অয়ন আজ প্রচন্ড রেগে রয়েছে। টিভিতে ক্রিকেট খেলা দেখাচ্ছে কিন্তু সে দেখতে পাচ্ছে না। বাবা বলেছেন এক সপ্তাহ বাদে যখন পরীক্ষা তখন একদম টিভি দেখে চলবে না! বলে বাড়ির টিভি অফ করে দিয়ে বাবা যেন কোথায় বেরিয়ে গেছেন। কিন্তু বেরিয়ে গেলেও কোন লাভ হবে না, একবার যখন বলে দিয়েছেন টিভি দেখা চলবে না তখনই হয়ে গেছে! এখন আর মাকে ধরে সাধাসাধি করলেও কিছু হবে না। অয়ন মনের দুঃখে কিছুক্ষণ বসে পড়ার ভান করল কিন্তু কিছুতেই পড়ায় মন বসছে না। বাবার জন্মদিনের জন্যে একটা কার্ড বানিয়েছিল সে, তাতে লিখেছিল ‘বেস্ট ফাদার ইন দয়া ওয়ার্ল্ড’। রাগের চোটে সেই কার্ডটাকে বার করে কালো কালি দিয়ে বেস্ট কথাটা কেটে দিল অয়ন।
আশপাশের বাড়ি থেকে চিৎকার শোনা যাচ্ছে। সবাই খেলা দেখছে এক অয়ন ছাড়া! মা ফোনে ছায়ামাসির সাথে কথা বলছেন। তার মানে পাক্কা এক ঘন্টা! সেই সুযোগে অয়ন টুক করে ছাদে পালিয়ে গেল। সন্ধ্যে হয় হয় করছে, পাখিরা সব কিচিরমিচির করতে করতে ঘরে ফিরছে। অল্প অল্প হাওয়ায় মণিদিদার লাগানো জবা গাছটা দুলছে। দারুণ লাগছে। মণি দিদা পাটনা গেছেন, মামার বাড়ি। কবে ফিরবেন কে জানে। এদিক ওদিক ঘুরঘুর করতে করতে হঠাৎ চিলেকোঠার দরজাটার দিকে নজর পড়ল অয়নের। ওমা! দরজাটা খোলা! ওটা তো সব সময় বন্ধ থাকে, মা-বাবা ওকে মোটেই ওই ঘরে ঢুকতে দেন না! আজকে মনে হয় মিতামাসি ঝাড়ু দিতে এসে বন্ধ করতে ভুলে গেছে! অয়নের অনেক দিনের শখ ঐ ঘরটায় ঢুকবে। না জানি কী যখের ধন আছে ওখানে! ক্রিকেট খেলা দেখার চেয়ে কম রোমাঞ্চকর নয় ঐ ঘরটায় ঢোকা! আস্তে আস্তে দরজাটা খুলে ভিতরে ঢুকল অয়ন।
বাবা! ভিতরটা কী ঘুটঘুটে অন্ধকার! দরজার দুপাশের দেওয়াল হাতড়ে আলোর সুইচটা পেল সে। সেটা টিপতেই নরম আলোয় ভরে গেল ঘরটা। যাক বাবা! বাল্বটা কাজ করছে তাহলে। চারিদিকে তাকিয়ে দেখল সে। প্রচুর বই রয়েছে সারা ঘরের তাক জুড়ে আর রয়েছে কয়েকটা বড় বড় ট্রাঙ্ক। ওগুলোতে মনে হয় জামাকাপড়, বাসন ইত্যাদি রাখা আছে। বইগুলোকে ঘেঁটে দেখতে লাগল অয়ন। নাহ, ওর পড়ার মতন কিছুই নেই, সব বড়দের বই। হঠাৎ একটা জিনিস দেখতে পেল সে। না, তেমন সাঙ্ঘাতিক কিছু নয়। একটা খাতা। একটা ট্রাঙ্কের তলা থেকে খাতাটার একটা কোনা বেরিয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। কৌতুহল বশত সেটাকে টেনে হিঁচড়ে বার করতে চেষ্টা করতে লাগল অয়ন। ট্রাঙ্কটা বেজায় ভারী সেটাকে নড়ানো ওর সাধ্যি নেই কিন্তু খাতাটার কোনাটা ধরে টানতে আস্তে আস্তে সেটা পুরোটাই বেরিয়ে এল। খাতাটা খুলে দেখল অয়ন, কারণ মলাটটা ঘসা লেগে ছিঁড়ে গেছে। প্রথম পাতাটা খুলেই ভারি মজা পেল সে। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা রয়ে ‘অনিকেত মজুমদার, ক্লাস সিক্স’। তার মানে এটা বাবার খাতা ছিল! কেমন একটা অদ্ভুত লাগছিল অয়নের, বাবা মা যে কোনদিন ছোট ছিল সেটা ভাবতেই কেমন লাগে! মারটা তাও ভাবা যায় কিন্তু বাবা? একেবারেই না! অয়নের বাবা ভীষণ রাশভারী আর গম্ভীর, সব সময় ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকে অয়ন!
খাতাটা উলটে পালটে দেখতে লাগল সে। প্রথমে সে ভেবেছিল বুঝিবা এটা স্কুলের খাতা কিন্তু তারপর দেখল না, স্কুলের খাতা নয়। এটা একটা ডায়েরি মতন। বাবা যখন ছোট ছিলেন তখনকার কিছু কিছু ঘটনা লিখে রেখেছেন। রোজ নয়, মাঝে মাঝে। মনে হয় লেখার মতন কিছু থাকলে তবেই লিখতেন। উল্টে পাল্টে এক ঝলক দেখে ক্রিকেট প্লেয়ার, ফুটবল প্লেয়ারদের নামের তালিকা সব দেখতে পেল অয়ন। বাবার উপর রাগটা আরো বেড়ে গেল! নিজে করলে কিছু ভুল নেই আর অয়ন করলেই যত দোষ! বাবারা যে দুই ভাই এক বোন সেটা জানে অয়ন, কারণ জেঠু আর পিসি তো আছেন। তা ছাড়া বাবার এক বিধবা পিসিও থাকতেন বাবাদের সাথে। সেই পিসির তিন ছেলেমেয়ে। সব মিলিয়ে ছজন, তাই সব সময় যেন একটা উৎসব উৎসব ভাব! কী মজাই না হত অয়ন ভাবে।
বাবাদের কান্ড কারখানা পড়তে পড়তে ওর হঠৎ মনে হল এখানে বড্ড কম আলো, তাই সে খাতাটাকে নিচে নিজের পড়ার ঘরে নিয়ে গেল। মা তখনও ছায়ামাসির সাথে গল্প করে চলেছেন। অয়ন পড়ার টেবিলে বসে বাবার খাতাটা খুলে পড়তে লাগল।
ভারি মজার মজার সব ঘটনা। আম বাগান থেকে আম চুরি করতে গিয়ে মালির তাড়া খাওয়া, বিশ্বকর্মা পুজোর দিন ঘুড়ির লড়াইয়ে ক্লাস টেনের বিজুদাকে হারান, পেয়ারা গাছ থেকে পেয়ারা চুরি করতে গিয়ে ডাম ভেঙ্গে পরে যাওয়া, পাড়ায় ক্রিকেট খেলা, ফুটবল খেলা, ঠিক যেন গল্পের মতন! ভাই বোনেদের সাথে মারামারি কাড়াকাড়ি করে চকোলেট খাওয়া, সব কিছু। পড়তে পড়তে অয়ন ভাবল, ‘বাবা আগে তো অন্য রকম ছিলেন তাহলে এখন এই রকম হয়ে গেছেন কেন কে জানে! বড় হলেই বুঝি সবাই ঐ রকম বদলে যায়?” অয়ন ঠিক করল সে মোটেই বদলাতে চায় না!
অথচ বাবারা কী মজা করেছেন ছোটবেলায়! বাবাদের বাড়িতে টিভি ছিল না তখন। ভাল প্রোগ্রাম বা খেলাটেলা হলে পাশের বাড়িতে টিভি দেখতে যেতেন ওরা সব ভাই বোনেরা মিলে। অয়ন পড়ে ভাবল সেটা তো মোটেই মজার নয়। টিভি তো কোন ছাড়, অয়নের তো নিজের কম্পিউটার, ভিডিও গেম সব আছে! চকোলেট কারো সাথে ভাগ করে খেতে হয় না, কিন্তু দাঁতে পোকা হবে বলে মা ওকে বেশি চকোলেট খেতেই দেন না! অয়ন ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না বাবাদের সময় বেশি মজা হত না এখন সে বেশি মজা করছে!
কোন কোন দিন বেশি রাত পর্যন্ত টিভি দেখেছেন সেটাও খাতাতে লেখা রয়েছে। সেটা পড়ে আরো রাগ হল অয়নের। নিজেরা দিব্যি সব টিভি দেখা হত আর এখন যত শাসন সব অয়নের উপর! মাছ ধরা, বনভোজন আরো কত কী সব মজার জিনিস করতেন বাবারা!
পড়তে পড়তে অয়ন হঠাৎ দেখল একটা পাতা লাল কালি দিয়ে লেখা। সে ভাবল হয় তো হাতের কাছে লাল কালির কলম ছিল তাই বুঝি, কিন্তু একটুখানি পরেই বুঝতে পারল ব্যাপারটা তা নয়! অবাক হয়ে পড়ল অয়ন, বাবা লিখেছেন—
“ভূগোলের পরীক্ষায় ১০০তে মাত্র ২০ পেয়েছি আমি, আর বিজ্ঞানে কোনমতে পাস করেছি। ওই পরীক্ষাগুলোর আগের দিন রাত জেগে ক্রিকেট ম্যাচ দেখেছিলাম, কিছু পড়া হয়নি। দিদিভাই, বাবলুদা, সোনামণি, বিলু এমনকি ছোটকুও বাড়িতে বসে পরীক্ষার পড়া করছিল। আমি যে খেলা দেখতে পালিয়েছি সেটা ওরা কাউকে বলেনি ওদের ভয় দেখিয়েছিলাম বলে। এখন ওরা সবাই কেমন হাসছে! আমি ভেবেছিলাম না পড়েই কেল্লা ফতে হয়ে যাবে কিন্তু সেটা হয়নি। ফেল করেছি আমি! ভাগ্য ভাল এটা হাফ ইয়ারলি পরীক্ষা, না হলে আমার প্রোমোশান আটকে যেত! বিলু আমার চেয়ে উঁচু ক্লাসে চলে যেত আর আমাকে ছোটকুর সাথে এক ক্লাসে পড়তে হত! সেটা হলে একেবারে লজ্জার একশেষ হত! বাবা সারাদিন অফিস করে রাতে বাড়ি ফিরে আমার রেজাল্টটা দেখে শুধু একটা দীর্ঘস্বাস ফেললেন, আর কিছুই বললেন না! লজ্জায় আমার মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিল! আমি আর কোনদিন পরীক্ষার আগের দিন টিভি দেখব না!”
শেষের লাইনটার তলায় লাল কালি দিয়ে বার বার দাগ দেওয়া! অয়ন এবার বুঝতে পারল কেন বাবা ওকে পরীক্ষার এক সপ্তাহ আগে থেকে টিভি দেখতে দেন না! অয়নও তো খেলা দেখার জন্যে অনেকবার পড়া শেষ না করেই মিথ্যে মিথ্যে ‘আমার পড়া হয়ে গেছে’ বলেছে। সত্যিই তো! মাসতুতো বোন জুনির সাথে এক ক্লাসে পড়তে হলে ব্যাপারটা বড়ই লজ্জার হবে! চট করে খাতাটা লুকিয়ে ফেলল অয়ন। বাবার জন্মদিনের কার্ডটা ছিঁড়ে ফেলে আবার নতুন করে একটা বানাতে শুরু করল। না, এবার থেকে সে নিজেই পরীক্ষার আগে টিভি দেখার জন্যে জেদ করবে না!