বিখ্যাত ২৫শে বৈশাখের অনেক বছর পরে সেই তারিখেই কলকাতায় আর একজন মানুষ জন্মেছিলেন। একটু পরিণত বয়সে তিনি জন্মতারিখ নিয়ে কুণ্ঠাভরে একটি কবিতা লিখেছিলেন :
অধমরবীন্দ্রনাথ জন্মেছিলেন
পঁচিশে বৈশাখ
সেই দিনে না হোক, সেই তারিখে
আমারো জন্মে বেজেছিল শাঁখ
পঁচিশে বৈশাখ!
কোথায় রবীন্দ্রনাথ!
ভালবেসে মূঢ় আত্মীয়বন্ধু গূঢ়
ভেবেছিল আমারো বা
বুঝি সেই ধাত।
কোথায় রবীন্দ্রনাথ!
কে খবর রাখে হায়
এই দিনে এ ধরায়
কত কোটি আরশুলা
কত লাখ টিকটিকি
পোকা আর মাকড়েরা
জন্ম নিল এ জগতে
দুর্গন্ধ নর্দমায়
একই দিনে আমাদের এ ধরায়
আমি পোকা মাকড়ের জাত
এতে ছিল না মোর হাত
তবু যদি পেয়ে থাকি
রবীন্দ্র জন্মদিনে তার
কিছু ছোঁয়া দিল, হোক ক্ষীণ মলিন
তারে আমি বুকে ধরে রাখি।জ্ঞান 13.9.87
জ্ঞান নামক এই ব্যক্তিটি প্রসিদ্ধ সঙ্গীতজ্ঞ সঙ্গীতশিল্পী পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ। এই আশ্চর্য নামটি কে দিয়েছিলেন জানি না। কিন্তু তাঁর কথা ভাবলেই মনে পড়ে প্রাণোচ্ছল অদম্য আকুল আগ্রহে জ্ঞান অন্বেষণ আর অকাতরে স্বতঃস্ফূর্ত ফোয়ারার মতন সর্বদিকে সর্বস্তরে তা বিতরণ! বিশেষত সঙ্গীতের ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাদানের কি নিপুন গভীর প্রবণতা! সদাব্যস্ত কর্মচঞ্চল প্রাণশক্তিতে ভরপুর কণ্ঠে, নানা যন্ত্রে সতত সৃজনশীল! বিশেষতঃ বিশুদ্ধ ছন্দের শিল্প - তবলায়!
কী করে দেখা হল, এবং পরে ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসার সৌভাগ্য হল এই আশ্চর্য মানুষটির সঙ্গে?
ছেলেবেলা থেকে গানবাজনা শোনার, শেখার সখ ছিল আমার। পড়াশোনার ফাঁকে বিচ্ছিন্ন ভাবে মাঝেমাঝে কিছু শিখেছি। তখন স্কুলে পড়ি। এক দিদি বাড়ীতে গান শিখতেন। সঙ্গে হীরুবাবুর এক ছাত্র তবলা বাজাতেন। একটু দেখে দেখে তবলা বাজাতাম। একটু একটু প্রাথমিক বোল জানলাম। তবলা বাজাতে ভাল লাগত। তারপর প্রধানত বিজ্ঞান পড়ে ১৯৫০ এ পদার্থবিজ্ঞানে এম. এস. সি পাশ করলাম। বিজ্ঞান কলেজে পড়ার সময় এক বোনঝির সঙ্গে সঙ্গীত গুরু যামিনী গাঙ্গুলীর কাছে গান শিখতাম। মনে বহুদিনের আকাঙ্খা ছিল জ্ঞানবাবুর কাছে তবলা শেখার। কিন্তু কি ভাবে তাঁর নাগাল পাব তার পথ খুঁজে পাচ্ছি না। সঙ্গীতজ্ঞ বিমলা প্রসাদ চট্টোপাধ্যায় আমার দাদার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। বিমলদা অগ্রজপ্রতিম আত্মীয়ের মতন ছিলেন। তাঁকে ছেলেবেলা থেকেই মাঝেমাঝেই বলতাম জ্ঞানবাবুর কাছে তবলা শিখতে চাই। তাঁর কাছে নিয়ে যেতে বলতাম। তিনি বলতেন 'তুই মন স্থির কর ভালভাবে - তবে নিয়ে যাব। নানা জিনিস করতে গেলে কিছুই করা হয় না। ভবিষ্যৎ বাণীটা ঠিকই ছিল। নানা শিক্ষা শুধু ছুঁয়ে ছুঁয়ে গিয়েছি। দক্ষ হতে পারি নি। কিন্তু ছাড়তেও পারিনি। বিমলদা নিয়ে গেলেন না। যামিনীবাবুকে তবলা শিখতে চাই বলার সাহস হল না। যদিও তাঁরা দুজনেই জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলেন।
সুযোগ ঘটলো অন্য পথে। ১৯৫৪ সালের শীতকালে Science Congress এ প্রসিদ্ধ পদার্থবিজ্ঞানী P. A. M Dirac সস্ত্রীক কলকাতায় এলেন। আমি তখন কলকাতা সায়েন্স কলেজে অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসুর তত্ত্বাবধানে পদার্থবিজ্ঞানে গবেষণারত। মাস্টারমশাই আমাকে ডিরাক দম্পতির আতিথ্যের ভার দিলেন। ডিরাক পত্নী সঙ্গীতানুরাগী। সত্যেন্দ্রনাথও সঙ্গীতানুরাগী। জ্ঞানপ্রকাশ প্রতিষ্ঠিত 'ঝঙ্কার' সঙ্গীত সংস্থার সভাপতি। মাষ্টারমশাই বললেন জ্ঞানবাবুকে গিয়ে বল্ একটা গানবাজনার ছোট আসর করতে ডিরাকদের শোনার জন্য। ডিরাক মেমসাহেব গানবাজনা ভালবাসেন।
আমি একলাফে ঝড়ের বেগে সায়েন্স কলেজ থেকে 'প্রাচী' সিনেমার পিছনের গলি ডিক্সন লেনে জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের বাসভবনে উপস্থিত হয়ে তাঁকে মাষ্টার মশায়ের বক্তব্য জানালাম। তিনি চট করে তাঁর বাড়ীতে তাঁর প্রতিভাধর ছাত্র প্রসূন ব্যানার্জীর গান এবং প্রতিভাবান যুবক সরোদিয়া বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর বাজনার একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেন!
ডিরাক দম্পতি ও মাষ্টার মশাইয়ের সঙ্গে আমিও জ্ঞানবাবুর বাড়ীতে বসে মহানন্দে সেই অনুষ্ঠান শুনলাম। সেই থেকে শুরু। আর কোনও বাধা রইল না। জ্ঞানবাবুকে আমার তবলা শেখার আকাঙ্খা জানালাম। কয়েকদিনের মধ্যেই শিক্ষা শুরু হল।
১৯৫৫ সালে তখন আমার সাতাশ বছর পূর্ণ হয়েছে। আলাদা করে বসিয়ে দিলেন জোড়াসনে বসলাম মাঝখানে তবলা বসিয়ে বাঁদিকে বাঁয়া বসিয়ে নিজে সামনে আর একজোড়া তবলা বাঁয়া নিয়ে বসলেন। অবর্ণণীয় কৌশলে অতি যত্নে আমার হাতের পাতার মাপ অনুযায়ী তবলা বাঁয়ার উপর ঠিকভাবে হাত রাখতে শিখিয়ে দিলেন। বললেন 'দেখ - তবলার তিনটে অংশ - কিনার (কানি), মাঝ ও গাব। প্রধানত তর্জনি ও মধ্যমা দিয়ে কিভাবে আঘাত করলে বাণীর সঠিক স্পষ্ট ধ্বনি উৎপন্ন হবে নিজে বাজিয়ে দেখিয়ে দিলেন। গাবের উপর মাঝে মাঝে তিনটি বা চার আঙুল ফেলে, কোন কোন বাণী উৎপন্ন হবে দেখালেন। বললেন, 'যতবার আঘাত করছ, আঙুল যেন ঠিক জায়গায় পড়ে ধ্বনি যেন perfect হয়। পরে পুরো হাতের পাতা ও বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠর চলনে ধরে ধরে কি করে বাজাতে হয় দেখালেন। তবলাতে ত, ব, ক, ট আবণত (??) বাঁ হাতে ক, ঘ, গ বাজাতে হয়। (??) বা হাতের তর্জনি আর মধ্যমা অনামিকা জুড়ে (??) কি করে ধী ধী-র বেশি বা কম জোরে বাজাবে দেখালেন। গাবের ওপর তর্জনী ও মধ্যমা জুড়ে আঘাত করেই তুলে কী কী করে সুর বাজবে - বিশদভাবে শেখালেন। অনেকদিন অনেককে শেখাবার অভিজ্ঞতালব্ধ সেই শিক্ষাদানের পারদর্শিতা অর্জিত। খাতার উপর প্রথম বোল দিলেন — ঘেঘে তেটে ঘেঘে তেটে, তাগে তেটে তাগে তেটে, কতেটে ঘেতেটে ঘেঘে, তেটে কতা ঘেঘে তেটে। ঘে ঘে তলায় ২, ১ লিখে কখন দু আঙুল কখন এক আঙুল পড়বে বুঝিয়ে দিলেন। সুর, সৎ, কানি কি বোলের নিচে(??) লিখে দিলেন। এই প্রথম বোলে সব কটা আঙুল এর অনুশীলন সম্ভব, বাঁয়ার আঘাতের জোর আর হাল্কাও বোঝা যায়। (??) প্রথম দিনই মনটা উদ্দীপিত হয়ে উৎসাহে ভরে উঠল বিজ্ঞান শিক্ষার প্রথম পর্ব এর মতো পদ্ধতি। প্রাকটিকাল। precise।
গুরুভাইরা ছিলেন পরবর্তীকালের খ্যাতনামা তবলিয়া কানাই বাবু, শ্যামল বোস, শঙ্কর ঘোষ, দিলীপ দাস, সর্বকনিষ্ঠ মানস দাশগুপ্ত, যে পরবর্তীকালে বিশ্বভারতীর তবলার অধ্যাপক হয়েছে। সকলের সঙ্গেই খুব ভাব হয়ে গেল। ২,১ করে ২ আঙুল ১ আঙুল বোঝানো, বোল লেখা দেখে, বয়োজেষ্ঠা প্রথম শিক্ষার্থী ছাত্রীকে কিভাবে গুরু ধ্বনি ফুটিয়ে তুলছেন দেখে ওরা মজা পেত। বলতো 'কি স্পষ্ট ধ্বনি! ওস্তাদের নিজের হাতে ফেলা তো!' ওদের সকলকে শেখানোর সময় আমি বসে দেখতাম, শুনতাম। দক্ষ অভিজ্ঞ কানাইবাবু আগে অন্য গুরুর কাছে শিখে হাত যে তফাৎ হয়েছে তাঁকে নতুন পথে বিশেষভাবে শেখাতেন। ধেরে ধেরে শেখানোর জন্য কাঠের উপর নিজের হাতের চলন দেখিয়ে - কাগজের উপর আঙুলে কালি মাখিয়ে ছাপ দিয়ে হাতের পাতার অবস্থান ও চলন পদ্ধতি দেখিয়েছিলেন। প্রত্যেকটি শিক্ষার্থীর বৈশিষ্ট্য বুঝে সেই অনুযায়ী শিক্ষা পদ্ধতি নির্ধারণ করতেন। এবং অক্লান্ত ভাবে নিজে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বাজিয়ে যেতেন। প্রত্যেকদিন ক্লাস দেখাটা একটা উৎসব উপভোগ করে শিক্ষা লাভ। আমাকে ধারাবাহিক ভাবে বোল দিতে লাগলেন যাতে ক্রমশ ধ্বনি স্পষ্ট হয় হাতের চলন সাবলীল হয় লয় বোধের উন্নতি হয়। সেই পরিবেশের প্রভাবে আমি নেশায় মেতে গেলাম। ভোর ছ'টা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত খাওয়া ও অন্য কাজের বিরতি ছাড়া তবলা অভ্যাস করতাম। সায়েন্স কলেজে কাজের পর ডিক্সন লেনে চলে যেতাম। অবারিত দ্বার। ঘরে উৎসাহী ছাত্রদের দিয়ে ভরা ঘর। মধ্যে ততোধিক উৎসাহী গুরু! ছুটির দিনেও যেতাম। 'ঝঙ্কার' এর সভ্য হয়ে নানা গুনী গায়ক বাদক ও তবলিয়াদের অনুষ্ঠান শুনতে লাগলাম ঘরোয়া পরিবেশে। তাছাড়া, রেডিওতে, টেপ এ নানা শিল্পীর গান বাজনা শুনতাম জ্ঞানবাবুর সঙ্গে বসে। তিনি শিল্পীদের নানা খুঁটিনাটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলতেন — মন্তব্য করতেন। আর সমালোচনা করে যেতেন মজার মজার কথা বলে।
এক মহিলা শিল্পী গাইছেন - বললেন "উঁহু, এখনই গোলাম আলির মতন গাইতে চেষ্টা করলে চলবে কেন? ওঁর এত বড় গোঁফ, সেটা পাবে কোথায়?" কখনও বলতেন, " একবারেই সিন্দুকে যা আছে সব বার করে দেখিয়ে দিলে চলবে কেন? - তারিয়ে তারিয়ে একটু একটু করে দেখাতে হবে।" বলতেন "গানে maturity আসতে দেরী হয়। এটা প্রেসার কুকারে রান্না নয়, কাঠের উনুনে অল্প আঁচে ধীরে ধীরে রাঁধতে হয়। তার স্বাদই আলাদা।" কিন্তু ক্লাসে সব বয়সের সকলকে উঁচু স্তরের গানবাজনা শুনিয়ে যেতেন।
তবলা শেখাতে গিয়ে বললেন মুখে স্পষ্ট উচ্চারনে বোন্দের (??) বাণী বল, লজ্জা করবে না। মুখে স্পষ্ট উচ্চারণ না হলে তবলাও ঠিকভাবে ধ্বনি উচ্চারণ করবে না। তবলাকে ঠিকভাবে বলালে, তবে তবলা কথা বলবে। একথা বার বার বলেছেন। ছোট বড় সব ছাত্রছাত্রীকে সব কিছু শোনাতেন, শেখাতেন। বলতেন - ' যে যা পারে নেবে - আগে ওস্তাদরা দিতেন না। কিন্তু চারদিকে ছড়িয়ে দিলেই ক্রমশ বাড়বে। সব ছাত্রছাত্রী মিলে তাঁর তবলায়, গানে নিজের কত কম্পোজিসন - বড় ওস্তাদদের কাছ থেকে কালেকশন শুনতে পেতাম। 'ঝঙ্কার' এর সভ্য হয়ে গেলাম সেখানে কত বড় বড় গুণী শিল্পীদের অনুষ্ঠান শুনলাম ঘরোয়া পরিবেশে। সব গুণী শিল্পীদের সঙ্গেই জ্ঞানবাবুর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক - তাঁরা সকলে কত শ্রদ্ধা করেন - কিন্তু মানুষটা লাজুক ছিলেন। নিজের অনুষ্ঠান বেশী করতেন না এবং অনুষ্ঠানের আগে নাৎস (??) হতেন, কিম্বা নিজেকে নিয়ে মজা করতেন। বেনারসে কবীর চৌড়াতে (??) গিয়ে দেখেন বড়ে মতি, গিরিজা দেবী, কণ্ঠে মহারাজ, শান্তাপ্রসাদদের ঘরে ঘরে জ্ঞানবাবুর প্রশংসা এবং তাঁর খবর জানার আগ্রহ।
সেই সময়ে সপ্তাহে একদিন সঙ্গীত শাস্ত্রজ্ঞ সুরেশ চক্রবর্তী শাস্ত্রীয় সংগীতের বিভিন্ন দিকের তত্ত্ব আলোচনা করতেন এবং জ্ঞানবাবু practical demonstration দিতেন। আমরা শুনতাম। জ্ঞানবাবু সকালে বললেন "গলাটা শিরীষ কাগজ দিয়ে ঘষার মতন খারাপ আছে কিছুই গাইতে পারব না", সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান শুনলাম অচেনা বাদ্যযন্ত্রে অপূর্ব গানের মতন সুন্দর বাজিয়ে শোনালেন। পরদিন জানতে চাইলাম কী বাজালেন, বললেন এই তানপুরার ওপর গীটারের স্টীল দিয়ে বাজিয়ে দিলাম।" ম্যাক্সমূলার ভবনের অধ্যক্ষর আমন্ত্রনে তার বক্তৃতা দেবার খবর শুনে আমার স্বামী সুরজিৎ সিংহের সঙ্গে আগে গিয়ে সামনের সিটে বসেছি। ঢুকে বললেন, 'তোমরা এসেছ কেন?' এসেছ তো সামনের সিটে বসেছ কেন?' বক্তৃতা শুনলাম অপূর্ব সুন্দর। আর একদিন বললেন "রাশিয়াতে গানবাজনা করতে যেতে হয়েছিল - স্টেজে উঠে 'জনগণমন' গাইতে গিয়ে ভয়ে হাঁটু এমন কাঁপতে লাগল - পাশের লোককে ধরে কোনমতে দাঁড়ালেন। কেবল মজা করা, মাতিয়ে দেওয়া। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে গুরুগম্ভীর ভাব নেই বন্ধুর মতন হৈ হৈ করে আনন্দ দেওয়া!
