• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৫৫ | অক্টোবর ২০১৩ | গ্রম্থ-সমালোচনা
    Share
  • বাংলা কবিতার অহংকারী মেয়েরা : উত্তম দাশ


    দামিনী : মহিলা কবিদের বাংলা কবিতার সংকলন ১৪০০-২০০০; সম্পাদনা : নমিতা চৌধুরী ও অনিন্দিতা বসু সান্যাল; প্রথম প্রকাশ: বইমেলা ২০১৩, নান্দীমুখ সংসদ - কলকাতা, পৃষ্ঠাঃ ৫৫৯ ; ISBN :

    'দামিনী' নমিতা চৌধুরী ও অনিন্দিতা বসু সান্যাল সম্পাদিত মেয়েদের কবিতা সংকলন। এই বইতে সংকলিত কবিতাগুলোর সময়সীমা চতুর্দশ শতাব্দী থেকে বিংশ শতাব্দী। মোট কবিতা সংখ্যা ২৭০টি। এর মধ্যে চৌদ্দ থেকে আঠার এই চার শতাব্দীতে কবির সংখ্যা মাত্র ৬ জন। উনিশ শতকের কবি ৫৩ আর বিশ শতকের কবি ২১১ জন। উনিশ শতকে বিদ্যাসাগর ডেভিড হেয়ারের জীবনপাত পরিশ্রমে স্ত্রীশিক্ষা প্রবর্তনের পরপরই এদেশের মেয়েরা সৃজনশীল সাহিত্যকর্মে বিশেষ দক্ষ হয়ে উঠেছে ক্রমাগত। আর বিশ শতকে স্ত্রী-স্বাধীনতা বৃদ্ধি পাবার সঙ্গে সঙ্গে নানা পেশায় মেয়েদের অংশগ্রহণ যত বেড়েছে ততই কবির সংখ্যা বেড়েছে আমাদের সাহিত্যে। ব্যক্তিগতভাবে আমার মহিলাকবি শব্দবন্ধে সম্মতি নেই। কবিদের এ-জাতীয় বিশেষণে সম্মানহানি ঘটে বলেই আমার বিশ্বাস।

    প্রকৃত প্রস্তাবে এদেশে আধুনিক শিক্ষার প্রবর্তন ইংরেজ আমলে। আঠারো শতকের মধ্যপর্বে এদেশের শাসক হয়ে বসার পঞ্চাশ বছরের মধ্যে শাসনকাজ নির্বাহের জন্য কেরানিকুল সৃষ্টিমানসে সরকার নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছিল। কলকাতাকেন্দ্রিক সে-সব শিক্ষাকেন্দ্র নতুন বাঙালি তৈরির সহায়ক হয়েছিল। এর আগের দেশির শিক্ষা ছিল টোল-নির্ভর। সে-শিক্ষার সুযোগ পেত মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ। মেয়েদের শিক্ষার প্রায় কোন ব্যবস্থাই ছিল না। কোন কোন পরিবারে পণ্ডিত পিতারা নিজেদের উদ্যোগে মেয়েদের শিক্ষার ব্যবস্থা করতেন। তেরো শতকের সূচনায় তুর্কি আক্রমণে সে সমাজব্যবস্থাও ভেঙে ছারখার হয়ে গেল। প্রাণ আর সম্মান রক্ষায় নগর ছেড়ে সবাই পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছে প্রত্যন্ত গ্রামে আশ্রয় নিয়ে। প্রায় আড়াইশো বছরের সেই নৈরাজ্যে বাঙালির সমাজব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ল। সম্মান বাঁচাতে পরিবারের ভেতরে মেয়েদের সম্পূর্ণ পর্দানশিন করে রাখা হলো। আতঙ্কে এদেশে প্রবর্তিত হলো মেয়েদের শৈশববিবাহ।

