|| ১ ||
সুপর্ণা এসে তাড়া দিয়ে গেল, কি সাতসকালে গান শুনছো বসে বসে? একবার পাতাগুলো সরিয়ে দাও না। নতুন বাড়িতে এসে তার এই এক বাতিক হয়েছে। লনে কুটোটিও পড়ে থাকতে পাবে না, উঠাও কি উঠাও। বেশ ছিল সুহাস, একটেরে এই স্টাডিরুমের একটি জানালা বাগানের দিকে, বাগানে আগের মালিকের বাচ্চাদের লাগানো ফিডার থেকে মাঝে মাঝে ছোট ছোট পাখিদের চি-কা-ডি-ই-ই-ই করে ডাক শোনা যাচ্ছে, বাড়িটা বিশ্ববিদ্যালয় পাড়ার লাগোয়া, বেশ পুরোনো। তারই আঙিনায় পুরোনো মেপল গাছ, এই শেষ সেপ্টেম্বরে পাতা ঝরিয়ে লালে লাল। বুড়ো গাছেরও তো ইচ্ছে যায়, পড়ে থাকা কমলা-উজ্জ্বল লাল শুকনো পাতার সঙ্গে দুদণ্ড স্মৃতি রোমন্থন করে নিতে। এমনিতেই তাদের স্টেট বিখ্যাত, এই হেমন্ত-বর্ণিমার জন্য, সারা দেশ জুড়ে নানা ভ্রমণ-সংস্থা বিজ্ঞাপন দিয়ে লোক ডেকে আনে, মেইন রাজ্যের ঝরাপাতার শোভা দেখাতে, প্রথমবার এরকম এক হৈমন্তী সেমেস্টারেই ভয়ে ভয়ে সুহাস এসে পৌঁছেছিল এখানে কারণ, স্কল, মানে স্কলারশিপ তখনো আংশিক।
প্রথম সেদিনও ইউনিভার্সিটি পাড়ার বাইরে একটা স্টোরে সে কিছু কিনতে ঢুকেছিল। বাইরে একটা ঝরঝরে (তখন সে কথা মনে হয় নি) ক্যাডিল্যাক গাড়ির থেকে "ঝরা পাতা গো, আমি তোমারি দলে" শুনে গাড়ির মালিকের সাথে আলাপ করবার জন্য সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিল, সেটা আজকের এই গানটাই। বাংলাদেশের আব্বাসদা তখন পোস্ট-ডক করছেন, আলাপ করতে সময় লাগল না, একই ডিপার্টমেন্ট, তাছাড়া গানের নামে দুজনেই পাগল।
সুহাস, আজ কুড়ি বছর পরেও একইভাবে শুনছিল, "ঝরা পাতা গো, আমি তোমারি দলে", তার প্লেয়ার তারপরেই শাফল করে চলে গেল "এ পরবাসে রবে কে"-তে। তা চলে তো গেছেন অনেকেই, আব্বাস দা গতবছর বুয়েট, বাংলাদেশ থেকে রিটায়ার করেছেন, অগোছালো মানুষ, না ওদেশে না এদেশে, কোথাও সুবিধে করতে পারেন নি, অথচ মেধায় তিনি কম ছিলেন না কারো চেয়ে। যে সময় তাঁর কাজের মধ্যগগন, তখনই সটকে পড়ার মত বাই যে তাঁর কেন চাপল...সুহাস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল নিজের মনেই। আব্বাসদা মেল করেন অবশ্য, বিজয়া দশমীতে, হোলিতে, সুহাসও চেষ্টা করে সাধ্যমত ঈদ, শবে বরাতে মেল করতে। তবে এসবে সে একটু ঢিলে। এনিয়ে সুপর্ণার সাথেও তার খটাখটি লাগে। আগের সুপর্ণাও কি একটু একটু করে পাল্টে গিয়েছে?
