বড় নাতি হওয়ার অনেক জ্বালা। বড়দের তার কাছে এক্সপেক্টেশন একেবারে আকাশচুম্বী। ভালো ছেলে হতে হবে, পড়াশুনোয় ভালো হতে হবে, বড়দের শ্রদ্ধা-ভক্তি করতে হবে। অমলের কাছে সেটা আর এক কাঠি বাড়া — গরমের ছুটির সময় দাদু-দিদা হাওয়া বদলাতে গেলে তাদের এসকর্ট করতে হবে। প্রথম দিকে সে একটু গাঁই-গুঁই করেছিল, কিন্তু তা ধোপে টেঁকে নি। ওঁদের বয়স হয়েছে —একা কোথাও যাওয়া কি সম্ভব। আর বাড়িতে অমল ছাড়া আর কেই বা এ কাজ করতে পারবে, ওর মতো ভালো ছেলে আর কটা আছে। ভদ্র-সভ্য, কলেজ যাবো-যাবো করছে - বালিগঞ্জ গভর্নমেন্টের মুখ উজ্জ্বল করবে স্কুলের টিচার সুদ্ধ সবাই আশা করে, কোনো বদ অভ্যেস নেই, আর পলিটিক্স থেকে দূরে থাকে। যখন নকশাল আন্দোলনের ঝাঁঝে সারা পশ্চিমবঙ্গ দাউ-দাউ করে জ্বলছে তখন এটা প্রায় বিরল ব্যাপার।
অমলের দাদু নাম করা ডাক্তার। তাঁর পেসেন্টদের মধ্যে অনেকেই বেশ পয়সা-কড়িওলা লোক। তাদের মধুপুর, দেওঘর ইত্যাদি জায়গায় বাড়ি আছে। বড়লোকদের হাওয়া বদলের জায়গা। আর এইসব জায়গার হাওয়া কলকাতার মতো ধোঁওয়া-ধুলো ভর্তি নয়, আর জল এমন ভালো যে যা খাবে তাই হজম হয়ে যাবে। ডাক্তারবাবুকে কয়েক সপ্তাহ সেখানে থাকতে দিলে তারা বর্তে যায়। আগের বছর পুজোর সময় অমল দাদু-দিদাকে নিয়ে মাসখানেক ছিল মধুপুরের এক বাংলোয়। এ বছর ঠিক হল রাজগীর যাওয়া হবে। অমলের ইচ্ছে ছিল এবার কলকাতায় থেকে পুজো দেখবে। কিন্তু তা আর হল কই। এবারেও যখন মা ওকে এই ব্যাপারে বললেন তখন অমল রাগে প্রায় ফেটে পড়েছিল। তা দেখে মা একেবারে অবাক। ছেলেকে এমন রেগে যেতে কোনোদিন দেখেন নি। কিন্তু অমল ভালো ছেলে, ভালো ছেলেদের কি মা-বাবার অবাধ্য হতে আছে। তাই কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে রাগ চেপে রেখে মার প্রস্তাবে রাজি হতে হল। খালি মাকে প্রমিস করে দিল যে এইবারেই শেষ। আর কোনো পুজোর সময় সে কলকাতা ছেড়ে কোন ধাপধাড়া গোবিন্দপুরে থাকতে পারবে না। তার জন্য যদি লোকে খারাপ ছেলে বলে তাও রাজি।
সুতরাং পুজোর ছুটিটা কলকাতায় কাটানোর আশা জলাঞ্জলি দিয়ে অমল স্যুটকেশ গুছোতে আরম্ভ করল। মাসখানেক থাকতে হবে, ওখানে ঠাণ্ডাও বোধহয় কিছুটা পড়ে যাবে—কিছু জামাকাপড়, সোয়েটার, টুথব্রাশ, পেস্ট ইত্যাদি, আর ওর ছবি আঁকার নানান সরঞ্জাম। প্রতি বছর বছর জন্মদিনের পাওয়া টাকা দিয়ে জি সি লাহার দোকান থেকে কেনা জল রং-এ আঁকার কাগজের প্যাড, ড্রাই প্যাস্টেল, সফ্ট প্যাস্টেল, চারকোল, নানান নম্বরের পেনসিল, নানা সাইজের তুলি ইত্যাদি। এ সবই স্যুটকেসের বেশি জায়গা নিয়ে নিল। অমল ছোটোবেলা থেকেই ছবি আঁকতে ভালোবাসে, জল-রং, প্যাস্টেল, চারকোল-পেনসিল স্কেচ সবেতেই ওর উৎসাহ। হাতও মন্দ নয়। স্কুলের আর্ট টিচার কমলবাবু ওর হাতের আঁকা দেখে বলেছিলেন হায়ার সেকেণ্ডারি পাশ করে গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজে ঢুকতে। ওর নাকি নামজাদা শিল্পী হওয়ার সম্ভাবনা আছে। অমল সাহস করে এ কথা মা-বাবাকে বলতে পারে নি। ছেলে পড়াশুনোয় ভালো, তাই তাঁরা ধরে বসে আছেন যে সে এঞ্জিনিয়ারিং স্কুলে যাবে অথবা ডাক্তারি পড়বে। শিল্পী হওয়া! আউট অফ কোয়েশ্চেন।
পুজোর ছুটির কিছু পরেই অ্যানুয়াল পরীক্ষা, তাই সঙ্গে নিতে হল পড়ার বই। অবশ্য সকালে দাদু-দিদাকে নিয়ে হাঁটতে নিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কি এমন কাজ। পড়াশুনো করে আর ছবি এঁকেই সময় কাটাতে হবে। পড়ার বইগুলো স্যুটকেসে ঢোকানোর পর অমল চারদিকে একটু দেখে নিল, কেউ নেই তো। তারপর সন্তর্পণে কাঁধের ব্যাগ থেকে কতগুলো চটি বই জামা-কাপড়ের ভাঁজে-ভাঁজে ঢুকিয়ে দিল। ওর প্রাণের বন্ধু প্রণবের দেওয়া। মা-বাবা জানে প্রণব ভালো ছেলে, পড়াশুনোয় ভালো। কিন্তু তলে-তলে তার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আর সেই পরিবর্তনের হাওয়া যে অমলের গায়েও লাগতে আরম্ভ করেছে তা তাঁরা আদৌ জানেন না।
হাওড়া স্টেশনে ওদের ট্রেনে তুলতে এসে অমলের বাবা-মা পাখি পড়িয়ে গেলেন — দাদু-দিদার যত্ন নেবে। ছবি আঁকো ঠিক আছে, কিন্তু পড়াশুনো করতে যেন ভুল না হয়। অমল তাদের সান্ত্বনা দিয়ে জানালো যে তাদের চিন্তার কোনো কারণ নেই — পড়াশুনো, দাদু-দিদার যত্ন এ সবই ঠিকমতো করবে। আর ঠিক মনে করে প্রতি সপ্তাহে সব খবর দিয়ে একটা পোস্টকার্ড পাঠিয়ে দেবে।
রাজগীরে ওরা উঠলো একটা ছোটো বাংলোতে, বেশ অনেকখানি জায়গা নিয়ে একতলা বাড়ি। দুটো শোবার ঘর, রান্নার ঘর, খাওয়ার জায়গা, বাথরুম, যেমন হয় আর কী। সামনের বারান্দা থেকে হলুদ-লাল মোরাম ছড়ানো লম্বা রাস্তাটা অনেকদূর চলে গিয়ে পিচ-ঢালা বড় রাস্তায় গিয়ে মিশেছে। বেলা পড়ে এলে রাস্তাটার দু-পাশের বড়-বড় গাছগুলো লম্বা-লম্বা ছায়া ফেলে। অনেকদিন অমল একা-একা বেড়িয়ে ফিরে আসতে আসতে দেখতে পায় বারান্দায় দাদু-দিদা বসে বিকেলের চা খাচ্ছেন। একটা লোক আছে, সেই চা করে দেয়, দু-বেলা রান্না করে, বাজার আনে, ঘরদোর ঝাঁট দেয়। বারান্দার ঠিক সামনে গোলাপ-দোপাটি-গাঁদার কেয়ারি। ওর জন্য একজন মালি আছে। সে নিয়মিত এসে গাছে জল দেয়, আগাছা পরিষ্কার করে। ফুল গাছের বাগানের পর ছোট্ট একটা সবুজ ঘাসে-ভরা লন, তার পরেই আরম্ভ হয়েছে লম্বা-লম্বা গাছের সারি। বাড়িটার বাঁ-দিকে খানিকটা সবুজ ঘাসের ঢালের পর ঘন শালের জঙ্গল। যতদূর চোখ যায়। নীল-সবুজ লম্বা-লম্বা গাছের আগায় রোদ ঝিকমিক করে। এদিকে রাতে এত অন্ধকার যে পাশে কেউ বসলে দেখা যায় না। আর ওপরে তাকালে দেখা যায় তারাভরা বেনারসী আঁচল।
ডানদিকে গাছের সারির মধ্যে দিয়ে চোখটা খানিকটা দূরে গিয়ে আটকে যায় পাশের বাড়ির পাঁচিলে। সেই ঘেরা পাঁচিলের মধ্যে একইরকম একটা বাংলো। সেখানেও বোধহয় ওদের মতো কারা এসেছে পুজোর ছুটি কাটাতে। আলাপ হয়নি। তবে প্রায়ই সন্ধের পর বাঁশি বাজানো শোনা যায়। কিন্তু এ কি রকম বাঁশি বাজানো! মাঝে-মাঝে মনে হয় যেন নতুন বাজাতে শিখছে, কাটা-কাটা, মাঝে-মাঝে বেসুরো। তবে মজার কথা সেই বাজনার মধ্যে কেমন যেন একটা ছন্দ আছে। কিছুটা ওঠা-নামা বাজনা, তারপর কিছুটা থামা, তারপর আবার বেসুরে উঁচু-নিচু। অমল বইতে পড়েছে টেলিফোনের প্রচলনের আগে টেলিগ্রাফে টরে-টক্কা-টরে-টক্কা করে খবর পাঠানো হত। অনেকটা সেই ধরনের। লোকটা ভালো বাজাতে পারে না, অথচ বাজানোর ইচ্ছে আছে ষোলোর ওপরে আঠারো আনা। শেখে না কেন!
অমলের দাদুর চেহারা বাঙালিদের মধ্যে সচরাচর দেখা যায় না। মাথায় প্রায় ছ-ফিট, ফর্সা, মেদবিহীন শরীর। পরনে সাদা হাতকাটা শার্ট, আর সাদা ধুতি। শীতকালে বড়জোর একটা খয়েরী রঙের হাতকাটা সোয়েটার। মাথার চুল ধবধবে সাদা, আর ঠোঁটের তলায় একতাড়া সাদা গোঁফ হলুদে-সবুজে মেশানো, নস্যির কল্যাণে। থেকে থেকেই দাদুর পকেট থেকে একটা রূপোলী নস্যির ডিবে বেরোয়। সেখান থেকে এক চিমটে নস্যি নাকে টেনে হ্যাঁচ্চো হ্যাঁচ্চো করে হেঁচে নিয়ে ধুতির খুঁটে নাক মোছা। বলাই বাহুল্য যে ধুতির খুঁটটাও নস্যি আর সর্দি মেশানো একটা রং নিয়েছে। এসব দেখে অমলের বেশ ঘেন্না পায়, কিন্তু দাদুর ওপর কোনো কথা বলার সাহস অমল তো বটেই অন্য কারোরই নেই। দাদুর পাশে ছোট্ট-খাট্টো লাল পাড় সাদা শাড়ি পরা দিদাকে বেশ বেমানানই লাগে। তবে গায়ের রং, টিকোলো নাক দেখে বোঝা যায় যে উনি এককালে বেশ সুন্দরী ছিলেন।
চেহারা ছাড়াও দাদুর আর এক ব্যাপারে খ্যাতি আছে, তা হল গলার আওয়াজ। রেগে গেলে তাঁর বাজের মতো গলার আওয়াজ পাড়ার এ মুড়ো থেকে ও মুড়ো শোনা যায়। একদিন কি কারণে অমল কলকাতায় দাদুর ডিস্পেনসারিতে গেছে। দাদু নিজের চেয়ারে বসে রোগী দেখছেন। কিছু লোক সামনে চেয়ারে বসে, আর কিছু দাঁড়িয়ে। দাদু কি হয়েছে জিজ্ঞাসা করে নাড়ি দেখার পর ঘস-ঘস করে সামনে রাখা প্যাডে ওষুধ লিখে দিচ্ছেন, আর সেই রোগী বলাইদা কম্পাউণ্ডারের কাছে ওষুধ কিনে নিয়ে চলে যাচ্ছে। এটাই রীতি। একজন কী খেয়ালে দাদুকে জিজ্ঞাসা করেছে - 'ডাক্তারবাবু, আমার কি হয়েছে?' ব্যাস্, দাদু তাঁর বাজখাঁই গলায় বোমার মতো ফেটে পড়লেন - 'যদি বলি তোমার কি হয়েছে, তা বুঝতে পারবে?' সেই লোকটিতো পালানোর পথ পায় না।
দাদু সাধারণত বেশি কথা বলেন না। কিন্তু অমলকে সামনে পেলেই তাঁকে কথায় পেয়ে বসে। সামনে বসা রোগীকে ডেকে বলেন — 'এ আমার বড় নাতি অমল। বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুলের মুখ উজ্জ্বল করবে। তারপর কলেজ থেকে বেরিয়ে অ্যামেরিকায় গিয়ে ক্যান্সারের ওপর রিসার্চ করবে। অ্যামেরিকায় যাওয়া ও ক্যান্সার-রিসার্চ করার আইডিয়াটা যে দাদুর মাথায় কি করে এলো তা অমল জানে না। কারণ সায়েন্স নিয়ে পড়ার তার কোনো ইচ্ছে নেই। কমলবাবুর কথা শুনে সে গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজে পড়ে আর্টিস্ট হবে। যদিও তার মনের কথাবাবা-মাকে কখনো জানায় নি।
সকাল সাতটা - সাড়ে সাতটায় এক কাপ চা আর দুটো বিস্কুট খেয়ে নিয়ে দাদু-দিদার সঙ্গে হাঁটতে বেরোয় অমল। অক্টোবরের প্রথম দিক, কিন্তু সকালে বেশ ঠাণ্ডা থাকে। তাই গায়ে সোয়েটার, তার ওপরে আলোয়ান, পায়ে মোজা ইত্যাদি পরতে হয়। হাঁটতে-হাঁটতে তারা কাছের গ্রামটাতে পৌঁছে যায়। তখন সবে দোকানপাট খুলতে আরম্ভ করেছে। কিছু লোকজন মাথার ওপর শাল জড়িয়ে রোদের ওম নিচ্ছে। একটা চায়ের দোকানের সামনে দুটো সাইকেল দাঁড় করানো। ধোঁয়াওলা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে জটলা চলছে। একপাশে তেলেভাজার জন্য আয়োজন আরম্ভ হয়ে গেছে। কোথাকার একটা নেড়ি কুকুর সামনে দু-পায়ের ওপর ভর দিয়ে বিজ্ঞের মতো এইসব আয়োজন দেখছে। হাটের দিন দোকানপাট একটু আগে খোলে। সেইসব দিন ডিম বা মাছ কিনে হাতে পুঁটুলি ঝুলিয়ে বাড়ি ফেরা হয়। অমলদের সেই প্রতিবেশী বাড়িটার সামনে কয়েকবার যাতায়াত করেও ওখানে যে কেউ আছে বলে মনে হয়নি। খালি একদিন সারা মুখ শাল দিয়ে জড়ানো এক ভদ্রলোক ওদের তিনজনকে দেখে 'গুড মর্নিং' বলেই ভেতরে ঢুকে যান। তাতে বোঝা যায় যে ওখানে কেউ থাকে।
হেঁটে বাড়ি ফেরার পর পেটে খিদে আগুনের মতো জ্বলতে থাকে। তাই হাতে-করা আটার রুটি, আলুর তরকারি আর একটা মিষ্টি একেবারে অমৃতের মতো লাগে। ব্রেকফাস্টের পর বেলা একটা-দেড়টা অবধি অমলের পড়ার সময়। নিজের ঘরে জানলার সামনে টেবিলে বই ছড়িয়ে সে পড়তে বসে। মাঝে-মাঝে মাথা তুলে দেখে সামনের পিচওলা রাস্তা দিয়ে বাস যাচ্ছে দু-একটা। মাঝে-মাঝে মাথায় মোট নিয়ে লোক চলেছে। একটা সাইকেল অনেকক্ষণ ধরে রিং বাজাতে বাজাতে চলে গেল। অমল মাথা তুলে দেখে সামনে যে চালাচ্ছে তার পিছনের কেরিয়ারে একটি গোলাপি রঙের শাড়ি পরা বৌ বসে। তাই বোধহয় এত ভেঁপু বাজানোর ঘটা। সামনের মোরাম-বিছানো রাস্তার ওপরে লম্বা-লম্বা গাছের ছায়া বেলা বাড়ার সাথে সাথে পাল্টাতে থাকে। সকালের দিকে ছায়াগুলো বেঁটে বাঁটকুল, আর বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যেগুলো বেড়ালের ল্যাজের মতো ফুলতে থাকে। দুটো ছায়া সমান্তরাল চলছে হঠাৎ পাশ থেকে একটা ছায়া বাড়তে বাড়তে একটা অসম চতুর্ভুজ তৈরি ফেলল। এসব দেখতে দেখতে অমল কেমিস্ট্রির বইতে মন দেয়।
দুপুরের খাওয়া শেষ হলেই দিদা-দাদু ভাতঘুম দিতে যান আর অমলের হাতে অঢেল সময়। অমল বেরিয়ে পড়ে। কাঁধে ঝোলানো থাকে একটা ব্যাগ, তাতে রং, তুলি, আঁকার কাগজ ইত্যাদি, আর প্রণবের দেওয়া সেই চটি বইগুলো। আর থাকে প্ল্যাস্টিকের বোতলে জল, খাওয়ার কাজ চলে আবার আঁকার কাজও চলে যায়। বাড়ি থেকে একটু দূরে গিয়েই অমলের পকেট থেকে বেরোয় একটা সিগারেটের প্যাকেট আর দেশলাই। মুখে একটা ব্যাঙ্গের হাসি টেনে অমল একটা সিগারেট ধরায়। হুঁ, অমল ভালো ছেলে, বিড়ি-সিগারেট খায় না! তোমরা জানো না এই অমল আর সেই অমল নেই। কারোর জন্মদিন বা অন্য কোনো পার্টিতে গেলে মা-বাবারা তাদের ছেলেমেয়েদের অমলকে দেখিয়ে বলে — 'একে দেখেছো, এর মতো হও'। শুনে শুনে কান পচে গেলেও খারাপ লাগে না। কোথায় যেন একটা অনুশোচনার খোঁচা লাগল। 'দূর ছাই' বলে হাতের আধ-খাওয়া সিগারেটটা একটা গাছের গুঁড়িতে ফেলে দিল অমল। তারপর প্যান্টের বোতাম খুলে ছর-ছর করে পেচ্ছাপ করে তা নিভিয়ে দিল। ভাগ্যিস কাছে-পিঠে কেউ ছিল না।
বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে অমলের একটা প্রিয় জায়গা আছে, একটা ছোট্ট টিলার ওপরে। আশেপাশে কোনো জনমনিষ্যি দেখতে পাওয়া যায় না। জায়গাটায় কোনো কারণে গাছপালা কম। দূর থেকে দেখা যায় বাঁদিকে ঘন জঙ্গল আর তার ঠিক গায়ে লাগানো ছোটো একটা গ্রাম। নানান আকৃতির কুঁড়ে ঘরের সারি, মধ্যে পায়ে-চলা লাল মাটির রাস্তা। একটা লম্বা বাঁশের আগায় লাল রঙের ত্রিকোণা হনুমানজীর ঝাণ্ডা উড়ছে। অমল জলরঙে আঁকে এই দৃশ্য। গ্রামটার ডানদিকে ছোট্ট একটা মাঠ, তারপরেই আরম্ভ হয়েছে পাথরের চড়াই-উৎরাই। ছোটো-বড় নানান আকৃতির, নানান রঙের পাথর ছড়িয়ে আছে যতদূর চোখ যায়। সেই পাথরের উঁচু-নিচু প্রান্তরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে একটা বৌদ্ধ মন্দির। হঠাৎ দেখে মনে হয় কারা যেন মন্দিরটা তৈরি করতে করতে বিশেষ কোনো তাড়ায় চলে গেছে, আর ফিরে আসে নি। অমল ঝোলা থেকে প্যাস্টেল রঙের স্টিক বার করে আঁকে সেই নিঃসঙ্গ মন্দির আর উপল-ছড়ানো প্রাকৃতিক দৃশ্য।
সেই টিলাটা ছাড়াও অমলের আর একটা নিজস্ব জায়গা আছে। জায়গাটা উঁচু শাল গাছের ছায়ায় ভরা। যেদিকেই তাকাও ধুসর আর ঘন সবুজ মেশানো বড়-বড় শালের গুঁড়ি। কোনো কোনোটার গা দিয়ে পরগাছা মাথা উঁচিয়ে আছে। এই দৃশ্য আঁকার জন্য আইডিয়াল হচ্ছে চারকোল আর সাদা-কালো জলরঙের মিশাল। অমল জলরঙের তুলোট কাগজে সেই ছবি আঁকে প্রাণভরে। চারিদিকে বেশ একটা সোঁদা-সোঁদা গন্ধ। আশেপাশে কোনো ঝর্ণা-টর্ণা আছে বোধহয়। কিছুক্ষণ আঁকার পর ঝোলা থেকে বেরোয় চটি বইগুলো। সেগুলো খবরের কাগজের মলাট দেওয়া, যাতে কারোর চোখে না পড়ে। অমল গাছের গুঁড়িতে ঠেসান দিয়ে বসে বইগুলো পড়ে। প্রণবের কাছে তার হাতেখড়ির মেয়াদ বেশিদিনের নয়। তাই লেখাগুলো বেশ শুকনো লাগে, অবোধ্যও। ওদের বাড়ির আবহাওয়ায় রাজনৈতিক বই ঢোকার কথা চিন্তাই করা যায় না। মা-বাবার রাজনীতিতে কোনো ইন্টারেস্ট তো নেই-ই, বরং মনে করেন এসব বাজে লোকদের কাজ। অমলের মনেও দ্বন্দ্বের অভাব নেই। প্রণবকে একদিন জিজ্ঞাসা করলো - 'আচ্ছা, ছাত্রদের তো পড়াশুনো করাই কাজ। তারা পলিটিক্স করবে কেন?' তাতে প্রণব উত্তর দিয়েছিল - 'তোর তো কিভাবে ভাত জুটবে তার চিন্তা করতে হয় না। কিন্তু একবার কী ভেবেছিস যারা আধপেটা খেয়ে বা না খেয়ে স্কুলে আসে তারা পড়াশুনোয় মন দেবে কী করে। তাই তো সবাইয়ের পেটে কিভাবে ভাত জুটবে তার ব্যবস্থা করা দরকার। আর সেখানেই আসে পলিটিক্স।' এ একেবারে অকাট্য যুক্তি, অমল কিছু বলতে পারে নি।
পাশের বাড়িটা অমলের কাছে একটা রহস্যের মতো থেকেই যায়। সেদিন দুপুরবেলা ছবি এঁকে ফিরতে বেশ দেরি হয়েছে। সবে সন্ধে সাড়ে পাঁচটা, কিন্তু এর মধ্যেই অন্ধকার বেশ ঘনিয়ে এসেছে। ভাবছে দাদুর কাছে বকুনি খেতে হবে, তাই তাড়াতাড়ি পা চালাচ্ছে। যেতে যেতে দূর থেকে দেখতে পেল সেই প্রতিবেশীর বাংলো। মুখ তুলে তাকাতেই দেখে সারা মুখ শাল দিয়ে ঢাকা জন তিনেক লোক সেই বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। তারপর কেমন টুক করে ভিতরে ঢুকে গেল। অমলকে বোধহয় দূর থেকে দেখতে পায়নি। আশ্চর্য ব্যাপার তো। এরকম চোর-চোর ভাব করা কেন! তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে বাড়ি ফিরে দেখে দাদু বারান্দায় চেয়ারে বসে, আর কে একটা লোক তাঁর সাথে কথা বলছে। অমলকে দেখেই লোকটা চুপ করে গেল। দাদু অমলের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন — 'এত দেরি করে ফিরলে কেন? চারিদিকের অবস্থা ভালো নয়। এরকম আর কোনোদিন যেন না দেখি।' অমল ভিতরে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল — 'লোকটা কে দিদা?' উনি বললেন - জানেন না, আগে কোনোদিন দেখেননি।
পরের দিন ছবি আঁকতে গিয়ে কিছুতেই আঁকায় মন দিতে পারল না অমল। কালকের সেই দাদুর সাথে কথা-বলা অচেনা লোকটা, সেই তিনটে লোকের সব মুড়ি দিয়ে চোরের মতো পাশের বাংলোয় ঢুকে পড়া, এই সবের মধ্যে কেমন যেন একটা যোগাযোগ আছে বলে মনে হল। দোনামনা মন নিয়ে বইগুলো পড়তে আরম্ভ করল অমল। তবে জায়গায় জায়গায় হোঁচট খেতে হয়। বুর্জোয়া, প্রলেতারিয়েত ইত্যাদি কথার মানে কী সে ভালোভাবে জানে না। তবে এই কথাগুলো সে কলকাতায় দেওয়ালে-দেওয়ালে লেখা আছে তা দেখেছে। আর বইয়ের লেখকদের নামের সাথেও একই ভাবে পরিচয়। তবে আগে বিশেষ কোনো আগ্রহ না থাকায় দেখেও বোঝার চেষ্টা করে নি। হঠাৎ কি মনে হওয়ায় কাগজ-পেনসিল নিয়ে ছবি আঁকতে আরম্ভ করল অমল। তবে এটা রাখি কোথায়? দাদু যদি দেখে তাহলে যে কী হবে তা ভেবে তার গায়ে কাঁটা দিল। তবে ছবি-টবির ব্যাপারে দাদুর বিশেষ উৎসাহ নেই। তাই তার আঁকা ছবির মধ্য থেকে এই পোর্ট্রেটটা দাদুর চোখে পড়ার কোনো কারণ নেই।
সেদিন কথায় কথায় জানা গেল যে পাশের বাড়িতে যে লোকটি কাজ করে সে অমলদের মালির গ্রামের লোক। তার কাছে জানা গেল যে ওখানে যিনি এসেছেন তিনি বেশ একটু অদ্ভুত প্রকৃতির। বাড়ি থেকে সাধারণত বেরোন না। আর যখন বেরোন তখন একেবারে সারা মুখ শাল দিয়ে ঢাকা থাকে। তার নাকি খুব ঠাণ্ডা লাগার ধাত আছে। তবে লোক বেশ ভালো। সারাদিন পড়াশুনো নিয়ে থাকেন। খাওয়ার সময় খাবার পেলেই উনি খুশি। আর বাজনা? সন্ধেবেলার বাজনা? তাতে নাকি আকাশ থেকে পড়েছে লোকটা। বাজনা-টাজনার কথা সে কিছু জানে না। তবে সন্ধে হওয়ার পরেই উনি তড়িঘড়ি তাকে ছেড়ে দেন। সুতরাং তার পরে বাজনা বাজাতেই পারেন। সে কিছু জানে না।
পুরো ব্যাপারটাই বেশ হেঁয়ালির মতো লাগে অমলের। বাইরে বেরোলে মুখ ঢেকে বেরোন। কেউ যেন না দেখতে পায়। ঠাণ্ডা লাগার কথাটা বাজে। কাজের লোক বলছে যে ওর কাছে কেউ আসে না। অথচ সে নিজের চোখে দেখেছে তিনজনকে ওই বাড়িতে ঢুকতে। উনি বাজনা বাজান খালি রাতের বেলা। সবটাই রহস্যজনক। সেদিন একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। অমল বনের মধ্যে তার নিজের জায়গায় বসে ছবি আঁকছে আর বই পড়ছে। এখানে আগে বহুবার এসেছে - কোনোদিন জনমনিষ্যি দেখেনি। সেদিন নিজের মনে সে ছবি আঁকছে, হঠাৎ লক্ষ্য করল চারদিক অস্বাভাবিক রকম চুপ। বনের নিজস্ব নানারকম শব্দ আছে। শালের বনে হু-হু করে হাওয়া বয়ে যাওয়ার শব্দ, মাঝে-মাঝে দু-একটা পাখি বা কোথায় একটা তক্ষক ডেকে ওঠে। এমন কি শীতকালের ঝরা পাতা পড়ার শব্দও কান পাতলে শোনা যায়। সেই স্তব্ধতার মধ্যে হঠাৎ অমলের মনে হল কে বা কারা তাকে যেন লক্ষ্য করছে। অমল মাথা তুলে চারদিক তাকিয়ে দেখে কেউ কোথাও নেই। কিন্তু কোথায় যেন মনটা খুঁতখুঁত করতে থাকে। ওর ষষ্ঠেন্দ্রিয় বলছে যে ওর আশেপাশে কে বা কারা আছে। কিন্তু তাদের ও দেখতে পাচ্ছে না। হঠাৎ কেমন যেন একটা ভয় ওকে ঘিরে ধরল। দ্রুত সে আঁকার সরঞ্জাম আর বইগুলো ব্যাগে ঢুকিয়ে নিয়ে লম্বা-লম্বা পায়ে বাড়ির দিকে এগোলো। সবটাই কি ওর মনের ভুল!
সেদিন বেশ তাড়াতাড়িই বাড়ি ফিরে এসেছে অমল। দেখে বারান্দায় দাদু বসে আছেন। সামনে চায়ের কাপে চা ভর্তি। উনি মুখে দেন নি। অমল কাছে আসতেই উনি গম্ভীর কণ্ঠে বললেন — 'বোসো, তোমার সাথে কথা আছে।' একে বনের মধ্যে সেই অদ্ভুত অভিজ্ঞতা, তারপর দাদুর বজ্র-নির্ঘোষ। চেয়ারে বসে ভয়ে কুলকুল করে ঘামতে আরম্ভ করল অমল। স্বভাবসিদ্ধভাবে কোনো উত্তরের তোয়াক্কা না করে দাদু একতরফা বলে গেলেন—
'তোমার ওপর আমাদের অনেক ভরসা। জানি একদিন তুমি আমাদের মুখ উজ্জ্বল করবে। কিন্তু জীবনে তো অনেক দেখলাম, তাই মাঝে মাঝে ভয় হয়। তুমি বোঝো কি না জানি না, অনেক ঝুঁকি নিয়ে আমরা তোমায় সঙ্গে এনেছি। কত কিছু ঘটতে পারে, কেউ কি বলতে পারে। তোমার মাকে ঠিকমতো তোমায় ফিরিয়ে দিতে পারলে বাঁচি। ভেবেছিলাম কলকাতা থেকে এখানে চলে এলে ওখানে যা ঘটছে তার থেকে অন্তত কিছুদিন নিস্তার পাব। কিন্তু ব্যাপার-স্যাপার দেখে তা মনে হচ্ছে না। জানো সেদিনের সেই লোকটা কে? পুলিশের লোক, ইনটেলিজেন্স্ ব্রাঞ্চের। আমার কাছে এসেছে আমি পাশের বাড়ি সম্বন্ধে কিছু জানি কী না। এখানেও নাকি নকশালের উপদ্রব শুরু হয়েছে।'
এই বলে দাদু থেমে পকেট থেকে নস্যির দিবে বার করলেন। বিকেলের পড়ন্ত আলোয় অন্যসময়ের সেই ঝকঝকে রূপোর কৌটোটাকে কেমন যেন ম্যাড়ম্যাড়ে লাগল। সেটা থেকে এক টিপ নস্যি নিয়ে নিয়মমত তিনি কয়েকবার হাঁচলেন আর নাক মুছলেন ধুতির খুঁটে। তারপর হঠাৎই বোমার মতো ফেটে পড়লেন।
'এই দেশদ্রোহী কম্যুনিস্টগুলোই দেশের সবচেয়ে ক্ষতি করছে। ইদানীং স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েদের পর্যন্ত মাথা খেতে আরম্ভ করেছে। আমি জানি তুমি এসবের মধ্যে নেই। তবে সাবধানের কোনো মার নেই। সবসময় মনে রাখবে যে তুমি ছাত্র, তোমার কাজ পড়াশুনো করা, আর জীবনে কৃতি হওয়া। ওই হাড়-বজ্জাত নকশালগুলোর ছায়া পর্যন্ত কোনোদিন মাড়াবে না।'
এই পর্যন্ত বলে দাদু একটু থামলেন তারপর প্রায় বাজ পড়ার মতো গলায় বললেন - 'যা-ও'।
আর দাঁড়ায়। অমল একেবারে পড়িমড়ি করে ছুটতে-ছুটতে নিজের ঘরে। কিন্তু সেখানে গিয়ে সে ভীষণ চিন্তায় পড়ল। তার সেই বইগুলো, সেই আঁকা ছবিগুলো যদি কোনোদিন দাদুর হাতে পড়ে - তখন কি হবে। ভয়ে হাত-পা সিঁটিয়ে যাওয়ার অবস্থা। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে আস্তে-আস্তে কেমন একটা দৃঢ়তা এসে ওর মন দখল করল। ছবিতো সে যার ইচ্ছে আঁকতে পারে। গতবছর তো এক কম্পিটিশনে নেতাজির ছবি এঁকে ও প্রথম পুরস্কার পেয়েছিল। আর আজ মার্কস-লেনিন-মাও এর ছবি আঁকলে অসুবিধে কোথায়। আর বই পড়লেই তো সে কিছু নকশাল হয়ে যাচ্ছে না। নিজের দৃঢ়তায় সে নিজেই আশ্চর্য হল। কিন্তু, সেরকম পরিস্থিতি হলে দাদুকে এসব বলতে পারবে কিনা, সে নিয়ে মনে যথেষ্ট সন্দেহ রয়ে গেল।
এর পরের দ্রুত ঘটে যাওয়া দুটো ঘটনায় ঐ জায়গাটার শান্ত, নিরুপদ্রব পরিবেশ একেবারে আমূল পালটে গেল। সে দিন অনেক ভোরে হৈ-চৈ আর নানারকম হট্টগোলে সবার ঘুম ভেঙে গেল। কোনোরকমে গায়ে-মাথায় একটা শাল জড়িয়ে অমল বারান্দায় এসে দেখে তখন সবে অল্প আলো ফুটেছে। সেই আলো-আঁধারিতে সে দেখতে পেল যে পাশের বাংলোটা ঘেরা রাইফেলধারী পুলিশে। এদের মধ্যে কয়েকজন বাংলোর দরজার পাশে রাইফেল উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে, আর একজন লাউড স্পীকারে চেঁচাচ্ছে — সারেণ্ডার, সারেণ্ডার, অওর হাম দরোয়াজা তোড়েঙ্গে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আবছা আলোয় দেখা গেল চশমা-পরা একজন বেরিয়ে আসছে, আর সঙ্গে-সঙ্গে বাইরে দাঁড়ানো কয়েকজন পুলিশ তাকে ঘিরে ফেলল, আর কয়েকজন ভিতরে ঢুকে টেনে আনল আরো একজনকে। তারপর কিছুক্ষণ ধরে পুরো বাংলোটা তছনছ চলল। এ দিকে দূর থেকে দেখা গেল সেই দুইজনকে হাতকড়া পরিয়ে তোলা হচ্ছে কালো রঙের পুলিশ ভ্যানে। আধ ঘন্টার মধ্যে পুলিশের ভ্যান সাইরেন বাজাতে বাজাতে চলে গেল, আর সেই বাংলোটা পড়ে রইল একা। খালি দেখা গেল একটা হাতল-ভাঙা চেয়ার বারান্দায় উলটে পড়ে রয়েছে। ততক্ষণে সকালের সলজ্জ মিষ্টি আলোয় ভরে উঠছে চারিদিক। বাতাসে হালকা ভাবে ভেসে বেড়াচ্ছে শাল গাছের মিষ্টি গন্ধ। উদাসীন প্রকৃতির কোনো হেলদোল নেই।
মালির কাছ থেকে শোনা গেল লোকটি নাকি বেশ বড় ধরনের জঙ্গী নকশাল নেতা। এখানে সংগঠন গড়ে তোলার কাজে এসে আত্মগোপন করে ছিল। আর সঙ্গের ধৃত ছেলেটি হচ্ছে ওর বাইরের জগতের সাথে যোগাযোগ রাখার ক্যুরিয়ার। বাঁশি বাজানোর ব্যাপারটা একটা অভিনব ব্যবস্থা। এইভাবেই নাকি লোকটি আশেপাশে লুকিয়ে থাকা কমরেডদের কাছে বিশেষ সংকেত-বার্তা পাঠাত। এখন পুলিশ হন্যে হয়ে জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা সেইসব লোকদের খুঁজে বেড়াচ্ছে।
