• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৫৬ | মার্চ ২০১৪ | গ্রম্থ-সমালোচনা
    Share
  • একটি আবশ্যক জীবনকথা : শ্রীধর মুখোপাধ্যায়


    একজন অখ্যাত বাঙালির জীবনচরিত; সমীর সেনগুপ্ত; প্রথম প্রকাশ: বইমেলা, জানুয়ারী ২০১৪, অব্যয় লিটারারি সোসাইটি - কলকাতা, পৃষ্ঠাঃ ৮৮

    বিখ্যাত নন অথচ অনন্যসাধারণ ছিলেন এক বাঙালি ভদ্রলোক - ডাঃ শিশিরচন্দ্র সেন। তাঁর সুযোগ্য পুত্র, বিশিষ্ট রবীন্দ্রগবেষক, জীবনীকার ও প্রাবন্ধিক সমীর সেনগুপ্ত জীবনের শেষপ্রান্তে পৌঁছে রচনা করেন ডাঃ সেনের জীবনচরিত। এমন সুন্দর একটি বই - যা আমাদের মতো বহুজনকে মুগ্ধ ও বিস্মিত করেছে তা তিনি দেখে যেতে পারেন নি — এটা সবিশেষ বেদনার কথা।

    ডাঃ সেনের বিস্ময়কর যাপন-ই এ বই-এর উপজীব্য, কিন্তু এই বইতে আমরা আরও যা পাই তা সমীর সেনগুপ্তের অনবদ্য মসৃণ ভাষা ও লেখার প্রসাদগুণ। এমন সুন্দর সতেজ গদ্য লিখতেন তিনি কেন যে ক্রিয়েটিভ লেখালিখি তেমনভাবে করলেন না তা রহস্যই থেকে গেল।

    নিকট আত্মীয় সম্পর্কে লিখতে বসলে সর্বদাই আবেগ ও অতিরঞ্জনের সম্ভাবনা থেকে যায়। এ বইটির ক্ষেত্রে অবশ্য সে কথা খাটে না। সমীর নিজেই লিখেছেন — 'যথাসম্ভব নিরঞ্জনভাবে, এবং যথাসম্ভব দূরে দাঁড়িয়ে আমি শিশিরচন্দ্রের জীবনকাহিনী বর্ণনা করার চেষ্টা করব।'

    আলোচ্য গ্রন্থটিতে একটি মানুষের সমস্ত জীবনব্যাপী রোমাঞ্চকর ঘটনার বর্ণনা থাকলেও যা এ বইকে সমৃদ্ধ করেছে তা হল শিশিরচন্দ্রের জীবনের সঙ্গে চলতে চলতে লেখক আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন সেইসব সময়ের ও যেসব জায়গায় তিনি ছিলেন সেখানকার সংক্ষিপ্ত কিন্তু নির্দিষ্ট ইতিহাস। এই প্রেক্ষাপটের অবতারণা না থাকলে স্মৃতিকথনের মূল্য বেশ কমে যায়।

    শিশিরচন্দ্রের জীবনী পাঠ করতে করতে আমরা জেনে যাই স্বদেশী আন্দোলনের পরবর্তী সময়ে ঢাকা শহরে নিয়মিত ছোটখাট সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার খবরও। জানতে পারি সেখানে ঢাকার নবাবের আদেশে হিন্দুদের ঘরে লাঠি রাখাও বেআইনি ছিল। সমীর তাঁর পিতৃদেবের যৌবনের কথা বলার ফাঁকে আমাদের জানিয়ে দেন গত শতকের ত্রিশের দশকের অর্থনৈতিক মন্দা ও তার প্রভাবের কথা। শিশিরচন্দ্রের রেঙ্গুনে বসবাসের কথা। পড়তে গিয়ে আমরা জেনে যাই বর্মা (বর্তমান মায়নামার)-র তৎকালীন রাজনৈতিক ইতিহাস। ছোট ছোট বাক্যে গল্প বলার ঢঙে লেখক তরতর করে সাবলীলভাবে এগিয়ে যান ঘটনা থেকে ঘটনান্তরে।

    শিশিরচন্দ্র সম্পর্কে বইটি পড়ার আগে তাঁর সম্পর্কে একটা মোটামুটি ধারণা করতে লেখকের একটি বাক্যই যথাযথ। তিনি লিখছেন — 'ইংরেজিতে যাকে বিপজ্জনকভাবে বেঁচে থাকা বলে - Living dangerously' - ঢাকার ছাত্রজীবন থেকেই তার লবনাক্ত স্বাদ পেয়ে গিয়েছিলেন শিশিরচন্দ্র, সারা জীবনেই সেই স্বাদের জন্য প্রলোভন তাঁর শমিত হয় নি।'

    দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন জাহাজের ডাক্তার ছিলেন শিশিরচন্দ্র। তখন সাধারণ জাহাজও ইংরেজ নৌবাহিনীর আওতায়। দীর্ঘদিন তাঁর কোনও খবর নেই। তিনি যে পিতা হয়েছেন তাও তাঁর অজানা। খবর এল ৬০ খানা জাহাজ পণ্য নিয়ে ভারতের দিকে আসবে ঘুর পথে। এ প্রসঙ্গে লেখক প্রায় নিরাসক্ত দর্শকের মতো ধারাবিবরণী দিয়েছেন: 'সব দুঃস্বপ্নই এক সময়ে শেষ হয়। একদিন উত্তমাশা অন্তরীপ পার হয়ে ভারত মহাসাগরে এসে পড়ল ৩১ খানা বাণিজ্য জাহাজ, বাকিগুলি ডুবে গেছে অতলান্তিকে ... তাও কি খবর আসে। তখনও তাদের থেকে চিঠিপত্র চলাচল মানা ... অবশেষে বোম্বাই থেকে ডাঃ সেনের টেলিগ্রাম এসে পৌঁছল নারায়ণগঞ্জের বাসাবাড়িতে ... এই টেলিগ্রাম এসে পৌঁছনোর পরের দিন মা আয়নায় দেখলেন এক রাত্রে তাঁর অজস্র চুল পেকে সাদা হয়ে গেছে।' — এই শেষ লাইনটিতে স্পষ্ট স্বাক্ষর সমীর সেনগুপ্তের মধুর লেখনের।

    সমস্ত জীবনই যেন অ্যাডভেঞ্চার ছিল ডাঃ সেনের কাছে। কিন্তু ঠিক অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় যে এমন তিনি করেছেন তা নয় - এসব করতে হয়েছে নিছকই বেঁচে থাকার জন্য। বর্মায় থাকাকালীন তিনি ও তাঁর পরিবার উগ্রবাদী বিপ্লবীদের হাত থেকে কাদাভরা গর্তের মধ্যে কলাবাগানে গুলিগোলা বাঁচিয়ে সারারাত কাটিয়েছেন। অরুণাচলের প্রত্যন্ত সেনাছাউনি থেকে চীনা আক্রমণের সময় একটি কম্বল, টর্চ, ছাতা ও রাইফেল নিয়ে ভয়াল পাহাড়ী পথে বম্‌ডিলা এসেছেন। বরাবর তিনি মৃত্যুর সঙ্গেও যেন সহবাস করে গেছেন।

    শিশিরচন্দ্র উপার্জন করেছেন প্রচুর কিন্তু মাঝেমধ্যেই তিনি ভীষণ আর্থিক কষ্টের মুখে পড়েছেন। আর অদ্ভুতভাবে একেবারে শেষ সময়ে তার সামনে আবার একটি সুযোগ এগিয়ে এসেছে। সত্যি বলতে কী সমীর সেনগুপ্তকে যাঁরা চিনতেন না তাদের পক্ষে সত্যিই বিশ্বাস করা শক্ত হতে পারে এসব সত্য কী না — এমন অদ্ভুত, বিচিত্র জীবন একেবারে বিস্ময়কর তো বটেই!

    শিশিরচন্দ্র 'অখ্যাত' মানুষ হয়ত ছিলেন, কিন্তু তিনি ছিলেন মানব মহাকাব্যের পুরুষ। জীবনের প্রতি তাঁর ভালবাসা, তাঁর সাহসিকতা, উদ্যম ও সৃষ্টিশীলতা এবং মানুষের প্রতি বিশ্বাস মানবের সেই চিরন্তন প্রত্যয়, শুভবোধ ও প্রতিবন্ধকাতে পেরিয়ে যাবার ইচ্ছাশক্তিরই পরিচয়। এইসব মানুষই সহমানুষদের কাছে হয়ে ওঠেন আদর্শ — নির্ভীক লাইটহাউস।

    সমীর সেনগুপ্তের এই বইটি শোক পেরিয়ে তাঁর স্ত্রী মায়া সেনগুপ্ত প্রকাশ করে আমাদের ধন্যবাদার্হ্য হয়েছেন। সমীরের মতো মানুষের প্রতি তর্পণ তো একমাত্র এমনই হতে পারত।

    আলোচ্য বইটি কেবল অনন্য নয়, এটি আবশ্যকও বটে। আমরা আশা করব এমন সুগ্রন্থ পাঠ থেকে পাঠক যেন নিজেকে বঞ্চিত না করেন।

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments