• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৫৬ | মার্চ ২০১৪ | প্রবন্ধ
    Share
  • খুশবন্ত সিং ও ট্রেন টু পাকিস্তান : রবিন পাল



    দ্যপ্রয়াত ভারতীয় সাহিত্যের Grand old man খুশবন্ত সিং প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বলেছেন—সাংবাদিক, সম্পাদক, ইতিহাস রচয়িতা, যে ভাবেই হোক খুশবন্ত-এর লেখালিখি ছিল উস্‌কে দেওয়া গল্প কথকের মতো, যেসব লেখায় মানব পরিস্থিতিতে আলোকপাত বিষয়ে তিনি কখনোই পরান্মুখ নন। এই ব্যাপারটা তিনি অব্যর্থভাবে, অকপটভাবে চালিয়ে আসছেন গত পঞ্চাশ বছর ধরে, আর এই প্রবণতা ছিল পরিহাসময়, বাগবৈদগ্ধ্য দীপ্ত যা সমাজদর্পণকার হিসেবে তাঁর বিপুল দক্ষতার পরিচয় দিয়ে থাকে। তাঁর একদা সহকর্মী Bachi Karkaria বলেন খুশবন্ত ছিলেন ভারতবর্ষের স্বীকৃত ঔপন্যাসিক, শিখ ইতিহাস ও ধর্মের বিশেষজ্ঞ, গাছ ও পাখি বিষয়ে পণ্ডিত, তাঁর কালে সম্পাদক হিসেবে অত্যন্ত সফল। ৯৯ বছর বয়সে প্রয়াত খুশবন্ত লিখেছেন ৮৫টি বই, যার মধ্যে আছে A History of the Sikhs (2 খণ্ড, ১৯৬৩), Train to Pakistan (১৯৫৬), Why I supported the Emergency (2009) ইত্যাদি। তাঁর ছেলে রাহুল বলেছেন—বাবাকে লোকে বিশেষ করে মনে রাখবে বহু পুরস্কৃত, আজও জনপ্রিয়, 'Train to Pakistan' উপন্যাসটির জন্য, যা দেশভাগের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ রচনা। আপাততঃ এই বহু উল্লিখিত উপন্যাসটি নিয়ে একটি চলচ্চিত্র রচিত হয়েছে, এর একটি বাংলা অনুবাদও খুঁজলে পাওয়া যাবে।

    রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কারুকৃতিত্বে যে ভারত উপমহাদেশের বিভাজন তা যে অপ্রত্যাশিত এবং ট্রাজিক তাতে কোনো বিতর্ক নেই। লক্ষ লক্ষ মানুষ বাধ্য হয়েছে তাদের বাস্তু, বস্তি, দেশ, ওয়াতন্‌ ত্যাগ করতে, নিজেদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কষ্টকর ও দুঃখদায়ক যাত্রায়, অজানা শহর, গ্রামে যেতে। এই বাস্তুচ্যুত মানুষগুলির অধিকাংশ ছিল সাধারণ হিন্দু বা মুসলমান বা শিখ যারা ধর্মীয় ভেদাভেদ অপেক্ষা দিনযাপনের প্রাণধারণের গ্লানিতে ব্যতিব্যস্ত। পেণ্ডেরেল মুনের হিসেব মতো ১৮০,০০০ মানুষ নিহত হয় পাঞ্জাবে, হিন্দু মুসলমান উদ্বাস্তুর সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে দশলক্ষ। প্রফুল্ল চক্রবর্তী জানান কেন্দ্রীয় সরকারের মতে ১৯৪৮ জুলাই মাসের শেষে সাড়ে এগার লক্ষ মানুষ পূর্ববঙ্গ ছেড়ে এসেছে। কিন্তু উদ্বাস্তু-ভবন চলেছে অনেক অনেক কাল ধরে। অন্ততঃ ৭৫,০০০ নারী ধর্ষিত, লাঞ্ছিত হয়, হাজার হাজার পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়, শস্য পচে যায়, গ্রাম পরিত্যক্ত হয়। উর্বশী বুটালিয়ার মতে, তাই এটি great convulsions of history. এই যে দুই নেশনের বলপ্রয়োগে সৃষ্টি, যাতে সাধারণ মানুষের ইচ্ছে না থাকলেও দেশত্যাগ বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে, প্রতিবাদ প্রতিরোধ ধর্মীয় হিংস্রতায় উড়ে যায়, আর্তনাদের বন্যায় ভারী হয়ে ওঠে ভারতের আকাশ—এ সবই যেসব সাহিত্যে ধরা পড়ে, ধরা হয়, তাকেই বলা যায় Partition fiction. দেশভাগের উপন্যাসের শিল্পীমূল্য নিয়ে নিরাপদ দূরত্বে চর্চারত পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্ক থাকতে পারে, কিন্তু তাঁরা ভুলে যান এই কথাসাহিত্যের শিল্পবিচারে প্রাধান্য পাওয়া উচিত