মেল বক্স খুলে টের পেল আজ বিজয়াদশমী। তাদের এখানকার উইক এন্ডের পুজো হবে আগামি সপ্তাহে। তার মানে কিছুক্ষণ পরেই মা ফোন করবে। বাড়ির প্রতিমার ভাসান হয়ে গেলে মা একবার পুঙ্ক্ষানুপুঙ্ক্ষ বিবরণ দিয়ে ফোন করে। হয়ত মা বলবে -বুঝলি, ভালোয় ভালোয় তো এবারও পার করে দিলাম, মা চলে গেলেন। তবে আর কদিন পারব জানি না। প্রতিদিন তিনঘন্টা করে ভোগের ঘরে থেকে পিঠ যেন ভেঙে যায়। তোরা এলে কত ভালো লাগত। ও বাড়ির হিস্যা জমজমাট, আর আমার সব থেকেও নেই।
ও-বাড়ি মানে ভাসুর, সুহাসের জ্যাঠামশাই। দুই মেয়ে, বিয়ে দিতে গিয়ে কলকাতার আগে তাকান নি। ছেলেটিও পড়ায় গ্রামের কাছেই কোনো স্কুলে। সবার বিয়ে থাওয়া হয়ে গেছে, নাতি-নাতনি নিয়ে জ্যাঠামশায়ের ভরাট সংসার। আর সুহাসরা দুই ভাই, তার দাদা বিয়ে করে নি। শরীকি বাড়ি, শরীকি পুজো বলেই কি মার চোখে তফাতটা বেশি করে ধরা পড়ে?
আবার লক্ষ্মীপূজার সন্ধ্যায় হয়ত মা বলবে, এবারো ভোগটা আমাকেই রাঁধতে হল, দিদির (তাঁর জা)শরীরটা নরম রয়েছে। দুলিদের বাড়ি থেকেও ভোগপ্রসাদ পাঠিয়েছিল, খাবার লোক তো দুটি মোটে। পাড়ায় সবার বাড়িতে প্রসাদ পাঠিয়ে দিলাম, এটসেটরা, এটসেটরা।
সুহাস সব শুনবে, হ্যাঁ-হুঁ করবে। তারপর বলবে, উপোস-টুপোস যাই কর, শরীরের দিকে নজর দিও, মা বলবে, আর শরীর, গেলেই হয়। বলেই বলবে, তেমন কিছু হলে তো আসতেও দুটো দিন। ঠেসটা গায়ে না মেখেই সুহাস বলবে, তেমন কিছু হবে না, ভাল থেকো, রোজ হাঁটতে যেও সকালে। সুহাস জানে, এখন দেশে রাত দশ সাড়ে দশ, দাদা মশারির মধ্যে এতক্ষণে, তাকে ডেকে আর লাভ নেই।
তাদের সকাল সবে হল, বাচ্চারা ঘুম থেকে এখনো ওঠেনি। সুহাস কথা বলতে বলতে আড়চোখে দেখে নেয় খাবার টেবলে লুচি আর আলুর দম সাজাচ্ছে সুপর্ণা, হ্যাম স্যান্ডউইচ, ফলের রস, সিরিয়াল আর ধুমসো টেট্রাপ্যাকের ঠান্ডা দুধের পরিবর্তে মাঝে মাঝে এইটুকু দেশি-পনা ভালোই লাগে তার। আজ একটু মুড়ি-গুড় খেলে কেমন হয়, ফ্রিজের হিমঘরে নিশ্চয় কিছু দেশ থেকে আনা খেজুর গুড় থাকবে, সুপর্ণাকে জিজ্ঞেস করবে কিনা ভাবে সুহাস।
|| ২ ||
"এ পরবাসে রবে কে " গানটির আগের এস্রাজের ছড় শুনলেই যেন তার মন এক লাফে তিরিশ বছর অতীতে পৌঁছে যায়। তাদের ভেতর-বাড়ির দোতলার ঘরে, মায়ের খাটে বসে মা আর সাবিত্রীমাসি গান শুনছে।
মালতী ঘোষালের সেই আদ্যিকালের ভিনাইল রেকর্ড সম্ভবতঃ তার মায়ের বিবাহের যৌতুক হিসাবে প্রথম এসেছিল তাদের বাড়িতে। সুহাস কল্পনা করতে পারে ১৯৬০ সালে দেবীপুর গ্রামের এক রক্ষণশীল পরিবারের ছোট বউয়ের বিবাহের যৌতুকে গান শোনার যন্ত্র আসা নিয়ে কিছুটা বউঝিদের মধ্যে বেশ খানিক কানাকানি-হাসাহাসি হয়ে থাকবে।
রেকর্ডের একপিঠে "এ পরবাসে রবে কে", অন্যপিঠে, "যদি এ আমার হৃদয়দুয়ার বন্ধ রহে গো প্রভু"। শৈশবে যে এ গান কতবার শুনেছে মনে নেই। তবে লুকিয়ে, মায়ের ঘরে, দরজা বন্ধ করে, সে, মা আর সাবিত্রী মাসি। ঠাকুমার রাজত্বে "হৃদি বৃন্দাবনে বাস"-কি "মজলো আমার মন-ভ্রমরা"-র আগে যাবার উপায় ছিল না। দেবীপুর তখনো সাবেকি চালের গ্রাম-জীবনে অভ্যস্ত। পরে মায়ের ইচ্ছায় তাকে গান শিখতেও হয়েছিল কিছুদিন। সাবিত্রীমাসির কাছেই। সাবিত্রীমাসির বাড়ি তাদের বাড়ি থেকে খুব দূরে ছিল না। কিন্তু কেন কে জানে, সুহাস গানের ক্লাসে ঠিক সুবিধা করতে পারে নি। সাধারণ চেহারা, কাপড়ে হলুদের হাত মুছতে মুছতে এসে গান শেখাতে বসে যাওয়া সাবিত্রীমাসিকে শিক্ষিকা হিসাবে বালক সুহাস ঠিক নিতেই পারে নি। তাতে মার খুব দুঃখ হয়েছিল। কিন্তু শৈশব-কৈশোরে এমন্ই হয়। জোরজার করলে আরো বেশি করেই হয়। পরে বড় হয়ে গ্রামের বৃত্ত ছেড়ে কলকাতায়, তারপর দিল্লিতে, তারপর একইরকম ভাসতে ভাসতে এই দেশ। গান শেখবার সুযোগ যখন হারিয়ে গেল ঠিক তখনই সে যেন আঁকড়ে ধরল গান। ততদিনে সেইসব গানেরা ডিস্ক থেকে টেপ, টেপ থেকে সিডি করতে করতে এসে ঢুকে পড়ল আই-পডে। শোনাটা চলতেই থাকল, ধীরে সুস্থে বসে বসে শেখার সময় এ জীবনে আর হবে না।
বাবার অসুস্থতার সময় ব্যবসা সামাল দিতে দাদা পড়া ছেড়ে দেয়, ব্যবসা দাঁড়িয়ে গেল, বাড়িটাও রক্ষা পেল, কিন্তু দাদা নিজে কেমন একলা, চুপচাপ মানুষ হয়ে গেল। এমনকি কবছর পরে তার বিয়েতেও মত করানো গেল না। বাবার মারা যাবার পর মা-ও হাল ছেড়ে দিলেন। এখন দাদারই পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই, মারও সত্তর, কে আর কাকে রাজি করায়। মধ্য-চল্লিশের সুহাস নিজেরই রগের পাশের রূপোলি ঝিলিক দেখে ভাবে, সত্যি, বোধহয় অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে।
সাবিত্রীমাসি "এ পরবাসে" শুনতে শুনতে একটা খুব মজার কথা বলেছিলেন - দেখ বৌদি, এ গানের সঙ্গে তালটা যেন লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে। গানের সঙ্গে সঙ্গে আছে, তবুও যেন ঠিক একসাথে নয়। ঠিক যেন সেকালের স্বামী-স্ত্রী চলল ম্যাটিনি শো-এ, রাস্তায় দুজনে কথা কবেন না। রাস্তা পার হতে গিয়ে কর্তা একটু দাঁড়াবেন, গিন্নি কতটা পিছিয়ে আছেন একবার দেখে নেবেন। মা হেসে উঠে বলেছিলেন, সাবিত্রী, তোমার কথা শুনলে মরা মানুষও জেগে উঠবে। সুরভি জর্দা নেবে নাকি আরেকটু? সাবিত্রীমাসির গান ছাড়াও সিনেমার নেশা ছিল প্রবল। উত্তম-সুচিত্রা। দেবীপুরে তখন একটাই সিনেমাহল ছিল, চিত্রমন্দির। এখন কি সেটা আছে? এই ডিভিডির জমানায়? কে জানে।
সাবিত্রী মাসিরা সেই গ্রামের বাড়ির পাট চুকিয়ে চলে গেছে কলকাতায়। কলকাতা মানে অবশ্য সেই শ্যামনগর কি বেলঘরিয়া। কলকাতায় আর কটা বাঙালি ছাদ তুলবার হিম্মত রাখে। মেসোর শেষজীবনটা কোনো শহরে কাটানোর ইচ্ছা। সাবিত্রীমাসি বিয়ে হয়ে এসে যে গ্রামের বাড়িতে ঢুকেছিলেন, আড়াইদশক পরে সেই চেনা জায়গা ছেড়ে যেতে তাঁর কেমন লেগেছিল সুহাস আন্দাজ করতে পারে। সেই থেকে মায়েরও নানা সমস্যার শুরু।
গুরুমা, ঠাকুরঘর, একাদশীর উপবাস ইত্যাদিতে রীতিমত জড়িয়ে যাওয়া এই মা কে সুহাস যেন দেখেনি আগে কোনোদিন। সংসারের কাজকর্ম তাড়াতাড়ি মিটিয়ে মা একলা বসে বই পড়ছে, গান শুনছে এরকমটাই তার জানা ছিল। তবে সান্ত্বনা এই যে এইসব পুজোপার্বণ-ব্রত ইত্যাদি করতে গিয়ে মা এখনো নড়াচড়া করতে পারে, সুহাসের জেঠিমা বয়সে মার চেয়ে সামান্যই বড় কিন্তু এখন খানিকটা জুবুথুবু হয়ে গেছে।
|| ৩ ||
মায়ের এই জীবনের ছন্দ তার অচেনা হলেও অপ্রত্যাশিত হয়ত নয়। অল্পবয়সের শখ আহ্লাদ যাই থাক, পরিণত বয়সে স্বামী-পুত্র-পৌত্র ইত্যাদিকে কেন্দ্র করেই চলতে চাওয়া এবং সেই সাধ অপূর্ণ থেকে যাওয়াতে মা নিজেকে ঘুরিয়ে নিয়েছে পুজো-আচ্চার দিকে।
কিন্তু সুহাসের আজকাল মনে হয় তার চারপাশে প্রত্যেকটা জীবনের কক্ষপথ আলাদা হয়ে গিয়েছে। যেমন দাদা। একথা সত্যি সে বাড়ির বড়ছেলের যা কর্তব্য তা করেছে। ঠিক সময়ে সে না এগিয়ে এলে পারিবারিক ব্যবসা বেহাত হয়ে যেত। কিন্তু এখন তার মত নিরুৎসুক সিবলিঙ বোধহয় আর হয় না। এমনকি শঙ্খ-শুভ্ররাও মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করে, রিয়ালি? ইউ টু আর ব্রাদার্স? ইউ ডোন্ট সীম টু কানেক্ট মাচ। হাউ ফানি ! দাদা কি করে, তার ব্যক্তিগত জীবনের চেহারা সুহাসের অজানা। তাদের মধ্যে টেলিফোনেও কথাবার্তাও খুব কম হয় আজকাল। দাদা নিয়মমত সকাল সাতটায় ওঠে, সাড়ে আটটার মধ্যে কাজে বেরিয়ে যায়, ফেরে সেই সাড়ে আটটা কি নটায়, সাড়ে দশটার মধ্যে বিছানায় ঢুকে পড়ে। কোনো অবস্থাতেই তার এই রুটিনের নড়চড় হয় না। সুহাসরা দেশে বেড়াতে গেলেও এই নিয়মের পরিবর্তন হয় না। কথা এমনিতেই খুব কম বলে। আর খুঁচিয়ে খুচিয়ে কথা বলাতে সুহাসের আজকাল বিরক্তি লাগে। জানে না, সে তার দাদাকে জানে না মোটে।
সুপর্ণা আজকাল প্রায়ই তাকে খোঁটা দেয়, তুমি কিন্তু খুব সেল্ফসেন্টারড হয়ে যাচ্ছ সুহাস। রিসার্চ আর গানশোনা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই তোমার? আমরা শেষ কবে ইউরোপ গিয়েছি মনে আছে? শঙ্খ আর শুভ্র তো সামনের বছর কলেজে যাবে, তখন তো তুমি আর বেড়ানোর জন্য খরচা করতে দেবে না। এবছর আর ইনডিয়া না গিয়ে বেড়াতে গেলে কেমন হয়। বাড়ি, গয়না, আরো টাকা, এত চাই, চাই –নাঃ, এই সুপর্ণাকেও সে চেনে না বোধহয়। তা ছাড়া, সুহাস জানে সুপর্ণার দেবীপুর নিয়ে কোনো আদিখ্যেতা নেই। থাকার কথাও নয়। তার বাবা দিল্লিতে উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারি ছিলেন। মেয়ের কনভেন্টে শিক্ষা। বিদেশে স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে এসেছিল। একই বিশ্ববিদ্যালয়। এবং বিবাহ। তার জীবনের কোনোকিছুতে দেবীপুরের অনুষঙ্গ নেই, সুহাসকে বাদ দিলে। এমনকি দেশ নিয়েও তার কোনো হ্যাং-আপস নেই। দেশ মানে সস্তায় মার্কেটিং। কাপড়জামা, গয়না, কিছু ডিভিডি। ব্যস্।
শঙ্খ আর শুভ্র, তাদের যমজ সন্তান। এরা যখন ছোট ছিল সুহাস হয়ত ভাবতে পারত ফেরার কথা। কিন্তু এখন কি আর তারা রাজি হবে? তাদের মধ্যে আমেরিকা ঢুকে পড়েছে। বাবার এই বাংলাগানের পাগলামি নিয়ে হাসে, বাবা ইয়ু আর এট ইট এগেইন, লিসনিং টু দোজ ক্রেজি টিউনস –তারা নিজেরা বাংলা বলতে পারলেও সুহাসের সন্দেহ হয়, ওরা ইচ্ছে করেই তার সামনে বাংলা বলতে চায় না। তবে তারা ঠিক বাংলা গান এপ্রিশিয়েট করতে পারে না, এটা সত্যি। শুভ্র একটু আউটগোয়িং ধরনের, তার বন্ধু-বান্ধবীর তালিকাটি বেশ লম্বা, কিন্তু অন্তর্মুখী শঙ্খর কি স্টেডি ডেট আছে, এই ১৬ বছর বয়সে? সুপর্ণাকে জিজ্ঞেল করলে সে কাঁধ ঝাঁকায় করেছে, সত্যিই কি তবে সুহাস পড়ে গিয়েছে পিছনে? ভারতীয় মা, পুত্রের বান্ধবী নিয়ে কনসার্নড নয়, এতটাই বদলে গিয়েছ তুমি সুপর্ণা?