    বাংলা ভাষাসাহিত্যের উদ্ভব দশম থেকে দ্বাদশ শতকে। 'দামিনী' সংকলনের সম্পাদকরা বাংলা ভাষায় প্রথম মহিলা কবির অস্তিত্ব খুঁজে পেলেন চতুর্দশ শতকে। তিনি লোকশ্রুতির রজকিনী রামী। পুরো নাম সম্ভবত রামমনি। পদাবলীর চণ্ডীদাসের সঙ্গে তাঁর প্রণয়সম্পর্ক এখনো লোকমুখে প্রচারিত। এই রামী নিরক্ষর ছিলেন। লোককবির মতো তিনি মুখে মুখে কবিতা রচনা করতে পারতেন হয়তো। কিন্তু লোকমুখে রামীর ভাষা এতই পরিবর্তিত যে এই সংকলনে সংকলিত পদটির ভাষা আঠারো শতকের শেষ পর্বের ভাষাছাঁদের আকার পেয়েছে। চতুর্দশ শতকের কবি বলে রামীকে পাওয়া গেল কিন্তু তাঁর ভাষারূপ পাওয়া গেল না। পঞ্চদশ শতকের কবি মাধবী দাসী সম্পর্কেও একই কথা। ভূমিকায় সুমিতা চক্রবর্তী এই মাধবী পুরুষ কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। অনেক আগে সুকুমার সেনও তাঁর সাহিত্যের ইতিহাসে সে সংশয়ের কথা বলেছেন। কবিপরিচিতিতে লেখা হয়েছে মাধবী ১৫০৯ সালে পুরীধামে শ্রীচৈতন্যের কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন। কিন্তু শ্রীচৈতন্যদেব নিজ ধর্মমত প্রচারের জন্য পুরীতে যান ১৫১০ সালের ফাল্গুনে। পরে ১৫১৫ সালে, পরের আঠারো বছর পুরী ছেড়ে কোথাও যান নি।

    সন্দেহাতীতভাবে বাংলাসাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি ষোড়শ শতকের সূচনাপর্বের চন্দ্রাবতী। ময়মনসিংহ নিবাসী মনসামঙ্গল কাব্যধারার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি দ্বিজ বংশীদাসের মেয়ে তিনি। পিতাই তাঁর শিক্ষক। তরুণ বয়সেই তাঁর কবিত্বশক্তির স্ফুরণ। পিতার প্রেরণায় অল্প বয়সে মনসার গান লিখেছেন। ব্যর্থ প্রেমের যন্ত্রণায় নিজেকে নিঃশেষ করেছেন। বাংলাভাষায় রামায়ণের ভাবানুবাদ করেছেন চন্দ্রাবতী। কুকুয়া নামে কৈকেয়ীর এক মেয়ের কথা লিখেছেন, মায়ের মতোই তার কুটিল স্বভাব। লোকমুখে প্রচারের ফলে চন্দ্রাবতীর ভাষারও পরিবর্তন ঘটেছে। তবু তাঁর মূল রচনার স্বাদ পাওয়া যায় তাঁর রামায়ণে।

    সপ্তদশ শতক বাংলা সাহিত্যের বন্ধ্যাযুগ। সুদূর আরাকানে বসে কিছু বাঙালি কবির কাব্যসাধনা এই শতকের মূল সম্পদ। শ্রীচৈতন্য প্রভাবে বৈষ্ণবপদ রচনার একটা ক্ষীণধারা মূল বঙ্গদেশে তখনও প্রবাহিত। এই পর্বের শ্যামপ্রিয়া এমনই এক বৈষ্ণব ভাবাপন্ন কবি। আঠারো শতকের আনন্দময়ী ও গঙ্গামণি দেবীও তাই। প্রকৃত প্রস্তাবে বাংলাসাহিত্যে মহিলা কবিদের ঢল নামে উনিশ শতকের রোমান্টিক কবিতা রচনা পর্বে। এখন থেকে মেয়েরা নিজের কথা বলছে অকুণ্ঠভাবে। মেয়েদের কবিতা চর্চা নিয়ে অনেকে এ-পর্বে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করেছেন। তার কিছুটা ঈর্ষাজনিত কিছুটা নতুন যুগকে মানতে না পারার ফল, বাঙালির জাতীয় বৈশিষ্ট্য অনেকটা কাজ করেছে এসবের পেছনে। ভূমিকায় সুমিতা চক্রবর্তী বারাঙ্গনা মেয়েদের নিয়ে গিরিশচন্দ্র ঘোষের পত্রিকা প্রকাশের বৈপ্লবিক ঘটনার উল্লেখ করেছেন। আমাদের সময়ে দুর্বার মহিলা-সংগঠন সমাজের এই অবহেলিত মেয়েদের নিয়ে যে কাজ করছেন তা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়। তাঁদের প্রচেষ্টাতেই এই মেয়েরা তাঁদের সৃজনশীলতার বিকাশে আত্মসম্মানবোধ অর্জন করে সমাজের মূলস্রোতে ফেরার অবকাশ পাচ্ছে।

    বিংশ শতাব্দীর মহিলা কবিদের তালিকা বিশাল, ২১১ জন কবি রয়েছেন এখানে। এই সময়ের শেষপর্ব সম্পাদকদের সময়ের অন্তর্গত। কবি নির্বাচনে ব্যক্তিগত সম্পর্ক এক্ষেত্রে বিশেষ কার্যকর। অনেক অকবির ভিড়ে বেশ কিছু প্রধান কবি অমনোযোগে বাদ পড়েছেন। পঞ্চাশের শেষপর্বের জব্বলপুরবাসী হেনা হালদার, ষাটের কবি-অধ্যাপক দীপালি রায়, পুরীনিবাসী সুজাতা প্রিয়ংবদা, সত্তরের কবি-অধ্যাপক রুচিরা শ্যাম, অঞ্জলি চক্রবর্তী বাদ পড়া কবিদের মধ্যে অন্যতম। আসাম-ত্রিপুরার কবিদের এই সংকলনে অন্তর্ভুক্তি অনিবার্য ছিল। শুধু চন্দ্রিমা দত্ত এই ভূখণ্ডের মূল প্রতিনিধি নন। বাংলাদেশের কবিতা এ-সংকলনে রাখা হয়নি বলেছেন সম্পাদকরা। কিন্তু বাংলাকবিতা সংকলনে বাংলাদেশের কবিরা বাদ যাবেন কেন? তসলিমা নাসরিন তো বাংলাদেশের কবি। কলকাতার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ নিবিড় বলেই তিনি অন্তর্ভুক্ত হবেন? আর বাংলাদেশের শক্তিমান মহিলা কবিরা বাদ যাবেন, এতো কোন যুক্তির কথা নয়। বিশেষ এত পরিশ্রমী গবেষণালব্ধ একটা সংকলনে এসব ত্রুটি মেনে নেওয়া কষ্টকর।

    একালের বাংলাকবিতার মেয়েরা আর আলাদাভাবে বিবেচ্য নয়। কলকাতা ছাড়িয়ে দূরদূরান্তের নানা কবিতাপাঠের আসরে মেয়েরা দাপটে কবিতা পড়ছেন। বিদেশে পাড়ি দিচ্ছেন কবিতা পাঠের জন্য কিন্তু এসব একালে ঘটছে মেয়ে বলে নয়, প্রকৃত কবি বলে। এখন আর নারীপুরুষের অবাধ মেলামেশায়, প্রাণখোলা মনবিনিময়ে রক্তচক্ষুর সামাজিকরা আর তাণ্ডব ঘটাতে পারেন না। কবিতা সে কারণে এখন স্বতঃস্ফূর্ত সকলের মধ্যে।

    রবীন্দ্রনাথের 'চতুরঙ্গ' উপন্যাসের নায়িকা দামিনী। সেই দামিনীর নামেই এই সংকলনের নামকরণ। চতুরঙ্গের দামিনী প্রথম জীবনে ভক্তির দস্যুবৃত্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহিনী হয়ে উঠেছিল। পরে শচীশের কাছে আত্মসমর্পণ করতে গিয়ে পেটে যে লাথির আঘাত পায় তাতেই তার মৃত্যু। শ্রীবিলাসকে বিয়ে করে সে ব্যর্থ প্রেমের যন্ত্রণা ভুলতে চেয়েছে। পরজন্মে এমন বিবেকবান স্বামী পেতে কামনা করেছে। দামিনী বাংলাসাহিত্যের সেই অহংকারী মেয়ে যে সহস্র পীড়নের মধ্যেও নিজের কথা বলতে জানে। নমিতা চৌধুরী ও অনিন্দিতা বসু সান্যাল দীর্ঘ গবেষণায় সেই অহংকারী মেয়েদের 'দামিনী' সংকলনে একত্রিত করেছেন, যাঁরা আটশ' বছর ধরে নিজেদের মেলে ধরেছেন কবিতায়। যোগেন চৌধুরীর প্রচ্ছদ পরিকল্পনায় নারীমুখের প্রদর্শনী সম্পাদকদের মূল ভাবনাকে নম্রভঙ্গিতে তুলে ধরেছে। এমন একটি ঐতিহাসিক গুরুত্বের সংকলনের রুচিশীল মুদ্রণ, কবিতাসজ্জা, টেঁকসই কাগজ আর বাঁধাই সম্পাদকদের ভাবনানিষ্ঠার পরিচায়ক।

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments