• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৫৫ | অক্টোবর ২০১৩ | গল্প
    Share
  • রয়্যাল বেঙ্গল ড্যান্স : দিলীপ ঘোষ


    সুমনের মনে হচ্ছে যেন অনেকক্ষণ পর ঘুমটা ভাঙলো। কিন্তু সামনে সবকিছু একদম ঝাপসা লাগছে, দূর থেকে কিছু আওয়াজ ভেসে আসছে, কিন্তু কিছুই ঠাহর করতে পারছে না। মাথায় যেন কেউ পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে আর চোখের সামনেটা যেন ঘষা কাঁচে ঢাকা। পেছনে ঝাপসা কিছু নড়ছে মনে হচ্ছে, কিন্তু কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। শরীরের নিম্নাংশ থেকে একটা তীব্র যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়ছে সারা শরীরে, কিন্তু কোনও আওয়াজ বেরোচ্ছে না মুখ থেকে । হাত, পা কিছুই নাড়াতে পারছে না, মনে হচ্ছে শরীরের কোনও অংশই যেন তার আর দখলে নেই। কিন্তু ও এখন কোথায়, আর এখানে এলোই বা কি করে? মনে করার চেষ্টা করে অনেক, কিন্তু কিছুই মনে আসছে না।

    ............ এবার মনে হচ্ছে ঝাপসা ভাবটা আস্তে আস্তে কেটে গিয়ে চোখটা পরিষ্কার হয়ে আসছে। হ্যাঁ, ওই তো পায়ের কাছে দাদা আর বৌদি দাঁড়িয়ে কি যেন কথা বলছে। পিছন দিকে......, হ্যাঁ মনে হচ্ছে বাবা মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে। ডান দিকে আর বাঁ দিকে অমলকাকু, অশোক, শিবু’দা, ছোটমামা, সবাই এসেছে। দেখে মনে হচ্ছে ও হাসপাতালে শুয়ে, কিন্তু কেন? কি হয়েছে ওর? আর কেনই বা এত অসহ্য যন্ত্রণা সারা শরীরে?

    আচ্ছা, সবাই এসেছে কিন্তু মা নেই কেন? হঠাৎ মনে হল কে যেন মাথায় হাত বোলাচ্ছে। অতি কষ্টে চোখটা একটু ঘুরিয়ে দেখে মা পাশে বসে বলছে “কেমন আছিস বাবা? খুব কষ্ট হচ্ছে? ঠিক কোথায় যন্ত্রণা হচ্ছে?” সুমন কোনোমতে ইশারায় বোঝায় যে অসহ্য যন্ত্রণা, তবে সেটা ঠিক কোথা থেকে হচ্ছে সেটা বুঝতে পারছে না। অতিকষ্টে সুমন অস্ফুট স্বরে জিজ্ঞেস করে “মা, আমার কি হয়েছে? আমি ভাল হয়ে যাব তো? আমি ফাইনালে যাব তো?” শুনে মা হঠাৎ কেঁদে উঠে দৌড়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।

    ইতিমধ্যে দাদা একজন নার্সকে ডেকে এনে বলে পেশেণ্টের যন্ত্রণা খুব বেশি হচ্ছে, কিছু ব্যবস্থা করার জন্য। শোনামাত্র নার্স এগিয়ে এসে একটা ইনজেকশন ফুটিয়ে দেয়, আর বলতে শুরু করে “ব্যথা হবে না, শরীর থেকে অত বড় একটা অংশ কেটে বাদ পড়লো – কষ্ট হবে না? পায়ের ইনস্যুরেন্স করিয়েছিলেন?” দাদা অবাক হয়ে বলে ওঠে “তাই – অমন করা যায় নাকি? না, আমরা তো কিছু করিনি - কেউ কখনো বলেনি আমাদের।” নার্স খুব রেগে বলে ওঠে “বলবে কেন? ওদের আর কি? নিজেদের নামের জন্য ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলোকে যা খুশি করিয়ে যাচ্ছে, আর সাথে মোটামোটা টাকা কামাচ্ছে। আপনাদেরও বলিহারি, লেখাপড়ার পাঠ সব গোল্লায় দিয়ে পাগলের মতো ছুটছেন এইসবের পেছনে। একবারও এদের ভবিষ্যৎ কি হবে ভেবে দেখেছেন? কি হবে বড় হয়ে – নাচিয়ে? প্রতি বছর টিভি চ্যানেলগুলো এমন কয়েকশো নাচিয়ে, গাইয়ে তৈরি করছে। এরা সবাই পারবে এটাকে পেশা করে সারা জীবন চলতে? তাছাড়া, এটা কি কোনও নাচ নাকি? আলো ঝলমলে মঞ্চে কিছু বিকৃতমনস্ক পোশাক পরে লাফালাফি, নয়তো দড়ি ধরে হনুমানের মত লম্ফঝম্ফ করা মানেই কি নাচ? এমনকি নাচের সাথে সুন্দর গানগুলোকে পর্যন্ত এরা বিকৃত করে দিচ্ছে। আর সাথে ওইসব উঠতি কোরিওগ্রাফারদের বড় বড় পণ্ডিতি মতামত শুনলে মনে হয় হঠাৎ এইসব দিগ্‌গজদের আবির্ভাব হল কোথা থেকে? অর্থ আর যশের জন্য এরা ছেলেমেয়েগুলোকে নির্বিকারে একের পর এক চরম বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।"

