ছবির পরিচালকও তো নতুন আইডিয়া নয়, পুরোনো ছবিরই সীকু্য়েল করলেন।

    নাহ, নতুন একটা জঙ্গলের ছবি করতেই হচ্ছে।

    শুনেই প্রোডিউসার ‘কেয়া বাৎ’ বলে লাফিয়ে উঠেছেন। নদীতে স্নান সেরে জঙ্গলে ঢুকে পড়ছে আদিবাসী যুবতী, এমন একখানা মন্দাক্রান্তা আকর্ষণ রাখতেই হবে, বলে দিয়েছেন। সুপারমডেল বঙ্গতনয়া, অধুনা বলিউডের প্রথম সারির তারকার সঙ্গে কথা হয়ে গেছে। প্রিয়রঞ্জনদার ছবিতে এমন একখানা ভূমিকা পেয়ে তিনিও উৎসাহী, এপ্রিলমাস থেকে টানা ডেট দিয়ে দিয়েছেন।

    মনের মতো একটা জঙ্গল পেলেই হয়।

    প্রদীপদা এ জায়গাটার কথা বলেছিলেন। গ্রাম ঘিরে ত্রিয়াং নদী। পাহাড় জঙ্গল জংলী-নদী জংলী-গ্রাম সবই আছে। উপরি পাওনা হল, এপ্রিলের এ সময় হাতিরা মাঝে মাঝেই নুন চাটতে আসে। রিয়েল জংলী হাতির ছবি পেয়ে গেলে দারুণ ব্যাপার হবে।


    অভিকে খবর দিয়েছেন প্রিয়রঞ্জন। ক্যামেরার কাজে টলিউডে অভির জুড়ি নেই। ছেলেটা সিরিয়াস নয়। তেমন সিরিয়াস হলে সারা ভারতে ওর নাম ছাড়িয়ে পড়তই, ভারত ছাড়িয়ে বিশ্বে নাম ছড়ালেও অবাক হবার কিছু নেই। এমন বিশ্বাস করেন শিল্পরসিকরা সবাই। অভিকে নিয়েই চিন্তা ছিল। এমনিতে প্রিয়দাকে অভি খুবই শ্রদ্ধা করে, প্রিয়দা ডাকলে শত ব্যস্ততার মধ্যেও সময় বার করে নেবেই। তবু .. অভির মধ্যে একটা যাযাবর মন আছে। চাইলেই নাগাল পাওয়া যায় না। জীবনশিল্পী প্রিয়রঞ্জন অভিকে বোঝেন। প্রশ্রয়ও দেন।

    দু’ তিন দফায় লোকেশন দেখে গেছে ইউনিটের লোকজন। অভিও একবার এসেছিল। একদিন থেকেই চলে যেতে হয়েছিল সেবার। ‘সেরা সুন্দরী’ প্রতিযোগিতাটা চলছিল তখন।

    এবার টানা কাজ হবে। বারোদিন ধরে। সবাই এসে পড়েছে।

    ডাকবাংলোটা দারুণ। সিমলিপাল অরণ্যের চাহলা রেস্টহাউস। সারাদিন কাজ। সারারাত হুল্লোড়। খুব জমেছে। ঘরে ঘরে আসর বসেছে। আপেল কমলালেবু-- এই এপ্রিলমাসের গরমে এত আপেল কমলালেবু কোথা থেকে জোগাড় হল কে জানে। কাজুবাদাম, চিকেন-পকোড়া, ডিমসেদ্ধ। শ্রমণার গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত। সুনন্দর গলায় ‘চন্দ্রবিন্দু’। প্রিয়দার একজন বন্ধু এসেছেন সঙ্গে, কাজলদা। কাজলদার উদাত্ত গলায় সুফী বাউল লোকগীতি। মাতোয়ারা ডাকবাংলো।

    এ বাংলোয় বিদ্যুৎ নেই। কেরোসিন, লন্ঠন। জঙ্গল এখানে আদিম। সহজ কিন্তু রহস্যময়। এবং এখন রাত। রাতের বেলায় আলো থাকার কথাই নয়। বিদ্যুৎ দিয়ে হবেটা কি!

    তা বললে চলে?

    বলিউডের নায়িকা, প্রিয়রঞ্জনের মতো চিত্র পরিচালক্‌, সঙ্গে এত নামী মানুষ, মিডিয়ার লোকজন -- স্বয়ং জেলাশাসক এসে ঘুরে গেছেন একদিন। বনবিভাগের কর্তাব্যক্তিদের বারম্বার আগমনে জঙ্গল রাজকীয় মযার্দায় প্রতিষ্ঠিত, সামান্য অস্থায়ী বিদ্যুতের ব্যবস্থা হবে না? এখানে অবশ্য লারেলাপ্পা গান বাজছে না। প্রিয়দার নিজস্ব মিউজিক সিস্টেমের গমগমে আওয়াজ, রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর, লোকগীতি পল্লীগীতির অসামান্য কালেকশন আছে ওঁর। সেইসব মাতাল করা সুরে জঙ্গল আচ্ছন্ন।


    ক’দিন অভিও খুব হুল্লোড় করেছে। একটা জরুরী কাজ সারতে কলকাতা যেতে হয়েছিল, সহকারির ওপর কাজ ছেড়ে গিয়েছিল, কাজ সেরে আজ ফিরছে আবার। সবেমাত্র অন্ধকার বনপথে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার রাস্তা পেরিয়ে যোশিপুর থেকে চাহলায় এসে পৌঁছেছে অভি।

    অন্ধকার জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এই পথ অতিক্রম, অভির জীবনে প্রথম। একলা এতখানি যেতে হবে ভেবেই খারাপ লাগছিল। কিন্তু একলা না এলে এমন অনুভূতি হত না। প্রতিমূহুর্তে রহস্যের পরতের পর পরত খুলে যাবার অনুভূতি।

    অন্ধকার রাস্তা, অনবরত বাঁক, দু’পাশে নিবিড় গাছপালা-- ইনোভার সামনের সিটে বসে অভি। একটা গাছের ডাল থেকে ঝুলতে থাকা বিশাল সাপ, চমকে উঠেছিল। একজোড়া বনবিড়াল গাড়ির সামনে এসে থমকে দাঁড়ালো। জ্বলজ্বলে চোখ দেখে বুকের মধ্যে শিহরণ। বাঘ নয়ত! একটা সজারু কাঁটা নামিয়ে রাস্তা পেরিয়ে যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো। বোধহয় এত রাতে জঙ্গলের মধ্যে গাড়ি আশা করেনি।

    কোথাও বড় বড় ঘাস, মানুষ লুকিয়ে থাকতে পারে এমন বড়। বড় বড় নাম-না জানা পাতার গাছ, অনেকটা কলাগাছের মত দেখতে। বাঁশগাছের বুনো ঝোপ। অন্ধকার একটা একলা বাড়ি, আগে বোধহয় গ্রাম ছিল এখানে। ভেঙে পড়া মাটির দেয়াল, খোলা মাথার চাল .. কে জানে একদিন এখানে কে বাসা বেঁধেছিল।

    মাঝে মাঝেই ছোট ছোট গ্রাম পেরিয়ে এসেছে অভি। ঘুমন্ত গ্রাম। নিঃশব্দ নীরব অশরী্রী স্বপ্নিল আট-দশ ঘরের গ্রাম। ইনোভার উজ্জ্বল আলোয় উঠোনের গাঁদা। অন্ধকার মাটির দেয়ালে সাদা একটা শঙ্খ কিংবা তীরধনুকের ছবি। ঘুম-ঘুম অনুভূতি। ঘুম-ঘুম কিন্তু টানটান। কেমন একটা উত্তেজনা।


    ডাকবাংলোর কাছাকাছি এসে জোরালো ধাক্কা। এতক্ষণের নিঃশব্দ শান্ত মনের নিবিড়তায় জোরালো ধাক্কা।

    স্পটলাইটগুলো এমন করে লাগানো হয়েছে, জঙ্গলের মধ্যেও অনেকখানি আলোয় উজ্জ্বল।

    ডাকবাংলোর সামনের অনেকখানি জায়গা পরিষ্কার করা হয়েছে। বনফায়ার হবে আজ। তখন আলোগুলো নিভিয়ে দেওয়া হবে। আগুন জ্বালানো হবে, কাঠপাতা জড়ো করে রাখা হয়েছে ঠিক মধ্যিখানে। এদিকে মুরগির বার-বি-কিউ, সরঞ্জাম নিয়ে ব্যস্ত প্রিয়দা নিজেই। অভিকে দেখে চওড়া হাসলেন।

    রেলিঙে ভেজা কাপড়ের রঙিন আলপনা। প্রিয়দার ব্যক্তিগত সচিব মধুদি কাপড়্গুলো তুলে নিয়ে যাচ্ছিলেন-- ‘না না, থাকতে দাও, ছবি তোলা হবে, বেশ ন্যাচারাল লাগবে,’ বলতে বলতে এগিয়ে এলেন সুজিতদা। টলিউডের ব্যস্ততম তারকা। এ ছবির নায়ক। প্রিয়দার ছবি বলেই টানা বারোদিন এখানে এসে আছেন। সঙ্গে স্ত্রী, ওঁদের জন্যে সব আলাদা ব্যবস্থা হয়েছে। অভিকে দেখে হাত তুলে হাসলেন। এটাও বেশ। কলকাতায় ওঁকে এমন সহাস্য আন্তরিক দেখা যায় না।

    এখনও সবাই ফ্রেশ হয়ে এসে পড়তে পারেনি। সারাদিনের শুটিং ছিল, কম ধকল নয়। সুজিতদা কিন্তু নায়কোচিত অহং না রেখেই এসে বসে পড়লেন।

    ‘আসছি,’ অভিও হাত নাড়ল। জামাটা বদলে নিতে হবে।

    কাঠের বারান্দায় পা রাখতেই একটা মিশ্র গন্ধ। কড়া ধূপ, শ্যাম্পু আর লোশনের গন্ধ। নাক কুঁচকে উঠল। ‘মশার ধূপ, কি মশা দেখেছিস?’ মধুদি ঠিক খেয়াল করেছেন।

    জেলুসিল, অ্যাসপিরিন, ডেটল নিয়ে প্রায় ছুটে নায়িকার ঘরে ঢুকল একজন। ‘নতুন হেয়ার ড্রেসার এনেছে,’ মুচকি হাসলেন মধুদি। জামা বদলে ক্যামেরাটা গুছিয়ে রেখে বাইরে বেরিয়ে এল অভি।

    টেবল-সল্ট, গোলমরিচ-গুঁড়ো, চিনি, লেবু, ছোট চাকু, চামচ সাজিয়ে নিচ্ছেন লালাদা। টলিউডের খ্যাতনামা শিল্পী। এ ছবিতে বিশেষ একটি ভূমিকায় আছেন, নিপীড়িত শোষিত আদিবাসী সমাজের নেতা হয়ে উঠবেন গল্পে। প্রথমদিন মেক-আপ নিয়ে ক্যামেরার সামনে এলে অভি চমকে উঠেছিল। এমন নিপুণ সাজ আর নিপুণ অভিনয়, কে বলবে ইনি একজন মার-খাওয়া জঙ্গুলে মানুষ নন!

    পরিচিত দৃশ্য, পরিচিত গন্ধ, পরিচিত সব মানুষজন। তবু কেন কে জানে, এই সব গন্ধে এই সব দৃশ্যে অভির মনটা কুঁকড়ে উঠল।


    দীর্ঘ অরণ্যযাত্রায় মনের ভেতরে অনন্তযাত্রার প্রস্তুতি গড়ে উঠছিল, মায়া মায়া নির্জনতায় নিজেকে ফিরে ফিরে দেখার অনুভূতি, নিঃসীম আকাশে জীবন-অন্বেষণের প্রস্তুতি। কে যেন অভিকে সপাটে মাটিতে আছড়ে ফেলল। অন্তত এমনটাই মনে হল অভির।

    এপ্রিলমাসের জঙ্গল। গাড়িতে আসতে আসতে দেখেছে অভি, ঝোপঝাড় শুকিয়ে গিয়ে পাতা ঝরে গিয়ে মাঝে মাঝেই জঙ্গলে অনেকখানি করে খোলা জায়গা। কেমন অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে এখন, যেন অনেকদূর থেকে বুনোরা এই সব নজর করে ফেলছে। এই উজ্জ্বল আলো, এই হুল্লোড়্‌, সব দেখে ফেলছে তারা। এই হুল্লোড়, এই পিকনিক-- মানাচ্ছে না। এক্কেবারে মানাচ্ছে না।


    একটু পরে বনফায়ারের আসরে আবার সেই অনুভূতি।

    বনফায়ার খুব জমেছে আজ। লীনাদি, এক সময়ের সেরা নায়িকা, এ-ছবিতে পাহাড়ি বৃদ্ধার ভূমিকায় অভিনয় করছেন, যাঁর একমাত্র ছেলে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের শিকার হবে। সেই লীনাদি পুরোনো ইংরেজি সব গান, কবেকার শোনা ফ্রাঙ্ক সিনাট্রা-জিম রিভস-ক্লিফ রিচার্ড-নীল ডায়মণ্ড শোনালেন। গমগম করে উঠল চারধার। পুরুষদের ঠোঁটে সিগারেট, হাতে রাম-হুইস্কি-ভদকা, প্রোডিউসার আজ খুশ মেজাজ; মাথা দুলিয়ে পায়ে তাল দিয়ে সঙ্গীত উপভোগ করলেন। জিন আর লাইম মেশানো তরল পানীয়ের পাতলা গ্লাস, মেয়েরাও মাথা দোলালেন।

    জীবনানন্দ থেকে আবৃত্তি করলেন শিবাশিসদা, এ ছবির সহযোগী চিত্রনাট্যকার। মল্লিকা সেনগুপ্তের কবিতায় মধুদি, মন্দাক্রান্তার কবিতায় লীনাদি। বলিউডের বঙ্গতনয়া, ছবির নায়িকা বিদিশার গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত। ‘বঁধূ কোন আলো’। সুজিতদার স্ত্রী হ্যাণ্ডিক্যামে সে সুর আর ছবি বন্দী করলেন। বিদিশার রবীন্দ্রসঙ্গীত এই প্রথম শুনল সবাই। প্রিয়দার ছায়াসঙ্গী রাহুল, নামী সিনেমাপত্রিকার রাহুল, খুশি এবং তৃপ্ত। একখানা নতুন খবর হবে।

    দারুণ জমেছে আজ।

    ডাকবাংলোর সিঁড়ির পাশে, ঘাসের মাটিতে বসে আছে একটি বুনো লোক। হাতে একটা বাদ্যযন্ত্র, কি জিনিস বুঝতে পারল না অভি। বুনো লোকটিও গানের তালে মাথা দোলাচ্ছে।


    প্রিয়দার ছবিতে সঙ্গীতের ভূমিকা কম। গাছের ডাল ধরে, হাওয়ায় গাড়ি চালিয়ে, দু’চারটে বিদেশি লোকেশনে গানের দৃশ্য প্রিয়দার ছবিতে থাকে না। সাধারণত একটা ব্যাকগ্রাউণ্ড মিউজিক থাকে সারা ছবি জুড়ে। আবছা মৃদু কিন্তু অদ্ভুত আমেজ, উচ্চকিত ঘোষণা নেই, কিন্তু ছবি শেষ হলেও দর্শক শ্রোতা সে সুর বুকের মধ্যে নিয়ে বাড়ি ফেরে।

    এসব নিয়ে প্রিয়দা এমন পারফেকশনিস্ট যে, এ ছবির সঙ্গীত পরিচালক অনুপমদা নিজে লোকেশনে এসেছেন আরো পাঁচদিন আগে। প্রিয়দার ছবিতে গান থাকে না। এবারও তাই ঠিক ছিল। জঙ্গলের পটভূমিতে জঙ্গলের নানা শব্দ থাকবে শুধু। এইরকমই ঠিক ছিল। অনুপমদা জঙ্গলের শব্দ, জঙ্গলের পাখির ডাক, নদীর সুর, বাতাসের গান, মাদলের শব্দ--সব টেপবন্দী করে নিয়ে যাবেন।

    কিন্তু এখানে এসে একটা বদল হয়েছে। ব্যতিক্রম হিসেবে এ ছবিতে একটা গান রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এখানের লোকেদের গান শুনে অনুপমদার মনে হয়েছে এমন। প্রিয়রঞ্জন একমত হয়েছেন। জঙ্গলের ছবি, আর মেঠো সুরের গান থাকবে না? তাছাড়া লোকসঙ্গীতটা লোকে ভালো খায়।

    বুনো গায়ক অনুপমদার সংগ্রহ। এ সন্ধের আসরে প্রধান গায়ক।


    ‘ই ডুংরী উ ডুংরী .. পিয়াল প্যাকেছে ..
    বেধুয়া শালা খ্যালভরা .. হামকে ভেলকাছে ..’

    শব্দের মানে বোঝা না গেলেও মাতাল করা মেঠোসুর। বুনো গায়কের গানে সবার মনে দোলা। পরপর চারটে গান গাইল লোকটি।

    ‘আমিও একটা ঝুমুর গা্‌ই,’ খোলা গলায় গান ধরেছেন পরমাদি। সহনায়ক দীপাঞ্জনের স্ত্রী, বিশিষ্ট পল্লীগীতি শিল্পীর ছাত্রী হিসেবে পরিচিত। নিজেরও ক’খানা ক্যাসেট সিডি বার হয়েছে, উঠতি সেলিব্রিটি বলাই যায়।

    পরমাদির গান শেষ হতেই ‘হিথায় তুকে মানাইছে না রে .. ইক্কেবারে মানাইছে না রে,’ খোলা গলায় গেয়ে উঠেছেন অনুপমদা। তারপর একের পর এক লোকসঙ্গীত। পুরুলিয়া বাঁকুড়া বীরভূম ছোটনাগপুর ঝাড়খণ্ডী লোকসঙ্গীত।

    বুনো মানুষটি নিঃশব্দে গান শুনছে। এ আসরে বড্ড বেমানান লাগছে ওকে। বিদিশা দু’তিনবার অস্বস্তি নিয়ে তাকালেন। প্রিয়দা কাছে এসে দাঁড়ালেন। বুনো লোকটির দিকে তাকালেন তারপর।

    প্রোডিউসার এই মুহুর্তে বেশ মাতাল হয়েছেন, বেশ দিলদরিয়াও হয়ে পড়েছেন। ‘এবার তুমি মানে মানে কেটে পড়ো’ ভঙ্গিতে একখানা একশো টাকার নোট বাড়িয়ে ধরলেন।

    ‘কাল সকালে আমার সঙ্গে দেখা কোরো,' প্রিয়দাও একশো টাকা দিলেন।

    ‘তোমার ওই ছেলেদুটোকেও কাল নিয়ে এসো’, অনুপমদা একটা সিগারেট বাড়িয়ে দিলেন।

    সিগারেট নিল না লোকটা। বোধহয় আসর ছেড়ে যাবার ইচ্ছে ছিল না, অনিচ্ছুক পায়ে এগিয়ে গেল জঙ্গলের দিকে। কি হল অভির কে জানে, সিগারেটের প্যাকেটটা তুলে নিয়ে সঙ্গী হল।


    ‘এই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাবে এখন? এই অন্ধকারে? কতদূরে তোমার গ্রাম?’

    মানুষটা ঘুরে দাঁড়িয়ে আপাদমস্তক দেখল অভিকে। তারপর একটা অদ্ভুত কথা বলল, ‘উয়ারা টুসুকে ‘ছুঁড়ি’ বললেক, কুথায় পেল ই গানের কথা?’

    কি যে বলল, অভি প্রথমটা বুঝে উঠতেই পারেনি। বেশ ক্ষোভের গলায় এল পরের কথাটা, ‘আমি কি উটা ঝুমুর গাইলি? উ দিদিটো ঝুমুর বললেক! কেউ কিছু বললেক নাই! উটা তো ট্যাঁড়ঁগীতি। তারপর আবার উ বাবু গানে গানে টুসুকে ছুঁড়ি বললেক! আমাকে ভাগায়ে দিলেন সব্বে মিলে, আমিও কিছু বলতে পারলাম নাই।’

    কপালে হাত ঠেকালো, ‘টুসু মোদের দেবী বটেক।’

    ক্ষোভের কারণটা খানিক স্পষ্ট এবার। ও যে গান গেয়েছিল, সেটা ঝুমুর নয়। ট্যাড়ঁগীত। জঙ্গলে না এলে অভিই কি জানতে পারত, ঝুমুর আর ট্যাড়ঁগীত কোথায় আলাদা?

    ‘দিদিমণি যিটা গাইল, উটাও ঝুমুর লয়। উ লকগুলা মিছা সুরে মিছা গান বলছে।’


    তারপর ক’দিন ধরেই ক্ষোভের কথাগুলো আরো স্পষ্ট হচ্ছে।

    নাম পাহাড়ু। পাহাড়ু কুইরি। ঝিঙাফুল, জিংলাফুল, টুসুমেলা, কোঁচাঘাট সব চেনে। আর গান গায়।

    ‘রঙ্কন থানে ফি বছর মুরগা বলি দিছি, ইকবার পাঁঠাবলিও দিছি। কনদিকেই পুজার কমতি নাই, কন দেবতার অপমান করি নাই। তবু পাপ লাগে ক্যানো?’

    অসহায় গলায় প্রশ্ন করেছে পাহাড়ু। বড়রা গান বেঁধেছে বছরের পর বছর। শানথাল যুবকরা দাপটে সে গান গাইলে ওঁরাও যুবতীদের না-বুঝ বুকও আনন্দে রিমঝিম বাজে। বনজঙ্গল মাতাল হয় সুরের সে উৎসবে। তবু কেন শহরের বাবুরা বোঝে না?

    আগের বছরও এক বাবু এসে টেপবন্দী করে নিয়ে গেছে পাহাড়ুর গান। সিংবোঙ্গা জানে, সে গান নিয়ে সে বাবু কি করল।

    লক্ষ্মণদাস কুইরি নিজের টাকায় নিজের গানের বই ছাপিয়ে হিরগুনাথের মেলায় বিলি করেছিল। সেই গান রেডিওতে শুনেছে সবাই। লক্ষ্মণদাস সিংবোঙ্গার কসম খেয়ে বলেছে, সে গান বিক্রি করেনি। তাহলে ‘শহরের লক সি গান পেল কুথায়?’

    সবাই শুনেছে রেডিওতে, ভুল কথা ভুল সুর্‌, জগঝম্প বাজনা্‌, মাদলের জায়গায় ধামসা, কেঁদ্রির জায়গায় একতারা্‌, সানাইয়ের জায়গায় বাঁশি-- যেখানে সেখানে বাঁশির সুর, পাপ নয়? ‘গান তো পুজা, লয় বাবু?’ আকুতিভরা চোখ মেলে সরল প্রশ্ন তুলেছে পাহাড়ু। প্রশ্ন শুনে অভির বুকের মধ্যে কাঁপন। তাই তো। যে কোনো শিল্পই তাই। পুজো। সাধনা।

    ছবি তুলতে শেখা সুমনদার কাছে। নিঃশব্দে লোকচক্ষুর আড়ালে প্রচারবিমুখ সুমনদা ছবির কাজ করেন। হাতে ধরে জুম-লেন্সের ব্যবহার শিখিয়েছিলেন সুমনদা। ভালো ছবি তুললে এখনও সুমনদাকে দেখিয়ে আসে অভি। সুমনদা বলেন, ‘ছবি তোলার মূল কথা হল অনুভব করা। বুকের মধ্যে থেকে অনুভব করা। ছবি তোলা একটা সাধনা।’

    বলেন, ‘আমি ঈশ্বর মানি না। পুজো-আচ্ছায় বিশ্বাস নেই। আমার কাছে ছবি তোলাই পুজো, উপাসনা। সাধনা। মন শুদ্ধ না রাখলে, সরল মন না রাখতে পারলে সে সাধনা হয় না।’

    পাহাড়ু দুঃখ করে, ‘শহরের বাবুগুলা লোভ আনল। গাইয়েরা সব জঙ্গলের গাইড এখুন।’

    দেখছে অভিও। হপন ওঁরাও, রাধে হো, বালা কিস্কু। ইউনিটের গাইড। ওরা যেন চিরকালই বনের পথপ্রদর্শকের কাজই করে এসেছে। ওরা যে গায়ক ছিল, তা নিজেরাই মনে রেখেছে কিনা কে জানে।

    ‘উয়ারা আর গাইতে পারবেক নাই’, মাথা নেড়ে বলেছে হপনের বুড়ো খুড়া। রাধের ঠাকুর্দার চোখের জল গালের ওপর দিয়ে নেমে এসেছে, ‘উয়ারা লোভে পড়িছে।’

    সীতারাম বাগাল। রোজ শুকনো কাঠের যোগান দেয় বনফায়ারের জন্যে। দারুণ চিকেন-পকোড়া বানায়। সীতারাম নাকি ছৌ নাচিয়ে। সব ছৌনাচের দল ওকে বায়না করে। ‘কুথায় নিজে ইকটা ছো-লাচের দল করবি, না ইখানে মজুর খাটতে আলি?’ পাহাড়ু রাগ করেছে।


    একটা নারকোলের মালার ওপর টানটান এক টুকরো খরখরে চামড়া। লম্বা বাঁশ, একটামাত্র তার, বালামচির ছড়। প্রথমদিন এই যন্ত্রটাই পাহাড়ুর হাতে দেখেছিল অভি। কেঁদ্রি। তারের ওপর দিয়ে ছড় টানলো একবার, কোনো শব্দ হল না।

    ‘ই দ্যাখেন বাবু। মালার গায়ে গালা বটে, দুবার ছড় টানলে তবে আবাজ মিঠা হবেক।গুরু শিখাইছে।’ কেঁদ্রি তুলে মাথায় ঠেকালো পাহাড়ু। ‘ডর নাই। লে বাজান। তুমাকে শিখাবক, তু ভালমানুস বটে। আপনি দুদিনে শিখে যাবিস বাবু। লে ধর ..’ তুই-তুমি-আপনি মিলে অপরূপ ভাষা। বাজনার মতই মিষ্টি লাগল অভির।

    ধামসা। ধাম ধু দুম ধৈ। সানাই। পোঁ পোঁ পোঁ পোঁ। আর সেই সঙ্গে বুড়ো খুড়ার ডিং লা লা ডিং আওয়াজ। নেশা হয়ে গেল অভির।


    পনেরো ঘরের চোগরা গ্রাম। গভীর জঙ্গলের মধ্যে খানিকটা গাছপালা কেটে ঘর। একটা দায়সারা গোছের কুয়ো। সন্ধে হলেই ঝিঁ ঝিঁ, জোনাকি, ব্যাঙ। আর গা ছমছম অন্ধকার। বুনো পাখি, মেঠো ইঁদুর। বুনো পেঁপে, কুঁদ্রু, ঝিঙে, নেনুয়া। অল্প ধান।

    পাহাড়ুর সঙ্গে গ্রামে রোজ আসে অভি। গান শোনে। ঝুমুরগান, টুসুগান, ভাদুগান, করমাগান, সোহরাইগীতি, বাহাগীত, ট্যাঁড়গীত। আলাদা আলাদা করে শুনিয়েছে পাহাড়ুরা।

    শুনতে শুনতে বুঝেছে অভি, অনেক জনপ্রিয় লোকগীতি যেমন ‘ভ্রমর বসে কাঁচা বাঁশে’ বা ‘কইলকাতার বিটিছালা’ কিংবা ‘মদনা ছঁড়া ধমসা বাজাছে’ গানগুলো না টুসুগান, না ঝুমুরগান। জগাখিচুড়ি।

    গায়কী ঢং, উচ্চারণ, বিষয়বস্তুর গভীরতা কিছুই নেই সেসব গানে। লোকায়ত সংস্কৃতি থেকে বহুদূরে সংস্কৃতির ধার-করা কিউরিও হান্টিং করে চলেছে কিছু মানুষ। শহুরে সাংস্কৃতিক ভাইরাসে আক্রান্ত জঙ্গল ও জঙ্গলের সভ্যতা।


    গ্রামের মিউজিক টেক করতে একদিন অনুপমদাও এলেন। ধামসা, তুইলা, ভুয়াং, মাদল, কেঁদ্রি, সানাই -- যা যা সম্ভাব্য সব জোগাড় হল। সঙ্গে থাকবে একটি আদিবাসী যুবকের গান। কিন্তু পাহাড়ু কিছুতেই গাইতে রাজি হল না। সব গানের সঙ্গে সব যন্ত্র বাজানো চলে না।

    এদিকে ছবিতে একটাই গান। নানা আদিবাসী বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করে চমক দিতে চান অনুপমদা। প্রিয়দার মতও তাই। ‘তুমি নিজের গান গাও, মিউজিক কি হবে ভাবতে হবে না।’

    ‘স্টুডিওতে এর সঙ্গে আরো কত সুর যোগ হবে। কি একখানা গান দাঁড়াবে! বাংলা ছবির এ গান সারা দেশে রমরম করে চলবে। ওই ঝিঙ্কা লা লা গানটা যেমন।’

    আজকাল হিন্দী গান এদিকেও বেশ পপুলার হয়েছে। কালই হপনদের গলায় এ গান শুনেছেন সবাই। হিন্দীগানের মহিমা শুনেও ঘাড় নোয়ালো না পাহাড়ু।

    ‘কিছু না বুঝেই ছোঁড়া ঝামেলা করছে’, প্রোডিউসার বেশ বিরক্ত, ‘কত টাকা চায়, দ্যাখো। টাকায় দুনিয়া বশ। এই একখানা গান কতগুলো অ্যাওয়ার্ড আনবে, আমি এখন থেকেই দেখতে পাচ্ছি।’

    তবু পাহাড়ু গাইল না। গাইতে দিল না গ্রামের কোনো যুবককেও। ‘তাহলে একজন আদিবাসী যুবতী এক্সটেম্পো গেয়ে উঠুক’, প্রিয়দা ব্যাপারটা সাজাতে চাইলেন। রাজি হল না পাহাড়ু।

    একরোখা, জেদী, ভবিষ্যৎহীন পাহাড়ু।


    পাহাড়ি পথঘাট, সুন্দর শোভা, রাতের অচেনা আঁধার, নীল গোল আকাশ, নক্ষত্র-- সব রিয়েল ছবি তোলা হল। জংলী পোকামাকড়ের কিটকিট শব্দ, ঝিঁঝিঁর শব্দ, দোয়েল-কোকিলের মিষ্টি ডাক, ময়ূরের কর্কশ ডাক, শুকনো পাতার মর্মর, জঙ্গলের মধ্যে থেকে আসা কর্কশ আর্তনাদ, সব আওয়াজ টেপবন্দী হল। বুনোহাতি খেদানোর দৃশ্য, ক্যানেস্তারা বাজানো, গ্রামের রাস্তায় জল ভরতে যাওয়া যুবতী, লাঙল কাঁধে কালো শরীরের বৃদ্ধ কৃষক, ধুলোময়লায় ক্রীড়ারত কালো নগ্ন গ্রাম্য শিশু। টুকরো টুকরো রিয়েলিটি সব ক্যামেরাতে তুলে নেওয়া হল।

    কিন্তু একজন সাবলীল গায়ক পাওয়া গেল না।

    হাল ছেড়ে দেবার পাত্র প্রিয়রঞ্জন নন। একবার যখন মাথায় এসেছে, জঙ্গলের লোকসঙ্গীত থাকবেই। অনুপমদার ইচ্ছেয় শেষ পযর্ন্ত প্রিয়দা নিজেই গান গাইলেন। রীতিমতো চমক শিল্পদুনিয়ায়। গায়ক প্রিয়রঞ্জন এলেন, গাইলেন এবং জয় করলেন। কে জানে, বোকা পাহাড়ুর কানে সে গান পৌঁছল কিনা।

    আর একটা বড় বাধা এসেছিল। অভি মাঝপথে ছবির কাজ ছেড়ে দিয়েছিল। প্রিয়রঞ্জন শক্ত হাতে হাল ধরেছেন। ছবির কাজ সময়মতো শেষ হয়েছে। বেশ কিছুদিন ধরে নানা মিডিয়ায় প্রিয়রঞ্জন-অভিমন্যুর পেশাগত সম্পর্কের নিপুণ বিশ্লেষণ এ-ছবির প্রচারে সহায়ক হয়েছে। এবং ছবিটি আলোড়ন তুলেছে।

    অরণ্য নিয়ে এমন ছবি আগে হয়নি। সে কথা দেশে বিদেশে সবাই একবাক্যে স্বীকার করেছেন। সাতখানা ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড এসেছে। তার দুখানা গানের জন্যে। ছবির গানের জন্যে প্রিয়রঞ্জন শ্রেষ্ঠ শিল্পীর পুরষ্কার পেয়েছেন। অনুপমদা শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক। আঞ্চলিক ছবি বিভাগে এ বছর অস্কার নমিনেশনের জন্যে ছবিটা পাঠানোর কথা চলছে।

    যদিও অরণ্যপ্রেমী কিছু মানুষজন এটাকে জঙ্গলের ছবি বলে মানতে রাজি হননি। এ নাকি জঙ্গলের আসল ছবি নয়। তাঁরা বেশ হৈচৈ করার চেষ্টা করেছিলেন, ‘এভাবে জঙ্গলের ছবি দেখিয়ে প্রিয়রঞ্জন নিজের রাজনৈতিক মতবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন।' তাতে ছবিটার প্রচারে লাভই হয়েছে।

    অ্যাওয়ার্ড কমিটির বিচারক জুরি সদস্যরা প্রিয়রঞ্জনকে পছন্দ করেন। তাছাড়া প্রিয়রঞ্জনের মেয়েও এখন বলিউডের তারকা। সেই সুবাদেও বলিউডি মহলে স্বজন অনেক।

    ‘বিতর্কিত ছবি’ হিসেবে ছবিটি বাহবা পেয়েছে। এবং প্রিয়রঞ্জনের ছবি সবর্কালের সিনেমা-ইতিহাসে খবর হয়েছে।

    আরো একটা খবর হয়েছে।

    প্রখ্যাত সিনে-ফোটোগ্রাফার অভিমন্যু চৌধুরী সেরা ওয়াইল্ডলাইফ ফোটোগ্রাফার হিসেবে জাতীয় পুরষ্কার পেয়েছেন। খবর শুনে প্রিয়রঞ্জন খুব খুশি হয়েছেন। অভিমন্যুর এই অরণ্যপ্রেম যে তাঁর সেরা ছবিটির সূত্রেই সেকথা প্রতিটি টিভি চ্যানেলে এবং পত্র-পত্রিকায় কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেছেন।

    কিন্তু পুরষ্কার গ্রহণের জন্যে অভিমন্যুকে পাওয়া যায়নি। অভিমন্যু এখন মধ্যপ্রদেশের দণ্ডকারণ্যে উপজাতিদের মধ্যে বাস করছেন বলে খবর পাওয়া গেছে।


    মুখোমুখি দুই অরণ্য। বুনো পাখি ওড়ে। সবুজ টিয়ার ঝাঁক। কালো লোমশ ভালুক তাক বুঝে উড়ন্ত পাখি ধরে ফেলে। তাড়া খাওয়া হাতি গ্রামের মধ্যে দিয়ে দৌড়তে দৌড়তে চলে যাবার সময় উপড়ে নিয়ে যায় ঘরের চাল, আব্রু। হরিণ নিশ্চিন্ত মনে ঘাস পাতা খায়। অতর্কিতে তাকে ফালা ফালা করে শেষ করে একটি রক্তাক্ত ঢেকুর ওঠে।

    আরেক অরণ্যেও সব এলোমেলো। কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। অরণ্যের অনাহত পরিষ্কার রঙিন মায়া থেকে কেড়ে আনা হয় রহস্য, গান, ছবি। নুন চাটতে আসা জানোয়ারের উদগ্র টান। সংস্কৃতির ভাইরাস সেসব স্মৃতি থেকে ঝেড়ে ফেলে আদিম গন্ধ। শহুরে সভ্যতার কিউবিকলে জোছনা ধরা থাকে, ছবি হয়ে।

    রিয়েলিটি সবচেয়ে বড় পণ্য। অরণ্য অলঙ্কৃত কিন্নরী।





    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ অনন্যা দাশ ও রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments