টেক্কা আর টুই যমজ ভাই বোন। দুজনের একদিনেই জন্মদিন তাই ওদের খুব রাগ। একটাই জন্মদিনের পার্টি হয় ওদের জন্যে তাই সব কিছু ভাগ হয়ে যায়। একটা কেক ভাগাভাগি করে নাও, হ্যাপি বার্থডে গানও একবারই গাওয়া হবে দুজনের নাম দিয়ে আর ওদের সব চেয়ে বেশি রাগ উপহারগুলো ভাগ করে নিতে। কেউ কেউ দুটো জিনিস আনে বটে কিন্তু বেশিরভাগ লোকই একটা উপহার আনে দুজনের জন্যে। এবারের জন্মদিনে মিনুমাসি এক বাক্স চকোলেট দিয়েছেন ওদের দুজনের জন্যে। টেক্কা নিজের ভাগের অর্ধেকটা হাঁউ হাঁউ করে খেয়ে নিয়ে টুইর ভাগে হাত দিল। আর যাবে কোথায়? ধুন্ধুমার লেগে গেল। বাবার অফিসের রতনকাকু একটা বড়সড় ডল-পুতুল উপহার স্বরূপ নিয়ে এসেছিলেন। উপহারটা খুলতেই টেক্কার মুখ কালো হয়ে গেল।
টুই খিল খিল করে হেসে বলল, “নে এবার আমার সাথে ভাগ করে নে! আমি সপ্তাহে চার দিন এটা নিয়ে খেলব আর বাকি তিন দিন তোর!”
টেক্কা রেগে গিয়ে বলল, “বয়েই গেছে আমার ওইসব মেয়েলি পুতুলখেলা খেলতে! তুই থাক তোর পুতুল নিয়ে, চাই না আমার। তবে ঝুমামাসি নবীনমেসোর দেওয়া কমিক্সগুলো কিন্তু আমার, ওগুলোতে তুই হাত দিবি না মোটেই!”
টুই ফোঁস করে উঠল, “তোর পুতুল খেলার ইচ্ছে নেই ঠিক আছে তা বলে আমি কমিক্স পড়ব না কোন দুঃখে? আমি পড়ব পড়ব পড়ব, একশোবার পড়ব!”
ব্যস আবার শুরু হয়ে গেল মারামারি, চুল ধরে টানাটানি, কিল, চড়, ঘুঁষি!
ছোটকাকু ওদের বাড়িতে এসে রয়েছেন দু দিন হল। কি একটা চাকরির ইন্টারভিউ দিতে। ওদের ওই রকম মারামারি করতে দেখে বললেন, “তোরা জন্মদিনে কি পেলি না পেলি সেই নিয়ে ওই রকম ঝগড়া করছিস কিন্তু ভেবে দেখ একবার, একদিনে হলেও তোদের জন্মদিন তো হয় কিন্তু এমনও তো লোক আছে যাদের জন্মদিন পালনই হয় না!”
টেক্কা শুনে বলল, “কে সে?”
“কেন তোদের দিদা!”
টেক্কা-টুই ভেবে দেখল সত্যি তো! বাবার জন্মদিন হয়, মা সেদিন ভালো ভালো সব রান্না করেন। কেক তৈরি হয়। মার জন্মদিনে মাকে যাতে রান্নাঘরে বেশি সময় না কাটাতে হয় তাই ওরা সবাই বাইরে খেতে যায় কিন্তু দিদার জন্মদিন তো কোনদিন হয় না! মারামারি থামিয়ে টেক্কা আর টুই দিদার কাছে তার ঘরে ছুটল। দিদা আলনায় কাপড় ভাঁজ করে রাখছিলেন, ওদের দেখে বললেন, “কি গো দাদুভাই দিদিভাই আজ তোমরা খেলতে যাচ্ছ না?”
টেক্কা-টুই সেই কথায় কান না দিয়েই বলল, “দিদা তোমার জন্মদিন হয় না কেন?”
দিদা হেসে ফেললেন, বললেন, “দুর দুর, বুড়ো মানুষের আবার জন্মদিন!”
“না, না তোমার জন্মদিন কবে বলো!”
“সে কি আর মনে আছে নাকি! মা বেঁচে থাকলে হয় তো বাংলা মাসটা বলতে পারতেন। তবে সঠিক কোন দিন তা মারও হয় তো মনে ছিল না। আমরা তো গ্রামে মানুষ হয়েছি, তখন ওখানে ওসব জন্মদিন টন্মদিনের বহর ছিল না।”
টুই লাফিয়ে উঠল, “ঠিক আছে দিদা, এবার আমরা তোমার জন্মদিন করব! সব লোকজন আসবে, কেক কাটা হবে। খুব মজা হবে!”
টেক্কা যোগ দিল, “হ্যাঁ, আগামী পঁচিশে বৈশাখ করলে কেমন হয়? সেদিন রবি ঠাকুরেরও জন্মদিন।”
বলে গলা ছেড়ে গাইতে লাগল, “চির নূতনেরে দিল ডাক...পঁচিশে বৈশাখ!”
টুই মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, “না, সেদিন হবে না আমার নাচের অনুষ্ঠান আছে। তাছাড়া সেদিন চারিদিকে ফাংশান। সবাই কিছু না কিছু করছে কেউ আসতে পারবে না। তার চেয়ে বরং তেইশে জানুয়ারি নেতাজি জয়ন্তির দিন করলে ভালো হবে।”
“না, না, ওটাতে এখন অনেক দেরি। তত দিনে ভুলে যাবো!”
ওদের তারিখ নিয়ে কথা কাটা কাটি থামিয়ে দিয়ে দিদা বললেন, “দাদুভাই, দিদিভাই শোনো। আমার জন্মদিন করে কি হবে, আমি তো বুড়ি হয়ে গেছি, চুল পেকেছে, দাঁত পড়েছে। তা তোমরা যদি কারো জন্মদিন করতেই চাও তাহলে না হয় নকুল আর নমিতার জন্মদিন করে দিও একদিন। ওদের তো কোনদিন জন্মদিন হয় না। তোমরা যখন কেক কাটছিলে উপহার খুলছিলে তখন ওরা হাঁ করে দেখছিল, ভারি মায়া লাগছিল তখন আমার।”
নকুল আর নমিতা ওদের বাড়ির কাজের লোক যশোদা মাসির ছেলে মেয়ে। নকুলের বয়স সাত কি আট আর নমিতা আরো ছোটো।
ব্যাস যেমন শোনা তেমনি কাজ। টেক্কা আর টুই মাকে গিয়ে ধরল, “মা, কালকে নকুল আর নামিতার জন্মদিন হবে তুমি একটা কেক করে দিও!”
যশোদামাসি সিঙ্কে বাসন ধুচ্ছিল, শুনে হাঁ হাঁ করে উঠল, “না, না ওসব করতে যেও না! একবার ওদের মাথায় ওই সব ঢুকলে আর রক্ষে থাকবে না। আমরা গরীব মানুষ আমাদের ওসব করা সহ্য হবে না।”
নকুল আর নমিতা দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে শুনছে দেখে মা বললেন, “থাক যশোদা এবারটা না হয় হোক। ওরাও একটু আনন্দ করুক। আমি কেক বানিয়ে দেব খন। লোকজন ডাকা হবে না, আমরাই থাকব তাই তোমার ভয়ের কিছু নেই!”
পরদিন স্কুল থেকে ফিরেই টেক্কা আর টুই নকুল আর নমিতাকে কি উপহার দেবে তাই নিয়ে জল্পনা কল্পনা করতে লাগল, যা দেবে সেটাকে আবার রঙচঙে কাগজ দিয়ে মুড়তে হবে তো!
বেশ মজা করেই জন্মদিন হল নকুল আর নমিতার। সবাই হ্যাপি বার্থডে গান গাইল। মোমবাতি দেওয়া কেক কাটতে কাটতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল ওদের দুজনের মুখ। তারপর সবাই কেক আর সিঙাড়া খেলো। ছোটকাকু ওদের দুজনকে চকোলেট উপহার দিলেন।
টেক্কা আর টুইর দেওয়া উপহার দুটো দেখে নমিতা আর নকুল তো থ! নকুলের জন্যে একটা ঝকঝকে খেলনাগাড়ি আর নমিতার জন্যে রতনকাকুর দেওয়া পুতুলটা!
নকুল আর নমিতা উপহার নিয়ে লাফাতে লাফাতে চলে যাওয়ার পর ছোটকাকু বললেন, “ওই উপহারগুলো নিয়ে কালকেই তোরা কত ঝগড়া করছিলি আর আজকেই ওগুলো দিয়ে দিলি? মন খারাপ করল না?”
টুই চোখ কপালে তুলে বলল, “টেক্কার সাথে ঝগড়া করার অভ্যাস হয়ে গেছে তো তাই করি তা না হলে আমার তো রাশি রাশি খেলনা আর পুতুল। নমিতার তো একটাও ভাল খেলনা নেই তাই ওকে দিয়ে দিলাম!”
টেক্কাও যোগ দিল, “আমারও তো এত গাড়ি, মা বলে ঘরে রাখার জায়গা নেই...!”
“হ্যাঁ বুঝেছি! তা কাজটা ভালই করেছিস তোরা!”
দিদা মুখে কিছু বললেন না বটে কিন্তু মাথায় হাত দিয়ে দুজনকে আশীর্বাদ করলেন।
“স্যার আপনার সাথে একজন দেখা করতে এসেছেন। আগে কখনও দেখিনি। বললেন পার্সোনাল দরকার। আসতে দেবো?”
সেক্রেটারির কথায় কিংশুক মল্লিক হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, “দাও। তবে আমার হাতে মাত্র দশ মিনিট সময় আছে সেটা বলে দিও কিন্তু।” বলে কাজে মন দিলেন।
পায়ের শব্দ শুনে চোখ তুলে তাকালেন তিনি। একজন অপরিচিত ভদ্রলোক হাত তুলে নমস্কারের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন।
“হ্যাঁ বলুন কি দরকার?”
“টেক্কাদা? আমি নকুল!”
“নকুল?”
“হ্যাঁ, তোমাদের বাড়িতে কাজ করত আমার মা...?”
“ও হো হো হো, যশোদামাসির ছেলে নকুল! তা কেমন আছিস? কি করছিস আজকাল?”
“পড়াশোনাটা শেষ করেছি। একটা স্কুলে পড়াই। নমিতার বিয়ে দিয়েছি।”
“বেশ বেশ! মাসি কেমন আছে?”
“ভালো আছে, আমার সাথেই থাকে।”
কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে নকুল আবার বলল “টেক্কাদা, আমার একটা অনুরোধ তোমাকে রাখতেই হবে! আমার ছেলেটার পাঁচ বছরের জন্মদিন আগামি মাসের দশ তারিখ, তোমাকে কিন্তু আসতেই হবে! টুইদি শুনলাম বম্বেতে থাকে তাই ওকে তো ডাকতে পারব না, তুমি যদি এসে ছেলেটাকে আশীর্বাদ করো... তোমরা আমাদের জন্যে সেদিন যা করেছিলে আমরা কোনদিনও ভুলব না। তোমরা তো বদলি হয়ে চলে গেলে তারপরেই কিন্তু ছেলেবেলার ওই একটা মুহূর্ত আমাদের কাছে স্বর্ণিম স্মৃতি হয়ে রয়ে গেছে! জানো ওই গাড়ি আর পুতুলটা আমি আর নমিতা আজও সামলে রেখেছি!”