অন্য কিছুর, হয়তো তা মানবিকতা। যাঁরা দেশভাগের উপন্যাস লিখেছেন তাঁদের, কথাসাহিত্যিকদের মতামত এক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক হবে না। ইনতিজার হুসেন, যিনি 'বস্তি' লিখেছেন, বলেন—যখন আমার লেখার আলোচকরা বলেন আমি দেশভাগের অভিজ্ঞতায় আচ্ছন্ন, ফাঁদে পড়া মানুষ আমি তখন বলি ১৯৪এ যা যা ঘটেছিল তা ছিল এমন জটিল, এমন বিপর্যয় সৃষ্টিকারী, যে আজও তা পুরোপুরি বুঝতে পারি নি। এই ব্যাপার থেকে আমি দূরে থাকব কি ভাবে? কৃষ্ণা সোবতী, যিনি লিখেছিলেন 'সিক্কা বদল গয়া' এবং দেশভাগের ত্রিশ বছর পরে 'জিন্দাগীনামা,' তিনি বলেন—ভারত ও পাকিস্তান বিভাজনের ওপর ভিত্তি ক'রে যে উপন্যাস রচিত হয়, তার আতঙ্ক বিপুলতা যথেষ্ট, কিন্তু তবু তার থেকে বেরিয়ে আসে প্রয়োজনীয় মানব মূল্যবোধের স্বর। কমলেশ্বর, যিনি লিখেছিলেন 'কত না পাকিস্তান,' বলেন—উৎখাত হওয়া মানুষের নিজকথা, মানবসভ্যতার কথা স্মরণ গুরুত্বপূর্ণ। একমাত্র কল্পনাপ্রবণ লেখকই বাস্তু থেকে, সভ্যতা থেকে শিকড়ছেঁড়া মানুষের দুঃখকে অনুভব করতে পারে, উদ্বেলিত করতে পারে মানুষকে। অলোক ভাল্লা তাই বলেন-মানব অনুষঙ্গের যাবতীয় করুণা, ধর্মবোধ যা ছিল মানুষের দৈনন্দিন জীবনের পাথেয়, ১৯৪৭-এর পরে তা অদৃশ্য হয়ে গেল জীবন থেকে। দেশভাগের কথাসাহিত্যে কমবেশী ধরা আছে সেই শোচনীয় অপহরণের ইতিবৃত্ত। কখনও তা অর্থাৎ অভিজ্ঞতা প্রকাশ পেয়েছে আকস্মিক প্রত্যক্ষতার হিংস্র বিবরণে, কখনও অশ্রুসজল অভিশাপদায়ী নস্টালজিয়ায়, কখনও পূর্বাপর অনেক ধর্মীয় উন্মাদনার পরিপ্রেক্ষিতে, কখনও নামহারা উদ্বাস্তুর আগন্তুক অস্তিত্বের রূপায়ণে। উপমহাদেশের সাধারণ মানুষের নৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক কল্পনার জগৎ যে সম্পূর্ণ পক্ষঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ল দেশভাগের উপন্যাসে, সফল রচনায় আমরা সন্ধান করি সেই ট্রাজেডিকে। রাজনৈতিক কৌশল, ধর্মীয় ও স্বার্থগত অন্ধতা ছাপিয়ে মনুষ্যত্ব বিনষ্টির আর্তস্বর ও শুভত্বের চুঁইয়ে আসা স্বর এই ট্রাজিক ঘটনার রূপ পাওয়া গল্প উপন্যাসে আজও আকর্ষণ করে আমাদের।

    খুশবন্ত সিং-এর 'ট্রেন টু পাকিস্তান' লেখকের প্রথম উপন্যাস যা ১৯৫৬তে প্রকাশিত হয়। ভারতীয় দেশভাগ-ভিত্তিক উপন্যাসধারায় ইংরেজিতে লেখা প্রথম ইণ্ডো অ্যাঙলিয়ান উপন্যাস এটি। পাঠককে জানাই ভারতীয় দেশভাগকেন্দ্রিক উপন্যাস প্রধানতঃ অখণ্ড বাংলাকেন্দ্রিক কিংবা পাঞ্জাবকেন্দ্রিক উপন্যাস। পাঞ্জাবের এই ঘটনা নিয়ে উপন্যাস আলোচনায় পাঞ্জাবী ঔপন্যাসিক নানক সিং-এর 'খুন দে সোহিলে' (Paeans of Blood, 1949) এবং 'আগ দে খেদ' (The Play of Fire, 1949) 'ট্রেন টু পাকিস্তান' প্রসঙ্গে বিবেচ্য। খুশবন্তের উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশকালে 'মানো মাজরা' এই নামে প্রকাশিত হয়েছিল। পরে নাম বদলে রাখা হয়—'ট্রেন টু পাকিস্তান'। মানো মাজরা সীমান্তবর্তী একটি অনুল্লেখ্য গ্রাম, যেখানে শতাব্দী জুড়ে হিন্দু ও মুসলমান সৌহার্দ্যে বসবাস করত, পাঞ্জাবে দাঙ্গা যখন বাঁধল তখনও এখানে সাম্প্রদায়িক টেনশন ছিল না। মানো মাজরায় সত্তরটি পরিবারের বাস এবং লালা রাম লালের পরিবারই একমাত্র হিন্দু পরিবার। অন্য পরিবারগুলো শিখ বা মুসলমান। গ্রামের চারপাশের সব জমির মালিক শিখ। মুসলমানরা শিখদের জমির বর্গাদার। কয়েকটি মেথর পরিবার আছে যাদের ধর্ম পরিচয় অনিশ্চিত। একটি মাত্র বস্তুকে সকল বাসিন্দা শ্রদ্ধা করে, যা হল তিনফুট উচ্চতার বেলে পাথরের একটি চাঁই—'দেও' অর্থাৎ দেবতার প্রতীক। আর আছে শতদ্রু নদী ও দর্শনীয় এক রেলওয়ে সেতু, যার দুই প্রান্তে রেললাইন বসানোর জন্য পাথরের বাঁধের সৃষ্টি। এ গ্রামের পরিচিতি শুধু রেলস্টেশনের জন্য, যদিও কোনো গুরুত্বপূর্ণ ট্রেন এখানে থামে না। ১৯৪৭ গ্রীষ্মের পূর্ব পর্যন্ত মানো মাজরায় সবসময় নিরুপদ্রব আলস্য প্রবণতায় ধর্ম উচ্চারণ অব্যাহত ছিল। উপন্যাসটি চারটি ভাগে বিভক্ত—ডাকাতি, কলিযুগ, মানো মাজরা, কর্ম। প্রথম ভাগের প্রথম চার পৃষ্ঠায় আছে গ্রামের সামগ্রিক বর্ণনা। উপন্যাসের কাহিনী শুরু হয় গ্রামের মহাজন লাল রাম লালের হত্যায়, একদল ডাকাত এই ঘটনা ঘটায়, যারা ফেরার সময় চুড়ি ছুঁড়ে দেয় জুগ্যতের বাড়িতে। এ লোকটা জেলফেরত আসামী, সে মাঠে শবীর নিয়ে খেলে নুরান-এর সঙ্গে। নুরান মুসলমান তাঁতির মেয়ে, তার বাপ প্রায় অন্ধ। অন্যদিকে হিন্দু ম্যাজিস্ট্রেট হুকুম চাঁদ মানো মাজরা গ্রামে এসেছে, সে চায় শান্ত মুসলমান লোকগুলোকে বিব্রত করতে। হুকুম চাঁদের নির্দেশে জুগ্যতকে গ্রেপ্তার করা হয় মহাজন হত্যার দায়ে। ম্যাজিস্ট্রেট সাব ইন্সপেকটরকে জানায় শিখরা নাকি হাজারখানেক মুসলমান শরণার্থীদের মৃতদেহ সীমান্তের ওপারে পাঠিয়ে প্রতিশোধ নিয়েছে। মুসলমানদের তাড়াতে হবে এ গ্রাম থেকে। গ্রামের লোক তো জানে না দেশটা ইতিমধ্যে দুভাগে ভাগ হয়ে গেছে। নুরানই জুগ্যতকে গ্রামে রেখেছে, নুরানের বাপের দাপটে কেউ মুসলমানদের কিছু বলে না। ম্যাজিস্ট্রেট জোর করে বেশ্যা গায়িকাকে তুলে নেয় বিছানায়। এরপর পাঠক পরিচিত হয় ট্রেনে আগত ইকবালের সঙ্গে, যে কম্যুনিস্ট সমাজকর্মী। লম্বরদার বা খাজনা আদায়কারী এবং মসজিদের মোল্লা এরা আসতে চায় ইকবালের সঙ্গে কথা বলতে। এদের সঙ্গে কথাবার্তায় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার ধারণা, স্বাধীনতা যে শিক্ষিতদের জন্য, দেশ জুড়ে ধ্বংসের বাতাস, বুর্জোয়া বিপ্লব ও প্রলেতারীয় বিপ্লব নিয়ে কথা হয়। ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে ইকবালকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার হওয়া জুগ্যত নির্বিকার কারণ সে আগেও গ্রেপ্তার হয়েছে, তার বাপও ছিল খ্যাত আসামী। ইকবাল তাকে বোঝাতে যায় তাকে বদমাশ বানিয়েছে সরকার ও পুলিশ। দুজনকে চন্দননগর জেলে আনা হয়। পুলিশ জুগ্যতের কাছে ডাকাতদের নাম জানতে চায়। দ্বিতীয় পর্ব 'কলিযুগ' যার শুরুতেই আছে ট্রেন চলা অনিয়মিত, রাতে ট্রেন চলে। 'সন্ধ্যায় সূর্য ডোবার আগে সবাই ঘরে ঢোকে, এক্সপ্রেস ট্রেন আসার আগেই শুয়ে পড়ে— অবশ্য ট্রেনটা যদি আদৌ আসে।' মালগাড়ির যাতায়াত বন্ধ হয়ে যায়, 'ভুতুড়ে ট্রেনের' যাতায়াত শুরু হল মাঝরাত ও ভোরের মাঝ সময়ে, লোকেদের স্বপ্নে ব্যাঘাত ঘটল। এর আগের অংশেও আমরা দেখেছি মানো মাজরা গ্রামের জীবনযাত্রার সমান্তরালে বারংবার লেখক আনেন ট্রেনের সমান্তরাল গতি। এবার দেখা গেল প্ল্যাটফর্মে সৈন্যের টহল, দিল্লী থেকে আগত সব ট্রেনের চালক ও গার্ড পরিবর্তন করা হতো পাকিস্তানের উদ্দেশে রওয়ানা হওয়ার আগে। পাকিস্তান থেকে যে ট্রেনগুলো আসে সেগুলোর ইঞ্জিন দিল্লীগামী হয় মুক্তি ও স্বস্তির আওয়াজ তুলে। একদিন পাকিস্তান থেকে এল একটা ট্রেন, সৈন্যরা লোকজনদের হটিয়ে দিল। কি আছে দিনে আসা এই ভুতুড়ে ট্রেনে। লোকে ভাবে—দুঃসময়, কলিযুগের ঘোর অন্ধকার সময় হাজির। সৈন্যরা আদেশ করল গ্রামবাসীদের কেরোসিন ও লকড়ি নিয়ে হাজির হতে। দুটো ট্রাক কিসব নিয়ে রওনা দিল, চতুর্দিকে ভেসে এল দুর্গন্ধ, ভুতুড়ে ট্রেনই এই দুর্গন্ধের উৎস, বুঝল সবাই। হুকুম চাঁদ ক্লান্ত শরীরে হুইস্কি নিয়ে বসলেন সন্ধ্যায়। আতঙ্কগ্রস্ত হুকুম চাঁদ খেল না, বাদক, বেশ্যা, বেয়ারা সব ধারে পাশে। হুকুম বেশ্যা মেয়েটিকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। এর পর বর্ষণ, বজ্রপাতের, প্রকৃতি জগতে সাপ কেঁচো বিছের জন্মকথার বিস্তার। হুকুম চাঁদের মনে পড়লো মৃতদেহগুলোর কথা। এরা পনেরশ নিরীহ মানুষ। অন্যগ্রাম থেকে মুসলমান শরণার্থী সরানো হলেও মানো মাজরায় তখনও তা ঘটে নি। হুকুম চাঁদ এ গ্রামের মুসলমানদের সরাতে চাইলেন। হুকুম চাঁদ ও তার বেষ্টনীতে থাকা মেয়েটির কথাবার্তায় জানা গেল ও অঞ্চলের যারা গায়ক তাদের হিন্দুমুসলমান ভেদ নেই। এরপর বন্দী ইকবালের, জুগ্যত ইকবালের কথা। মেয়ে লোক নিয়ে কথা হল, ইংরেজি ভাষার কথা হল। সাব ইনসপেক্টর খোঁজ নিতে চাইলেন ইকবাল সম্পর্কে। জুগ্যত গরাদের ফাঁক দিয়ে খামচে ধরল মাল্লিকে। তার মৃত্যু চাইল। ইকবাল যুযুধান এই দুজনের থেকে পৃথক ঘরে থাকবার আবেদন করল। তৃতীয় পর্বের নাম—'মানো মাজরা'। ট্রেন ভর্তি লাশ আসা, এখানে দাহ গ্রামের লোকেদের মধ্যে এনে দিল দুঃখময় নীরবতা। কেউ কেউ সন্দেহ করছিল ইকবাল বিষয়ে, কিন্তু সে শিখ, এসেছে লালা হত্যার পরদিন। অন্যদিকে হেড কনস্টেবল গ্রামের সব মুসলমানদের গ্রাম ছেড়ে যাবার নির্দেশ দিল। এ হল মুসলমানদের ওপর শিখদের নির্মম অত্যাচারের বিরুদ্ধ প্রক্রিয়া। গ্রাম বৈঠকে কেউ কেউ মুসলমান বিরোধী কথা বললে ও লম্বরদার ও কয়েকজন বহুদিনের সাথী মুসলমানদের ছাড়তে চায় না। আর পাকিস্তান থেকে যারা হাজারে হাজারে আসছে তাদের, শরণার্থীদের দায়িত্ব নিতে চায় তারা। কিন্তু তবু ইমাম বক্স তার স্বজাতি মুসলমানদের গ্রাম ছেড়ে চলে যাবার কথা বলে বেড়াল। 'সে রাতে মানো মাজরার খুব বেশি মানুষ ঘুমালো না। তারা বাড়ি বাড়ি গেল — কথা বললো, কাঁদলো, ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের কসম কাটলো। একে অন্যকে আশ্বস্ত করলো যে খুব শিগগির সব ঝামেলা চুকে যাবে।' নুরান বিদায়ের আগে জিনিসপত্র গোছায়, তারপর বিদায় নিতে যায় জুগগার কাছে। সে বাড়ি ছিল না, জুগগার মা তাকে কুত্তী বলে গাল দিল, অনেক খারাপ কথা বলল। কিন্তু যখন শুনল তার ছেলেই তাকে গর্ভবতী করেছে তখন বিমূঢ় হয়ে গেল। ইচ্ছে না থাকলেও গ্রামের মুসলমানদের ট্রাকে অবিলম্বে ওঠার আদেশ দেওয়া হল। মিত সিং, লম্বরদার চেনা মানুষজনের চলে যাওয়ার বেদনার্ত কিন্তু কোনো কোনো ব্যক্তির 'মুখে রহস্যময় হাসি'। গ্রামের মুসলমানদের সম্পত্তির হেফাজতকারী করা হলো চোর, খুনে মাল্লিকে। মাল্লির দল গরু মোষ তাড়িয়ে ঘরে নিল, গাড়ির মালপত্র লুট করলো। এ পর্বে লেখক দেখান গ্রামীণ শিখদের অশ্রুময় বেদনাহত মুখ, চোর মাল্লার লোভের তীব্রতা, চলে যেতে থাকা মুসলমানদের বিমূঢ় বেদনা।

    চতুর্থ পর্বের নাম - কর্ম। প্রথম দিকেই আছে শতদ্রু নদীতে বন্যার কথা, যা হয়তো পারস্পরিক সাম্প্রদায়িক হিংসার মেটাফর হিসেবেও দেখা যেতে পারে। লোকেরা চোখের সামনে দেখেছে তাদের গ্রামে মাল্লি ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরা কিভাবে মুসলমান বাড়ি ধ্বংস করছে, লুটপাট করছে। নদীর ক্রমবর্ধমান জল তাদের সব কিছু ভোলালো। সেই জলে ভেসে এল মরা গরু, মরা মানুষ। সবাই বুঝলো এদের খুন করা হয়েছে। ট্রেন দেখলেই, থামলেই গ্রামবাসীর আতঙ্ক। গণকবর রচনা করল সৈনিকরা। সন্ধ্যায় গুরুদোয়ারায় যখন শিখরা প্রার্থনারত, তখন জীপে করে কয়েকজন এল, যারা মনে করে—'সরকার কিছু করবে না। এটা হচ্ছে কাপুরুষ বেনিয়া সুদখোর মহাজনদের সরকার।' আগত লোকেরা চায় শিখ হত্যার বদলা নিতে মুসলমানকে হত্যা, নারীদের অপহরণ ও ধর্ষণ করা হোক। মুসলমানদের বাড়ি লুঠ করা উচিত। বহরে হামলা করা উচিত। মিত সিং শিখদের পক্ষে এসব করা অনুচিত জানালে ব্যঙ্গবিদ্রুপ করা হল। সিদ্ধান্ত হল আগামীকাল এক ট্রেন মুসলমান শরণার্থীকে পাকিস্তানে পাঠানোর কথা। তাদের সবাইকে হত্যা করা হোক। উত্তেজিত শিখরা একে একে এই কাজের জন্য উঠে দাঁড়াল। আগামী কাল অন্ধকারে ট্রেন চলার সময় সেতুতে বাঁধা দড়ি থাকবে, তার ধাক্কায় কামরার ছাদে বসা চার পাঁচ'শ লোক পড়ে যাবে, যাদের ওপর তলোয়ার ও বর্শা চলবে। তারপর ট্রেন সেতু পার হলেই জানলা দিয়ে গুলি। মুসলমান বিদ্বেষী হুকুম চাঁদ খুনিদের কাজ করতে, সাহায্য চেয়ে পাঠানোর নির্দেশ ও রেকর্ড রাখতে আদেশ দেয়। 'গোটা দুনিয়া পাগল হয়ে গেছে। পাগল হতে দিন। আরো হাজার খানেক মরলেই বা কি?' হুকুম চাঁদ ও সাব ইনসপেকটরের কথায় আসন্ন বিপজ্জনকতা, পিপলস পার্টি, মুসলিম লীগ কর্মীদের কথা, ইকবাল ও জুগগাকে ছেড়ে দেওয়া এবং টোঙ্গায় মানো মাজরায় পাঠিয়ে দেবার কথা জানা যায়। ইকবাল ফিরে এল গ্রামে। জানল রাতে সেতুর কাছে ট্রেনের ওপর হামলা হবে। মাল্লি, জুগগা এরা হবে সেই হত্যাকাণ্ডের নায়ক। এদিকে গুজরানওয়ালার রাস্তায় বাস থেকে নামিয়ে শিখদের কুপিয়ে মেরে ফেলা হল, যাদের খতনা করা তাদের ছেড়ে দেওয়া হল। হুকুম চাঁদের আর্দালির মেয়েটা, চলেছিল স্বামীর ঘরে, কিন্তু স্বামীর লিঙ্গ কেটে তার হাতে ধরিয়ে দেওয়া হলো আর মেয়েটা গণধর্ষণের শিকার হল। আর সুন্দর সিং তীব্র গরমে চল্লিশ জনের বসার কামরায় পাঁচশ জনের সঙ্গে যখন স্ত্রী ও তিন সন্তান সহ আসছিল তখন ট্রেন আটক হল এক স্টেশনে। সুন্দর তার তৃষ্ণার্ত শিশুদের পেচ্ছাব খেতে দিল। তারপর রিভলবার দিয়ে বাচ্চাদের ও স্ত্রীকে গুলি করে মারল। এদিকে সেতুর কাছে মেশিনগান লাগানো, রাইফেল ও বর্শা হাতে ঘাতকের দল। একটা লোক সেতুতে বাঁধা রশিটা কেটে দিচ্ছিল, গুলি খেয়ে সে পড়ে গেল। ''তার পড়ে যাওয়ার সাথে সাথে রশি মাঝখানে দ্বিখণ্ডিত হয়ে দুদিকে ঝুলে পড়লো। ট্রেনটি তার উপর দিয়ে গেল এবং পাকিস্তানে চলে গেল।' এখানেই উপন্যাসটির সমাপ্তি। লেখক অনুক্ত রেখে গেলেন আসন্ন গণহত্যা প্রসঙ্গ আর দেখালেন শেষ পর্যন্ত মরিয়া মানুষের মুসলমানদের বাঁচানোর জন্য দড়ি কেটে দেওয়ার চেষ্টাকে।

    Niaz Zaman সুন্দর বলেছেন এ বইটি সম্পর্কে—'Singh's story is a masterwork of narration, blending the land and the people with the story of communal differences and the story of how partition changed everything.' (A Divided Legacy - The Partition in Selected Novels of India, Pakistan, and Bangladesh - Niaz Zaman, Manohar, 2000, Pg. 41) যদিও উপন্যাসটির শেষ ট্রাজেডিতে তথাপি লেখক আদ্যন্ত দেখাতে চান দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্ক সবসময় খারাপ ছিল না। তাঁর বর্ণিত গ্রামের বাসিন্দারা, শিখ ও মুসলমানরা, সহিষ্ণু, হয়তো সবসময় মিত্রভাবাপন্ন নয়। তিনি দেখান গ্রামে যাবতীয় কিছু বিপর্যয়ের পিছনে আছে বাইরের লোক, বা ডাকাত, যারা ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি করতে চান। এটা অবশ্য ইতিহাসসিদ্ধ নয়, কারণ, দেশনেতৃবৃন্দের কলকাঠি নাড়া, সম্পর্ক বদল, সিদ্ধান্ত বদল এ সব তো ইতিহাসের পরিচিত ব্যাপার। যে কোনো কারণেই হোক খুশবন্ত এই ভারতবর্ষীয় রাজনীতিকে এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলেন। বড়ো জোর একটা যুবকের মুখ দিয়ে বলান—'তোমরা কি মনে করো সরকার কিছু করবে? এটা হচ্ছে কাপুরুষ বেনিয়া সুদখোর মহাজনদের সরকার।' দোষ চাপানো হয় নারী ও ক্ষমতালোভী মুসলমান বিদ্বেষী জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কমিশনার হুকুম চাঁদের ওপর। চরিত্রায়ন প্রসঙ্গে বলা যায় -- টুকরো টুকরো ভাবে অনেকগুলো চরিত্র জীবন্ত করা সম্ভব হয়েছে। বিশেষতঃ অন্ধকারে হারিয়ে যেতে থাকা নূরান, যার বাবা ছিল গ্রামের মুসলমান নেতা, যার পেটে জুগগার বাচ্চা, যে গ্রাম থেকে চলে যাবার আগে জুগগার বাড়িতে আসে, গাল খেয়েও বাস্তবটা জানায়, গভীর আবেগে বৃদ্ধা মহিলাকে জড়িয়ে ধরে এবং সৎ শ্রী আকাল বলে বের হয়ে যায়। মিত সিং চরিত্রায়নে ঝামেলা আছে। এক সময়ে বলা হয় লোকটা চাষী, কাজ ফাঁকি দেয়ার জন্য ধর্মের আশ্রয় নিয়েছে। পরে দেখা যায় আসন্ন গণহত্যার মুখে, সে গ্রন্থসাহেব পাঠ ক'রে মানুষের প্রতি ঈশ্বরের কৃপাদৃষ্টির কথা বলেন, হুকুম চাঁদের কথায় সে 'বুড়ো আহম্মক' বা 'ভালো মানুষ বুড়োটা'। ইকবালের চরিত্রায়নও দ্বিধান্বিত। তার সেবাধর্ম, তার সাম্যবাদ, তার কার্যকলাপ কোনো স্পষ্টমুখ নয়, তার সম্পর্কে লেখকের অ্যাটিচুড অস্পষ্ট। তবে বইয়ের বর্ণনাংশ, লোকজনের সারল্য, বিমূঢ়তা, বেদনা, আর্তনাদ উপস্থাপনে লেখকের কলমের প্রশংসাই করতে হয়।

    দেবেশ রায় 'রক্তমণির হারে' নামে দেশভাগের গল্প সংকলনের প্রসঙ্গে বলেছিলেন, এ ধরনের গল্পে বা উপন্যাসে ট্রেনের বা পথের মেটাফর বহুদৃষ্ট হয়। কথাটা যথার্থ। কেন ট্রেন, কেন পথ এ ধরনের লেখায় গুরুত্বপূর্ণ? সহজ উত্তর বোধকরি দেশান্তরী হবার পথে ট্রেন যেমন বহনমাধ্যম হয়ে ওঠে, পথ তেমনি হতভাগ্য মানুষের বাঁচার ক্ষেত্রে মাধ্যম হয়, পথেই কতো লোক মরে, ধর্ষিত হয়, কেউ কেউ স্রেফ ভাগ্যের জোরে ট্রেন বা পথ ধরে পৌঁছে যেতে পারে জীবনের কাছে।

    খুশবন্তের এ-উপন্যাসে আমরা পাঠকরা লক্ষ্য করব নানাভাবে ট্রেনের ইমেজ উপন্যাসটিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। লেখক যে গ্রামের কথা বলেন সেই মানো মাজরা গ্রামের জীবনযাত্রা চলত ধীর কদমে, তাদের জীবনের রুটিন নির্ণীত হত ট্রেন আসা-যাওয়া ধরে। উপন্যাসের প্রারম্ভে আমরা দেখব বড়ো ট্রেন সাধারণতঃ এখানে থামে না, কিন্তু ছোট ট্রেন আসে, যায় যথানিয়মে। কিন্তু চল্লিশ দশকের শেষ দিকে ট্রেনের সময় হয়ে পড়ল এলোমেলো। শেষ পর্যন্ত ট্রেন হয়ে ওঠে দানব, যা মানো মাজরা গ্রামের সংহতি ধ্বংস করে দেয়। মানো মাজরার লোকজন 'ট্রেন সম্পর্কে বেশ সচেতন' ছিল। মেল ট্রেন রেলসেতুর কাছে পৌঁছানো, দুবার হুইসেল বাজানোর সময়ই লোকজন জেগে উঠে পড়ে, কাক ডাকতে শুরু করে, বাদুড় বটগাছে জায়গার জন্য বিবাদ শুরু করে, মুসলমানরা ফজরের নমাজের জন্য তৈরি হতে থাকে। সকাল সাড়ে দশটার সময় লোকাল ট্রেন এলে মানুষজনের 'অলস