'- কী এনেছিস?
- কী এনেছিস বল্?'
জিজ্ঞাসা করলেন বুঝি মন্দিরাদি?
জিজ্ঞাসা করলেন বুঝি সেই অপূর্ব কণ্ঠস্বরে?
কই না তো।
বিপুল নিস্তব্ধতার মাঝে নিঃশব্দে চারকাঁধে উঠে এলো তাঁর শীতল দেহটি।
উপরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম এক অপার পূর্ণিমা।
যেন ঝুঁকে পড়েছে সেই পরমা মুখশ্রীটিকে শেষবারের মতো দেখতে।
পাশ থেকে কেউ অস্পষ্টে বলে উঠলো—
হরিবোল হরি
হরিবোল হরি
হঠাৎ যেন ভয়ঙ্কর একা হয়ে গেলাম — ওনার সামনে - একগুচ্ছ রজনীগন্ধা হাতে নিয়ে-
মনে হোলো উপরের প্রকাণ্ড চাঁদটা যেন দ্রুত নেমে আসছে আমাদের উপর
এইবার স্পষ্ট শুনলাম সেই কণ্ঠ —
কি এনেছিস বল্?
বললেন মন্দিরাদি কিংবা উপরের প্রকাণ্ড পূর্ণিমাটি।
তখন আমি সদ্যসতেরো। সেও ছিল এক পূর্ণিমার সন্ধ্যা। রাখীপূর্ণিমা। শঙ্করদের বাড়ির ঘরোয়া গানের আসর। একেবারে সামনেই বসেছিলাম। শুরুতেই একজন হারমোনিয়ামে সুরের কত কারুকার্য শোনালেন। এরপর একজন গাইলেন একটি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত। কিছুই মাথায় কিংবা মনে প্রবেশ করছিল না। ঠিক এই সময়েই সে এল। এবং একটি মাত্র গানই গাইলো। সবাই বলল অসাধারণ। ভবিষ্যতে প্রচুর নাম করবে। জানলাম ওর নাম মন্দিরা। শঙ্করের এক সম্পর্কের দিদি।
সারারাত ঘুম এল না। চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাচ্ছিলাম সরস্বতীর মতো সেই মুখ। সেই রকম যেন বসার ভঙ্গিমা। আর আমার দিকে চেয়েই তো সে গাইল - 'আজ শ্রাবণের পূর্ণিমাতে ...'। আমার চোখে চোখ রেখেই তো সে বলল - কি এনেছিস বল্?
কি এনেছি? সত্যিই তো কি এনেছি আমি ওর জন্যে? কিছুই তো আনিনি। কিন্তু ও চাইলে আমার গোটা পৃথিবী আমি এনে দেবো ওর পায়ে!
'কি চাইছো তুমি?'
'কি চাইছো?'
এই ভেবে ভেবে সারারাত কেটে গেল আমার। আর এইভাবেই কেটেছিল অনেক বিনিদ্র রাত। তখন আমি সতেরোয়।
আবার দেখা হল তার সাথে আমার উত্তরতিরিশে। হঠাৎ সুযোগ এল তাকে খুব কাছ থেকে দেখার। আর গান শোনার। এ সুযোগ বড় দুর্লভ। কারণ মন্দিরাদি তখন অতি বিখ্যাত গায়িকা। অসংখ্য তাঁর ভক্ত। বিপুল তাঁর প্রচার।
'বাজিল কাহার বীণা- মধুর ....' মন্দিরাদির কণ্ঠে বীণারই মতো কিছু যেন বাজছিল সেই সন্ধ্যায়। অজস্র মুগ্ধের মাঝে সেই প্রকাণ্ড অডিটোরিয়ামে আমি তখন এক নগণ্য শ্রোতা। আমার প্রথম যৌবনের দেবীর দিকে তাকিয়ে যেই উপলব্ধি করলাম যে আজও নিবেদিত আমি - তখনই শুনতে পেলাম - 'আজ শ্রাবণের পূর্ণিমাতে'!
গান শেষ হওয়ার সাথে সাথে সমস্ত হলঘর ফেটে পড়লো হাততালির আওয়াজে। আর সেই আওয়াজে হঠাৎ যেন বড় হীন হয়ে গেলাম আমি। একটু আগেই তো মনে হচ্ছিল আমাকেই উদ্দেশ্য করে বলছেন মন্দিরাদি। কিন্তু অনুষ্ঠান শেষে মনে হল হলঘরের প্রতিটি শ্রোতাই বোধহয় ভাবছে এই কথা!
তবু সাহস করে দেখা করতে গেলাম। কিন্তু সে এক ভয়ঙ্কর ব্যাপার। শেষ পর্যন্ত দেখা হল। 'আমি অনুপম .... শঙ্করের বন্ধু .... সেই যে শঙ্করদের বাড়িতে ...' শেষ করতে পারলাম না আমার কথাটা। অসংখ্য ভক্তের ধাক্কায় সরে যেতে হল সঙ্গে সঙ্গে। মনে হল মন্দিরাদি যেন চোখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু বলা হল না। মনে হল উনি যেন হাসলেন। আমার দিকে তাকিয়ে? বুঝলাম না।
তবে এটুকু বুঝলাম যে আমার থেকে অন্তত কিছু চাইছেন না উনি। আমার থেকে কিছু চাইবার নেই ওনার। অনেক উঁচুতে ওনার স্থান এখন।
তখন আমার উত্তরতিরিশ।
সেদিন পঞ্চাশে পড়েছিলাম। আর কি আশ্চর্যভাবে সেদিনই আবার দেখা হল তাঁর সঙ্গে। এক চিকিৎসক বন্ধুর বাড়িতে। একটি ঘরোয়া অনুষ্ঠানে।
কিন্তু কি দেখলাম! এক জীর্ণ বিবর্ণ বৃদ্ধা! শুনেছিলাম মন্দিরাদির ব্যক্তিগত জীবন সুখের ছিল না। স্বামী নেশায় আসক্ত। একমাত্র পুত্রসন্তান গত হয়েছে দুর্ঘটনায়। অনেকদিন আর প্রকাশ্যে আসেন না বললেই হয়। শ্রোতাদের থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসন নিয়েছেন বহুকাল।
সেই চিকিৎসক বন্ধুটির অনেক অনুরোধ উপরোধের পর উনি গাইতে রাজি হলেন - 'বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বারি ..."। দেখলাম, শুনলাম এবং অনুভব করলাম কণ্ঠে গান এলে আবার তিনি সেই বীণাপাণি! আমার সেই পরমা!
গানটি শেষ হওয়ার সাথেসাথেই এগিয়ে গেলাম ওনার দিকে। ওনাকে স্পর্শ করলাম আর কেন জানিনা বলে ফেললাম অনেক কথা - "আমি অনুপম .... আপনার ভাই শঙ্করের ছেলেবেলার বন্ধু .... আপনার এক অন্ধভক্ত .... সেই ছোটোবেলা থেকে .... শঙ্করদের বাড়ির গানের আসরে নিয়মিত আসতাম আপনার গান শুনতে .... তারপর অনেকদিন বাদে সেই দেখা করলাম রবীন্দ্রসদনে আপনার অনুষ্ঠানের পর .... আপনি শেষ গানটি গেয়ে ছিলেন 'আজ শ্রাবণের পূর্ণিমাতে ....' একবারটি গাইবেন এখন? দুটি লাইন ?
মন্দিরাদি মাথা নিচু করে নিরুত্তর রইলেন। মনে হল আদৌ শুনলেন কি আমার একটা কথাও?
তারপর মাথা তুলে চোখ বন্ধ করে আরম্ভ করলেন সেই কণ্ঠ-নিবেদন —
"আজ শ্রাবণের পূর্ণিমাতে কী এনেছিস বল -
হাসির কানায় কানায় ভরা নয়নের জল"
দেখলাম তিনি যখন গাইছিলেন তখন তাঁর মুদ্রিত নয়ন-দুটির কোলে এসে বসল দুটি মুক্তো বিন্দু। গান শেষ করেই মাথা নিচু করে উঠে পড়লেন তিনি। তারপর একজনের সাহায্যে ধীরে ধীরে অশক্ত শরীরে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।
সারা রাত ধরে মনে পড়ছিল মন্দিরাদির মুখটা আর নিঃশব্দে ফুটে ওঠা চোখের জলের বিন্দু দুটিকে।
উপলব্ধি করলাম কার থেকে কি চাইছেন উনি এমনভাবে — জীবনের প্রান্তে এসে।
'ফুলফোটানোর খেলায় কেন ফুল ঝরানোর ছল' - বুঝতে পারলাম এতদিনে। জীবনের পঞ্চাশটি বছর কাটিয়ে।
পরের ঘটনা এর মাত্র কদিন বাদেই।
শঙ্করের থেকেই পেলাম খবরটা।
সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ালাম ওনার বাড়ির দিকে।
যদিও রাত তখন অনেক।
ঘরে ঢুকেই চোখে পড়লো তাঁর অল্পবয়সের এক বিরাট ছবি।
সেই অপূর্ব মুখশ্রী।
কি অসামান্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন আমার দিকে। আমার সেই পরমা।
'কী এনেছিস্?'
'কী এনেছিস্ বল্?'
ঘরে আর কেউই নেই।
এই ক্রমাগত নিঃশব্দ নিরুচ্চারের সামনে একা অল্পক্ষণের বেশি দাঁড়াতে পারলাম না।
বাইরে বেরিয়ে এলাম।
উপরে বিশাল শীতের আকাশ।
এবং পূর্ণচাঁদের অপার জ্যোৎস্না।
দেখতে পেলাম সেখানেই অসংখ্য নক্ষত্রের সাথে স্থির হয়ে আছে ওনার গাওয়া যাবতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত — এক সাধ্যাতীত পূর্ণিমায়।