(অশোক কাকলির কিচেন। রবিবার সকাল এগারোটা। ব্যস্তসমস্ত হয়ে প্রবেশ করেন অশোক। হাতে কয়েকটি বাজারের ব্যাগ এবং একটি বাক্স। বাক্স থেকে কিছু বোতল উঁকি দিতে দেখা যায়।)
অশোক: কাকলি! কাকলি! কোথায় গেলে। আঃ, প্রয়োজনের সময় কখনো দেখা পাওয়া যায়না।
(কাকলি প্রবেশ করেন)
কাকলি: কি ব্যাপার? চেঁচাচ্ছ কেন?
অশোক: পাশে না পেলে তো আর কানে কানে ফিশফিশ করে ডাকতে পারি না। চেঁচাতেই হবে! এতগুলো মাল হাতে করে বয়ে আনতে হয়েছে - একটু সাহায্য আশা করাটা কি খুব অন্যায়?
(অশোক বাক্স থেকে একটা একটা করে বোতল বার করে টেবিলে রাখতে থাকেন।)
কাকলি: একি এগুলো কি?
অশোক: কেন চিনতে পারছো না? বোতল, মালের বোতল! মাল বোঝতো? সাতরকমের মালের সাতটা বোতল।
কাকলি: ওমা, এতগুলো মদের বোতল? এত মদ এনেছ কেন? তুমি কি মদ ধরবে নাকি?
অশোক: মদ ধরব মানে? আমি কি মদ খাই না নাকি?
কাকলি: খাও, তবে নিজের পয়সায় বাড়িতে বসে কোনোদিন খেতে দেখিনি তো!
অশোক: এই, এই জন্যই তোমায় কিছু বলতে চাই না। সুখেনদাও এই কথা বললেন - মাল - বাবার ব্রত পালনে মহিলাদের জড়াতে নেই।
কাকলি: কি বললে? কি বললে তুমি? মাল-বাবার ব্রত?
অশোক: আজ্ঞে হ্যাঁ! মাল-বাবা ইজ দ্য লেটেস্ট ক্রেজ! কি যেন বললেন সুখেনদা? ভক্তিভরে যে জনা পুজিবে মাল-বাবার চরণ, মালের অভাব তার রবে না - রবে না - কখন - ওর সামথিং লাইক দ্যাট! মোদ্দা কথা মাল বাবার ব্রত পালন করলে বাড়িতে আর মালের অভাব থাকবে না। সব দিক থেকে মাল এসে আমায় ভাসিয়ে দেবে!
কাকলি: ওমা একি অলুক্ষুনে কথা! বাড়ি কি মদের ডিপো করবে নাকি?
অশোক: ওঃ এই হচ্ছে তোমাদের মেয়েদের প্রবলেম - অলওয়েজ ওয়ানট্র্যাক মাইণ্ড! মাল মানে কি কেবল মদ? মাল শব্দের কতরকম মানে হয় জানো? মালের মতো এমন ভার্সেটাইল ওয়ার্ড বাংলা ভাষায় দুটি নেই। মাল কামানো কাকে বলে জানো না?
কাকলি: মানে টাকা?
অশোক: একজ্যাকটলি! টাকা বল, সোনা বল, হীরে, জহরৎ, সোফা, টেবিল, টিভি, ফ্রীজ - যাই বল, সবই মাল। যা চাইবে, তাই মাল - সুন্দরী যুবতী - সেও মাল! মালটা কি দেখেছিস মাইরি - বলেই সিটি! আঃ, মাল-বাবা যদি দয়া করেন, তাহলে আর কোনো দুঃখ থাকবে না জীবনে!
কাকলি: তার মানে? এই বয়েসে তুমি সুন্দরী যুবতীদের সিটি মারবে নাকি? তাহলে আর দেখতে হবে না, সুন্দরীদের জুতোর স্টিলেটো হিল তোমার ঐ টাক ফুটো করে দেবে।
অশোক: আমি সিটি মারতে যাব কেন? ধরো মাল-বাবার দয়ায়, পার্টি সার্টিতে সেরকম কোনো মাল যদি যেচে আমার ঘনিষ্ঠ হতে চায়, দু-একটা মিষ্টি কথা বলতে চায়, মায় গালে চপাক করে একটা চুমুও খেয়ে ফেলে, আমি কি করতে পারি?
কাকলি: তুমি কি করতে পারো জানি না। কিন্তু আমি কি করতে পারি সেটা তুমি ভালো করেই জানো। তোমার মতো মালকে কি করে -
(টিং টং শব্দে ডোর বেল বেজে ওঠে।)
অশোক: ঐ সৌমেন এসে গেছে।
কাকলি: সৌমেন? সৌমেন এখন?
অশোক: আমি আসতে বলেছি। ও আমার রাইট হ্যাণ্ড - মাল-বাবার ব্রত পালনে আমার পাশে পাশে ও থাকবে-
কাকলি: কেন? তুমি মাল খেয়ে বেসামাল হয়ে পড়লে ও তোমায় সামলাবে? নাকি, তোমার সঙ্গে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে মেয়েদের সিটি মারবে?
অশোক: আঃ বাজে কথা না বলে দরজাটা খুলে দাও, আমি এই মাল গুলো গুছিয়ে ফেলি।
(কাকলি গজ গজ করতে করতে বেরিয়ে যায়। অশোক সেদিকে নজর রেখে চট করে মোবাইল ফোন বার করে ডায়াল করে।)
অশোক: সুখেনদা, আপনি কখন আসছেন?
- আরে এদিকে যে সব ভেস্তে যাবার যোগাড়।
- আরে রেসিস্টেন্স বলে রেসিস্টেন্স! কাকলি একেবারে বেঁকে বসেছে।
- না না আমি ঠিকঠাকই সব বলেছি, কেবল মাল শব্দের নানান ব্যঞ্জনা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ঐ সুন্দরী যুবতী ব্যাপারটাও -
- আঃ কি করব বলুন? মুডের মাথায় বেরিয়ে গেল - সামলাতে পারলাম না।
- আপনি চলে আসুন, মাল-বাবার মাহাত্ম্যটা একটু ট্যাক্টফুলি কাকলিকে বোঝান। আপনি তখন যে শ্লোকটা বললেন, সেটাও আমি ঠিকঠাক বলতে পারলাম না।
(বাইরে সৌমেন আর কাকলির গলা শোনা যায়)
- ঐ সৌমেন এসে গেছে। ওকে কনভিন্স করতে পারলে অনেকটা হেল্প হবে। আপনি ইমিডিয়েটলি গাড়ি ঘুরিয়ে চলে আসুন। আমি রাখছি!
(কাকলি ও সৌমেন প্রবেশ করেন)
সৌমেন: বিশ্বাস করুন বৌদি, আমি কিছু জানি না। দাদা, বললেন চলে এসো আর্জেন্ট দরকার - ব্যস আমি চলে এলাম।
কাকলি: তুমি বললেই আমি মেনে নেব? আমি কিছু বুঝি না ভেবেছ? তুমিও ঐ মালেদের একজন।
অশোক: তুমি একটু চুপ করবে? একটা পবিত্র কাজ করতে চলেছে তোমার স্বামী, কোথায় তাকে তুমি সাহায্য করবে - তা নয় কেবল বাধা দিয়ে চলেছ। এই যে তুমি রোজ নিত্যি নতুন ব্রত করছ - আজ অমুক মা, কাল তমুক বিবি - আমি কখনো বাধা দিয়েছি?
কাকলি: সেকি কেবল আমার নিজের জন্য করেছি? তোমার মঙ্গলের জন্য, সংসারের মঙ্গলের জন্য করেছি।
অশোক: মাল-বাবার ব্রত সাকসেসফুল হলে, তোমারও বিশেষ অমঙ্গল হবে না। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে কিছু এক্সট্রা মাল-কড়ি এলে, মলে দোকানে মাল কিনে সেটা খরচ তো করবে তুমিই।
কাকলি: আর ব্রত সাকসেসফুল করতে গিয়ে তুমি মালের নেশা করে নর্দমায় গড়াগড়ি খাবে আর পাড়ার লোকে আমাকে ছি ছি করবে, সেটা খুব ভালো হবে তাই না?
অশোক: নেশা করে নর্দমায় গড়াগড়ি খাব? কেন, আমি কি ভাটি খানায় বসে দেশি মাল গিলব নাকি? নেশা করব তো নিজের বাড়িতে বসে করব, বিলিতি মাল খেয়ে নেশা করব। তাতে কার কি বলার থাকতে পারে?
কাকলি: আর তারপর বমি করে বাড়িঘর ফার্নিচার সব ভাসাবে, আর আমাকে সেই নোংরা পরিষ্কার করতে হবে।
অশোক: নেভার! মাল বাবার প্রসাদ করে খেলে ওসব কিছুই হবে না।
কাকলি: আর নিজে করছ করো, এই ছেলেটাকেও টেনে এনেছ?
অশোক: বেশ করেছি। তুমিও তো তোমার কোনো বিবির ব্রত উদ্যাপন করতে পাড়ার বৌদের যোগাড় করে এনে ভালমন্দ খাওয়ালে। সে বেলায় কোনো দোষ হয়না না?
কাকলি: সেটা করেছি বিবির প্রচারের জন্য। আমায় দেখে পাড়ার মেয়ে বৌরা ব্রত পালন করলে, মঙ্গলটা তাদেরই।
অশোক: একজ্যাকটলি সেই কারনেই সৌমেনকে ডাকা। শুধু সৌমেন কেন, আরো ছয়জন পুরুষমানুষকে আমায় ডাকতে হবে। আমার সাফল্য দেখে ইন্সপায়ার্ড হয়ে ওরাও মাল-বাবার ব্রত পালন করবে। এই ভাবেই দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়বে মাল-বাবার মাহাত্ম্য। সৌমেন এদিকে এস, এই বোতলগুলো সাজিয়ে ফেলি।
সৌমেন: করেছেন কি দাদা - এতগুলো বোতল? পার্টি তো জমে যাবে!
(সৌমেন এগিয়ে যায় টেবিলের দিকে)
কাকলি: খবর্দার সৌমেন, তুমি ভদ্র ঘরের ছেলে - ঐ সব মাল একদম ছোঁবে না।
(ধমক খেয়ে সৌমেন থমকে যায়।)
সৌমেন: কিন্তু বৌদি, দাদা পুজো করবেন বলে ডাকলেন, আমি কি করে হাত গুটিয়ে থাকব বলুন?
কাকলি: ঐ তো, এখন কথা বেরোচ্ছে। তবে যে বলছিলে কিছুই জানো না?
(সৌমেন থতমত খেয়ে যায়। আমতা আমতা করে বলে।)
সৌমেন: না মানে ঐ টুকুই শুনেছি। দাদা হুড়মুড় করে ফোনে কি সব বললেন - মাল-বাবার পুজো হবে, মাল সেবন হবে - আমি এক্সাইটেড হয়ে চলে এলাম! কিন্তু সত্যি বলছি বৌদি, আমি মাথা মুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারিনি।
কাকলি: বুঝবে কি করে? সুস্থ মস্তিষ্কের লোক এসব বুঝতে পারে না।
অশোক: সব বুঝবে - সব। এখুনি সুখেন দা এসে পড়বেন, উনি নিজেই সব বুঝিয়ে বলবেন। আপাতত জেনে রাখ, সাতদিন আমায় সাতরকমের মাল সেবন করতে হবে। সূর্যাস্তের পর, স্নান করে, এক পেগ মাল নিয়ে মাল-বাবাকে নিবেদন করে পবিত্র মনে, মাল-বাবাকে মনে মনে মনস্কামনা জানিয়ে - অনুপান সহযোগে মালটুকু সেবন করতে হবে।
সৌমেন: মাত্র এক পেগ?
অশোক: না না, মিনিমাম এক পেগ। বেশিও চলতে পারে। তারপর অষ্টম দিন উদ্যাপন - ব্যস! মাল-বাবা তাতেই সন্তুষ্ট! আর মালবাবা সন্তুষ্ট হলে, মনে মনে যে মালই চাও না কেন, সুড় সুড় করে তোমার কাছে এসে ধরা দেবে। মালবাবার ব্রত করে সুখেনদা দারুণ ফল পেয়েছেন - স্টক মার্কেট থেকে প্রচুর মাল কামিয়েছেন।
কাকলি: সৌমেন, তুমি জীবনে এরকম দেবতার কথা শুনেছ? মাল দিয়ে পুজো?
অশোক: কেন? তোমাদের দেবতারা যদি ছোলা গুড়ে কিম্বা নুন জলে সন্তুষ্ট হতে পারেন, তাহলে মাল কি দোষ করল?