    দাদা এতক্ষণ চুপ করে থাকার পর আস্তে করে বলে ওঠে “আসলে, আমাদের ভাগ্যটাই খারাপ, নয়তো সুমন এত ভাল নাচছিল যে ওর ফাইনালে যাওয়া প্রায় নিশ্চিত ছিল।” নার্স ধমকে উঠে বলে “চুপ করুন। শুধু সুমন নয়, ওর সাথে আপনারাও আনন্দে নাচছিলেন আর সেই জন্যই এত বড় বিপদটা ঘটে গেল। একবারও বলেছিলেন আপনাদের ওই নাচের মাষ্টারকে যে এমন বিপদজনক নাচ না করানোর জন্য? বলবেন কেন – আসলে আপনারাও তো চান যে আপনাদের ছেলে, মেয়ে, ভাই, বোন সব হঠাৎ করে সেলেব্রিটি হয়ে যাক, আর সাথে চিচিং ফাঁকের মত সমাজে আপনাদের নাম, খ্যাতি, অর্থের ভাণ্ডার উন্মুক্ত হয়ে যাক। আপনারা কি ভাবেন সব কিছুই এত সোজা যে দু-তিন মাস একটু নাচন-কোঁদন করলেই বিখ্যাত নাচিয়ে হয়ে যাবে? তাই যদি হত, তাহলে আমাদের উদয়শংকর বা বিরজু মহারাজদের মত মানুষদের সারাজীবন সাধনা করতে হত না।

    বাবা হঠাৎ কেঁদে বলে ওঠেন “আমি কিন্তু প্রথম থেকেই এইসবের বিরুদ্ধে ছিলাম, কিন্তু আমার কথা শোনার প্রয়োজন মনে করে নি কেউ। করবেই বা কেন – সংসারে রিটায়ার্ড লোকের কথার কি কোনও মূল্য থাকে?” বৌদি একটু বিরক্ত হয়ে বলে ওঠে “আঃ বাবা, এই সব কথাগুলো এখন না বললে চলছে না?”

    ব্যথাটা এখন একটু কমেছে মনে হচ্ছে, হয়তো ইঞ্জেকশনের ফল। এতক্ষণ সুমন কেমন যেন ঘোরের মধ্যে নার্সের কথা শুনছিল, কিন্তু মাথায় কিছু ঢোকেনি। বাবার কান্না দেখে হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পায়। খেয়াল হয় নার্স কি যেন পা কেটে বাদ দেবার কথা বলছিল, তাহলে কি ওর ...............? সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করে পা দুটোকে নাড়িয়ে দেখতে। বাঁ পা-টা মনে হয় একটু নড়ছে, কিন্তু ডান পা-টা তো নড়ছে বলে মনে হয় না। এবার প্রাণপণে আবার চেষ্টা করে ডান পা-টা নাড়ানোর জন্য। কিন্তু না, মনে হচ্ছে না ওটা নড়ছে বলে। তবে কি সত্যিই ওর ডান পা-টা নেই? বুক ফেটে একটা চাপা কান্না বেরিয়ে আসে সুমনের, মুখ থেকে কোনও আওয়াজ বেরোয় না, নিমেষে চোখ দুটো ভরে যায় জলে।

    ~~~~ ০ ~~~~

    আজ থেকে প্রায় আড়াই বছর আগে শুরু হয় সুমনের এই নাচের নেশা। ছোট থেকেই ও খুব চঞ্চল প্রকৃতির। যতক্ষণ ঘরে থাকে, হয় এপাশ থেকে ওপাশ দাপিয়ে বেড়ায় নয়তো লাফালাফি, নাচানাচি, অঙ্গভঙ্গি ইত্যাদি চলতে থাকে – কোনও ক্লান্তি নেই। ওর এইরকম কার্যকলাপ দেখে ওর বাবা এতটাই বিরক্ত হতেন যে মাঝে মাঝে চেঁচিয়ে উঠতেন “কি হচ্ছেটা কি সুমন? সারাটা দিন শুধু খেলা আর হুল্লোড়বাজি – লেখাপড়া কি সব গোল্লায় গেল? এভাবে চললে তো কিছুদিনের মধ্যে স্কুল থেকে দূর করে দেবে।” যখন উনি খুব রেগে যেতেন, এগিয়ে গিয়ে সজোরে বসিয়ে দিতেন দু’ঘা চড় ওর পিঠে, আর তারপর একটা কান পাকিয়ে ধরে হিড়হিড় করে টেনে এনে পড়ার টেবিলে বসিয়ে বলতেন এগুলো শেষ না করা পর্যন্ত সমস্ত খেলা এবং খাওয়া সব বন্ধ। যতক্ষণ না সুমন সমস্ত কাজ শেষ করছে, ওর বাবা পায়চারি করতেন ওর চারপাশে আর একটা ভুল করলে নিস্তার নেই, এমন বেদম মার শুরু হয়ে যেত যে ওর মা সহ্য না করতে পেরে চলে যেতেন রান্না ঘরে।

    তখন সবে সুমন ক্লাস সিক্সে উঠেছে। একদিন বাড়ি ফিরে মা’কে জড়িয়ে ধরে বলে যে সে নাচ শিখবে। শুনে তো মার চক্ষু চড়ক গাছ "কি বলছিস? নাচ শিখবি মানে? পড়াশোনা করবি না?” সুমন বলে “পড়াশোনা তো করছি, সাথে নাচও শিখব। আমাদের ক্লাসের অঞ্জন শিখছে। এরমধ্যে ও কয়েকটা প্রতিযোগিতায় পুরস্কারও পেয়েছে, আর এবার ও টিভিতে রয়্যাল বেঙ্গল ডান্স প্রতিযোগিতায় প্রথম পঞ্চাশ জনে ঢুকে গেছে। রেমন্ড স্যর বলেছে যে ঠিকমতো প্র্যাকটিস করলে ও অনায়াসে আরবিডি-তে প্রথম তিন জনে চলে যাবে। আজকাল অঞ্জন দিনে প্রায় আট ঘণ্টা নাচ প্র্যাকটিস করে। ওর বাবা ও মা বলে দিয়েছে যে এই মুহূর্তে ওর সামনে প্রধান লক্ষ্য হল রয়্যাল বেঙ্গল ডান্স চ্যাম্পিয়ন হওয়া – পড়াশোনা, পরীক্ষা ইত্যাদি নিয়ে এখন বেশি ভাবার দরকার নেই। অঞ্জন বলছিল যে একবার চ্যাম্পিয়ন হতে পারলে আর কোনও চিন্তা নেই – টিভিতে প্রোগ্রাম, সিনেমায় চান্স, দেশে-বিদেশে হাজারো প্রোগ্রাম, সাথে বিজ্ঞাপন, কাগজে, ম্যাগাজিনে ছবি ইত্যাদি। কি হবে এতো খেটে বছরের পর বছর পড়াশোনা করে? আজ টিফিনের সময় আমার একটু নাচ দেখে ও বলল যে আমার মধ্যেও ক্ষমতা আছে, আর রেমন্ড স্যরের কাছে গেলে উনি এমন তৈরি করে দেবেন যে আমিও খুব শিগগির রয়্যাল বেঙ্গল ডান্সে চান্স পেয়ে যাব। ও আমায় কথা দিয়েছে যে আমাকে রেমন্ড স্যরকে আমার হয়ে বলে দেবে। তুমি কিন্তু না বললে চলবে না।”

    এই প্রথম সুমন তার মায়ের কাছে কোনও আবদার করল, কিন্তু ছোট ছেলের এই আবদার কি করে পূরণ হবে তা ভেবে পান না ওর মা। একে তো নাচের কথা শুনলে ওর বাবা প্রচণ্ড রেগে যাবেন, তারপর এসবের জন্য তো খরচাও অনেক। সবে তিন মাস আগে সুমনের বাবাকে অফিস থেকে স্বেচ্ছাবসর দিয়েছে, এই অবস্থায় উনিই বা করে টাকার যোগান দেবেন। কিন্তু এটাও তো ঠিক যে সুমন তো আর ওর দাদার মত পড়াশোনায় ভাল নয় – এবার তো অতিকষ্টে পাশ করেছে। ওর বাবা বলে দিয়েছেন যে সামনে বছর থেকে বাড়িতে আর কোনও মাস্টারমশাই রাখা যাবে না, কারণ এতো খরচ টানা সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে লেখাপড়া নিয়ে বেশি চেষ্টা না করে ওর যখন আগ্রহ নাচে, সেটাই করা ভাল।

    গত তিনদিন ভেবে কোনও কূলকিনারা করে উঠতে পারেননি সুমনের মা। এদিকে সুমন খালি মাকে জিজ্ঞেস করে চলেছে কবে রেমন্ড স্যরের কাছে যাওয়া হবে। কোনও উপায় নেই দেখে শেষপর্যন্ত সুমনের মা বড় ছেলে সমরকে কথাটা পেড়ে বসেন। যদিও সমরের তেমন একটা মত ছিল না, কিন্তু বউ রত্নার সাথে কথা বলে শেষপর্যন্ত রাজী হয়ে যায় সমর। বউমার অবশ্য সিনেমা, অভিনয়, নাচ ইত্যাদিতে ভীষণ আগ্রহ – সারাক্ষণ টিভিতে পোকার মত লেগে থাকে। টিভিতে রয়্যাল বেঙ্গল ড্যান্স হলে তো কথাই নেই। রেমন্ড স্যরের (আসল নাম রমেন দাস) নাম শোনামাত্র রত্না উল্লসিত হয়ে ওঠে বলে “ঊঃ কি মজা, সুমন রেমন্ড স্যরের কাছে নাচ শিখবে? আমিও সুমনের সাথে গিয়ে দেখব রেমন্ড কেমন করে নাচ শেখান। কতরকম নাচ জানেন উনি। যেমন স্মার্ট, তেমনি দারুণ কমেন্ট করেন।”

    সমর শেষপর্যন্ত রাজি হয়েছে সুমনকে নাচের ক্লাসে ভর্তি করতে, তবে বলেছে যে তেমন কিছু করে দেখাতে পারলে তবেই সে নাচের খরচ যোগাবে, নয়তো ফালতু টাকা খরচ করবে না। ঠিক হয়েছে আগামী শনিবার ওরা সুমনকে রেমন্ড স্যরের ক্লাসে ভর্তি করবে।

    সমর আর রত্না সুমনকে নিয়ে এসেছে ‘রেমন্ড ড্যান্স অ্যাকাডেমিতে’। সমর তো দেখে অবাক, এটা কি নাচের স্কুল না ছাতুবাবুর বাজার। বাড়ির একতলার একটা ঘরে চলছে নাচের ক্লাস, আর সামনের ছোট জায়গাটায় ভিড়ে ঠাসাঠাসি। বাড়ির বাইরে রাস্তায় বহু মানুষের ভিড়। কিছু না কিছু আলোচনায় ব্যস্ত সবাই।দেখে বুঝতে অসুবিধে হয় না সমরের যে এরা সকলেই তাদের ছেলে,মেয়ে,ভাই,বোনকে নিয়ে এসেছেন নাচ শেখাতে এবং সবাই নাচের আলোচনায় মগ্ন – বিভিন্ন টিভি প্রোগ্রামে কে কেমন নাচলো, কার কোন স্টেপটা ভুল হয়েছে, কার কস্ট্যুমটা বেমানান ছিল ইত্যাদি। এমনকি কোন জাজ কি পোশাক পরেছিল, তা নিয়েও বিস্তর আলোচনা। তবে একটা ব্যাপারে প্রায় সবাই প্রচণ্ড তর্ক করে চলেছে, সেটা হল মার্কস দেওয়া নিয়ে – “অমুক এতো ভাল নেচে কেন মাত্র সাত পেল, আর ও এতো ভুল করা সত্ত্বেও কি করে আট পায়” ইত্যাদি।

    আশপাশে ভিড়ে ঠাসাঠাসি অভিভাবকদের দেখে আর তাদের আলোচনা শুনে সমর কেমন যেন হতভম্ব হয়ে যায়। নাচ নিয়ে এতো মানুষ যে এতো চিন্তিত এবং উদ্বিগ্ন হতে পারে, তা দেখে সমর বেশ আশ্চর্য হয়ে যায় আর ভাবে তবে এটাই কি তাহলে এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের জীবনের লক্ষ্য? কিন্তু তাদের অভিভাবকরা তো আগের প্রজন্মের হয়েও............।

    রত্না যেখানেই রেমন্ড স্যারকে নিয়ে কোনও আলোচনা শুনছে, সেখানেই গিয়ে হাজির হচ্ছে, আর ওদের সাথে তাল মিলিয়ে কথা বলে চলেছে। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক অপেক্ষার পর রেমন্ড স্যর বেরিয়ে আসেন ক্লাসের বাইরে, আর সাথে সাথে প্রায় সব বাবা, মায়েরা তাকে ঘিরে ধরে শুরু করে দেয় অসংখ্য প্রশ্ন “স্যার, দিব্যা আজ জাম্পটা ঠিকমত পেরেছে”, “স্যার, অভির লকিংটার কিছু উন্নতি হল?”, “স্যার, আপনি কি অয়নের কোনও স্পেশাল ক্লাস নেবেন?”, “স্যার, দিনে ঠিক কত ঘণ্টা প্র্যাকটিস করা উচিত সুমির?”, “স্যার, ঋজু প্রথম আঠারো জনে থাকবে তো, কারণ ওর ঠাকুমার ভীষণ শখ ওকে টিভিতে অন্তত একবার দেখার।”, “স্যার, রমিতা হিল টার্নটা পারছে, আর ফ্রি স্পিনটা?”, “ঋজু মুন-ওয়াকটা এখন কেমন করছে স্যার?”, “রাহুলের ট্যাপ ড্যান্স ভীষণ পছন্দ, তবে হিপ-হপটাও ভালোবাসে। কোন নাচটা ওর পক্ষে ভালো হবে স্যার?”, “মন্দিরা গত দু’মাস ধরে দুপুরে না খেয়ে প্রায় ৬ কিলো ওজন কমিয়েছে, এবার পারবে তো ঠিক মত নাচতে? আর নিশ্চয় ওকে লিফট করতে ওর পার্টনারের অসুবিধে হবে না?”, “আনন্দের ইংলিশ টিউশনটা বন্ধ করে দিলাম, যাতে ও আরও বেশি সময় নাচ প্র্যাকটিস করতে পারে। আপনি যদি বলেন, অঙ্কের টিউশনটাও বন্ধ করে দেব। একটু দেখবেন স্যার ও যেন এবার আর-বি-ডিতে চান্স পায়।”, “স্যার,............”

    সমর এতক্ষণ তাকিয়েছিল রেমন্ড স্যারের দিকে। পরনে একটা কালো জামা, তার প্রায় সব কটা বোতামই খোলা, আর তার ভিতর থেকে দেখা যাচ্ছে তিনটে বিভিন্ন রঙের হার – কি করে যে ওইসব চেনের ফাঁস থেকে নিজেকে রক্ষা করে ওইরকম লম্ফঝম্ফ আর ডিগবাজি নাচ করেন উনি? তার ওপর ওই রঙচটা জিন্‌সের হাতকাটা জ্যাকেটটাই বা কি করে এই গ্রীষ্মের গরমে উনি পরে আছেন তা বোঝা মুশকিল - হয়তো এই জন্যেই সারা জিন্‌সের প্যান্টটা কেটেকুটে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিয়েছেন বায়ু চলাচলের জন্য। সমরের ধারণা ছিল ঘুঙুর হচ্ছে নাচিয়েদের পোশাকের প্রধান অঙ্গ, অথচ রেমন্ড স্যার পায়ে ঘুঙুরের বদলে হাতে পরেছেন একটা মোটা বালা যার ওজন কিলোখানেক হবে, হয়তো আত্মরক্ষায় কাজে আসে। আর ওই শতচ্ছিন্ন জামাপ্যান্টের তলায় পরেছেন খুব দামি একটা জুতো - যার ফিতেগুলো ঠিকমতো বাঁধতে নিশ্চয় আধঘণ্টা সময়ের প্রয়োজন। এছাড়া মাথার বহুবর্ণের চুলের বৈচিত্র্য এবং তাদের এলোমেলো বিন্যাস পুষ্পোদ্যানের প্রতি তাঁর ভালবাসার কথাই ইঙ্গিত করে। তবে ওই একটা কানে বড় দুল পরার কারণ নিশ্চয়ই অন্যটা হারিয়ে যাওয়া ছাড়া কিছু হতে পারেনা।

    রত্না সমরের কানের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে “এই ড্রেসটা রেমন্ড স্যার গত মাসে একটা এপিসডে পরেছিলেন – ওঃ দারুণ হ্যান্ডসাম লাগছে।” সমর চেষ্টা করে এগিয়ে গিয়ে রেমন্ড স্যারের সাথে কথা বলার, কিন্তু মহিলাদের ভিড় ঠেলে এগোনোই মুশকিল। চোখে পরে স্যারের পিছনে এক ভদ্রমহিলার দিকে। বয়স অবশ্যই তিরিশের ওপর, আর পাঁচ ফুটের ওই চেহারায় ওজন সত্তরের কাছাকাছি হবে। অনেকক্ষণ চেষ্টা চালানোর শেষে উনি পাশের মহিলাকে কনুইয়ের ধাক্কায় সরিয়ে সোজা স্যারের সামনে হাজির এবং প্রশ্ন করে ওঠেন “শুনলাম এবার নাকি টিভিতে ‘ডান্স ঘরণী ডান্স’ শুরু হবে? আমার হাবি তাই বললেন আপনার সাথে কথা বলেতে। আপনি কবে হাউস ওয়াইফদের জন্য ক্লাস শুরু করছেন?” রেমন্ড স্যার এক ঝলকে মহিলার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে বলেন “এখনও কিছু ঠিক করিনি, হলে জানাবো।” স্যারের উত্তরে খুশি না হয়ে মহিলা বলে চলেছেন “কেন স্যার এখন শুরু করছেন না ...............”

    সমর এবার অধৈর্য হয়ে রত্নার এক হাত ধরে টেনে স্যারের কাছে এগিয়ে গিয়ে জোরে বলে ওঠে “আমার ভাইকে আপনার ক্লাসে ভর্তি করার জন্য এনেছি। এই নিয়ে দু’ঘন্টার ওপর অপেক্ষা করে আছি। প্লিজ আমাদের কি করতে হবে বলুন।” পাশ থেকে রত্না বলে ওঠে “স্যার, আসলে আমরা সবাই আপনার ভীষণ ফ্যান, আপনার কোনও প্রোগ্রাম আমি মিস করি না। আর সুমনেরও নাচে ভীষণ আগ্রহ। মনে হয় ও ভালই পারবে, তাই ওকে আপনার কাছে এনেছি। আমিও স্যার আপনার ভীষণ ......।” কথা শেষ করতে না দিয়ে পাশ থেকে আরেক মহিলা চেঁচিয়ে ওঠেন “কি হল কি? আমি তো সামনে ছিলাম, আর আপনি কেন পেছন থেকে এসে শুরু করে দিলেন? আগে আমার কথা শেষ হোক, তারপর আপনি যত ইচ্ছে কথা বলবেন, ন্যাকা?” মহিলা এবার হাতে ধরে থাকা ওই বছর তিনেকের ছেলেটাকে দেখিয়ে স্যারের দিকে চেয়ে বলে ওঠেন “এই যে স্যার, এর কথাই গত সপ্তাহে আপনাকে বলেছিলাম। স্যার, এবছর পুজো প্যান্ডালে ও এতো ভাল নেচেছিল যে সবাই বলেছে আপনার হাতে পড়লে ওকে আর কেউ আটকাতে পারবে না। আপনি ওকে ভর্তি করে নিন, দেখবেন ও সবাইকে তাক লাগিয়ে দেবে।” স্যার বলেন “এখন তো আমার সব ক্লাস ফুল, আপনি পরের সেশনে দেখা করবেন।” সমর আর ধৈর্য ধরতে না পেরে রত্নাকে বলে “আমি বাইরে গিয়ে দাঁড়াচ্ছি, তুমি পারলে ওনার সাথে কথা বলে এস।”

    বাড়ির সামনে চায়ের দোকানে গিয়ে ঢুকতে, অল্প বয়সী ছেলেটা এগিয়ে এসে বলে “বসুন দাদা। একটা বড় গ্লাস বানাই? রেমন্ড স্যারের কাছে এসেছেন তো – কার জন্য? মালকড়ি ছাড়তে পারবেন তো?” মালকড়ির মানে সমর ঠিক বুঝতে না পারায়, ছেলেটি বলে ওঠে “মানে টিভিতে যেতে দুই থেকে তিন মত খরচা করতে হবে – ওটাই এখন রেট। ওই যে গত বছর যে বাচ্চা মেয়েটা হেভি নেচেছিল টিভিতে, ওর দাদু আমার দোকানে আসতেন চা খেতে – উনিই তো আমাকে বলেছেন। আর শ্যামলদাও বললেন যে ওনার ছেলের জন্য এবছর দুই খরচা হয়ে গেছে, আরও প্রায় দুই খরচা আছে। তবে যাই বলুন, রেমন্ড স্যার আমাদের পাড়ার গর্ব। উনি যাকে তৈরি করে দেবেন, তার আর কোনও চিন্তা নেই। সারা জীবন নাচো আর পয়সা কামাও। আমাদের মত কি আর - সকাল থেকে উনুনে আগুন দাও, চা বানাও, লোককে চা দাও, কাপপ্লেট ধোও, আর মাসের শেষে ওই কটা টাকা, যা দিয়ে নিজের খরচ চালিয়ে বাবা,মাকে টাকা পাঠাবো কোথা থেকে?”

    রত্না আর সুমনকে বেরিয়ে আসতে দেখে, সমর এগিয়ে গিয়ে জানতে পারে যে রেমন্ড স্যার রাজি হয়েছেন সুমনকে ভর্তি করতে, তবে খরচের অঙ্কটা খুবই বড়। রত্না বলে যে এতো চিন্তার কিছু নেই, প্রয়োজন হলে ওর কিছু গয়না বিক্রি করে খরচার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। সমর অবাক হয়ে ভাবে যে কিছুদিন আগে রান্নার লোক ছাড়িয়ে দিয়েছে কিস্তিতে গয়না কিনবে বলে, তার মুখে এ আবার কি কথা?

    ~~~~ ০ ~~~~

    প্রায় দেড়-বছর হল সুমন নাচ শিখছে। ইতিমধ্যে বেশ কিছু প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে কিছু পুরস্কারও পেয়েছে। রেমন্ড স্যার সুমনের খুবই প্রশংসা করছেন - ওনার ধারণা এবছর আর-বি-ডিতে প্রথম তিনজনে অবশ্যই থাকবে সুমন। রত্না তো উচ্ছ্বসিত, অপেক্ষায় রয়েছে এবছরের আর-বি-ডি শুরু হওয়ার জন্য। ইতিমধ্যে খরচ হয়ে গেছে বহু টাকা, আর এই মাসের মধ্যে আরও দুলক্ষ টাকার দিতে হবে। প্রভিডেন্ট ফান্ড, ফিক্সড ডিপোসিট ইত্যাদি দিয়ে যোগাড় হয়েছে মাত্র এক লাখ, আর তাই সমর আর রত্না এসেছে রেমন্ড স্যারের কাছে টাকার অঙ্কটা কমানোর অনুরোধ নিয়ে। শুনে রেমন্ড স্যার বলেন “দেখুন, আমার যেমন কর্তব্য সর্বরকম ভাবে চেষ্টা করে আপনার ভাইকে চ্যাম্পিয়ন করার, তেমনি আপনাদেরও কর্তব্য তার উপযুক্ত পারিশ্রমিক দেওয়ার। আপনাদের দেওয়া এই টাকাটা কেবল আমার পারিশ্রমিক নয়, সাথে রয়েছে আরও অনেক অন্য খরচ। যেমন আমার মিউজিক ডাইরেক্টর যার কাজ নানা রকম গানের কোলাজ তৈরি করে নাচের সাথে জুড়ে দেওয়া, যেমন ধরুন একলাইন পুরনো গানের সাথে একলাইন নতুন গানের সংযোজন, ঢিমে গানকে ফার্স্ট করে দেওয়া অথবা ফার্স্ট গানকে স্লো করে দেওয়া, অথবা ধরুন সায়গল সাহেবের গানের সাথে ড্রাম বাজানো বা ঊষা উথুপের গানে বেহালা বাজানো ইত্যাদি যেগুলো একমাত্র উনিই করতে পারেন। আমার নাচের বৈশিষ্ট্য যেমন স্পেশাল মিউজিক তেমনি স্পেশাল কষ্টুম ছাড়া আমার নাচ সম্ভব নয়। তাই আমার ডিজাইনার নাচের সিকোয়েন্সের সাথে এমন মানানসই কষ্টুম তৈরি করে যেটা অন্যদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা, যেমন কখনও জামায় থাকে একটা হাত বা প্যান্টে থাকে একটা পা (অন্যটা খুব ছোট থাকে), ছেলেদের জামা হয় ব্লাউজের সাইজে আর মেয়েদের জামা হয় এতো ছোট যে শরীরের বাকি অংশটা রঙ দিয়ে এঁকে দেওয়া হয় অথবা এতো বড় যে প্যান্টের প্রয়োজন নেই, ছেলেরা পরে মেয়েদের মত পোশাক আর মেয়েরা পরে ছেলেদের মত পোশাক অথবা শরীরের অর্ধেকটা পোশাক হয় ছেলেদের মত আর বাকি অর্ধেকটা মেয়েদের মত, কখনও ছেলেরা হাফ প্যান্টের সাথে খালি গায়ে কোট পরে আর মেয়েরা শাড়ি পরে মিনি স্কারটের মত করে - আরও কত কি। আমাদের কষ্টুম ডিজাইন হচ্ছে ইউনিক, কখনও দ্বিতীয়বার ব্যবহার করা হয় না। এছাড়া আছে অন্যান্য খরচ, যেমন মঞ্চে কৃত্রিম চৌবাচ্চা অর্থাৎ সুইমিং পুল বানানো, আগুনে ঝাঁপানোর জন্য চিতা অর্থাৎ চুল্লি বানানো, ফাঁসির দড়ির মত ছাদ থেকে ঝোলার জন্য নানারকম দড়ির ব্যবস্থা, ডিগবাজি খাওয়ার জন্য কৃত্রিম সিঁড়ি, রোম্যান্টিক সিকোয়েন্সের জন্য পূর্ণিমার চাঁদ, ফুল, সরোবর এবং আরও কত কিছু। এবার নিশ্চয় বুঝতে পারছেন যে টাকার অংকটা মোটেই বেশি নয়। আপনারা যে ভাবে সম্ভব চেষ্টা করুণ টাকাটা যোগাড় করতে আর আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করবো সুমনকে অন্তত প্রথম তিনে পৌঁছে দিতে যাতে করে তৃতীয় পুরস্কারের দশ লাখ টাকাটা এসে যায়, তবে আমার লক্ষ ওকে চ্যাম্পিয়ন করার, মানে পঞ্চাশ লাখ।”

    বাড়ির সকলেই আশা করে আছে সুমন এবার আর-বি-ডিতে কিছু করে দেখাবে। রত্না তো ধরেই নিয়েছে যে এবার সুমন চ্যাম্পিয়ন হচ্ছে, ফলে ওদের সুদিন আসছে।

    শুরু হয়ে গেছে এবছরের আর-বি-ডি। দিনে প্রায় পনেরো ঘণ্টা চলেছে নাচের প্র্যাকটিস, আর সঙ্গে রয়েছে রেমন্ড স্যারের নানান অভিনব নাচের কারিকুরি, ফলে চলেছে সাঙ্ঘাতিক পরিশ্রম। তবে সুমন দমবার পাত্র নয়, তা’ছারা রত্নাও সমানে উৎসাহ জুগিয়ে চলেছে। তাই সুমনের কাছে এটা একটা মরণ বাঁচন লড়াই – আর সামনে ওই একটাই লক্ষ্য যেভাবেই হোক চ্যাম্পিয়ন ট্রফিটা ঘরে আনা।

    প্রথমে পঞ্চাশ জন, তারপর প্রথম আঠারো জনে ঢুকতে কোনও অসুবিধে হয়নি সুমনের। শুরু হয়ে গেছে জনতার ভোট পর্ব আর গত সপ্তাহে প্রথম দশজনের মধ্যে সুমন জনতার ভোটে প্রথম স্থান পেয়েছে। খবরটা পেয়ে রত্না আনন্দ সুমনের মা’কে জড়িয়ে ধরে এমন নাচ নেচেছিল, যেন সুমন চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেছে।

    প্রতিযোগিতা ক্রমশ কঠিন থেকে কঠিনতম হয়ে চলেছে। চলেছে ভোট অঙ্কের নানারকম জটিল হিসাব নিকাশ আর সাথে ভোট আকর্ষণের সব অভূতপূর্ব কৌশল। দশজন প্রতিযোগীর মধ্যে ওরা সমান সংখ্যক ছেলে এবং মেয়ে রয়েছে। এর মধ্যে ওরা চারজন রেমন্ড স্যারের প্রার্থী। রেমন্ড স্যারের সব চেয়ে প্রিয় প্রার্থী শ্রেয়সী আর তারপর ওনার পছন্দ রাহুলকে। উনি মাঝেমধ্যেই বলছেন যে রাহুলই এবারের সম্ভাব্য বিজেতা, তবে শ্রেয়সী প্রথম তিনে থাকবে। সুমন এবং সবিতার ব্যাপারে যে খুব বেশী আশাবাদী নন সেটা বোঝা যায় ওনার কথায় “শুধু কি নাচ দেখালেই হবে, আসল তো জনতার ভোট। আরে বাবা ভোট কি আর পাবলিক শুধু নাচ দেখে দেয় নাকি? ক’জন বুঝবে আমার কোরিওগ্রাফের অর্থ? ভোটের জন্য নাচ ছাড়া নিজেকেও অনেক বেশী আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে, সুন্দর কথা বলতে হবে, প্রয়োজনে অভিনয় করতে হবে এমনকি মিথ্যে করেও কিছু বলতে হতে পারে। রাহুল তো ড্যাম স্মার্ট এবং এমন সুন্দর ভঙ্গিমায় কথা বলে যে মেয়েদের ভোটটা ওর জন্য বাধা, আর শ্রেয়সীকে তো দেখে ছেলেরা ভোট না দিয়ে পারবেই না। তোমাদের ভোট কি করলে আসবে সেটা তো ভাবতে হবে?”

    ~~~~ ০ ~~~~

    এগিয়ে চলেছে প্রতিযোগিতা দুর্দান্ত গতিতে। প্রতি সপ্তাহে প্রতিযোগীর সংখ্যা যত কমছে, ততই জটিল উঠছে প্রতিযোগিতা। ভোট ব্যাঙ্ককে সক্রিয় করতে চলেছে নানান অভিনব প্রয়াস। কোনও প্রতিযোগী মঞ্চে নিয়ে আসছে ঠাকুমাকে আর চোখ ভরা জলে জনতাকে আবেদন জানাচ্ছে ভোট দেবার জন্য কারণ তার সদ্যপ্রয়াত ঠাকুরদার ইচ্ছে ছিল নাতিকে চ্যাম্পিয়ন হতে দেখা, কেউ হুইল চেয়ারে চেপে মঞ্চে এসে এক পায়ে প্লাস্টার নিয়ে অন্য পায়ে নাচছে নটরাজের মতন, কেউ নাচতে নাচতে আগুনের বলয়ে প্রবেশ করছে বা কেউ কুড়ি ফুট ওপর থেকে ঝাঁপ দিচ্ছে, কখনও চলেছে আইটেম গানের সাথে উদ্যম নাচের ‘ধুম’ বা কখনও করুণ সুরে নিহত সৈনিকদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন, কেউ বলছে নাচকে পেশা করতে চায় অভাবের সংসার চালানোর জন্য বা কেউ চাইছে নাচের মাধ্যমে বান্ধবীকে খুশি করতে, কেউ চাইছে ভারতীয় নাচকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিতে বা কেউ চাইছে ভারতীয় নাচের সাথে পাশ্চাত্য নাচের সংমিশ্রণ ঘটাতে। প্রতিযোগীদের সাথে জাজেরাও পিছিয়ে নেই, সেখানেও চলেছে রকমারি প্রয়াস। নিজের প্রার্থীকে অভিনন্দন জানানোর জন্য কখনও আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াচ্ছেন বা কখনও চড়ে উঠছেন টেবিলের ওপর, বা কখনও সোজা দৌড়ে গিয়ে মঞ্চে উঠে কোলে তুলে নিচ্ছেন প্রার্থীকে, আবার কখনও শুরু করছেন নিজেদের মধ্যে বাক, বিতণ্ডা, চিৎকার এমনকি ক্ষণিকের জন্য অনুষ্ঠান কক্ষ ত্যাগ, কখনও বা হয়ে উঠছেন আবেগপ্রবণ, কখনও করছেন রসিকতা, বা কখনও করছেন বিশেষজ্ঞের মত চুলচেরা বিশ্লেষণ। কখনও দর্শকদের ধন্যবাদ জানাচ্ছেন অনুষ্ঠানটিকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য আবার কখনও তাদেরই প্রতি অভিযোগ আনছেন পর্যাপ্ত ভোট না দেওয়ার জন্য, কখনও বা অভিভাবকদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ দেশকে এমন দুর্লভ প্রতিভা উপহার দেওয়ার জন্য। অভিভাবক-মহল এবং দর্শককুলও যথেষ্ট সক্রিয়। কোনও কোনও প্রার্থীর বাবা, মা, এমনকি ঠাকুমা পর্যন্ত মঞ্চে উঠতে পারার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে গানের তালে শরীরটা দুলিয়ে ছোটবেলার শখ পূরণ করে নিচ্ছেন। ওদিকে দর্শকদের নানা মন্তব্য প্রদর্শিত হচ্ছে ছোট ছোট ভিডিও ক্লিপিংসের মাধ্যমে।

    সর্বোপরি রয়েছে প্রযোজকের অনুষ্ঠান পরিকল্পনা, ওনার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা আর জন সমীক্ষার বিশ্লেষণ ঠিক করে দিচ্ছে প্রতিদিনের অনুষ্ঠানের নাচের থিম, প্রার্থীদের ভোট আবেদনের কৌশল, জাজেদের মন্তব্যের ভাষা, অনুষ্ঠান পরিচালকের আদব কায়দা, সন্তানের প্রতি অভিভাবকদের আবেগ প্রকাশের ভাষা, দর্শকদের উল্লাসের পদ্ধতি এমনকি প্রার্থীদের আহত বা অসুস্থ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা এবং চিকিৎসকদের বিবৃতি।

    সব মিলে অনুষ্ঠান পৌঁছে গেছে এক চরম উত্তেজনাময় কঠিন প্রতিযোগিতায়। এক এক করে অপসারণ হয়েছে প্রতিযোগীদের – কেবল তিনজন পৌঁছে গিয়েছে ফাইনালে। গত তিন মাস কঠিন পরিশ্রম এবং একনিষ্ঠ চেষ্টার ফলে সুমন পৌঁছে গিয়েছে ফাইনালে, তবে এরজন্য ওকে কখনও সহ্য করতে হয়েছে অপমানের জ্বালা, কখনও হতে হয়েছে প্রতারণার শিকার, কখনও ভোট আবেদনের জন্য নিতে হয়েছে মিথ্যা কথার আশ্রয়, কখনও বা চাহিদামত হতে হয়েছে অসুস্থ। রত্নার আগ্রহ এবং উৎসাহের জন্যই সুমন আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেছে, যদিও মানসিক এবং শারীরিক ভাবে ও সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত।

    ফাইনালের অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। রেমন্ড স্যার বলেছেন যে সুমনকে এমন একটা চিত্তাকর্ষক নাচ করাবেন যেটা এতটাই মারাত্মক এবং বিপজ্জনক যে অন্য কোনও প্রতিযোগী করার কথা চিন্তাও করতে পারবে না। প্রস্তুতি পর্ব শেষ, প্রতিযোগীরা প্র্যাকটিসও করেছে তাদের নাচ। তৈরি হয়েছে বিশাল মঞ্চ ফাইনালের জন্য, আর সাথে কয়েক হাজার দর্শকাসন।

    আলোর রোশনাইয়ে ঝলমলিয়ে উঠেছে মঞ্চ, আর সামনে একঝাঁক চিত্রজগতের তারকাদের ভিড়ে অনুষ্ঠানের ঔজ্জ্বল্য বেড়ে গেছে অনেকগুণ। সুমনের দাদা, বৌদি ছাড়াও মা, এমনকি বাবাও এসেছেন ওর নাচ দেখার জন্য। এসে থেকে রত্না ঘুরে বেরাচ্ছে ওই ডায়েরিটা নিয়ে আর সংগ্রহ করে চলেছে সব তারকাদের অটোগ্রাফ। এমন সাজ সেজেছে আজ, যে দেখে দাদা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে “তুমিতো বিয়ের বেনারসী, মাথায় রজনীগন্ধা, আর গয়না............বিয়ের সবকটাই পরে নিয়েছ দেখছি।"

    শুরু হল RBD ফাইনাল। প্রথম নাচটা ওই মেয়েটা দারুণ নাচল। হাততালিতে ভরে উঠেছে সমস্ত দর্শকাসন। দ্বিতীয় নাচ ওই লম্বা ছেলেটার – আরও দারুণ নাচছে। মনে হয় শরীরের সমস্ত জয়েন্টগুলো কেউ যেন স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে লুস করে দিয়েছে। শীর্ষাসনের ভঙ্গিতে হাতের ওপর ভর দিয়ে যেভাবে নাচছে, তা দিয়ে ডারউইন সাহেবের মতবাদের সত্যতাকে সহজেই প্রমান করা যায়। দর্শকরা সবাই অভিভূত এই নাচ দেখে।

    এবার সুমনের পালা। রেমন্ড স্যার সুমনের হাত ধরে বলে দিলেন “বাকি দুজন দারুণ নেচেছে। অতএব, তোকে আজ ফাটিয়ে দিতে হবে, চ্যাম্পিয়ন হওয়া চাইইইই।"

    সুমন ধীরে ধীরে প্রবেশ করল মঞ্চে, ওর চোখ দুটো কালো কাপড়ে বাঁধা। মঞ্চের ওপর থেকে নেমে এল মোটা একটা দড়ি। হাতড়ে এগিয়ে গিয়ে ধরে নেয় দড়িটা, জড়িয়ে দেয় শরীরে। দড়ি উঠে যায় ওপরে, আর শুরু হয় বাজনার তালে দড়িতে ঝুলতে ঝুলতে চোখ বন্ধ সুমনের নাচ। ঝুলন্ত অবস্থায় ওই সব মারাত্মক ভঙ্গিমা দেখে দর্শকরা তালি দেওয়ার সাথে সাথে আঁতকে উঠছে। এবার বৃত্তাকারে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে দড়িটাকে, আর তারই মধ্যে সুমন কখনও দড়িতে এক পা জড়িয়ে ঝুলছে, কখনও বা এক হাত জড়িয়ে ডিগবাজি খাচ্ছে। করতালিতে ফেটে পড়ছে দর্শকাসন। রেমন্ড স্যার একের পর এক সিটি দিয়ে চলেছেন। আর এদিকে সুমনের মা ভয়ে দুর্গানাম জপে চলেছেন। রত্নার একদিকে যেমন আনন্দ হচ্ছে, তেমনি ভয়ে সারা শরীর হিম হয়ে আসছে।

    বাজনার লয়ের সাথে দড়ি ঘোরার গতিও বেড়ে চলেছে, সাথে সুমনের নাচও। বাজনার আওয়াজ ছাপিয়ে যাচ্ছে দর্শকদের চিৎকার আর হাততালিতে। হটাৎ একটা বিকট আওয়াজ, দেখা গেল সুমন মাটিতে পড়ে। দর্শকরা উল্লসিত, উঠে দাঁড়িয়ে তারা অভিনন্দন জানাচ্ছে সুমনকে ওই নাচ, এবং বিশেষ অতো উঁচু ঝাঁপ দেওয়ার জন্য। এদিকে সুমন মেঝেতে পরে অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করছে। ধীরে ধীরে সবকিছু কালো হয়ে আসছে, মনে হচ্ছে কোনও অন্ধকার অতল গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছে সে। না, আর কিছুই মনে করতে পারে না সুমন এর পরের ঘটনা।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments