নীললোহিত চিরকালের মতো হারিয়ে গেলেন, সেই দিক্শূন্যপুরেই। এ-বছর পুজোর সব আনন্দ লুটিয়ে দিয়ে। নীললোহিত আমার কিশোর বয়েসের সাথী। প্রত্যেক বছর ওর লেখার আশায় থাকতাম। তারপর বড়ো হয়ে অন্যান্য লেখাও পড়েছি। আমি ছোটোবেলা থেকেই 'দেশ'-এর পাঠিকা। মনে আছে, 'সেই সময়' যখন ধারাবাহিক বেরোচ্ছিল। আসীম আগ্রহে অপেক্ষা করতাম পরের সংখ্যাটার জন্য। নবীনকুমারের মৃত্যুর বিবরণ পড়ে কী কান্নাই কেঁদেছি। আশ্চর্য, সে তো ১৯০০ মরে ভুত হয়ে গেছে, তবু তার জন্যে কী আকুতি! পরে প্রবাসী হয়ে এদেশে বসে 'জীবন যেরকম'-এ প্রবাসীদের সঙ্গেও কতো একাত্ম বোধ করেছি।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে যে চাক্ষুষ দেখা হবে তা কখনো কল্পনাও করিনি। কিন্তু, হঠাৎ ২০০৫ সালে নর্থ আমেরিকা বঙ্গসম্মেলন-এ তার সুযোগ পেয়ে গেলাম। ব্রোশিওর-এ দেখেছিলাম সুনীল ও নবনীতা দেব সেন-এর নাম। তাঁরা একদিন, কিছু গল্পগুজব, প্রশ্ন-উত্তর ইত্যাদি করবেন, নিছক আড্ডা যাকে বলে। কনফারেন্সটা ডেট্রয়েট-এর এক বিরাট হোটেলে হয়েছিলো। প্রথম দিনই লিফ্ট-এ করে উঠছি, হঠাৎ একটা তলায় সুনীল স্বয়ং সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে লিফ্ট-এ ঢুকলেন। আমি তো বিস্ময়ে একেবারে স্তব্ধ। অন্য লোকের ভিড় না-থাকলে নিশ্চয়ই ঢিপ করে একটা প্রণাম করে ফেলতাম।
পরের দিন আড্ডা শুরু হলো; এ-কথা, সে-কথা, সুনীল আর নবনীতা ছাড়াও আরো তিনজন লেখক-লেখিকা ছিলেন। সুনীল নিজের দু'টি কবিতা পড়লেন, 'যদি নির্বাসন দাও' আর 'কেউ কথা রাখেনা'। দুটোই আমার প্রিয় কবিতা। সঙ্গে ওঁর কবিতার বই ছিলো, টুক করে একটা অটোগ্রাফ নিয়ে নিলাম। আড্ডার মাঝেই বাংলাদেশের কথা ওঠায়, তুড়ি মেরে সুনীল গান ধরলেন, 'কী ঘর বানাইছে দ্যাখো সাহেব কোম্পানি'। সঙ্গে তালি দিয়ে নবনীতা। মাঝে একটু ভুলে গেলেও, সুনীলের তাল-জ্ঞান আছে বেশ। আমার হাতে ছিলো ছোট্টো ফোন-ক্যামেরা, তাইতেই ধরে রাখলাম সেই অমূল্য মুহূর্তগুলো। সেদিনের সেই আড্ডাটা আমার চিরকাল মনে থাকবে।