কর্মসূচী' চলতে থাকে, দুপুরের মেল ট্রেন চলে গেলে গ্রামবাসীরা বিশ্রামের জন্য থাকে, পুরুষ, শিশু, কিশোররা ঘরে আসে দুপুরের খাবার খেতে, বিশ্রাম করতে, তারপর বটের ছায়ায় জিরোনো, কথা বলা। সন্ধেয় লাহোর থেকে লোকাল ট্রেনটি এলে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে গরু মোষ দুধ দুইয়ে বাড়ি ফিরোনোর জন্য, তারপর রান্না, খাওয়া, ছাদে জড়ো হওয়া। মালগাড়ি গেলে সবাই সবাইকে জানান দেয়—'শুভরাত্রি' বলার মতো। রাতের অবশিষ্ট ট্রেনগুলোর অতিক্রমের সময় শুধু কুকুরের ঘেউ ঘেউ। এই ছিল ১৯৪৭ গ্রীষ্মপূর্ব সীমান্তবর্তী এই ছোট্ট গ্রামের অবস্থা। জুগগত সিং এর মতো ডাকাতের জন্যও 'রাতের ট্রেনের আগমন ছিল একটি সংকেত', তারা তৈরি হয়। ট্রেন, রেললাইন, সেতু বলা যেতে পারে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত মেটাফর। আর সেতুর পাশেই ম্যাজিস্ট্রেট হুকুম চাঁদের রেস্টহাউস। ডাকাতি ও লালা হত্যার পর স্টেশনে লোকের ভিড় বাড়ে। গ্রামের কিছু লোক সকাল সাড়ে দশটায় দিল্লী থেকে লাহোরগামী লোকাল এলে স্টেশনে হাজির থাকে। তারা তর্ক করতে ভালোবাসে কোনো একটা ট্রেন কবে কবে ঠিক টাইমে কবে বেঠিক টাইমে এসেছিল এ নিয়ে। এবার শুরু হল ভারত থেকে পাকিস্তানে, পাকিস্তান থেকে শরণার্থীদের আসা যাওয়া, ছাদে গাদাগাদি করে যাওয়া। লোকে এসব দেখে। ট্রেনে করেই এ গ্রামে এলো ইকবাল সিং, সমাজকর্মী সে, দেশভাগের রক্তপাত বন্ধ করতে কিছু করতে চায়। দু এক দিনের অভিজ্ঞতায় ইকবালও 'বিস্তীর্ণ সমতল দিয়ে ধাবমান ইঞ্জিনের শব্দে নিঃসঙ্গ অবসাদগ্রস্ত বোধ করল।' মনে হল তার — এই বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডে দাঙ্গা বন্ধ করতে সে পারবে না। উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্ব (কলিযুগ) থেকেই ট্রেনের সময়সূচি হয়ে গেল 'উলটো পালটা'। বন্ধ হলো মালগাড়ির আসাযাওয়া। ফলে গ্রামবাসীর জীবনে ট্রেনের প্রভাব কমে এল, এমনকি 'স্বপ্নে ব্যাঘাত ঘটতে শুরু করল'। একসময় এখানে পাকিস্তানগামী ট্রেনের চালক ও গার্ড পরিবর্তন করা হত এখানে। এবার পাকিস্তান থেকে এল একটি ট্রেন, 'ভুতুড়ে ট্রেন', যাতে শব বোঝাই, পুলিশের নির্দেশে যে ট্রেনের শব দাহ করা হল কেরোসিন ও কাঠ দিয়ে, 'মাংস দগ্ধ হওয়ার কটু গন্ধ' বুঝিয়ে দিল ধর্মান্ধ হত্যা শুরু হয়ে গেছে ব্যাপকভাবে। এর পরই পাকিস্তান-চেতনার চাপ পড়তে শুরু করল গ্রামবাসীর জীবনে। উপন্যাসের শেষে গণহত্যার পরিকল্পনা, পালটা নেবার প্রস্তুতি শুরু হল ট্রেন নিয়েই। সেতুতে বাঁধা হবে দড়ি, যাতে চলন্ত ট্রেনের ছাদ থেকে কিছু মানুষ ধাক্কা খেয়ে পড়ে শতদ্রুর জলে, তারপর গুলি চলবে ট্রেনের কামরার জানলা লক্ষ্য ক'রে। জুগগত অবশ্য ট্রেন আসার সময় সেতুতে বাঁধা দড়িটা কেটে দেবার চেষ্টা করেছিল। সে প্রমাণ রাখতে চেয়েছিল তার ঘরে চুড়ি ছুঁড়ে দিয়ে মাল্লি যে বিদ্রুপ করেছিল তা তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কিন্তু তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। শেষ পর্যন্ত আর এক গণহত্যার হিংস্র নমুনা নিয়ে 'ট্রেনটি তার উপর দিয়ে গেল এবং পাকিস্তানে চলে গেল।' শুরুতে ছিল নিঃশব্দ ট্রেন, শেষেও তাই।

    উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্বে আছে একটি বর্ষার কথা। এই বর্ষার যে বিস্তৃত বর্ণনা, তার প্রভাব ও শেষপর্যন্ত মানুষের সকল আশা হারিয়ে ফেলার কথা আছে। বর্ষার আনন্দ, বর্ষা সঞ্জাত হতাশার সঙ্গে যুক্ত হয় বজ্রপাতের প্রচণ্ড শব্দ — যা গ্রামবাসীদের ম্যাজিস্ট্রেটের জীবনে অভিঘাত সৃষ্টি করে। উপন্যাসে তো লেখক প্রকৃতির বর্ণনাকে অনাবশ্যকে করে তুলতে চান নি। শ্লেটের মতো ধূসর আকাশের কথা তো শুধু শুধু বলেন নি লেখক। হুকুম চাঁদের বৃষ্টি দেখা উদাস ভাবে — এটাই স্বাভাবিক। যদি বর্ষা হয় আসন্ন দুর্বিপাকের, হিংস্রতার উদ্বেলতা, যদি বজ্রপাত হয় আকস্মিক আঘাতের দ্যোতক তাহলেই উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় তাৎপর্যের সঙ্গে তা অন্বিত করা যায়। এর পরে (অর্থাৎ ৩য় পর্বে) যখন হিন্দু বা মুসলমান দু দলেরই কাটাকাটি, পলায়ন শুরু হয়ে গেছে তখন লেখক বলেন — 'রাতটা বিষণ্ণ অন্ধকারে ঢাকা। যে বাতাস মেঘ উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল তা আবার ফিরে এলো।' আমরা বলতেই পারি আসন্ন ভবিতব্যের আবহ নির্মিত হচ্ছে, প্রকৃতিতে তারই স্বাক্ষর। গর্ভবতী নূরান গ্রাম ছাড়ার কালে 'বৃষ্টির মাঝেই বেরিয়ে পড়লো জুগগার বাড়ির দিকে। রাস্তায় অনেক লোককে অতিক্রম করলো সে। চটের বস্তা দিয়ে মাথা ঢেকে তারা যাচ্ছে। পুরো গ্রাম জেগে আছে।' এ বর্ণনাও বিপদ-বৃষ্টির দিকেই ইঙ্গিত দেয়। তারপর — 'সারারাত থেমে থেমে বৃষ্টি হলো। খুব সকালে প্রবল বর্ষণ। গ্রামবাসী যারা সারারাত প্রায় জেগে কাটিয়েছে তারা বৃষ্টির একঘেঁয়ে শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লো।' বৃষ্টির এ বর্ণনার পরই পাকিস্তানে মুসলমান পাঠানোর প্রস্তুতি। শেষ পর্বেও শুরুতেই আমরা দেখব অব্যাহত বর্ষণ, গ্রামের ফসলী মাঠের বিচ্ছিন্নতা, ট্রেনের আসা যাওয়া বিরতি, নদীতে জলের প্রাবল্য, 'সেতুর স্তম্ভগুলো দৃঢ়কঠিন এবং নদীকে প্রবলভাবে প্রতিরোধ করছে।।' এসব কথা ও হিংসার প্রবর্ধমান প্রাবল্য ও প্রতিরোধের ইঙ্গিত রাখে।

    উপন্যাসটির কেন্দ্রে রয়েছে ৪৭ পরবর্তী ভারতবর্ষে হিংস্র ধর্মান্ধতার বলি হিন্দু এবং মুসলমান দুই ভিন্ন ভিন্ন ট্রেন ভর্তি শব। এরকম ঘটনা যে সে সময় ঘটেছিল তার প্রমাণ আছে। পেণ্ডেরেল মুন তাঁর সে সময়কার স্মৃতি ইতিহাসে ঠিক এই ধরনের শবপূর্ণ ট্রেন স্বচক্ষে দেখেছিলেন একথা বলেছেন। কৃষণ চন্দরের 'পেশোয়ার এক্সপ্রেস' নামক বিখ্যাত গল্পটির বিষয়ও ধর্মান্ধতার বলি এক ট্রেন ভর্তি শব। সুতরাং খুশবন্ত যে বাস্তবতার ওপর ভিত্তি করে কাহিনীটি সাজিয়েছেন তাতে সন্দেহ নেই। বাস্তবতাকে মর্মস্পর্শী করা, বাস্তবতাকে শিল্পসম্মত করার কৌশল তিনি রপ্ত করেছিলেন।

    'আউটলুক' পত্রিকার এডিটরিয়াল চেয়ারম্যান বিনোদ মেহতা বলেন — 'Khushwant Singh wore three hats — scholar, journalist and jester, in all three, he was a spectacular success.' এই সাফল্য — সামাজিক মানুষের মাথা ঘুরিয়ে দেয়। ফলে ট্রেন টু পাকিস্তান উপন্যাসের লেখক হারিয়ে গেলেন, শিখ জাতির ইতিহাস রচয়িতা লেখক হারিয়ে গেলেন। ইতিমধ্যে হয়ে উঠলেন নারীপ্রিয়, দেশনেতাপ্রিয় সাংবাদিক। জরুরী অবস্থার সমর্থক শুধু নন, নিজেকে ডিফেণ্ড করে একটা আস্ত বইও লিখতে হল। বাকি রইল কোর্ট জেস্টার-এর ভূমিকা। এই স্ফুলিঙ্গ-জীবন, স্কচশাসিত, নারী পরিবৃত জীবন, চমকপ্রদ বক্তব্য মাধ্যমে বিনোদন সর্বস্ব হয়ে ওঠাই হয়ে উঠেছিল তাঁর স্বেচ্ছারচিত ভবিতব্য।



    অলংকরণ (Artwork) : অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments