“সবুজ-লাল-হলুদ-কালো ওড়িশি আঁচল ঘাসবনের চড়াই-উতরাই ধরে ঢেউভাঙা বিভঙ্গে ছুঁয়েছে পুরোনো চাতাল। দীর্ঘ অনাবৃত হাত। দৃষ্টি অলোকে। পিঠ ঝাঁপানো সঘন মেঘপট। গলায় কানে কাঠের গয়না। ঘন মধুরঙ। কপালে মুক্তো ঘাম। কয়েকশো বছরের অতীত ভাসছিল চোখের কাচে। পিছনে অপার্থিব গভীর সবুজ। একদৃষ্টে চেয়ে আমি। হলুদ উত্তরীয়, নীল নীবিবন্ধ, লম্বা চুলে আমি কর্পোরেট এক্সিক্যুটিভ কৃশানু বিশ্বাস নই, জিতেন্দ্রিয় মুনিঋষি নই, শরীরসবর্স্ব তৃষ্ণার্ত নাগরিক। আর সে চৌষট্টিকলাপটিয়সী... নৃত্যাঙ্গনা আম্রপালী অথবা বাসবদত্তা! কী জোরালো আহ্বান! সূর্যমন্দিরের ধ্বসা প্রাচীন দেওয়াল জুড়ে প্রস্তরায়িত অনবদ্য রমণদৃশ্য। অসংখ্য। শিল্পিত বাৎস্যায়ন কি পর্নোগ্রাফি? আমি বিমূঢ়। তার দিকে নিরন্তর একভাবে... অনিশ্চিত বয়ে গেল যেন পল, অনুপল। নিরালা ঝাউবন দুলিয়ে হঠাৎ খোলা বাতাস খিলখিল, ‘আরে কৃশানুদা... কতক্ষণ?’ চমকে চেয়ে দেখি, দু’হাত দূরে সে বৈদেহী কেউ নয়। তার গন্ধ মেখে ম’ম আমার অস্তিত্ব... স্বপ্ন দেখছিলাম? তুমুল ঝাঁকুনি খেয়ে বললাম, ‘না, এমনি!’ অতলান্ত দৃষ্টি আমার মুখে, ‘কি মনে হচ্ছিল জানেন? পৃথিবীর শেষ ধ্বংসস্তূপের চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছি! ফেরার রাস্তা নেই।’ আমি কিছু ভাবার আগে হাঁফাতে হাঁফাতে এসেছিল প্রুৎ, ‘বাবা! আন্টি! কি করছ এখেনে? আমি আর মা ওই যে হাতির মূর্তি... ওয়েট করছি!’ আমায় ধাক্কা মারল। আমি কি জাগলাম না পড়ে গেলাম? খাঁচাবন্দী হলাম?”
ডায়েরিটা লুকিয়ে রাখার প্রয়োজন ছিল! তারপর তিনবছর পার হয়ে গেছে।
বেড়ানোর ইচ্ছেটাই যাওয়া নয়, সেখানে শারীরিক উৎসাহ লাগে। কত ছুটি জলে গেছে। এগারো বছরের যুগলযাপনে বারপাঁচেক শহর ছাড়িয়ে। দূরে কোথাও নয়... ঘরের কাছে আরশিনগরে শীতভ্রমণ। হোটেল ‘বুক্’ করা হয়নি আগে থেকে। অথচ সে এজাতীয় অবিবেচক নয় মোটেও। আসলে ধারণাই করেনি ট্রেন থেকে নেমে এমন আতান্তরে পড়বে। ভারী পকেটের আত্মবিশ্বাসে ধ্বস ক্রমশঃ বিপর্যয়ের আকারে। মৌমিতার রোদ-ঠেকানো শরাবী চশমায় চোখ অদৃশ্য, মুখের রেখা অবিকল। কৃশানু আশ্বাসবাণী “ডোন্ট ওয়ারি, ঠিক পেয়ে যাব, দেখোনা...” স্বগতোক্তির মত মিয়ানো। অটো থামিয়ে সমুদ্রতীরবর্তী একের পর এক হোটেলে অনুরোধ করেছিল, অন্তত একটা দিন! এও অভিজ্ঞতা! দ্বার হ’তে দ্বারে... প্রুৎ অধৈর্য। বেচারা। রাতে ট্রেনে বসা থেকে এপর্যন্ত বাপ-ছেলের মহার্ঘ সখ্য উধাওপ্রায়। বাড়িতে উচ্চাশী ব্যস্ত পিতার মা-ন্যাওটা প্রুৎ। কৃশানু অসহায়। মালপত্রের বহর দেখছিল। মাত্র চারদিনের ভ্রমণে মৌমিতার দশাসই সুটকেস! কৃশানুর আলাদা লাগেজ সংক্ষিপ্ত। প্রুৎ-এর টুকিটাকি ছোট্ট ট্রলিব্যাগে। স্বাবলম্বনের পাঠ। মৌমিতার কাঁধে মোটা ভ্যানিটি। স্টেশন থেকে অটোর পিছনের সিটে মৌমিতা ও সুটকেস। সামনে ড্রাইভারের পাশে তার কোলে প্রুৎ। বারবার তবু জিজ্ঞাসা করেছিল, “মৌ, অসুবিধে হচ্ছে নাকি?” পিচের রাস্তা থেকে ঢালু হয়ে নামা সাগরবেলায় সীমাহীন থিকথিক ভিড়। উপরে অবাধ উজ্জ্বলতা, নীচে ঢেউ হলদে বালিতে ভেঙে পড়ছে। কেমন ভোজবাজি! জল ডাকছে, ‘আয়’। মগ্ন হওয়ার বদলে অপরাধী মন। প্রথমবার বিশালত্বের সামনে উত্তেজিত সাত বছুরে প্রাণ, স্কুল, হোম ওয়র্ক, কার্টুনের বাইরে। পারলে অটো থেকে নেমে ছুটে যায়, “বাবা, দ্যাখো সব্বাই আগে চলে গেছে... কত ভিড়! আর খালি নেই। আমরা সী দেখবো কি করে?” মৌমিতা অভিব্যক্তিশূন্য, কৃশানুর আত্মপক্ষ সমর্থন বা দোষস্বীকারের সুযোগ না রেখে।
উদ্ধার করেছিল অটোচালক। ওড়িয়া-বাঙলা মেশানো যা বলছিল, বোঝা গেল কাছে কোথাও নোতুন হোটেল, অসমাপ্ত। সিদ্ধান্ত কৃশানুর। প্রত্যাশিত কিছু হবেনা ধরে নিয়েই সম্মত হয়েছিল অগত্যা। হাতঘড়িতে ভরদুপুর। জৈবিক প্রয়োজনগুলোর খোঁচাখুঁচি অনেকক্ষণ ধরে। ট্রে্নে বসে নিশ্চিত বিলাসে ভোরালি চায়ের আমেজ কোন্কালে উধাও। সমুদ্রের প্রবল নোনতা হাওয়া আর যাহোক্ স্বস্তিকর নয়। অলিগলি পথে অবশেষে হোটেলের সামনে। বেশ বড় আয়োজনে কাজ চলছে। রিসেপশনে হিন্দীভাষী ম্যানেজার দরাজ হয়ে জানাল, দোতলায় বিলাসবহুল স্যুইট খালি। কিন্তু লিফট্ চালু হয়নি। প্রায় স্বর্গলাভের অনুভূতি হচ্ছিল। অটোওয়ালাকে আভূমিনত কৃতজ্ঞতা জানাল। তারপর ডাকল, “মৌ এসো এসো। আগে থেকে জানলে... বেকার হয়রানি!” জগদ্দল বাক্সপ্যাঁটরা... মুহূর্তে পালকের মত। ঠিক পাশের স্যুইটটি ভেতর থেকে বন্ধ, অর্থাৎ বোর্ডার আছে। নোতুন ঘর ঝক্ঝকে প্রশস্ত। লাগোয়া ছোট্ট বসার জায়গা, বিশাল স্নানঘর, বড় ব্যালকনি। যতক্ষণ গুছিয়ে রাখছিল মৌমিতা, সোফায় বসে সাফল্যের তাত সেঁকছিল কৃশানু, “কী, কেমন? শুধু শুধু চিন্তা করছিলে।” দৌড়ে ঢুকেছিল প্রুৎ, “বাবা! ব্যালকনি থেকে, কোত্থাও সী দেখা যাচ্ছে না! পচা হোটেল। এক্খুনি চলো। আমি সীওয়েভ দেখবই।” কৃশানু যুৎসই উত্তর হাতড়াচ্ছিল আর দেখছিল একজন ড্রেসিংটেবিলে কৌটো শিশি সাজাচ্ছে তো সাজাচ্ছেই। মুখের একপাশ আয়নায়। নির্লিপ্ত। সে ছেলেকে ভোলাচ্ছিল, “যাবো প্রুৎ, সী দেখতে তো যেতে হবেই। আগে নিচে কাজগুলো সেরে আসি। তুমি মায়ের কাছে থাকো?” প্রুৎ হাত ধরে ঝুলছিল, “আমিও, আমিও।” নিচে গিয়ে নিয়মাফিক তথ্য সংযোজন করে এসেছিল পিতাপুত্র। হঠাৎ পাশের স্যুটের দরজা খুলে গিয়েছিল। চমকে উঠেছিল সে, “তিমির!” “আরে তুমি!” প্রায় একইসঙ্গে বলে উঠেছিল। খুশি হয়েছিল। মিনিটদুই পরে যে বেরিয়ে এল তাকে আগে দু’চারবার দেখেছে তিমিরের সাথে নন্দন চত্বরে বা শিয়ালদা’ পাঁচমাথার মোড়ে। তখন কালো রোগাটে সাদামাটা মনমরা তরুণী। সম্ভবত আলাপ হয়েছিল। মনে রাখার কথা নয়। সময়ের তেমন ছাপ পড়েনি। এখন ঘষা কাঁচে আলো। ঘাস গজিয়েছে শুকনো কাঠে। অথচ তিমিরের চমৎকার খেলোয়াড়ি দীর্ঘ চেহারায় ভাঙচুর খুব। কৃশানু হেসেছিল, “কবে বিয়ে করেছো? খবর দাওনি।” তেমন ঘনিষ্ঠতা ছিলনা কলেজজীবনে। নারী পুরুষ পরস্পরের দিকে তাকাল। বন্ধুস্ত্রী সহাস্যে বলেছিল, “আমি শ্যামপর্ণী। চিনতে পেরেছেন?” ঝকঝক করে উঠেছিল জুঁইসারি। কৃশানুর অন্তরে স্বতস্ফুর্ত ‘বাঃ’ এবং তারপর ঠোঁট ছড়িয়ে বলেছিল, “ভুলি কি করে!” কথার কথা। সদ্য পরিচিতা দু’হাতে জড়িয়ে নিয়েছিল প্রুৎ-কে, “নাম কি সোনা?” ছেলে গুরুগম্ভীর, “প্রত্যয় বিশ্বাস। মা বাবা বলে প্রুৎ।” “প্রুৎ? বাঃ, কে দিয়েছে নামটা?” এত সহজ নাকি মুহূর্তে আপন হওয়া? এবারে জড়তা কাটিয়ে কৃশানুও হেসেছিল, “আন্কমন্? ও নিজেই। আরে, ছোটোবেলায় ভালো নামটা উচ্চারণ করতে পারত না, সেই থেকে।” “এই নামে ইস্ট ইওরোপে একটা ছোট নদী আছে... জানো প্রুৎ? ওরা অবশ্য বলে প্রুথ্।” কৃশানু জানত না। প্রথম শুনলো।
ঠাণ্ডাঘরে শুয়ে যথেচ্ছ আলসেমি করছিল কৃশানু। সিগেরেট খায়না বিশেষ, তবু ঠোঁট সুড়সুড়। দুপুরে বাথরুমের মস্ত বাথটবে প্রাণভরে জল ঘেঁটে সী-এর দুঃখ ভুলেছিল প্রুৎ। এই হোটেলে খাওয়ার ব্যবস্থা আপাতত মামুলি। ভাতরুটি, ডালভাজা, সমুদ্রের মাছ বা মুরগির কারি। টুকটাক স্ন্যাক্স। মৌমিতা একবার বলেছিল, “ওরা বলল, রেষ্টুরেন্ট চালু হয়নি?” বুঝে নিতে হল, কারণ এর বেশি বলেনা মৌমিতা। “আসলে”, সতর্ক ঢোঁক গিলে কৃশানু বলেছিল, “বেলা হয়ে গেছে তো... খিদে পেয়েছে জোর। বুঝলে? ডিনারে তোমার চাইনিজ্।” নিশ্চিন্ত ভরপেটে ঘুমিয়ে পড়েছিল কৃশানু। “বাবা যাবেনা?” হুমড়ি খেয়ে প্রুৎ তার ঘাড়ে। রেশম স্পর্শ, স্বর্গীয় শিশুগন্ধ। ঘুমোয় নি ছেলেটা? পাশেই শুয়েছিল। হাতঘড়িতে প্রায় সাড়ে চারটে। আয়নার সামনে গাঢ় লিপস্টিক ডলছিল মৌমিতা। মুখ ফিরিয়ে আস্তে বলেছিল, “ঘুম হলো? ওঠো।” সামান্য উঁচু সামনের দাঁত। সে আলস্যের হাই তুলল, বৌকে ছোট্ট চোখ মারল, বাথরুমে ঢুকল। বেরিয়ে শার্ট গুঁজতে গুঁজতে দেখছিল মৌমিতা সেজেছে খুব। ঘীরঙ চুড়িদার কুর্তা, লাল রাজস্থানী ওড়না। মস্ত মেরুন টিপ, কাজল, ঝোলা দুল। মাখন ত্বক। কাঁধ অবধি কোঁকড়া চুল পাতলা। চওড়া কপাল। এত রঙেও তেমন স্পন্দন জাগেনা। আগেকার মৌমিতাকে প্রায়ই মনে পড়ে। অঝোর বৃষ্টির ধূসর বিকেলে ঢাকুরিয়া থেকে কলেজস্ট্রিট। সে, তার মা, বড়দা বড়বৌদি। রক্ষণশীল বনেদিয়ানার অনুশাসনে কলেজ পেরোন নতমুখী তরুণীকে নিয়ে তার দিদি আর বৌদি ঘরে ঢুকেছিল। ঘরের মধ্যে গরাদওয়ালা বড়বড় সবুজ জানালা। সদ্য চুনকাম করা সাদা দেওয়ালে টিউবলাইটের বেআব্রু ফ্যাটফ্যাটে আলো। ছোটোখাট চেহারায় লালচে জমকালো শাড়ি জড়ানো পুঁটলি, সরু দুটো বেণী, কাজল-পরা বড়বড় নিরাবেগ চোখ। মায়ের পছন্দে বিয়ে। দাদাবৌদিরা ছিল। কৃশানু সকলের ছোট, মতামতের প্রশ্ন আসেনি। তারপর এতবছর ধরে জন্মানো মায়া বিশ্বাস ভরসা। হয়তো ভালোবাসাও। এবং স্বাভাবিক নিয়মে প্রুৎ।
কৃশানু জোরে মাথা ঝাঁকাল। ঘন চুলের মধ্যে আঙুল চালাল। মনে পড়লে অস্বস্তি হয় আজকাল, গা ছমছম করে। সে বৌয়ের দিকে দু’আঙ্গুল জুড়ে প্রশংসার ভঙ্গি করল। উৎসাহ সাজাল, “নামো তোমরা, লক্ করে এক্ষুনি আসছি।” প্রুৎ মায়ের হাত ছাড়িয়ে দু’তিনটে করে সিঁড়ি টপকাচ্ছিল। রিসেপশনে চাবি জমা রাখতে রাখতেই দৌড়ে উধাও। তার মা ডেকেছিল, “প্রুৎ দাঁড়াও!” হোটেলের সামনে ফুটপাথে তিমির। শ্যামপর্ণীর গা ঘেঁষে প্রুৎ। মৌমিতা অসম্ভব অবাক হয়ে পিছিয়ে এসেছিল। শ্যামপর্ণী এগিয়ে এল “তুমি মৌমিতা, না? আমি শ্যামপর্ণী।” সজল হাওয়ার হাসি ছড়িয়ে গিয়েছিল। প্রুৎ গুছিয়ে বলেছিল, “আন্টি, দিস ইজ মাই মম্ মিসেস মৌমিতা বিশ্বাস!” “ইয়েস বেবি। দ্য বেস্ট মম্। জানি তো!” হাত ধরেছিল মৌমিতার, “কী সুন্দর স্কিন্ তোমার। আলোর মতোন।” মৌমিতা শুধু বলেছিল, “কীযে বলো।” কৃশানু হাঁটছিল তিমিরের সাথে একটু এগিয়ে। কানে আসছিল এটা সেটা। “শ্যামপর্ণী মানে জানতে চাইলে না মৌমিতা? সব্বাই কিন্তু জিজ্ঞেস করে। তুমি জানো। না?” গলার স্বর ব্যতিক্রমী চাপা, কেমন ধরাধরা। মৌমিতা সংক্ষেপে বলেছিল, “নাতো।” “মানে চাপাতা। মজার না? আসলে জন্মেছিলাম ডুয়ার্সে দাদুর বাড়িতে। তারপরে আমার গায়ের রং...” খুব হাসছিল সে। বলেছিল, “এ্যাই, আমি একাই বকছি। তুমি খুব শান্ত গম্ভীর। রাগ করছ নাতো?” কৃশানু শুনেছিল। মৌমিতার জবাব আসেনি। খুব কাছে নয়, তাই অটো নিয়ে সমুদ্রে সূর্যাস্ত দেখতে যাওয়া। প্রস্তাবটা দিয়েছিল শ্যামপর্ণী, “দশমিনিটের রাস্তা, অটোতে একসাথে গেলে মজা হতো কিন্তু!” প্রুৎ খুব উত্তেজিত, “তারপরেই সী। আমরা নামবো, না আন্টি?” কৃশানু আড়ে দেখছিল। মৌমিতার নিস্তরঙ্গ ফ্যাকাশে মুখে কি পুরু ফেসপাউডার? কিছু অনুমান করেছিল তিমির, “অসুবিধে হবে তোমাদের?” কৃশানু সাবধানে বলেছিল, “আরে না না। ধুস্। কী মৌ?” অটোর সামনে কৃশানুর কোলে প্রুৎ, পেছনে বাকি তিনজন। খুঁতখুঁত কৃশানুর মনে। চাপাচাপিতে কষ্ট হচ্ছে নাতো মৌমিতার? রাজি না হলেই... প্রুৎএর নরম চুলের ঝাপটায় শিথিল হয়ে আসছিল সব সংশয়, বিরক্তি। এত কথা বলতে পারে তার ছেলে? দীর্ঘ এক প্রশ্নপত্র। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মধ্যবর্তিনীর উত্তর আসছিল পেছনের সীট থেকে। উষ্ণ হাসির মৌতাত। বাকিরা শ্রোতা। অকারণ কান গরম হয়ে উঠছিল কৃশানুর, গোপনে কলেজ জীবনের মত হুল্লোড় ফুটছিল বগ্বগ্। পৌঁছনোর আগে জানা হয়ে গেল বৃত্তান্ত। ভূগোলে অনার্স্। তারপর চাকরি, জিওলজিক্যাল সার্ভেতে।
সমুদ্রতট অথৈ মানুষের ক্রীড়াভূম। কোটিবছর ধরে সূর্যাস্ত প্রতিদিন একইভাবে, অর্বুদ মানুষ আসে কালের সীমা পেরিয়ে। অটো থেকে নেমে সৈকতে দাঁড়িয়ে কৃশানু স্তব্ধ। তার বাহু ছুঁয়ে মৌমিতা উদ্বিগ্ন, “প্রুৎ আমার হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে চলে গেল!” কৃশানুর আবেশ নিমেষে ধাক্কা খেল, “কি? একা? কোথায়?” অসহায় দেখাচ্ছিল মৌমিতাকে, “ঐযে... ওই! ছেলেটার ঠাণ্ডার ধাত।” দূরে চলে গেছে ছেলে। জলের কিনারায় দৌড়চ্ছে। ঢেউয়ের সঙ্গে স্প্রিং-খেলনার মত লাফাচ্ছে। ওর হাত ধরেছিল শ্যামপর্ণী। চারদিকে অসংখ্য মানুষ। সঘন সমুদ্রগর্জন ছাপিয়ে জনোল্লাস। অদ্ভুত মায়া হল কৃশানুর, “কিচ্ছু হবে না, এত লোক চারদিকে।” একপাশে দাঁড়িয়ে তিমির। নীরব, অন্যমনা। এমন তো ছিলনা আগে? কৃশানু তার কাঁধে হাত রেখে বলল, “এসো, বসি খালি জায়গায়।” তিমির কুণ্ঠিত হেসেছিল, “ভেবোনা। তোমাদের ছেলে ঠিক থাকবে। চলো বসব।” নিরিবিলি জায়গা পাওয়া মুশকিল। নোংরাও খুব, মানুষের অবিবেচনায়। বসেছিল ওরা। অতিকষ্টে হাওয়ার ধাক্কা এড়িয়ে সিগেরেট ধরিয়েছিল কৃশানু। তিমির বলেছিল, “বহুদিন ছেড়ে দিয়েছি।” গেরুয়া বালিতে মৌমিতার ধবধবে পায়ের পাতায় সরু রূপোর পায়েল, লম্বা নখে কফিরঙ। এত শব্দের মধ্যে একা হয়ে যাওয়া সোজা, কৃশানু ভাবছিল। কবেকার রূপকথাবেলায় বাবা মা দাদারা ও সে এইখানে এই সূর্যাস্তের সাক্ষী হয়েছিল। বালি পায়ে ছুটেছিল চলমান জলের চিরকালীন টানে। বাবা তাকে ডেকেছিল, “আর যায়না শানু। ফিরে এসো এবারে।” আজ সে তার ছেলেকে আটকাল না, ডাকল না, “ফেরো” বলল না। ফেরা কি যায়? ইচ্ছে করলেই বত্রিশ তেত্রিশ বছর আগে? ঢেউগোনার ধৈর্যই কি আছে? তখুনি কানের কাছে ফিসফিস, “আমিও যাই?” চমকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেছিল, মৌমিতা। গভীর সমুদ্রবাসনা রোধ করছিল, খেয়াল রাখেনি কৃশানু। এতক্ষণ হয়ত ছেলের জন্যে সাবধানতায় যায়নি, বা আজন্মের রুচির দুভের্দ্য বেড়ায় আটকে পড়ে। মুহূর্তে নিভের্জাল স্বস্তি উঠে এসেছিল। স্বামীসুলভ ঔদার্যে বলেছিল, “হ্যাঁ-এ্যা, যাওনা... ওইতো দেখা যাচ্ছে ওদের।” মৌমিতা উঠে পড়ে তাকিয়েছিল কৃশানুর দিকে। তার আনন্দে উচ্ছ্বলতা নেই, শান্ত কৃতজ্ঞতা। আরো যা ছিল, তা অমূল্য, কৃশানুর অল্প চেনা। চটি খুলে রেখে বালি বয়ে চলে গেল মৌমিতা। কৃশানুর নিজেকে পরিপূর্ণ সুখী ভাবতে ভালো লাগছিল। পাশে তিমির নীরব। এসময়ে কেন বিমনা কে জানে। বিমর্ষ চোখ। “কি করে এ্যাফেয়ার হয়েছিল তোমাদের? শুনেছিলাম, ভুলে গেছি!” ঘনিষ্ঠ হতে চেয়েছিল কৃশানু, “তোমার বৌ ডুয়ার্সের মেয়ে শুনলাম আর তুমি বারাসাতের।” তিমির অনিচ্ছুক হাই তুলছিল, “শুরুতে একই অফিস্ ছিল। চলো এগোই। বাঃ এক্সওটিক্, দ্যাখো।” একটু সরে এসে ক্যামেরা তাক্ করছিল তিমির। এড়িয়ে গেল? কয়েক হাজার ক্যামেরা ও মোবাইল তখন সমুদ্রমুখী। সূর্য মুচ্কি হাসল, স্তরে স্তরে রঙ ছিটিয়ে ডুব মারল দিক্চক্রবালে। আরো এক অসামান্য সায়াহ্ন। এও পুনরাবৃত্তি। বালিমাখা প্রুৎ দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল কোলে, “জানো বাবা ওইযে... ঢেউটা তো লাফিয়ে লাফিয়ে...” উত্তেজনায় কথা হারিয়ে যাচ্ছিল। কৃশানু শান্ত করেছিল, “ও! ঈস্ ভিজে গেছিস্। খুব কাছে গিয়েছিলি?” “ভীষণ মজা হচ্ছিল না প্রুৎ? মৌ?” সে শ্যামা, শিখরীদশনা। মরচেরং সিল্ক প্রায় নিঁখুত তন্বী শরীরে সাপটে রেখেছে উচ্ছ্বলতা। কিছুটা চৌকোণা মুখে তীক্ষ্ণ নাক, স্ফুরিত ঠোঁট। কাজলমাখা নিলাজ চোখে শব্দের ঠেলাঠেলি। ঘন চুলে উঁচু পনিটেল, অবাধ্য উড়ন্ত কিছু। বাঁ-গালে টোল। মুখরা ব্রণগুলো সমুদ্রবাতাসে টানটান। হাসতে হাসতে নুয়ে পড়ছিল চঞ্চল বেখেয়ালি নমনীয়তা। দিনশেষের অনুপম আলোয় রহস্যময়ী। শাড়িতে, চুলে, কপালে, গুঁড়োগুঁড়ো বালি। কৃশানু প্রাণভরে শুষে নিচ্ছিল! চুরি করে। পাশে মৌমিতা খুশিমুখে। প্রবল হাওয়া পোশাক টেনে ধরে প্রকট করে দিচ্ছিল একমাত্রিক দেহের অন্ধিসন্ধি। ঢাকাঢুকি দিতে বেসামাল লজ্জিত হয়ে পড়ছিল বেচারি। “ক্রমশ ফুল্ছে... ডিজ্গাস্টিং!” কৃশানুর চোখে বিরক্তির আঁচ মৌমিতা লক্ষ্যই করেনি। পোশাকের বালি ঝাড়তে ঝাড়তে স্মিতমুখে বলছিল, “থ্যাঙ্ক্ ইয়্যু। ভালো লেগেছে।” শ্যামপর্ণী যেন অভিভূত, “বল্লাম না তোমায়?” মৌমিতার আনন্দের দুলর্ভ প্রকাশেও সঠিক অনুভব এলো না কৃশানুর।
বিকেল ফুরিয়ে অন্ধকার। অবিরাম ঢেউভাঙা গর্জন আর কোন্ দূরে জাহাজের সঙ্কেত। বাতি জ্বলছিল লাইটহাউসের মাথায়। সৈকতসংলগ্ন রাস্তা জুড়ে আলোকসজ্জা। জনারণ্য। মাথার মধ্যে এলোমেলো আঁকিবুঁকি, উত্তাল বাতাস...। ভাবনাগুলো যথেচ্ছ উড়িয়েছিল কৃশানু। প্রুৎ খিদের বায়না ধরেছিল বাবার কাছে। খিদে তখন সকলেরই, সমুদ্রের হাওয়াতে স্বাভাবিক। কৃশানু কথা দিয়েছিল রাতে চাইনিজ্। শ্যামপর্ণী বলছিল, “গভর্নমেন্ট শোরুমটা রাস্তার ওপরে। চলোনা মৌ শাড়িটাই কিনে নি আগে। যদি বন্ধ হয়ে যায়... তারপর ডিনার।” আপত্তির অবকাশ ছিলনা। মৌমিতা দ্বিধায় পড়ে স্বামীপুত্রকে দেখেছিল। প্রুৎ-এর হাতে চিপ্সের বড় প্যাকেট। ঘুষটা কে দিল? ওরা ঢুকেছিল দোকানে। সাবেকি দোকান। কাউন্টারে দুই বস্ত্রাভিলাষী নারী। কমর্চারীটি একেকটি নামিয়ে রাখছিলেন শোকেস থেকে। রঙের দাক্ষিণ্য ঠিকরাচ্ছিল ওদের চোখে মুখে। “দেখো মৌ, দুর্দান্ত! তোমাকে যা দেখাবে! আয়নায় দেখো... আমি কিন্তু তোমার মত রঙ পেলে... বলুন তো!” উজ্জ্বল রঙগুলো তুলে নিয়ে তার গায়ে রাখছিল শ্যামপর্ণী। “নাগো... এটা নয়।” মৌমিতা হাসিমুখে নামিয়ে রাখছিল প্রত্যেকটি। একটু যান্ত্রিক। বেশ কিছুক্ষণ এই খেলা... আন্তরিক ছিল শ্যামপর্ণী, কিন্তু হেরে গেল। অন্য কাউন্টারে এসে কথা বলেছিল তিমিরের সঙ্গে। মিনিট দশেকের মধ্যে প্যাকেট হাতে বিল মিটিয়ে দোকানের বাইরে দাঁড়িয়েছিল ওরা। কৃশানু লক্ষ্য করেছিল। কাউন্টারে শাড়ির পাহাড়ের সামনে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করেছিল, “কোন্টা নেবে মৌ?” মৌমিতা স্থির তাকিয়েছিল, “পরে নোবো।” বিরক্তিতে চিড়বিড় করে উঠেছিল, প্রকাশ করলনা, “ওক্কে। চলো ডিনার করা যাক।” বড় রেস্তোরাঁ, যথেষ্ট ভীড়। প্রিয় চাইনিজ। ঢোঁকে ঢোঁকে জল মৌমিতার। ঝাল লেগেছে। কৃশানু রসিয়ে খাচ্ছিল অনেকদিন পরে। জলে চুমুক দিয়ে বলছিল প্রুৎ, “টেস্টি টেস্টি। না বাবা?” মৌমিতার রান্না সাদামাটা, জোলো, বিস্বাদ। তবু সে প্রংশসা করে। তার মা খুব ভালো রাঁধতেন। শ্যামপর্ণী উচ্ছ্বসিত, “চিকেন প্রেপারেশনটা দারুণ! আমাদের বাড়ি একদিন আসবেন সব্বাই। খাওয়াব। ঠাকুমা ঢাকার মেয়ে ছিল তো! আমি আবার এক্সপেরিমেন্ট করতে ভালোবাসি।” বিনা ভূমিকায় নিরভিমান হাসতেও পারে মেয়ে! মৌমিতা চুপ। তিমির ব্যস্তসমস্ত হয়ে বলল, “ওঃহো, এই নাও কালকের কন্ডাক্টেড্ ট্যুরের টিকিট। কেটে রেখেছি। সুপার ডিলাক্স। বাসটা আটটায় ছাড়বে।” কৃশানু বিগলিত। তবু কোথাও অদৃশ্য চিড় ধরেছিল বিকেলের মধুর নৈকট্যে।
ফেরার সময়ে দু’টো অটো। প্রুৎ ঘুমিয়ে পড়েছিল রাস্তাতেই। কৃশানু শুইয়ে দিয়েছিল বিছানায়। সোফায় আধশোয়া হয়ে সিলিং দেখছিল, “রাত খুব একটা হয়নি। ওদের রুমে বসে, বা এখানেই একটু আড্ডা দেওয়া যেত!” মৌমিতা ডলে ডলে ক্রিম মাখছিল পায়ের পাতায়। গভীর নীল পাৎলা রাতপোশাকের নিচে কালো নেটের ব্রা, ত্বকের উজ্জ্বল শুভ্রতা। কৃশানু সন্তর্পণে জানতে চেয়েছিল, “মৌ?” মৌমিতার গলাটা পুরোনো দইয়ের মত শোনাল, “আমার ঘুম পাচ্ছে। তুমি যাও।” টোকো ঝাঁঝ ব্রহ্মতালু পর্যন্ত। কৃশানু নিঃশব্দে উঠে পোশাক বদল করে আলো নিভিয়ে এল। প্রায়ান্ধকার স্নিগ্ধ রাতবাতি, হিমহিম ঠাণ্ডা ঘর। কম্বলের নিচে সে নাক ডুবিয়েছিল মৌমিতার সাদা ঘাড়ের পরিচিত গন্ধে। পা তুলে দিয়েছিল ওর কোমরে। অনেক রাতে জোয়ার আসে সমুদ্রে। থিতিয়ে যাওয়া ভিজে বালি তাড়াহুড়োয় জেগে ওঠে। আবেগে বারবার বলছিল, “লভ ইয়্যু মৌ... লভ ইউ মৌ।” অনেকদিন পর অভ্যাসাতিরিক্ত অতিরেকে সম্পৃক্ত কৃশানু। উঠে বাথরুমে গিয়েছিল দু’জনে পরপর। না ডাকলেও চুপকথারা নড়াচড়া চালিয়ে যায় অনেকসময়ে। “একটা শাড়ি অন্তত নিতে পারতে মৌ...,” কৃশানু টুং করেছিল স্পশর্কাতর বিন্দুতে। পিঠ ছুঁয়ে দৃঢ় উষ্ণ স্তন, রূপোর বালা-পরা গোল হাত বুকের ওপরে। ছোট হাতের পাতা, ফুলোফুলো আঙুলে সোনার আঙ্টিরা... ভীষণ চেনা। অনেকক্ষণ সংলগ্ন এভাবে। ফিসফিস করেছিল মৌমিতা, “শ্যামপর্ণী একটু... কেমন!” কেমন? পাঁজরে হাঙরের লেজের ঘাই। অথচ কোনো কারণ ছিল কিনা কৃশানু বোঝেনি। সে উত্তর খুঁজে পেলনা! মৌমিতার মাথার চুলে হাত বোলাতে চেয়ে চাঁদি ছুঁয়ে ফেলছিল। “খুব উঠে গেছে মৌ, না? কতরকম লোশন-টোশন?” অন্ধকারে মৌমিতার মুখ দেখা যায়নি। আস্তে করে কৃশানুর আদরের হাতটা নামিয়ে দিয়েছিল, “আমার চুল বরাবর পাতলাই। ঘুমোও। সকালে উঠতে হবে।” তার স্বর কোমল, অনুযোগহীন। কৃশানুর ঘড়ির রেডিয়াম জ্বলছিল। চোখ খুলে শুয়েছিল সে। দু’পাশে নিদ্রিত নিশ্বাসের ছন্দ মিলিয়ে ওঠাপড়া। তৃপ্তিতে আপ্লুত হওয়ার বদলে মাথার মধ্যে ক্রমাগত ঢেউয়ের ধাক্কা ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাচ্ছিল। সাময়িক, কেটে যাবে, কেটে যাবে...! সে ব্যালকনিতে গিয়ে বসল। জোর করে ভাবছিল, ‘ধুস্! সে কোথায় পাবে মৌয়ের আভিজাত্য? ওর পছন্দ? পাতি মামুলি!’ বাইরের জগতে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে মৌ যাবে চাকরি করতে, দুঃস্বপ্নও দেখেনা কৃশানু। সে চিরকাল সংযত, পত্নীনিষ্ঠ। তাও কেন অদ্ভুত অনুভূতির টালমাটাল? সবটাই ধোঁয়াটে... সংযোগহীন। কৃশানু ডুবছিল আর ভাসছিল। কী যে খুঁজছিল! দূরে হলেও মাঝরাতে নিঃঝুম বসে সমুদ্রের আহ্বান স্পষ্ট শোনা যায়। সে বুঁদ হয়ে কান পেতেছিল। পাশের স্যুটের লাগোয়া বারান্দায় সতৃষ্ণ তাকিয়েছিল। কেউ নেই ওখানে। ঘুমিয়ে পড়েছে ওরা? অপরিহার্য ক্রমশঃগুলো সরিয়ে রাখল জোর করে। কোথায় কান্নার শব্দ। কাছেই। করুণ আর তারযন্ত্রের মন্দ্রসপ্তকের মত চাপা, গভীর। ভরা রাতে অশরীরী কান্না কে কাঁদে? কেনই বা? অফুরন্ত চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে সনাতন পুণ্যভূমি। কৃশানু দ্রুত ঘরে এসে ফেলে যাওয়া রাজপাটের দখল নিল।
মৌমিতার ঘন নীলজমি লালপাড় দামী সাউথকটন, স্নান-ভেজা কাঁঠালিচাপার মত মুখ, অরুণিম টিপ। কৃশানুর বুকের মধ্যে তৃপ্তির দোল। লাল-হলুদ-সবুজ জামাকাপড়ে উজ্জ্বল প্রুৎ। ঠাণ্ডা একটু লেগেই গেছে বেচারার। মাথায় উলের টুপি। নির্ধারিত বাসের কাছে দাঁড়াতেই তিমির বলল, “সুপ্রভাত।” তাকে সতেজ দেখাচ্ছিল। “সুপ্রভাত কৃশানুদা’। আরে প্রুৎসাহেব, এতসব জামাকাপড়? গরম লাগবে যে! তোমায় কী মিষ্টি দেখাচ্ছে মৌ...,” শ্যামপর্ণী সুবাস ছড়িয়ে দিয়েছিল। কৃশানু সোজাসুজি তাকাচ্ছিল না। সৌজন্য বিনিময় করেছিল, “সুপ্রভাত। চলো তিমির, বাসে বসা যাক্, আশা করি পছন্দমত হবে।” মৌমিতা বলছিল, “তুমি কালকের কেনা শাড়িটা পরেছো? সুন্দর তো!” মুখর হয়েছিল শ্যামপর্ণী, “আসলে ভেবে রেখেছিলাম। প্রতিবছরই বেড়াতে যাইতো, একটা না একটা কিনি, পরেও ফেলি।” মৌমিতা ছোট্ট হেসেছিল, “তাই?” কৃশানুর মায়া হয়েছিল মৌমিতার জন্যে। বিশেষ কোথাও নিয়ে যায়নি তাকে। একই সঙ্গে পাঁজরে গুমগুম জলের শব্দ শুনতে পাচ্ছিল। বিশ্বাসঘাতক চোখে উদাসীনতার ভান। সাধারণ রংমিলন্তি কটকী শাড়ি বেয়ে চলেছে শরীরের বাঁকে। তিমিরের মাথার পেছনটায় চক্চকে ইন্দ্রলুপ্তির আভাসে তার যুক্তিহীন ঈর্ষা জেগেছিল। ট্যুরের বাসে আগে-পিছে সীট। নরম গদীওয়ালা। তাদের পেছনে তিমিররা, ওখানে প্রুৎও। কৃশানু জানালার বাইরে মাইলের পর মাইল ছুটে হারিয়ে যাচ্ছিল। ইতিহাসের ছাত্র সে নয়, কোনো কট্টরবাদীও নয়। সরে যেতে থাকা দৃশ্যসমষ্টি থেকে অজানা ভাপ উঠে এসে স্পর্শ করছিল। কোটি বছরের কাহিনিসূত্র, ভাষা, মানুষের বেড়ে ওঠা, সংঘাত, সমুদ্রবাতাসে, তটে আছড়ানো ঢেউয়ে কিম্বা ঝাউবনের ঝমঝমে আওয়াজে। আর পাঁচজনের মতো যাপনের স্বাভাবিক ব্যস্ততা, অফিস-সংক্রান্ত চাপ, ছেলে-বৌ, চাহিদার মুহূর্ত - অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিল অতীতের ঝাপটায়। যাত্রার শুরুতে দশর্নীয় দু’একটি জায়গায় থেমেছিল বাস। নেমেছিল সকলে। মধ্যযুগের অতুলনীয় স্থাপত্য। তিমির ক্যামেরায় মগ্ন, ফোটো তুলতে ভালোবাসে। কৃশানুও তুলছিল... প্রুৎ তার মায়ের কোল ঘেঁষে। একা। মৌমিতা রোদচশমায়। মৌমিতা মন্দিরের সামনে। দূর থেকে অনুপম সে বিভঙ্গ দেখে গোপন দমনের মুখোমুখি প্রবল সংঘাত চলছিল। অধিকার নেই। পুরুষাঙ্গ অসভ্য, অসংযত। অবশ্য জিতে যাচ্ছিল সংযম। আবার দীর্ঘ যাত্রা। কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল মৌমিতা সে টের পায়নি। বাস যখন থামলো, কাঁধের ওপরে কল্যাণী মুখ, কপালের টিপে ভোরের সূর্য। ভ্রূর মাঝে কী হালকা ভাঁজ? খুঁজে পেলনা। প্রচণ্ড আবেগে ধুয়ে গেল সব। নামিয়ে এনেছিল নিজের ঠোঁট। “এই... কি হচ্ছে? দেখবে সবাই...” মৌমিতা তৃপ্তিতে, লাবণ্যে টলটল। “বেশ হচ্ছে, দেখুক্...” জোর দিয়ে বলেও কিন্তু থামল সে। যাত্রীরা নেমে গেছে সকলে। প্রুৎও ওদের সঙ্গে।
মন্দির সূর্যের ঘোড়া, রথের প্রকাণ্ড চাকাগুলো... মহাকায় স্থাপত্য... কল্পনা আর বাস্তবে মেশানো ইতিকথা। কৃশানু মোহিত হয়ে গিয়েছিল। কে জানে কেন, ছোটবেলার স্মৃতির সঙ্গে মিল পাচ্ছিল না। যে কোনো নির্জনতা অস্তিত্ববিরোধী। কিন্তু মানুষ যতটা পারে চেটেপুটে খায়। ওরা পাঁচজন ছড়িয়ে গিয়েছিল। প্রুৎ মায়ের কাছে, তিমির ক্যামেরালগ্ন। কেউ হাওয়ায় সবর্নাশের রঙ ছড়িয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। কৃশানু খুঁড়ছিল নিজের মধ্যেকার চোরাবালি। সব ভুলভাল হচ্ছিল। তারপর দিশাহীন বেভুল কীভাবে পৌঁছেছিল অতীতের সীমায়। কেন? অথচ জানত ঠিকভুলের হিসেব কঠিন। বন্ধুস্ত্রী সে - গায়ের ভারী সুবাস কৃশানুর বুকের ভেতরে। এমনও হয়? তবু সাহসী প্রশ্রয় দিচ্ছে, এও অবাস্তব। এভাবে যাওয়া নেই। পথ বন্ধ। গণ্ডী স্পষ্ট দেগে দেওয়া... অবচেতনে টিংটিং সতর্কতা। আর প্রুৎ... তার আর মৌমিতার। নোতুন পরিষ্কার গন্ধহীন হাওয়া টেনে সরিয়ে এনেছিল তাকে। কৃশানু লম্বা উপদেশ ঝেড়েছিল নিজেকে। ঠাটিয়ে চড় খাচ্ছিল। টান মেরে আলগা করছিল কটকী নক্সার দুভের্দ্য ব্যূহ। আহত হয়েছিল। সেও কি লক্ষ্য করেনি কৃশানুকে? ফেরার রাস্তায় বাস যখন হস্তশিল্প গ্রামে দাঁড়াল, সকলেই ধ্বস্ত। উৎসাহে কমতি নেই। মৌমিতা দু’একটা জিনিস নিল... উপহার দেবে। বসল কাঠের টুলে, যতক্ষণ না বাস ছাড়ে আবার। “কী হয়েছে গো? শরীর খারাপ লাগছে?” শুনে চমকে উঠেছিল কৃশানু। যুদ্ধের কাটাকুটি কি মুখেও নাকি? কতক্ষণ ধরে তার দিকে তাকিয়ে আছে মৌ? “আরে নাঃ। কত দেরী হবে ভাবছি। তুমিও ড্যাম টায়ার্ড্।” এভাবে উড়িয়ে দিয়েছিল। অদূরে ছোট্ট দোকানের সামনে তিমির আর শ্যামপর্ণী। কিছু নিয়ে মতান্তর... কেনাকাটি সংক্রান্তই। এর মধ্যে তার কি ভূমিকা? সে চুলের মধ্যে হাত চালালো। এগিয়ে গেলো... মৌমিতার চোখের বাইরে স্বচ্ছন্দবোধ হবে ভেবে। চূড়ান্ত সপ্রতিভতা দেখিয়ে বলল, “কী তিমির, ম্যাডামের মতের বিরুদ্ধে যাচ্ছো নাকি?” তিমির একটু বিরক্ত ছিল, “আর বোলো না! কিনছে তো কিনছেই... আবার কতগুলো সিঁদুরকৌটো।” সেই ধরাধরা গলা সালিশি মানলো তাকে, “দেখুন না... কী ইউনিক! গিফ্ট্ দেবো যে, নিজেও রাখব...।” “বলো কী! স্বাধীন ওয়ার্কিং উওমেন তোমার মত... সিঁদুরটিঁদুর লাগাও? বিশ্বাস করো?” পরে অনেকবার ভেবেছে, কেন ওরকম আক্রমণ করেছিল। আলগা পায়ে চলতে গিয়ে আচমকা হোঁচট খেলে যেমন হয়, তেমন বিহ্বল তাকিয়েছিল শ্যামপর্ণী। একবার তার দিকে, একবার তিমিরের। তিমিরের মুখটাই প্রশ্নচিহ্ন! কথাগুলো রাবার দিয়ে মোছা সম্ভব নয়। কৃশানু ভীষণ কৃত্রিম আন্তরিকতায় বলেছিল, “আরে কি হল! চলো, বাস বোধহয় ছাড়ছে।”
ক্লান্ত ঘুমন্ত যাত্রীবাহী বাস কলরবশূন্য। তার কাঁধে মাথা রেখে মৌমিতাও। কৃশানু বাইরের অন্ধকারে দেখেছিল অপসৃয়মান ছিট্ছিট্ আলো। সমস্ত দিনটাকে ভেঙে বিশ্লেষণ করে স্বস্তি পাচ্ছিল না। অযৌক্তিক এই আদেখেলাপনা কেন? পরে লিখেছিল নিজের ডায়েরিতেও। তিমির ঘুমন্ত কি? পেছনের সীটে মৃদু নরম কথোপকথন। প্রুৎ যেন কোন্ গোপন কথা পাড়ছে, “জানো আন্টি, আমার মা না সাবানের বাব্ল বানাতে খুউব ভালোবাসে... বলে - দ্যাখ্ প্রুৎ, কেমন রঙগুলো! এটা না মা শুধু আমাকেই বলেছে...!” চাপা উত্তর ভাসল, “হ্যাঁ প্রুৎ... মা তার সব ভালো লাগার কথা তোমাকে বলবেই তো। ছেলেকে বলবে না?” কৃশানু নিজেকে সংশোধনের কথা ভেবেছিল। পরদিন মন্দিরে পুজো দেওয়া, তারপর চিল্কায় দুদি’ন। তিমিরদের প্রোগ্রাম জানা হয়নি। হোটেলে পৌঁছে নীরবে ঢুকে গিয়েছিল পাশাপাশি স্যুটে। খুবই ক্লান্ত। সন্ধে উৎরেছে অল্প আগে। এখানে নৈশাহার আজ। পোশাক বদলে প্রুৎ আর মৌমিতাকে পরিচ্ছন্ন দেখাচ্ছিল। সেও তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে ঘরোয়া পোশাকে। বলল, “চলো নিচে খেয়ে আসি।” নামার আগে ছোট্ট টোকা দিল পাশের দরজায়। খাবার টেবিলে সকলে মুখোমুখি। “মৌমিতা আজ একটু... প্লিজ বারণ কোরোনা। তুমিও নিও দু’সিপ...।” আনুষ্ঠানিক অনুমতি নিয়েছিল মৌমিতার। তিমিরের সামনেও গেলাস। শ্যামপর্ণীকে বলল, “তুমি?” শ্যামপর্ণীর অরেঞ্জ জুস্। উদাসভাবে মাথা নাড়ল। তুঁতেরঙ কাফতান পরেছিল। চুল আলগা বাঁধনে নরম। অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ! কৃশানুকে কড়্কড়ে ইচ্ছেগুলো কামড়াচ্ছিল। ভূমিকা নেই কিছু নেই, হঠাৎ টেবিল ঘুরিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ল, “কি তিমির? এভাবে কতবছর চালালে? ওয়ার্কিং স্পাউজ্, ট্যুরজ্ - এভাবে বেঁধে রাখা যায়? বিশ্বাস নড়ে যায়না? আমাদের দ্যাখোতো... কমপ্লিট বৃত্তে তিনজন। আমি অবশ্য হম দো হমারা দো-র পক্ষপাতি। বাট্, মৌয়ের শরীরের কথা ভেবেই... ওর সিজার বলে। লভ হার মাচ্... আর তোম্...” জড়িয়ে যাচ্ছিল স্বর। কৃশানুর কবে এত তাড়াতাড়ি নেশা হয়? টেবিলের তলায় মৌমিতার হাত তার হাঁটুতে। ফিসফিস অনুরোধ, “থামো প্লিজ্।” ফর্কে আটকানো বোনলেস্ পকোড়া বিস্বাদ। মৌমিতা ভয়ানক বিস্মিত আতঙ্কিতভাবে তাকিয়ে শ্যামপর্ণীর দিকে। সেই চোখ অস্বাভাবিক চক্চকে। ঘুমঘুম স্বর। মদের গ্লাসে ঠোঁটও ছোঁয়ায়নি, তাও টলছিল। সরু লম্বা আঙুল তুলেছিল মৌমিতার দিকে। ফ্যাসফ্যাসে স্বর চেরাচেরা, “এ্যা-ই... ইউ লিস্ন.. ‘বিলভেড্’ ওয়াইফ অব্... মিঃ... কি যেন! ওয়াটস্ দ্য নেম... হেল্ হেল্ হেল্! তোমার হাজ্ব্যান্ড... একটা...!” ভেঙে সে পড়ে যাচ্ছিল। তিমির তাকে দু’হাতে জড়িয়ে নিয়ে উঠে গেল টেবিল ছেড়ে, “এক্সকিউজ মী প্লিজ্।” কৃশানু থতমত খেয়ে বলতে গিয়েছিল, “জাস্ট এ জোক্...। ছিল!” তিমির বলল, “ঠিক আছে।” মৌমিতার চোখ থমথম। প্রুৎ মায়ের আঁচল ধরে জবুথবু শিশু। কৃশানুর সমস্ত দেহ জ্বলছিল। এরকমটা কি হবার ছিল? অবান্তর এই দৃশ্যনির্মাণ? অর্ডার দেওয়া সাধের কষা মাংসের প্লেট পড়ে রইল। ঘরে ঢুকে একটি শব্দ করেনি মৌমিতা। তাকায়নি কৃশানুর দিকে। কৃশানু কৈফিয়ৎ দিয়ে হাল্কা করতে চেয়েছিল, “মৌ, ব্যাপারটা কী হলো বলোতো! যত নাটক! আমি শুধু একটু...।” মৌমিতা কথা বলেনি। সারারাত প্রুৎএর দিকে পাশ ফিরেছিল। হয়তো ঘুমোচ্ছিল, হয়তো নয়। কৃশানু বুঝতে পারেনি। শেষরাতে অঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছিল সেও।
কোন্ ভোরে উঠে স্নান সেরেছিল মৌমিতা। ভিজে চুল সেঁটেছিল ঘাড়ে মাথায়। ফোলাফোলা হাল্কা হলুদ জামদানিটি স্নিগ্ধ। প্রুৎও ফিটফাট। দুটিতে চুপ করে বসেছিল ব্যালকনিতে। কৃশানু ঘুম ভেঙে “ডাকোনি কেন?” বলার সাহস পেলনা পর্যন্ত। দ্রুত তৈরি হয়ে ওদের নিয়ে নামার সময়ে আড়চোখে পাশের দরজা দেখেছিল। বন্ধ।
যেহেতু বেশ সকাল, ভীড় তত হয়নি মূল মন্দিরে। সুন্দর দর্শন। মন্দিরের কারুকাজ, গর্বিত স্থাপত্য দেখা গেল। সমুদ্রের পাড়ে এসে বসল। সূর্যোদয় হয়ে গেছে বেশ কিছুক্ষণ। স্নানার্থীর ঢল জলে নামছিল। নুলিয়াদের আনাগোনা। চমৎকার মনভোলানো। খানিক পরে একেবারে সামনে না গেলে জনজোয়ারে ঢেউয়ের উচ্ছ্বাস আর দেখা যাবেনা। মায়ের গা ঘেঁষে চুপ করে বসেছিল ছোট্ট ছেলেটা। একবারও বায়না করলনা জলের কাছে যাবার। অথচ কৃশানু ভীষণ চাইছিল সেটা। মৌমিতার গায়ের ফুল, চন্দন, পারফ্যুম মেশানো সুগন্ধ। প্রুৎ প্রায় অশ্রুতভাবে বলল, “মা, আন্টী এলোনা তো, ভালো লাগছে না।” কৃশানুর হৃদপিণ্ড লাফ মারল হঠাৎ। স্বামীস্ত্রীতে চোখাচোখি হল। সে বলল, “চল্তো, কী খাবি আজ ব্রেকফাস্ট-এ? এই রাস্তা ধরে দারুণ দোকান আছে।” শুধু রেস্টুরেন্ট নয়, অন্যান্য দোকানও সরগরম এতক্ষণে। পেট ভরে খাওয়া হল এই প্রথম এখানে এসে। শাড়ীর সাবেকি বড় দোকানটি পাশেই। কৃশানু অনুনয়ের ভঙ্গিতে তাকিয়েছিল। মৃদু হেসেছিল মৌমিতা। সামনে সামান্য উঁচু দাঁত। কৃশানুর মন বলল, এরি জন্যে সকালটি এত নির্মল। সেদিন বেশিক্ষণ সময় নিলনা মৌমিতা। কৃশানু দাঁড়িয়েছিল পাশে। কোনো মতামত নয়, মন্তব্য নয়, নীরব আগ্রহ নিয়ে। ক্রমশঃ ফিরছিল স্বঠিকানায়। একবারে তিনখানা শাড়ি কিনল মৌমিতা। দুটো দামী সিল্ক... একটা সোনালি বালির রঙে, একটা সমুদ্রী শাঁখের। রেশম সুতোর পাড়। ওর চোখ আনন্দে ঝিকঝিক করছিল। তৃতীয়টি মাঝারি দামের সেই সবুজ-লাল-হলুদ-কালো মেশা ওড়িশি সুতোয় হবহু এক। কেন? কৃশানু দেখল। চোখে জল এল খামোকা। “তুমি এসো। আমি কাউন্টারে পেমেন্ট করছি।” সরে গেল সামনে থেকে। সারাদিন ধরে কাছেপিঠে ঘোরা হল, বেশ খাওয়া হল দুপুরে। চিল্কা যাওয়ার গাড়ি বুক্ হল। উচ্ছ্বল প্রাণবন্ত প্রুৎ। সিগরেট ঠোঁটে নিয়ে পাড়ের দিকে বেঞ্চে বসেছিল কৃশানু। ছেলের হাত ধরে হাঁটছিল মৌমিতা। বাতাসে এখন অনেক দূষণ। বুক ভরে শ্বাস নিতে কোথাও আটকাচ্ছিল। এই অবিরল বিস্তৃত বেলাভূমে সে ভীষণ একা বোধ করছিল। কেমন অবরুদ্ধ ভয়। আত্মবীক্ষণ, আত্মসমীক্ষা... অতখানি গভীর সে নয়, তবু হঠাৎ পাওয়া অস্থায়ী দার্শনিকতা! নিজের শহরে ফিরে যাবার সঙ্গেই মিলিয়ে যাবে, এও সত্যি।
“ওরা চলে গেছে সকালেই,” বলেছিল রিসেপশন। কোথায় – জানতে চাওয়া অশোভন। সে চুপ করেছিল। “আ প্যাকেট ফর ইউ স্যর... টোল্ড আস্ টু হ্যান্ড ওভার।” হাতে তুলে দিয়েছিল সুদৃশ্য প্যাকেট। ঘরে ঢুকে বাতি জ্বেলে ধীরে ধীরে খুলল। তাড়াহুড়ো করল না। কাঠের খেলনাটা পেয়ে উচ্ছ্বসিত প্রুৎ। রূপোর চমৎকার সিঁদুরের কোটোটি। আর কোণার্ক মন্দিরের ছোট্ট রেপ্লিকা। শাড়ি তিনটে খাটে ছড়ানো। বালিরঙ শাড়িটায় হাত রেখে আস্তে করে বলেছিল মৌমিতা, “ভেবেছিলাম এটা ওকে...।” ততক্ষণে ব্যালকনিতে কৃশানু। হাতের চিরকুট দেখাতে চায়নি মৌকে। ইংরেজিতে একরত্তি চিঠি তিমিরের।
“ডিয়ার কৃশানু, বিভিন্ন পারিবারিক অসুবিধার কারণে আমাদের বিয়েতে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। তার আগে আমাদেরই অসতর্কতায় যে মিশ্হ্যাপ হয়, তা আর শোধরানো যায়নি। তারপর থেকে শ্যামপর্ণী...। আজ যা দেখলে ওটা তাৎক্ষণিক কিছু নয়। সরি ফর এভরিথিং। ভালো থেকো। তিমির।”
ছিঁড়ে ফেলা কাগজের সব কুচি এলোমেলো হাওয়ায় ছড়িয়ে পড়ল এদিক ওদিক। তিমিরের মোবাইল নম্বর সে নোট করেছিল। কথাটা মনে পড়ল।