দিনটা পুকানের কাছে মোটেই ভাল ছিল না। রাতে শোবার পরও মনটা কেবল ডুকরে উঠছে। বুকের ভেতরটা ফাঁপাচ্ছে থেকে থেকেই। চোখের জল বের হয় আর কি! কেন যে মা অমনভাবে মারল! বুঝে উঠতেই পারে না পুকান। আসলে ইউনিট টেস্টের অঙ্কের নম্বরটাই যত গণ্ডগোল পাকালো। স্কুল থেকে ফেরার পথেই জেনেছিল মা। তারপরই রেগে আগুন। সঙ্গে সঙ্গে দু-তিনবার কানমলা। বাড়িতে আসার পর বেধড়ক মার। ভাগ্যিস কাকু ধরেছিল। তা না হলে আজ আর রক্ষে ছিল না। সারা গায়েই চাকা চাকা দাগ হয়ে যেত। পুকানের অপরাধ অঙ্কে পঁচিশের মধ্যে কুড়ি পাওয়া। মা-র প্রশ্ন, শুভ যদি অঙ্কে পঁচিশের মধ্যে পঁচিশ পেতে পারে, তা হলে সে কেন পাবে না?
রাতে শুয়ে পুকান পিঠে ব্যথা অনুভব করে। কিন্তু কাউকে কিছু বলে না। শুধু মনে হয় চারিদিকে সবাই নিষ্ঠুর। মা ও এখন তাকে ভালবাসে না। এই ছ'বছর বয়সেই তাকে কত ইংরেজী বই পড়তে হয়। কিচ্ছু মাথায় ঢোকে না। কেবল মুখস্থ আর মুখস্থ। অসহ্য লাগে পুকানের। কিন্তু নিরুপায়। কি করতে পারে সে! ঠোঁট দুটো ফুলে ওঠে পুকানের। সামনে সরস্বতী পুজো। পুকান ভাবছে এবার মা সরস্বতীকে বলবে তাকে যেন কালিদাসের মত তাড়াতাড়ি মহাপণ্ডিত করে দেয়। তা হলে আর মা-র পিটুনি খেতে হবে না। ভাবতে ভাবতে খোলা জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে পুকান। রাতে শুয়ে শুয়ে দেখে আকাশে অসংখ্য তারার ঝিকিমিকি। কেউ কেউ মিটমিট করে হাসছে। কেউ যেন ঘুমের হাতছানি দিচ্ছে অনবরত।
স্কুলে এবার ধুমধাম করে সরস্বতী পুজো হচ্ছে। সুন্দর প্রতিমা। সাজানো হয়েছে ভালই। ঠাকুরের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে পুকান। অনেক ছাত্র-ছাত্রী এসেছে স্কুলে। সকলেই হই হই করছে আনন্দে। দুপুরে আছে খাওয়া-দাওয়ার পর্ব। সন্ধেয় হবে আরতি। তারপর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। গত বছর পুকান আবৃত্তি করেছিল। সকলেই প্রশংসা করেছে। হাততালি দিয়েছে। এবার কিছুই করার মন নেই। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে প্রতিমার দিকে। মনে মনে যেন বলছে, ঠাকুর আমাকে কালিদাসের মতো পণ্ডিত করে দাও। তাহলে আমাকে আর মার খেতে হবে না। ও মা এ কী কাণ্ড! মনে হল সরস্বতী ঠাকুরের চোখ দুটো যেন নড়ে উঠল একবার। মুখে তার হাসি। হাতের ইশারায় কাছে ডাকছে পুকানকে। আশেপাশে কেউ নেই। শুধু পুকান একা। বাতাসে একটা সুন্দর গন্ধ। চারিদিকে মায়াময় আলো। ঠাকুরের মুকুট থেকে ঠিকরে বের হচ্ছে জ্যোতি। স্কুলটা যেন আর স্কুল নেই। দেবলোক মনে হচ্ছে। মিষ্টি সুরে মাখামাখি। পুকান কি করবে ঠিক করতে পারে না। অনেক ভেবে এক পা, দু'পা করে এগোতে থাকে। হাত দুটো জোড় করা। ঠাকুর যেন এবার স্নেহ মাখা কণ্ঠে বলছে, কাছে এসো, তোমার মুখ অমন কালো কেন! পুকান কি বলবে বুঝতে পারে না। শুধু একবার ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। কিন্তু এ যে অবাক কাণ্ড! ঠাকুর এবার সিংহাসন থেকে নেমে একেবারে পুকানের সামনে। এক হাত পুকানের মাথায়, আর এক হাত থেকে ঝরছে অসংখ্য ফুল। ঠাকুর মাথায় হাত ছোঁয়াতেই পুকানের সারা দেহে কেমন শিহরণ খেলে গেল। নিমেষের মধ্যেই পুকানের মনে হল সে যেন বড় পণ্ডিত হয়ে উঠেছে। আর তাকে পায় কে। এখন থেকে আর কারও কাছে মার খেতে হবে না। বরং উল্টে সে অন্যকেই বকতে পারবে। আনন্দে মা... মা... বলে চিৎকার করে উঠল পুকান।
পুকানের চিৎকার শুনে মা এলেন ছুটে। বললেন, ঘুমের মধ্যে অমন মা... মা... বলে চিৎকার করছো কেন? সাড়ে পাঁচটা বাজে, উঠে পড়। স্কুল যেতে হবে।
স্বপ্ন ভাঙার পর পুকানের মনটা আবার খারাপ হয়ে গেল। ফের স্কুলে যাওয়া। সেই ঢাউস ব্যাগ। মা-র বকুনি। বিছানা থেকে নেমে আসে পুকান।