• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৫৫ | অক্টোবর ২০১৩ | প্রবন্ধ
    Share
  • সতত সৃজনশীল সঙ্গীতগুরু জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষপ্রজ্ঞা ও প্রযুক্তি (২৫শে বৈশাখ ১৯১২ - ৬ই ফাল্গুন ১৯৯৭) : পূর্ণিমা সিংহ


    তবলা ও গান শিক্ষা :

    পূ: আচ্ছা, আজম খাঁর কাছে শেখা continue করলেন কি?

    জ্ঞা: আজম খাঁ আজমীরের লোক ছিলেন। ওঁদের ঘরে তবলা ছিল। কিন্তু উনি আবার মসীদ খাঁর কাছে শিখেছিলেন।

    পূ: তাহলে একই ঘরের হল?

    জ্ঞা: ঘর এক বলব না। তবে উনি মসীদ খাঁর সাগরেদ হয়েছিলেন। গুরুভাই ছিলেন।

    পূ: উনি কী করে আপনার জীবনে এলেন - আজম খাঁ?

    জ্ঞা: আজম খাঁ এলেন - ঋষিকেশ বিশ্বাস বলে একজন - এখনও বেঁচে আছেন - খুবই সংস্কৃতিবান লোক, - যিনি গান শিখেছিলেন অনেকের কাছে, রমজান খাঁর কাছে, মানে একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তি - আমাদের দোকানে কাজ করতেন মানে Dwarkin-এ। তিনি এবং তাঁর এক বন্ধু আজম খাঁকে ধরে ঠিক করে দেন। আমি নিজেই রাইচাঁদ বড়ালের কাছে গিয়েছি। তিনি আজম খাঁর কাছে শিখেছিলেন। মসীদ খাঁর কাছেও শিখেছিলেন। তিনি আমাকে মসীদ খাঁর সন্ধান দেন। তারপর মসীদ খাঁ আমার কাছে আসেন। তিনি অত্যন্ত অমায়িক লোক ছিলেন এবং আমি ওঁর কাছে খুবই ঋণী। কেন না উনি বিশেষ যত্ন করে আমাকে শেখাতেন। কেরামৎ খাঁর সঙ্গে আমি একসঙ্গে রেয়াজ করতাম। এবং আমি দেখতুম কেরামৎ খাঁ আমার থেকে অনেক advanced ছিল। আমার চেয়ে বয়সে ছোট, কিন্তু বাচ্চাবেলা থেকে রেয়াজ করেছে তো! আর আমি বাঙালী ঘরের খোল তবলা পাখোয়াজ বাজিয়েছি - আমার হাত তফাৎ হয়ে গেছে। তবু আমার জানা ছিল বলে pick up খুব তাড়াতাড়ি করতাম। কোনও দেরী হত না। তখন আমি মনে করতাম খুব তাড়াতাড়ি pick up করছি, খুব improve করছি। যা করছি খুব ঠিক করছি। বহুদিন পরে বুঝেছি - বুঝতে সময় লেগেছে, যে আমি যা শিখেছি - শেখার দিক থেকে ঠিক আছে, কিন্তু পুরনো যে idea যে practice, সেই অনুসারে খাঁ সাহেবদের ঘরে শিখলে justice করা হয় না। অনেক ঠেকে আমি শিখেছি, বুঝেছি - আরও বহু তবলীয়াদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশে। খাঁ সাহেবের সঙ্গে তো বটেই! ওঁর সঙ্গে তো ছিলুম।

    পূ: মসীদ খাঁর কাছে কত বয়সে শিখলেন?

    জ্ঞা: ২০-২১ বছর বয়স হবে।

    পূ: পাখোয়াজ বাজাতে জানতেন। তবলা?

    জ্ঞা: পাখোয়াজ বাজাতুম, তবলাও বাজাতুম।

    পূ: আপনার মনে আছে প্রথম লেস্‌ন কী শিখেছিলেন, আর কার কাছে?

    জ্ঞা: সেটা লেস্‌ন না বলে লেস অ-ন বলা ভাল। কারণ এখন যেটা -
    ধা   তেরেকেটে   তাক্‌   তাকতেরেকেটে   তাক্‌,   —সেটা:

    ধা   তেরে   কেটে   তাকঅ
    তাকঅ   তেরে   কেটে   তাকঅ
    বোলের বাণীর তফাৎ ছিল। বই থেকে তুলেছিলাম। ভাল লাগতো।

    ধা    তেরেকেটে    তাক,    ধা    তেরেকেটে    তাক্‌
    তুন্না    কেটে    তাক,       তাক    তেরেকেটে    তাক্‌

    ধিন    তা    নাক ধেনে,    ধাগেতেরেকেটে    তুন্না    কতা
    তাক    তেরেকেটে    তাক্‌,    তেরেকেটে    তেরেকেটে    ধিন—

    থাক সে সব পুরনো কথা।

    পূ: আজম খাঁর কাছ থেকে প্রথম লেস্‌ন?

    জ্ঞা: ধাধা   তেটে    ধাকা   তুন্না
          তাতা   তেটে    ধাধা   -ধিন্‌না

    আজম খাঁর কাছে যা শিখেছি। আবার আমরা তা শেখাতে পারি। গোড়া থেকেই আমি যে সমস্ত জিনিস পেয়েছি, সেগুলো যে কোনও আসরে যে কোনও বাড়িতে বাজাতে পারি। এক বছর দুবছরের মধ্যে তো বটেই! খাঁ সাহেব আমাকে নিয়ে যেতেন অনেক জায়গায়। জোর করে বাজাতে বসিয়ে দিতেন। আমার হয়তো বাজাতে মোটেই ইচ্ছা নেই। লহরা কী করে বাজাতে হয় জানি না। উনি বলতেন যা জানো তাই বাজাও। উনি খোসামোদ করার জন্য না, উনি দেখাতে চাইতেন ওঁর ঘরানার কত উৎকর্ষ। আমি বাজাতে পারতুম মোটামুটি। আগে বাজানো ছিল, আগে রেওয়াজ করতুম, অল্প জিনিস শিখতুম বলে। তাছাড়া আমার হাতে কতকগুলো জিনিস ভাল উঠতো। সেইগুলো অনেকে পারতো না। যেমন পাখোজের অঙ্গ যেগুলো সেই গৎ তোলা ছিল বলে, তবলায় সেগুলো ভাল উঠতো। সেই জিনিসগুলি খাঁ সাহেব আমার হাতে শুনতে খুব ভাল বাসতেন। খাঁ সাহেব ওইগুলো বাজাতেন না। আমাকে দিয়ে বাজাতেন। তাকেটে তাকেটে ধুমা ...। আমার চোখের গণ্ডগোলের জন্য তো পড়তে পারতুম না। মারাত্মক প্র্যাকটিস করতুম না। তবে করতুম।

    পূ: ক ঘন্টা?

    জ্ঞা: তা দিনের মধ্যে পাঁচ-ছ'ঘন্টা তো হত।

    পূ: আর গান?

    জ্ঞা: গান আমি তবলা শিখতে শিখতে আরম্ভ করেছিলুম। সাদ্দাম খাঁ বলে একজনের কাছে। তাছাড়া দবীর খাঁ সাহেবের কাকা উজীর খাঁ সাহেবের ছোট ছেলের কাছে শিখতুম। তাছাড়া আমরা যখন গিরিডি যাই সেই সময় দবীর খাঁ সাহেবের কাছে শিখতুম। ১৯৩৯-এ আমি গিরিজা বাবুর কাছে শিখতে আরম্ভ করলুম।

    পূ: মসীদ খাঁ বাড়িতে আসতেন?

    জ্ঞা: হ্যাঁ, তিনি বাড়িতে আসতেন। আমি গিরিজাবাবুর কাছে যেতুম।

    পূ: দক্ষিণা?

    জ্ঞা: তা যা দেওয়া হত তাতে চলত না। টাকা হয়তো তিরিশ, চল্লিশ। যখন সারপেনটাইন লেনের বাড়িতে থাকতুম তখন কেরামৎ আসত। আমার সঙ্গে সঙ্গে বাজাতো। দেখতুম যে খাঁ সাহেবের মতন না। খানদানী না। ও highly original! খাঁ সাহেবের সঙ্গে ওর বাজের অনেক তফাৎ। কেরামৎ ছেলেবেলা থেকেই একটা creative artist। ওপর চালাকী করে বাজাতো। ভয়ানক intelligent, ভয়ানক talented! ওর বাজানো অন্যরকম। তখন আমাদের বাড়িতে ভোর ছটা থেকে ওঁর যত ছাত্র আসতো। উনি বাজাতেন। কেরামৎ, মুন্নে খাঁ আর আমি আলাদা বাজাতুম। বাড়ির সকলের সঙ্গে খুব একটা জমত না। ভাষার অসুবিধা ছিল। আমার একটু অসুবিধা হত। হিন্দী তো অত তাড়াতাড়ি pick up করা যায় না। প্রথম প্রথম ভয়ানক অসুবিধা হত। - তখন আমি পড়াশোনা করতুম। রেডিও থেকে, হিন্দী উর্দু dictionary দেখে শিখতুম।

    পূ: অন্যান্য জায়গাতেও তো ঘুরতেন!

    জ্ঞা: ঘুরতুম। তখন অসুবিধা ছিল। এখন ভাষার ওপর যে control আছে, সম্পূর্ণ দখল আছে তখন তা ছিল না। জোর করে, চেষ্টা করে, শিখেছি। গাইয়ে বাজিয়েদের সঙ্গে তাছাড়া প্রোগ্রাম শুনে ভুলভাল বলতে বলতে। সঙ্কোচ ছিল। উর্দু accent আয়ত্ত করা কঠিন ছিল। অর্থগত তফাৎ বেশী না, কিন্তু উচ্চারণগত তফাৎ অনেক!

    পূ: রেয়াজের নিয়ম কী হওয়া উচিত?

    জ্ঞা: কয়েকটা 'কায়দা' আয়ত্ত করা। নখদর্পণে রাখা। যাতে যখন দরকার ব্যবহার করা যায়। এক একটা কায়দা নিয়ে hundred times! হাতটা যাতে ঘোরে, clear করা, সাফাই করা, দম বাড়ানো। কটাই বা বাণী আছে তবলায়! চার পাঁচটা 'কায়দা' দিয়ে যদি রেয়াজ কর — ধর বারো বছর বয়সে আরম্ভ করে যদি পাঁচ বছর করা যায়, (কথাটা বলেই বারোটা বোল বাজালেন)।

    আমরা সাধারণতঃ কী করি? বাঁধা কায়দা মুখস্ত করি, তারপর খাতায় লিখে নিয়ে হাতে বাজাই। এবং সঙ্গে সঙ্গে কিছু মাথায় আসছে, সেটা বাজাচ্ছি। কিন্তু আমি বলছি আর একটা জিনিস অভ্যাস করা। যেটা আমি করতুম। ওরা করে গানের ব্যাপারে আর তবলার লোকেরা তবলার ব্যাপারে। তবলাকে একটা ভাষা হিসাবে তৈরি করা। বাঁয়ার intonation-টা ভাল হবে, তবলা বাঁয়ার যুক্ত intonation-টা ভাল ভাল হবে, যদি তোমার মুখের intonation-টা ভাল হয়। সেটা একবার দেখা যাক। আমি তোমাকে যেটা বলছি যে - ধা তেটে ঘেড়ে নাগ, ধা তেটে ঘেড়ে নাগ, ধিন্না ঘেড়ে নাগ। আমি বলছি - তবলাটা ধরবে না। শুধু মুখে মুখে চিন্তা করা - মুখে চিন্তা করে বলবে। তারপর brain চিন্তা করছে - আর হাত বাজাচ্ছে। এই তিনটে জিনিসের যদি সংযোগ হয় তবে শুনতে আরও ভাল হয়। আর তোমাদের innovation এর আরও রাস্তা আরও নতুন নতুন বেরোবে। মুখে একবার অভ্যাস হয়ে গেলে, তোমার তবলা বাঁয়া হাতে কথা বলবে। কিন্তু composition টা তোমার। যে কোনও কায়দা নিয়ে তার থেকে innovation করে। - Simple variation করবে। মনে মনে কর। extempore করবে। উলটো দিক থেকে দেখতে গেলে বোঝা যায়, যে শিল্পীর brain কতটা তা ধরা পড়ে। এই variation করার ক্ষমতার ওপর। কতখানি ভেতরে গেছেন, অর্থাৎ লয়ের ওপর তাঁর অধিকার কতখানি। এবং একটা 'কায়দা' বাজাতে গেলে তার একটা system আছে। এতক্ষণ বাজছে হঠাৎ একটা বাইরের বোল, যেটা এই কায়দার সঙ্গে ধরে না - সেটা দিলে চলবে না তো! এখন যিনি বড় ওস্তাদ হয়ে গেছেন তিনি হয়তো আর্ষপ্রয়োগের মতো ঢুকিয়ে দিলেন, কিন্তু তারও একটা logic আছে। এমন logically দিলেন যে সেই বেআইনিটাই আইনি মনে হবে। কিন্তু সেটা সব জায়গায় চলে না।

    পূ: কী করে সেটা বোঝা যায়?

    জ্ঞা: তুমি যে প্রশ্নটা করছ - যা বাজাচ্ছেন তার মধ্যে উৎকর্ষ আছে কিনা কিভাবে বুঝব? কোনও বাহাদুরী আছে কিনা ভাল কথা বলেছ, এখন বিচার করতে গেলে, judgement করতে গেলে আমার কথা কেউ শুনবে না। লোকে বলবে আমাদের ঘরানায় আছে ইত্যাদি। ... আমার নিজের বিচার এর মধ্যে তোমার প্রশ্নের কতটা আছে জানিনা। কিছুটা answer পাওয়া যাবে।

    পূ: আপনি বললেই তো হবে। আপনি তো জানেন কেন বলছেন। তবলা এবং গানের ক্ষেত্রেও আপনার বক্তব্য জানতে চাই, উৎকর্ষ বিচারের ক্ষেত্রে।

    জ্ঞা: ১৯৩৪-এ এলাহাবাদ conference-এ গান শুনে আমার চক্ষুস্থির হয়ে গেল। দেখলাম এদের ব্যাপারটাই আলাদা। নাসিরুদ্দীন কে শুনলাম। কি control গলার উপর! অপূর্ব! ভাষা, ভাব, রাগ, গায়কী, লয়-এর মধ্যে কি সঙ্গতিপূর্ণ সামঞ্জস্য বিধান! এমন আগে শুনিনি। তাঁকে আবার দু'বছর পর কলকাতা ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট-এ শুনেছি একেবারে সামনের সারিতে বসে। It was a turning point in my life. শুনেছি একেবারে সামনের সিটে বসে। সেদিন আবদুল করিম এর সঙ্গে শ্যামসুন্দরের তবলা। অতি সুন্দর শুনলাম। It was a turning point in my life.

    সঙ্গীতে উৎকর্ষ বিচার :

    পূ: একটা কথা বলেছিলেন, লিখে রেখেছিলামঃ বলেছিলেন, "আমার একটা অহঙ্কার আছে।" কেন বলেছিলেন? মনে হয় বলছিলেন নিজের মতন করে বুঝে সৃষ্টি করেন, নকল করার পথে চলেন না। কথাটা একটু বিশদভাবে বলবেন?

    জ্ঞা: অহঙ্কার মানে বলছিলাম আত্মবিশ্বাস। নিজেকে বিশ্লেষণ করে যখন দেখি আমার এই এই কাজ করা উচিত। সেটা শুভ কি অশুভ, ভাল কি খারাপ। বিচার করে বলতুম এটা উচিত না! -- যেমন গোলাম আলি খাঁ সাহেব যখন নিচের দিকে গমক দেবার অভ্যাস ছিল। খরজের দিকে গমক করা শক্ত, ঠিক correct গমক করা মুস্কিল, কিন্তু উনি তা পারতেন। কিন্তু আমি মনে করলাম খাদের দিকে গমকের কাজ যেটা করেন, অনেকেই করে - ওই অ্যাই অ্যাই অ্যাই অ্যাই অ্যাই — ওটার কোনও দরকার নেই। কিন্তু গোলাম আলি করতেন। আমার খারাপ লাগত। উনি কেন করতেন? ওঁর মতন এক চিন্তাশীল লোক — যাঁর ভালমন্দ বিচারের ক্ষমতা ছিল! অহঙ্কার মানে আত্মবিচার!

    পূ: মানে কোথায় excellenceটা থাকছে না।

    জ্ঞা: হ্যাঁ।

    পূ: হয়তো কাজ দেখাবার জন্য ...

    জ্ঞা: হ্যাঁ exactly! এখন excellence বলা মুস্কিল। কারুকার্যের দিকে...

    পূ: ... সেটা মুস্কিল। কিন্তু একজন গুণী শিল্পী যতই গুণী হোন, তাঁর কোথাও ত্রুটি থাকতে পারে। বাহবা পাবার জন্য যদি compromise করেন; আপনি গোলাম আলি খাঁ সাহেবের ভীষণ ভক্ত, কিন্তু এই ত্রুটিটা দেখেছেন - এইখানে এই দোষটা আছে। আচ্ছা আমীর খাঁ আর গোলাম আলীর তুলনা করলে কী বলবেন?

    জ্ঞা: মানে style এর দিক দিয়ে বলা যেতে পারে সব দিক দিয়ে বলা মুস্কিল। আমীর খাঁর যে style ছিল তার মধ্যে ওঁর লক্ষ্য ছিল, তার মধ্যে অসংখ্য দিক, অনেক জিনিস; অনেক জিনিস দেখবার দিকে ওঁর লক্ষ্য ছিল। গোলাম আলীর কতকগুলো point উনি লক্ষ্য করতেন, যেগুলো হওয়া ভাল।

    পূ: এই দুই গুণী শিল্পীকে তো আপনি অনেক শুনেছেন -

    জ্ঞা: হ্যাঁ শুনেছি আর analyseও করেছি। কারুকার্যের দিকে গোলাম আলীর লক্ষ্য ছিল, mastery-ও ছিল মানে - তোমার physics এর মধ্যে এসে পড়বে। Frequency high আর low. Lower দিকে যে development করা - তাতে গোলাম আলি খাঁ সাহেবের voice এর যে quality -- timbre এ, সেই গলাতে নেই। অবশ্য উনি ওপরে নিচে অনেক যেতে পারতেন। কিন্তু ওঁর যেটা স্বাভাবিক আওয়াজ যে quality - যে timbre সেটা সুন্দর বটে কিন্তু আমীর খাঁর যে depth, যে গাম্ভীর্য তা নেই। আমীর খাঁর গাইবার মধ্যে অস্থায়ী প্রধান! অন্তরা খুব একটা করতেন না। অস্থায়ী composition-এ languagewise linguistic variation-এর দিকে তাঁর লক্ষ্য ছিল।

    পূ: এমন দুই গুণীর performance আপনি তো অনেক শুনেছেন!

    জ্ঞা: শুনেছি নিশ্চয়ই আর তার analysisও করেছি। বলতে গেলে গোলাম আলি খাঁর যে লয়ের আন্দাজ - ইংরিজীতে যাকে rhythm বলে তার মধ্যে অনেক সূক্ষ্ম বিভাগ আছে, সেই সূক্ষ্মতার দিকে যে observance - সেটা আমীর খাঁর বেশী ছিল। Rhythm মানে আমি বলছি space। Accepted rhythm বলতে যে formation সেটা বলছি না। কিন্তু যেটা formed হয়নি, সেখানেও rhythm তো রয়েছে - অফুরন্ত! অফুরন্ত সেই space তো আর কোনও বাঁধাধরা নেই। সেইখানে গোলাম আলি খাঁর যে space-এর আইডিয়া সেটা অনন্ত বিস্তৃত নয়। সেটা বোধহয় আমীর খাঁর ছিল। আমীর খাঁর কিন্তু তবলার লয় ছিল। তবলার সম্বন্ধে অনেক কথা বলেছেন।

    কিন্তু গোলাম আলি খাঁর গানগুলি শুনতে ভাল লাগত। এবং সেই ভাল লাগাটা লাগার মধ্যে একটা জিনিস আছে - সেটা সত্যি কথা। কিন্তু সেটা ভাষায় প্রকাশ করার মতো শক্তি এখন নেই। বলতে গেলে strain feel(*) করছি। (* -- অঙ্গাঙ্গীভাবে সুসঙ্গত বিন্যাস? space-time continuum, physics-এর ভাষায়?--পূঃ) সেটা হচ্ছে যে সুর এবং লয়ের মধ্যে কোনও তফাৎ নেই। সেটা আমি অনেক ভেবেছি। কথাটা হচ্ছে সুরটা ভাল লাগছে কেন? এই কারণেই ভাল লাগছে। এবং এক সময় এমন মনে হয়েছে যে সুর এবং লয়ের মধ্যে কোনও difference নেই। যদিও এ দুটো factor-ই আলাদা। Rhythm যেটা সেটাকে analyse করলে calculation এর মতো। Rhythm মানে calculation । কিন্তু সুরের মধ্যে calculation এর কথা আমরা ভাবি না। সুরের যে আমরা চিন্তা করি, সুরটাও যে calculation এর সঙ্গে logically যুক্ত - তার ভগ্নাংশগুলি বড়জোর শ্রুতি পর্যন্ত আছে - তা ছাড়া চিন্তা করি না। লয় নিয়ে মারামারি কাটাকাটি করি। যারা গায় মীড়গুলো - মীড়ের মধ্যে pass করে যতগুলি ভগ্নাংশ হতে পারে। গোলাম আলির সঙ্গে আমীর খাঁর গানের তুলনা করলে আমীর খাঁর গানের মধ্যে যে grandeur, গোলাম আলির গানের মধ্যে সেই grandeur নেই। যে dignity--বাংলায় কী বলা যায়? গাম্ভীর্য, সম্ভ্রান্তভাব - অর্থাৎ যে একটা order of excellence উন্নত সমুন্নত ভাব। একটা আভিজাত্য--সেটা আমীর খাঁর মধ্যে আছে। আমীর খাঁর গানের মধ্যে খানিকটা নিশ্চয়ই তাঁর কণ্ঠস্বরের জন্য এই ভাবটা আছে। অর্থাৎ তাঁর কণ্ঠস্বরের যে ব্যাপ্তি - তার মধ্যে অনেকখানি আছে।

    পূ: ফৈয়জ খাঁ ও গোলাম আলির তুলনা করছিলেন একদিন।

    জ্ঞা: তাই নাকি?

    পূ: কার মধ্যে কোনটা আছে, কোনটা থাকা উচিত, কোনটা ভাল -

    জ্ঞা: সেসব analysis করলে ভাল হবে! তুমি যে প্রশ্নটা করছ গানের মধ্যে কোনও উৎকর্ষ, বাহাদুরী আছে কিনা--artistic excellence আছে কিনা কি করে বুঝব? ভাল কথা বলেছ - এখন বিচার করতে গেলে judgement করতে গেলে প্রমাণ করতে গেলে - আমার কথা কেউ শুনবে না। খাঁ সাহেবদের গানের মধ্যে পুরনো লোকেরা বলেন - 'এরকম গান আর হবে না এরকম গায়কী আর হবে না' - ইত্যাদি। আমার নিজের বিচারে তোমার প্রশ্নের answer কতটা আছে জানিনা - কিছুটা answer পাওয়া যাবে। আমি যখন ছেলেমানুষ ছিলাম, গান ভালবাসতুম - আবদুল করিমকে শুনলুম, নাসিরুদ্দীন শুনলুম, এনায়েৎ খাঁ ভয়ানক নাম করেছেন যখন, শুনলুম - আমার নিজের কেন মনে হল - আমি বলছি বলে সেটা ঠিক - তা বলছি না। কিন্তু আমি গান ভালবাসি, সুর ভালবাসি, রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃতির মধ্যে মানুষ হয়েছি, বাড়িতে গানবাজনা হত, একটু ভালমন্দ বিচার নিজেও বুঝতে পারি, যেটা ভাল বা মন্দ বলি, কিছু গুণীজন একমত হন আমার সঙ্গে। হঠাৎ আমার ফৈয়জ খাঁ ভাল লাগল না কেন? দারুণ নাম! আজও পর্যন্ত অনেকে বলেন যে ফৈয়জ খাঁর মতো গান আর হয়নি - তুমি শুনেছ কিনা জানিনা। কেমন লাগে তাও জানি না। কিন্তু আমার মনে হয় তুমি শুনলে পরে দেখবে fineries ওঁর মধ্যে বড় কম। Fineries নেই। ফৈয়জ খাঁ যখন ভাল লাগেনি বলেছি তা অনেক দিনের কথা। Conference-এ যখন ফৈয়জ খাঁ গাইছেন - যাঁদের গান আমার ভাল লাগে তাঁরাও impressed! এবং এমন atmosphere তিনি তৈরী করলেন, তার মধ্যে পড়ে আমার ভাল লাগতে বাধ্য। তখন আমি analyse করে ওঁকে বিচার করেছি। তখন ফৈয়জ খাঁ গাইছেন - গোলাম আলি খাঁ সাহেব তাঁকে একটা সম্মান দিতেন - খানদান হিসাবে কিন্তু তিনি ফৈয়জ খাঁকে একটা বড় কলাকার বলে নিজে মনে করতেন বলে আমার মনে হয় না। হয়তো মুখে তিনি জীবনেও কখনও তা বলেন নি। তবে তাঁর নিজের গান থেকে আমি বলতে পারি analyse করে যে তাহলে ফৈয়জ খাঁর কিছু ওঁর মধ্যে থাকত। কারণ ফৈয়জ খাঁর ওইরকম নাম - ওঁর senior কিন্তু গোলাম আলির মধ্যে তাঁর প্রভাব একদম prominent by absence! গোলাম আলি খাঁসাহেবকে আমার খুব ভাল লাগত। আমার মনে হয় ওইরকম একটা artistic approach ওঁর আগে কেউ করে নি। সব রকম দিক থেকে লয়, বোল বাণী - সব মিলিয়ে মনে হয় artistic বিচারে ওঁর তুলনা নেই। তবে analyse করলে হয়তো শুনতে খারাপ লাগবে যে শ্রদ্ধা হারাচ্ছি। তা নয়। এখন ফৈয়জ খাঁ আর গোলাম আলির মধ্যে এঁর এটা ভাল, ওঁর এটা ভাল সেটা বিচার করে যদি analyse করি তবে বেশী নম্বর পাবেন গোলাম আলি। এখন ফৈয়জ খাঁর ভক্তরা বলবেন গানের যে আদর্শ তাতে ফৈয়জ খাঁর তুল্য আর কেউ নেই। তা তাঁরা বলতে পারেন। তাহলে আদর্শটা কী?

    কী কী quality থাকলে বলা যাবে যে এই ঘরের গায়কী একটা উঁচু আদর্শে প্রতিষ্ঠিত। সেটা কী করে বলা যায়? যখন approach করি analyse করে, তখন analyseed part গুলো তো not equal to the appreciation of the whole thing! তা তো নয়। সেটা খুব মুস্কিল। কিন্তু analyse তো করতেই হবে তারপর whole-টা বিচার করে আমরা একটা মতে পৌঁছতে পারব। এটা কঠিন ব্যাপার। কিন্তু আমার মনে হয় যতই কঠিন ব্যাপার হোক analyse করতেই হবে। এই জিনিষটা ভাল লাগছে, এটা লাগছে না। একটা কথা তো মাধুর্য। শ্রুতি মধুর আর শ্রুতি কটু। এখন classical গান যাঁরা করেন, তাঁরা বলেন মিষ্টি হলেই classical হবে না। সেটা সত্যি। মিষ্টি হবে না সেটাও একটা কথা না। মিষ্টি হবে সেটা প্রয়োজন। কিন্তু মিষ্টি হতে গেলে তাকে আগাপাশতলা মিষ্টি হতেই হবে তা তো নয়। আর্ট-এর মধ্যে অনেক রকম কৌশল আছে। তাছাড়া কতকগুলি tradition আছে কী সেটা তা আবার একটা অন্য রাস্তা।

    ফৈয়জ খাঁ গোলাম আলি তুলনা করলে খানিকটা বোঝা যাবে। ফৈয়জ খাঁর মধ্যে যেটা ছিল সেটা - উনি জমিয়ে দিতে পারতেন। আত্মসমাহিত ভাবটা তাঁর মধ্যে কম ছিল। exhibitionismটা যেহেতু বেশী ছিল, তিনি audienceকে মাতিয়ে দিতে পারতেন। আর অডিয়েন্সের মধ্যে তন্ময় হয়ে উপলব্ধি করার দক্ষতা কজনের ছিল? খুব কম লোকেরই থাকে। কিন্তু ফৈয়জ খাঁ তন্ময় হতেন না তা নয়। ফৈয়জ খাঁ তন্ময় হয়ে যখন গাইতেন সেটা ভাল তখন তাঁকে হয়তো পাওয়া যেত। সেটা আসরের মধ্যে অনেক সময়। আবার গোলাম আলিও হয়তো কখনও অনেকক্ষণ ধরে গাইলেন - আসল শ্রোতারা appreciate করতে পারল না। এই ব্যাপারটা vary করে। যখন আর্টিস্ট তাঁর নিজের আর্টকে নিজেই আনন্দ করে উপলব্ধি করে গাইতে চান সেইটা ভাল হয়। কিন্তু যখন for the pleasure of the audience সেটা বদলে যায়।

    তুমি যেটা বলছিলে, কয়েকটা concrete প্রশ্ন দিয়ে আরম্ভ করছি পরে আরও বলব। গোলাম আলি এবং ফৈয়জ খাঁর performance এর কোনও analysis করছি না। দুজনের গানের মধ্যে কী পার্থক্য এঁর মধ্যে কী পাওয়া যায়, ওঁর মধ্যে কী পাওয়া যাচ্ছে না ...

    পূ: Finery-র কথা বলছিলেন।

    জ্ঞা: Voice, মানে আমাদের নাদ যেটা বলে। মানে musical sound - আমরা যতক্ষণ শুনছি বুঝতে পারছি না। গোলাম আলি যদি 'সা' - বলেন আর ফৈয়জ খাঁ যখন 'সা' বলেন তার frequency measure যায়।

    (সেদিন এই পর্যন্ত আলোচনা করা সম্ভব হয়েছিল।--পূঃ)

    সঙ্গীতের উৎকর্ষ বিচার :

    সঙ্গীতের উৎকর্ষ বিচারের জন্য concrete উপাদান-ভিত্তিক আলোচনা করতে তিনি আগ্রহী ছিলেন। বলেছিলেন আরও বলব। কিন্তু তা শোনা হল না। এইরকম অভিজ্ঞ চিন্তাশীল ব্যক্তিদের উপলব্ধিজাত বিশিষ্ট বক্তব্য শোনার সুযোগের সদ্ব্যবহার প্রায়ই ঘটে না। বয়সের ভারের ক্লান্তির কথা স্মরণ থাকে না। সেদিন তাঁর আলোচনা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বিশ্লেষনের দিকে যাচ্ছিল। মৌলিক উপাদানগুলি বিশ্লিষ্ট করে সেগুলির ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করার কথা বলছিলেন। দু'জন বিশিষ্ট শিল্পীর মধ্যে উপাদানগুলির 'গুণ' বিচারের ভিত্তিতে। যেমন করা হয় জড়বিজ্ঞানে সমগ্র পদার্থের 'গুণ' - তার উপাদান গুলির গুণ বিচারের ক্ষেত্রে। তবে সঙ্গীতের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত অনুভূতির বিভেদের দরুণ সর্বজন স্বীকৃত সমাধানের পথ আরও কঠিন। তবু, তিনি যেসব উপাদান ভিত্তি করে এই কাজে অগ্রসর হবার পথ দেখালেন তার সন্ধানের প্রচেষ্টা করা যাক:

    ফৈয়জ খাঁ এবং গোলাম আলির 'সা' স্বরের প্রয়োগের ক্ষেত্রে স্বরগুলির থেকে উৎপন্ন শব্দতরঙ্গের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে আঙ্কিক পদ্ধতিতে পরিমাপ করা যায়। তরঙ্গের প্রকৃতির 'সৌন্দর্য' জ্যামিতির স্বতঃসিদ্ধর প্রাথমিক শর্তরূপে অনুমান করা যায় মাধুর্য ও কর্কশতা অনুযায়ী শব্দ তরঙ্গের রূপ সরল বা বিকৃত হয়। ধ্বনি মাধুর্যের একটা শর্ত ধরা যায়। তারপর সঙ্গীত পরিবেশনের জন্য শিল্পীর 'আত্মসমাহিত ভাব' তাঁর বিচার অনুযায়ী একটা উপাদান। আর একটি, পরিবেশনে finery (সূক্ষ্মতা!) এ সম্বন্ধে হয়তো সর্বজন স্বীকৃতি অর্থাৎ সহমত হবার সম্ভাবনা আছে। তৃতীয় উপাদান ভাষার বিশুদ্ধতা - বিশুদ্ধ উচ্চারণ, চতুর্থ - সাঙ্গীতিক 'সুর', পঞ্চম - লয়-- এই ক'টি উপাদানের বিশুদ্ধ প্রয়োগ - তার পরের শর্ত এই উপাদান গুলির 'সঙ্গত' ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট 'ভাব' প্রকাশ। এই অংশের সৌন্দর্য বিচারে ব্যক্তিগত অনুভূতির প্রবেশে সহমত হওয়া মুস্কিল। কিন্তু বর্তমানে উপাদানগুলির প্রকৃতির পরিমাপ করার জন্য যান্ত্রিক পদ্ধতি যে রকম ভাবে ক্রমোন্নত হচ্ছে তাতে হয়তো সর্বজন স্বীকৃত 'সৌন্দর্য' বিচারের পথ ক্রমোন্নত হয়ে তা একটি আঙ্কিক 'সত্য'র স্বীকৃতি পেতে পারে বলে আশা করা যায়। 'সঙ্গতি' - 'সঙ্গত' কথাটা তিনি বারবার ব্যবহার করেছেন। চিত্রশিল্পীরা ও চিত্রের বিভিন্ন অংশের মধ্যে সঙ্গতি বা 'balance' এর কথা বলেন। এমনকি আইনস্টাইন প্রাকৃতিক 'পদার্থ' গুলির মধ্যে ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়ার নিয়ম 'গাণিতিক' সঙ্গত নিয়ম ('সৌন্দর্য')-র নিয়ম মেনে চলে বলে বুঝেছেন। ব্যক্তিগতভাবে যাঁদের শুনেছি তার মধ্যে আমীর খাঁর গান আমার সবচেয়ে ভাল লেগেছে। জ্ঞানবাবুর বিশ্লেষণে তাঁর পরিবেশনের উৎকর্ষ সমুন্নত শুনে ভাল লাগল। গোলাম আলির গানও খুব ভাল লাগত। এবং তাঁর গানের উৎকর্ষ ও ত্রুটি বিষয়ে জ্ঞানবাবুর বক্তব্যর সঙ্গে আমি সহমত। এঁদের সামনে বসে শুনেছি - ফৈয়জ খাঁকে সেভাবে শুনিনি। রেকর্ডে কয়েকটা গান ভাল লেগেছে - কেন লেগেছে বিশ্লেষণ করিনি। ফৈয়জ খাঁর গান খুব কম শুনেছি। আলোচনা করা হয়নি জ্ঞানবাবুর সঙ্গে। 'আত্মসমাহিত ভাব' আমীর খাঁ এবং বন্ধু নিখিল ব্যানার্জীর মধ্যে অনুভব করেছি। নিখিলের আমীর খাঁর গানের প্রতি খুব শ্রদ্ধা ছিল। তার বাজনায় তাঁর প্রভাবও ঘটেছে।

    সার্থক সঙ্গীত সৃষ্টির সুর সমাবেশের নিয়ম অনুসন্ধানে এখন অনেকেই রত আছেন। বিজ্ঞানী এবং সঙ্গীতজ্ঞ যৌথ ভাবে কাজ করছেন।

    ১৯৯৪-এ পুনাতে দেখেছি ইলেকট্রনিক্স এর অধ্যাপক সহস্রবুদ্ধের স্ত্রী সুগায়িকা বীণা সহস্রবুদ্ধের গানের রেকর্ড ভিত্তি করে তাঁর এক ছাত্রকে computer এর সাহায্যে বিশ্লেষণে রত থাকতে দেখেছি। দুটি দুটি স্বর নিয়ে তারা কতবার পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে - তার পরিমাপ করছেন। এমন কাজ অতি দ্রুত সম্পন্ন হয়।

    এখন অনেক জায়গায় নিশ্চয়ই বিজ্ঞানী ও সংগীতজ্ঞর সহযোগিতায় এই ধরনের কাজ করছেন। এবং অনেক তথ্য জড়ো হয়ে সঙ্গীতের বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণের পথ সুগম হচ্ছে।

    কিন্তু এমন কাজের পথিকৃৎ ছিলেন জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ।

    উপরোক্ত অর্ধসমাপ্ত আলোচনা থেকেই বোঝা যায় তাঁর বিচারের উপস্থাপনা কী যুক্তিনিষ্ঠ। তাঁর বিচারের প্রাথমিক শর্ত অনুযায়ী তাঁর বক্তব্য অকাট্য। তবে আর্টের ক্ষেত্রে উৎকর্ষ বিচারের প্রাথমিক শর্ত জ্যামিতিক স্বতঃসিদ্ধর মতো অপরিবর্তনীয় নয়। ব্যক্তিগত রুচিনির্ভর। কেউ যদি প্রাথমিক শর্ত দাপট ও মজলিশ জমানোর ক্ষমতাকে নির্বাচন করে, কিছু বলার নেই। তবে জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের বক্তব্য প্রকাশের ভাষা এত অনবদ্য ঘন্টার পর ঘন্টা শুনলেও ক্লান্তি ঘটে না। এত জিনিস জানতেন, পারতেন যে চব্বিশ ঘন্টায় তার কাজ কখনও শেষ হত না। তাছাড়া এত সুরসিক যে পরিপূর্ণ আনন্দে মেতে থাকতেন। মনে পড়লো-- ক্লাসে একদিন ব্যস্তভাবে তবলা-গান শিখিয়ে চলেছেন। বাড়ি থেকে ফেরার তাড়া এলো। বললেন, "এই গানটা, তবলাটা শেষ করে নিই - আবার গীটার এসে যেতে পারে।" এমন সময় গীটারের গৎ নিতে এক ব্যক্তির প্রবেশ। বললেন "তুমি এসেছো? - তোমার কথাই ভাবছিলাম।" ঘরভর্তি সকলে অট্টহাস্যে ফেটে পড়লো। আমাদের শোনার ক্লান্তি ছিলনা - কিন্তু তাঁর যে শরীরে ক্লান্তি ঘটতে পারে বোঝা যেত না।

    রবীন্দ্রসংগীত প্রসঙ্গে :

    মাঝে মাঝে আলোচনা এবং ডায়েরীর পাতায় রবীন্দ্রসংগীত বিষয়ে যা বলেছেন:

    জ্ঞা: সুবিনয়, বুদ্ধদেব এরা রবীন্দ্রসংগীত এবং classical music-এর সঙ্গে তার সম্পর্ক নিয়ে অনেক চর্চা করেছে আর ওরা practical demonstration দিচ্ছে। - যদুভট্ট এই করেছেন, সেটা রবীন্দ্রনাথ এইভাবে করেছিলেন ইত্যাদি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের classical music-এ যতই আগ্রহ থাকুক রবীন্দ্রনাথের সময়ে বা একটু পরে আমাদের সময়ে classical music-এর যা চর্চা হত বা যে ধারণা ছিল সেটা প্রায় entirely পালটে গেছে for the better. সেটা কেন বলছি - আমি বললে তো হবে না!

    পূ: আপনি বললেই তো হবে। আপনি কেন বলছেন আপনি জানেন।

    জ্ঞা: সেটা আমার বলতে হবে। মানে clearly বোঝাতে হবে।

    পূ: যেভাবে evolve করেছে, সেটা যে বললেন। কেন বললেন? আর একটা কথা বলেছিলেন, "রবীন্দ্রনাথকে এখন যত ভাবছি, আমার খুব ভাল লাগছে। কারণ উনি ভাসাভাসা ভাবে যা জেনেছেন, নিজের মতন করে absorb করে নিজের জিনিসটা বের করেছেন" - সেই কথাটা বলতে বলতে আমার টেপ ফুরিয়ে গেল। সেটা একটু বিশদভাবে বলবেন?

    জ্ঞা: রবীন্দ্রসঙ্গীত যে ভাবে উনি সৃষ্টি করেছেন এবং প্রচারিত হয়েছে, তার ভাবটা আমার ভাল লাগে। কিন্তু হিন্দুস্থানী classical music বিষয়ে যেভাবে আমরা ধারণা করেছি। শুধু আমরা না শাস্ত্রীয় অনুশাসনে যা আছে তাদের বক্তব্য জেনেছি। খুবই বৈদগ্ধ্য ছিল। কত প্রাচীন জানা নেই তবে 14th century তে শার্ঙ্গদেবের লেখাগুলির ওপরেই লোকে বিশ্বাস করে। সেটা আমি ছেড়ে দিচ্ছি, আমি চলে যাচ্ছি একদম রবীন্দ্রনাথে। তিনি এসব পড়েছেন নিশ্চয়ই। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের প্রতি তাঁর যথেষ্ট শ্রদ্ধা ছিল, কিছু শিক্ষাও হয়তো ছিল সেই যদুভট্টের আমলে। শ্রদ্ধা যতই থাক, শ্রদ্ধা থাকা সত্ত্বেও, একটা লোক সে পৃথিবীর যা কিছু আছে সবই করবেন তা তো হতে পারে না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তো করেছিলেন খানিকটা - যা করেছিলেন তার তুলনা নেই। কিন্তু classical সঙ্গীত নিয়ে অত চিন্তা করার তাঁর সময় ছিল না। এবং ওঁর জীবন যতদিন ছিল, তার মাঝখানে যাঁকে যাঁকে শুনেছিলেন, তখনকার দিনে ঠাকুরবাড়িতে যাঁরা ঢুকতেন তাঁদের শুনেছেন। তার থেকে তাঁর একটা ধারণা ছিল। আর পরবর্তী যুগে আমাদের যা জানা কেশরবাঈকে শুনেছেন। তাঁর বক্তব্য ছিল তাঁর ভাল লেগেছিল। এই পর্যন্ত। কেন ভাল লেগেছিল, কতটা ভাল লেগেছিল জানা নেই। এবং কেশরবাঈ এমন একটা সত্যিকারের উঁচুদরের কলাকার - আল্লাদিয়া খাঁর কাছে গাণ্ডা বেঁধে শিখেছিলেন। [ধূর্জটি মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ কিছু বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন কেশরবাঈ সম্বন্ধে (পূ: সিংহ এটা বলা হয়নি।] রবীন্দ্রনাথ-- এখন মনে হয়, শিক্ষার দিক দিয়ে খুব যে অতটা যেতে পেরেছিলেন তা নয়। তখনকার দিনে যাঁরা ছিলেন - নানা কিংবদন্তীর মধ্য দিয়ে প্রচার হয়েছে। যে সত্যিকারের ওঁর classical music ভাল লাগতো এবং শান্তিনিকেতনে তখনকার দিনে যারা পড়তো তাদের যাতে classical-এর প্রতি একটা আসক্তি জন্মায় এটা তিনি চিরকাল চাইতেন। কিন্তু সেটা কতটা হয়েছিল তা ভাববার কথা। রবীন্দ্রনাথের classical-এর প্রতি খুব শ্রদ্ধা ছিল। কিন্তু শিক্ষার দিক দিয়ে আজকের তুলনায়, কিছুই ছিল না।

    পূ: তাঁর exposure কতদূর হয়েছিল মনে হয়?

    সেটা তো কতদূর হয়েছিল জানা যায় না। চলে গেলেন তো কত আগে। আজকের দিনে তিনি বেঁচে থাকলে আগ্রহ কতটা থাকত তা তো আর কেউ বলতে পারে না। নিশ্চয়ই থাকত। কিন্তু তখন আজকে young এবং old people দের মধ্যেও যা আছে তা ছিল না।

    পূ: বিশেষ করে বাঙালীদের মধ্যে?

    জ্ঞা: ওঁর নিজের সৃষ্টি যেটা--উনি নানা বিষয় নিয়ে চিন্তা করেছেন এবং লিখেওছেন। বাংলা গানের পর্যায় হিসাবে নানা বিষয় আছে। রবীন্দ্রনাথের নিজের ভাল লাগার level যে ছিল খুব উঁচুদরের এবং সেটা বোধহয় সকলেরই থাকা উচিত। রবীন্দ্রনাথের ভাল লাগার একটা বিশেষ মূল্য আছে। রবীন্দ্রনাথ বলেই। কেন ভাল লেগেছিল। আজকের দিনে বলা মুস্কিল। তখনকার পরিবেশ সংস্কৃতি সবই ছিল আলাদা। সেই সংস্কৃতির সঙ্গেই উনি ছিলেন। উনি রাগরাগিণী মিশ্রণ করছেন। ওঁর ভাল লাগলে সেই ভাল লাগাটার একটা মূল্য ছিল। শুধু তখনকার দিনে নয় — for all times! কতকগুলো ভাল লাগা যে কোনও সময় ভাল লাগবে।

    (Diary 19-7-87 p. 126)

    রবীন্দ্রসঙ্গীত ও ক্ল্যাসিকাল প্রসঙ্গে :

    ভারতীয় সনাতন classical সঙ্গীতের মধ্যে একেবারে গোড়া থেকে musical culture-এর মধ্যে সরলতম থেকে আরম্ভ করে আলঙ্কারিক প্রক্রিয়ার মধ্যে জটিল কুশলতা এসে পড়েছে এবং সেটা নান্দনিক বা aesthetic পর্যায়ে। এ সংগীত নানান ভাবধারায় সম্বলিত হয়েও পূর্ণরূপে ভারতীয় - সামগ্রিক রূপে। বাঙালী, মহারাষ্ট্রীয়, গুজরাটি, ওড়িয়া, বিহারী, আসামী বা পাঞ্জাবী regional বা প্রাদেশিক সংস্কৃতি থেকে সামগ্রিক রূপে ভিন্ন এবং মৌলিক। অথচ এই সবগুলির সমন্বয়ে তৈরী।

    রবীন্দ্রনাথ এই সুমহান বা বিস্তৃত ঐতিহ্যের তুলনায় সীমিত। সেই কারণে ভারতীয় সনাতন সংগীতের সঙ্গে সমকক্ষতার দাবী করতে পারে না। রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত পরিকল্পনা এবং আন্তরিক সৌন্দর্যবোধ বা সৃষ্টি যতই আশ্চর্য হোক না কেন, শিল্পকৌশল এবং সূক্ষ্ম কারুকৃতি, ভারতীয় classical এর তুলনায় বৃহৎ বা মহৎ নয়। অর্থাৎ অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রায়তন।

    রবীন্দ্র সংগীত ও classical music প্রসঙ্গে - নব্বইয়ের দশকে আলোচনায় যা বলেছেন, আলোচনা করছি:

    "রবীন্দ্রনাথের সময়ে classical music চর্চা যা ছিল, completely পালটে গেছে - আর changed for the better।" নিশ্চয়ই বঙ্গদেশে চর্চার কথা বলেছেন। ... 'যতই ভাবছি খুব ভাল লাগছে', 'শিক্ষার দিক থেকে বিশেষ কিছু ছিলনা' - 'classical music নিয়ে তাঁর ভাববার সময় ছিল না।' - 'ভাসাভাসা ভাবে যা জেনেছেন - নিজের মতো করে absorb করে নিজের সৃষ্টি করেছেন। 'রবীন্দ্রনাথের ভাল লাগার level খুব উঁচু ছিল - সকলেরই তেমন হওয়া উচিত।' তাঁর 'ভাল লাগার একটা মূল্য আছে' শুধু তখনকার জন্য না 'for all times to come! সব সময়েই ভাল লাগবে।' ... তারপর - ১৯৮৭-এ ডায়েরীর পাতায় যা পড়লাম তার মর্ম-- সারা ভারতের ভাবধারা সম্বলিত হয়ে classical music এ যে সুমহান ঐতিহ্য সৃষ্টি হয়েছে 'তার তুলনায় রবীন্দ্রসংগীত বৃহৎ বা মহৎ না - অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রায়তন।' প্রথমে কিন্তু বলেছিলেন বুদ্ধদেব যে classical-এর সঙ্গে রবীন্দ্রসংগীতের তুলনা করেছে ... সেটা তাঁর ঠিক মনে হয় না।

    আমার নিজের মনে হয় classical music এবং রবীন্দ্রসংগীত এর বিচরণ ক্ষেত্র ভিন্ন প্রকৃতি। মানুষের মনে দু'রকমের অনুভূতি জগৎ সৃষ্টি করে। সুতরাং এ দুই ধরনের মধ্যে তুলনা করা সঙ্গত নয়। Classical music এর বৈশিষ্ট্য বিষয়ে যে আলোচনা করেছেন, অল্প কথায় - তাঁর বক্তব্য অত্যন্ত সঙ্গত এবং সুন্দর। রবীন্দ্রসংগীত বিষয়ে যে আলোচনা করেছেন তাতেও অতি স্পষ্টভাবে রবীন্দ্রসংগীতের বৈশিষ্ট ফুটে উঠেছে। ডায়েরীতে লেখা বক্তব্য পরে পড়েছি - আমার বক্তব্য বিষয়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া নিয়ে আলোচনার সুযোগ পেলাম না। আমার মনে হচ্ছে classical music যদি সর্বভারতের ভাবধারার মিলিত হয়ে ভারত মহাসাগরের মতন মহামূল্য সম্পদ সমৃদ্ধ হয়, তবে রবীন্দ্রসংগীত তুষারাবৃত্ত হিমালয় শৃঙ্গ। যার উপর থেকে আলো বিচ্ছুরিত হয়ে নানা রঙের আলো সৃষ্টি করে। যা মানবমনকে আলোকিত আলোড়িত করে নানা ভাবের জগতে অনুরণন ঘটায়।

    তুলনা যুক্তি নয়। রবীন্দ্রসংগীত সত্যিই বাংলার বাইরে তেমনভাবে ছড়ায়নি। বাংলাভাষা রবীন্দ্রনাথের দ্বারা যেভাবে সমৃদ্ধ হয়েছে তা একক, অনন্য সৃজনশক্তিতে ঘটেছে। রবীন্দ্রনাথের কবিতা (কিন্তু ইংরেজিতে লেখা) সারা বিশ্বে সম্মানিত। মনে হয় দেশ স্বাধীন থাকলে বাংলাভাষা শিখে সাহিত্যরসজ্ঞ তার মূল সৃষ্টি পড়তেন। কালিদাস-এর রসগ্রহণের জন্য যেমন সংস্কৃত জানা প্রয়োজন, গ্যোয়েটে পড়ার জন্য যেমন জার্মান শেখা প্রয়োজন, সেক্সপীয়রকে জানতে ইংরেজী জানা প্রয়োজন তেমনি রবীন্দ্রনাথের মূল রসগ্রহণের জন্য বাংলাভাষা জানা প্রয়োজন। পর্বতশৃঙ্গ থেকে বিচ্ছুরিত আলোর তুলনা দিয়েছিলাম - রবীন্দ্রসংগীতে আলো সুরে বাজে। 'যে সুরে বাজালে প্রভাত আলোরে' - এমন অনেক উদাহরণ আছে - গ্যোয়েটের কাব্যে সূর্য সঙ্গীতে বেজে ওঠে। এইরকম উঁচু স্তরের কবিদের মনের প্রকৃতি এমনভাবেই বিশিষ্ট রূপ গ্রহণ করে। রবীন্দ্রসংগীত নৃত্যনাট্য ইত্যাদি ব্যাপক ক্ষেত্রে বিস্তৃত হতে গিয়ে সুরেও হয়তো নতুন মাত্রা যোগ করেছে যা অবাঙালীদের মনেও সাড়া দিতে পারে। এ বিষয়ে যথেষ্ট কাজ হয়নি। রবীন্দ্রনাথের যে সব গান classical-এর বন্দিশে সৃষ্ট - যাকে ভাঙা গান বলা হয় - বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত সেইগুলি সরোদে কি রূপ তা দেখিয়েছেন। কিন্তু যে গানগুলি সম্পূর্ণ নিজস্ব সৃষ্টি সেগুলি নিয়ে কতদূর আলোচনা হয়েছে জানি না। তবে সে গানগুলিও অবাঙালী classical গাইয়েদের আকৃষ্ট করেছে। মোহন সিং অত্যন্ত সুন্দর রবীন্দ্রসংগীত করেন। তিনি অবশ্য শান্তিনিকেতনের সঙ্গীতভবনের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু ওস্তাদ রসীদ খাঁ অতি সুন্দর রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করেছেন। বাঙালী বিয়ে করে বাংলাভাষার সঙ্গে কিছু পরিচয় আছে। কিন্তু বাঙালী সংস্কৃতিতে প্রতিপালিত নন। বাংলাভাষার সঙ্গে সম্পূর্ণ অপিরিচিত অবাঙালী classical গাইয়েদের রবীন্দ্রসংগীত শুনিয়ে প্রতিক্রিয়া জানা প্রয়োজন।

    একদিক দিয়ে রবীন্দ্রসংগীত অভারতীয়। কারণ ভারতীয় classical সঙ্গীত থেকে লোকসঙ্গীত পর্যন্ত ব্যক্তিগত গায়কের কথা ও সুর বিস্তারের স্বাধীনতা থাকে, কিন্তু রবীন্দ্রসংগীতে কথা ও সুর এতই অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত হয়ে সৃষ্ট, যে এমন স্বাধীনতা থাকে তা হয় না। সঙ্গতও না। পশ্চিমী কম্পোজারদের সৃষ্ট সঙ্গীত যেমন যথাযথ ভাবে পরিবেশিত হয় তেমন। কোনও কোনও শিল্পী অবশ্য রবীন্দ্রসংগীতে কিছুটা সুর বিস্তার করেন - কিন্তু তা অতি বিশিষ্ট গুণী শিল্পীর ক্ষেত্রে ঘটা বাঞ্ছনীয়।

    জ্ঞানপ্রকাশ ভাষার বিশুদ্ধতা রক্ষা এবং বিশুদ্ধ উচ্চারণের প্রতি বিশেষ মূল্য দিয়েছেন। মনে হল রবীন্দ্রসংগীতে যেমন ভাষার বিশুদ্ধ প্রয়োগ যতটা গুরুত্বপূর্ণ classical music-এর পরিবেশনের ক্ষেত্রে কি তেমনই হবার কথা? তার পরেই মনে পড়লো আমীর খাঁর খেয়ালের বন্দিশ উচ্চারণের কি অপূর্ব সৌন্দর্য! যাইহোক 'ক্ষুদ্রায়তন' মহৎ বা বৃহৎ না পড়ে অনেক কথা মনে পড়লো। রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞরা এ বিষয়ে অনেক কথা বলেছেন - আমার পক্ষে বেশী আলোচনা করা ঠিক নয়। Classical বহু মানুষের বহুদিনের চিন্তা ও প্রয়োগের উদ্যোগে সৃষ্ট বিরাট সৃষ্টি ঠিকই কিন্তু সমান্তরালভাবে 'মহৎ' আর এক সৃষ্টি যে হতে পারে তার অনেক উদাহরণ আছে। রবীন্দ্রনাথ নিজেই বিদ্যাসাগর বিষয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছেন হঠাৎ একজন 'মানুষ' সৃষ্ট হল। রবীন্দ্রনাথ নিজেও তেমন একজন 'মানুষ' এবং তেমন মানুষের মাঝে মাঝে উদয় হয়। তার ফলে আমরা মনের প্রায় সবরকম অনুভূতি উপলব্ধি ও প্রকাশের পথ পেয়েছি। 'বিষাদ' মুক্ত হবার পথ পেয়েছি।

    জ্ঞানবাবুর সঙ্গে নিঃসঙ্কোচে সঙ্গীত বিষয়ে যা খুশী আলোচনা করেছি তাই এত কথা বলার প্রেরণা পেলাম। কথাগুলিতে তাঁর প্রতিক্রিয়া কী হত জানি না। তবে মনে হয় খুব বিরুদ্ধ অনুভূতি তাঁর হত না। আর একটা কথা মনে পড়ল - তাজমহল ভাল লাগলেও 'কোনারক' মন্দির আমার খুবই ভাল লাগে। এবং লক্ষ্ণৌর বা বেনারসী টপ্পা খুব ভাল লাগলেও, কালী পাঠকের টপ্পা ভাল লাগতো। ভুঁড়িওয়ালা মহাদেব ও গণেশ-এর মধ্যে নিশ্চয়ই এমন কিছু আছে যার জন্য অসংখ্য মানুষ তাঁদের নিয়ে মেতে উঠেছে! সমান্তরাল ভাল লাগা!

    রম্যগীতি :

    ডিক্সন লেনে তবলা শিক্ষার সময় দেখেছি জ্ঞানবাবুর সৃজনে মেতে ওঠার পর্যায় - রম্যগীতি রচনা! বলতেন আকর্ষণীয় বাংলা গানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের রাগসংগীতের সঙ্গে পরিচিত করা তাঁর উদ্দেশ্য। ব্যাপারটার কিন্তু রাগপ্রধান গানের সঙ্গে তফাৎ আছে। রাগপ্রধান-এ রাগের ভূমিকাই প্রধান, তার প্রকাশের জন্য বাণীর ব্যবহার। রম্যগীতিতে গানের ভিতর দিয়ে রাগের প্রবেশ। সেই সময়ে তাঁর গুণী ছাত্র প্রসূন ব্যানার্জীর অপূর্ব গান শুনেছি 'নিশীথ শয়নে জাগে আঁখি উদাসী'। প্রসূনের অকালমৃত্যু বাঙালীর গান ও বাংলাগানের একটা বড় ক্ষতি। রম্যগীতি তাঁর কণ্ঠেই প্রথম শুনেছি। তারপর রেডিওতে জ্ঞানবাবুর নিজের গাওয়া সুন্দর গান শুনেছি। পরবর্তীকালে অজয় চক্রবর্তীর কণ্ঠেও অতি সুন্দর গান শুনেছি। অন্যান্য ছাত্রছাত্রীরাও অনেকে গাইতেন। আমি বেশি শুনিনি। জ্ঞানপ্রকাশের প্রধান ভূমিকা ছাত্র তৈরীর - গুরুর ভূমিকা। রম্যগীতি বিষয়ে জ্ঞানবাবুর সঙ্গে বিশেষ আলোচনা হয়নি। সুতরাং সে বিষয়ে আমার বিশেষ কিছু বলার নেই। তবে অনেক ছাত্রছাত্রী নিশ্চয়ই সংগ্রহ ও সংকলন করেছেন। মানস বলেছিল তবলায় জ্ঞানপ্রকাশের অজস্র সৃজন সংগ্রহ করে বই লিখছে - তাতে রম্যগীতির সংকলনও আছে। বইটা প্রকাশিত হয়েছিল কিনা জানি না। আমি দেখিনি। রম্যগীতি সৃষ্টি বিষয়ে তাঁর খুবই মমতা ছিল।

    সর্বভারতীয় অভিজ্ঞতায় শিক্ষাদানের প্রস্তুতি ও পরিণতি :

    পূ: কলকাতায় ১৯৩১ থেকে তবলা ও গান শিখতে শুরু করলেন। তারপর ১৯৩৪-এ এলাহাবাদ conference-এ গান শুনে classical music সম্বন্ধে আপনার ধারণা পালটে গেল। It was a turning point in my life বলেছিলেন, বলেছিলেন এদের গান আরও logical! গানের ব্যাপারে logicalটা কী ব্যাখা?

    জ্ঞা: ১৯৩৪-এ এলাহাবাদে গিয়ে গান শুনে আমার চক্ষুস্থির হয়ে গেল। দেখলাম এদের ব্যাপারটাই আলাদা। নাসিরুদ্দীন কে শুনলাম। অপূর্ব! কী control গলার ওপর! নাসিরুদ্দীন সংস্কৃত শিখেছিলেন ভাল করে। ভাল উচ্চারণে ব্যাখ্যা করতেন। তাঁর গানে ভাষা, ভাব, সুর, লয়, গায়কীর মধ্যে কী সামঞ্জস্য বিধান! Logical কথাটার অর্থ হল এই সঙ্গতিপূর্ণ treatment-এ প্রকাশ! Logical অর্থাৎ সঙ্গত। এটা বাঙালীদের মধ্যে হয়নি।

    পূ: কেন হয়নি বলে আপনার মনে হয়? বলেছিলেন সঙ্গীতের পণ্ডিতদের সঙ্গে সাহিত্যিকদের যোগাযোগ ছিল না বলে ক্ষতি হয়েছে। তাছাড়া এখান ওখান থেকে কিছু নিয়ে গড়ে উঠেছে বলে কি? বাঙালীদের তো কোনও নিজস্ব classical গানের tradition ছিল না!

    জ্ঞা: কথাটা যখন উঠেছে - এ কথাটা আমাকে আগে কেউ জিজ্ঞেস করেনি আর আমার বলবার অবকাশ হয়নি। এখনও মনে আছে নাসিরুদ্দীন সংস্কৃত শিখেছিলেন ভাল করে - ভাল উচ্চারণে ব্যাখ্যা করতেন। হিন্দীতে গাইতেন। তার মধ্যে একটু উর্দু না হলে হিন্দুস্থানী হয় না, ভাষাটা ছিল উর্দু, হিন্দী আর সংস্কৃত মিশিয়ে। ভাষার শুদ্ধ উচ্চারণ দরকার।

    পূ: ভাষা-ভাব ইত্যাদি মিলে সঙ্গতিপূর্ণ বিকাশ বাঙালীদের মধ্যে হয়নি কেন?

    জ্ঞা: বাঙালীরা বিকৃত করেছে।

    পূ: তা কেন হল?

    জ্ঞা: সুনীতিবাবু যদি গান করতেন, হত না। সাহিত্যিকদের সঙ্গে সঙ্গীতের ঘনিষ্ঠতা ছিল না।

    পূ: নাসিরুদ্দীন মুসলমান আমলে কী করে সংস্কৃত শিখলেন এবং তার ব্যাপারটা বুঝে প্রয়োগ করলেন?

    জ্ঞা: নাসিরুদ্দীন ইন্দোরের ছিলেন। ওইখানে বাস করতেন। আমীর খাঁও ইন্দোরের। নাসিরুদ্দীনের ছেলে আমিনুদ্দীন এখনও জীবিত। সে সংস্কৃত শিখেছে কিনা জানিনা তার দাদা শিখেছিলেন। মুসলমান মানে ইসলাম ধর্ম নিয়ে মারামারি নয়। ওদের একটা গুণ ছিল। ওরা খুব artistic। হিন্দুরাও ছিল! কিন্তু হিন্দু architecture আর মুসলমান architecture-এর তফাৎ মন্দির আর তাজমহল দেখলে বোঝা যায়। যেমন মহাদেব বললেই তার চেহারা বেশ হৃষ্টপুষ্ট ভুঁড়িওয়ালা না হলে না - তাতে একটা হিন্দুহিন্দু ভাব আছে। মুসলমানদের পছন্দটা খুব fineryর দিকে। হিন্দুরা gross। গানেও যেমন টপ্পা - আমাদের হল নিধুবাবুর - বে এ এ এ এ এ। slow! দ্রুত হবে না - সূক্ষ্ম হবে না। দ্রুততার দিকে - fast movement - finery মুসলমানদের। মুসলমানরা ধ্রুপদ থেকে খেয়াল, ঠুংরী টপ্পায় চলে গেল কারণ fineryর দিকে ওদের art।

    পূ: আপনি বলছেন হিন্দুরা একটা স্থির অবস্থায় ছিল এরা আরও evolve করে নিয়ে গেল?

    জ্ঞা: Evolved কোনটা বলা মুস্কিল। ওদের প্রগতি-গতিশীলতা বেশী। আমাদের যতটা slow হবে - slowটা আমরা বুঝতে পারি হিন্দুদের মধ্যে বোধগম্য সেটাই।

    পূ: আপনি বলছিলেন এখনকার দিনে বাঙালী ছেলেমেয়েদের সঙ্গীতে যে রকম আগ্রহ - যে রকম ভালভাবে শিখতে পারছে রবীন্দ্রনাথের সময় - আপনাদেরও সময়ে তেমন ছিল না। Changed for the better! বলেছিলেন - এলাহাবাদে নাসিরুদ্দীন, আবদুল করিম, এনায়েৎ খাঁ শুনে যে বাঙালীদের মধ্যে তেমন হয়নি। এই বোধের ভিত্তিতে আপনি নিজেকে নতুন ভাবে creative পথে নিয়ে যেতে কি বাধা পেয়েছিলেন?

    জ্ঞা: বাধা আমি মানব কেন?

    পূ: আপনার তো খুব enquiring mind। আমি বলছি অন্যদের কথা - এমনি সাধারণ শিক্ষার্থীদের এগিয়ে যাবার পথে পরিবর্তনের পথে বাধা ঘটেছিল মনে হয়?

    জ্ঞা: একশো বার! এখানে যে গুরুকে পণ্ডিত বলে শ্রদ্ধা করতুম তাঁর কাছ থেকে এমন ছেলেমানুষী কথা শুনতে হয়েছে যে শ্রদ্ধা থাকা মুস্কিল - আরও পণ্ডিতদের কাছেও তেমন শুনেছি। এঁদের চেয়ে সত্যেন বোসের সঙ্গীতবোধের বিষয়ে বেশী শ্রদ্ধা ছিল। এমন সব কথা শুনতে হয়েছে যে মনে দুঃখ পেয়েছি। কিন্তু নিজের বিচার ছাড়িনি। এমনও ঘটেছে - সঙ্গীতের পণ্ডিত গাইছেন - সঙ্গে আমি হারমোনিয়ম বাজাচ্ছি। তানপুরা মেলাচ্ছেন - এক শ্রুতি কম। পণ্ডিত হলেই তো হবে না - যথাযথভাবে সঙ্গীত প্রকাশ করতে হবে।

    পূ: ক্রিয়াসিদ্ধ বিদ্যা!

    জ্ঞা: আমার নিজেকে correct করে নিতে হয়েছে।

    পূ: বিষ্ণুপুর ঘরানা কি একটা উল্লেখযোগ্য ঘরানা বলে মনে করেন?

    জ্ঞা: উল্লেখযোগ্য ছিল ঠাকুরবাড়িতে। সেখানে ইন্দোর, রাজস্থানের প্রবেশ ঘটেনি। এখন obsolete হয়ে গেছে। অমিয় আসে -- আমার কাছ থেকে আমার খেয়ালের বন্দিশ কিছু নিয়েছে। কিন্তু তার বাড়িতে তা প্রকাশ করতে পারে না।

    ১৯৯২-তে এই পর্যন্ত আলোচনা হয়েছিল। তার পরে আর দেখা হয়নি। অনেক কিছু জানার ইচ্ছে ছিল। হল না। অমিয় বন্দ্যোপাধ্যায় পরবর্তীকালে একদিন অনুষ্ঠান করলেন। শুরুতেই বললেন আমি কিন্তু বিষ্ণুপুর ঘরানার গান করব না। ভাল গাইলেন। আমার সমবয়সী, বন্ধুত্ব হয়েছে। তখন অবশ্য তাঁর পিতা সত্যকিঙ্কর জীবিত ছিলেন না। হয়তো পরবর্তীকালে গবেষক, গায়করা এই ঘরানার সম্বন্ধে জানবেন - কিছুটা পুনরুদ্ধার করতেও পারেন।

    জ্ঞানবাবু নিজেকে বিশ্লেষণ করে নতুন অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে শিক্ষা পদ্ধতি গড়ে তুলে কত গুণী ছাত্রছাত্রী তৈরী করেছেন আমরণ। সময়োপযোগী শিক্ষাদান ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন। শিক্ষার্থীদের তৈরী করে তাঁর ঘনিষ্ঠ অন্য গুণী অবাঙালী মুসলমান ওস্তাদের কাছে শিক্ষালাভ করতে প্রেরণা দিয়েছেন। তাঁর হাতে সারা ভারতে সম্মানিত কয়েকজন বিশিষ্ট বাঙালী ও সংগীতশিল্পী তৈরী হয়েছে - তাঁর কাছে শিখে গোলাম আলি খাঁর কাছে শিখেছেন। তাঁর এই উদার নীতিও কিন্তু অন্যান্য বাঙালী গুরুরা বলেন না। গুরু পরিবর্তন করলে বিরক্ত হন। তবলায় অনেকে তৈরী হয়েছেন শুধু তাঁর কাছে শিখেই সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছেন। গানে প্রসূন ব্যানার্জী, অরুণ ভাদুড়ী, অজয় চক্রবর্তী - আরও অন্যান্য অনেকে। তাঁর ছাত্রী সুকণ্ঠী সুগায়িকা প্রভাতী মুখার্জী আমাদের স্কুলের ছাত্রী ছিল আমাদের বাড়ির কাছে থাকত। সে পরবর্তীকালে গোলাম আলির কাছে শিখেছিল। তার বাড়িতে গোলাম আলির শেষ গান শুনেছি ঘরোয়া পরিবেশে। কিন্তু তখন stroke হয়ে অসুস্থ অবস্থায় গান করলেন স্তিমিতভাবে। নিজেই বুঝেছিলেন গানের সেই সৌন্দর্য প্রকাশিত হয়নি। বললেন 'গান যৌবনের জন্য'। ছোট একটি অনভিজ্ঞ ছেলে তবলা বাজাচ্ছিল - তাকে খুব উৎসাহ দিলেন। তাঁর ব্যক্তিত্ব মধুর ছিল। আমীর খাঁ শুনেছি একজন বন্ধুকে বলেছিলেন এখন ওঁর গান গাওয়া উচিত না। তবে এই প্রজন্মের শ্রোতারা ভাবে উনি বুঝি এইরকমই গান!

    মনে পড়ল খুব অল্পবয়সে কলকাতায় গোলাম আলি খাঁর প্রথম অনুষ্ঠান শোনার স্মৃতি। ঘরভর্তি শ্রোতারাসহ এই নতুন শিল্পীর অতুলনীয় নতুন শিল্পীর গানে চমৎকৃত হয়েছিলাম। সঙ্গে কেরামৎ উল্লা খাঁ তবলা সঙ্গত করেছিলেন আর হারমোনিয়ম বাজিয়ে ছিলেন জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ - বহু অনুষ্ঠানে এই শিল্পীযুগল সঙ্গত করেছেন। নিজের অনুষ্ঠান - শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান করে সর্বদা তাঁর পরিবেশকে আনন্দে মাতিয়ে রেখেছিলেন। আমাদের তবলা ক্লাসে আমার এক নৃতাত্ত্বিক বন্ধু একটি আমেরিকান মেয়েকে নিয়ে গিয়েছিলাম। সে বলল "এই ঘরে এত আনন্দ কী করে?"

    সুর ছন্দের এই অফুরন্ত আনন্দের ফোয়ারা স্তব্ধ হল ১৯৯৭-এর ১৮ই ফেব্রুয়ারী! সৃষ্টির যে সম্ভার ভরে উঠলো তার বিস্তারের বিপুলতা দেখে মনে হয় ১৮৬১-র পঁচিশে বৈশাখ কলকাতার জোড়াসাঁকোর একটি ঘরে যা ঘটেছিল তার বিকীরণের 'কিছু ছোঁয়া' নিশ্চয়ই পৌঁছেছিল ১৯১২-র পঁচিশে বৈশাখে কলকাতার ক্রীক রোর একটি ঘরে।

    [বহু ছাত্রছাত্রী, বন্ধুবান্ধবদের কাছে তাঁর সৃষ্টির যে সব নিদর্শন ছড়িয়ে আছে তা সঙ্কলন করে, রেডিয়োতে যা আছে সংগ্রহ ও সংকলন করে "জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ" সংগ্রহশালা গড়ে তোলা একটি অত্যন্ত জরুরী কাজ।]



    অলংকরণ (Artwork) : ছবিটি 'দ্য হিন্দু' থেকে নেওয়া
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments