(মুখবন্ধ - এই নাটকটির ঘটনাস্থল কলকাতা। গড়িয়াহাট থেকে বৈষ্ণবঘাটা অবধি ইস্টার্ন বাইপাসের দুপাশ বেয়ে এলোমেলো শহররতলি গত কয়েক দশকে বেমালুম ভোল পালটে ফেলেছে। পুকুর, ডোবা বুজিয়ে, চাষের জমি আর বেওয়ারিশ মাঠঘাট দখল করে মাথা তুলেছে বিরাট বিরাট সব আবাসন প্রকল্প, তার আশেপাশে ছোটো প্রমোটারদের বানানো আধাখ্যাঁচড়া ফ্ল্যাটবাড়ি, সিমেন্ট-বালির গাদা, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, বিজ্ঞাপনের বোর্ড আর খুচরো দোকানবাজার। এইসব কাণ্ড শুরু হবার আগেও অবশ্য ওই তল্লাটে কিছু মানুষজন ছিল। ধরে নেওয়া যায় যে তারা জমি-বাড়ি চড়া দামে বেচে নানা ধান্ধায় দুপয়সা কামিয়ে একরকম ভালোই আছে। সবজায়গাতেই অবশ্য কিছু কিছু বেখাপ্পা লোক থাকে তাদের নিয়েই যত্তো ঝামেলা। আমাদের রিকশাওয়ালা বাচ্চু মণ্ডল সেইরকম একজন বেখাপ্পা লোক।)
(চায়ের দোকান। চেয়ার টেবিল পাতা। প্রবেশ, বলাই ও রিংগো। ওরা চেয়ার টেনে বসবে)
বলাই:রিংগো কালকের কাজটা ঠিকমতো হয়েছে?
রিংগো: কি যে বলেন বড়দা। আমার কাজ ঠিকমতো হবে না? এই তল্লাটে আমি থাকতে আপনার কোনো চিন্তা নেই। শুধু আপনাদের ওই কাউন্সেলর চ্যাটার্জিবাবুকে একটু সাবধানে হ্যান্ডল করতে হবে।
বলাই: ওটা আমার ওপর ছেড়ে দাও। তুমি কাগজপত্র সব উকিলবাবুকে বুঝিয়ে দেবে, আর মিস্তিরিদের সাথে রেটটা ঠিক করে রাখো। পূজার পরেই দুর্গা দুর্গা বলে নেমে পড়তে হবে।
রিংগো: আজ্ঞে, কোনো অসুবিধে হবে না। দু-একটা খুচরো ঝুপড়ি বাদ দিলে, বাকি পুরো একশো একর জমি আপনার হাউজিং প্রজেক্টের জন্য পরিষ্কার।
বলাই: দু-একটা ঝুপড়ি মানে? দেখো বাপু আমার কিন্তু কাগজপত্রে কোনো গোলমাল থাকলে চলবে না। কোটি কোটি টাকার প্রজেক্ট, বিদেশি ব্যাঙ্কের ক্যাপিটাল, এন আর আই ক্লায়েন্ট, এখানে বাজে পাবলিসিটির কোনো জায়গা নেই। যা করার সাবধানে করবে।
রিংগো: আপনার স্যার এখনো আমার ওপর ভরসা হলনা। ওরকম দু-একটা উটকো লোক সব জায়গাতেই থাকে, নরমে-গরমে বশে আনতে হয়। আর বেশি বেগড়বাঁই করলে কড়া ওষুধের ব্যবস্থা তো আছেই।
বলাই: থাক আর মাস্তানি করতে হবে না। বুঝিয়েসুজিয়ে রাজি করাও। আমি পরের হপ্তায় ব্যাঙ্কের লোকজন নিয়ে ইনস্পেকশনে আসবো। (প্রস্থান। উল্টোদিক থেকে বাচ্চু মণ্ডল ও রিয়া বসু ঢোকে)
বাচ্চু: রিংগোদা, একটু শোনেন
রিংগো: (রিয়াকে দেখে একটু হকচকিয়ে যায়) আরে বাচ্চু দেখছি। তা মত বদলালো নাকি? ঝুপড়িটার মায়া কাটলো?
বাচ্চু: আজ্ঞে সেইজন্য না। এই দিদিমণি আমার রিক্সায় উঠেছিলেন, বিদেশ থেকে এইয়েছেন তো ঠিকানাটা ঠিকঠাক বলতে পারতেছেন না।
রিয়া: হাই। আমার নাম রিয়া, এখানে নিউ লাইট বলে একটা অর্গানাইজেশন আছে, আই অ্যাম লুকিং ফর দেয়ার অফিস।
রিংগো: নিউ লাইট? ও বুঝেছি। ওই যে রাস্তার বাচ্চাগুলোকে পড়ায়, মাঝে মাঝে বাইরে থেকে সাহেব-মেমেরা আসে, ওটাই তো?
রিয়া: হ্যাঁ ওটাই। আমি নিউইয়র্কে থাকি এখানে কয়েক মাসের জন্য এসেছি অ্যাজ ভলান্টিয়ার।
রিংগো: ওর আবার অফিস। ওই শেতলা মন্দিরের পাশে ভাঙা বাড়িটার দোতলায় ক্লাস বসে। তবে ওটা তো আর বেশিদিন থাকবে না। যাও হে রতন, দিদিমণিকে শেতলা মন্দিরে নিয়ে যাও। আর আমার কথাটা মনে রেখো, নইলে পস্তাবে। (প্রস্থান)
বাচ্চু: আইসেন দিদিমণি এবার বোঝাতে পারছি।
রিয়া: চলুন। আচ্ছা উনি কেন বললেন যে ওটা বেশিদিন থাকবে না? হি অ্যাপিয়ারড টু বি আপসেট।
বাচ্চু: ওরা হইলেন গিয়ে প্রমোটার, এখানে নতুন সব ফ্ল্যাটবাড়ি হচ্ছে তো, পুরনো একতলা বাড়ি সব বিক্কিরি হয়ে যাচ্ছে। সে অনেক গল্প দিদিমণি, আপনার সময় নষ্ট হবে। আপনি চলেন।
রিয়া: না না আই ওয়ান্ট টু নো। ও আপনাকে কি যেন বলছিল?
(দুজনে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে যায়। পর্দা নেমে আসে)
(বাচ্চুর ঘর। ছোটো একটা খাট, আলনা, চেয়ার-টেবিল, একদিকে উনুন, রত্না রান্না করছে। বিশু খাটের ওপরে শুয়ে)
রত্না: শুনেছো। রিংগোদাদা আসছে, সঙ্গে আরো কজন ভদ্রলোক আসবেন, তুমি একটা ভালো জামা পরে নাও। আমি লুচি-ক'টা ভেজে ফেলি।
বাচ্চু: এই নিয়ে দুবার হলো। সকালবেলায় কাজ নষ্ট, বাচ্চাগুলোর স্কুলে যেতে দেরি। আমার যা বলার তো বলে দিয়েছি, ওঁরা খামোকা জবরদস্তি করছেন।
বিশু: শোনলাম নিউটাউনে নাকি এক মস্ত হোটেল করছিলো গিয়া। রিসর্ট না কি যেন কয়। সেখানে কিসব গণ্ডগোল হইছে, বাবুগো সঙ্গে গেরামের লোকেদের। কি যে হইত্যাসে আজকাল।
রত্না: কি হচ্ছে? তোমাদের মতো আহাম্মকেরা ছাড়া বাকি সবাই দুটো পয়সা করার চেষ্টা করছে। আরে বড়ো ফ্ল্যাটবাড়ি হবে, দোকানবাজার বসবে, এতে দোষটা কোথায় শুনি? তোমরা বাপ ব্যাটায় বসে থাকো তোমাদের কুঁড়েঘর আর ওই সাধের রিকশা মাথায় করে।
বিশু: ওই কথা কইয়োনা বৌমা। ওপার থিক্যা সব খোয়াইয়া আইছিলাম। তোমার সোয়ামি তহন এইটুকুন পোলা। আমি রিকশা ধরলাম, তোমার শাশুড়ি বাড়ি বাড়ি কাজ নিলো —
রত্না: জানি। হাজারবার শুনেছি। ওই রিকশা তোমাদের অন্নদাতা, তোমরা আগে অন্যের রিকশা চালাতে, অনেক কষ্ট করে পয়সা জমিয়ে এখন ওটার মালিক হয়েছো। এই জবরদখল জমিতে ঝুপড়ি করে থাকতে, এখন পাট্টা নিয়ে পাকা ঘর তুলেছো। এই ঘরে মা মারা গেছিলেন। সব জানি। কিন্তু এসব কথায় পেট ভরেনা।
বাচ্চু: কিন্তু রত্না, এই ঘর বিক্কিরি করে যে টাকা পাবো তাতে তো সারা জীবন চলবে না। রিকশা তো আমায় চালাতেই হবে। আশপাশে সব ঝাঁ-চকচকে বাড়ি উঠতেছে, সেসব জায়গায় তো আমরা থাকতে পারবো না। নতুন জায়গায় রিকশা চালানোর অনেক ঝক্কি।
রত্না: কোথাও যেতে হবে না, শুধু আমাকে কথাবার্তা বলতে দাও। নিজেরা বুদ্ধি খেলিওনাকো। (কড়া নাড়ার আওয়াজ) ওই যে ওঁরা এসে পড়েছেন। (দরজা খুলে দেয়, বলাই আর রিংগো ঢোকে) আসুন আসুন।
রিংগো: এই দেখো হে বাচ্চু, সাহেব নিজে তোমার সঙ্গে কথা বলতে এসেছেন।
বাচ্চু: আসুন স্যার, আপনাদের শুধু শুধু কষ্ট হলো। আমাকে ডেকে নিতেন।
রত্না: আমাদের সৌভাগ্য, আপনারা এসেছেন। গরীবের ঘরে আগে একটু মিষ্টিমুখ করতে হবে। রিংগোদা তোমার জন্য লুচি ভেজেছি।
(সবাই বসে। খাবারে প্লেট, চা ইত্যাদি দেওয়া হয়)
বলাই: দেখো বাচ্চু আমি চাই এই প্রকল্প থেকে তোমাদেরও লাভ হোক। তুমি কেন বুঝতে চাইছনা বলতো। এতো বড়ো রাস্তা হয়েছে, এখন শহরতলির চেহারাটাই পালটে যাবে। বিদেশ থেকে ডলারওয়ালা বাবুরা আসবেন। তোমাকে যা টাকা দেবো তাতে তুমি একটা নতুন ব্যবসা খুলতে পারবে।
বিশু: আমরা যে আর কোনো ব্যবসা জানি না বাবু।
রত্না: বাবু চুপ করো দেখি! স্যার আপনি কিছু মনে করবেন না, বুড়োমানুষ তো। আপনি এসেছেন এবার নিশ্চয় একটা ব্যবস্থা হবে। বলো না রিংগোদা (চোখ মারে)
রিংগো: হ্যাঁ মানে বৌদি বলছিলেন ওঁরা এই বাড়িটা ছেড়ে দেবেন কিন্তু নতুন বাড়িতে ওদের একটা ফ্ল্যাট দিতে হবে।
বাচ্চু: আ-আমিতো এমন কথা বলি নাই!
রত্না: (ঝাঁঝিয়ে ওঠে) চুপ করো, একটাও কথা মনে থাকে না তোমার। কতবার বলেছি ওই খোট্টাটার সাথে বসে মদ গিলোনি। (গলা বদলে) স্যার ছোট বোনের এই আবদারটুকু রাখতে হবে। আমার অনেক কালের শখ একটা ফেলাটে থাকবো।
বলাই: বলো কি হে? কোটি টাকার ফ্ল্যাট, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, এন. আর. আইদের বুড়ো বাবা-মা এরা সব থাকবেন। তুমি বরং আরেকটু দক্ষিণে চলে যাও, ওখানে আমার কিছু সস্তাদরের ফ্ল্যাট হচ্ছে, আমি ওখানে ব্যবস্থা করে দেবো।
রত্না: (আদুরে গলায়) না আমার শখ হয়েছে এখানেই থাকবো। একটা ঝকঝকে নতুন ফেলাট, আলো, হাওয়া খেলবে, আমার ছেলেটার জন্য একটা আলাদা পড়ার ঘর আর বারান্দায় অনেক ফুলগাছ। আপনি চাইলে কি না হয় স্যার? রিংগোদা তুমি সাহেবকে একটু বুঝিয়ে বলোনা।
রিংগো: তাইতো, এন. আর. আইয়ের পাশে রিকশাওয়ালা। দেখি কি করতে পারি। স্যার আপনার পয়লা কাজটা তো হয়ে গেল। আপনি কাগজপত্তর ঠিক করুন, আমি বৌদির সাথে আরেকটু কথাবার্তা চালাই (চোখ মারে)
বাচ্চু: রত্না আমি তো এইসব কিছুই জানিনা। তুমি কি নিজে নিজেই কথা চালাচ্ছো নাকি?
রত্না: চালাতে তো হবেই। তুমি তো ঘাড় বেঁকিয়ে বসে আছো, তার ফল কি হবে জানো?
বাচ্চু: কি হবে? জোর করে উঠিয়ে দেবে। দেশে আইন নাই?
রিংগো:আইন দেখাচ্ছো? এই জমিতে ধান চাষ হতো। তোমরা যখন উড়ে এসে জুড়ে বসলে তখন আইন কোথায় ছিল?
বিশু: (চেঁচিয়ে) আমাগো উপায় ছিল না। পোয়াতি বৌটা প্ল্যাটফর্মে পইর্যা ছিল।
বলাই: (দাঁড়িয়ে উঠে) দেখো তোমাদের ঘরোয়া কথাবার্তার মধ্যে আমি থাকতে চাইনা। রিংগো কাগজপত্র রেডি হলে জানিও, আমার অফিসে বসে কথা হবে।
রত্না: রাগ করে চলে গেলে খুব দুঃখ পাবো স্যার। (বাচ্চুকে) ছি ছি মানী লোকের মান রাখতে পারোনা। বাবাকে নাহয় বাহাত্তুরে ধরেছে, তোমারও কি আক্কেল বলে কিছু নেই। এমন সুযোগ জীবনে দুবার আসেনা। রিংগোদা তোমরা এখন খাওয়াদাওয়া করো, কালকে আমি কাগজপত্র নিয়ে সাহেবের অফিসে যাবো এখন। তুমি আমাকে দশটা নাগাদ তুলে নিও।
বাচ্চু: (হতাশভাবে) স্যার আমাকে মাপ করুন, ছোটমুখে বড়ো কথা বলে ফেলেছি। আমি বরং এবার কাজে বেরুই। দিদিমণিকে ইস্কুলে পৌঁছে দিতে হবে। (বেরিয়ে যায়)
রত্না: সেই ভালো তুমি রওনা হও।
বলাই: (রত্নাকে) আপনাকে তো বেশ চালাকচতুর মনে হচ্ছে। আপনি তাহলে আপনার স্বামীকে বুঝিয়েসুঝিয়ে রাজি করান। আমরা উঠি।
রিংগো: রেডি থেকো, কালকে ঠিক দশটায়।
(রিংগো আর বলাই বেরিয়ে যায়। বিশু ঘুমিয়ে পড়েছে, নাক ডাকছে)
রত্না: যত সব অপদার্থের ঢেঁকি। শুনে রাখো আমি এখানেই থাকবো, বড় ফেলাটে, আমার ছেলে ইংরাজি স্কুলে যাবে। হেঁশেল ঠেলে আর অন্যের ঘর ঝাঁট দিয়ে অনেকখানি কাটিয়েছি, আর নয়। আমারও সাধ আহ্লাদ আছে। এই বলে রাখলাম।
বিশু: (শব্দ করে হাই তোলে) অ বৌমা এক গেলাস জল দ্যাও।
রত্না: ওই। ছেলে বেরুল আর শুরু হল বুড়োর ফাইফরমাশ। বিনে মাইনের ঝি আমি।
(গজগজ করতে করতে বেরিয়ে যায়। পর্দা নেমে আসে)
(বিমান দাশগুপ্তের বৈঠকখানা। বিমান, নন্দনা ও রিয়া)
নন্দনা: শুনছো। রিয়াকে বলোনা আজ সন্ধ্যায় বাড়ি থাকতে। মেয়েটার জন্মদিন, রোহিণী আর অনিন্দ্যকে ডেকেছি, রিয়ার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবো।
রিয়া: কাকিমা, স্কুল শেষ হলেই চলে আসবো।
নন্দনা: ওই তো স্কুল। একদিন বন্ধ রাখলে কি হয়। বস্তির বাচ্চাদের বিনাপয়সায় পড়াচ্ছিস, বই কিনে দিচ্ছিস, তাই তো অনেক।
রিয়া: কাকিমা, ইট ইজ মাই জব। আমি ইচ্ছেমতো ছুটি নিতে পারিনা।
বিমান: রিয়া বি ক্যালকাটান হোয়েন ইউ আর ইন ক্যালকাটা। ডুব মেরে দে, আমি ফোন করে দিচ্ছি তোর শরীর খারাপ। লেটস সেলিব্রেট ইয়োর বার্থডে।
রিয়া: ইউ টু কাকু! এই না ওয়ার্ক কালচার নিয়ে এতো কথা হলো। এখন আমার খারাপ লাগছে। তোমরা এতো অ্যারেঞ্জমেন্ট করেছো কিন্তু আই কান্ট টেক টাইম অফ লাইক দ্যাট। আমার স্টুডেন্টরা একেবারে ডেস্টিটিউট, স্ট্রীট কিডস, মেনি অফ দেম আর ফ্রম দা রেড লাইট এরিয়া। ওদের একসাথে করাই একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ, আই কান্ট ক্যান্সেল দেয়ার ক্লাস ফর আ পার্টি।
নন্দনা: শোনো মেয়ের কথা। একেই তো ভয়ে আমার বুক শুকিয়ে আছে, পাড়াটা একেবারেই ভালো না, সেখানে মেয়েটা রোজ রাত অবধি বসে থাকে। চারদিকে মাতাল, বদমায়েশের ভিড়। আরে শুনছো, ও নাহয় নিউইয়র্কের মেয়ে, এখানে আমাদের তো একটা দায়িত্ব আছে। একটা কিছু হলে দাদাকে মুখ দেখাতে পারবে তুমি?
রিয়া: (নন্দনাকে জড়িয়ে ধরে) কিছু হবে না কাকিমা। আই ক্যান টেক কেয়ার অফ মাইসেলফ। তার ওপর যা একখানা বডিগার্ড দিয়ে দিয়েছো।
বিমান: বডিগার্ড আবার কে?
নন্দনা: ওই আমাদের রিকশাওয়ালা বাচ্চু। খুব বিশ্বাসী লোক, এ পাড়ার সব বাচ্চাদের ও স্কুলে পৌঁছে দেয়। ওকে বলে দিয়েছি সবসময় নজর রাখবে, দিদিমণি বিদেশ থেকে এসেছে, ছেলেমানুষ।
রিয়া: ছেলেমানুষ। হা হা, আমি নিউইয়র্ক সিটিতে কলেজ যাই কাকিমা।
নন্দনা: তা বাপু সেটা আমেরিকা। এদেশে মেয়েদের কোনো নিরাপত্তা নেই। আমি কোনো কথা শুনতে চাইনা তুমি সাতটার মধ্যে চলে আসবে।
রিয়া: সরি কাকিমা। আই উইল ট্রাই সাড়ে-সাতটা। জাস্ট ফর ইউ। বাই (প্রস্থান)
নন্দনা: শুনলে!
বিমান: ওরা অন্য পৃথিবীর মানুষ নন্দনা। তুমি চিন্তা কোরোনা, ওই স্কুলটার জন্য ওখানে বিদেশ থেকে লোকজন আসে, বস্তির লোকেরাই ওদের প্রটেকশন দেয়। (উঠে জানলার কাছে যায়) তাছাড়া ওই বস্তিও আর বেশিদিন নেই। ওই দ্যাখো কি বিরাট ক্রেন এসে হাজির হয়েছে, কনস্ট্রাকশন শুরু হলো বলে। আমার আকাশটুকুও হারিয়ে গেল। ওইখানে তিরিশতলা কংক্রিটের দৈত্যরা মাথা তুলবে, তাদের ছায়ায় আমরা ইঁদুরের মতো—
নন্দনা: হ্যাঁ গো শুনছি নাকি আমাদের পাড়াতেও প্রমোটারের দালালরা আসছে আজকাল। ওই কমপ্লেক্স যারা করছে, তারা নাকি আরো একটা করতে চায়। এই শোনো, আমাদের বাড়ির দাম খুব বেড়েছে নিশ্চয়। দেখো না ঝোপ বুঝে কোপ মারা যায় কিনা।
বিমান: সারাজীবন চাকরির জন্য এদেশ ওদেশ ঘুরেছি। ইচ্ছা ছিল শহরতলির নির্জনে একটা ছোটো বাড়ি আর একটুখানি সবুজ আর দু-একজন মনের মতো প্রতিবেশী নিয়ে শেষ জীবনটা কাটাবো। বিশতলার ওপরে পেন্টহাউসে থাকতে চাইলে তো লণ্ডনেই থেকে যেতাম।
নন্দনা: ওই শুরু হলো। তোমার মতো পণ্ডিত লোক ইচ্ছা করলেই থেকে যেতে পারতো। লাভটা কি হলো শুনি? একমাত্র ছেলে তো বিদেশে চলে গেল।
বিমান: ও ঠিকই করেছে। ওদের প্রজন্মের ওপর আমার অনেক আশা। নতুন দুনিয়া, নতুন সংস্কৃতির সঙ্গে আমার ঝগড়া নেই। আমি যা ভালোবাসি, যে পরিবেশে আরাম পাই, তা আমার নিজস্ব ব্যাগেজ। স্মৃতি সততই সুখের নয় কিন্তু স্মৃতি সততই সঙ্গে থাকে।
নন্দনা: আমি রান্নাঘরের দিকে যাই। তুমি ওই দালালের সাথে একবার কথাটা বলেই দেখনা। আরে বাপু দামটা জেনে রাখতে তো ক্ষতি নেই। (প্রস্থান)
বিমান:
একদিন ম্লান হেসে আমি
তোমার মতন এক মহিলার কাছে
যুগের সঞ্চিত পণ্যে লীন হয়ে গিয়ে
অগ্নিপরিধির মাঝে সহসা দাঁড়িয়ে
শুনেছি কিন্নরকণ্ঠ দেবদারু গাছে
দেখেছি অমৃতসূর্য আছে
সব চেয়ে আকাশ, নক্ষত্র, ঘাস, চন্দ্রমল্লিকার রাত্রি ভালো
এই পৃথিবীর সব পরিচিত রোদের মতন তুমি দান করোনিতো
সুদর্শনা তুমি আজ মৃত।
নাঃ লাইনগুলো ভুলে যাই আজকাল। বুড়ো হয়ে গেছি। যুগের সঞ্চিত পণ্যে লীন।
(একটু নীরবতা। হই হই করে চ্যাটার্জি পরিবার ঢোকে। অনিন্দ্য, রোহিণী ও ঊর্মি। অন্যদিক দিয়ে নন্দনা)
নন্দনা:আসুন আসুন। আয় ঊর্মি, কেমন আছিস?
ঊর্মি: ভালো আছি কাকিমা। রিয়ার সঙ্গে আলাপ করতে এলাম।
রোহিণী: বাঃ ফ্ল্যাটটা তো বেশ গুছিয়ে নিয়েছো ভাই।
নন্দনা: কি যে বলো। এই তো ছোট্টো ফ্ল্যাট। হ্যাঁ দেখার মতো হলো তোমাদের বাড়ি। আসুন অনিন্দ্যদা, আজকাল তো আপনার দেখা পাওয়াই ভাগ্যের কথা।
অনিন্দ্য: আরে যতদিন অপোজিশনে ছিলাম, ভালো ছিলাম বুঝলে। এখন সরকারে গিয়ে হাজার গণ্ডা ঝুটঝামেলা। কই, আমাদের বার্থডে গার্ল রিয়া কোথায়?
নন্দনা: ও এই এলো বলে। তোমরা একটু বসো আমি চা নিয়ে আসি। নাকি হুইস্কি খাবেন অনিন্দ্যদা?
অনিন্দ্য: আরে বিমানের স্টকের ওপর আমার বরাবরের নজর। কিছু আছে নাকি বিমান?
বিমান: স্টক প্রায় শেষ হয়ে এলো। তাও কয়েকটা আছে বোধহয়। এই একটা ব্যলভানি, ডাবল উড, শেরি ফিনিশ।
অনিন্দ্য: (হুইস্কি খেতে খেতে) তুমি যাই বলো বিমান, দুপাত্তরের পর আমার তো সবই একরকম লাগে।
বিমান: ওটা ওরকমভাবে খায়না অনিন্দ্য। আস্তে আস্তে অনুভব করো ওর মধ্যে পাবে স্কটল্যাণ্ডের পাহাড় আর উপত্যকার গন্ধ, ব্যাগপাইপের সুর, ঝর্নার ধারে দুশো বছরের পুরনো ডিস্টিলারি। আ সেলিব্রশন অফ কালচার অ্যাণ্ড কন্টিনুইটি।
অনিন্দ্য: ওসব তোমাদের জন্য। আমি শুধু জানি যে মাথা ধরাটা কম হয়। সে যাকগে, ঊর্মির খুব আমেরিকা যাবার শখ, তোমার ভাইঝির কাছে কিছু টিপস নিতে চায়।
নন্দনা: নিশ্চই আরে ওইতো রিয়া এসে পড়েছে (রিয়া ঢুকছে) রিয়া আয় আলাপ করিয়ে দিই, অনিন্দ্যকাকু আর কাকিমা। আর এই হলো আমাদের মেয়ে ঊর্মি।
রিয়া: হাই। আমি রিয়া।
ঊর্মি: কেমন আছো রিয়া। শুনলাম তুমি এম. আই. টি.-তে যাচ্ছো। দ্যাটস সো কুল।
রিয়া: আমি আসলে এক বছর স্টপ গ্যাপ নিয়েছি। কিছু ভলান্টিয়ার কাজ করতে চাই। হয়তো সামনের বছর জয়েন করবো।
রোহিণী:তোরা বরং ওঘরে গিয়ে বোস। আমাদের বুড়োদের কথার মধ্যে বোর হতে হবে না।
রিয়া: না না আমরা এখানেই বসছি। অনিন্দ্যকাকু আই ওয়ান্টেড টু মিট ইউ। আমার একটা ব্যাপারে কিছু জানার আছে।
অনিন্দ্য: বলো বলো।
রিয়া: দি জেন্টলম্যান হু অপারেটস মাই রিকশা হ্যাজ আ প্রবলেম। কিন্তু যদি আমি কালকে আপনার অফিসে যাই। আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু স্পয়েল ইয়োর ইভনিং।
নন্দনা: শোন মেয়ের কথা। রিকশাওয়ালার প্রবলেম নিয়ে তোর মাথা ঘামানোর দরকার কি? আমাদের কাছে দুদিনের জন্য এসেছিস, তোকে নিয়ে কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয়নি। চল না এই উইকএণ্ডে সবাই মিলে বরং মন্দারমণি যাই, কি বলো রোহিণীদি?
ঊর্মি: খুব ভালো হবে তাহলে, তোমার সঙ্গে ভালো করে আলাপ করা যাবে। আই হ্যাভ অ্যান অফার ফ্রম সিসকো।
রিয়া: তাহলে কাল অফিসে?
অনিন্দ্য:আরে না না, বলোই না তোমার রিকশাওয়ালার কথা। আরে মানুষের কথা শোনাই তো আমাদের কাজ।
(সবাই মিলে কথা বলছে। তার মধ্যে পর্দা নেমে আসবে)
(চায়ের দোকান। বাচ্চু, মুন্না ও রিংগো।)
রিংগো: তোরা দুজনে আমায় বড্ড চাপে রেখেছিস কিন্তু। সোজা আঙ্গুলে ঘি তুলতে দিবিনা মনে হচ্ছে। টাকা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তবু তোদের খাঁই মিটছে না।
মুন্না: রিংগো ভাই, এ শুধু পয়সার মামলা থোড়াই আছে। হাম লোক অন্য কোনো ধান্ধা জানেনা। হামরা খেটে খাই, কারো কাছে ভিখ মাঙ্গেনা। এই এরিয়ার বাইরে চলে গেলে, ভিন মহল্লার রিকশাওয়ালারা আমাদের কাম করতে দিবে কি? লেড়কা-লেড়কি এখানে স্কুলে যায়, ওরা পড়ালিখা শিখবে, বড়ো হবে। আমাদের এই মহল্লাতেই থাকতে হবে।
রিংগো: ইয়ার্কি পেয়েছিস। এখানে কতো বড়ো বাড়ি হবে জানিস। এখানে তোরা থাকবি কি করে? সব কিছুর দাম বেড়ে যাবে আর রিকশা চড়ার কেউ থাকবেও না, সবাই গাড়ি চড়বে। আমি বলি কি তোরা বরং অটো চালা। আমি লাইসেন্স করে দেবো।
মুন্না:এ বাচ্চুভাই তুমি কিছু বাত করছো না কেন?
বাচ্চু: (হঠাৎ যেন চমকে উঠে) না মানে আমি তো ভালো কথা বলতে পারিনা। বউ বলেছে মুখ বন্ধ করে রাখতে। কিন্তু রিয়া দিদিমণি যে কথাটা বললো সেটা আমার মনে ধরেছে বটে।
রিংগো: তাই নাকি। কথাটা কি বলেই ফেলো তাহলে।
বাচ্চু: দিদিমণি বললো, এটা ইজ্জতের প্রশ্ন। কি যেন বললো কথাগুলো - (ধরে ধরে উচ্চারণ করে) প্রফেশনাল প্রাইড আর - হ্যাঁ সেলফ রেসপেক্ট। আরো কি বললো জানো। আজকাল নাকি সারা পৃথিবীতে যেখানে মানুষজন বেড়াতে যায়, সেখানে রিকশা ফিরে আসছে। রিকশা নাকি অটোর মতো তেল পুড়িয়ে জল-হাওয়া নষ্ট করে না। দুনিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বড়ো শহর নিউইয়র্ক তার চৌরঙ্গির নাম হলো গিয়ে টাইম স্কোয়ার। দিদিমণি বলেছে সেখানেও রিকশা চলে।
রিংগো: আমেরিকায় রিকশা। হা হা গুল মারার আর জায়গা পেলি না।
মুন্না: সাচ বাত রিংগো ভাই। হামাকে পিকচার দেখালো, সাহেব রিকশা টানছে।
রিংগো: (দাঁড়িয়ে উঠে গলা চড়ায়) তোদের খুব বাড় বেড়েছে দেখছি! তোরা বরং আমেরিকায় গিয়েই রিকশা চালা না, মাঝখান থেকে আমার কাজটা বরবাদ করছিস কেন? শালা এই এন. আর. আই. ফুটানো ক্লায়েন্টকে নিয়েই যত ঝামেলা হয়েছে, আগের দিন হলে কবে ঝেড়ে সাফ করে দিতাম, দুদিনে ওই জমি গড়ের মাঠ হয়ে যেত! এখন আবার নতুন দাদারা এয়েছেন। এই মুন্না তুই আমার সঙ্গে আয়তো। বাচ্চু তুই বরং বাড়ি যা, আমি ওবেলা তোদের বাড়ি যাবো এখন।
(রিয়া ঢোকে)
রিয়া: আরে আপনারা দুজনেই এখানে। আমাকে পৌঁছে দেবে কে শুনি?
রিংগো: মানে, ওদের একটু দরকারে ডেকেছিলাম আরকি? দিদি আপনি চান তো আমার বাইকে করেও পৌঁছে দিতে পারি।
রিয়া:থ্যাঙ্কস কিন্তু তার দরকার হবেনা। ওদের সঙ্গে যেতে আমার ভালো লাগে, অনেক কিছু শেখা যায়। শুনলাম আপনি ওদের সাথে নেগোশিয়েট করছেন, ওই জমিটা নিয়ে। অনিন্দ্যকাকু, মানে আপনাদের কাউন্সেলরের সাথে আমার কথা হয়েছে।
রিংগো: (দর্শকের দিকে) সর্ব্বনাশ, জল অ্যাদ্দুর গড়িয়েছে। বলাইদা যে বলল, কাউন্সেলর অলরেডি ম্যানেজ। এই মাল আবার কোন ক্যাঁচাল করলো।
রিয়া: কি বিড়বিড় করছেন। বাচ্চুদা চলুন আমার স্কুলের দেরি হয়ে যাবে।
বাচ্চু: দিদিমণি আপনি যে আমাদের সাহেবি রিকশার ছবি দেখালেন, রিংগোদা বিশ্বাস করছেনা।
রিয়া: তাই নাকি রিংগোবাবু। নিউইয়র্ক রিকশ বলে একটা কোম্পানি আছে জানেন? ওরা বলে পেডিক্যাব - দি বেস্ট ওয়ে টু সি সেন্ট্রাল পার্ক। বিশ্বাস না হয় গুগুল করে দেখুন।
রিংগো: ইয়ে মানে জানতাম না। বাচ্চু তুই বরং দিদিকে নিয়েই যা। সাবধানে যাবেন দিদি, রাস্তাটা খারাপ, দিনকাল ভালো না। এ আপনার নিউইয়র্ক নয়।
রিয়া: (হেসে) মোর সিমিলার দ্যান ডিফারেন্ট। চলো বাচ্চুদা।
রিংগো: অ্যাই মুন্না তুই আবার কোথায় চললি। দাঁড়া তোর সাথে কথা আছে।
মুন্না: আবার কি বাত রিংগো ভাই।
রিংগো: (কাছাকাছি এসে বসে) শোন তোর ভালোর জন্য বলছি তুই বাচ্চুর কথায় চলিস না। আমি ব্যাঙ্ক থেকে লোন করিয়ে দেবো, লাইসেন্স বার করে দেবো, তুই অটো চালানো শুরু কর। ও ব্যাটা মারা যাবে। আমেরিকা দেখাচ্ছে আমাকে! পিঁপড়ের পাখা ওঠে মরবার জন্য। তোকে অনেক দিন থেকে চিনি তাই সাবধান করে দিচ্ছি।
মুন্না: সেই ধমকি আর গদ্দারি, তাই না রিংগো ভাই। এক টাইম ছিলো আমি এতেই ডরে যেতাম। আভি মালুম হচ্ছে টাইম একটু বদলেছে। আমার লেড়কা ভি গুগুল করতে পারে।
রিংগো: (রাগে গরগর করছে) বেরো আমার চোখের সামনে থেকে। পুরোনো ওষুধ ছাড়া তোমাদের রোগ ছাড়বেনা। (মুন্না বেরিয়ে যায়, বলাই ঢোকে) এই যে বলাইদা, আপনার জন্যই বসে আছি।
বলাই: কি হলো চেঁচামেচি করছো কেন?
রিংগো: চেঁচাবোনা। আপনি দাদা ঠিক করে ফেলুন প্রমোটারি করবেন না গাঁধিগিরি। এই দুই বদমাশ রিকশাওয়ালাকে নিয়ে আমি তো হদ্দ হয়ে গেলাম। ওই আমেরিকান ছুকরিটা গুগুল করে করে ব্যাটাদের আস্পর্ধা বাড়িয়ে দিয়েছি। আপনি বাগড়া না দিলে দুদিনে আপনার জমি হাসিল করে দিতাম।
বলাই: তাই নাকি? তা কি করতে চাও শুনি?
রিংগো: কোনো লফড়া নেই, ছেলেদের একবার বলে দিলেই রিকশা আর ছোকড়ির পুরো দেখভাল করে দেবে।
বলাই: তাই নাকি? ওই মেয়েটি আমেরিকান সিটিজেন ওর কাকা কাউন্সেলার অনিন্দ্যবাবুকে খুব ভালো করে চেনে। ও কলকাতার কতগুলো সিভিল সোসাইটি গ্রুপের সঙ্গেও কথা বলেছে। জোর খাটাতে গেলে তুমিও মারা যাবে, আমার কাজটাও লাটে উঠবে।
রিংগো: তবে কি করবো। বসে বসে ব্যাঙের লাথি হজম করবো?
বলাই: যা বলছি শোনো। মুন্না আর বাচ্চু যদি একটা করে ফ্ল্যাট চায় তো আমি রাজি আছি। মেন্টেনেনসের খর্চা দেখলেই দুদিন বাদে বিক্কিরি করে দেবে। কিন্তু মেয়েটাকে নিয়ে কোনো ঝুটঝামেলা পাকিও না। আমি চললাম, এখন আবার কাউন্সেলারকে ম্যানেজ করতে হবে। লাল ঝাণ্ডাওয়ালা নেতাদের তবু একটা নিয়মকানুন ছিল, এই নতুন নেতারা একেবারে গিরগিটির মতো হয়েছেন - কখন কি রঙ ধরেন ঠিক নেই। (বেরিয়ে যায়)
রিংগো: তার মানে? এদিকে আমি একটা ফ্ল্যাট চাইলেই বাবুর ঘাড় বেঁকা হয়ে যায়। নিকুচি করেছে তোমার এন. আর. আই.-এর।
(রত্না ঢোকে। বেশ সেজেগুজে এসেছে)
রত্না: কার কথা বলছ, রিংগোদা
রিংগো: আরে রত্না খুব যে সেজেছিস দেখছি। তা সাজতেই পারিস, এন. আর. আই. ফ্ল্যাটের মালকিন বলে কথা।
রত্না: কি যে আজেবাজে কথা বলো। সিনেমা দেখতে গেছিলাম। মাল্টিপ্লেক্সে। আরে বাস, ছবিগুলো যেন জ্যান্ত হয়ে ঘাড়ের ওপর এসে পড়ে।
রিংগো: বাচ্চু তো কাজে গেল। একা গেছিলি নাকি কোনো বন্ধুর সঙ্গে?
রত্না: তোমায় বলবো কেন?
রিংগো: আসছে হপ্তায় আমার সাথে যাবি তাহলে?
রত্না: যেতে পারি। আগে বলো কি ব্যবস্থা করলে?
রিংগো: আরে তোর জন্য খবর আছে। এখানে এসে বোস দেখি।
রত্না: আমার কাজটার কি হলো?
রিংগো: হয়ে গেছে। তোর ছবিগুলো এনেছিস।
রত্না: ওখান থেকেই তো আসছি। (একটা ফাইল দেয়)
রিংগো: বাঃ বেশ সেক্সি লাগছে। এক ছেলের মা, বোঝবার উপায় নেই।
রত্না: কি যে বলো রিংগোদা। আগে আরো কত রোগা ছিলুম। তুমি আমাকে কবে ওখানে নিয়ে যাবে বলো দেখি?
রিংগো: আরে যাবো যাবো, নিয়ে যাবো। ওরাও তোকে লুফে নেবে। কিন্তু এই ফ্ল্যাটের ব্যাপারে গোঁ ধরেছিস কেন বল দেখি।
রত্না: গোঁ ধরে বসে আছে বাচ্চু। রিকশা চালাবে আর এই পাড়া ছেড়ে যাবেনা। ওকে এই কথা বলে রাজি করিয়েছি। ফেলাট পাবে, তার গ্যারেজে রিকশা থাকবে।
রিংগো: তার মানে? খরচ চালাবি কি করে?
রত্না: তার জন্যে তুমি আছো। আরে দুদিন বাদে দাম বেড়ে গেলে বেচে দেবো, তারপর নিজের একটা ব্যবসা খুলবো। কিন্তু ফেলাট আমার চাই। বুঝলে?
(দুজনে কাছাকাছি বসে কথা বলছে, তার মধ্যে পর্দা নেমে আসবে)
(বিমান দাশগুপ্তের বৈঠকখানা। রিয়া ও ঊর্মি)
ঊর্মি: দ্যাখ রিয়া, বাড়িটা তৈরি হয়ে গেছে, কি সুন্দর দেখাচ্ছে। এই সপ্তাহেই বাবারা মুভ করে যাবে তারপর আরেকটা টাওয়ার উঠবে। অবশ্য আমি তখন আমেরিকায়।
রিয়া: কাকু ঠিকই বলেছিল। দা স্কাই ইজ লস্ট, বাড়িগুলো গায়ে গায়ে লেগে দাঁড়িয়ে আছে।
ঊর্মি: রিয়া তোকে কি বলে যে থ্যাঙ্কস দেবো। তুই হেল্প না করলে আমার আমেরিকা যাওয়া স্বপ্নই থেকে যেতো। উফ আই অ্যাম সো একসাইটেড। কোর্সটা শেষ করে ইন্টার্নশিপ, তারপরে একটা রিয়াল চাকরি।
রিয়া: তারপরে বিয়ে। বয়ফ্রেণ্ডটিও তো বেশ জোগাড় করেছিস।
ঊর্মি: ও মাই গড, জয় যখন প্রপোজ করলো, আমি তো প্রায় ফেইন্ট করে যাচ্ছিলাম। আর ওদের ফ্যামিলিটাও কি ভালো, তাইনা? সত্যি রিয়া গত বছরটা কেমন যেন ম্যাজিক্যাল, ফুল অফ আননোন অ্যাণ্ড ওয়ান্ডারফুল থিংস।
রিয়া: জাস্ট ওয়ান ইয়ার। থিংস চেইঞ্জড ডিফারেন্টলি ফর ডিফারেন্ট পিপল। তাও ভালো বাচ্চুদা আর মুন্নাদা একটা করে ফ্ল্যাট পেয়েছে।
ঊর্মি: (হেসে ওঠে) তুই চিন্তা করিস না রিয়া? এটা নিউইয়র্ক নয়। ওরা ওই ফ্ল্যাট রাখতে পারবে ভেবেছিস?
রিয়া: তার মানে?
ঊর্মি: ওরা ফ্ল্যাট পেতোই না, স্রেফ মেরে তাড়িয়ে দেওয়া হতো। মাঝখান থেকে তুই এসে আন্দোলন শুরু করে দিলি, আজকাল মেয়েদের আন্দোলন মানেই ব্যাড পাবলিসিটি। তাই বাবা আর বলাইকাকু মিলে ব্যাপারটা মিটিয়ে দিল। কিন্তু ওরা ওই ফ্ল্যাটে থাকতে পারবে না।
রিয়া: হোয়াট ডু ইউ মিন? জোর করে তাড়িয়ে দেবে?
ঊর্মি: আরে না না, ওরা নিজেরাই ছেড়ে দেবে। কলকাতার ক্লাস ক্যারেকটার কি জিনিস জানিস না তো। ধরে নে নাইন্টিন সিক্সটির আমেরিকার কোনো সাদার্ন অল-হোয়াইট রইস মহল্লায় একটা ব্ল্যাক ফ্যামিলি বাড়ি কিনেছে। কদিন টিঁকবে বল তারা?
রিয়া: এটা টুয়েন্টিফার্সট সেঞ্চুরি ঊর্মি। আচ্ছা এখানে সবাই একটা ডাবল স্ট্যাণ্ডার্ড দিব্যি মেনে নিয়েছে তাইনা? নো ওয়ান ইজ বদারড। হোয়াইট আমেরিকানরা শুধু রেসিস্ট, আমরা এখানে রেসিস্ট, ক্লাসিস্ট অ্যাণ্ড সেক্সিস্ট!
ঊর্মি: এ এ এই দেখো। রাগ করছিস কেন? দেখ গত বছর থেকে আমিও তো তোকে কতো হেল্প করলাম। তোর ওই স্কুলটা উঠে যাবার সময় নতুন এন. জি. ও. ধরে ফাণ্ডিং ম্যানেজ করলাম কেমন বল দেখি? বাচ্চাগুলোর জন্য এখন কতো ভালো ব্যবস্থা হয়েছে।
রিয়া: কিন্তু এটা তো কাজের শুরু, শেষ নয়। তোদের সঙ্গে কথা বলে মনে হয় এটা একটা ক্লোজড চ্যাপ্টার, নাউ উই শুড জাস্ট মুভ অন।
ঊর্মি: দেখ রিয়া তোরা সাবার্বান অ্যামেরিকায় মানুষ। ছোটবেলা থেকে ডিপ্রাইভেশন দেখিসনি, স্কুলে, কলেজে সোস্যাল জাস্টিসের জয়গান শুনতে শুনতে বড়ো হয়েছিস। তোদের কাছে এটা একটা প্যাশন, একটা নভেলটি। আমাদের কাছে এটা হ্যাণ্ডিক্যাপ ছাড়া কিছু নয়, আমরা উপরদিকে উঠতে চাই, অ্যাওয়ে ফ্রম দি হিট অ্যাণ্ড ডাস্ট। ওই টাওয়ারগুলোর মতন।
রিয়া: কিন্তু যারা রাস্তার ধূলোয় পড়ে রইলো তাদের সিম্পলি ইগনোর করতে হবে অ্যাজ আ নুইসেন্স।
ঊর্মি: দেখ আমি বাপু প্র্যাগম্যাটিক, রিয়ালিটিটা দেখি। বাবা এতদিন ধরে সাধারণ লোকের জন্য পলিটিক্স করেছে, অন্যদের দোষ দিয়েছে, কিন্তু এখন পাওয়ারে এসে কিছুই বদলাতে পারছেনা। আমরা বাইরে থেকে এসে সব বদলে দেবো? না রে সত্যি বলছি গা বাঁচিয়ে কেটে পড়াই ভালো।
রিয়া: কিন্তু তাই বলে সোস্যাল ক্লাইম্বিংটাকেই লাইফের ওনলি গোল মেনে নিতে হবে।
ঊর্মি: জানিনা রে। কিন্তু তোকে ভালবাসি বলেই তোর জন্য আমার ভীষণ ভয় করে। রিয়া এই দেশে প্রতিদিন কতগুলো সেক্সুয়াল অ্যাসল্ট হয় জানিস? তুই এমন বেপরোয়ার মতো ঘুরে বেড়াস।
(নেপথ্যে একটা হইচই)
রিয়া: আরে আবার পুলিশ এসেছে দেখছি
ঊর্মি: নতুন কনস্ট্রাকশনগুলো চোর আর অ্যান্টিসোস্যালদের আড্ডা হয়েছে। চল দেখি।
(দুজনে বেরিয়ে যায়। বিমান, নন্দনা অনিন্দ্য আর রোহিণী ঢোকেন)
নন্দনা: শুনেছো কাণ্ড। আবার ওই ফ্ল্যাটে চুরি হয়ে গেছে।
রোহিণী: হবেনা। যত সব ছোটোলোকদের ফ্ল্যাট দিয়েছে--এবার বোঝো...
অনিন্দ্য: আরে আমাকে বলছো কেন? প্রমোটার জমির বদলে ফ্ল্যাট দিয়েছে।
রোহিণী: চুপ করো, আমি সব জানি। মেয়েগুলো নাচলো তোমরাও ওদের সঙ্গে নাচতে শুরু করলে। (রিয়াকে দেখে হকচকিয়ে যায়)
রোহিণী: তা যাই বলো জয় আর ঊর্মিকে মানাবে বেশ।
নন্দনা: তা আর বলতে। তোমার এমন স্মার্ট মেয়ে, বৌদি তো ওর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। দুঃখ করছিল - আমার মেয়েটাকে দেখো, সেটল করার নাম নেই, ধিঙ্গির মতো এদেশ ওদেশ ঘুরে বেড়াচ্ছে। হ্যাঁগো ওরা কি ইস্ট কোস্টেই থাকবে ভাবছে। আমার বাপু বে এরিয়া পছন্দ।
বিমান: অবাক করলে তোমরা। এই যুগে কে কখন বিয়ে করবে তাদেরই ঠিক করতে দাওনা।
অনিন্দ্য: ঠিক বলেছো। আরে রিয়ার মতো স্পিরিটেড মেয়ে হয়না, এদেশে থাকলে মন্ত্রী হয়ে যেত।
(নেপথ্যে আবার হইচই। মুন্না দৌড়ে এসে অনিন্দ্যর পায়ে পড়ে)
মুন্না: কাউনসিলারবাবু দয়া করুন, হামার জান বাঁচিয়ে দিন।
অনিন্দ্য: আরে আরে, তোর আবার কি হলো।
মুন্না: আমি চুরি করিনি বাবু। আমাকে পুলিশে দিবেন না।
(রিংগো ঢোকে)
রিংগো: অনিন্দ্যদা আপনি চিন্তা করবেন না, আমি সব সামলে দিচ্ছি। এই মুন্না তুই আমার সাথে চল।
অনিন্দ্য: এ তো ভারি মুশকিল হলো। নতুন বাড়িতে চোরের উৎপাত।
বিমান: যা কিছু হারায় গিন্নি বলে কেষ্টা ব্যাটাই চোর। তোমরা ধরেই নিয়েছো বাচ্চু বা মুন্না চুরি করছে। গতবার সেই গয়না চুরি নিয়ে বাচ্চুর ফ্ল্যাট সার্চ করলে, তারপর দেখা গেল গয়নাটা আদৌ চুরি হয়নি, হারিয়ে গেছিল।
মুন্না: রিংগোদা তুমি সচ বাত বলেছিলে। আমাকে মাপ করো, এই ফেলাট তুমি নিয়ে নাও। আমার অটো চালানোই ভালো।
অনিন্দ্য: রিংগো তুমি তাহলে কাল ওকে আমার অফিসে নিয়ে এসো। চলো আমি থানার সাথে কথা বলছি।
রিংগো: গরীবের কথা বাসি হলে ফলে। চল চল
(মুন্না, রিংগো ও অনিন্দ্য বেরিয়ে যায়)
রোহিণী: ওফ আর পারা যায় না। সারাদিন এর ঝামেলা মেটাও, ওকে পারমিট করিয়ে দাও।
বিমান: শুনলাম তোমরাই ফ্ল্যাটটা কিনে নিচ্ছো।
রোহিণী: ওই বাধ্য হয়ে আর কি। ছোটমেয়ে তো আমেরিকা চললো, বড়োটি হয়তো কাছাকাছি থাকবে।
নন্দনা: থাকবেই তো। তাছাড়া এই ফ্ল্যাটের দাম কি দাঁড়াবে ভাবতে পারছো?
বিমান: কিন্তু ফ্ল্যাটে রিকশওয়ালা থাকলে দাম কমে যাবেনা।
রোহিণী: কি বলবো ভাই, ওই রিকশটাকে কোথায় রেখেছে জানো। গ্যারেজে, আমাদের গাড়ির পাশে।
নন্দনা: ভেবে দেখো কি অদ্ভুত দৃশ্য।
বিমান: অদ্ভুত দৃশ্যই বটে। একেই বলে মন্টাজ, ফেলিনি বা চ্যাপলিন দেখলে খুশি হতেন। তা আমাদের বাচ্চু তো এখনো গোঁ ধরে আছে দেখছি। আরো কিছু চুরি-ডাকাতি না হলে -
নন্দনা: ওই শুরু হল বাঁকা বাঁকা কথা। বলুন তো রোহিণীদি ওরা তো যথেষ্টই টাকাপয়সা পেয়েছে ওই জবরদখল জমির জন্য। কোথাও একটা ছোট ঘর নিয়ে অন্য ব্যবসা খুললেও তো পারে।
রোহিণী: আরো শুনবে। বাচ্চু তো রিকশা নিয়ে সকালবেলা বেরিয়ে যায়। তারপর ওই রিংগো এসে ওর বৌটাকে নিয়ে বেরোয়। তার সাজের ঘটাও দিন দিন বাড়ছে। কি বলবো এইসব লো ক্লাস লোকজন হাউজিংটার পরিবেশ নষ্ট করে দিলো।
নন্দনা: এইরকমই দিনকাল পড়েছে আজকাল। খবরের কাগজে রোজ দেখোনা - ওপেন মাইণ্ডেড রিলেশনশিপ ওয়েলকাম, এসকর্ট অ্যাভেইলেবল। যাকগে ওসব কথা চল বরং তোমার কার্পেটটা দেখে আসি। (নন্দনা ও রোহিণী বেরিয়ে যায়)
বিমান: ওরে বাচ্চু তুই কেন বোবাকালা মেশিনটার সাথে লড়ার চেষ্টা করছিস। পারবি না, হেরে যাবি। রিয়া, ঊর্মি তোরা তোদের নিয়ম মানা পৃথিবীতে ফিরে যা, নাহলে ক্ষতবিক্ষত হবি। মেয়েটা ঠিক দাদার মতো হয়েছে। দেশের সেরা ছেলেমেয়েগুলো বাইরে চলে গেলো। পড়ে রইলো একটা মস্তবড়ো ভাগাড়, যেখানে দেশবিদেশের লাশ এসে জমা হয়েছে, তার চারিদিকে শেয়াল, কুকুর, হাড়গিলের উল্লাস। এখানে তোরা ডিগনিটি অফ লেবার খুঁজতে এসেছিস। পালা। পালিয়ে যা। এখনো সময় আছে পালা। (কথার মধ্যেই পর্দা নেমে আসবে)
(বাচ্চুর ঘর। বিশু ও বাচ্চু)
বাচ্চু: তা কি করতে হুকুম করো তুমি?
বিশু: বৌমারে বোঝা। ওর লগে কথা বল আর ওই রিংগো ব্যাটারে এ বাড়িতে আসতে মানা কইর্যা দে।
বাচ্চু: রত্নার এক কথা। রিকশা বিক্কিরি করো, বাড়িতে একটা বিউটি পার্লার খোলো। ওই রিকশা যতদিন আছে আমাদের নাকি কেউ ভদ্দরলোক বলে মানবে না। ভদ্দরলোক! এতদিন ভদ্দরলোকেরা তোকে খাইয়েছিল।
বিশু: আমার কথা শুইন্যাই তগো এই বিপদ। ওই হালা রিংগো চক্ষের উপর বৌটারে কুবুদ্ধি দিত্যাছে, আর আমি বুড়া অথর্ব, আমি শুধু এইখানে বইস্যা গজরাই। কিছু করনের খ্যামতা তো নাই, আমারে মানুষ বইল্যাই ধরেনা।
বাচ্চু: আমি কি করবো। রিংগো নাকি রোজ ওকে বিউটি ট্রেনিং স্কুলে নিয়ে যায়। টাকা রোজগার না করলে ফেলাটের ট্যাক্স আর সোসাইটির ফিজ কে দেবে? নিজের বাড়ির জন্য মাসে মাসে টাকা দিতে হয় এটা তো আগে জানি নাই। রত্না আর রিংগো মিলে বোঝালো।
বিশু: সেইটা ছিল ১৯৫৪ সাল, কলকাতার চারধারে তহন তেলাপকার মত লাখে লাখে ঘরছাড়া মানুষ। রিফিউজি ছেলেরা হক্কলে বেকার, বামপন্থী রাজনীতি করে। ওই মুন্নার বাপ আইস্যা আমায় কইলো - জুয়ান মরদ, খাইট্যা খাইতে পারোনা? দেহো আমি বিহারের হরিজন, জোতদার ঘর জ্বালাই দিসে, এহন তোমাগো শহরে খাইট্যা খাই, জরু-বাচ্চারে খাওয়াই কারো ধার ধারি না। আমিও হালায় ওর মহাজনের থিক্যা কর্জ নিয়া রিকশা ধরলাম। তারপর কত কি হইয়া গেল - পুলিশ, ধরপাকড়, বোমা, লাশপোড়া গন্ধ, বাংলাদেশের লড়াই, জরুরী অবস্থা, জনতা পার্টি, বামফ্রন্ট আর এই বড়ো রাস্তা। এই সবের মাঝখান দিয়া আমার রিকশাখান ঠিক গড়গড়াই চলছে, এক দিনের জন্যও থামে নাই। গলা জল ঠেইল্যা আমি রুগি, পোলাপান আর পোয়াতি মাইয়াগো হাসপাতালে নিয়া গেছি। তার কি কিছুই দাম নাই রে বাচ্চু?
বাচ্চু: আমিও তো এই রিকশ নিয়েই ভালো ছিলাম বাবা। খাওয়া-পরার তো কোনো অভাব রাখিনি।
বিশু: ওই রিকশাটা আর আমাগো একটা পরিচয় আছিল। বিশু রিকশাওয়ালার ছেলে বাচ্চু রিকশাওয়ালা - বিশ্বাসী, ইমানদার, মহল্লার সবাইকে চেনে, সকলের সুখেদুঃখে থাকে। ওইটারে বাদ দিলে আমরা শুধু কয়ডা অশিক্ষিত ছোটলোক - চোর, গুণ্ডা, পাতাখোর, ভিখারি।
(রত্না ঢোকে)
রত্না: একি তুমি দুপুরবেলায় ঘরে বসে আছো। শরীর খারাপ নাকি?
বিশু: নাঃ মন খারাপ। তুমি গেছিলেটা কোথায়?
রত্না: ইস্কুলে একটা কাজ ছিল। ছেলেটাকে পড়াশুনা শিখাতে হবে তো, নাকি তোমাদের বাপ-ব্যাটার মতো বড়ো হয়ে রিকশা চালাবে।
বাচ্চু: ওই রিকশাই তোমাদের এতদিন খাইয়েছে ভুলে যেওনা।
রত্না: শুধু খাওয়ালেই তো হয়না। আমরা যেসব কাজ করি, তোমার রিকশা, আমার দু'বাড়ি রান্নার কাজ - এসবের কোনো ইজ্জত নেই। আমি ভদ্দরলোকদের মতো থাকতে চাই।
বাচ্চু: ওই মস্তান রিংগো আর প্রমোটার বলাইবাবু তোমার মাথায় এইসব ঢুকিয়েছে। চাইলেই ভদ্রলোক হওয়া যায়? দেখোনা একটা করে চুরি হয় আর সবাই আমাদের দিকে আঙুল তোলে। কতরকম খারাপ কথা কানে আসে, আমি সেসব কিছু বিশ্বাস করিনা। রত্না (হাত ধরে) চল মুন্নার মতো আমরাও ফ্ল্যাটটা বিক্রি করে একটা ছোটো ঘর নিই। তুমি চাইলে একটা সেলুন খুলতে পারো, আমি তো আর কিছু পারি না, রিকশাটাই চালিয়ে যাবো। এইখানে আমার ভালো লাগছে না গো।
রত্না: (হাত ছাড়িয়ে নেয়) না তুমি আমার কথা শোনো। এই ফ্ল্যাটের দাম অনেক বাড়বে, এখনই বিক্কিরি করলে চলবে না। মাটি কামড়ে থাকো। ওই রিকশাটাই যত নষ্টের গোড়া। ওটাকে বিদায় করো, আমায় বিউটি পার্লার খুলতে দাও, তারপর দেখি ভদ্দরলোকেরা কি বলে। আগে ঝামা ঘষে আমাদের গা থেকে রিকশাওয়ালার গন্ধ তাড়াতে হবে।
বাচ্চু: (রুখে ওঠে) না আমি রিকশা ছাড়বোনা। আর শোন, তোমাকে ওই রিংগোর সাথে রোজ রোজ বেরোতে হবেনা। বাসে করে যাবে আর রাত্তিরের আগে বাড়ি ঢুকবে, এই বলে রাখছি।
রত্না: আরে বাস! ঢোঁড়া সাপ ফণা তুলতে শিখেছে দেখছি। আমি যেমন খুশি যাবো, যেমন খুশি আসবো। এই বাড়ির খর্চা, ছেলের স্কুলের মাইনে, এইসব যেদিন দিতে পারবে সেদিন অধিকার ফলাতে এসো।
বিশু: কোথা থিক্যা এতো পয়সা পাস তুই? কি কাম করিস?
রত্না: তার কৈফিয়ৎ কি তোমায় দিতে হবে? হুঁ সারাজীবন রিকশা টেনে এখন বাতে পঙ্গু, জ্ঞান দিতে লজ্জা করে না।
বাচ্চু: খবরদার। মুখ সামলে! বাবার কাছে মাপ চাও বলছি।
রত্না: কারো কাছে মাপ চাইবো না। আমার নিজের দাম আমি জানি, তোমাদের ঘরে হেঁসেল ঠেলা আর পরের বাড়ি ঝিগিরি করার জন্য আমার জম্মো হয়নি। দুনিয়া বদলে গেছে তোমরা যদি গর্তে মুখ লুকিয়ে আরাম পাও তো সেখানেই থাকো দয়া করে আমাকেও গর্তে টেনোনা। আমার বিউটিশিয়ান ট্রেনিং আছে, স্পোকেন ইংলিশ ক্লাস করছি, কম্পিউটার চালানোও শিখবো। তার জন্য যা করতে হয় করবো।
বাচ্চু: (বিকৃত স্বরে) না করবি না। সেদিন রাস্তায় একটা ছোঁড়া টিটকারি দিলো। বাজারের মেয়েদের মতই সাজগোজ করিস তুই আজকাল। আজ থেকে বাড়িতে থাকবি আর ওই রিংগোকে বলে দিবি, এদিক পানে এলে ঠ্যাং ভেঙ্গে দেবো। এই ফেলাট এখুনি বেচে দেবো আমি।
রত্না: তোমার মুরোদ জানা আছে আমার। ফ্ল্যাট বেচে দেবে? মনে রেখো এই ফ্ল্যাট আমাদের দুজনের নামে। এবার সরো আমাকে বেরোতে হবে। খাবার ঢেকে রেখে দিয়েছি, গরম করে খেয়ে নিও (আয়না, লিপস্টিক বার করে মুখ ঠিক করে)
বাচ্চু: বলছি না কোথাও যাবেনা। (আয়নাটা কেড়ে নেয়)
রত্না: তুমি কি আমার গায়ে হাত তুলবে নাকি?
বাচ্চু: (জোর করে ওর হাত ধরে) ওই রিংগোর সাথে বেরুবি না তুই!
বিশু: ওরে খোকা ঠাণ্ডা হ' বৌমারে বুঝা, চেঁচামেচি কইর্যা একটা কেলেংকারি বাধাইস না--
রত্না: ছোটলোক, ইতর, জানোয়ার। রিংগো তোমার থেকে অনেক ভালো, মেয়েদের সঙ্গে কিভাবে ব্যবহার করতে হয় অন্তত জানে।
(দুজনে ঝটাপটি করছে, বাচ্চু ওকে একটা জোরে চড় মারে, রত্না ঘুরে পড়ে যায়, টেবিলের সাথে ধাক্কা লাগে। রিয়া দৌড়ে ঢুকছে)
রত্না: মা গো!
রিয়া: ছিঃ বাচ্চুদা। তুমি এভাবে ওকে মারলে?
বিশু: দিদিমণি আপনি অরে বোঝান।
বাচ্চু: (বিকৃত স্বরে) রিয়াদি, ওকে জিগ্যেস করো ও এসকর্ট সার্ভিসে কাজ করে কিনা?
রিয়া: যাই করুক, তোমার ওকে মারার অধিকার নেই। রত্না চলো আমার সঙ্গে।
(রিংগো ঢোকে)
রিংগো: এই হারামজাদা বাচ্চু তুই নাকি রত্নার গায়ে হাত তুলেছিস।
বাচ্চু: সাবধান রিংগোদা, এটা আমার বাড়ির ব্যাপার, এখানে মাস্তানি ফলিওনা।
রিংগো: শুয়োরের বাচ্চা তোর খুব বাড় বেড়েছে (রিভলবার বার করে। বাচ্চু একটা লোহার রড তুলে নেয়)
বিশু: ভগবানের দোহাই তোমরা অহন খুনোখুনি কইর্যা ছাড়বা দেখত্যাসি। দিদিমণি তুমি এইখান থ্যিকা চইল্যা যাও, পুলিশে ডাকো।
রিয়া: (দুজনের মাঝখানে গিয়ে) মাথা ঠাণ্ডা করুন আপনারা।
রিংগো: আমি রত্নাকে নিয়ে যাচ্ছি, সাহস থাকে তো আটকা।
(একটা বিকট চিৎকার করে বাচ্চু ঝাঁপিয়ে পড়ে, গুলির আওয়াজ, রিয়া আর্তনাদ করে বসে পড়ে, বিশু বাঁচাও বাঁচাও করে চেঁচিয়ে ওঠে। রত্নাকে টেনে রিংগো বেরিয়ে যায়। বাচ্চু রিয়ার দিকে দৌড়ে যায়। কোলাহলের মধ্যে পর্দা নেমে আসে।)
(বিমান দাশগুপ্তের বৈঠকখানা। রিয়া, বিমান, অনিন্দ্য, বলাই ও ঊর্মি। রিয়ার হাতে ব্যাণ্ডেজ)
অনিন্দ্য: রিংগো আর রত্না গা ঢাকা দিয়ে আছে। পুলিশ কেস করে লাভ নেই সেক্ষেত্রে রিয়া নিউইয়র্কে ফিরতে পারবে না। ভগবানের দয়ায় ওর ইনজুরি খুবই অল্প।
ঊর্মি: কি সাংঘাতিক ব্যাপার হয়ে গেল বলোতো। গুলিটা যদি গায়ে বা মাথায় লাগতো? ওই মস্তানটার কোনো শাস্তি হবেনা।
অনিন্দ্য: প্রমাণ করতে পারলে হবে। কিন্তু রিয়াকে কোর্টে দাঁড়াতে হবে, ও ফরেন ন্যাশন্যাল সেই নিয়ে আরেক ঝামেলা, কোথা থেকে কি ফাঁসিয়ে দেবে ঠিক নেই। আমি বাচ্চুর সাথে কথা বলেছি, ব্যাপারটা আপসে মিটিয়ে নেওয়া ভালো।
ঊর্মি: আপসে মিটিয়ে নেবে। একটা ক্রিমিন্যাল অ্যাক্ট, স্যুটিং, ইলোপমেন্ট।
বলাই: দেখুন আমার আরেকটা প্রজেক্ট সদ্য অ্যাপ্রুভাল পেয়েছে। আমি কোনো বাজে পাবলিসিটি চাইনা। বাচ্চুকে ভালোভাবে রিলোকেট করার দায়িত্ব আমি নিচ্ছি। রিংগোর সাথে আমার আর কোন সম্পর্ক নেই, ও এখন অনিন্দ্যবাবুদের পার্টির হয়ে কাজ করে, ওকে ওনারাই প্রটেকশন দেবেন। রিয়া আপনার ইনজুরির জন্য আমরা জেনুইনলি সরি। যেহেতু আমাদের বানানো কমপ্লেক্সে এরকম একটা কাণ্ড হয়েছে, আমার কোম্পানি আপনাকে ভালো ক্ষতিপূরণ দেবে। আপনি ইণ্ডিয়ান পুলিশ আর কোর্টকাছারিতে ইনভলভড হবার কথা স্বপ্নেও ভাববেন না। এসব নোংরা ব্যাপার; আপনাকে জড়িয়েও নানারকম নোংরা কথা উঠবে।
ঊর্মি: তার মানে? রিয়া ইজ দি ভিক্টিম হিয়ার।
বিমান: ওরা প্রশ্ন তুলবে রিয়া ওখানে কেন গেছিল? একটা রিকশওয়ালার সঙ্গে ওর সম্পর্ক কি? বাচ্চু কেন নিজের বৌকে অ্যাটাক করেছিল? বলাইবাবু আসলে একটা আলগা থ্রেট ইস্যু করছেন। রিয়া আর মোহন আমেরিকা চলে যাক, এদিকটা উনি আর অনিন্দ্য মিলে সামলে দেবেন। তারপর এখানে জল পড়বে পাতা নড়বে, ওখানেও মধুরেণ সমাপয়েৎ। নাহলে জল অনেক ঘোলা হবে, কি বলো অনিন্দ্য।
অনিন্দ্য: তোমার কথা বলার ধরনটা আমার ভালো লাগছে না বিমান। তুমি চাও যে তোমার ভাইঝি কলকাতায় পুলিশ কেসে জড়িয়ে পড়ুক। এদিকে ওর বাবা মা নিউইয়র্ক থেকে আসছেন, দে আর ওরিড লাইক হেক। তুমি জানো ওঁরা তোমাকেই রেসপনসিবল ভাববেন।
রিয়া: আই অ্যাম নট ফিলিং ওয়েল। আমি আসছি।
ঊর্মি: চল আমরা বরং ওপরের ঘরে গিয়ে বসি।
রিয়া: প্লীজ ঊর্মি, আমাকে একটু একা থাকতে দে।
(বেরিয়ে যায়। ঊর্মি অনিন্দ্যের দিকে ফিরে আসে)
ঊর্মি: বাবা ইজ ইট ট্রু যে তুমি রিংগোকে প্রটেকশন দিচ্ছো।
অনিন্দ্য: ঊর্মি মাথা ঠাণ্ডা কর। কাউকে প্রটেকশন দিচ্ছিনা আই অ্যাম ট্রাইং টু ক্লীন আপ দি মেস। তোদের বোঝা উচিৎ যে এটা আমেরিকা নয়, আর আমেরিকাও স্বর্গ নয়। ভেস্টেড ইন্টারেস্ট ইজ অ্যাক্টিভ এভরিহোয়্যার। এই তল্লাটে বস্তি উঠে গিয়ে বড় রাস্তা হয়েছে, লাক্সারি হাউসিং হয়েছে, একে বলে উন্নয়ন কিন্তু তার মানে এটাও যে বাচ্চু রিকশাওয়ালার এখানে আর দরকার নেই।
বলাই: তারপর এলাকায় এই চুরি-ছিনতাই, গুণ্ডামি, এসবে বাড়ির দাম কমে যায়।
বিমান: তাইতো। ভুলেই গেছিলাম বাচ্চু আর মুন্না এখানে যত চুরি ছিনতাই চালিয়ে যাচ্ছে। আমার গিন্নিও তাই বলে।
অনিন্দ্য: কে করছে সেটা ইমপর্ট্যান্ট নয়। পাবলিক পারশেপসনটাই আসল। রিকশার পাশে গাড়ি পার্ক করতে হলে লোকে বিরক্ত হবেই। তারপর ওই মেয়েটা একটা কল গার্ল।
ঊর্মি: আমি তো শুনলাম রিংগোই ওকে ফুসলেছে, চুরিগুলোও ওরই দলের কাজ।
বিমান: কিন্তু রিংগোকে নিয়ে ভদ্রলোকদের সমস্যা নেই, সে তার সীমানা পেরোয়নি। একটা ভালো চেহারার অ্যামবিশাস মেয়ে মাসাজ পার্লার বা এসকর্ট সার্ভিসে কাজ করছে এটাও আজকাল কোনো খবর নয়। যত ঝামেলা ওই গাড়ির পাশে রিকশ নিয়ে।
বলাই: দেখুন আমার হেঁয়ালি শোনার টাইম নেই। সব মিটিয়ে নিতে চান তো খর্চাপাতি নিয়ে ভাবতে হবেনা। বেশি নাটক করতে গেলে শেষমেশ পস্তাবেন। চলি অনিন্দ্যদা।
অনিন্দ্য: বিমান তুমি আমার বন্ধু, তোমার যথেষ্ট বয়েস হয়েছে, তুমি ভালোই জানো যে লাইফ ইজ নট ফেয়ার। অনুরোধ করবো আর বাচ্চাগুলোর মাথা খেয়োনা। অলরেডি অনেক দূর জল গড়িয়েছে। মোহন চল, মিটিং শেষ। আমি জানি তুই মনে মনে ফুটছিস কিন্তু ঠাণ্ডামাথায় ভেবে দেখিস, আই অ্যাম অ্যাক্টিং ইন হার বেস্ট ইন্টারেস্ট। অ্যাণ্ড ইয়োরস।
ঊর্মি: আসছি বিমানকাকু। রিয়াকে বলে দেবেন আমি ওর সাথে আছি।
(অনিন্দ্য ও ঊর্মি বেরিয়ে যায়)
বিমান: এই হল কলকাতা। থ্রি হাণ্ড্রেড ইয়ারস অফ কেওস অ্যাণ্ড হিপোক্র্যাসি।
Thus the midday halt of Charnock--more's the pity!
Grew a City.
As the fungus sprouts chaotic from its bed,
So it spread—
Chance-directed, chance-erected, laid and built
On the silt—
Palace, byre, hovel--poverty and pride—
Side by side;
And, above the packed and pestilential town,
Death looked down.
(বিমান বেরিয়ে যায়। রত্না আরো দুটি ছেলেমেয়ের সাথে ঢোকে। চড়া সুরের নাচগানের মধ্যে পর্দা নেমে আসবে)
(চায়ের দোকান। রতন ও মুন্না বসে দেশি মদ খাচ্ছে)
বাচ্চু: আমার সবকিছু চুরি হলে গেলো রে মুন্না।
মুন্না: ভাবীজি তুমার সাথে এতনা বড়া বেইমানি করলো--
বাচ্চু: শুধু রত্না নয়রে মুন্না। আমাদের আমেরিকান দিদিমণিও তো সব মিটিয়ে নিলো। কোনো কেসই হলো না। আমাকে এতো বড়ো বড়ো কথা বলে শেষে নিজে গা বাঁচিয়ে সরে পড়লো।
মুন্না: এ বাত বোলো না বাচ্চুভাই। দিদি তোমাকে বাঁচাতে জখমি হলো।
বাচ্চু: চুপ কর। ও আসলে রিংগোকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। ওই পিস্তল তোলার আগেই আমি ওর মাথার ঘিলু বার করে দিতাম।
মুন্না: তোমার তো জেল হয়ে যেতো বাচ্চুভাই
বাচ্চু: কিন্তু আমার ইজ্জতটা থাকতো। কি বোকা আমি, ওই মেয়েটা আমাকে গুগুল করে করে কিসব দেখালো আর আমিও নেচে উঠলাম। সেই এক বুড়ো জেলের গল্প বলেছিল। অনেকদিন বাদে সে এক মস্ত মাছ ধরলো কিন্তু মাছটা নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারলো না। মাঝসমুদ্রে হাঙর সব খেয়ে নিল। তবু ও পরদিন আবার নৌকা ভাসাবে - কারণ মানুষকে শেষ করে ফেলা যায় কিন্তু হারিয়ে দেওয়া যায়না। (বোতল উলটে মদ খায়) মিথ্যে কথা সব মিথ্যে কথা।
মুন্না: এই দ্যাখ তুই কেমন গুছিয়ে নিয়েছিস। আমিই বোকা, টাইম স্কোয়ারের রিকশা দেখে নাচলাম। (নতুন বোতল খোলে)
মুন্না: সব ঠিক হো জায়গা বাচ্চুভাই। তুমি এতনা পিয়ো মৎ।
বাচ্চু: ঠিক হয়ে যাবে। আমার বৌ এখন ওই হারামখোর রিংগোর সাথে থাকে জানিস। ওরা একটা পার্লার চালায়, সেখানে আরো মেয়েরা আসে। বাইক বেচে ওরা এখন গাড়ি কিনেছে। আমি দেখেছি সিনেমার মেয়েদের মতো সাজগোজ করে। আমাদের ছেলেটাকেও নিয়ে গেছে, সে এখন ওর মায়ের কাছে থাকে, স্কুলে যায়, আমার কথা নাকি জানতেও চায়না। শালী রেণ্ডি আমাকে চুতিয়া বানিয়ে ফেলে গেল! আমি পাগল হয়ে যাচ্ছিরে মুন্না। (উঠতে গিয়ে টলে পড়ে যায়)
মুন্না: আরে বাচ্চুভাই সম্ভালকে--
(হঠাৎ রিয়া ঢোকে। সবাই একে অপরকে দেখে চমকে যায়)
মুন্না: দিদিমণি তুমি রাত্তিরে এই জায়গায়।
রিয়া: আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি বাচ্চুদা।
বাচ্চু: কেন, ক্ষমা চাইবার কি আছে?
রিয়া: আমি কাল বাবা-মা'র সাথে নিউইয়র্ক ফিরে যাচ্ছি। আই ফেইলড ইউ বাচ্চুদা। ইট ইজ টু কমপ্লিকেটেড। আই হোপ দে উড টেক গুড কেয়ার অফ ইউ।
(কথা বলতে বলতে রিয়া বাচ্চুর কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। বাচ্চু হঠাৎ দুহাতে ওর মাথাটা চেপে ধরে চিৎকার করে ওঠে)
বাচ্চু: তোর ইংরাজি মিথ্যা কথায় আমি থুতু ফেলি। আমি এখন পথের কুকুরেরও অধম। আমার চোর বলে বদনাম, বৌ পাঁচ জনের সঙ্গে শোয়, বাবাটা আধপাগলা হয়ে গেছে, ছেলে আমায় চেনে না। আর কি নিবি আমার। ওই রিকশাটা? নিয়ে যা রিক্সা তোর নিউইয়র্কে।
রিয়া: বাচ্চুদা ছেড়ে দাও, লাগছে।
মুন্না: ছোড়ো, আভি ছোড় দো--
বাচ্চু: (এখন পুরোপুরি মাতাল) আমি তোকে শাস্তি দেবো। মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়ে তারপর তার সব কিছু লুটে নেওয়ার শাস্তি। তোরা কেন এলি এখানে। বেশ ছিল শান্ত চুপচাপ পাড়াটা, সবার সাথে সবার ভাব ছিল। চারদিকে দৈত্যের মতো বাড়ি তুলেছিস, মানুষগুলো সব দুমুখো সাপ। বল কেন এলি এখানে? দেখবি আমি কি করতে পারি।
(বাচ্চু রিয়াকে ধরে ঝাঁকানি দিচ্ছে, মুন্না কোনোমতে দুজনকে আলাদা করে, বাচ্চুকে ঠেলে মাটিতে ফেলে দেয়।)
মুন্না: তুমাহারা শির পর শয়তান সওয়ার হো গিয়া বাচ্চুভাই।
বাচ্চু: (টলতে টলতে উঠে দাঁড়ায়) হ্যাঁ আমি জানোয়ার হয়ে গেছি। ওই রিকশা থাকতে তোরা আমার পিছু ছাড়বি না তাইনা। ঠিক আছে। আমি জানি কি করতে হবে। জানি কি করতে হবে। (দৌড়ে বেরিয়ে যায়)
মুন্না: চলো দিদিমণি আগে তুমাকে ঘর নামিয়ে দিই তারপর এ মাতালকে ঢুনবো--
রিয়া: ও কি করতে গেল মুন্না। হি ইস রানিং অ্যামক, তুমি পুলিশে খবর দাও। (সেলফোন বার করে) ঊর্মি, ক্যান ইউ কাম টু দা চা শপ রিয়ালি ফাস্ট। অ্যাণ্ড কল দি পোলিস।
মুন্না: দো তিন হপ্তা সুবা সাম যব দেখো পিতা রহতা। বহুত তকলিফ হুয়া উসকো।
রিয়া: হি লাভস হিজ ওয়াইফ। রত্নার কাছ থেকে আঘাতটা ওকে টলিয়ে দিয়েছে, তার আগে অবধি হি স্টুড স্ট্রং। ও আমাকে বিশ্বাস করেছিল। ভেবেছিল আমি ওর পাশে থেকে লড়াই করবো। মাই লিভিং হিজ সাইড ওয়াজ দি ফাইন্যাল ব্লো।
মুন্না: তুমি অনেক করেছো দিদিমণি। সাচ বলছি, তুমি ওয়াপস যাচ্ছো শুনে আমি খুব খুশি হয়েছি। ওউর রোও মৎ দিদিমণি।
রিয়া: (চোখের জল মুছে) নো আই অ্যাম নট লিভিং। চলো মুন্না ওকে খুঁজে বার করি। যদি পুলিশ আমাকে নিয়ে টানাটানি করে তো করবে। দরকার হলে কনসুলেটে যাবো, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশন্যালকে জানাবো। আই মাস্ট ফাইট টু দি এণ্ড।
(বাইরে জিনিসপত্র ভাঙার আওয়াজ, চেঁচামেচি)
মুন্না: আরে এতনা শোর কাঁহাসে।
(বাইরে আরো ধাতব আওয়াজ, কোলাহল। ঊর্মি ঢোকে)
ঊর্মি: কি হয়েছে এখানে? রিয়া তুই এত রাত্তিরে এখানে কি করছিস, কাল সকালে তোর ফ্লাইট। ওদিকে তো সাংঘাতিক কাণ্ড।
রিয়া: কি হয়েছে?
ঊর্মি: বাচ্চু একটা লোহার ডাণ্ডা নিয়ে নিজের রিকশাটাকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। তারপর আশেপাশের গাড়িগুলোকে পেটাচ্ছে, পেট্রল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। সিকিওরিটি গার্ড জখম।
(বাইরে আগুনের আভা দেখা যাবে। প্রচণ্ড হইচই। মুন্না বেরিয়ে যায়)
রিয়া: পুলিশ কি করছে?
ঊর্মি: কলকাতার পুলিশ সব চুকেবুকে গেলে তারপর হাজির হয়।
(বলাই ও রিংগো ঢোকে)
বলাই: অ্যাটাক, অ্যাটাক। বাচ্চু আমার বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে।
রিংগো: চিন্তা করবেন না আমি দেখছি।
বলাই: আর দেখছো। যতসব অপদার্থের দল। প্রজেক্টটার বদনাম না করিয়ে ছাড়বে না
রিংগো: শালা আজ তোকে গুলি করেই মারবো।
(বলাই ও রিংগো বেরিয়ে যায়। বিমান ও অনিন্দ্য ঢোকেন)
বিমান: রিয়া তুই ঠিক আছিস তো? ওদিকে তো তাণ্ডব নৃত্য চলছে।
অনিন্দ্য: তোমরা এক্ষুনি এখান থেকে চলে যাও। রিয়া তোমার বাবা তোমাকে নিয়ে এয়ারপোর্ট হোটেলে চলে যাবেন। পুলিশ এক্ষুনি এসে পড়বে।
বিমান: তাই দেখছি। গোলমালও থেমে গেছে। একটা পাগল এতবড় বাড়ির কতটুকুই বা ক্ষতি করতে পারে। আপদের গোড়া ওই রিকশটা আশাকরি পুড়ে ছাই হয়েছে।
রিয়া: বাচ্চুর কি হবে? আর দে গোয়িং টু কিল হিম?
অনিন্দ্য: সেসব কথা পরে ভাবলেও চলবে। ঊর্মি তুমি ওকে নিয়ে যাও।
ঊর্মি: তুই কাকুর সাথে যা রিয়া। আমি কথা দিচ্ছি, এখানকার কাজ আমি দেখবো। বিশ্বাস কর ইউ হ্যাভ মেড মি অ্যান অ্যাক্টিভিস্ট।
অনিন্দ্য: তার মানে?
ঊর্মি: আমি নিজে যাচ্ছি ওর খবর নিতে।
অনিন্দ্য: ওই মারামারির মধ্যে? মাথাটা একবারে খারাপ হয়েছে তোর?
বিমান: (এগিয়ে এসে উঁচু গলায়) ওরা পাগল? আর আমরা সব সেনসিবল অ্যাডালট তাইনা। মিথ্যে কথা। আওয়ার জেনারেশন, উই করাপ্টেড এভরিথিং, কেন জানিস? উই আর আ বাঞ্চ অফ সোললেস জম্বিস, সমাজের ঠাণ্ডাঘরে ঝুলিয়ে রাখা মৃতদেহ। চোখের সামনে অন্যায়-অবিচারের স্রোত বয়ে যায় অথচ আমাদের মড়া চোখে পলক পড়েনা। শুধু নিজের গায়ে হাত পড়লে আমরা খুব জোর জ্যান্ত হয়ে উঠি।
(বাইরে আবার তুমুল হইচই, গুলির আওয়াজ। মুন্নার গলা শোনা যাবে। বলাই হন্তদন্ত হয়ে ঢোকে)
বলাই: সাংঘাতিক ব্যাপার মশাই। কাউনসিলার সাহেব আপনি দাঁড়িয়ে দেখছেন কি, সাইটে যান। হায় হায় আমার সাধের প্রকল্প বুঝি লাটে উঠলো।
অনিন্দ্য: আরে মশাই কি হলো বলবেন না কি?
বলাই: লাশ পড়ে গেছে। জোড়া লাশ। ওই ব্যাটা বাচ্চু, ওটা কি মানুষ না দৈত্য মশাই?
বিমান: কার কার লাশ পড়লো বলাইবাবু।
বলাই: আরে মশাই, রিংগো আর তার ছেলেরা বাচ্চুকে পেড়ে ফেলেছিল, আগুনটাও বাগে এসে গেছিল। হঠাৎ কোথা থেকে ওই মুন্না এক লাঠি নিয়ে হাজির। ঝটাপটির মধ্যে বাচ্চু ওই রিকশারই একটা হাতল নিয়ে - বলবো কি মশাই তখন ওর পেটে গুলি লেগেছে, তার মধ্যেই এক ঘায়ে রিংগোর মাথাটা ছাতু করে দিলো। ওরে বাবারে সে দৃশ্য চোখে দেখা যায়না।
(বাইরে পুলিশের সাইরেন, দমকলের ঘন্টা। রিয়া একটা কান্নার আওয়াজ করে দুই হাতে মুখ ঢাকে)
বিমান: তাইতো আগুনটাও আবার জোর হয়ে উঠলো। এই নির্জীব সমাজ, এই দালালি আর সুবিধাবাদে ভরা পৃথিবীতেও কখনো কখনো আগুন জ্বলে ওঠে। তুই যা, রাত প্রায় ফুরিয়ে এলো। লিভ টু ফাইট ফর অ্যানাদার ডে। কিন্তু ভেতরের আগুনটাকে নিভতে দিসনা। তোদের ওপর আমার অনেক আশা। ফ্রম ক্যালকাটা টু নিউ-ইয়র্ক - গো ওয়াক টুগেদার উইথ দা ফ্রি স্পিরিট অফ অল নেশনস - হু সাফার, ফাইট, অ্যাণ্ড উইল প্রিভেইল।
(নেপথ্যে নাইনথ সিম্ফনি বেজে ওঠে। ঊর্মি রিয়ার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়, আলো শুধু ওদের দুজনের ওপর। পর্দা নেমে আসে।)
(সমাপ্ত)