দু'বছর ডিক্সন লেনের অপূর্ব সাঙ্গীতিক পরিবেশে শিক্ষালাভ করার পর ১৯৫৯ এ নাগপুরে ছিলাম আমার সহপাঠী বন্ধু সুরজিৎ সিংহের সঙ্গে বিয়ের পর। শিক্ষায় ছেদ পড়ল তবে তানপুরা তবলা সঙ্গে ছিল - তবলার খাতাও ছিল। যা শিখেছিলাম নিজের মনে বাজিয়ে আনন্দ পেতাম। এক বছর পর কলকাতায় ফিরে আবার তবলার ক্লাসে যেতাম - তখন রাসবিহারী রোডের 'বাণীচক্র' স্কুলে। সেখানেও ক্লাসভর্তি গানের, তবলার ছাত্রছাত্রীতে ভরা সাঙ্গীতিক পরিবেশ।
১৯৬১-৬৪ আমেরিকায় ছিলাম। যাবার আগে জ্ঞানবাবু তখন পর্যন্ত যা শিখেছি টেপ এ সবগুলো বাজিয়ে বোলগুলো নির্দেশ সহ রেকর্ড করে দিলেন। আজও তা আছে আমার কাছে। ওখানেও বাড়ীতে প্র্যাকটিস করতাম কোনো কোনো বন্ধুকে শোনাতাম। তবলা ও গানের অন্যদের ক্লাসগুলিরও টেপ রেখেছি পরবর্তীকালেও যখন যেতে পেরেছি। সঙ্গীত রিসার্চ আকাদেমি (SRA) তে তার কপি দিয়েছি তখনকার দিনে যেভাবে রেকর্ড করা সম্ভব ছিল সেইভাবে। ইঞ্জিনিয়র বললেন, 'এরকম রেকর্ড সংরক্ষণ করে কি লাভ?' বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত ছিলেন বললেন ' পঞ্চাশের দশকে জ্ঞানবাবুকে শোনার জন্য এগুলি অমূল্য'। যাইহোক, দিয়ে এসেছি। ১৯৯২ পর্যন্ত তাঁর কাছে যেতে পেরেছি।
ডিক্সন লেনের এক অতি মজার অভিজ্ঞতা প্রায় ১০ ছাত্রসহ জ্ঞানপ্রকাশের উদ্ভাবিত 'তবলার ড্রিল! চৌতালের ১২ মাত্রার ঠেকা বাজছে - সঙ্গে সরল সুরের ধূন = ধা ধা ধিন ধা, কৎ ধাগে ধিন ধা, তেটে কতা গদি ঘেনে সা সা জ্ঞ স স সাম জ্ঞা স, স স স ম জ্ঞ জ্ঞ স স (এখানে টেকনিক্যাল ব্যাপারগুলো বোঝাতে কিছু সাইন আছে, সেগুলো কিভাবে দেওয়া যাবে বুঝতে পারছি না??)
এই সুরে ধুন চলেছে! সমবেত ভাবে ঠেকার ফাঁকে নানা বোলের প্যাটার্ন বাজিয়ে চলেছে। সারা ঘরে একটা অনাবিল আনন্দের ধারা বয়ে চলেছে। সবাই শুনে মজা পাচ্ছি। রেডিওতে প্রোগ্রামটা হয়েছিল। রেকর্ডও হয়েছিল। তখন শুনেছি আর শোনা যায় না। রেডিওতে নিশ্চয়ই সংরক্ষিত আছে। নিজের বিখ্যাত কম্পোজিশনে 'নিতাই খুঁড়োর ..', ও 'নগেনের গিন্নির ...' এছাড়াও 'আবোলতাবোল' এর 'গন্ধবিচার' দারুন সঙ্গতিপূর্ণ সুর দিয়ে গেয়েছিলেন - তখন শুনেছি, আশাকরি সংরক্ষিত আছে। তাছাড়া 'বুড়ো বুড়ি দুজনাতে, মনের মিলে সুখে থাকত' -- টাও সুর দিয়ে গেয়েছিলেন। হয়তো এসব মাঝে মাঝে রেডিওতে বাজে।
১৯৬৬ তে আমার সাত বছরের কন্যা সুকন্যাকে নিয়ে গেলাম 'বাণীচক্র'তে জ্ঞানবাবুর কাছে গান শেখাতে। তার ভালো গানের ক্ষমতা ছিল। আমিও আবার তবলা শিখতে শুরু করলাম একটু একটু গানের ক্লাসে যোগ দিতাম। সুকন্যাকে 'তুমতো হো সাহিব'-এর মতো কঠিন কাজের টপ্পা তুলিয়ে দিলেন। অনেকেই গাইছিল। ছাত্রছাত্রীতে ভরা জমজমাট পরিবেশ।
সত্তরের দশকে আমার দশবছরের কনিষ্ঠা কন্যা সুপুর্নাকে নিয়ে গেলাম তবলার ক্লাসে। যত্ন করে শেখালেন 'একটি গোলাপ গাছে ফুটিয়াছে কত ফুল ..' গানের ছন্দে তবলা শেখালেন। এমনি করে যোগাযোগ ছিল তাঁর শেষ জীবন পর্যন্ত।
'সৌরভ' এও যেতাম। সব ক্লাসের টেপ করতাম। তখন তৈরি হচ্ছে নতুন গুণী ছাত্র অনিন্দ্য। এমনি করে ছাত্রধারা বয়ে চলেছে অনির্বান।
তাঁর গভীর স্তবের সৃজনী শক্তির নাগাল পাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। এমন বিচ্ছিন্ন অনুশীলনে দক্ষ তবলিয়া হবার আমার ক্ষমতাও নেই। উদ্দেশ্য ও ছিল না। শুধু নিজের মনে আনন্দ পেয়েছি। সঙ্গীতের রসগ্রহণ করা রসবোধ পরিশীলীত হয়েছে কিছুটা - এবং এই আশ্চর্য সঙ্গীতগুরুর সাঙ্গীতিক ব্যক্তিত্ত্ব এবং জীবন কথা জানার আগ্রহ হয়েছে। সেজন্য যথাসম্ভব দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছি। তার ফলে সঙ্গীত সমালোচক জ্ঞানপ্রকাশের কিছু পরিচয় পেয়েছি। যা পরবর্তী প্রজন্মের সঙ্গীতানুরাগী মানুষদের কাজে লাগতে পারে ভেবে লিপিবদ্ধ করছি।
বার্ধ্যকে অনেকটা অশক্ত হয়ে যাবার পর ১৯৯৩ সালের ২৫শে বৈশাখ তাঁর জন্মদিনে 'হেমছায়া'তে তাঁর সঙ্গে প্রায় শেষ সাক্ষাৎ হয়েছিল। সেদিন বাড়িটা ফাঁকা ছিল। কিছুক্ষণ আলোচনার পর তাঁর ঘরে বসে হাত বাক্সে রাখা অজস্র ডায়েরীর মধ্যে একটি তুলে আমার হাতে দিয়ে সুরজিৎকে বললেন 'পূর্ণিমা আমার জীবনী লিখতে পারবে'। ডায়েরী জেরক্স করে রেখে ফেরৎ দিয়েছিলাম।
কাজটি অত্যন্ত দুরূহ। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে আলোচনার টেপ - সঙ্গীত শিক্ষা ক্লাসের টেপ ডায়েরীর পাতাগুলির কিছু সম্বল করে এই বিশিষ্ট মানুষটির কিছু পরিচয় তুলে ধরার প্রচেষ্টা করব। গুরুর এত যত্ন করে শিক্ষাদানের মর্যাদা দিতে পারিনি, নিষ্ঠাভরে চর্চা না করে। এটুকুও না করলে গুরুর ঋণভার দুর্বহ হয়ে উঠবে। আজ নিজে বিরাশী বছর সম্পূর্ণ করে বুঝতে পারছি তাঁর পক্ষে শেষ দিকে আলোচনা করা কত কঠিন হয়েছিল। তাঁর মনের এবং কর্মকাণ্ডের এত বিস্তৃত ক্ষেত্রে বিচরণ করত যে ধারাবাহিক ভাবে জীবন কথা না লিখে, কিছু টুকরো ঘটনা, ডায়েরীর পাতার নানা চিন্তার কথা, যে সাক্ষাৎকারে শোনা অল্প বয়সের কথা বলেছেন সে কথাগুলি লিখে তাঁর ব্যক্তিত্ত্বের কিছু পরিচয় দেবার প্রচেষ্টা করব।
১৯৭৫-৮০ তে সুরজিৎ যখন বিশ্বভারতীর উপাচার্য ছিলেন, জ্ঞানবাবু অতিথি অধ্যাপক রূপে একবছর সেখানে ছিলেন। তাঁর সঙ্গে কাটানো দিনগুলোর কিছু কথা :
১৯৭৭-৭৮ এ সঙ্গীতের একটা সেমিনারে আমন্ত্রিত কয়েকজন সংগীত শিল্পীকে আমাদের বাড়ীতে অর্থাৎ উপাচার্যর কোয়ার্টার 'পূর্বিতা' বাড়ীতে আমরা নিমন্ত্রণ করেছিলাম। অমলা শঙ্কর, কপিলা বাৎসায়ন, শান্তিদেব ঘোষ, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, মানস ও মমতা দাশগুপ্তর উপস্থিতিতে আমাদের অনুরোধে জ্ঞানবাবু তাঁর বিখ্যাত রচনা 'নিতাই খুড়োর মুখে দিনরাত তত্ত্বকথা এবং নগেনের গিন্নীর দাঁত কনকন' আবৃত্তি করে তবলায় বাজালেন। ঘরে হাসির হুল্লোড় শুরু হল - অমলাদি বললেন - 'word গুলো না বললেও তবলাতে সব কথা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।' কপিলা বললেন চক্রদার পুরা কথার (??) অনুরোধ করেছিল। আমরা সকলের মন্তব্য সহ পুরো অনুষ্ঠান টেপ করলাম। মাঝে মাঝে বন্ধুদের শুনিয়ে প্রভূত আনন্দ পাই।
তাঁর ডায়েরীর পাতাগুলির বিন্যাস অপরিবর্তিত ভাবে রেখে পড়লে তাঁর উত্তেজিত বিস্তৃত ক্ষেত্রে সতত সৃজনশীল বিচরণের চিত্রটা ফুটে ওঠে। আমাদের ক্লাসগুলিও তেমনি হত। কিছু তবলার কম্পোজিশন - কয়েকটা গানের রচনা। কিছু প্রচলিত, কিছু স্বরচিত বন্দিশ, কবিতা, বাংলা ও ইংরিজী - নানা বিষয়ে নানা চিন্তা - ইত্যাদি লেখায় ভরপুর। তারিখ এবং স্থানের গুছিয়ে লেখা। তাঁর ক্লাসগুলির টেপ এও একই রকম উত্তেজিত ভাবে গান, তবলা, কথাবার্তা!
ডায়েরীর পাতা : (তবলার বোল):
তা ক্রা-ন ধা তেরেকেটেতাক ধেরেধেরে ধেরেধেরে তা ক্রা-ন ধেরে ধেরে তে - ধেরে ধেরে ধে - ধা ধিন ধিন ধা
(ত্রিতালের এই কম্পোজিশন মজা করে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বারবার বাজাতেন। তার পরেই তারানা গান) &mbash;
তা না-দেরে না- তা-না-দেরে না- (তারপরে ভাটিয়ার রাগে)
উচট গয়ি .. (বড় ছাত্রছাত্রীরা গাইতেন)
(ক্লাসে হারমোনিয়ম নিয়ে তারসঙ্গে অপূর্ব বাজনা কিছুক্ষণ। পরে ছোটদের জন্য ইমন রাগে - গুরু বিন ক্যায়সে ...) ঘন্টার পর ঘন্টা অক্লান্ত গেয়ে চলেছেন।
তার পরে তবলা প্রসঙ্গে লেখা। ১৯৮৭ অক্টোবর :
"পৃথিবীর সব দেশেই সভ্যতার আলো প্রকাশ পেয়েছে প্রথম ভাষার উচ্চারণে। এবং লেখাপড়ার পূর্বেই মানুষ অনুভব করেছে ছন্দের দোলা বা তার শিরায় শিরায় তন্ত্রে তন্ত্রে এবং আনন্দ অনুরণন। আবৃত্তি আসে আগে, তার পরে চাক্ষুষ লেখাপড়া।
গদ্যের পূর্বে আবৃত্তি এবং ছড়া কবিতা, সাহিত্যে প্রথম পদক্ষেপ। নৃতত্ত্বে আমাদের এই কথাই বলবে। তাহলে আমার বক্তব্য দাঁড়াচ্ছে, এই যে মানুষ সভ্যতার আলোয় প্রথম যে দোলা অনুভব করেছে দৃশ্যের নড়াচড়ার ভিতরে বা শব্দ বা নাদের অনুরণনে। Visual movement এর মধ্যে বা Sound movement এর মধ্যে - অর্থাৎ impact চাক্ষুষ বা শাব্দিক?
কারণ নৃত্যের মাধ্যেও পাওয়া যায় ছন্দ এবং নাদের মধ্যেও ছন্দ প্রতীয়মান। যাইহোক, ক্রমশঃ প্রথমে ছড়া, কাব্য এবং পরে সাহিত্যর উপর মানুষের যখন অখণ্ড অধিকার এসে গেল এবং সঙ্গীতে কণ্ঠের সঙ্গে যখন সুরের যন্ত্র এবং চামড়ার বা মৃদঙ্গ, পাখোয়াজ, মাদল, খোল, তবলা ইত্যাদি percussion বাদ্যযন্ত্রের বিভিন্ন উন্নততর যন্ত্রের উদ্ভাবন স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়মে ঘটতেই থাকল।
পৃথিবীর মধ্যে নানা দেশেবিদেশে অসভ্য অবস্থা থেকে সভ্য এবং কৃষ্টি সম্পন্ন হয়ে এসে পর্যন্ত মানুষ তার সৃষ্ট সঙ্গীত সমাজ চামড়ার বাদ্যযন্ত্র নানা আকারে প্রকারের তৈরি করেছে এবং বাজিয়ে চলেছে। Culture বা সংস্কৃতির ধারার প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অনেক দেশের বা অনেক জাতির চিন্তাধারার মধ্যে প্রয়োজন অনুভূত হওয়ায় চামড়ার বাদ্যযন্ত্রের শব্দ ও ছন্দের রূপায়নে মানুষের কণ্ঠনিসৃত ধ্বনি থেকে উৎসারিত স্বরকে কাজে লাগিয়ে একটা একটা বাদ্যরীতি প্রবর্তন করার চেষ্টা করে থাকবেন হয়তো কোনো কোনো দেশের বাদকেরা। শব্দের টুকরো নিয়ে ছন্দের লঘুগুরু বা হ্রস্ব ও দীর্ঘ ছন্দ ব্যাঞ্জনার আবৃত্তির দ্বারা ছন্দ সৃষ্টির একটা আনন্দ উদ্ভাবনার ধারা সৃষ্টি হল - যার উৎস সাহিত্যে এবং কবিতা এবং ছড়ার সংস্কৃতি থেকে উৎপন্ন বলা যায়।
কিন্তু মৃদঙ্গ বা তবলার যে বোল ক্রমে ক্রমে আজকের দিনে পুরাতন কাল থেকে বহু বিবর্তনের ভিতর থেকে প্রকাশমান হচ্ছে তার ভিতরের গভীরে স্বরোচ্চারণের সৃষ্টির ধারার মধ্যে যে নানা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ছন্দ উদ্বেলিত হয়ে চলেছে কালে কালে তা একটা বিশেষ discipline বা শাস্ত্রের প্রস্তুতির অপেক্ষা রাখে। যার জন্য লয়-তাল-ছন্দ ইত্যাদির বিশেষজ্ঞদের semenar বা আলোচনা সভার সুষ্ঠু প্রয়োজন।
জ্ঞান 13.10.87
...."মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় সম্পদ বোধহয় আনন্দ। উপনিষদেও আশাকরি এই কথাটারই আভাষ আছে। এই যে 'আনন্দ' সেটা হৃদয়ের অনুভূতির ব্যাপার। অন্য কোনও ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণে একে ব্যক্ত করা যায় না। কারণ, এ জিনিস বস্তুগ্রাহ্য নয় বাহ্য নয় বলে। ইত্যাদি অনেক কথা।
তবলা শেখানোর ব্যাপারে আমি বলি যে আমি যখন ওস্তাদদের কাছ থেকে পাখোয়াজ বা তবলা শিখেছি এবং নানা বর্ন সম্পন্ন সম্বলিত শব্দ বাণীর ব্যবহারে রচনা করেছি, তখন শুধু আঙ্কিক চিন্তার দ্বারা আমার রচনাকে গঠিত বা গ্রন্থিত করি নি। আমার রচনার মধ্যে প্রধান লক্ষ্য চিরকালই শব্দ-বাণী-ধ্বনির আক্ষরিক উৎকর্ষ এবং তার থেকে উদ্ভুত আনন্দের দিকেই থেকেছে। এ আনন্দ শ্রুতি এবং মন এবং এদের সমন্বয়ে ছন্দবোধের সূক্ষ্ম রসানুভূতির দ্বারা পরিপুষ্ট হয় সন্দেহ নেই। অবশ্য এটা অনস্বীকার্য যে মহাশূন্যে অবস্থিত অনন্ত আকাশ কে ছন্দ বিভাজনে খণ্ডিত করে তবলার বোল রচনার মধ্যে একটা আঙ্কিক বা Calculative বা Mathematical কার্য আছে। যুগে যুগে Calculative factor টাই বিজ্ঞানভিত্তিক সমস্ত চিন্তায় ও ক্রিয়ায় মানুষের ক্রিয়াত্মক প্রবৃত্তিকে আচ্ছন্ন করে রাখে, তা রাখুক। কিন্তু আমি দেখেছি এবং অনুভব করেছি যে বায়ুস্তরের যে কোনো ধ্বনির তরঙ্গ সৃষ্টি কোটি কোটি মানুষের কানের ভিতর দিয়ে সেখানকার যন্ত্র মারফৎ যে মস্তিষ্কের মধ্যে যে অনুভূতির অবস্থায় পৌঁছে যায় শব্দের প্রকৃত অনুভূতির প্রকৃতি সব ক্ষেত্রে এক নয়। চোখ, কান, নাক, জিভ, গাত্রচর্ম ইত্যাদির বা সাম্যিক একত্ব থাকে। কানের দ্বারা যে অনুভূতি মাথার মধ্যে কাজ করে তার অনুভূতির প্রকৃতি বোধহয় একটু বেশি রকমের সূক্ষ্ম এবং পৃথক।"
(Visual artist বলতে পারেন রামধনুর সাত রঙের মাঝে অনেক সূক্ষ্ম রঙ আছে। কিন্তু তার প্রয়োগ স্বরের মতো আঙ্কিক নিয়মে চলে না।) - পূর্ণিমা সিংহ
পরের পাতায় :
Tabla flourish
1. Phonetically 2. Rhythmically 3. Musically 4. That is technologically
সংস্কৃতি
সংস্কৃতি হচ্ছে কতকগুলি শুভ সত্যের সম্মেলন। যে চারুকলাত্মক সৃষ্টির বা fine art এর মধ্যে সেই সৃষ্টিরই মাহাত্ম্য বেশি যার আনন্দ অপরিমিত। যার পরিমাপ বোধহয় অসম্ভব। 20.9.87
"নগেনের গিন্নী" আর "নিতাই খুড়ো" বোল রচনার তাল Oriented চেষ্টার খুব একটা প্রচার না হলেও দেশ বিদেশে সমাদৃত হওয়ায় আমি খানিকটা খুশী নিশ্চয়ই। বিশেষ করে দুটি ঘটনার আমি উল্লেখ করতে চাই —
একটা হল বহুদিন আগে পাটনা থেকে আমার ডাক আসে প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনে সঙ্গীত শাখায় সভাপতিত্ত্বের জন্য। উদ্যোক্তা ছিলেন পরম আশীর্বাদক রঙীন হালদার মহাশয়। যেতে হয়েছিল। কিন্তু এই ঘটনাকে উপলক্ষ্য করে একটি সাংস্কৃতিক তথা সাঙ্গীতিক জলসায় ঁ রাধিকা মোহন মৈত্রের সঙ্গে আমি তবলা বাজিয়েছিলাম। এবং 'নগেনের গিন্নী' এই গল্পটা বাজিয়ে শুনিয়েছিলাম। চিরকাল মনে রেখেছি সেদিন ঁ তুলসী লাহিড়ী-র প্রশংসা আমার রচনা শোনার পর।
দ্বিতীয় ঘটনা হল বড়ে গুলাম আলী খাঁ কিছুদিন আমার পিতৃভবন ২৫ ডিক্সন লেনে দয়া করে অবস্থান করেছিলেন। হয়তো ১৯৫৫ র পরে কোনো এক সময়। সেই সময়ের আমার রচনা নগেনের গিন্নী'র বর্ণনা ও তবলা বাজানো বিশেষ করে 'গণ্ডা গণ্ডা খোকাখুকু' জায়গায় গুলাম আলী খাঁ সাহেব অট্টহাস্যে এমন লুটিয়ে পড়লেন যে আতঙ্কে আমার প্রায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যায় আর কি। খাঁ সাহেব হাসি সম্বরণ করলেন - আমি বাঁচলাম।
এবার তৃতীয় স্মরণীয় ঘটনা - আমাদের গুরুদেবকে তাঁর তদানীন্তন অবস্থানে রূপালী বোনের বাড়ীতে তাঁকে শোনাতে হয়েছিল তবলায় "নিতাই খুড়ো'র বোলটা পড়ে এবং বাজিয়ে। তেহাই এর সময়ে উনি 'গুরু দক্ষিণা দে' বাণীটি শুনে ঠাট্টা করে বললেন "এটা কি আমি ব্যাটা গুরুকে লক্ষ্য করে বলই (??) বলা হয়েছে?" কি নির্মম রসিকতা গুরু সুদিন মিত্রের।
(এই পাতার নীচে ডায়েরীর পাতায় দুটি কবিতা লিখেছেন -)
কবিতা তো ছন্দের রানী গদ্য কিন্তু তার রাজা আমি জানি জ্ঞান 20/9/87
যে দান জোর করে দেয় পিছনে রয় আশা - প্রশংসা তো আসেই না আসে অপভাষা।
(টেপ থেকে রচনা দুটির বাণী লিখে দিচ্ছি)
নিতাই খুড়োর মুখে দিনরাত তত্ত্বকথা ধরে ধরে খদ্দের কানে কানে মন্তর দেন তারিনী-তারো মা দীনে তক্ষুনি ধরে ঘাড় ট্যাঁকে মেরে টান হেঁকে কয় গুরু দক্ষিণা দে গুরু দক্ষিণা দে গুরু দক্ষিণা দে
নগেনের গিন্নীর দাঁত কনকন্ মাড়ি টন্টন্ মাথা ঘোরে দিনরাত কর্ত্তাকে ঠোকে খ্যাঁদা নেকো মর্কট গণ্ডা গণ্ডা খোকাখুকু ঢ্যাঁকে কানাকড়ি নেই ডাক্তার ডাকা নেই মরি খেটে খেটে নগেনের গিন্নীর দাঁত কন্কন্ মাড়ি টন্টন্ মাথা ঘোরে— দিনরাত কর্ত্তাকে ঠোকে— খাঁদানেকো মর্কট গণ্ডাগণ্ডা খোকাখুকু ধেনো তাড়ি টেনে ঢুকুঢুকু দিনরাত নাকডাকা? ট্যাঁকে কানাকড়ি নেই ডাক্তার ডাকা নেই— মরি খেটে খেটে দুর দুর ধুত্তোর— ধেঁড়ে মদ্দর গর্দান ধর গোটা দুই তিন ধাঁই ধাঁই দে— (তেহাই)
আজকের যে ক'জন বাঙালী তবলিয়া ভারতে এবং দেশ বিদেশে খ্যাতিলাভ করেছেন তাঁদের প্রায় সকলেই জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের শিষ্য প্রশিষ্য। শুধু ভারতে নয়, বিদেশেও জ্ঞানপ্রকাশ সমাদৃত।
কলকাতায় জ্ঞানবাবুর কাছে তবলা শিখতে এবং তাঁর তত্ত্বাবধানে গবেষণা করে তবলায় ডক্টরেট করতে এলেন আমেরিকা থেকে রবার্ট গউলিব। তিনি পশ্চিমী সঙ্গীতে শিক্ষিত দক্ষ শিল্পী। দু'বছর গবেষণার পর তাঁর কাছ থেকে অনেক বোল শিখলেন এবং তাঁর সঙ্গে আলোচনা করে ডক্টরেট করে একটা বড় বই লিখলেন। বইয়ের পিছনের পাতায় আলোচনা ও বোলগুলির পাতলা রেকর্ডও রাখা ছিল। তিনি জ্ঞানবাবুর এক বন্ধুর বাড়ীতে বাজালেন এবং তাঁর কিশোরী কন্যা দু'বছরে ভরতনাট্যম শিখে নাচল। জ্ঞানবাবুর সঙ্গে সেখানে গিয়েছিলাম। বইটি দেখলাম। তাঁর সঙ্গে পরিচয় হল। তিনি সমস্ত বোলগুলি staff notation এ লিখেছিলেন। আমাকে পদ্ধতিটা শিখিয়ে দিলেন। জ্ঞানবাবুর কাছে শেখা একটা 'টুকড়া' (ত্রিতালের) আমার খাতায় staff notation এ লিখে দিয়েছিলেন। টুকড়াটা ছিল :
কৎতেটে থুনতেটে গদিঘেনে নাগতেটে
ঘেনতেরেকেটেতাক তাতেরেকেটেতাক তাককড়ান ধা
তেরেকেটে ঠেৎ তাকেন্নে ধা ধাতেরেকেটেধেৎ
তাকেন্নেধা ধাতেরেকেটেধেৎ তাকেন্নেধেৎ তাকেন্নে ধা
মাত্রা দিয়ে লিখতে গেলে যে অসুবিধাটা হয় staff notation এ তা কি সুন্দর ভাবে বোঝানো যায় দেখলাম। যদিও আমাদের সাবেক বাংলা নিয়মটাতেই আমরা অভ্যস্ত। যেমন চিনা জাপানী লেখা দেখে আমরা ভাবি বড় গোলমেলে কিন্তু তাদের কাছে কোনও অসুবিধা নেই। জ্ঞানবাবুর দেশ বিদেশে ব্যবহৃত সব পদ্ধতি বিষয়ে সদা আগ্রহী মন। তাঁর সান্নিধ্যে মন সদা উৎসাহী থাকে। এই উৎসাহভরা পরিবেশে থেকে আনন্দ উপভোগ করেছি। যথাসাধ্য তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছি। কিন্তু কতদিনই আর তা সম্ভব! ক্রমশঃ তার শরীর অশক্ত হয়ে যেতে লাগল। সঙ্গীত রিসার্চ আকাদেমীর শিক্ষার্থীদের গানের সঙ্গে তবলা না বাজিয়ে হাতে তালি দিয়ে বাজাচ্ছিলেন। (??)
সাক্ষাৎকার (টেপ থেকে) : কলকাতায় সঙ্গীতে প্রাথমিক শিক্ষা :
পূ : কবে থেকে শিখতে শুরু করলেন?
জ্ঞা : কবে থেকে আরম্ভ করলাম? - তা বছর ২২-২৩ হবে। তার আগেও হতে পারে। ২০-২১ বছরে হবে। এদিকে একটা ঝোঁক হল। আর শিখতে আরম্ভ করলাম। ২১-২২ থেকে ২৪-২৫ পর্যন্ত আমি তবলা পাখোয়াজ - এই গুলো। খেলার খুব সখ ছিল। স্কুল থেকে আমাদের ক্লাব ছিল। (??) টুরনামেন্ট হত। কলেজে যখন পড়তুম, কলেজেও খেলতুম। ১৯৩১ থেকে সেসব বন্ধ হয়ে গেল। চোখ খারাপের জন্য। চোখে ফুটবল লেগে after effect এ অন্য চোখেও দেখতে পাচ্ছিলাম না! ১৯৩১-৩৩ তে যখন আমি খেলাধূলো ছেড়ে দিয়েছি, আর গানবাজনা seriously আরম্ভ করিনি, তবলা পাখোয়াজ এমনি বাড়িতে বাজাতুম। মাঝে মাঝে কিছু অনুষ্ঠান হল - বাজাতুম, এইরকম। পাখোয়াজ শিখেছিলুম কিছু আমাদের বাড়ীতে। ডিক্সন লেনের বাড়ী তখন হয়নি। ক্রীক রো তে একটা বাড়ীতে অর্থাৎ আমার জন্মস্থানের বাড়ীতে। দানিবাবু আসতেন। খুব নামকরা লোক ছিলেন! আমি তাঁর সঙ্গে রেয়াল করতুম। তারপরে actualy আমি দুচোখেই তখন দেখতে পেতুম না - বাঁ চোখটা comparatively কম ছিল। clearup করেওনি তখন আমি আজম খাঁর কাছে শিখতে আরম্ভ করলাম। সেটা হবে ৩১, তারপর আজম খাঁ চলে গেলেন। বছর খানেক কি বছর দুয়েক কাটার পর আমি মসীদ খাঁর কাছে শিখতে আরম্ভ করলাম। সেটা ৩৩-৩৪ সাল হতে পারে। কারণ, একটা বছর চলে গেছে আজম খাঁর পর। তখন আমি লিখছি। দেখতে পাচ্ছি না ভাল, কিন্তু খাতা ছিল। তখন আমি পড়তে পারি। পড়াশোনা তখন বন্ধ। আমি MA দিতুম বোধহয় ৩১ এ। দিতে পারলুম না চোখের জন্য।
পূ: জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র সহপাঠী ছিলেন কি?
জ্ঞা: তিনি আমার contemporary ছিলেন। কিন্তু আমি প্রেসিডেন্সিতে পড়তুম তিনি স্কটিশ এ পড়তেন।
পূ: কলেজে সে যুগে গানবাজনা কি হত?
জ্ঞা: কলেজের যুগে তখনকার দিনে হয়তো নাটক টাটক হত। আমাদের সিনিয়র যাঁরা ছিলেন সুশীল দে, হুমায়ূন কবীর এঁরা গাইতেন। আমরা শুনতুম। তবে আমি তখন কলেজে ঢুকিনি হয়তো। তখনও ওঁদের সঙ্গে পরিচয় ছিল। ওঁরা তখন প্রেসিডেন্সিতে পড়তেন। তখন সম্মিলনী বলে একটা স্কুল ছিল, সেখানে সুরেন বাঁড়ুজ্যে শেখাতেন। সত্যকিঙ্করবাবু ও আমার বোনেরা সেখানে শিখত।
পূ: আমি যখন ওয়ান-টু তে পড়ি, আমাদের স্কুলেও সুরেন ব্যানার্জী শেখাতেন, বড়দের।
জ্ঞা: ব্রাহ্ম গার্লস স্কুল?
পূ: না, লেক স্কুল।
বোঝো তাহলে তোমার তখন ৫/৬ বছর হবে। আমি যখনকার কথা বলছি তার অনেক পরে তোমার পাঁচ বছর হবে। সুরেন বাঁড়ুজ্যের কাছে আমার বোনেরা শিখত। আমি শিখতাম আ। ওরা সুরেনবাবুর কাছে শিখত। (??) কোনও কোনও function হলে আমি তবলা বাজাতুম। আমার বোনেরা গাইতো। ওরা সত্যকিঙ্করবাবুর কাছেও শিখত। মিসেস বি. এল. মুখার্জী ছিলেন অর্গানাইজার। যেহেতু আমার বোনেরা গাইছে বা অন্য কোনও গ্রুপ গাইছে - আমাকে তবলা বাজানোর জন্য ডাকতেন। হয়তো হুমায়ূন কবীর বা সুশীল দে এবং মৃগেন মিত্তির জজ ছিলেন, তাঁর ছেলেও আছেন, তাঁদের সঙ্গে আমি তবলা বাজাতাম।
পূ: হুমায়ূন কবীর গান করতেন?
জ্ঞা: একটু হেসে বললেন -ওই আরকি। গান করতেন, খুব উৎসাহ ছিল, গাইতে পারতেন না। একদিন অনেকদিন পরে একটা জায়গায় উনি চিফ গেস্ট ছিলেন, আমি প্রেসিডেন্ট ছিলাম। আমি বললুম যে, উনি গাইতেন। উনি বিনয় করে বললেন, "আমি গানটান করতে পারতাম না।" যাইহোক, ওঁদের সঙ্গে তবলা বাজাতুম।
পূ: আপনাদের বাড়ীতে বাবা উৎসাহ দিতেন?
জ্ঞা: বাড়ীতে খুবই উৎসাহ দিতেন। ভাইদের মধ্যে আমার বড় দাদা খুবই মেধাবী ছিলেন। Western Music করতেন। বেহালা বাজাতেন। তাছাড়া খুব বই পড়তেন, পড়াশোনা করতেন। তিনি বড় ছিলেন। তাঁর কাছ থেকে তাঁর সঙ্গে সঙ্গে উনি যা করতেন সে সম্বন্ধে আমার মোটামুটি একটা আইডিয়া হয়েছিল। তবে উনি Continue করেন নি। আমি করলাম। আমার অন্য ভাইদের মধ্যে আমার ছোটভাই বেহালা বাজাতো। সঙ্গীত সম্মিলনীতে মিহিরবাবুর কাছে শিখত এস্রাজ! বোনেদের মধ্যে চর্চা ছিল। বোনেরা খুবই ভাল গাইতে পারতো। তবে তখনকার দিনে সমাজে বেশীদূর আমল দেওয়ার বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে, রেওয়াজ ছিল না। ওরা দুই বোনই Continue করলে খুবই ভাল গাইতে পারত। এস্রাজও বাজাতো, গানও করত।
পূ: বাবা গাইতেন?
জ্ঞা: বাবা শুনেছি গাইতেন। আমি শুনিনি। ঠাকুরদার গলা খুব ভাল ছিল। গান গাইতেন - ব্রহ্মসঙ্গীত গাইতেন। বাবা খানিকটা পরে, যখন দেখলেন আমি তবলা টবলা শিখছি - তারপর চোখ যখন খারাপ হয়ে গেল - কিছুই করার নেই, তখন উৎসাহ দিতেন। তারপর আমি গানও শিখতে আরম্ভ করলাম। যখন মুসলমান ওস্তাদরা আসতেন, সারেঙ্গীয়ারা আসতেন, তখন থেকেই আমি গানের দিকে ঝুঁকলুম। গানটা আমাকে আকর্ষণ করত। আমি গাইতুম ছেলেবেলায় আমার গলা ভাল ছিল। কিন্তু শিখিনি। তবে ওইরকম গাইতুম, রবীন্দ্রসংগীত-টংগীত। বোনেদের কাছে শিখে broadcast করতুম।
কলেজে যখন ঢুকেছি, তখন থেকেই। গীটার-টিটার বাজাতুম। আর আমাদের নিজেদের অর্কেস্ট্রা ছিল। নাটক হত থিয়েটারের গানটান হত।
পূ: Public performance কখন করলেন?
জ্ঞা: Public performance এর আমার খুব একটা ইচ্ছাই ছিল না। ছেলেবেলায় এমনি যা করতাম, Public performance বললেও চলে, তবে তখনকার দিনে সেটা ছোট scale এ হত। প্রফেসনাল Standard এর কথাই ছিল না। গাইয়ে বাজিয়ের চেহারা দেখতাম না তখন। Whole setup টাই অ্যামেচারের মতন ছিল। হয়তো গোপেশ্বরবাবু বর্দ্ধমানে গাইতেন - কিন্তু কোথাও গাইতে গেলে এমনি নেমতন্ন করে করা হত। মুসলমান ওস্তাদ যাঁরা ছিলেন, তাঁরা শেখাতেন। তারপর তো রেডিও এসে গেল। রেডিও আসার পরে হল কি আমাদের আরও সখ বাড়ল। আর রেডিওর সঙ্গে আমাদের খানিকটা যোগাযোগ ছিল। আমাদের Dwarkin and Sons যে বাদ্যযন্ত্রের দোকান - পুরানো ভারতবর্ষের মধ্যে বোধহয়, প্রথম Indian Owned সবচেয়ে পুরানো দোকান। বাবা সেখানে ছিলেন। তারপর বাবার সঙ্গে কিছুদিন গোলমাল হওয়াতে, (??) - রেডিও তখন তো experimental stage এ ছিল - বাবা রেডিওর সঙ্গে যোগাযোগ করে রেডিওর ব্যবসা আরম্ভ করলেন। তা - ওই ব্যবসাটা থাকার জন্য আমার শেখার খানিকটা সুবিধা হল। কারণ বাবার হোটেলে থাকিতাম তো! যদিও তখনকার দিনে টাকাপয়সাগুলো এখনকার দিনের মতন অত দামী ছিল না। যদি কাউকে পঞ্চাশ টাকা দিতাম - তো gladly ওস্তাদ বাড়ীতে এসে শেখাতেন। এখন যেখানে দুশো, পাঁচশো লাগবে।
তখন তো বিলিতি আমল, কলকাতা প্রথম হয়, তারপর বম্বে, তারপর ম্যাড্রাস, তারপর দিল্লী। কর্ত্তারা যাঁরা ছিলেন, তাঁরা সাহেব। তবে তারা Indian music support করতেন - প্রোগ্রামের জন্য। Director General Indian musical cultural activity চালু রেখেছিলেন। কিন্তু সেটা বন্ধ করে দেবার উপক্রম হল। তখন গভর্নমেন্ট হয়নি Registration হল। তার আগে অনেক কথা - যাইহোক, রেডিও বন্ধ হয়ে গেল। কোম্পানী লাটে উঠে গেল। কারণ লাইসেন্স ফাইসেন্স কিছুই লাগতো না। করবে কী? খরচা তো আছে। উঠে যাচ্ছিল - উঠে গেলে আমাদের খুবই ক্ষতি হবে। বাবা খুব উঠে পড়ে লাগলেন। আরও কয়েকজন ছিলেন। স্যার বীরেন মিত্তির ছিলেন High Commisioner। তাঁদের ধরে টরে গভর্ণমেন্টের হাতে তোলা হল। গভর্ণমেন্ট থেকে আপত্তি ছিল। কী হবে রেডিওতে? নানা ভাবে বুঝিয়ে বলা হল। এটা একটা বড় নতুন সংস্থা Publicityর জন্য বড় মিডিয়াম ইত্যাদি, গভর্নমেন্টের অনেক কাজে আসবে, অনেক কথা বলে বোঝাতে হয়েছে। তারা কোনও খবর রাখত না - যে এটা একটা কতবড় ব্যাপার! সে বুদ্ধি হয় নি।
ঠাকুরদা মশাইয়ের সঙ্গে ঝগড়া করে বাবা রেডিওর দোকান খুললেন। দেখালেন এটা business এর দিক দিয়ে, culture এর দিক দিয়ে, সবকিছুর দিক দিয়ে একটা বিরাট সম্ভাবনাপূর্ন। তারা দয়া দাক্ষিণ্য করে রেডিও take up করলেন। গভর্নমেন্ট বুঝলো লাভ হবে।
(১৯৬৪ সালে আমেরিকা থেকে ফিরে রেডিও স্টেশনে জ্ঞানবাবুর সঙ্গে দেখা হল তবলা, গান শিক্ষার ক্লাসে, যেমন দেখেছি তেমনি (??) সঙ্গীত অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে সদাব্যস্ত। হিন্দি, বাংলা গান, তবলা দলে দলে অনুষ্ঠানের জন্য আসছে। যাঁরা নিয়মিত রেডিও শোনেন তারা নিশ্চয়ই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁর প্রত্যক্ষ (??) অনুষ্ঠান এবং ছাত্রছাত্রী শিল্পীদের নির্দেশ দিয়ে প্রস্তুত করার নিদর্শন। (??) একক (??) জমজমাট উপস্থিতি প্রাণশক্তিতে ভরপুর। হারমোনিয়ম, গীটার এ অপূর্ব বাজানো।(??) মন্নে পড়লো দিলীপ রায় উসা বস্রর (??) গানের সঙ্গে তাঁর গীটার সঙ্গতের রেকর্ডের কথা।)
তবলা ও গান শিক্ষা :
পূ: আচ্ছা, আজম খাঁর কাছে শেখা continue করলেন কি?
জ্ঞা: আজম খাঁ আজমীরের লোক ছিলেন। ওঁদের ঘরে তবলা ছিল। কিন্তু উনি আবার মসীদ খাঁর কাছে শিখেছিলেন।
পূ: তাহলে একই ঘরের হল?
জ্ঞা: ঘর এক বলব না। তবে উনি মসীদ খাঁর সাগরেদ হয়েছিলেন। গুরুভাই ছিলেন।
পূ: উনি কী করে আপনার জীবনে এলেন - আজম খাঁ?
জ্ঞা: আজম খাঁ এলেন - ঋষিকেশ বিশ্বাস বলে একজন - এখনও বেঁচে আছেন - খুবই সংস্কৃতিবান লোক, - যিনি গান শিখেছিলেন অনেকের কাছে, রমজান খাঁর কাছে, মানে একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তি - আমাদের দোকানে কাজ করতেন মানে Dwarkin এ। তিনি এবং তাঁর এক বন্ধু আজম খাঁকে ধরে ঠিক করে দেন। আমি নিজেই রাইচাঁদ বড়ালের কাছে গিয়েছি। তিনি আজম খাঁর কাছে শিখেছিলেন। মসীদ খাঁর কাছেও শিখেছিলেন। তিনি আমাকে মসীদ খাঁর সন্ধান দেন। তারপর মসীদ খাঁ আমার কাছে আসেন। তিনি অত্যন্ত অমায়িক লোক ছিলেন এবং আমি ওঁর কাছে খুবই ঋণী। কেন না উনি বিশেষ যত্ন করে আমাকে শেখাতেন। কেরামৎ খাঁর সঙ্গে আমি একসঙ্গে রেয়াজ করতাম। এবং আমি দেখতুম কেরামৎ খাঁ আমার থেকে অনেক advanced ছিল। আমার চেয়ে বয়সে ছোট, কিন্তু বাচ্চাবেলা থেকে রেয়াজ করেছে তো! আর আমি বাঙালী ঘরের খোল তবলা পাখোয়াজ বাজিয়েছি - আমার হাত তফাৎ হয়ে গেছে। তবু আমার জানা ছিল বলে pick up খুব তাড়াতাড়ি করতাম। কোনও দেরী হত না। তখন আমি মনে করতাম খুব তাড়াতাড়ি pick up করছি, খুব improve করছি। যা করছি খুব ঠিক করছি। বহুদিন পরে বুঝেছি - বুঝতে সময় লেগেছে, যে আমি যা শিখেছি - শেখার দিক থেকে ঠিক আছে, কিন্তু পুরনো যে idea যে practice, সেই অনুসারে খাঁ সাহেবদের ঘরে শিখলে justice করা হয় না। অনেক ঠেকে আমি শিখেছি, বুঝেছি - আরও বহু তবলীয়াদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশে। খাঁ সাহেবের সঙ্গে তো বটেই! ওঁর সঙ্গে তো ছিলুম।
পূ: মসীদ খাঁর কাছে কত বয়সে শিখলেন?
জ্ঞা: ২০-২১ বছর বয়স হবে।
পূ: পাখোয়াজ বাজাতে জানতেন। তবলা?
জ্ঞা: পাখোয়াজ বাজাতুম, তবলাও বাজাতুম।
পূ: আপনার মনে আছে প্রথম লেস্ন কী শিখেছিলেন, আর কার কাছে?
জ্ঞা: সেটা লেস্ন না বলে লেস অ-ন বলা ভাল। কারণ এখন যেটা - ধা তেরেকেটে তাক্ তাকতেরেকেটে তাক্, সেটা:
ধা তেরে কেটে তাকঅ
তাকঅ তেরে কেটে তাকঅ
বোলের বাণীর তফাৎ ছিল। বই থেকে তুলেছিলাম। ভাল লাগতো :
ধা তেরেকেটে তাক, ধা তেরেকেটে তাক্
তুন্না কেটে তাক, তাক তেরেকেটে তাক্
ধি তা নাক ধেনে, ধাগেতেরেকেটে তুন্না কতা
তাক তেরেকেটে তাক্, তেরেকেটে তেরেকেটে ধিন—
থাক সে সব পুরনো কথা।
পূ: আজম খাঁর কাছ থেকে প্রথম লেস্ন?
জ্ঞা: ধাধা তেটে ধাকা তুন্না
তাতা তেটে ধাধা -ধিন্না
আজম খাঁর কাছে যা শিখেছি। আবার আমরা তা শেখাতে পারি। গোড়া থেকেই আমি যে সমস্ত জিনিস পেয়েছি, সেগুলো যে কোনও আসরে যে কোনও বাড়িতে (??) বাজাতে পারি। (??) এক বছর দুবছরের মধ্যে তো বটেই। (??) খাঁ সাহেব আমাকে নিয়ে যেতেন অনেক জায়গায়। জোর বাজাতে বসিয়ে দিতেন। আমার হয়তো বাজাতে মোটেই ইচ্ছা নেই। লহরা কী করে বাজাতে হয় জানি না। উনি বলতেন যা জানো তাই বাজাও। উনি খোসামোদ করার জন্য না, উনি দেখাতে চাইতেন ওঁর ঘরানার কত উৎকর্ষ। আমি বাজাতে পারতাম মোটামুটি। আগে বাজানো ছিল, আগে রেওয়াজ করতুম, অল্প জিনিস শিখতুম বলে। তাছাড়া আমার হাতে কতকগুলো জিনিস ভাল উঠতো। সেইগুলো অনেকে পারতো না। যেমন পাখোজের অঙ্গ যেগুলো সেই গৎ তোলা ছিল বলে, তবলায় সেগুলো ভাল উঠতো। সেই জিনিসগুলি খাঁ সাহেব আমার হাতে শুনতে খুব ভাল বাসতেন। খাঁ সাহেব ওইগুলো বাজাতেন না। আমাকে দিয়ে বাজাতেন। তাকেটে তাকেটে ধুমা ...। আমার চোখের গণ্ডগোলের জন্য তো পড়তে পারতাম না। মারাত্মক প্র্যাকটিস করতুম না। তবে করতুম।
পূ: ক ঘন্টা?
জ্ঞা: তা দিনের মধ্যে পাঁচ-ছ'ঘন্টা তো হত।
পূ: আর গান?
জ্ঞা: গান আমি তবলা শিখতে শিখতে আরম্ভ করেছিলুম। সাদ্দাম খাঁ বলে একজনের কাছে। তাছাড়া দবীর খাঁ সাহেবের কাকা উজীর খাঁ সাহেবের ছোট ছেলের কাছে শিখতুম। তাছাড়া আমরা যখন গিরিডি যাই সেই সময় দবীর খাঁ সাহেবের কাছে শিখতুম। ১৯৩৯ এ আমি গিরিজা বাবুর কাছে শিখতে আরম্ভ করলুম।
পূ: মসীদ খাঁ বাড়ীতে আসতেন?
জ্ঞা: হ্যাঁ, তিনি বাড়ীতে আসতেন। আমি গিরিজাবাবুর কাছে যেতুম।
পূ: দক্ষিণা?
জ্ঞা: তা যা দেওয়া হত তাতে চলত না। টাকা হয়তো তিরিশ, চল্লিশ। যখন সারপেনটাইন লেনের বাড়ীতে থাকতাম তখন কেরামৎ আসত। আমার সঙ্গে সঙ্গে বাজাতো। দেখতাম যে খাঁ সাহেবের মতন না। খানদানী না। ও highly original! খাঁ সাহেবের সঙ্গে ওর বাজের অনেক তফাৎ। কেরামৎ ছেলেবেলা থেকেই একটা creative artist। ওপর চালাকী করে বাজাতো। ভয়ানক intelligent, ভয়ানক talented! ওর বাজানো অন্যরকম। তখন আমাদের বাড়ীতে ভোর ছটা থেকে ওঁর যত ছাত্র আসতো। উনি বাজাতেন। কেরামৎ, মুন্নে খাঁ আর আমি আলাদা বাজাতাম। বাড়ীর সকলের সঙ্গে খুব একটা জমত না। ভাষার অসুবিধা ছিল। আমার একটু অসুবিধা হত। হিন্দী তো অত তাড়াতাড়ি pick up করা যায় না। প্রথম প্রথম ভয়ানক অসুবিধা হত। - তখন আমি পড়াশোনা করতুম। রেডিও থেকে, হিন্দী উর্দু dictionary দেখে শিখতুম।
পূ: অন্যান্য জায়গাতেও তো ঘুরতেন!
জ্ঞা: ঘুরতুম। তখন অসুবিধা ছিল। এখন ভাষার ওপর যে control আছে, সম্পূর্ণ দখল আছে তখন তা ছিল না। জোর করে, চেষ্টা করে, শিখেছি। গাইয়ে বাজিয়েদের সঙ্গে তাছাড়া প্রোগ্রাম থেকে ওকে (??) ভুলভাল বলতে বলতে সঙ্কোচ ছিল। উর্দু accent আয়ত্ত করা কঠিন ছিল। অর্থটার তফাৎ (??) বেশী না, কিন্তু উচ্চারণগত তফাৎ অনেক!
পূ: রেয়াজের নিয়ম কী হওয়া উচিত?
জ্ঞা: কয়েকটা 'কায়দা' আয়ত্ত করা। নখদর্পনে রাখা। যাতে যখন দরকার ব্যবহার করা যায়। এক একটা কায়দা নিয়ে (??) times! হাতটা যাতে ঘোরে, clear করা, সাফাই করা, দম বাড়ানো। কটাই (??) বা বাণী আছে তবলায়! চার পাঁচটা 'কায়দা' দিয়ে যদি রেয়াজ কর — ধর বারো বছর বয়সে আরম্ভ করে যদি পাঁচ বছর করা যায়, (কথাটা বলেই বারোটা বোল বাজালেন)।(??)
আমরা সাধারণতঃ কী করি? বাঁধা কায়দা মুখস্ত করি, তারপর খাতায় লিখে নিয়ে হাতে বাজাই। এবং সঙ্গে সঙ্গে কিছু মাথায় আসছে, সেটা বাজাচ্ছি। কিন্তু আমি বলছি আর একটা জিনিস অভ্যাস করা। যেটা আমি করতাম। ওরা করে গানের ব্যাপারে আর তবলার লোকেরা তবলার ব্যাপারে। তবলাকে একটা ভাষা হিসাবে তৈরি করা। বাঁয়ার intonation টা ভাল হবে, তবলা বাঁয়ার যুক্ত intonation টা ভাল ভাল হবে, যদি তোমার মুখের intonation টা ভাল হয়। সেটা একবার দেখা যাক। আমি তোমাকে যেটা বলছি যে - ধা তেটে ঘেড়ে নাগ,ধা তেটে ঘেড়ে নাগ, ধিন্না ঘেড়ে নাগ। আমি বলছি - তবলাটা ধরবে না। শুধু মুখে মুখে চিন্তা করা - মুখে চিন্তা করে বলবে। তারপর brain চিন্তা করছে - আর হাত বাজাচ্ছে। এই তিনটে জিনিসের যদি সংযোগ হয় তবে শুনতে আরও ভাল হয়। আর তোমাদের inovation এর আরও রাস্তা আরও নতুন নতুন বেরোবে। মুখে একবার অভ্যাস হয়ে গেলে, তোমার তবলা বাঁয়া হাতে কথা বলবে। কিন্তু composition টা তোমার। যে কোনও কায়দা নিয়ে তার থেকে inovation করে। - simple variation করবে। মনে মনে কর। extempore (??) করবে (??) করে। উলটো দিক থেকে দেখতে গেলে বোঝা যায়, যে শিল্পীর brain কতটা তা ধরা পড়ে। এই variation করার ক্ষমতার ওপর। কতখানি ভেতরে গেছেন, অর্থাৎ লয়ের ওপর তাঁর অধিকার কতখানি। এবং একটা 'কায়দা' বাজাতে গেলে তার একটা system আছে। এতক্ষণ বাজছে হঠাৎ একটা বাইরের বোল, যেটা এই কায়দার সঙ্গে ধারণা - সেটা দিলে চলবে না তো! এখন যিনি বড় ওস্তাদ হয়ে গেছেন তিনি হয়তো আর্য (??) প্রয়োগের মতো ঢুকিয়ে দিলেন, কিন্তু তারও একটা logic আছে। এমন logically দিলেন যে সেই বেআইনিটাই আইনি মনে হবে। কিন্তু সেটা সব জায়গায় চলে না।
পূ: কী করে সেটা বোঝা যায়?
জ্ঞা: তুমি যে প্রশ্নটা করছ - যা বাজাচ্ছেন তার মধ্যে উৎকর্ষ আছে কিনা কিভাবে বুঝব? কোনও বাহাদুরী আছে কিনা ভাল কথা বলেছ, এখন বিচার করতে গেলে, judgement করতে গেলে আমার কথা কেউ শুনবে না। লোকে বলবে আমাদের ঘরানায় আছে ইত্যাদি। ... আমার নিজের বিচার এর মধ্যে তোমার প্রশ্নের কতটা আছে জানিনা। কিছুটা answer পাওয়া যাবে।
পূ: আপনি বললেই তো হবে। আপনি তো জানেন কেন বলছেন। তবলা এবং গানের ক্ষেত্রেও আপনার বক্তব্য জানতে চাই, উৎকর্ষ বিচারের ক্ষেত্রে।
জ্ঞা: ১৯৩৪ এ এলাহাবাদ conference এ গান শুনে আমার চক্ষুস্থির হয়ে গেল। দেখলাম এদের ব্যাপারটাই আলাদা। নাসিরুদ্দীন কে শুনলাম। কি control গলার উপর! অপূর্ব! ভাষা, ভাব, রাগ, গায়কী, লয় এর মধ্যে কি সঙ্গতিপূর্ণ সামঞ্জস্য বিধান! এমন আগে শুনিনি। তাঁকে আবার দু'বছর পর কলকাতা ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট এ শুনেছি একেবারে সামনের সারিতে বসে। It was a traning point in my life (??) সেদিন আবদুল করিম এর সঙ্গে শ্যামসুন্দরের তবলা। অতি সুন্দর শুনলাম।
সঙ্গীতে উৎকর্ষ বিচার :
পূ: 'একটা কথা বলেছিলেন, লিখে রেখেছিলাম বলেছিলাম "আমার একটা অহঙ্কার আছে।" কেন বলেছিলেন? মনে হয় বলছিলেন নিজের মতন করে বুঝে সৃষ্টি করেন, নকল করার পথে চলেন না। কথাটা একটু বিষদভাবে বলবেন?
জ্ঞা: অহঙ্কার মানে বলছিলাম আত্মবিশ্বাস। নিজেকে বিশ্লেষণ করে যখন দেখি আমার এই এই কাজ করা উচিত। সেটা শুভ কি অশুভ, ভাল কি খারাপ। বিচার করে বলতাম এটা উচিত না! - যেমন গোলাম আলি খাঁ সাহেব যখন নিচের দিকে গমক দেবার অভ্যাস ছিল। খরাজের (??)দিকে গমক করা শক্ত, ঠিক correct গমক করা মুস্কিল, কিন্তু উনি তা পারতেন। কিন্তু আমি মনে করলাম খাদের দিকে গমকের কাজ যেটা করেন, অনেকেই করে - ওই অ্যাই অ্যাই অ্যাই অ্যাই অ্যাই — ওটার কোনও দরকার নেই। কিন্তু গোলাম আলি করতেন। আমার খারাপ লাগত। উনি কেন করতেন? ওঁর মতন এক চিন্তাশীল লোক — যাঁর ভালমন্দ বিচারের ক্ষমতা ছিল! অহঙ্কার মানে আত্মবিচার!
পূ: মানে কোথায় excellenceটা থাকছে না।
জ্ঞা: হ্যাঁ।
পূ: হয়তো কাজ দেখাবার জন্য ...
জ্ঞা: হ্যাঁ exactly! এখন excellence বলা মুস্কিল। কারুকার্যের দিকে (??)
পূ: সেটা মুস্কিল। কিন্তু একজন গুণী শিল্পী যতই গুণী হোন, তাঁর কোথাও ত্রুটি থাকতে পারে বাহবা পাবার জন্য যদি compromise করেন আপনি গোলাম আলি খাঁ সাহেবের ভীষণ ভক্ত, কিন্তু এই ত্রুটিটা দেখেছেন - এইখানে এই দোষটা আছে। আচ্ছা আমীর খাঁ আর গোলাম আলীর তুলনা করলে কী বলবেন?
জ্ঞা: মানে style এর দিক দিয়ে বলা যেতে পারে সব দিক দিয়ে বলা মুস্কিল। আমীর খাঁর যে style ছিল তার মধ্যে ওঁর লক্ষ্য ছিল, তার মধ্যে অসংখ্য দিক, অনেক জিনিস অনেক জিনিস দেখবার দিকে ওঁর লক্ষ্য ছিল। গোলাম আলীর কতকগুলো point উনি লক্ষ্য করতেন, যেগুলো হওয়া ভাল।
পূ: এই দুই গুণী শিল্পীকে তো আপনি অনেক শুনেছেন -
জ্ঞা: হ্যাঁ শুনেছি আর analyse ও করেছি। কারুকার্যের দিকে গোলাম আলীর লক্ষ্য ছিল, mastry-ও ছিল মানে - তোমার physics এর মধ্যে এসে পড়বে। frequency high আর low /lower দিকে যে development করা - তাতে গোলাম আলি খাঁ সাহেবের voice এর যে quality -timbre এ, সেই গলাতে নেই। অবশ্য উনি ওপরে নিচে অনেক যেতে পারতেন। কিন্তু ওঁর যেটা স্বাভাবিক আওয়াজ যে quality - যে timbre সেটা সুন্দর বটে কিন্তু আমীর খাঁর যে depth, যে গাম্ভীর্য তা নেই। আমীর খাঁর গাইবার মধ্যে অস্থায়ী প্রধান! অন্তরা খুব একটা করতেন না। অস্থায়ী Composition এ language linguistic variation এর দিকে তাঁর লক্ষ্য ছিল।
পূ: এমন দুই গুণীর Performance আপনি তো অনেক শুনেছেন!
জ্ঞা: শুনেছি নিশ্চয়ই আর তার analysis ও করেছি। বলতে গেলে গোলাম আলি খাঁর যে লয়ের আন্দাজ - ইংরিজীতে যাকে Rhythm বলে তার মধ্যে অনেক সূক্ষ্ম বিভাগ আছে, সেই সূক্ষ্মতার দিকে যে Observance - সেটা আমীর খাঁর বেশী ছিল। Rhythm মানে আমি বলছি space। Accepted rhythm বলতে যে formation সেটা বলছি না। কিন্তু যেটা formed হয়নি, সেখানেও Rhythm তো রয়েছে - অফুরন্ত। অফুরন্ত সেই space তো আর কোনও বাঁধাধরা নেই সেইখানে গোলাম আলি খাঁর যে space এর আইডিয়া সেটা অনন্ত বিস্তৃত নয়। সেটা বোধহয় আমীর খাঁর ছিল। আমীর খাঁর কিন্তু তবলার লয় ছিল। তবলার সম্বন্ধে অনেক কথা বলেছেন।
কিন্তু গোলাম আলি খাঁর গানগুলি শুনতে ভাল লাগত এবং সেই ভাল লাগার মধ্যে একটা জিনিস আছে - সেটা সত্যি কথা। কিন্তু সেটা ভাষায় প্রকাশ করার মতো শক্তি এখন নেই। বলতে গেলে stram feel (??) করছি। সেটা হচ্ছে যে সুর এবং লয়ের মধ্যে কোনও তফাৎ নেই। (??) সেটা আমি অনেক ভেবেছি। কথাটা হচ্ছে সুরটা ভাল লাগছে কেন? এই কারণেই ভাল লাগছে, এবং এক সময় এমন মনে হয়েছে যে সুর এবং লয়ের মধ্যে কোনও difference নেই। (??) যদিও এ দুটো factor ই আলাদা। Rhythm যেটা সেটাকে analyse করলে calculation এর মতো। Rhythm মানে calculation । কিন্তু সুরের মধ্যে calculation এর কথা আমরা ভাবি না। (অঙ্গাঙ্গীভাবে সুসঙ্গত বিন্যাস? Physicsএর ভাষায়।) সুরের যে আমরা চিন্তা করি, সুরটাও যে calculation এর সঙ্গে logically যুক্ত - তার ভগ্নাংশগুলি বড়জোর শ্রুতি পর্যন্ত আছে - তা ছাড়া চিন্তা করি না। লয় নিয়ে মারামারি কাটাকাটি করি। যারা গায় মীড়গুলো - মীড়ের মধ্যে pass করে যতগুলি ভগ্নাংশ হতে পারে। গোলাম আলির সঙ্গে আমীর খাঁর গানের তুলনা করলে আমীর খাঁর গানের মধ্যে যে granders (??), গোলাম আলির গানের মধ্যে সেই granders (??) নেই। যে dignity বাংলায় কী বলা যায়? গাম্ভীর্য, সম্ভ্রান্তভাব - অর্থাৎ যে একটা order of excellence উন্নত সমুন্নত ভাব। একটা আভিজাত্য- সেটা আমীর খাঁর মধ্যে আছে। আমীর খাঁর গানের মধ্যে খানিকটা নিশ্চয়ই তাঁর কণ্ঠস্বরের জন্য এই ভাবটা আছে। অর্থাৎ তাঁর কণ্ঠস্বরের যে ব্যাপ্তি - তার মধ্যে অনেকখানি আছে।
পূ: ফৈয়াজ খাঁ ও গোলাম আলির তুলনা করছিলেন একদিন।
জ্ঞা: তাই নাকি?
পূ: কার মধ্যে কোনটা আছে, কোনটা থাকা উচিত, কোনটা ভাল -
জ্ঞা: সেসব analysis করলে ভাল হবে! তুমি যে প্রশ্নটা করছ গানের মধ্যে কোনও উৎকর্ষ, বাহাদুরী আছে কিনা artistic excellence - আছে কিনা কি করে বুঝব? ভাল কথা বলেছ - এখন বিচার করতে গেলে judgement করতে গেলে প্রমাণ করতে গেলে - আমার কথা কেউ শুনবে না। খাঁ সাহেবদের গানের মধ্যে পুরনো লোকেরা বলেন - 'এরকম গান আর হবে না এরকম গায়কী আর হবে না' - ইত্যাদি। আমার নিজের বিচারে তোমার প্রশ্নের answer কতটা আছে জানিনা - কিছুটা answer পাওয়া যাবে। আমি যখন ছেলেমানুষ ছিলাম, গান ভালবাসতুম - আব্দুল করিম-কে শুনলুম, নাসিরুদ্দীন শুনলুম, এনায়েৎ খাঁ ভয়ানক নাম করেছেন যখন, শুনলুম - আমার নিজের কেন মনে হল - আমি বলছি বলে সেটা ঠিক - তা বলছি না। কিন্তু আমি গান ভালবাসি, সুর ভালবাসি, রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃতির মধ্যে মানুষ হয়েছি, বাড়ীতে গানবাজনা হত, একটু ভালমন্দ বিচার নিজেও বুঝতে পারি, যেটা ভাল বা মন্দ বলি, কিছু গুণীজন একমত হন আমার সঙ্গে। হঠাত আমার ফৈয়াজ খাঁ ভাল লাগল না কেন? দারুণ নাম! আজও পর্যন্ত অনেকে বলেন যে ফৈয়াজ খাঁর মতো গান আর হয়নি - তুমি শুনেছ কিনা জানিনা। কেমন লাগে তাও জানিনা। কিন্তু আমার মনে হয় তুমি শুনলে পরে দেখবে fineries ওঁর মধ্যে বড় কম। fineries নেই। ফৈয়জ খাঁ যখন ভাল লাগেনি বলেছি তা অনেক দিনের কথা। Conference এ যখন ফৈয়জ খাঁ গাইছেন - যাঁদের গান আমার ভাল লাগে তাঁরাও umpressed ! (??) এবং এমন atmosphere তিনি তৈরী করলেন, তার মধ্যে পড়ে আমার ভাল লাগতে বাধ্য। তখন আমি করে ওঁকে বিচার করেছি। তখন ফৈয়জ খাঁ গাইছেন - গোলাম আলি খাঁ সাহেব তাঁকে একটা সম্মান দিতেন - খানদান হিসাবে কিন্তু ফৈয়জ খাঁকে একটা বড় কলাকার বলে নিজে মনে করতেন বলে আমার মনে হয় না। হয়তো মুখে তিনি জীবনেও কখনও তা বলেন নি। তবে তাঁর নিজের গান থেকে analyse করে আমি বলতে পারি যে তাহলে ফৈয়জ খাঁর কিছু ওঁর মধ্যে থাকত। কারণ ফৈয়জ খাঁর ওইরকম নাম - ওঁর senior কিন্তু গোলাম আলির মধ্যে তাঁর প্রভাব একদম Promenent by absence গোলাম আলি খাঁসাহেবকে আমার খুব ভাল লাগত। আমার মনে হয় ওইরকম একটা artistic approach ওঁর আগে কেউ করে নি। সব রকম দিক থেকে লয়, বোল বাণী - স০ব০ মিলিয়ে মনে হয় artistic বিচারে ওঁর তুলনা নেই। তবে analyse করলে হয়তো শুনতে খারাপ লাগবে যে শ্রদ্ধা হারাচ্ছি। তা নয়। এখন ফৈয়জ খাঁ আর গোলাম আলির মধ্যে এঁর এটা ভাল, ওঁর এটা ভাল সেটা বিচার করে যদি analyse করি তবে বেশী নম্বর পাবেন গোলাম আলি। এখন ফৈয়জ খাঁর ভক্তরা বলবেন গানের যে আদর্শ তাতে ফৈয়জ খাঁর তুল্য আর কেউ নেই। তা তাঁরা বলতে পারেন। তাহলে আদর্শটা কী?
কী কী quality থাকলে বলা যাবে যে এই ঘরের গায়কী একটা উঁচু আদর্শে প্রতিষ্ঠিত। সেটা কী করে বলা যায়? যখন approach করি analyse করে, তখন analyseed part গুলো তো not equal to the appreciation of the whole thing! তাতো নয়। সেটা খুব মুস্কিল। কিন্তু analyse তো করতেই হবে তারপর whole টা বিচার করে আমরা একটা মতে পৌঁছতে পারব। এটা কঠিন ব্যাপার। কিন্তু আমার মনে হয় যতই কঠিন ব্যাপার হোক analyse করতেই হবে। এই জিনিষটা ভাল লাগছে, এটা লাগছে না। একটা কথা তো মাধুর্য। শ্রুতি মধুর আর শ্রুতি কটু। এখন classical গান যাঁরা করেন, তাঁরা বলেন মিষ্টি হলেই classical হবে না। সেটা সত্যি। মিষ্টি হবে না সেটাও একটা কথা না। মিষ্টি হবে সেটা প্রয়োজন। কিন্তু মিষ্টি হতে গেলে তাকে আগাপাশতলা মিষ্টি হতেই হবে তা তো নয়। আর্ট এর মধ্যে অনেক রকঅম কৌশল আছে। তাছাড়া কতকগুলি tradition আছে কী সেটা তা আবার একটা অন্য রাস্তা।
ফৈয়জ খাঁ গোলাম আলি তুলনা করলে খানিকটা বোঝা যাবে। ফৈয়জ খাঁর মধ্যে যেটা ছিল সেটা - উনি জমিয়ে দিতে পারতেন। আত্মসমাহিত ভাবটা তাঁর মধ্যে কম ছিল। exhibitionism টা যেহেতু বেশী ছিল, তিনি audience কে মাতিয়ে দিতে পারতেন। আর অডিয়েন্সের মধ্যে তন্ময় হয়ে উপলব্ধি করার দক্ষতা কজনের ছিল? খুব কম লোকেরই থাকে। কিন্তু ফৈয়জ খাঁ তন্ময় হতেন না তা নয়। ফৈয়জ খাঁ তন্ময় হয়ে যখন গাইতেন সেটা ভাল তখন তাঁকে হয়তো পাওয়া যেত। সেটা আসরের মধ্যে অনেক সময়।(??) আবার গোলাম আলিও হয়তো কখনও অনেকক্ষণ ধরে গাইলেন - আসল শ্রোতারা appreciate করতে পারল না। এই ব্যাপারটা vary করে। যখন আর্টিস্ট তাঁর নিজের আর্টকে নিজেই আনন্দ করে উপলব্ধি করে গাইতে চান সেইটা ভাল হয়। কিন্তু যখন for the pleasure of the audience সেটা বদলে যায়।
তুমি যেটা বলেছিলে, কয়েকটা concrete প্রশ্ন দিয়ে আরম্ভ করছি পরে আরও বলব। গোলাম আলি এবং ফৈয়জ খাঁর performance এর কোনও analysis করছি না। দুজনের গানের মধ্যে কী পার্থক্য এঁর মধ্যে কী পাওয়া যায়, ওঁর মধ্যে কী পাওয়া যাচ্ছে না ...।
পূ: finery র কথা বলছিলেন।
জ্ঞা: Voice, মানে আমাদের নাদ যেটা বলে। মানে musical sound - আমরা যতক্ষণ শুনছি বুঝতে পারছি না। গোলাম আলি যদি 'সা' - বলেন আর ফৈয়জ খাঁ যখন 'সা' বলেন তার frequency measure (সেদিন এই পর্যন্ত আলোচনা করা সম্ভব হয়েছিল।)
সঙ্গীতের উৎকর্ষ বিচার :
সঙ্গীতের উৎকর্ষ বিচারের জন্য Concrete উপাদান ভিত্তিক আলোচনা করতে তিনি আগ্রহী ছিলেন। বলেছিলেন আরও বলব। কিন্তু তা শোনা হল না। এইরকম অভিজ্ঞ চিন্তাশীল ব্যক্তিদের উপলব্ধিজাত বিশিষ্ট বক্তব্য শোনার সুযোগের সদ্ব্যবহার প্রায়ই ঘটে না। বয়সের ভারের ক্লান্তির কথা স্মরণ থাকে না। সেদিন তাঁর আলোচনা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বিশ্লেষনের দিকে যাচ্ছিল। মৌলিক উপাদানগুলি বিশ্লিষ্ট করে সেগুলির ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করার কথা বলেছিলেন। দু'জন বিশিষ্ট শিল্পীর মধ্যে উপাদানগুলি 'গুণ' বিচারের ভিত্তিতে। যেমন করা হয় জড়বিজ্ঞানে সমগ্র পদার্থের 'গুণ' - তার উপাদান গুলির গুণ বিচারের ক্ষেত্রে। তবে সঙ্গীতের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত অনুভূতির বিভেদের দরুণ সর্বজন স্বীকৃত সমাধানের পথ আরও কঠিন। তবু, তিনি যেসব উপাদান ভিত্তি করে এই কাজে অগ্রসর হবার পথ দেখালেন তার সন্ধানের প্রচেষ্টা করা যাক :
ফৈয়জ খাঁ এবং গোলাম আলির 'সা' স্বরের প্রয়োগের ক্ষেত্রে স্বরগুলির থেকে উৎপন্ন শব্দতরঙ্গের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে আঙ্কিক পদ্ধতিতে পরিমাপ করা যায়। তরঙ্গের প্রকৃতির 'সৌন্দর্য' জ্যামিতির সতঃসিদ্ধর প্রাথমিক শর্তরূপে অনুমান করা যায় মাধুর্য ও কর্কশতা অনুযায়ী শব্দ তরঙ্গের সরল বা বিকৃত হয়। ধ্বনি মাধুর্যের একটা শর্ত ধরা যায়। তারপর সঙ্গীত পরিবেশনের জন্য শিল্পীর 'আত্মসমাহিত ভাব' তাঁর বিচার অনুযায়ী একটা উপাদান। আর একটি, পরিবেশনে finery (সূক্ষ্মতা!) এ সম্বন্ধে হয়তো সর্বজন স্বীকৃতি অর্থাৎ সহমত হবার সম্ভাবনা আছে। তৃতীয় উপাদান ভাষার বিশুদ্ধতা - বিশুদ্ধ উচ্চারণ, চতুর্থ - সাঙ্গীতিক 'সুর', পঞ্চম - লয় এই কটি উপাদানের বিশুদ্ধ প্রয়োগ - তার পরের শর্ত এই উপাদান গুলির 'সঙ্গত' ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট 'ভাব' প্রকাশ। এই অংশের সৌন্দর্য বিচারে ব্যক্তিগত অনুভূতির প্রবেশে সহমত হওয়া মুস্কিল। কিন্তু বর্তমানে উপাদান গুলির প্রকৃতির পরিমাপ করার জন্য যান্ত্রিক পদ্ধতি যে রকম ভাবে ক্রমোন্নত হচ্ছে তাতে হয়তো সর্বজন স্বীকৃত 'সৌন্দর্য' বিচারের পথ ক্রমোন্নত হয়ে তা একটি আত্ত্বিক 'সত্য'র স্বীকৃতি পেতে পারে বলে আশা করা যায়। 'সঙ্গতি' - 'সঙ্গত' কথাটা তিনি বারবার ব্যবহার করেছেন। চিত্রশিল্পীরা ও চিত্রের বিভিন্ন অংশের মধ্যে সঙ্গতি বা 'balance' এর কথা বলেন। এমনকি আইনস্টাইন প্রাকৃতিক 'পদার্থ' গুলির মধ্যে ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়ার নিয়ম 'গানিতিক' সঙ্গত নিয়ম ('সৌন্দর্য')-র নিয়ম মেনে চলে বলে বুঝেছেন। ব্যক্তিগত ভাবে যাঁদের শুনেছি তার মধ্যে আমীর খাঁর গান আমার সবচেয়ে ভাল লেগেছে। জ্ঞানবাবুর বিশ্লেষনে তাঁর পরিবেশনের উৎকর্ষ সমুন্নত শুনে ভাল লাগল। গোলাম আলির গানও খুব ভাল লাগত। এবং তাঁর গানের উৎকর্ষ ও ত্রুটি বিষয়ে জ্ঞানবাবুর বক্তব্যর সঙ্গে আমি সহমত। এঁদের সামনে বসে শুনেছি - ফৈয়জ খাঁকে সেভাবে শুনিনি। রেকর্ডে কয়েকটা গান ভাল লেগেছে - কেন লেগেছে বিশ্লেষন করিনি। ফৈয়জ খাঁর গান খুব কম শুনেছি। আলোচনা করা হয়নি জ্ঞানবাবুর সঙ্গে। 'আত্মসমাহিত ভাব' আমীর খাঁ এবং বন্ধু নিখিল ব্যানার্জীর মধ্যে অনুভব করেছি। নিখিলের আমীর খাঁর গানের প্রতি খুব শ্রদ্ধা ছিল। তার বাজনায় তাঁর প্রভাবও ঘটেছে।
সার্থক সঙ্গীত সৃষ্টির সুর সমাবেশের নিয়ম অনুসন্ধানে এখন অনেকেই রত আছেন। বিজ্ঞানী এবং সঙ্গীতজ্ঞ যৌথ ভাবে কাজ করছেন।
১৯৯৪ এ পুনাতে দেখেছি ইলেকট্রনিক্স এর অধ্যাপক সহস্রবুদ্ধের স্ত্রী সুগায়িকা বীণা সহস্রবুদ্ধের গানের রেকর্ড ভিত্তি করে তাঁর এক ছাত্র computer এর সাহায্যে বিশ্লেষণে রত থাকতে দেখেছি। দুটি দুটি স্বর নিয়ে তারা কতবার পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে - তার পরিমাপ করছেন। এমন কাজ অতি দ্রুত সম্পন্ন হয়।
এখন অনেক জায়গায় নিশ্চয়ই বিজ্ঞানী ও সংগীতজ্ঞর সহযোগিতায় এই ধরনের কাজ করছেন। এবং অনেক তথ্য জড়ো হয়ে সঙ্গীতের বিজ্ঞান সম্মত বিশ্লেষণের পথ সুগম হচ্ছে। কিন্তু এমন কাজের পথিকৃত ছিলেন জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ।
উপরোক্ত অর্ধসমাপ্ত আলোচনা থেকেই বোঝা যায় তাঁর বিচারের উপস্থাপনা কী যুক্তিনিষ্ঠ। তাঁর বিচারের প্রাথমিক শর্ত অনুযায়ী তাঁর বক্তব্য অকাট্য। তবে আর্টের ক্ষেত্রে উৎকর্ষ বিচারের প্রাথমিক শর্ত জ্যামিতিক সতঃসিদ্ধর মতো অপরিবর্তনীয় নয়। ব্যক্তিগত রুচিনির্ভর। কেউ যদি প্রাথমিক শর্ত দাপট ও মজলিশ জমানোর ক্ষমতাকে নির্বাচন করে, কিছু বলার নেই। তবে জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের বক্তব্য প্রকাশের ভাষা এত অনবদ্য ঘন্টার পর ঘন্টা শুনলেও ক্লান্তি ঘটে না। এত জিনিস জানতেন, পারতেন যে চব্বিশ ঘন্টায় তার কাজ কখনও শেষ হত না। তাছাড়া এত সুরসিক যে পরিপূর্ণ আনন্দে মেতে থাকতেন। মনে পড়লো ক্লাসে একদিন ব্যস্তভাবে তবলা-গান শিখিয়ে চলেছেন। বাড়ী থেকে ফেরার তাড়া এলো। বললেন 'এই গানটা, তবলাটা শেষ করে নিই - আবার গীটার এসে যেতে পারে'। এমন সময় গীটারের গৎ নিতে এক ব্যক্তির প্রবেশ। বললেন 'তুমি এসেছো? - তোমার কথাই ভাবছিলাম। ঘরভর্তি সকলে অট্টহাস্যে ফেটে পড়লো। আমাদের শোনার ক্লান্তি ছিলনা - কিন্তু তাঁর যে শরীরে ক্লান্তি ঘটতে পারে বোঝা যেত না।
রবীন্দ্রসংগীত প্রসঙ্গে :
মাঝে মাঝে আলোচনা এবং ডায়েরীর পাতায় রবীন্দ্রসংগীত বিষয়ে যা বলেছেন :
জ্ঞা: সুবিনয়, বুদ্ধদেব এরা রবীন্দ্রসংগীত এবং classical music এর সঙ্গে তার সম্পর্ক নিয়ে অনেক চর্চা করেছে আর ওরা practical demonstration দিচ্ছে। - যদুভট্ট এই করেছেন, সেটা রবীন্দ্রনাথ এই করেছিলেন ইত্যাদি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের classical music এ যতই আগ্রহ থাকুক রবীন্দ্রনাথের সময় বা একটু পরে আমাদের সময়ে classical music এর যা চর্চা হত বা যে ধারণা ছিল সেটা প্রায় enterly পালটে গেছে for the better সেটা কেন বলছি - আমি বললে তো হবে না!
পূ: আপনি বললেই তো হবে। আপনি কেন বলছেন আপনি জানেন।
জ্ঞা: সেটা আমার বলতে হবে। মানে clearly বোঝাতে হবে।
পূ: যেভাবে evolve করেছে, সেটা যে বললেন। কেন বললেন? আর একটা কথা বলেছিলেন, "রবীন্দ্রনাথকে এখন যত ভাবছি, আমার খুব ভাল লাগছে। কারণ উনি ভাসাভাসা ভাবে যা জেনেছেন, নিজের মতন করে absorb করে নিজের জিনিসটা বের করেছেন" - সেই কথাটা বলতে বলতে আমার টেপ ফুরিয়ে গেল। সেটা একটু বিশদভাবে বলবেন?
জ্ঞা: রবীন্দ্রসঙ্গীত যে ভাবে উনি সৃষ্টি করেছেন এবং প্রচারিত হয়েছে, তার ভাবটা আমার ভাল লাগে। কিন্তু হিন্দুস্থানী classical music বিষয়ে যেভাবে আমরা ধারণা করেছি। শুধু আমরা না শাস্ত্রীয় অনুশাসনে যা আছে তাদের বক্তব্য জেনেছি। খুবই বৈদগ্ধ্য ছিল। কত প্রাচীন জানা নেই তবে 14th Century তে শঙ্গদেবের লেখাগুলির ওপরেই লোকে বিশ্বাস করে। সেটা আমি ছেড়ে দিচ্ছি, আমি চলে যাচ্ছি একদম রবীন্দ্রনাথে। তিনি এসব পড়েছেন নিশ্চয়ই। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের প্রতি তাঁর যথেষ্ট শ্রদ্ধা ছিল, কিছু শিক্ষাও হয়তো ছিল সেই যদুভট্টের আমলে। শ্রদ্ধা যতই থাক, শ্রদ্ধা থাকা সত্ত্বেও, একটা লোক সে পৃথিবীর যা কিছু আছে সবই করবেন তা তো হতে পারে না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তো করেছিলেন খানিকটা - যা করেছিলেন তার তুলনা নেই। কিন্তু classical সঙ্গীত নিয়ে অত চিন্তা করার তাঁর সময় ছিল না। এবং ওঁর জীবন যতদিন ছিল, তার মাঝখানে যাঁকে যাঁকে শুনেছিলেন, তখনকার দিনে ঠাকুরবাড়ীতে যাঁরা ঢুকতেন তাঁদের শুনেছেন। তার থেকে তাঁরা একটা ধারণা ছিল। আর পরবর্তী যুগে আমাদের যা জানা কেশর বাইকে শুনেছেন। তাঁর বক্তব্য ছিল তাঁর ভাল লেগেছিল। এই পর্যন্ত। কেন ভাল লেগেছিল, কতটা ভাল লেগেছিল জানা নেই। এবং কেশর বাই এমন একটা সত্যিকারের উঁচুদরের কলাকার - আল্লাদিয়া খাঁর কাছে গাণ্ড (??) বেঁধে শিখেছিলেন। [ধূর্জটি মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ কিছু বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন কেশরবাই সম্বন্ধে] (পূ: সিংহ এটা বলা হয়নি।) (??) রবীন্দ্রনাথ এখন মনে হয়, শিক্ষার দিক দিয়ে খুব যে অতটা যেতে পেরেছিলেন তা নয়। তখনকার দিনে যাঁরা ছিলেন - নানা কিংবদন্তীর মধ্য দিয়ে প্রচার হয়েছে। যে সত্যিকারের ওঁর Classical music ভাল লাগতো এবং শান্তিনিকেতনে তখনকার দিনে যারা পড়তো তাদের যাতে Classical এর প্রতি একটা আসক্তি জন্মায় এটা তিনি চিরকাল চাইতেন। কিন্তু সেটা কতটা হয়েছিল তা ভাববার কথা। রবীন্দ্রনাথের Classical এর প্রতি খুব শ্রদ্ধা ছিল। কিন্তু শিক্ষার দিক দিয়ে আজকের তুলনায়, কিছুই ছিল না।
পূ: তাঁর exposure কতদূর হয়েছিল মনে হয়?
সেটা তো কতদূর হয়েছিল জানা যায় না। চলে গেলেন তো কত আগে। আজকের দিনে তিনি বেঁচে থাকলে আগ্রহ কতটা থাকত তা তো আর কেউ বলতে পারে না। নিশ্চয়ই থাকত। কিন্তু তখন আজকে young এবং old people দের মধ্যেও যা আছে তা ছিল না।
পূ: বিশেষ করে বাঙালীদের মধ্যে?
জ্ঞা: ওঁর নিজের সৃষ্টি যেটা নানা (??) বিষয় নিয়ে চিন্তা করেছেন এবং লিখেওছেন। বাংলা গানের পর্যায় হিসাবে নানা বিষয় আছে। রবীন্দ্রনাথের নিজের ভাল লাগার Level যে ছিল খুব উঁচুদরের ছিল এবং সেটা বোধহয় সকলেরই থাকা উচিত। রবীন্দ্রনাথের ভাল লাগার একটা বিশেষ মূল্য আছে। রবীন্দ্রনাথ বলেই। কেন ভাল লেগেছিল। আজকের দিনে বলা মুস্কিল। তখনকার পরিবেশ সংস্কৃতি সবই ছিল আলাদা। সেই সংস্কৃতির সঙ্গেই উনি ছিলেন। উনি রাগরাগিনী মিশ্রন করছেন। ওঁর ভাল লাগলে (??) সেই ভাল লাগাটার একটা মূল্য ছিল। শুধু তখনকার দিনে নয় — for all times! কতকগুলো ভাল লাগা যে কোনও সময় ভাল লাগবে।
(Diary 19-7-87 p 126)
রবীন্দ্রসঙ্গীত ও ক্ল্যাসিকাল প্রসঙ্গে :
ভারতীয় সনাতন classical সঙ্গীতের মধ্যে একেবারে গোড়া থেকে musical culture এর মধ্যে সরলতম থেকে আরম্ভ করে আলঙ্কারিক প্রক্রিয়ার মধ্যে জটিল কুশলতা এসে পড়েছে এবং সেটা নান্দনিক বা aesthetic পর্যায়ে। এ সংগীত নানান ভাবধারায় সম্বলিত হয়েও পূর্নরূপে ভারতীয় - সামগ্রিক রূপে। বাঙালী, মহারাষ্ট্রীয়, গুজরাটি, ওড়িয়া, বিহারী, আসামী বা পাঞ্জাবী regeonal বা প্রাদেশিক সংস্কৃতি থেকে সামগ্রিক রূপে ভিন্ন এবং মৌলিক। অথচ এই সবগুলির সমন্বয়ে তৈরী।
রবীন্দ্রনাথ এই সুমহান বা বিস্তৃত ঐতিহ্যের তুলনায় সীমিত। সেই কারণে ভারতীয় সনাতন সংগীতের সঙ্গে সমকক্ষতার দাবী করতে পারে না। রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত পরিকল্পনা এবং আন্তরিক সৌন্দর্যবোধ বা সৃষ্টি যতই আশ্চর্য হোক না কেন, শিল্পকৌশল এবং সূক্ষ্ম কারুকৃতি, ভারতীয় classical এর তুলনায় বৃহৎ বা মহৎ নয়। অর্থাৎ অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রায়তন।
রবীন্দ্র সংগীত ও classical music প্রসঙ্গে - নব্বইয়ের দশকে আলোচনায় যা বলেছেন, আলোচনা করছি :
"রবীন্দ্রনাথের সময়ে classical music চর্চা যা ছিল, completely পালটে গেছে - আর changed for the better" । নিশ্চয়ই বঙ্গদেশে চর্চার কথা বলেছেন। ... 'যতই ভাবছি খুব ভাল লাগছে', 'শিক্ষার দিক থেকে বিশেষ কিছু ছিলনা' - classical music নিয়ে তাঁর ভাববার সময় ছিল না।' - ভাসাভাসা ভাবে যা জেনেছেন - নিজের মতো করে absorb করে নিজের সৃষ্টি করেছেন। 'রবীন্দ্রনাথের ভাল লাগার level খুব উঁচু ছিল - সকলেরই তেমন হওয়া উচিত। তাঁর 'ভাল লাগার একটা মূল্য আছে' শুধু তখনকার জন্য না for all times to come! সব সময়েই ভাল লাগবে।' ... তারপর - ১৯৮৭ এ ডায়েরীর পাতায় যা পড়লাম তার মর্ম সারা ভারতের ভাবধারা সম্বলিত হয়ে classical music এ যে সুমহান ঐতিহ্য সৃষ্টি হয়েছে তার তুলনায় রবীন্দ্রসংগীত বৃহৎ বা মহৎ না - অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রায়তন।" প্রথমে কিন্তু বলেছিলেন বুদ্ধদেব যে এর সঙ্গে রবীন্দ্রসংগীতের তুলনা করেছে ... সেটা তাঁর ঠিক মনে হয় না।
আমার নিজের মনে হয় Classical music এবং রবীন্দ্রসংগীত এর বিচরণ ক্ষেত্র ভিন্ন প্রকৃতি। মানুষের মনে দু'রকমের অনুভূতি জগৎ সৃষ্টি করে। সুতরাং এ দুই ধরনের মধ্যে তুলনা করা সঙ্গত নয়। Classical music এর বৈশিষ্ট্য বিষয়ে যে আলোচনা করেছেন, অল্প কথায় - তাঁর বক্তব্য অত্যন্ত সঙ্গত এবং সুন্দর। রবীন্দ্রসংগীত বিষয়ে যে আলোচনা করেছেন তাও অতি স্পষ্টভাবে রবীন্দ্রসংগীতের বৈশিষ্ট্যে ফুটে উঠেছে। (??) ডায়েরীতে লেখা বক্তব্য পরে পড়েছি - আমার বক্তব্য বিষয়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া নিয়ে আলোচনার সুযোগ পেলাম না। আমার মনে হচ্ছে Classical music যদি সর্বভারতের ভাবধারার মিলিত হয়ে ভারত মহাসাগরের মতন মহামূল্য সম্পদ সমৃদ্ধ হয়, তবে রবীন্দ্রসংগীত তুষারাবৃত্ত হিমালয় শৃঙ্গ। যার উপর থেকে আলো বিচ্ছুরিত হয়ে নানা রঙের আলো সৃষ্টি করে। যা মানবমনকে আলোকিত আলোড়িত করে নানা ভাবের জগতে অনুরণন ঘটায়।
রবীন্দ্রসংগীত সত্যিই বাংলার বাইরে তেমনভাবে ছড়ায়নি। বাংলা ভাষা রবীন্দ্রনাথের দ্বারা যেভাবে সমৃদ্ধ হয়েছে তা একক, অনন্য সৃজন শক্তিতে ঘটেছে। রবীন্দ্রনাথের কবিতা (কিন্তু ইংরেজিতে লেখা) সারা বিশ্বে সম্মানিত। মনে হয় দেশ স্বাধীন থাকলে বাংলাভাষা শিখে সাহিত্যরসজ্ঞ তার মূল সৃষ্টি পড়তেন। কালিদাস এর রসগ্রহণের জন্য যেমন সংস্কৃত জানা প্রয়োজন, গ্যোয়েটে পড়ার জন্য যেমন জার্মান শেখা প্রয়োজন, সেক্সপীয়রকে জানতে ইংরেজী জানা প্রয়োজন তেমনি রবীন্দ্রনাথের মূল রসগ্রহণের জন্য বাংলাভাষা জানা প্রয়োজন। পর্বতশৃঙ্গ থেকে বিচ্ছুরিত আলোর তুলনা দিয়েছিলাম - রবীন্দ্রসংগীতে আলো সুরে বাজে। 'যে সুরে বাজালে প্রভাত আলোরে' - এমন অনেক উদাহরণ আছে - গ্যোয়েটের কাব্যে সূর্য সঙ্গীতে বেজে ওঠে। এইরকম উঁচু স্তরের কবিদের মনের প্রকৃতি এমন ভাবেই বিশিষ্ট রূপ গ্রহণ করে। রবীন্দ্রসংগীত নৃত্যনাট্য ইত্যাদি ব্যাপক ক্ষেত্রে বিস্তৃত হতে গিয়ে সুরেও হয়তো নতুন মাত্রা যোগ করেছে যা অবাঙালীদের মনেও সাড়া দিতে পারে। এ বিষয়ে যথেষ্ট কাজ হয়নি। রবীন্দ্রনাথের যে সব গান classical এর বন্দিশে সৃষ্ট - যাকে ভাঙা গান বলা হয় - বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত সেইগুলি সরোদে কি রূপ তা দেখিয়েছেন। কিন্তু যে গানগুলি সম্পূর্ণ নিজস্ব সৃষ্টি সেগুলি নিয়ে কতদূর আলোচনা হয়েছে জানি না। তবে সে গানগুলিও অবাঙালী classical গাইয়েদের আকৃষ্ট করেছে। মোহন সিং অত্যন্ত সুন্দর রবীন্দ্রসংগীত করেন। তিনি অবশ্য শান্তিনিকেতনের সঙ্গীতভবনের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু ওস্তাদ রসীদ খাঁঅ অতি সুন্দর রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করেছেন। বাঙালী বিয়ে করে বাংলাভাষার সঙ্গে কিছু পরিচয় আছে। কিন্তু বাঙালী সংস্কৃতিতে প্রতিপালিত নন। বাংলাভাষার সঙ্গে সম্পূর্ণ অপিরিচিত অবাঙালী classicalগাইয়েদের রবীন্দ্রসংগীত শুনিয়ে প্রতিক্রিয়া জানা প্রয়োজন।
একদিক দিয়ে রবীন্দ্রসংগীত অভারতীয়। কারণ ভারতীয় classical সঙ্গীত থেকে লোকসঙ্গীত পর্যন্ত ব্যক্তিগত গায়কের কথা ও সুর বিস্তারের স্বাধীনতা থাকে, কিন্তু রবীন্দ্রসংগীতে কথা ও সুর এতই অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত হয়ে সৃষ্ট, যে এমন স্বাধীনতা (??) তা হয় না। সঙ্গতও না। পশ্চিমী কম্পোজারদের সৃষ্ট সঙ্গীত যেমন যথাযথ ভাবে পরিবেশিত হয় তেমন। কোনও কোনও শিল্পী অবশ্য রবীন্দ্রসংগীতে কিছুটা সুর বিস্তার করেন - কিন্তু তা অতি বিশিষ্ট গুণী শিল্পীর ক্ষেত্রে ঘটা বাঞ্ছনীয়।
জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ ভাষার বিশুদ্ধতা রক্ষা এবং বিশুদ্ধ উচ্চারণের প্রতি বিশেষ মূল্য দিয়েছেন। মনে হল রবীন্দ্রসংগীতে যেমন ভাষার বিশুদ্ধ প্রয়োগ যতটা গুরুত্বপূর্ণ classical music এর পরিবেশনের ক্ষেত্রে কি তেমনই হবার কথা? তার পরেই মনে পড়লো আমীর খাঁর খেয়ালের বন্দিশ উচ্চারণের কি অপূর্ব সৌন্দর্য! যাইহোক 'ক্ষুদ্রায়তন' মহৎ বা বৃহৎ না পড়ে অনেক কথা মনে পড়লো। রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞরা এ বিষয়ে অনেক কথা বলেছেন - আমার পক্ষে বেশী আলোচনা করা ঠিক নয়। Classical বহু মানুষের বহুদিনের চিন্তা ও প্র্যোগের উদ্যোগে সৃষ্ট বিরাট সৃষ্টি ঠিকই কিন্তু সমান্তরালভাবে 'মহৎ' - এক সৃষ্টি যে হতে পারে তার অনেক উদাহরণ আছে। রবীন্দ্রনাথ নিজেই বিদ্যাসাগর বিষয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছেন হঠাৎ একজন 'মানুষ' সৃষ্ট হল। রবীন্দ্রনাথ নিজেও তেমন একজন 'মানুষ' এবং তেমন মানুষের মাঝে মাঝে উদয় হয়। তার ফলে আমরা মনের প্রায় সবরকম অনুভূতি উপলব্ধি ও প্রকাশের পথ পেয়েছি। 'বিষাদ' মুক্ত হবার পথ পেয়েছি।
জ্ঞানবাবুর সঙ্গে নিঃসঙ্কোচে সঙ্গীত বিষয়ে যা খুশী আলোচনা করেছি তাই এত কথা বলার প্রেরণা পেলাম। কথাগুলিতে তাঁর প্রতিক্রিয়া কী হত জানি না। তবে মনে হয় খুব বিরুদ্ধ অনুভূতি তাঁর হত না। আর একটা কথা মনে পড়ল - তাজমহল ভাল লাগলেও 'কোনারক' মন্দির আমার খুবই ভাল লাগে। এবং লক্ষ্ণৌর বা বেনারসী টপ্পা খুব ভাল লাগলেও, কালী পাঠকের (??) টপ্পা ভাল লাগতো। ভুঁড়িওয়ালা মহাদেব ও গনেশ এর মধ্যে নিশ্চয়ই এমন কিছু আছে যার জন্য অসংখ্য মানুষ তাঁদের নিয়ে মেতে উঠেছে! সমান্তরাল ভাল লাগা!
রম্যগীতি :
ডিক্সন লেনে তবলা শিক্ষার সময় দেখেছি জ্ঞানবাবুর সৃজনে মেতে ওঠার পর্যায় - রম্যগীতি রচনা! বলতেন আকর্ষনীয় বাংলা গানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের রাগসংগীতের সঙ্গে পরিচিত করা তাঁর উদ্দেশ্য। ব্যাপারটার কিন্তু রাগপ্রধান গানের সঙ্গে তফাৎ আছে। রাগপ্রধান এ রাগের ভূমিকাই প্রধান তার প্রকাশের জন্য বাণীর ব্যবহার। রম্যগীতিতে গানের ভিতর দিয়ে রাগের প্রবেশ। সেই সময়ে তাঁর গুণী ছাত্র প্রসূণ ব্যানার্জী-র অপূর্ব গান শুনেছি 'নিশীথ শয়নে জাগে আঁখি উদাসী'। প্রসূনের অকাল মৃত্যু বাঙালীর গান ও বাংলা গানের একটা বড় ক্ষতি। রম্যগীতি তাঁর কণ্ঠেই প্রথম শুনেছি। তারপর রেডিওতে জ্ঞানবাবুর নিজের গাওয়া সুন্দর গান শুনেছি। পরবর্তীকালে অজয় চক্রবর্তীর কণ্ঠেও অতি সুন্দর গান শুনেছি। অন্যান্য ছাত্রছাত্রীরাও অনেকে গাইতেন। আমি বেশি শুনিনি। জ্ঞানপ্রকাশের প্রধান ভূমিকা ছাত্র তৈরীর - গুরুর ভূমিকা। রম্যগীতি বিষয়ে জ্ঞানবাবুর সঙ্গে বিশেষ আলোচনা হয়নি। সুতরাং সে বিষয়ে আমার বিশেষ কিছু বলার নেই। তবে অনেক ছাত্রছাত্রী নিশ্চয়ই সংগ্রহ ও সংকলন করেছেন। মানস বলেছিল তবলায় জ্ঞানপ্রকাশের অজস্র সৃজন সংগ্রহ করে বই লিখছে - তাতে রম্যগীতির সংকলনও আছে। বইটা প্রকাশিত হয়েছিল কিনা জানি না। আমি দেখিনি। রম্যগীতি সৃষ্টি বিষয়ে তাঁর খুবই মমতা ছিল।
সর্বভারতীয় অভিজ্ঞতায় শিক্ষাদানের প্রস্তুতি ও পরিনতি :
পূ: কলকাতায় ১৯৩১ থেকে তবলা ও গান শিখতে শুরু করলেন। তারপর ১৯৩৪ এ এলাহাবাদ Conference এ গান শুনে classical music সম্বন্ধে আপনার ধারনা পালটে গেল। It was a turning point in my life বলেছিলেন, বলেছিলেন এদের গান আরও logical! গানের ব্যাপারে logicalটা কী ব্যাখা?
জ্ঞা: ১৯৩৪ এ এলাহাবাদে গিয়ে গান শুনে আমার চক্ষুস্থির হয়ে গেল। দেখলাম এদের ব্যাপারটাই আলাদা। নাসিরুদ্দীন কে শুনলাম। অপূর্ব! কী control গলার ওপর! নাসিরুদ্দীন সংস্কৃত শিখেছিলেন ভাল করে। ভাল উচ্চারণে ব্যাখ্যা করতেন। তাঁর গানে ভাষা, ভাব, সুর, লয়, গায়কীর মধ্যে কী সামঞ্জস্য বিধান! logical কথাটার অর্থ হল এই সঙ্গতিপূর্ণ treatment-এ প্রকাশ! logical অর্থাৎ সঙ্গত। এটা বাঙালীদের মধ্যে হয়নি।
পূ: কেন হয়নি বলে আপনার মনে হয়? বলেছিলেন সঙ্গীতের পণ্ডিতদের সঙ্গে সাহিত্যিকদের যোগাযোগ ছিল না বলে ক্ষতি হয়েছে। তাছাড়া এখান ওখান থেকে কিছু নিয়ে গড়ে উঠেছে বলে কি? বাঙালীদের তো কোনও নিজস্ব classical গানের tradition ছিল না!
জ্ঞা: কথাটা যখন উঠেছে - এ কথাটা আমাকে আগে কেউ জিজ্ঞেস করেনি আর আমার বলবার অবকাশ হয়নি। এখনও মনে আছে নাসিরুদ্দীন সংস্কৃত শিখেছিলেন ভাল করে - ভাল উচ্চারণে ব্যাখ্যা করতেন। হিন্দীতে গাইতেন। তার মধ্যে একটু উর্দু না হলে হিন্দুস্থানী হয় না, ভাষাটা ছিল উর্দু, হিন্দী আর সংস্কৃত মিশিয়ে। ভাষার শুদ্ধ উচ্চারণ দরকার।
পূ: ভাষা-ভাব ইত্যাদি মিলে সঙ্গতিপূর্ণ বিকাশ বাঙালীদের মধ্যে হয়নি কেন?
জ্ঞা: বাঙালীরা বিকৃত করেছে।
পূ: তা কেন? হল?
জ্ঞা: সুনীতি বাবু যদি গান করতেন, হত না। সাহিত্যিকদের সঙ্গে সঙ্গীতের ঘনিষ্ঠতা ছিল না।
পূ: নাসিরুদ্দীন মুসলমান আমলে কী করে সংস্কৃত শিখলেন এবং তার ব্যাপারটা বুঝে প্রয়োগ করলেন?
জ্ঞা: নাসিরুদ্দীন ইন্দোরের ছিলেন। ওইখানে বাস করতেন। আমীর খাঁও ইন্দোরের। নাসিরুদ্দীনের ছেলে আমিনুদ্দীন এখনও জীবীত। সে সংস্কৃত শিখেছে কিনা জানিনা তার দাদা শিখেছিলেন। মুসলমান মানে ইসলাম ধর্ম নিয়ে মারামারি নয়। ওদের একটা গুণ ছিল। ওরা খুব artistic । হিন্দুরাও ছিল! কিন্তু হিন্দু architecture আর মুসলমান architecture এর তফাৎ মন্দির আর তাজমহল দেখলে বোঝা যায়। যেমন মহাদেব বললেই তার চেহারা বেশ হৃষ্টপুষ্ট ভুঁড়িওয়ালা না হলে - তাতে একটা হিন্দুহিন্দু ভাব আছে। মুসলমানদের পছন্দটা খুব finery র দিকে। হিন্দুরা gross। গানেও যেমন টপ্পা - আমাদের হল নিধুবাবুর - বে এ এ এ এ এ। slow! দ্রুত হবে না - সূক্ষ্ম হবে না। দ্রুততার দিকে - fast movement - finery মুসলমানদের। মুসলমানরা ধ্রুপদ থেকে খেয়াল, ঠুংরী টপ্পায় চলে গেল কারণ fineryর দিকে ওদের art।
পূ: আপনি বলছেন হিন্দুরা একটা স্থির অবস্থায় ছিল এরা আরও evolve করে নিয়ে গেল?
জ্ঞা: evolved কোনটা বলা মুস্কিল। ওদের প্রগতি-গতিশীলতা বেশী। আমাদের যতটা slow হবে -slow টা আমরা বুঝতে পারি হিন্দুদের মধ্যে বোধগম্য সেটাই।
পূ: আপনি বলছিলেন এখনকার দিনে বাঙালী ছেলেমেয়েরা সঙ্গীতে যে রকম আগ্রহ - যে রকম ভালভাবে শিখতে পারছে রবীন্দ্রনাথের সময় - আপনাদেরও সময়ে তেমন ছিল না। change for the better! বলেছিলেন - এলাহাবাদে নাসিরুদ্দীন, আবদুল করিম, এনায়েৎ খাঁ শুনে যে বাঙালীদের মধ্যে তেমন হয়নি। এই বোধের ভিত্তিতে আপনি নিজেকে নতুন ভাবে creative পথে নিয়ে যেতে কি বাধা পেয়েছিলেন?
জ্ঞা: বাধা আমি মানব কেন?
পূ: আপনার তো খুব enquiring mind। আমি বলছি অন্যদের কথা - এমনি সাধারণ শিক্ষার্থীদের এগিয়ে যাবার পথে পরিবর্তনের পথে বাধা ঘটেছিল মনে হয়?
জ্ঞা: একশো বার! এখানে যে গুরুকে পণ্ডিত বলে শ্রদ্ধা করতাম তাঁর কাছ থেকে এমন ছেলেমানুষী কথা শুনতে হয়েছে যে শ্রদ্ধা থাকা মুস্কিল - আরও পণ্ডিতদের কাছেও তেমন শুনেছি। এঁদের চেয়ে সত্যেন বোসের সঙ্গীতবোধের বিষয়ে বেশী শ্রদ্ধা ছিল। এমন সব কথা শুনতে হয়েছে যে মনে দুঃখ পেয়েছি। কিন্তু নিজের বিচার ছাড়িনি। এমনও ঘটেছে - সঙ্গীতের পণ্ডিত গাইছেন - সঙ্গে আমি হারমোনিয়ম বাজাচ্ছি। তানপুরা মেলাচ্ছেন - এক শ্রুতি কম। পণ্ডিত হলেই তো হবে না - যথাযথভাবে সঙ্গীত প্রকাশ করতে হবে।
পূ: ক্রিয়াসিদ্ধ বিদ্যা!
জ্ঞা: আমার নিজেকে correct করে নিতে হয়েছে।
পূ: বিষ্ণুপুর ঘরানা কি একটা উল্লেখযোগ্য ঘরানা বলে মনে করেন?
জ্ঞা: উল্লেখযোগ্য ছিল ঠাকুরবাড়ীতে। সেখানে ইন্দোর, রাজস্থানের প্রবেশ ঘটেনি। এখন হয়ে গেছে। অমিয় আসে আমার কাছ থেকে আমার খেয়ালের বন্দিশ কিছু নিয়েছে। কিন্তু তার বাড়ীতে তা প্রকাশ করতে পারে না।
১৯৯২ তে এই পর্যন্ত আলোচনা হয়েছিল। তার পরে আর দেখা হয়নি। অনেক কিছু জানার ইচ্ছে ছিল। হল না। অমিয় বন্দ্যোপাধ্যায় পরবর্তীকালে একদিন অনুষ্ঠান করলেন। শুরুতেই বললেন আমি কিন্তু বিষ্ণুপুর ঘরানার গান করব না। ভাল গাইলেন। আমার সমবয়সী, বন্ধুত্ব হয়েছে। তখন অবশ্য তাঁর পিতা সত্যকিঙ্কর জীবিত ছিলেন না। হয়তো পরবর্তীকালে গবেষক, গায়করা এই ঘরানার সম্বন্ধে জানবেন - কিছুটা পুনরুদ্ধার করতেও পারেন।
জ্ঞানবাবু নিজেকে বিশ্লেষণ করে নতুন অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে শিক্ষা পদ্ধতি গড়ে তুলে কত গুণী ছাত্রছাত্রী তৈরী করেছেন আমরণ। সময়োপযোগী শিক্ষাদান ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন। শিক্ষার্থীদের তৈরী করে তাঁর ঘনিষ্ঠ অন্য গুণী অবাঙালী মুসলমান ওস্তাদের কাছে শিক্ষালাভ করতে প্রেরণা দিয়েছেন। তাঁর হাতে সারা ভারতে সম্মানিত কয়েকজন বিশিষ্ট বাঙালী ও সংগীতশিল্পী তৈরী হয়েছে - তাঁর কাছে শিখে গোলাম আলি খাঁর কাছে শিখেছেন। তাঁর এই উদার নীতিও কিন্তু অন্যান্য বাঙালী গুরুরা বলেন না। গুরু পরিবর্তন করলে বিরক্ত হন। তবলায় অনেকে তৈরী হয়েছেন শুধু তাঁর কাছে শিখেই সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছেন। গানে প্রসূন ব্যানার্জী, অরুণ ভাদুড়ী, অজয় চক্রবর্তী - আরও অন্যান্য অনেকে। তাঁর ছাত্রী সুকণ্ঠী সুগায়িকা প্রভাতী মুখার্জী আমাদের স্কুলের ছাত্রী ছিল আমাদের বাড়ীর কাছে থাকত। সে পরবর্তীকালে গোলাম আলির কাছে শিখেছিলেন। তার বাড়ীতে গোলাম আলির শেষ গান শুনেছি ঘরোয়া পরিবেশে। কিন্তু তখন stroke হয়ে অসুস্থ অবস্থায় গান করলেন সীমিত (??) ভাবে। নিজেই বুঝেছিলেন গানের সেই সৌন্দর্য প্রকাশিত হয়নি। বললেন 'গান যৌবনের জন্য'। ছোট একটি অনভিজ্ঞ ছেলে তবলা বাজাচ্ছিল - তাকে খুব উৎসাহ দিলেন। তাঁর ব্যক্তিত্ব মধুর ছিল। আমীর খাঁ শুনেছি একজন বন্ধুকে বলেছিলেন এখন অঁর গান গাওয়া উচিত না। তবে এই প্রজন্মের শ্রোতারা ভাবে উনি বুঝি এইরকমই গান!
মনে পড়ল খুব অল্প বয়সে কলকাতায় গোলাম আলি খাঁর প্রথম অনুষ্ঠান শোনার স্মৃতি। ঘরভর্তি শ্রোতারাসহ এই নতুন শিল্পীর অতুলনীয় নতুন শিল্পীর গানে চমৎকৃত হয়েছিলাম। সঙ্গে কেরামৎ উল্লা খাঁ তবলা সঙ্গত করেছিলেন আর হারমোনিয়ম বাজিয়ে ছিলেন জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ - বহু অনুষ্ঠানে এই শিল্পী যুগল সঙ্গত করেছেন। নিজের অনুষ্ঠান - শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান করে সর্বদা তাঁর পরিবেশকে আনন্দে মাতিয়ে রেখেছিলেন। আমাদের তবলা ক্লাসে আমার এক নৃতাত্ত্বিক বন্ধু একটি আমেরিকান মেয়েকে নিয়ে গিয়েছিলাম। সে বলল 'এই ঘরে এত আনন্দ কী করে?' (??)
সুর ছন্দের এই অফুরন্ত আনন্দের ফোয়ারা স্তব্ধ হল ১৯৯৭ এর ১৮ই ফেব্রুয়ারী! সৃষ্টির যে সম্ভার ভরে উঠলো তার বিস্তারের বিপুলতা দেখে মনে হয় ১৮৬১-র পঁচিশে বৈশাখ কলকাতার জোড়াসাঁকোর একটি ঘরে যা ঘটেছিল তার বিকীরণের 'কিছু ছোঁয়া' নিশ্চয়ই পৌঁছেছিল ১৯১২-র পঁচিশে বৈশাখে কলকাতার ক্রীক রোর একটি ঘরে।
[বহু ছাত্রছাত্রী, বন্ধুবান্ধবদের কাছে তাঁর সৃষ্টির যে সব নিদর্শন ছড়িয়ে আছে তা সঙ্কলন করে, রেডিয়োতে যা আছে সংগ্রহ ও সংকলন করে "জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ" সংগ্রহশালা গড়ে তোলা একটি অত্যন্ত জরুরী কাজ।]