• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৫৫ | অক্টোবর ২০১৩ | কবিতা
    Share
  • নির্বাচিত অসমীয়া কবিতা : কমল কুমার তাঁতী
    translated from Assamese to Bengali by অমিতাভ


    ঝড়ের প্রান্তে
    সন্ধ্যা যেন গোপনে মৌনে নামে ধোঁয়ার রেখায়ঃ
    আকুল মনের মুদ্রা কেঁপে যায় গহন জলের
    গভীরে, ধীরে ধীরে, আর যেন নীরব মনে
    ছায়াগুলি নেমে যায় ঘন হয়ে নিজের মৌনে।

    কেউ নেই, কেউ আসেনাঃ মন যেন নিজের মৌনকে
    শুনে বসে। কেউ নেইঃ নামে না গহন জলে
    বাতাসের ভার। আকাশ বেয়ে পাখায় ধোঁয়া নিয়ে
    কেউ আসেনা। ভয় করে মন যেন নিজের মুদ্রাকে।

    কেমন দীঘল রাত, কেমন নীরব হাত তার
    ছায়াগুলো পায় না মানেঃ মুদ্রার কাঁপুনিগুলো
    দেয়না সন্ধান কোনো— কতোটা গহীন জলভার।
    মন যেন শোনে বসে ভয়ে ভয়ে নিজের মৌনকে,
    বাজেনা পাখার ধ্বনি, কেউ আসেনা জলের পথেঃ
    গোপন মুদ্রাই কেবল ডাকে যেন মৌন ঝড়কে।

    ।। শীত ।।

    কণ্ঠ তোমার রুদ্ধ হয়
    নিস্তরঙ্গ জলাশয়ের বরফে।

    সকরুণ পোকা-মাকড়গুলি
    তোমার শরীরে গর্ত খুঁড়ে ঢুকে পড়ে
    আর সেখান থেকে আশ্রয় নেয়
    তোমার গর্ভে।

    নিরন্ন হিমেল বাতাসের রাতে ফুটপাথের ক্ষুরধারে
    বিষ-জর্জর তোমার শরীর

    প্রাচীন রিক্ত গাছগুলির তলে তলে
    পথের মর্মর ধ্বনি তুলে আমি যাই—
    আর আমার দুহাতে ধরি গিয়ে
    ধূসর পাহাড়ে দৃশ্যমান
    তোমার নীলাভ মুখ

    হে অটল বেদনার সঙ্গিনী!

    ।। আঁধারের হাত ।।

    তোমার হাতের শিহরণ
    রাতে এস্ফ্যাল্টের রাস্তায়
    বিচ্ছিন্ন গানের কলিতে
    শীতের মতো আসে

    তোমার হাতের শিহরণ
    একটুকরো চামড়া কামড়ে ধরা কুকুরের
    দাঁতে

    তোমার হাতে
    হলদে পাতাগুলির কাঁপুনি
    বাতাসে আয়না ভাঙার শব্দ
    তোমার হাতে

    সমুদ্রের হিংস্র নীলাভ স্বরগুলি
    তোমার হাতে ভর দিয়ে নামে
    আর আমার শরীর ছাপিয়ে যায়

    কাঁটা তারে ঘেরা
    বহু মাইলের নির্জনতায়
    শুধুই হাওয়ার
    শুধুই হাওয়ার

    ।। শব্দ ।।

    জলরাশিতে
    তোমার হাতে ফোঁটে
    সাপের নিঃশ্বাসের মধ্যে
    অটল নিদ্রার পদ্ম

    চাদের আলো জলে
    কাঁটা তারের ওপরে

    ।। হ্রদ ।।

    এখনো ঘুরে নাকি ওগো
    সেইসব প্রেতায়িত কংকালের ছায়া
    প্রান্তরের বিশাল বুকে?

    তাদের আর্ত স্বরগুলি
    এখনও ভাঙে নাকি
    প্রান্তরের আঁধার নীরবতা?

    সমগ্র চেতনা জুড়ে তাদের ধুমল ছায়ায়
    রচলে যে ব্যুহ—
    সে যে হায় বিশাল আকাশ!

    বিম্বিত তারই রূপ এ হ্রদের বুকে?

    হ্রদের পারের এই দৃশ্যপট
    সুগোপন স্বপ্ন যেন চিরবসন্তের—
    অন্বিষ্ট যে দীর্ঘ জীবনের।
    দিকে দিকে সেথা যেন যৌবনের মোহিনী মুদ্রায়
    নিবিড় শ্যামল বনরাজি।

    এখানে সমাপ্ত যাত্রা সুদীর্ঘ পথেরঃ
    ওই পারে আর কেউ নেই।

    বহু কংকালের ছায়া পার হয়ে সন্ধ্যার প্রান্তে
    দেখলাম এই হ্রদ,
    এই শ্যামলিমা।
    হ্রদের বুকের এই বিকশিত ফুলের সম্ভার;
    হ্রদের বুকের এই কৃষ্ণনীল শীতল সলিল।
    নামিছে সন্ধ্যার মায়া হ্রদের বুকে!
    ক্রমে উঠছে মঞ্চে যেন যবনিকাঃ

    রঙিন বেশে কোনো নটী যেন
    নিসর্গে বিলীন সূর্যাস্ত—
    নাটকীয় ভঙ্গিমায় ঢালছে যে মৃত্যুর গরল।
    কুয়াশার নির্বাক অশ্ব
    ঘোষিছে আতংকের কাল।
    জ্বলছে আকাশে
    মৃত্যুহীন অসিধারী নির্মম কংকাল।

    দেখছি তারই রূপ হ্রদের বুকে?

    শ্যামল গাছের শোভা হ্রদের বুকে জেনে
    ভুলে রেখে মত্ত প্রবাহের কলোচ্ছাস
    এসেছিল অতীতে আমার মতো আরো বহু লোক

    সমাপ্ত এখানে যাত্রা সুদীর্ঘ পথের;
    তার পর আর কিছু নেইঃ
    দিকে দিকে সমাকীর্ণ
    বসন্তের বিপুল বৈভব।

    তবুও মন্ত্রমুগ্ধ চন্দ্রকিরণে
    দেখেছি কি অভিনয়
    শান্ত জলে?
    তাহলে কি নিজেরই সম্মোহনের মায়া
    রচলো যে নিজেরই অনুগামী কংকালের
    ছায়ার ভয়ে?

    শুনি হ্রদের পারে
    রাতের হাওয়ায় নিয়ে আসা
    শূন্যতার কণ্ঠস্বর
    হিংস্র অসহায়।
    পদধ্বনি শুনি যেন পথের বুকেতে
    কংকাল মূর্তির—
    নাহলে আখ্যান-প্রসিদ্ধ সেই জ্যেষ্ঠ পাণ্ডবের;
    নিঃসঙ্গ সুদূর যার স্বর্গযাত্রা
    সুদীর্ঘ শীতেঃ
    পশ্চাতে সহস্র কংকাল।

    ধোঁয়ার কুণ্ডলী আর ছায়ার মাঝেতে
    কে সে আসছে এখানে?

    শুনি যেন হ্রদের শীতল সলিলে
    সুদীর্ঘ শীতের শিহরণ।

    স্বপ্নেও উঠছে বেজে হিংস্র আর্তস্বর
    যেন কোনো শ্বাপদের
    অসহায় কণ্ঠস্বর নৈশ আঁধারেঃ

    সেই-ই অন্তিম অভিনয়
    হ্রদের পারে

    হ্রদের বুকের এই শীতল সলিল,
    দিকে দিকে স্বপ্নের ঘর শ্যামলিমা।
    তারপর আর কিছু নেইঃ
    এখানেই পৃথিবীর সীমা।

    ।। সোনালী জাহাজ ।।

    যখন আঁধার কেটে ভেসে আসে বন্দরে সোনালী জাহাজ
    ভরে ওঠে সুদূরের সোনালী শস্যে এই নীল ভাণ্ডার;
    দুখের নাবিকরা দেখা দেয় — সোনালী যেন সে নীল কাপড়
    দুঃখের বণিককে নিয়ে সোনালীতে ডুবে যায় নিকষ আঁধার!

    যে জাহাজ আলোয় ভাসে — তার স্বর্ণপ্রভ পালের জ্যোতি
    আমার রক্তের রঙ উচ্ছ্বল কাঁপন তোলে সূর্যের মুখে।
    যে বনজ আনে সোনালী জাহাজে সেই প্লাবন-ভূমির
    ক্লেদের নির্যাস ভরা শস্যরাশি! নীল যেথা ডুবে সোনালীতে?

    ।। স্বচ্ছতা ।।

    জলরাশিতে মন ডুব দিল
    আর পেল অতল বেদনার
    স্বচ্ছতার সুর।

    নলখাগড়ার মাঝে সেখানে আঁকা আছে
    গুঞ্জিত রেখায়
    একটি মুখের স্বচ্ছ বেদনা।

    তাতে দু'একটা পচে যাওয়া ফল।

    সেই গভীরতায় সকলই হল স্বচ্ছ;
    সকলেই হল নিরূপিত—
    হাতের জোর, আলোর ঢেউ, আঁধারের গতি
    ঝড়ের ভয় আর নেইঃ
    কোনো উন্মাদ আলোড়নেও হারায় না
    সেই স্বচ্ছতার সুর।


    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments