গ্রামের নাম হাঁপানিয়া।
অগ্রবর্তী গ্রামের নাম জিরানিয়া। গ্রীষ্মের হাঁ-ক্লান্ত পথিক জিরানিয়ায় দু-দণ্ড জিরিয়ে তবেই হাঁপানিয়ায় পৌঁছায়। ওখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থাটা মোটামুটি এইরকম --
প্রথমে যেতে হবে পাটুলি। ব্যাণ্ডেল-কাটোয়া ব্রাঞ্চ লাইনের ছোট স্টেশন। বড় স্টেশন বলতে ও লাইনে নবদ্বীপধাম। নবদ্বীপ থেকে ছয়টি স্টেশন। বিষ্ণুপ্রিয়া, ভাণ্ডার-টিকুরি, পূর্বস্থলি, ফলেয়া, লক্ষ্মীপুর, বেলেরহাট। এরপর পাটুলি। পাটুলি নেমে যেতে হবে পশ্চিমে। ভাগ্য ভাল থাকলে গো-শকট পাওয়া যাবে। নচেৎ যেতে হবে পায়ে হেঁটে। আল ভেঙে। পেরুতে হবে মাঠ, বিল, হাওড়। জুতো খুলে হাতে নিতে হবে। ভাঙা শামুকে পা কাটতে পারে নতুবা জোঁকে ধরতে পারে। তবু জুতো পরা চলবে না। এইভাবে ক্রোশ দেড়েক হাঁটতে পারলে আসবে কাটোয়া-নবদ্বীপ পাকা সড়ক। পাক্কিটা পার হয়ে আনুমানিক আরো এক ক্রোশ হাঁটতে পারলে হাঁপানে।
অগ্রহায়ণের এক ধোঁয়াটে সন্ধ্যায় সমরেশ পাটুলি স্টেশনে নেমে পড়ল। শিয়ালদা-শালার প্যাসেঞ্জারের শার্সি-ভাঙা জানলার পাশে বসে সে সারাটা বিকেল পাটক্ষেত দেখেছে। হকারদের কাছ থেকে কাঁচাগোল্লা কিনে খেয়েছে। নবদ্বীপের তাঁতিদের বোনা গামছা কিনেছে। এরপর সন্ধ্যার অন্ধকারে লেজে লাল ফুটকি জ্বেলে ট্রেনটা যখন শালারের দিকে ছুটে মিলিয়ে গেল, সমরেশ তখন স্টেশনের বাইরে এসে দাঁড়াল। পাট তার কাজের ক্ষেত্র। ভারতীয় পাট নিগম বছরের এই সময়টা চাষীদের কাছ থেকে সরকারী-দরে পাট কেনে। গরুরগাড়ির খোঁজে সে যখন জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে, ঠিক সেইসময় একজন লম্বা ঢ্যাঙা লোক হাতে হারিকেন ঝুলিয়ে এসে দাঁড়াল,
'স্যার, আমি ঘেঁটুচরণ।'
স্বল্পাহার শীর্ণ সংস্কারবিহীন চেহারা, কথায় একটু জড়তা, ধুতির উপর একটা মলিন বোতাম-খোলা জামা, ভাবলেশহীন চোখ। যৌবনের যে জ্যোতি যুবকদের থাকে তার কিছুই নেই। হাঁটছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। বিনা ভূমিকায় আগন্তুক আবার বলল,
'স্যার আমি ঘেঁটুচরণ, ওয়াচম্যান।'
ব্যাপারটা এবার পরিষ্কার হল। পাট ক্রয় কেন্দ্রের নাইট ওয়াচম্যান। হালকা কিছু কথাবার্তা বলে সমরেশ ঘেঁটুর সঙ্গে যাত্রা শুরু করল। ডাল ভাঙা ক্রোশ বলে দেশ পাড়াগাঁয়ে একটা কথা চালু আছে। আজ সন্ধ্যায় সেটা বাস্তবে জানা গেল। হাঁটছে তো হাঁটছেই। সমরেশ মাঝে মাঝে জিজ্ঞাসা করছে, ঘেঁটুচরণ আর কতদূর? সে তার উত্তরে ঘোঁৎ জাতীয় একটা শব্দ করছে। লোকটার কথাবার্তা হ্যাঁ বা না-র মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিংবা কে জানে গ্রামদেশে হয়তো চলতি অবস্থায় কথা কম বলার নিয়ম। এর উপর লক্ষ্য করার বিষয় ঘেঁটু একটু ভীতু গোছের। কোনো শব্দ হতেই দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। সমরেশ যখন বলছে, কি হল ঘেঁটুচরণ? তখন আবার হাঁটা শুরু করছে। সমরেশ আগেও লক্ষ্য করেছে রাতের প্রহরীরা একটু সন্দিগ্ধ প্রকৃতির হয়।
এক সময় ওরা ছোটখাটো একটা বিলের ধারে পৌঁছে গেল। বর্ষাকালে এর চেহারা রমরমা থাকলেও থাকতে পারে। এখন দেখাচ্ছে সরু ফিতের মতন। পায়ের পাতাও ভিজবে না।
'ঘেঁটুচরণ বিলের নাম কি?'
'কানা বিল'।
'নাম শুনেছি। এটা যে এখানে কে জানত।'
'বর্ষাকালে কানার চোখ ফোটে।'
'বিল পার হতে হবে?'
'আজ্ঞে, না স্যার। পাশ কাটিয়ে যাব।'
হঠাৎ পরিস্থিতি অন্যরকম হয়ে গেল। কার যেন নৈকট্য ঘেঁটুচরণকে উত্তেজিত করে তুলল। অতি উগ্র গন্ধে আশেপাশের ঝোপঝাড় ভরে গেল। এমন প্রখর বলিষ্ঠ আত্মঘোষণায় সমর্থ উগ্র ঝাঁঝালো গন্ধ সমরেশ আগে কখনো অনুভব করেনি। ঘেঁটুচরণের শরীর কাঁপছে। একসময় সে মাটিতে বসে পড়ল। কিছুটা ধাতস্থ হয়ে সে আবার উঠে বসল। অলীক গন্ধটা যেমন হঠাৎ এসেছিল, তেমন হঠাৎই চলে গেল। বাতাসে তখনও কিছুটা নেশার ঝাঁঝ। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সে বলল,
'চলুন স্যার'।
সমরেশ বেশ আশ্চর্য হয়েছে। ভয়ের ব্যাপারটা নিয়েই সে আলাপ করতে চায়। কিন্তু কিভাবে সেটা করা যায়। সরাসরি প্রসঙ্গটায় আসাও মুশকিল। ইতস্তত করে সে বলে,
'তুমি ভূত-টুত দেখ নাকি?'
'না স্যার, ভূত বলে কিছু নেই, ওগুলো হচ্ছে কুসংস্কার।'
'তবে ভয় পেলে কেন?'
'ওটা আমার অসুখ স্যার।'
'তুমি কিছু একটা লুকাচ্ছো।'
'না স্যার, তবে..'
'তবে কি?'
এতক্ষণ চলার পর এই প্রথম ঘেঁটুচরণ গ্রামদেশের নিয়ম ভেঙে দু-চারটে বাড়তি কথা বলে। এই ব্যাপারে তার জ্ঞানও বেশ টনটনে।
'ভোলায় ধরা বলে একটা জিনিস আছে, স্যার।'
'তোমায় ভোলায় ধরেছিল?'
'হ্যাঁ স্যার, এক সন্ধ্যায় এই মাঠ পার হতে গিয়ে কেমন যেন সব তালগোল পাকিয়ে যায়। এতদিনের চেনা পথ। তিন ক্রোশ রাস্তা, ছ-ক্রোশ হাঁটা হয়ে গেল। কোথায় বাড়ি, কোথায় বা গাঁ, ঠাওর হয়নি।'
'কাউকে দেখেছিলে সামনে?'
'না স্যার, সাধারণ মানুষ দেখে না।'
'দেখনি? তবে কাদের কথা বলছ?'
'চোখে দেখিনি স্যার, কিন্তু গন্ধ পাই। মাঝে মাঝেই পাই। একটা গন্ধ অন্তত চার-পাঁচ বছর ধরে আমার পিছু হাঁটছে।'
সমরেশ অবাক হয়ে ঘেঁটুচরণের কথা শুনছিল। এসব কথা আর কখনও শোনেনি সমরেশ। তার অধীত বিদ্যা ও জ্ঞানগম্যি পাট-গবেষণা ও কেনা বেচার মধ্যেই সীমিত। অবৈজ্ঞানিক কোনো কিছুই সে জীবনে গ্রহণ করেনি। আর যে পথে এই কথোপকথন চলছে, এর পারিপার্শ্বিক অবস্থা এই কথার উপযুক্ত। দিগন্ত বিস্তৃত চষা মাঠ, উন্মুক্ত বিল, জনশূন্য পথ। হারিকেন হাতে পাগল গোছের একটা লোক অদ্ভুত ধরণের কথা বলছে। প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্য সমরেশ বলল,
'আর কতদূর ঘেঁটুচরণ?'
'হাঁপানে, ঐ তো দেখা যায়।'
নিঃশব্দে পাকা সড়কটা পার হয়ে যায় ওরা। এরপরও সমরেশ প্রায় এক ক্রোশ হেঁটেছে।
বাণিজ্যিক ভাবে পাটের ব্যবহার এদেশে যে কবে শুরু হয়েছিল জানা নেই। তবে বাইবেল, মনু সঙ্ঘিতা এমনকি মহাভারতেও পট্টবস্ত্র ব্যবহারের কথা বলা আছে। পাটের আবাদ ও রপ্তানির একচেটিয়া সুবিধার জন্য, দেশি ব্যবসায়িরা প্রত্যন্ত গ্রামে তৈরি করত প্রাসাদপম অট্টালিকা। তারই একটিকে ভাড়া নিয়ে সরকারি পাট-ক্রয়-কেন্দ্র। চলতি নাম সেন্টার। সেন্টারের লাগোয়া থাকার ব্যবস্থা। যে হাঁপানিয়াকে অজপাড়াগাঁ বললেও সম্মান দেখানো হয়, সেখানে সেন্টারের সুবাদে সৌরশক্তিতে আলো, পর্যাপ্ত জল আর অনিয়ন্ত্রিত প্রাকৃতিক হাওয়া। একজন আবাসিক ম্যানেজার, করণিক ও একজন ওয়াচম্যান বা প্রহরী নিয়ে দপ্তর। পাট কেনা শুরু হয় অগস্টের শেষ সপ্তাহ থেকে। সেই সময় সদর দপ্তর কলকাতা থেকে আসেন একজন সিনিয়র ইনস্পেক্টর পারচেজ্ বা ক্রয়-আধিকারিক। এবছর পাটের সরকারি দর কিছুটা ভালো, কুইন্টাল প্রতি সতেরোশো তেত্রিশ টাকা। বাজারের দর একুশশো ছাড়িয়েছে। বর্ধমান জেলাকে অনেকে লক্ষ্মীর বাথান বলে আখ্যা দেয়। হাঁপানিয়ার অবস্থিতি বর্ধমান জেলায় হলেও প্রাতিবেশী নদীয়া জেলার মহীশুড়া, গাঁইঘাটা ও নবদ্বীপ থেকে পাট আসে গরুর গাড়িতে।
সকালবেলাটা পাটের দরাদরি করে মোটামুটি ভালই কাটে সমরেশের। একগাদা বই সঙ্গে করে এনেছে। বই পড়া, খুব বেশি ইচ্ছা করলে খাতা-কলম নিয়ে বসা - এই তার দ্বিপ্রাহরিক কাজ। পাট সংক্রান্ত একটি গবেষণামূলক প্রবন্ধে সে সম্প্রতি হাত দিয়েছে। নতুন পরিবেশে যদি লিখতে ইচ্ছে হয়, তাই অর্ধসমাপ্ত পাণ্ডুলিপি সঙ্গে করে এনেছে। নতুন জল-হাওয়ার কারণেই হোক বা অন্য কোনও কারণে সমরেশ অর্ধসমাপ্ত পাণ্ডুলিপি নিয়ে বসল। চারিদিকে সোনালি রঙের পাটের গাঁঠরি। এরই মাঝে নব্য আধিকারিকটি সারাদিন লেখালিখি, কাটাকুটি করে। সময়টা বড় চমৎকার কাটতে লাগল। লেখার ব্যাপারে আগ্রহ বাড়ছে।
এক দুপুরের কথা। সমরেশ একমনে লিখছে। পাটের গাঁঠরির ওপাশে খুট করে শব্দ হল। তাকিয়ে দেখে ঘেঁটুচরণ গভীর আগ্রহে তার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ পড়তেই সমরেশ বলল,
'কি ব্যাপার, সেদিনের পর থেকে যে দেখা নেই?'
ঘেঁটুচরণ চট করে গাঁঠরির পিছনে সরে গেল। সমরেশ বলল, 'চলে গেলে নাকি?'
ও আড়াল থেকে বলল, 'না'।
'এসো ভিতরে এসো।'
'না।'
আর কোনো কথাবার্তা হল না। সমরেশ লেখায় ডুবে গেল। ডাহুক ডাকা দুপুরে পল্লীগ্রামের শান্ত পরিবেশে লেখালিখির আনন্দই আলাদা। ঘেঁটুচরণের কথা ভুলে গেল সে। পরদিন আবার একই ব্যাপার। পাটের গাঁঠরির ওপাশ থেকে ঘেঁটুচরণ বড় বড় কৌতুহলী চোখে তাকিয়ে। সমরেশ ডাকল,
'এসো ভিতরে এসো।'
সে বলল, 'না।'
রাতে সেন্টারের ম্যানেজার তালুকদারের ওখানে খাবার কথা ছিল। ভদ্রলোক হাঁপানিয়াতে ঘরভাড়া নিয়ে আছেন। বর্ধমান জেলারই লোক। কী কারণে ঘেঁটুচরণের উপর ভীষণ চটা। খেতে খেতে বললেন,
'ঘেঁটু আপনার কাছে আসে নাকি? ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে দেবেন না। বদমাইসটা জিন্ পোষে।'
'জিন্? আপনি বিশ্বাস করেন নাকি?'
'আগে করতাম না। তবে বদমাইসটা ঘরে ঢুকলেই যা ঘটে তা কহতব্য নয়। ওর সঙ্গে যে থাকে তার অবয়ব আমাদের দেখায় না ঠিকই, কিন্তু নানা ভাবে সে জানান দেয় যে সে প্রবল ভাবে ঘরে উপস্থিত। উগ্র ছাতিম ফুলের গন্ধে ঘর ভরে যায়। সামনের দরজা বারবার খুলে দিয়ে, বাথরুমের দরজায় প্রবল ধাক্কার পর ধাক্কা দিয়ে সে তার অস্তিত্ব জাহির করে। ও চলে গেলেও ঝাঁঝালো গন্ধটা আর যায় না।'
একটু থেমে তালুকদার আবার বললেন, 'আরে মশাই ও হল অন্ধকার জগতের লোক।'
কথাটার মধ্যে একটা ব্যঞ্জনা ছিল, ধরা গেল না। ঘেঁটুচরণের জীবনে যে একটা বিশেষ ঘটনা আছে তা অবশ্য জানা গেল কয়েকদিন পরে, ওই ম্যানেজার সাহেবের কাছেই। ঘটনাটা মোটামুটি এইরকম -
হতদরিদ্র বাড়ির ছেলে ঘেঁটুচরণ ভর্তি হয়েছিল পাঁটুলি হাইস্কুলে। স্কুল যেতে হুত মাঠ-বিল-রেললাইন পার হয়ে। গঙ্গার ধারে প্রাচীন স্কুল। পড়াশুনোয় অমনোযোগী ঘেঁটুর প্রাত্যহিক কাজ ছিল কিছুটা ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বিনাটিকিটে ট্রেনে ভ্রমণ করা। ট্রেনে চড়ে সে চলে যেত কখনো ব্যান্ডেল কখনো বা কাটোয়া। সপ্তম শ্রেণিতে ওঠার আগেই প্রায় - অভিভাবকহীন ঘেঁটুর নাম স্কুল থেকে কেটে গেল। তখন ঘেঁটুর ট্রেনে চড়া আরো বেড়ে গেল। মানুষ গতির দাস। ট্রেনের গতির সাথে পাল্লা দিয়ে সে ঝুলত। রেললাইনের পাশের লোহার পিলার গুলো তার চুল ছুঁয়ে যেত। তাতে ঘেঁটুর নেশা আরও বেড়ে যেত।
একদিন অসাবধানে মাথা তার ঠুকে গেল ওভারব্রিজে। কাটোয়া স্টেশনের আগে এক কাটা-খালের উপর রেলের সেতু। সেতুর দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে সে পড়ল নিচে, খালের নরম মাটিতে। মাটিতে পড়ে সে ছটফট করছিল। খালের জলে মাছ ধরছিল কিছু ধীবর শ্রেণির লোক। তারাই ছুটে আসে। ঘেঁটুর মাথা ফেটে রক্ত পড়ছিল। ওরা সবাই মিলে ধরে সংজ্ঞাহীন ঘেঁটুকে সাইকেল ভ্যানে তুলে নিয়ে যায় হাসপাতালে। হাসপাতালে আসার কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘেঁটু মারা গেল। হাসপাতালে জন্ম ও মৃত্যু দুটোই স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করা হয়। মরা মানুষ যত তাড়াতাড়ি তার আত্মীয়-স্বজনের হাতে তুলে দেওয়া যায় ততই ভালো। ঘেঁটুর কোনো আত্মীয়-স্বজন নেই। কাজেই ওর জায়গা হল গাদাঘরে, লাশ রাখার ড্রয়ারে। এটাই হাসপাতালের স্বাভাবিক রীতি। অস্বাভাবিক ব্যাপারটা শুরু হল পরদিন সকালে। যে ধীবর শ্রেণির লোকেরা ঘেঁটুকে পৌঁছে দিয়েছিল, তারা এসে ঘেঁটুকে দেখতে চাইল। তাদের একজন কিভাবে যেন দেখেছে যে তিনটে মৃতদেহের উপরে জ্যান্ত ঘেঁটুকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। বলাই বাহুল্য, হাসপাতালের কেউ তাদের পাত্তা দিল না। কিন্তু লোকগুলো বাইরে থেকে লোক জুটিয়ে এমন হইচই বাঁধিয়ে দিল যে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বাধ্য হল গাদা-ঘর খুলে দিতে।
ঘর খোলা হল। অস্বাভাবিক দৃশ্য।
সারি সারি লাশকাটা ড্রয়ার। মেঝেতেও অনেকগুলো প্রাণহীন দেহ পড়ে আছে। এরই মাঝে আধখোলা একটি ড্রয়ার থেকে মুমুর্ষু একটি হাতের চারটে আঙুল বেরিয়ে আছে। সরোষে জানান দিচ্ছে জীবনের অস্তিত্ব, নিঃশব্দে ভিক্ষা করছে অবশিষ্ট আয়ু।
জীবন ও মৃত্যুর মধ্যবর্তী দেরাজটি উন্মোচিত হল। যা ঘটে তাকে অস্বীকার করা যায় কি করে? দেখা গেল ঘর্মাক্ত একটি ছেলে দেরাজে স্বল্প-পরিসরে চোখ খুলে শুয়ে আছে। জানান দিচ্ছে যে সে 'ভীষণভাবে জীবিত'।
এই হল ঘেঁটুচরণের গল্প। সমরেশের টানা লেখালেখিতে এইবার ছেদ পড়ল। কিছুতেই সে আর লিখতে পারে না। সবসময় মনে হয় কিশোর একটি ছেলে হাসপাতালের গাদাঘরে জ্ঞান ফিরে জেগে উঠে কি দেখল। মাত্র পঞ্চাশ স্কোয়ার ফিটের দেরাজে শুয়ে তার মনের অনুভূতিটাই কেমন ছিল। তালুকদারকে একদিন জিজ্ঞাসা করল,
'ঘেঁটুর চাকরিটা কেমন ভাবে হল?'
'সে একরকম কাকতালীয়। এত বড় অট্টালিকা যখন পাটনিগম ভাড়া নিল, তখন রাতের প্রহরীর জন্য লোক খোঁজা শুরু হল। প্রাসাদ থাকবে, অথচ ভূত থাকবে না, তা কখনো হয়? প্রথম প্রথম যারা এল, তারা ভয় পেত। মৃত ব্যবসায়ীদের আত্মারাই নাকি মায়া ত্যাগ করতে পারেনি বাড়িটির। মাঝে মাঝে তারাই দেখা দেয়। এই সময়ে ডাক পড়ল ঘেঁটুচরণের। সে এমনিতেই রাত-চরা। ঘেঁটু নাইট-ওয়াচম্যান হবার পর, ইদানীং আর শোনা যায় না কোনো অভিযোগ।'
কলকাতা ফেরার দিন এগিয়ে এল। এ বছর ফসল ভাল। প্রচুর পাট কেনা হয়েছে। নিগমের গুদাম প্রায় ভরে উঠেছে। সমরেশের লেখার সাময়িক ছেদ পড়লেও অবশিষ্টটা সম্পূর্ণ করে এনেছে সে। শুধু একটা কৌতূহল এখনো নিরসন হয়নি তার। এর জন্য ঘেঁটুচরণের সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন।
একটা গো-শকট ভাড়া নেওয়া হল। সম্বুক-গতির গো-শকট ক্যাচ ক্যাচ শব্দ তুলে অলস মধ্যাহ্নে সমরেশকে নিয়ে যাত্রা করল। ঘেঁটুচরণ বসেছে সামনে, গাড়োয়ানের পাশে। ঘেঁটুকে যাই জিজ্ঞাসা করা যায়, সে হ্যাঁ অথবা না এর মধ্যেই উত্তর দেয়। গো-শকটে যাত্রা মোটেই সুখকর নয়। অসমতল মেঠো রাস্তায় অনভ্যস্ত যাত্রী। বড়ডাঙার ধারে জিরানিয়ায় পৌঁছে সমরেশ নেমে পড়ল রাস্তায়। বাকি রাস্তাটা হেঁটেই চলল গোরুর গাড়ির পাশাপাশি। স্টেশনে পৌঁছেই সমরেশ ঘেঁটুকে বলল,
'তোমার সঙ্গে কয়েকটা কথা বলি, উত্তর দেবে তো?'
'কি কথা?'
'হাসপাতালের কথা'।
ঘেঁটু চুপ করে রইল। সম্ভবত এই ভয়ের স্মৃতিটা সে ভাগ করতে চায় না। সমরেশ তবু বলল,
'হাসপাতালের গাদা ঘরে তোমার যখন জ্ঞান ফিরল, তখন কী দেখলে?'
'অন্ধকার'।
'ভয় করল না?'
'না'।
'কেন?'
'আমার সঙ্গে আরেকজন ছিল।'
'কে ছিল?'
'চোখে দেখা যায় না, স্যার। সাধারণ মানুষ দেখে না। তবে তার গায়ে একটা গন্ধ ছিল।'
'কেমন গন্ধ?'
'ঝাঁঝালো মিষ্টি গন্ধ।'
'কেমন ঝাঁঝ?'
ঘেঁটুচরণ চুপ করে রইল। এই শহুরে বাবুটির কৌতূহল মেটানোর ভাষা তার সঞ্চয় নেই। তাছাড়া যে ধূসর জগরতের দরজায় করাঘাত করে সে ফিরে এসেছে, সেই রহস্যের অধিকার তার নিজের। কারও অনুপ্রবেশ সেখানে অভিপ্রেত নয়।