সেদিন দুপুরবেলা খাওয়া-দাওয়ার পর দাদু-দিদা ঘুমোতে গেছে, অমল কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে ছবি আঁকতে বেরল। বনের মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সে নিজের জায়গায় প্রায় পৌঁছে গেছে, ডানদিকে একটা অগভীর খাদ। হঠাৎ অমল দেখতে পেল সেখানে কে শুয়ে আছে। তার হাতদুটো পিছনদিকে দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা। মাথার চারপাশের মাটি রক্তে ভেজানো। তবে লোকটা মারা গেছে বেশ কয়েক ঘন্টা হল, কারণ রক্তের রঙে কালচে টান ধরেছে। বাড়িতে মাংস এলে তার মধ্যে থাকে পাঁঠার মেটে। লোকটার পাশে রক্ত-ভেজা মাটির রং সেই মেটের রঙের। কলকাতায় থাকতে খবরের কাগজে পড়েছে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে চারজনের মৃত্যু, কোথায় বোমায় দু-জন উড়ে গেছে, কোথায় পাওয়া গেছে পিঠে ভোজালি-ঢোকানো মৃতদেহ। কখনই এসব বাস্তব বলে মনে হয় নি। মনে হয়েছে এরা আমার কেউতো নয়, আমার মাথা ঘামানোর দরকার নেই। দিনের পর দিন খবর এসেছে, আর দিনের পর দিন অমল এসব শুনেও শোনে নি, বুঝেও বোঝে নি, চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেও দেখে নি।
আজ সেই বাস্তব সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। একটা কালো ভয় অমলকে ঘিরে ধরল। মনে হল যেন লম্বা-লম্বা গাছগুলো হঠাৎ জীবন্ত হয়ে আস্তে আস্তে, পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে ওকে ঘিরে ধরতে আসছে। আর প্রত্যেক গাছের পিছনে এক জোড়া চোখ যেন তার দিকে তাকিয়ে আছে। অমল তাদের চোখের তারার ক্রূর দৃষ্টি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু তারা অবয়বহীন। এক্ষুণি এসে তারা অমলকে ঘিরে ধরবে, ছিনিয়ে নেবে তার কাঁধের ব্যাগ, আর টেনে বার করবে সেই বইগুলো, আর তার আঁকার তাড়া থেকে টেনে টেনে বার করবে তার লেনিনের পেনসিল স্কেচ, চারকোল আঁকা মাও-সে-তুং। দু-জন এসে তার হাতদুটো পিছমোড়া করে বাঁধবে, তারপর সার দিয়ে দাঁড়িয়ে তারা রাইফেল উঁচিয়ে তাক করবে তার দিকে - ছবির বইতে দেখা ফ্রান্সিস্কো গয়ার আঁকা '৩-রা মে, ১৮৮৪' ছবিটার মতো।
ওর মাথায় যেন বোমার মতো ফাটল - 'ফায়ার'। অমল ছুটতে আরম্ভ করল দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে। কাঁধের ব্যাগটা একটা অসম্ভব জোর কদমে দুলতে-দুলতে চলল ওর সাথে। মনে হতে লাগল কখন যেন কাঁধ থেকে ছিটকে বেরিয়ে যাবে। অমল ছুটতে-ছুটতে বন-জঙ্গল পেরিয়ে পায়ে চলা পথে এসে পড়ল। এতক্ষণে ও বুঝতে পেরেছে যে ওর পিছনে কেউ নেই। কিন্তু মাথা গুঁজে পড়ে থাকা লোকটার কথা মনে হতেই ও আবার ছোটার গতি বাড়িয়ে দিল। ওর পায়ের সামনে রাস্তাটা গোটানো বেল্টের মতো খুলতে খুলতে ওদের বাংলোর বারান্দার সামনে গিয়ে শেষ হল। অমল সামনে তাকিয়ে দেখে সামনে দাদু দাঁড়িয়ে আছেন। তবে কি দাদু কিছু জানতে পেরেছেন! অমল দাদুর পাশ কাটিয়ে ছুটতে ছুটতে নিজের ঘরে খাটে মুখ গুঁজে পড়ে রইল আর দু'চোখে নেমে এল ক্লান্তিভরা ঘুম। ঘুম যখন ভাঙল ততক্ষণে পরের দিনের সকালের রোদ্দুর জানলা দিয়ে ওর মুখে এসে পড়েছে। চোখ মুছতে মুছতে বারান্দায় গিয়ে দেখে দাদু আর দিদা বসে চা খাচ্ছেন। দাদু বললেন —
'কাল এত গভীরভাবে ঘুমোচ্ছিলে তোমাকে খাওয়ার জন্য ডাকিনি। হাত-মুখ ধুয়ে এসে এখানে বসে চা-ব্রেকফাস্ট খাও। তোমার সাথে কথা আছে।'
কী কথা, দাদু কী জানেন? ভাবল অমল। কিন্তু এখন এসব জিজ্ঞাসা করা যায় না। দাদুর কথামতো সে হাত-মুখ ধুয়ে খেতে বসল। অমলের খাওয়া হয়ে গেলে দাদু নস্যির ডিব্বা থেকে বেশ বড় একটিপ নস্যি নিয়ে যথারীতি সারা পাড়া কাঁপিয়ে হেঁচে নিয়ে অমলের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালেন।
'কাল দুপুরে কোথায় গিয়েছিলে? আর ওইভাবে ছুটতে-ছুটতে এলে, না খেয়ে রাতটা ঘুমিয়ে কাটালে - কেন?'
অমল ভয়ার্তভাবে বলল —
'দাদু, ওখানে তো আমি প্রায়ই যাই ছবি আঁকতে। কিন্তু, কিন্তু কাল ওখানে গিয়ে দেখি একটা লোককে কারা মেরে ফেলে রেখেছে।'
দাদু যেন জানতেন। বেশ একটু তাচ্ছিল্যের সুর গলায় এনে বললেন —
'ওই নকশাল-টকশাল হবে। সেদিন পুলিশের লোকটা বলেছিল যে এখানে চিরুনি অপারেশন আরম্ভ হবে - সাবধানে থাকবেন। তা তুমি যে তার মধ্যে গিয়ে পড়বে তা কি করে জানব।'
আর্তস্বরে অমল প্রায় চেঁচিয়ে উঠল — 'দাদু, নকশালরা কী মানুষ নয়!'
'মানুষ তা কি। এদের জন্যেই তো যত গণ্ডগোল, দেশের এই অবস্থা। এই মারামারি-কাটাকাটি এ দিয়ে দেশের ভালো করবে! ভেবেছিলাম কলকাতা থেকে দূরে এসে বাঁচব। তা এখানে এসেও একই অবস্থা। এর মধ্যে আবার একটা নেতা জুটেছিল। গেছে, আপদ বিদায় হয়েছে।'
দাদুর মুখের ওপর কথা বলার সাহস অমলের কেন ওর চেনা-জানা কারোরই নেই। কিন্তু কি করে যেন ওর মনে একটা অদৃশ্য শক্তি ভর করল। একেবারে আনকোরা নতুন জিনিস। ওর এই নতুন নিজের সাথে আদৌ পরিচয় ছিল না। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে দাদুর চোখের ওপর চোখ রেখে অমল বলল —
'তোমার মতের সাথে না মিললেও এরা মোটেই দেশদ্রোহী নয়। আজ যে লোকটা ঐ জঙ্গলে মরে পড়ে আছে সে কী দুটো পয়সার জন্য নকশাল করত। ওরা চায় এই পচা সমাজটাকে ফেলে দিয়ে এক নতুন সমাজ আনতে যেখানে গরিব-বড়লোক কোনো বৈষম্য থাকবে না।'
দাদু কিছুক্ষণ হতম্ভম্বের মতো বসে থাকার পর একেবারে ফেটে পড়লেন।
'বাঃ, বেশতো ভালো বুলি বেরিয়েছে। যা ভয় করেছিলাম ঠিক তাই হল। যত তাড়াতাড়ি পারা যায় কলকাতা যাওয়ার টিকিট কাটছি। তোমার মা'র হাতে তোমায় তুলে দিয়ে তবে আমি স্বস্তি পাব।'
দাদুর দু'চোখে তখন অগ্নিবর্ষণ হচ্ছে। সেদিকে না তাকিয়ে মুখে-চোখে একটা প্রতিরোধী ভাব এনে অমল নিজের ঘরে চলে গেল।
দাদু কথা বলা বন্ধ করেছেন। তাঁর সবচেয়ে প্রিয় নাতি, তাঁর মুখ উজ্জ্বল করবে, সেই কিনা এখন মুখে-মুখে কথা বলছে, হয়তো বদ-সঙ্গে পড়েছে। অমলের মনটা আজ খুবই অশান্ত। দাদুর মুখের ওপর কথা বলা কী ঠিক হয়েছে। বুলি কপচানো মানেই যে নকশাল করা নয় সে কথা সে দাদুকে কি করে বোঝাবে। তাছাড়া বাড়ি গিয়ে তো আছে মা-বাবার প্রশ্নবাণ। তাছাড়াও যে আর কী কপালে আছে কে জানে। তাদের এত ভালো, সাত চড়ে রা না-কাটা ছেলে নকশালের কথা বলছে। এত চেষ্টা করেও তাঁরা বাইরের দাউ-দাউ আগুন ভিতরে আসা বন্ধ করতে পারেন নি।
সারা সকাল অমল একটুও পড়ায় মন দিতে পারে নি। দুপুরবেলা খাওয়ার পর কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে সেই বাংলোর পাশের জায়গাটায় গেল। জঙ্গলে যাওয়ার কথা চিন্তাই করতে পারল না। সেখানে গিয়ে ব্যাগ থেকে বইগুলো বার করল, কিন্তু মন দিতে পারল না। আচ্ছা, এ সবে বিশ্বাস করা মানেই কি ওইভাবে মরতে হবে! ছবি আঁকবে বলে কাগজ, পেনসিল, রং-তুলি বার করল, কিন্তু সেখানেও মন দিতে পারল না। তখন ও ব্যাগ থেকে আঁকা ছবিগুলো বার করে দেখতে আরম্ভ করল। ল্যাণ্ডস্কেপের নানান ছবি, তারপর বেরোলো পেনসিল বা চারকোল আঁকা ছুঁচলো দাড়ি লেনিন, গোঁফদাড়ির জঙ্গল নিয়ে মার্কস আর মাথায় টুপি মাও-এর ছবি। মনের মধ্যে কেমন যেন একটা উত্তেজনা হচ্ছে। হঠাৎ চারকোলের স্টিকটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো অমল। দৃঢ় পায়ে হেঁটে গিয়ে সেই বাড়ির পাঁচিলের গায়ে চারকোল দিয়ে আঁকতে আরম্ভ করল। চারদিক একেবারে শান্ত, কেউ কোথাও নেই, পাশের শালবনের হাওয়ায় সেই পরিচিত হালকা মিষ্টি গন্ধ। হাওয়া এসে মাঝে মাঝে ওর চুল উড়িয়ে দিচ্ছে। মুখ থেকে চুল সরিয়ে দিয়ে অমল এঁকে যাচ্ছে নির্লিপ্তভাবে। মাও-এর প্রতিকৃতিটা ভালো এসেছে, একটু দূরে সরে গিয়ে নিজের আঁকার তারিফ করল অমল। ওরা এখান থেকে চলে যাবে, কিন্তু ওর স্বাক্ষর রেখে যাবে, যদি এই দেখে কেউ উদবুদ্ধ হয়। আঁকা শেষে 'নকশালবাড়ি লাল সেলাম' সবে লিখতে আরম্ভ করেছে, হঠাৎ পিঠের ওপর প্রচণ্ড এক ঘুঁষি, কিছু বোঝবার আগে একজন পেছন থেকে চুলের ঝুঁটি ধরে ওকে মাটিতে ফেলে দিয়েছে। এবার অমল দেখতে পেল একজন নয়, দু-জন। মুখে তাদের অশ্রাব্য গালাগালি। খালি একটা কথাই বারবার বলছে - ডাক্তারবাবুর নাতি না হলে তারা জানে মেরে দিত। একজন চুলের মুঠি আর একজন একটা কান ধরে তাকে হিড়-হিড় করে টানতে টানতে দাদুর কাছে নিয়ে চলল। এখানে-ওখানে ছড়িয়ে রইল তার ঝোলা, আঁকার নানা সরঞ্জাম, ছিটকে বেরিয়ে আসা দু-একটা বই, আর সাদা কাগজের ওপর আঁকা মাও-এর পোট্রেট তাকিয়ে রইল দুপুরের ঝকঝকে আলোয়।
দাদু আর দিদা গণ্ডগোল শুনে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন। লোকদুটো অমলকে টানতে টানতে দাদুর সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলল — 'ডক্টরসাব - অগর হামে পতা নেহি হোতা কে উয়ো আপকা পোতা হ্যায়, তো হাম আবতক উসে খতম কর দেতে থে।' এই বলে লোকদুটো চলে গেল। অমল দাদুর সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভয়ে ঘামতে লাগল। মাথা-কান সব একেবারে ঝন-ঝন করছে। কিন্তু দাদুর বকুনি তার চেয়ে অনেক বেশি ভয়াবহ। চড়-থাপ্পড়ও খেতে হতে পারে হয়তো। দাদু চেয়ারে গিয়ে বসলেন। পকেট থেকে বার করলেন নস্যির ডিব্বা, সব চুপচাপ হচ্ছে - ঝড়ের আগের প্রশান্তির মতো। দাদু নস্যি বার করলেন দুই আঙুলের টিপে, ধরে রইলেন, নাকে দিলেন না। সব চুপ, খালি দিদা পাশ থেকে মৃদুস্বরে বললেন - 'যে করেই হোক কালই ফিরে চল। আমার মোটেই ভালো লাগছে না।' দাদু চুপ। তারপর যা ঘটল তার জন্যে কেউই প্রস্তুত ছিলা না। হঠাৎ দেখা গেল দাদুর চোখে জল। আঙুলের টিপে ধরা নস্যি জামায় পড়ে হলুদ-সবুজ রং ছিটিয়ে দিল। দাদু মাঝে মাঝে ধুতির খুঁট দিয়ে চোখ মুছছেন, আর একটা অসহায়, প্রায় অস্ফুট স্বরে বলছেন — বড় নাতি, আমাদের মুখ উজ্জ্বল করবে। ততক্ষণে বিকেলের ছায়া ঘন হয়ে সন্ধে নেমেছে। কালো অন্ধকার মুছে দিয়েছে সব আলো।