ক্লাস ইলেভেনে উঠে নতুন স্কুলে পড়তে যাওয়াটা মোটেও সুখের নয়। তার উপর আবার ছোট শহরের ছোট স্কুল। মা বাবার উপর আবিরের যা রাগ হচ্ছিল তা আর বলবার নয়। বাবার বদলির চাকরি। অনেক বলে কয়েও এ বছরের বদলিটা ঠেকাতে পারেনি। তা পারেনি তো পারেনি, আবিরকে তো কলকাতার কোন একটা স্কুলের হোস্টেলে রেখে দিতে পারতো! তা না, মার ধারণা কলকাতার স্কুলের হোস্টেলগুলোতে ওর বয়সী ছেলেরা সব উচ্ছন্নে যায়! কে বোঝাবে? মা-বাবা তার কথায় কানও দেয়নি-তাদের মতে ভাল করে পড়াশোনা করলে স্কুলটা কোনও ফ্যাক্টরই নয়! অগত্যা স্কুল বদল।
আবির পড়াশোনায় বেশ ভালো তবে তার খেলাধুলোর দিকে মনটা একটু বেশি। আগের স্কুলটা মফস্বলের হলেও বেশ ভালো ছিল। বেশ একটা প্রতিযোগিতার ভাব ছিল প্রথম সারির সবার মধ্যে, আর সেটা ছিল শুধু ছেলেদের স্কুল। নতুন স্কুলে ছেলে মেয়ে দুইই পড়ে, মানে কোএডুকেশান স্কুল। কয়েকদিন ক্লাস করেই আবির রেগে-মেগে মাকে এসে বলল, “মেয়েদের কোন স্পোর্টসম্যান স্পিরিট নেই! প্র্যাক্টিকাল ক্লাসে প্র্যাক্টিকাল না করতে পারলে স্যারেদের কাছে গিয়ে কান্নাকাটি করে! আর স্যারেরাও যেন কেমন, ওমনি এসে ওদের এক্সপেরিমেন্টগুলো করে দেন। তখন তাদের সে কী হাসি! ক্লাসের টেস্টে গার্গী কম নম্বর পেয়ে এমন কাঁদল যে স্যার ওর নম্বর বাড়িয়ে দিলেন!”
সব শুনে মা হাসল, কিছু বলল না, হয়তো মা নিজেও মেয়ে বলে!
ঊর্মি ক্লাস শুরু হওয়ার কয়েকদিন পর এসে ভর্তি হল। প্রথম যে-দিন ও ক্লাসে এলো, বেশ হই চই পড়ে গিয়েছিল। ঊর্মি যেমন লম্বা তেমনি ফর্সা আর সুন্দরী। তাই ঊর্মিকে নিয়ে সবার কৌতূহলের শেষ নেই। সে নাকি অনেক দূর থেকে আসে প্রচুর কষ্ট করে–-এমন অনেক কথাই শুনতে পাওয়া গেল তাকে নিয়ে। ঊর্মি নিজে কিন্তু খুব কম কথা বলে, আর আবিরের যেটা সব চেয়ে খারাপ লাগে সেটা হল ওর মুখে হাসি নেই। অমন সুন্দর মুখ কিন্তু সব সময়ই কেম যেন গোমড়া আর দুঃখ দুঃখ ভাব।
সেদিন ক্রিকেট খেলা দেখতে গিয়ে জ্যামিতির হোমওয়ার্কটা করা হয়নি, তাই প্রার্থনার আগে বসে আবির চটপট সেটা করছিল। এদিকে ঘন্টা পড়ে গেছে, কোনরকমে হোমওয়ার্কটা সেরে ক্লাস থেকে বেরোতে গিয়ে একটা শব্দ শুনে আবির ফিরে তাকাল। ঊর্মি একা বসে আছে ডেস্কের উপর মাথা রেখে!
“প্রার্থনার সময় হয়ে গেছে, যাবি না?”
কোনও উত্তর নেই।
“কি রে শরীর খারাপ?” আবার জিজ্ঞেস করল আবির।
এইবার ‘না’ বলে কোন রকমে একবার মুখ তুলেই আবার মুখ লুকোলো সে। কিন্তু ততক্ষণে আবির দেখে ফেলেছে, ঊর্মি কাঁদছে। আবির আর ওকে না ঘাঁটিয়ে তাড়াতাড়ি প্রার্থনা করতে চলে গেল।
সেদিন লাস্ট পিরিয়েডে বাংলা ছিল। বাইরে প্রবল বৃষ্টি। সবাই স্যারকে ধরল, “স্যার আজকে আর পড়ব না, আজ আপনি একটা গল্প বলুন।”
স্যার বললেন, “না, না, তা হবে না। রোজই তো আমি বলি আজ আমি শুধু শুনব, তোমাদের মধ্যে কেউ গল্প বলো।”
অনেক তর্কবিতর্কের পর আবির উঠল গল্প বলতে। (পরে আবির অনেকবার ভেবেছে, কেন সে ওই রকম কাজ করল, কিন্তু কোনও উত্তর পায়নি।)
গল্প বলতে শুরু করে আবির ইনিয়ে-বিনিয়ে-ফেনিয়ে ঊর্মির গল্প বলে ফেলল। শেষ করল, “তারপর একদিন মেয়েটা ক্লাসে বসে খুব কাঁদছিল!” বলে।
সবাই হই হই করে উঠল, “তারপর? তারপর?”
“তারপর তো আর জানি না!”
“দূর তা আবার হয় নাকি! গল্পের তো একটা শেষ থাকতে হয়! ওই রকম মাঝপথে ছেড়ে দেওয়াটা খুব অন্যায় হচ্ছে তোর!”
বন্ধুরা যখন নাছোড়বান্দা তখন আবির বলল, “আমি আর একটা কথাই বলতে পারি, সেই মেয়েটা এই ক্লাসেই পড়ে!”
ক্লাসে আবির আর মুখ খোলেনি। বাংলাস্যার ক্লাসকে শান্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা করলেন, তারপর ছুটির ঘন্টা পড়ে যেতে সবাই বাড়ি চলে গেল।
আবিরের সেই গল্প বলার জল অবশ্য অনেকদূর পর্যন্ত গড়াল।
পরের দিন আবির ওর ডেস্কে একটা চিরকুট পেল। তাতে গোটা গোটা অক্ষরে শুধু লেখা আছে-– ‘তোর কাছ থেকে এই রকমটা আশা করিনি।’
আবিরের ভারি রাগ হল। সামনা সামনি কথা বললেই হত, লুকিয়ে লুকিয়ে চিরকুট দেবার কি দরকার ছিল? যত্ত সব! মেয়েটার সাথে একবার কথা বলতে হবে ভেবে আবির খেলতে চলে গেল। সেদিন তালেগোলে আর কথা বলা হল না।
ছুটির পর একটা ছেলে এসে বলে গেল, “আবিরদা, বাংলা স্যার তোমাকে স্টাফ রুমে ডাকছেন।”
আবির কিছুটা ভয়ে ভয়েই গেল। স্যার ওকে দেখে বললেন, “এসো আবির, তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে। দাঁড়াও এক মিনিট, তুমি বাড়ি যাবে তো? আমিও যাচ্ছি, যেতে যেতে তোমার সাথে কথা হবে।”
সাইকেল ঠেলে বাড়ি যেতে যেতে স্যার বললেন, “সেদিন কাজটা তুমি ঠিক করনি আবির! তুমি যে ঊর্মির কথা বলছিলে সেটা আমি বুঝতে পেরেছিলাম, হয়তো ক্লাসের অন্য অনেকেই বুঝেছে। তুমি জানো না মেয়েটার পড়াশোনা করার অদম্য ইচ্ছার কথা। ওর থ্যালিসিমিয়া আছে। লোহিতকণিকায় কি একটা প্রোটিনের অভাব যার জন্যে ওকে ঘনঘন রক্ত নিতে হয়। ও কতদিন বাঁচবে তা ও নিজেই জানে না। অনেক দূর থেকে আসে স্কুলে। ক্লাস টেনে ভালো ফল করেছিল ও কিন্তু ওদের গ্রামে ইলেভেন টুয়েলভ পড়ার মতন স্কুল নেই।”
বাংলা স্যার ঊর্মির কথা বলতেই থাকলেন। আবির চুপ করে শুনল।
“ওদের অভাবের সংসার, অনেকগুলো ভাইবোন। ওর বাবার ক্ষমতা নেই ওকে বারবার বড়ো শহরে নিয়ে গিয়ে রক্ত বদল করাবার, কিন্তু ঊর্মি পড়তে চায় বলে হাজার কষ্ট হলেও স্কুলে আসে। ওর মার আবার হার্টের অসুখ দেখা দিয়েছে, বোধহয় পেসমেকার বসাতে হবে। ওকে কাঁদতে দেখেছ বলে তুমি ওকে নিয়ে ঠাট্টা করো না, ওর কাঁদার সত্যি কারণ আছে। তুমি পারলে ওর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিও।”
বাংলাস্যার বাড়ি চলে গেলেন। আবার আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল। আবির সাইকেল ঠেলতে ঠেলতেই বাড়ির দিকে চলল। ভিজে একেবারে জবজবে হয়ে বাড়ি ঢুকল। মন খারাপ লাগছিল, কেন যে ওর মাথায় সেদিন ওই রকম ভুত চেপেছিল!
সেদিন রাতে আবিরের খুব জ্বর এলো। সেই জ্বর তাকে ভোগালো বেশ কিছুদিন। এক সপ্তাহ বাদে যখন জ্বর ছাড়ল তখন সে স্কুলে এসে শুনল যে ঊর্মি দুদিন ধরে আসছে না।
মাসখানেক বাদে স্কুলে খবর এলো সে মারা গেছে।
খবরটা শুনে লুকিয়ে লুকিয়ে কেঁদেছিল আবির, ইস যদি শুধু ‘সরি’ টুকু বলার সুযোগটা পেত!
আবির এখন খুব মন দিয়ে পড়াশোনা করছে। ওকে ডাক্তার হতেই হবে। থ্যালিসিমিয়ার রুগীদের বিনা পয়সায় চিকিৎসা না করা পর্যন্ত তার মনে শান্তি নেই!
তাদের সেবা করার মধ্যে দিয়েই আবির প্রতিদিন বলবে, “ঊর্মি, আমি দুঃখিত।”