সৌমেন: এটা কিন্তু ঠিক কথাই বলেছেন দাদা। সেই বৈদিক যুগ থেকেই কিন্তু হিন্দু দেবদেবীর আরাধনায় মদ ব্যবহার হয়ে আসছে। শুধু মদ কেন, গাঁজা ভাং ইত্যাদির নেশারও চল আছে। আমাদের ভোলে বাবা বিশ্বনাথের তো অসব নাহলে একবারেই চলে না।
অশোক: একজ্যাক্টলি। তবে মাল-বাবা কিন্তু কোনোরকম নার্কোটিক্স পছন্দ করেন না। কেবল নানান দেশের নানান রকমের মাল - স্কচ, রাম, ভদকা, জিন, টেকিলা - এসবই পছন্দ করেন। এরকম ইন্টারন্যাশনাল দেবতা তুমি আরেকটা দেখাও দেখি?
সৌমেন: সত্যি দাদা, আমি একেবারে ইম্প্রেসড! দেবতা হতে হয় তো এমনি। কার কাছে খোঁজ পেলেন এই মাল-বাবার?
কাকলি: কার কাছে আবার? তোমাদের সুখেন দা, সুখেন ভটচাজ এই সব বদ বুদ্ধি ঢুকিয়েছে তোমার দাদার মাথায়।
অশোক: কাকলি, তুমি কিন্তু ব্ল্যাশফেমি করছ! মাল-বাবার ব্রত বদবুদ্ধি? মাল-বাবা চটে গেলে কি হতে পারে জানো?
কাকলি: কি? কি হতে পারে শুনি?
অশোক: ইয়ে মানে, একজ্যাক্টলি কি হবে জানি না, তবে খুব একটা সুখকর কিছু হবে না বলে মনে হয় না। সুখেনদা আসুন, উনি ঠিক বলে দেবেন।
(দরজায় ডোর বেল বেজে ওঠে)
অশোক: ঐ, সুখেনদা এসে গেছেন। আমি যাই, ওনাকে নিয়ে আসি।
(অশোক বেরিয়ে যায়)
কাকলি: সৌমেন, আমি জানি তুমি ভালো ছেলে। তুমি আমার একটা কথা রাখ, ওকে আটকাও। এই বয়েসে মাল মাল করে যদি বিপথে যায়, তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। সমাজে মুখ দেখাতে পারব না।
সৌমেন: আঃ বৌদি আপনি তো দাদাকে চেনেন! এরকম হুজুগ কি এর আগে কম করেছেন? দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে।
কাকলি: আমি কিছু জানিনা সৌমেন। যদি বেচাল কিছু দেখি, তাহলে কাউকে ছাড়ব না বলে দিলাম।
(অশোক ও সুখেন প্রবেশ করেন)
অশোক: সুখেনদা, আপনি সব দেখে শুনে বলে দিন যোগাড়যন্ত্র সব ঠিক আছে কিনা। আপনি সার্টিফাই করলেই আমি শুরু করব।
সুখেন: নিশ্চই দেখব। একটা শুভ কাজ শুরু করতে চলেছ, আমাকে তো দেখতেই হবে। এটাতো আমার পবিত্র কর্তব্য! (কাকলিকে) কেমন আছ কাকলি?
কাকলি: এসব কি শুরু করেছেন সুখেন দা? মাল-বাবা মাল-বাবা হুজুগ তুলে সবাইকে কি এল্কোহলিক করে ছাড়বেন নাকি?
সুখেন: (জিব কেটে, কান স্পর্শ করে) ছি ছি ছি - কি বলছ কি তুমি কাকলি? মাল-বাবা অপার করুণাময় - উনি আনন্দ দান করেন, ভক্তের মনের সব দুঃখ শোক ভুলিয়ে দেন!
সৌমেন: মাল তো অনেকে শোক দুঃখ ভোলার জন্যই ধরে সুখেনদা! মানে সেটাই অজুহাত হয় তাদের, অন্তত সিনেমায় যা দেখি।
সুখেন: তুমি ভুল বুঝছ সৌমেন। আমি বলতে চাইছিলাম, মাল-বাবা কাউকে মদ্যপ করেন না। মদ্যপ লোকে হয় নিজের দোষে। শোন কাকলি, তোমরা তো দেব দেবীর পূজার সন্দেশ মিষ্টি ভোগ দাও, এখন সেই মিষ্টি খেয়ে যদি কেউ সুগার এডিক্ট হয়ে যায়, ডায়বেটিক হয়, সেটা কি তোমার দেবতার দোষ?
অশোক: কি? এবার কি বলবে? সুখেনদা, আপনি যে মাল-বাবার পাঁচালীর গপ্পটা আমাকে শোনাচ্ছিলেন, সেটা এদের বলুন। তাহলে এদের সংশয় দূর হবে।
সুখেন: নিশ্চই বলব! কিন্তু তার জন্য তো একটু প্রস্তুতির প্রয়োজন। অশোক, তোমার কাছে ব্যঘ্র চর্মের আসন রয়েছে?
অশোক: ব্যঘ্র চর্মের আসন? মানে বাঘের চামড়া?
সুখেন: হ্যাঁ! মাল-বাবার পাঁচালী বলতে হলে ব্যঘ্র চর্মের আসনে বসেই বলা বাঞ্ছনীয়।
অশোক: কাকলি, আছে নাকি?
কাকলি: না না, ওসব বাঘ ছাল টাল কোথায় পাব? কম্বল পেতে দিতে পারি!
সুখেন: কম্বলে হবে না! ঠিক আছে, ব্যঘ্র চর্মের বিকল্পে কাষ্ঠাসনেই চলবে।
সৌমেন: বাঃ তাহলে তো এই চেয়ারেই চলবে।
(সৌমেন চেয়ার এগিয়ে দেয়)
সুখেন: বেশ বেশ! (সুখেনদা চেয়ারে বসেন) অশোক, শুরু করার আগে যে আচমন করতে হবে!
অশোক: হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চই! কাকলি, যাও না একটু জল নিয়ে এস।
সুখেন: না না, জলে হবে না! কারণবারি লাগবে - একটা মালের বোতল নিয়ে এস।
অশোক: কি আনব সুখেনদা? হুইস্কি, ভদকা, রাম?
সুখেন: ভদকাই দাও! ভদকা বড় পবিত্র - স্বচ্ছ!
(অশোক তাড়াতাড়ি একটা ভদকার বোতল আর একটা গেলাস নিয়ে আসে)
অশোক: (সুখেনকে গেলাসটা দিয়ে) ধরুন সুখেনদা।
(সুখেন গেলাসটা ধরে, চোখ বুজে কিছু মন্ত্র উচ্চারণ করেন, তারপর গেলাসটা এগিয়ে ধরেন)
সুখেন: দাও। বেশি না, এক পেগ মতো।
কাকলি: এক পেগ দিয়ে আচমন?
(সুখেন আড় চোখে কাকলির দিকে তাকান। অশোক ধমকে ওঠেন।)
অশোক: আঃ, কাকলি! তুমি চুপ করবে? আপনি শুরু করুন সুখেনদা!
(সুখেন চোখ বুজে আরো কিছু দুর্বোদ্ধ মন্ত্র উচ্চারণ করেন, তারপর চোখ মেলে, হাতের তালুতে সামান্য ভদকা ঢেলে আচমন করেন।)
সুখেন: এস। তোমরা সবাই এই পুন্য পানীয় ওষ্ঠে স্পর্শ করে আচমন কর। মন পবিত্র হোক।
(অশোক হাত বাড়িয়ে এগিয়ে যায়। সুখেন সামান্য ভদকা ঢেলে দেন, অশোক চট করে সেটা মুখে ফেলে হাত মাথায় মুছে ফেলে)
সুখেন: সৌমেন, তুমিও এস। কাকলি এস।
কাকলি: অসম্ভব! মদ আমি ছুঁই না!
অশোক: কেন, সামান্য একটু জিবে ছোঁয়ালে কি তোমার জিব খসে যাবে? হোমিওপ্যাথি ওষুধ খাবার সময় মনে থাকে না?
সৌমেন: আহা ঠিক আছে, বৌদি চাইছেন না যখন ছেড়ে দিন না। বৌদির হয়ে না হয় আমি দুবার আচমন করে নিচ্ছি। আমাকে দিন সুখেনদা!
(সৌমেন এগিয়ে যায়। সৌমেনকে ভদকা ঢেলে দিতে বলেন।)
সুখেন: না, সৌমেন - কাকলির স্বামী আচমন করেছে, তাহলেই হবে। তুমি কোনো চিন্তা করো না কাকলি, শাস্ত্রেই বলেছে - পতির পুণ্যে সতির পুণ্য!
(কাকলি কটমট করে তাকায়। সৌমেন আচমন সারে।)
সুখেন: এবার শুরু করি তাহলে?
অশোক: হ্যাঁ, শুরু করুন।
সুখেন: যেহেতু পাঁচালী সঙ্গে নেই, আমি তোমাদের সেই অপূর্ব সুললিত কাব্য শোনাতে পারব না। কিন্তু কাহিনীটুকু তোমাদের শোনাতে পারি।
অশোক: ওতেই চলবে সুখেনদা। আপনি শুরু করুন।
সুখেন: বেশ! বহুকাল আগে, বিদর্ভ নগড়ে, বীতশোক নামে এক শ্রেষ্ঠী বাস করতেন। শ্রেষ্ঠী মানে বোঝাতো সৌমেন?
অশোক: বুঝবে না কেন? শ্রেষ্ঠী মানে যে শ্রেষ্ঠ -
সুখেন: না অশোক। শ্রেষ্ঠী অর্থবনিক - ব্যবসায়ী - বিজনেসম্যান!
সৌমেন: ঐ একই হল। বিজনেস ম্যানরাই তো শ্রেষ্ঠ ক্লাস আজকাল, তাই না!
সুখেন: বীতশোকের প্রধান কারবার ছিল, রাজপ্রাসাদ এবং অন্যান্য সরকারী দপ্তরে মাল সাপ্লাই করা!
সৌমেন: রাজপ্রাসাদে মদ সাপ্লাই করতেন?
সুখেন: (একটু বিরক্ত) না, রাজ কার্যে যা যা মাল লাগে, সেই সব আরকি।
অশোক: আঃ সৌমেন, পাঁচালী পাঠের সময় ইনটারাপ্ট করো না।
সৌমেন: সরি। আপনি বলুন সুখেনদা।
সুখেন: হ্যাঁ যে কথা বলছিলাম। শ্রেষ্ঠী বীতশোক রাজাকে মাল সাপ্লাই করে বেশ ভালোই মালকড়ি কামাচ্ছিলেন। সুন্দরী স্ত্রী, ধন-রত্ন, প্রাচুর্য, বিলাস-ব্যসন - সবকিছু নিয়ে সুখে দিন কাটছিল তার। কিন্তু রাজার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎই চরম বিপর্যয় নেমে এল শ্রেষ্ঠীর জীবনে। রাজার ছেলে কুমারদেব রাজা হবার পর, মিথ্যে অভিযোগ এনে শ্রেষ্ঠী বীতশোকের সমস্ত অর্ডার বাতিল করে দিলেন। তার নিজের পেয়ারের লোকের কছ থেকে মাল নিতে থাকলেন। শ্রেষ্ঠীর গুদামে মাল পচতে থাকল। ব্যবসার কারনে বাজারে প্রচুর দেনা ছিল বীতশোকের, পাওনাদারেরা এসে বাড়ির সমস্ত মাল, মায় দরজা জানালা, কড়ি বড়গা সব খুলে নিয়ে চলে গেল। সুন্দরী স্ত্রী ও স্বামীকে পরিত্যাগ করে পর পুরুষের সঙ্গে চলে গেল। দুঃখে শোকে কাতর বীতশোক আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিলেন।
সৌমেন: সাঙ্ঘাতিক!
কাকলি: ন্যাকা!
অশোক: তারপর? তারপর?
সুখেন: বীতশোক একগাছা দড়ি নিয়ে, একা একা চললেন আত্মহনের পথে। লোকালয় ছাড়িয়ে অনেক দূরে এক অশ্বত্থ গাছের নিচে এসে দাঁড়ালেন। বিশাল অশ্বত্থ গাছ দেখে ঠিক করলেন এরই কোনো একটা মজবুত ডাল দেখে ঝুলে পড়বেন।
সৌমেন: এত একেবারে জীবনানন্দ দাসের কবিতা -
অশোক: আঃ সৌমেন -
সৌমেন: সরি! সরি!
সুখেন: এতটা পথ হেঁটে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন বীতশোক। ভাবলেন, চিরবিশ্রামের আগে এই বিশাল বৃক্ষের তলায় বসে সামান্য বিশ্রাম নিয়ে নেবেন। গাছের তলায় বসে নিজের দূর্ভাগ্যের কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লেন ক্লান্ত বীতশোক! ঠিক তখনই স্বপ্নে দেখা দিলেন -
অশোক: মাল-বাবা!
সুখেন: ঠিক বলেছ। ঐ অশ্বত্থ গাছের তলায় ছিল মাল-বাবার থান। মাল-বাবা দেখা দিয়ে বললেন, আমার আশ্রয়ে যখন এসেই পড়েছিস, তখন তোর আর চিন্তা কিসের? বীতশোক হাঁউমাঁউ করে কেঁদে উঠলেন - বাবা আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে - আমি সব হারিয়েছি - আমি এ জীবন আর রাখতে চাই না। বাবা বললেন, ওরে আমি অন্তর্যামী - তোর সব সমস্যার কথা আমি জানি। এখন আমি যা বলছি তা মন দিয়ে শোন। আমার কথা যদি অক্ষরে অক্ষরে পালন করিস, তাহলে আবার সব ফিরে পাবি। বীতশোক বাবার পা চেপে ধরে কেঁদে বললেন, বল বাবা বল, আমি সব করব। বাবা বললেন, বন্দরে যা - সেখানে দেখবি এক বিদেশী বনিক জাহাজ ভরতি মাল নিয়ে অপেক্ষা করছে। নাম মাত্র মূল্যে সেই মাল ও তোকে বেচে দেবে। তুই ঐ মাল কিনে প্রথমে সাত দিন ধরে আমাকে স্মরণ করে মাল সেবন করবি। তারপর অষ্টম দিনে আটজন উপকারি বন্ধুকে ডেকে আমার কথা শোনাবি, আর মাল সেবন করাবি, তাদের মাল উপঢৌকন দিবি। শুধু বন্ধু নয়, তোর শত্রুকেও আমার নাম করে মাল উপহার দিবি। তাহলেই দেখবি তোর সুদিন ফিরে আসবে।
অশোক: ফিরে এল? ওর সুদিন ফিরে এল?
সুখেন: অবশ্যই এল। শ্রেষ্ঠী বীতশোক সেই বন্দরে গিয়ে দেখলেন, ঠিক মাল বাবা যেমন বলেছিলেন, বিদেশী বনিক জাহাজ ভরতি মাল - হাজার হাজার বোতল মাল - জলের দরে বেচে দিচ্ছে। শ্রেষ্ঠী ধার দেনা করে সব মাল কিনে ফেললেন। তারপর, মাল বাবার কথামতো নিষ্ঠাভরে আটদিন ধরে ব্রত পালন করলেন। দুহাতে মাল বিতরণ করলেন - রাজবাড়ির যে সমস্ত লোকেদের চক্রান্তে বীতশোক সর্বসান্ত হয়েছিলেন, তাদেরও অঢেল মাল উপঢৌকন দিলেন।
সৌমেন: উপঢৌকন, না উৎকোচ?
(সুখেন কথাটায় খুব একটা পাত্তা দিলেন না)
সুখেন: আবার রাজবাড়ির মাল সরবরাহের বরাত পেলেন - কিছুদনের মধ্যেই নতুন সাতমহলা বাড়ি হল, ধন সম্পদ হল -
কাকলি: আর ওর স্ত্রী? সে ফিরে এল?
সুখেন: না, সে আর ফিরে আসে নি। কিন্তু স্ত্রী রত্ন লাভ থেকেও বঞ্চিত রইলেন না শ্রেষ্ঠী বীতশোক। অতি শীঘ্রই এক অসামান্যা সুন্দরী যুবতী রমনী তাঁর ঘরনী হয়ে এল -
কাকলি: এই! এই, সুন্দরী যুবতী পাবার আশায় আপনাদের এই সব ভড়ং! আমি কিছু বুঝি না ভেবেছেন?
সুখেন: আহা, তুমি চিন্তিত হচ্ছো কেন কাকলি? তুমি তো আর তোমার স্বামীকে পরিত্যাগ করছ না! (দীর্ঘশ্বাস ফেলে) তোমার মতো সুন্দরী স্ত্রী থাকতে অশোক কেন অন্য রমনীর আকাঙ্খা করবে?
কাকলি: ঘরকা মুরগী দাল বরাবর - শোনেন নি কথাটা? আর মাঝ বয়েসের রোগটা যাবে কোথায়? অল্পবয়েসী মেয়ে দেখলেই তো গদ গদ হয়ে পড়ে!
অশোক: আঃ তুমি থামবে? কথা হচ্ছে মাল-বাবার, সেখানে মুর্গী, দাল, মেয়েছেলে - যত্ত সব বাজে কথা।
সৌমেন: কিন্তু সুখেনদা, এই মাল-বাবার হদিস আপনি কি করে পেলেন?
সুখেন: সেও এক অত্যাশ্চর্য অলৌকিক কাহিনী বলতে পারো! ভাবলে আজও আমার শিহরণ হয়।
অশোক: কি রকম? কি রকম?
সুখেন: অশোক, তুমি তো জানো তোমার বৌদি আমায় ছেড়ে চলে যাবার পর, আমি কিরকম ডিপ্রেসড হয়ে পড়েছিলাম? কিছুই ভালো লাগত না! চাকরিটাও চলে গেল দুম করে। চুপচাপ কেবল ঘরে বসে থাকতাম আর মাল খেতাম। ঠিক সেই সময় এক পবিত্র সন্ধ্যায় দেখা দিলেন বাবা!
অশোক: কি আশ্চর্য! কি আশ্চর্য!
সুখেন: আশ্চর্য বলে আশ্চর্য! সেদিন আমার মনটা খুবই খারাপ - কোনো দিকেই কোনো দিশা খুঁজে পাচ্ছি না। সন্ধ্যে হয়ে গেছে। একটা বারে, আধো অন্ধকারে বসে, ঢুকু ঢুকে মাল খাচ্ছি আর নিজের দুর্ভাগ্যের কথা ভাবছি। হঠাৎ দেখি সামনের চেয়ারে কে একজন এসে বসেছে। উষ্কো খুশকো চুল দাড়ি - পাগল পাগল চেহারা! সত্যি বলতে কি, আমার বুকের ভেতরটা কেমন ছ্যাঁৎ করে উঠল। আর চোখ দুটো - কি বলব তোমাকে অশোক - অমন চোখ আমি জীবনে দেখিনি! সেদিন বুঝলাম অন্তর্ভেদী দৃষ্টি কাকে বলে - যেন বুকের ভেতরটা দেখতে পাচ্ছে। আমাকে মুখ তুলতে দেখেই বললেন, মাল খেলেই চলবে? তোর উপর যে অনেক দায়িত্ব! আমি ফ্যাল ফ্যাল করে চইয়ে রইলাম। উনি চট করে ব্যাগ থেকে কিছু বার করে আমার হাতে দিলেন। চমকে তাকিয়ে দেখি একটা পোস্টকার্ড আর একটা চটি বই। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এগুলো কি? উনি বললেন, পড়ে দেখ - পড়লেই সব বুঝতে পারবি। অন্ধকার থেকে একটু ঘুরে আলোতে পোস্টকার্ডটা এনে দেখি তাতে ডিটেলসে মালবাবার ব্রত বৃত্তান্ত লেখা রয়েছে। আর পোস্টকার্ডের নিচে ওনার নামের আদ্যক্ষর সই করা - ম. ব.!
সৌমেন: ম. ব. ?
অশোক: বুঝলে না? মাল-বাবা!
সৌমেন: কেন অন্য নামও তো হতে পারে? মাধব বসু, মৃগাঙ্ক ব্যানার্জি, মধুসূদন বটব্যাল, কিম্বা মনোহর বল -
সুখেন: অবিশ্বাসীর কাছে হতে পারে। কিন্তু আমার কাছে আজ আর কোনো সন্দেহ নেই যে উনিই মালবাবা! কারন পোস্টকার্ড থেকে মুখ তুলে তাকিয়ে দেখি উনি অদৃশ্য - কোনো সাধারণ মানুষও অত তাড়াতাড়ি উধাও হতে পারে না। আর যে চটি বইটা দিয়েছিলেন, সেটি আর কিছুই নয় - মালবাবার পাঁচালী। আমি স্পষ্ট অনুভব করলাম এক দৈব শক্তি আমাকে প্রভাবিত করছে! আমি বুঝতে পারলাম, মালবাবাই আমার নিয়তি।
অশোক: তারপর? তারপর?
সুখেন: তারপর আর কি? নিষ্ঠা ভরে মালবাবার ব্রত পালন করলাম। আর মাল-বাবাও দুহাত ভরে দয়া বর্ষন করলেন। স্টক মারকেটে কয়েকটা বাজি লেগে গেল - একটা ব্যবসায় লেগে পড়লাম, মালবাবার দয়ায় সেটাও দিব্যি চলতে থাকল। এখন কেবল একটা প্রার্থনাই পূরণ হতে বাকি -
সৌমেন: সুন্দরী ঘরনী, তাই তো?
সুখেন: (লজ্জিত হয়ে) ঐ আর কি! বাবার দয়া হলে-
অশোক: সে আশাও আপনার পূর্ণ হবে সুখেনদা। আপনি পুন্যবান - আপনি তো কেবল নিজের জন্যই করছেন না -
কাকলি: পরের ঘর ভাঙার ব্যবস্থাও করছেন! আপনি সুন্দরী ঘরনী যোগাড় করতে চান ভালো কথা, কিন্তু ওর মাথার এসব বুদ্ধি ঢোকাচ্ছেন কেন?
অশোক: আঃ, কেন এসব বাজে কথা বলছ? যাও না, ভেতরে গিয়ে আমাদের অনুপানের যোগাড় কর। মাল সেবনের জন্য উৎকৃষ্ট অনুপানের প্রয়োজন। (সুখেনকে) কি অনুপান বলব সুখেন-দা?
সুখেন: মালের সঙ্গে যা ভালো চলে, সে রকম কিছু হলেই চলবে। কষা মাংস, মেটে চচ্চড়ি, কাবাব, পরোটা এই সব আরকি।
অশোক: (কাকলিকে) কি, শুনলে তো। একটু কাবাব টাবাবের বন্দোবস্ত কর গিয়ে যাও!
কাকলি: আমি পারব না। আমি ভেতরে গেলাম। এই সব মোদো মাতালের মোচ্ছবের ব্যবস্থা আমি করতে পারব না। সৌমেন তুমি একবার ভেতরে শুনে যেও তো।
সৌমেন: আসছি বৌদি!
অশোক: না, তুমি যাবে না। তোমার বৌদি যখন অনুপানের ব্যবস্থা করবে না, তখন তোমাকেই হেল্প করতে হবে সৌমেন। তুমি যাও, কাবাব অ্যাণ্ড কারী থেকে কিছু কাবাব আর পরোটা নিয়ে এস। পুজোয় লাগবে।
কাকলি: সৌমেন!
(কাকলি সৌমেনের দিকে ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টি হেনে ভেতরে চলে যায়)
সৌমেন: ঠিক আছে দাদা, আমি নিয়ে আসছি। আগে বৌদির কথাটা একটু শুনে আসি। বৌদিকে ঠাণ্ডা না করতে পারলে তো -
অশোক: হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলছে। যাও, তুমি ভেতরে যাও!
(সৌমেন ভেতরে চলে যায়।)
অশোক: কি মনে হল দাদা? কাকলি মানবে বলে মনে হয়?
সুখেন: অনেক দিনের সংকার, একটু সময় লাগবে। চিন্তা কোরো না, মাল-বাবা ওকে ঠিক পথে নিয়ে যাবেন। এখন চল, তোমার ব্যবস্থাপনা দেখি গিয়ে।
অশোক: হ্যাঁ, আসুন।
(অশোক সুখেনকে টেবিলের কাছে নিয়ে আসে)
অশোক: এই দেখুন আপনার কথামতো সাত রকমের মাল। হুইস্কি, রাম, টেকিলা, জিন, কনিয়াক, ভদকা, আর ব্র্যাণ্ডি! কনিয়াক আর ব্র্যাণ্ডি যদিও একই গোত্রের, আশাকরি অসুবিধে হবে না।
সুখেন: না, তা হবে না। কিন্তু সাত বোতল কেন? তোমার তো লাগবে আট বোতল। অষ্টম দিনেই তো উদ্যাপন। সেই দিন তুমি কোন মাল উৎসর্গ করবে?
অশোক: এই সেরেছে! আমি তো শুনলাম সাত দিনের যোগাড় করতে হবে। কি হবে তাহলে?
সুখেন: চিন্তার কি আছে? আরেকটা বোতল নিয়ে আসলেই হবে। তবে কোয়ান্টিটি-টা একটু বেশি আনবে - সেদিন তোমার আটজন গেস্টকেও দিতে হবে তো। তাছাড়া, পুরোহিত বিদায়ের একটা ব্যাপার আছে।
অশোক: কোনো প্রবলেম নেই। কি আনব বলুন? আমার মাথায় তো আর কিছুই আসছে না।
সুখেন: হুইস্কি এনেছ বটে, কিন্তু এটা তো ব্লেণ্ডেড স্কচ! তুমি কয়েক বোতল, চার লিটার মতো, ভালো কোনো সিঙ্গল মল্ট আনতে পার। কিম্বা কোনো আইলে মল্ট - আমি ওগুলোই পছন্দ করি বেশি।
অশোক: মাল-বাবাও সিঙ্গল মল্ট পছন্দ করবেন বলছেন? ঠিক আছে, আমি আনিয়ে নিচ্ছি। আর কিছু।
সুখেন: না, তেমন কিছু নয়। তুমি সাতদিন রোজ সন্ধ্যেবেলা, স্নান করে, পবিত্র মনে মাল-বাবার কাছে তোমার মনস্কামনা জানিয়ে ঢক করে এক পেগ খেয়ে নেবে। ইচ্ছে হলে মাল-বাবার নাম করে আরো কয়েক পেগ মেরে দিতে পারো। ইতিমধ্যে তোমার বন্ধু বান্ধব যাদের উদ্যাপনে বলবে তাদের জানিয়ে দিও। উদ্যাপনের অন্যান্য যা আয়োজন, সে ব্যবস্থা আমিই করে দেব।
অশোক: থ্যাঙ্ক ইউ সুখেনদা। আপনি যে আমার কি উপকার করলেন কি বলব!
সুখেন: না না, এটা তো আমার কর্তব্য। মাল-বাবার দাখ্যিন্য যারা লাভ করেছে, মাল-বাবার মাহাত্ম্য প্রচার করা তাদের অবশ্য কর্তব্য। তুমিও করবে! তোমার কথা শুনে যারা মাল-বাবার ব্রত পালন করবে, তাদের পুণ্যের ভাগও তুমি লাভ করবে। তারপর তারাও যখন আরো আটজন ভক্তকে অনুপ্রাণিত করবে, সেই আটজনের পুণ্যের ভাগও উঠে আসবে তোমার ঝুলিতে। এইভাবেই চলতে থাকবে -
অশোক: বা বা! এত একেবারে মাল্টিলেয়ার মার্কেটিং সিস্টেম - এম ওয়ের মতো!
(হন্ত দন্ত হয়ে সৌমেন প্রবেশ করে)
অশোক: একি সৌমেন, তুমি এখনও যাওনি? ভালোই হয়েছে! শোন, তুমি তিন বোতল - না চার বোতল ম্যাকালান সিঙ্গল মল্ট হুইস্কি নিয়ে আসবে।
সৌমেন: সে না হয় নিয়ে আসব, কিন্তু আপনি ভেতরে গিয়ে বৌদিকে একটু সামলান।
অশোক: কেন? কেন? কি হয়েছে? খুব রেগে গিয়েছে?
সৌমেন: না না রাগেন নি! আপনি ভেতরে গিয়ে দেখুন না!
অশোক: আহা, কি হয়েছে বলবে তো? একটু প্রিপারেশন নিয়ে যেতে হবে না?
সৌমেন: বৌদি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবেন বলছেন। স্যুটকেশ গোছাচ্ছেন।
অশোক: সেকি?
সুখেন: বুঝতে পারছ অশোক? ঠিক সময়েই তুমি মাল-বাবার দয়া পেতে চলেছ। কোনো চিন্তা কোরো না, মাল-বাবা যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন। সব ক্ষতি তোমার পূরণ হয়ে যাবে - কড়ায় গণ্ডায়!
(কাকলি একটা স্যুটকেস হাতে নিয়ে প্রবেশ করে। বেশ সেজেগুজে এসেছেন।)
কাকলি: সুখেন! সুখেন ডার্লিং! আমায় তোমার সঙ্গে নিয়ে চল সুখেন! তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না। আমাকে এই মুহূর্তে এখান থেকে নিয়ে চল।
অশোক: একি? একি? এসব কি বলছ তুমি কাকলি?
কাকলি: না অশোক, তোমার সঙ্গে আর আমি থাকতে পারব না। তোমার মতো অপদার্থ, অসফল মানুষের সঙ্গে আর ঘর করতে পারব না আমি। আমি আমার মনের মানুষ পেয়ে গিয়েছি - সুখেন। (সুখেনের খুব বিপজ্জনক সান্নিধ্যে গিয়ে, সুখেনের গলা জড়িয়ে ধরে।) সুখেন আমার স্বপ্নের প্রেমিক পুরুষ - তাই না সুখেন?
(সুখেন ভীষণ ঘাবড়ে গেছেন)
সুখেন: আঃ! এসব কি যা তা বলছ কাকলি! আমাকে ছাড়ো!
কাকলি: না ছাড়ব না! কিছুতেই ছাড়ব না। বল, তুমি বল, আমায় তুমি ভালোবাসো না? বল তুমি?
সুখেন: না - মানে - আমি - উঃ কি বিপদ!
কাকলি: ওমা কেন? লোকে কি বলবে তাই ভাবছ? তোমার জন্য আমি সব বদনাম সইতে রাজি আছি ডার্লিং! (গেয়ে ওঠে) মুন্নি বদনাম হুই, ডার্লিং তেরে লিয়ে -
(সুখেনকে ঘিরে নেচে ওঠে কাকলি)
অশোক: ছি ছি ছি! কাকলি তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? সুখেনদার সঙ্গে তুমি - ছিঃ!
সৌমেন: আমার মনে হয় এসব বড়দের ব্যাপার আমার দেখা ঠিক হচ্ছে না। আমি মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছি।
কাকলি: সৌমেন, ইউ নটি বয়! এখন মুখ ঘুরিয়ে থাকলে চলবে? আমাদের নতুন সংসার পাততে সাহায্য করবে না তুমি? (সুখেনকে) জানো ডার্লিং, সৌমেন আমার চোখ খুলে দিয়েছে। ওই তো আমায় বলল, তুমি নাকি আমাকে পাবার জন্যই মাল-বাবার পুজো করছ? সত্যি?
অশোক: সৌমেন তুমি কি করে -
সৌমেন: না, মানে - আমি বলেছিলাম সুখেনদার সুন্দরী ঘরনীর প্রার্থনাটা তো এখনো পুরণ হয়নি -
কাকলি: (সুখেনকে) আর তখন তো সবার সামনেই তুমি আমায় সুন্দরী বলে কত প্রশংসা করলে - ইস আমি তখন একদম বুঝতে পারিনি তুমি আমায় কতটা চাও। আই এম সো সরি ডার্লিং!
সুখেন: (কাকলিকে) না - মানে - আমি ঠিক তোমাকে -
কাকলি: কেন আমি সুন্দরী নই? আমাকে তোমার ভালো লাগে না? বল না? আমি মালটা কি খারাপ? বল না?
সুখেন: না না সে কথা নয় - সে কথা নয়!
অশোক: সুখেনদা আপনি? আপনি?
কাকলি: (অশোককে) এই তুমি চুপ করবে? আমাদের কথার মধ্যে কথা বলতে এস না তো। (সুখেনকে) এই জানো, আমার না - তোমাকে চিরদিনই ভালো লাগত - তোমাকে দেখলেই বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠত! তোমার করত না? এই বল না গো, তোমার কিছু হত না?
সুখেন: ইয়ে - মানে - হত - একটু একটু -
অশোক: কি? কি বললেন সুখেন-দা?
সৌমেন: বললেন, একটু একটু হত - কুছ কুছ হোতা -
কাকলি: (সুখেনকে আরো গাঢ় করে জড়িয়ে ধরে) আমি জানতাম! ঠিক জানতাম, মাই ডার্লিং। ভাগ্যিস তুমি মাল-বাবার পুজো করেছিলে, তাই আজ আমি সব বন্ধন কাটিয়ে তোমার কাছে ছুটে আসতে পেরেছি! মাল-বাবাই আমাকে সাহস জুগিয়েছে! চলো সুখেন, আমরা আমাদের ঘর বাঁধি গিয়ে - আমাদের ভালোবাসার নীড়! (সুখেনের হাত ধরে টানে) চলো না প্লীজ!
অশোক: খবরদার বলছি! এক পাও নড়বে না। কোথাও যাবে না তুমি।
কাকলি: ইস! বললেই হল। মাল-বাবা আমাদের মিলন ঘটিয়েছেন। তুমি কে আমাদের আটকাবার? (সুখেনকে) কি গো, বল না? আমি ঠিক বলিনি?
সুখেন: (অশোককে) মাল-বাবা অপার করুণাময়! মাল-বাবার কাছে প্রার্থনা কর অশোক, তুমিও তোমার মনের -
অশোক: নিকুচি করেছে মাল-বাবার। (সুখেন) ছাড়ুন, আমার বউকে এই মুহূর্তে ছেড়ে দিন! নইলে ঐ সব মালের বোতল আমি আপনার মাথায় ভাঙব। (সুখেন ভয় পেয়ে কাকলিকে ছেড়ে সরে যায়। কাকলি লাফিয়ে পড়ে আবার সুখেনকে জড়িয়ে ধরে)
কাকলি: না, তুমি আমায় ছাড়বে না। আমাকে ধর, আমাকে শক্ত করে ধর। তোমার বাহুডোরে আমাকে চিরকালের জন্য বেঁধে রাখ! আমাকে আর ওর কাছে ফিরিয়ে দিও না।
অশোক: খবরদার সুখেনদা! ছাড়ুন বলছি আমার বউকে - নইলে -
(অশোক টেবিল থেকে ভদকার বোতল তুলে নিয়ে আসে)
সুখেন: আঃ, আমি কোথায় ধরে রেখেছি তোমার বউকে? তোমার বউই তো আমায় ধরে আছে!
অশোক: কাকলি, ছেড়ে দাও বলছি! ভালো হবে না কিন্তু -
কাকলি: কি ভালো হবে না? শুনলে না সুখেনদা বললেন, মাল-বাবার পুজো কর - তোমার পেছনে সুন্দরী মালেদের লাইন পড়ে যাবে? কি সুখেন, আমি ঠিক বলিনি?
অশোক: চাই না আমার ঐ মাল। তুমি আমায় ছেড়ে কোথাও যাবে না - ব্যস এই হল শেষ কথা!
কাকলি: ওমা, সে কি গো? তাহলে কিসের জন্য তোমার মাল বাবার পুজো?
অশোক: সে তো কয়েকদিন একটু মাল খেতে পাবো বলে। এমনিতে তো তুমি খেতে দেবে না।
কাকলি: ঠিক আছে, তাই কর তাহলে। মাল-বাবার পুজো কর, আর মাল খাও। (সুখেনকে) চল ডার্লিং আমরা যাই!
অশোক: বলছি তো, মাল-বাবার পুজোটুজো আর করব না। (টেবিলের কাছে গিয়ে বোতলের বাক্স ধরে নিয়ে আসে। সুখেনকে ধরিয়ে দেয়) এই নিন সুখেনদা, সব বোতল নিয়ে আপনি আপনার ঘরে বসে যত খুশি মাল-বাবার আরাধনা করুন। আমার বৌ মালটিকে ছেড়ে দিন।
কাকলি: (অশোকের কাছে এসে) সত্যি বলছ? আমার জন্য এতটা স্যাক্রিফাইস করবে তুমি? প্রমিস?
অশোক: এতগুলো বছর যখন করতে পেরেছি, বাকি জীবনটাও নাহয় করব।
কাকলি: থ্যাঙ্ক ইউ অশোক! ইউ আর রিয়ালি আ ডার্লিং। সুখেনদা, আপনার মাল-বাবার মহিমা সত্যিই অপার! আমার এই বুড়ো মালটাকে চিনতে সাহায্য করেছে আমায়।
সুখেন: (কাকলিকে) তাহলে আমি -
কাকলি: হ্যাঁ সুখেনদা, আপনি এখন আসুন। আমি আমার মাল সামলে রাখি, আপনি আপনার মাল রাখুন।
সৌমেন: পুরোহিত বিদায় তো পেয়েই গেলেন, এবার বাড়ির দিকে রওয়ানা হোন। চলুন, আমিও আসছি আপনাকে সঙ্গ দেবার জন্য। এতবড় চোটটা সামলাতে মাল-বাবার অনেক করুণার প্রয়োজন হবে। আসি বৌদি, আসি অশোকদা!
কাকলি: বাই বাই সৌমেন! অ্যাণ্ড থ্যাঙ্ক ইউ ফর এভরিথিং!
(সুখেন ও সৌমেন বেরিয়ে যায়। কাকলি ও অশোক হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে থাকে। আলো নিভে যায়।)
সমাপ্ত