আর সুহাস নিজে? সে কি করবে দেশে গিয়ে? দেশের হট্টমেলা-গোলকধাঁধার মধ্যে সে কি একদিনও টিঁকবে? এইতো সেদিন তার এক উত্তর ভারতীয় সহকর্মী হাসতে হাসতেই বলছিল, কঁহা জাওগে মুকর্জী, হম অব পোল্ট্রিওয়ালে মুর্গে বন গয়ে। বো পর্বাস-পর্বাস কেয়া কহতে রহতে হো। তুমারা অপনা দেশ ভি তো আমেরিকা বননা চাহতা হ্যায়।
|| ৪ ||
সকালে নয়, প্রায় বেলা দেড়টার সময় ফোনটা এল। সুপর্ণা খেতে খেতে উঠে এসে ফোন ধরল, তারপর বলল, এই, দাদা ফোন করেছেন, ধরো।
সুহাস একটু অবাক হয়, কিন্তু মুখে সহজভাবেই বলে, হ্যাঁ, দাদা বল।
-"শোন, সমু, আজ সকালে মাকে হসপিটালে নিতে হয়েছে। একটা ম্যাসিভ অ্যাটাক, ডাক্তার বলছে বাহাত্তর ঘন্টা না গেলে কিছু বলা যাবে না। " -আমি আসছি।
-পারলে আয়, তবে তাড়াহুড়োর কিছু নেই। আমি তো সারাক্ষণই আছি।
তাদের অতি সংক্ষিপ্ত কথোপকথন। দাদা বললো না, আয়। যেন মা-র দেখাশুনো চিরকাল তো আমিই করে আসছি। তুই আর এসে কি করবি? আর সত্যিই সুহাস জানে ব্যস্ত হওয়া বৃথা। ছুটির বন্দোবস্ত হয়ে গেলেও টিকিট ইত্যাদি করে গিয়ে পৌঁছনো মানে কমসে কম আটচল্লিশ ঘণ্টার ধাক্কা। তার চেয়ে এখন ধীরে সুস্থে টিকিটের বন্দোবস্ত করা ভালো। তাদের এমনিতেই ডিসেম্বরে যাওয়ার কথা, সেটাকে এগিয়ে আনতে হবে, ভালোই মাশুল লাগবে। তাহলে সে যে একটা ইউরোপ ভ্রমণের ফন্দি করছিল সেটা বাতিল করতে হবে। সুহাস আনমনা, ভাবতে থাকে। মা গাইত, মোর জীবনের রাখাল ওগো, ডাক দেবে কি সন্ধ্যা হলে। মার জীবনে সেই সন্ধ্যা কি এল এবার? খালি তো, কবে যাব ,কবে যাব করছিল।
সুপর্ণা এসে তার পাশে বসে। সে এর মধ্যে জেনে গিয়েছে।
-সোম, তুমি কি দেখলে নেট-এ, টিকেটস্ এর কি হবে?
-জানিনা, চার চারটে টিকেটস্ অল্টারেশন, তাও এত শর্ট নোটিসে, খরচ আছে অনেক। আমি বলি আমি একা চলে যাই। তোমরা যেমন যাচ্ছিলে ডিসেম্বরে-তেমনই এসো।
-উঁহু, আমরা সবাই যাব।
শঙ্খ, শুভ্র কখন এসে দাঁড়িয়েছে সুহাস দেখে নি। ইয়েস ড্যাড, লেট আস অল গো। সুহাসের কাঁধে পিঠে অনেকগুলো চেনা হাত। তখনই বিদ্যুৎচমকের মত তার মনে পড়ে মধ্যমান,মধ্যমান। এই এত বছর পরেও সুহাসের মনে সেই পুরোনো কথোপকথন যেন পুনরাবৃত্ত হতে থাকে। ঘরোয়া কথাবার্তায় লুকিয়ে থাকা এক সাঙ্গীতিক সত্য যেন সে প্রত্যক্ষ করে। স্বরলিপিতে পূর্ণ ষোলোমাত্রা-ভিত্তিক বিভাগ লেখা থাকলেও তালটা যেন চলে সম্পূর্ণ ভিন্নচালে, কিন্তু চলতে চলতে একে অন্যের হাত ছাড়ে না কখনোই, গানের সঙ্গে মধ্যমানের ঠেকায় যেন সেই লুকোচুরি চলতেই থাকে এবং, প্রতি আবর্তনের সমে তাদের দেখা হয়, এবং এইভাবেই শেষ যখন সম্ আসে সেই সমাপ্তির প্রশান্তি অন্যরকম।
এ সম তবে শুধু তার মায়ের জীবনের নয়, তার নিজের জীবনেরও একটা সম।
চোখে কি জল? তাই কি ঝাপসা লাগে?