• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৫৩ | ফেব্রুয়ারি ২০১৩ | গল্প
    Share
  • পরি : ভবভূতি ভট্টাচার্য




    “কী? আপনাদের সাহেবের ফিরতে কি আ-রো দেরি হবে নাকি?"

    বেঞ্চি ছেড়ে উঠে গিয়ে সামনের কেরানিবাবুটিকে দু’ঘন্টার মধ্যে এই নিয়ে তিনবার প্রশ্নটা করতে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল লোকটা। ভেংচি কেটে বলল, “হ্যাঁ, আমাদের সাহেবের ফিরতে দেরি হবে বৈ কি। তা যান না আপনার সাহেবের কাছে যান না। যত্তসব...” আরো কত কী যেন বলল বিড়বিড় করে। বয়স্ক মানুষদের মান্যি করার দিন চলে গেছে।

    এই ঘেন্নায় সরকারি দপ্তরে আসতে চায় না কেউ--নেহাত ফেরে না পড়লে। আর এরাই নাকি জনগণের সেবক--সরকারি কর্মচারি। উত্তরবঙ্গের এই জেলাশাসকের মস্ত দোতলা বাংলোর একতলায় তাঁর আপিস। এখানে জেলার সাধারণ নানা মানুষজনের অভাব-অভিযোগের দরবার বসে। সে-সব শোনা ও তাঁর সরকারি ক্ষমতা-মোতাবেক প্রতিকার করাটা তো জেলাশাসকের কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। এটা করে তাই তিনি বিশেষ কোনো দাক্ষিণ্য করছেন না আমার প্রতি। তাছাড়া আমি তো রীতিমত এপয়েন্টমেন্ট করেই এসেছি। সকাল এগারোটা থেকে এখন এই দুপুর দুটো বাজতে চলল প্রায়--ঠায় বসে আছি। ভরা চৈত্রের দুপুর। বারবার শোনা যাচ্ছে, ডি এম সাহেব জরুরি কাজে সদরের বাইরে গেছেন, এখনই এসে পড়বেন।

    প্রায় জনাবিশেক মানুষ এ’পাশ-ও’পাশের বেঞ্চিগুলোতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে আছে; হাতে তাদের নানান কাগজপত্র-ফাইল-দরখাস্ত, আমারও যেমন। এ’দিকে একটি সিলিং ফ্যান আর হলের ও-ই কোণে আরেকটি ধীরলয়ে ঘুরে গর্মি বাড়াচ্ছে বই কমাচ্ছে না। এ’হেন হাটুরে লোকজনের সঙ্গে এক পঙ্‌ক্তিতে বসার প্রবৃত্তি এস এন সর্বাধিকারির হবার কথা নয়। কিন্তু কী করব? দায়। এই আটষট্টি বছর বয়সে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতেও যে পারিনা। না:, ছেলের ফ্যাক্টরির লাইসেন্সের বিষয়ে আজ একটা হেস্তনেস্ত করে ফেলতেই হবে। ছেলে, তার কলকাতার ব্যারিস্টার বন্ধু--সবাই হার মেনে যেতে আমি নিজেই জোর করে এ’দায়িত্বটা কাঁধে নিয়েছি। নিজে সরাসরি ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে কথা বলে সমস্যাটার হাল করব আমি। দেখিয়ে দেব খোদ বৃটিশ ম্যানেজমেন্টের শিক্ষা কাকে বলে!



    ঢং করে দেওয়ালের বড় ঘড়িটায় আড়াইটে বাজতে ক্ষিদে আর চেপে রাখা গেল না। এই আপিসের বাইরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পাইস হোটেলে বসে ভাত খাবার প্রবৃত্তি আমার হবার কথা নয়। এটা জেনেই বাড়ি থেকে বেরোবার সময় বৌমা বলেছিলেন, “বাবা, দুটি ভাত খেয়ে...”। আমল দিইনি। এগারোটায় এপয়েন্টমেন্ট করাই আছে। বড়জোর আধাঘন্টার ধাক্কা। বারোটার মধ্যে বাড়ি ফিরে চান করে ভাত খাবো। অত কথায় কথায় ক্ষিদেয় কাতর হওয়া ভেতো বাঙালি এস. এন. সর্বাধিকারি নয়। তাহলে আর পাক্কা পঁয়ত্রিশ বছর ওই সুনামের সঙ্গে ‘হার্ভে এন্ড হ্যারিসন’-এর মতো কোম্পানিতে চাকরি করে খেতে হত না। প্রোডাকশনের জি এম সর্বাধিকারিকে সমঝে চলত গ্লাসগোর ডিরেক্টররা পর্যন্ত। আর এই ডি এমটাও জুটেছে দেখছি তেমনি। এপয়েন্টমেন্ট দিয়েও এত্তজন মানুষকে দু’-তিন ঘণ্টা ধরে বসিয়ে রাখে কোন্‌ আক্কেলে? এ’যুগের আই এ এস কিনা। হত বৃটিশকালের আই সি এস......!

    যাঃ! আবার লোডশেডিং হয়ে গেল। বারান্দার বেঞ্চি ছেড়ে সামনের পোর্টিকোটায় নেমে এলাম। এখানে কয়েকটা গাছপালা রয়েছে। ছোট লন একটা। হাল্‌কা হাওয়াও দিচ্ছে একটু একটু। যদিও বাইরের দিকে তাকালেই রোদ্দুরে চোখ ঝলসে যাচ্ছে।

    নানান লোকের আনাগোনার বিরাম নেই জেলাশাসকের অফিসে। গাড়িবারান্দার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাতের ‘স্টেটসম্যান’-টা নেড়ে হাওয়া খেতে খেতে গরম দূর করার ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছি, আর চোখ রাখছি কখন তাঁর ‘অশোকস্তম্ভ’-চর্চিত গাড়িখানি ঢোকে। হঠাৎ আনমনা চোখ আটকে গেল সামনের এক বৃদ্ধের প্রতি। এ’দিকেই হেঁটে আসছে না? রোগাকালো শুভ্রকেশ এক বৃদ্ধ। পরনে নীল ফতুয়া আর ধুতি, সেই আগের মতোই। হ্যাঁ, গলায় কণ্ঠিটিও পূর্ববৎই আছে দেখছি। চোখে আজও চশমা ওঠেনি পরির? বয়স তো সত্তর ছুঁই-ছুঁই হতে চলল নিশ্চয়ই।

    আমার এক দৃষ্টে তাকানো দেখেই দূর থেকে নজর করেছে পরিদা, দেখি দু’হাত জোড় করে সামনে একটু ঝুঁকে প্রণাম জানাতে জানাতে এগিয়ে আসছে সেই আদি ও অকৃত্রিম পার্বতীচরণ পরিদা, ‘হার্ভে এন্ড হ্যারিসনে’ আমার বিশ বছরের পুরনো খাসবেয়ারা। “স্যর নমস্কার, নমস্কার”, দূর থেকেই উচ্চৈঃস্বরে বলতে বলতে এগিয়ে আসে সে।

    “কী হে? পরিদা নয়? কেমন আছ হে?” গলায় অনভ্যস্ত তারল্য এনে বলি। এই গরমে পচতে পচতে হঠাৎ পুরনো সঙ্গীকে দেখে পুলকিত হয়ে উঠি, নৈলে পিওনের সঙ্গে এই বন্ধুত্বস্বরে কোনো রিটায়ার্ড জেনেরাল ম্যানেজারই কথা বলবে না। পার্বতী পরিদার পেছনের কাহিনিও তো বড় কম নয়।

    পরিদার পেছনে লাগত না, ‘হার্ভে এন্ড হ্যারিসন’ কোম্পানিতে ঝাড়ুদার থেকে হেডক্যাশিয়ার এমন কর্মীর সংখ্যা হাতে গোণা যেত। সবকাজে তার গয়ংগচ্ছভাবের জন্য পরিদার ওপর আমিও কম রুষ্ট হতাম না। কিন্তু একদিন এক দল ছোক্‌রা পিওনকে আমি প্রচণ্ড ধমক দিয়েছিলাম, আমার চেম্বারের বাইরে স্টুলে বসা পরিদার মাথার ক্যাপখানি তুলে নিয়ে তাকে উত্যক্ত করছিল বলে। তবে পরির সততা ও নিষ্ঠা ছিল অনুকরণীয়। এতদিন পরে তাই আজ তাকে দেখে উৎফুল্লই হয়েছি। বলি, “তুমি হঠাৎ এখানে কোত্থেকে উদয় হলে হে পরিদা?" অজান্তেই গলার স্বরে পুরনো বস্‌ বেরিয়ে পড়েছে। একটু আগেই মিন্‌মিনে স্বরে প্রশ্ন করে আপিসের কেরানিটির কাছে ধমক খেয়েছে যে এস এন সর্বাধিকারি, এ’গলা সে-গলা নয়।

    “স্যর আপনি এখানে?" আমার প্রশ্নটাকেই ঘুরিয়ে আমায় শুধোয় সে, বিনয়ে বিগলিত কণ্ঠ।

    “আমি তো এখন এখানে এসে রয়েছি আমার ছেলের কাছে। ছেলে মস্ত ফ্যাক্টরি করেছে...” বলি। যদিও ছেলের ‘মস্ত ফ্যাক্টরি’ যে এখনও শুরুই হয়নি, ডি এমের কাছে তার লাইসেন্সের ব্যাপারে তদ্বির করতেই যে আজ আমার এখানে আগমন--সে-সব তো আর পিওনের সামনে ভেঙে বলতে পারিনা।

    “ও হো স্যর! সুগতবাবু এতো বড় হয়ে গেছেন? ফ্যাক্টরি করেছেন এখানে?" পরির গলায় নিখাদ সম্ভ্রম। আমার ছেলের সঙ্গে পরির স্মৃতি জড়িয়ে গিয়েছিল সে এক বিশেষ ঘটনাসূত্রে।

    “বাঃ। তোমার তো নামধামগুলো বেশ মনে থাকছে হে আজকাল। ওকে একবার স্কুল থেকে ফিরিয়ে আনতে গিয়ে কী কাণ্ডটাই না বাধিয়েছিলে, মনে আছে?" বলি।

    “এ’ হে হে হে স্যর...” এতোদিন পরেও সে-ঘটনার উল্লেখে পরি লজ্জায় আধহাত জিভ কাটে। পারলে নাককান মলে।


    ঘটনাটা এইঃ আমার ছেলে তখন বোধহয় ক্লাস ফোরে পড়ে। সেদিন তুমুল বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে কলকাতা শহর। গিন্নি বাড়ি থেকে অফিসে আমায় ফোন করে জানালেন ড্রাইভার আব্দুল গাড়ি নিয়ে পার্ক স্ট্রিটে ফেঁসে গেছে বলে জানিয়েছে। সেন্ট জেভিয়ার্সের সামনে এক কোমর জল। আমি কি ছেলেকে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরিয়ে আনার কোনো ব্যবস্থা করতে পারি? সেদিন আবার দিল্লি থেকে কমার্স মিনিস্টার এসেছেন। সাড়ে তিনটেয় তাঁর সঙ্গে মিটিং বেঙ্গল চেম্বারে। আমি এম ডি.র জন্য পেপার রেডি করতে হিমসিম খাচ্ছি। এক মুহূর্ত দম ফেলার সময় নেই। তারই মধ্যে কোনক্রমে অফিসের একটা জিপগাড়ি যোগাড় করে পরিকে সব বুঝিয়ে সুঝিয়ে, এক চিরকুটে ছেলের নাম-ক্লাস ইত্যাদি লিখে পাঠিয়ে দিলাম তাকে আনতে।

    তারপর তো আমি বেঙ্গল চেম্বারে ঢুকে গেছি। সাড়ে পাঁচটা নাগাদ মিটিং সেরে ফিরতে ফিরতেই রিসেপশানিস্ট জানালো বাড়ি থেকে ম্যাডামের বারবার ফোন আসছে, ছেলে এখনও ফেরেনি। সে কি! আমি হতবাক। পরিদাকে আমি সব বুঝিয়ে সুঝিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি সেই বেলা দু’টো নাগাদ। কোথায় গেল সে? “রেসিডেন্সে লাইন লাগান” রিসেপশনিস্টকে নির্দেশ দিয়ে দৌড়ে বাঁকটা ঘুরে আমার চেম্বারের সামনে আসতেই দেখতে পেলাম পরিদা বসে আছে সামনের বেঞ্চিটায়। পাশে স্কুল-ইয়ুনিফর্ম পরা একটা বছর দশেকের বালক মোড়ক ছাড়িয়ে ক্যাডবেরি খাচ্ছে।

    “পরি তুমি এখানে? আমার ছেলে কোথায়?" রাগে-বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠি আমি। পরি সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়িয়ে তর্জনীনির্দেশ করে সেই অচেনা ছেলেটির প্রতি, “কেন স্যর , এই যে....। আমি নামটাম সব মিলিয়ে দেখে নিয়ে এসেছি।” প্রচণ্ড রাগে ওর গালে ঠাস করে একটা চড় মারতে ইচ্ছে করে আমার--মানুষ এতো অকর্মণ্যও হতে পারে?

    তারপর হৈ হৈ ছোটাছুটি থানাপুলিশ কম হল না। ছেলেকে উদ্ধার করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত আটটা বাজল। পরি কেবল নাককান মলছে আর বলছে, “মু বিভ্রান্ত হৈ গিলা”। সেই ছেলেটিরও নাম সুগত। ক্লাস ফোরেই পড়ে, অন্য সেকশনে। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কী বলে একটা অচেনা লোকের সঙ্গে চলে এলে?"
    “ও যে বলল বড় একটা ক্যাডবেরি দেবে !”



    হ্যাঁ, এই হল পরি, পরিদা। সবার কোণে, সবার শেষে পড়ে থাকা এক নির্বিরোধী উৎকলবাসী। মাঝেমাঝে ছুটি নিয়ে গ্রামে যেত পরি। জিলা বালেশ্বর। আর বেশিরভাগ সময় অফিসের একতলায় সার্ভেন্টস’ কোয়ার্টার্সে থাকত। একদিন বেশ সন্ধে করে অফিস থেকে বেরোতে যাব, ক্লাবে ‘এনুয়াল ডে’ না কী যেন একটা অনুষ্ঠান ছিল, দেখি পরি আমার চেম্বারের বাইরে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে, পাশে এক বছর চোদ্দ-পনেরোর শীর্ণ কালো হাফপ্যান্ট পরা বালক। আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতে ছেলেটি ঢিপ করে এসে প্রণাম করল। “স্যর, আমার একমাত্র সন্তান। ছেলে এবার ম্যাট্রিক পাশ করে বেরোলো। ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছে!”

    “বাঃ বাঃ বেশ বেশ.....ফার্স্ট ডিভিশন!” পকেট থেকে একটা কড়কড়ে পঞ্চাশ টাকার নোট আলগোছে বাড়িয়ে দিয়ে বলি, “নাও পরি, ছেলেকে একটা জামাটামা কিনে দিও..”। ভক্তিগদগদ স্বরে কী জবাব দিলো পরি তা শোনার জন্য আর দাঁড়াইনি।

    বর্তমানে ফিরে এলাম। শুধোই, “কেমন আছ পরি? শরীর-স্বাস্থ্য সব ঠিক আছে তো?"

    “হ্যাঁ স্যর, মহাপ্রভুর কৃপায়....আপনি?"

    “আমি তো বেশ ভালই আছি। আজ এখানে এসেছি ডি এমের সঙ্গে দেখা করতে, রীতিমত এপয়েন্টমেন্ট করেই। কিন্তু দেখ না, তেনার দেখা নেই। সময়ানুবর্তিতা শিখতে পারল না বলেই জাতটার কিছু হল না। আমাদের কোম্পানির রুটিন তোমার মনে আছে তো? আমাকে কোনোদিন দশটা বেজে এক মিনিটে অফিসে ঢুকতে দেখেছ?"
    “কী যে বলেন স্যর!” একবিঘৎ জিভ কেটে বলে পরিদা, “আমি বলে দেব, স্যর, আমি বলে দেব ওনাকে।”

    পরির কথা বলার ধরনে হাসি পেয়ে গেল আমার । তেমনই অলবড্ডে-অকম্মার ধাড়ি রয়ে গেল লোকটা। ও’ কী বলে দেবে ডি এমকে আমার হয়ে? আরও নিয়মানুবর্তি হতে? পরি কি এই বয়সেও ডি এমের অফিসে পিওনগিরি করে নাকি? জানতে হবে তো। মুখে বলি, “তুমি কী বলে দেবে হে ডি এম.কে? একবার দার্জিলিং ডি এমের অফিসে গিয়ে কী কাণ্ডটা-ই না করেছিলে, মনে আছে?"


    সে সত্তরের দশকের কথা। আমাদের কোম্পানির চা-বাগানের কিছু সমস্যা নিয়ে দার্জিলিং ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে মিটিং। সে এমন এই আজকের মত উপযাচক হয়ে ডি এমের দরবারে ধণ্ণা দিয়ে বসে থাকা নয়, রীতিমতো চেম্বার অব কমার্সের প্রতিনিধি হয়ে চা-শিল্পের সমস্যা নিয়ে আলোচনা। পাক্কা সকাল দশটায় মিটিং শুরু। বলতে শুরু করতে যাবো, মোটা রেগুলেশন বইটার মাথার ফ্ল্যাগগুলো আর খুঁজে পাই না। কাল রাত জেগে রেলেভ্যান্ট জায়গাগুলো বের করে করে রেখেছিলাম। বিরক্ত ও বিভ্রান্ত হয়ে চেয়ার পেছনে ঘুরিয়ে আমার খাস-আর্দালিকে চাপাগলায় শুধোই, “পরি, ফ্ল্যাগ কোথায়?"

    “ফ্ল্যাগ? কেন স্যর ফ্ল্যাগ তো এই বাড়ির মাথায় দিব্যি পত্‌পৎ করে উড়ছে। ঢোকার সময় দেখে এসেছি।”

    রাগে কাঁপতে কাঁপতে দাঁত কিড়মিড় করে বলি, “বইয়ের পাতায় পাতায়, ফাইলে, যেখানে যেখানে ফ্ল্যাগ দিয়ে রেখেছিলাম কাল রাতে...”

    “ওঃ”, নিশ্চিন্ত গলায় পরি বলে, “তাই বলুন স্যর। ও’গুলো বইয়ের মাথা থেকে বেরিয়ে বেরিয়ে ছিল কিনা, কেমন দেখাচ্ছিল, তাই আমি সবগুলোকে এক জায়গায় করে আপনার কোটের বাঁ পকেটে ঢুকিয়ে রেখে দিয়েছি, যাতে দরকার পড়লেই আপনি হাতের কাছে পান। হাত ঢোকান, স্যর, পাবেন, পেয়ে যাবেন।”

    এই হল পরি, পরিদা, শ্রীমান পার্বতীচরণ পরিদা, যে আজ বলছে ডি এমকে আমার হয়ে বলে দেবে আরও সময়ানুবর্তি হতে !

    ###

    কথা বলতে বলতে পোর্টিকোতে দুটো গাড়ি এসে ঢুকেছে। সামনেরটা পুলিশের জিপ। পেছনে লালবাতিজ্বলা সাদা এম্বাসাডরটি থেকে নেমে এলেন বছর পঁয়ত্রিশের এক শ্যামবর্ণ যুবক, সাদা বুশশার্ট ও ছাইরঙা ট্রাউজার্স পরা। বুঝলাম, ইনিই জেলাশাসক, যাঁর প্রতীক্ষায় চার ঘন্টা বসে আছি। সামনের সিট থেকে নেমে তাঁর খাস-পেয়াদা ভিড় হঠাতে লেগেছে। ডি এম পাশের এক ভদ্রলোকের সঙ্গে কী কথা বলতে বলতে আমাদের দিকেই হেঁটে আসতে লাগলেন। হঠাৎ আমার পাশে পরিদার দিকে চোখ পড়তেই বলে উঠলেন, “আপনি এই দুপুর রোদে নিচে নেমেছেন কেন?" গলায় বিনয় ও যত্নের সুর। কথাটা ওড়িয়াভাষাতেই বললেন। আমি ছোটবেলা কটকে থাকতাম, ওড়িয়াভাষা বুঝি। আমি অবাক হলাম। ডি এম ভদ্রলোক পরিদাকে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন নাকি? এবার পরিদার গলার জবাব শুনে রীতিমত চমকে উঠলামঃ “তুমি সকাল এগারোটায় আসবে বলে এতো ভিজিটার বসিয়ে রেখেছ কেন? ইনিও কারো বাবা, ইনিও বৃদ্ধ।” পরির গলায় এমন গভীর কর্তৃত্বের সুর আগে কখনও শুনিনি।

    জেলাশাসক এবার আমার দিকে ঘুরে হাত তুলে নমস্কার করে চোস্ত ইংরিজিতে বললেন, “আমায় মাফ করবেন। বড় নদীবাঁধে একটা ফাটল দেখা গেছে। আমি সকাল থেকে সেটাই পরিদর্শন করতে ব্যস্ত ছিলাম। বর্ষার আগেই সেটিকে মেরামত না করে ফেলতে পারলে...। যাহোক্‌, আপনি আসুন আমার সঙ্গে, আপনার কথা শুনি।” জেলাশাসক পা বাড়ালেন নিজের চেম্বারের দিকে। যেতে যেতে ঘাড় ঘুরিয়ে পরিকে আবার বলে গেলেন, “বাবা, আপনি এই দুপুর রোদে আর বেরোবেন না। ওপরের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ুন। সন্ধেবেলা আপনার সঙ্গে কথা বলব।”

    আমার কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভাবটা কাটেনি। এবার ছেলেটির কাঁধে হাত রেখে আমি বললাম, “তুমিও তো লাঞ্চ করোনি, বাবা। করে নাও। আমি একটু বসছি।”

    দেখি, পাশে দাঁড়িয়ে পরি হাসছে। ওর চোখে জল।

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments