বিদুর; মিহির সেনগুপ্ত; প্রথম প্রকাশ: ২০০২, সুবর্ণরেখা, পরিবর্ধিত সংস্করণ: ২০১২, সাহিত্য সংসদ - কলকাতা, পৃষ্ঠাঃ ২২৩; ISBN: 978-81-7955-209-4
মহাভারতকে বলা যেতে পারে বিচিত্রের বিস্ময়মঞ্জুষা। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধকাল সম্বন্ধে মতভেদ আছে —খৃ. পূ. ৩০০০ থেকে খৃ. পূ. দশম শতাব্দ পর্যন্ত, আদি মহাভারত হয়ত খৃ. পূ. ৫ম বা ৪র্থ শতাব্দের রচনা, যাতে বহু আখ্যানের বৈচিত্র্য-নদী মিলে মিশে তৈরি করেছে মহাসাগর। রবীন্দ্রনাথ তাই বলেন - এ বইটি যেন 'একটি জাতির সমগ্রতার এক বিরাট মূর্তি', এ বইকে এক ব্যক্তিবিশেষের রচনা বলা যাবে না, বরং বলা ভালো 'ইহা একটি জাতির স্বরচিত স্বাভাবিক ইতিহাস'। মহাভারত সুপ্রাচীনকাল থেকে বিশাল বটবৃক্ষের মত ভারতীয় জীবনে ছায়া দান করেছে, বহুকালের বহুভাষী পাঠককে প্রেরণা দিয়েছে, সমৃদ্ধ করেছে, সচল রেখেছে। সাধারণ পাঠক মহাভারতের গল্প পড়তে আগ্রহী, কিন্তু তাতে অনেক 'সন্দর্ভ'ও আছে। এ বই একই সঙ্গে 'সংগ্রহগ্রন্থ' (সংহিতা) আবার ধর্মগ্রন্থ (পঞ্চমবেদ)। কেউ বলেন এটি মহাকাব্য, কারো মতে ইতিহাস। রাজশেখর বসু তাঁর আধুনিক ধর্মবিযুক্ত মন নিয়ে বলেন—বইটি হল 'অতিপ্রাচীন ইতিহাস' ও 'রূপকথা'র সমন্বয়, যাতে মেলে 'মনোহারিতা', 'মনস্তত্ত্ব', 'জীবন্ত চরিত্রের জটিলতা ও অসংগতি'। ঘটনা ও চরিত্রগত অসংগতির কার—'কিংবদন্তীর যোজনা', 'আঞ্চলিক অভিক্ষেপ', 'প্রাচীন ও আধুনিক আদর্শের পার্থক্য'। একথা সর্বজনীন স্বীকৃত যে মহাভারতের ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে, খৃ. পূ. ভারতীয় সমাজ ও জীবনযাত্রার ধারণা মেলে এর থেকে। গল্পের মধ্যে গল্প, মূল গল্পের চারপাশে গল্পের ডালপালা রামায়ণ মহাভারত ইলিয়াড অডিসী বা আরব্যরজনীর মধ্যে মেলে। মহাভারতের মনোরঞ্জন ধর্ম, লোকশিক্ষা, ধর্মতত্ত্ব শিক্ষা—যুগে যুগে এই অনিঃশেষ সম্পদকে সাধারণ মানুষ, প্রাজ্ঞগণ, সৃজনশীল মানুষ নানাভাবে দেখেছেন—কখনো সামগ্রিকতায়, কখনো খণ্ডতায়।
পণ্ডিতদের মতে এ বই যেহেতু Primary Epic তাই মহাভারত তুলনীয় Gilgamesh, Iliad, Odyssey, Beowulf, The Lays of the Elder Edda, দক্ষিণ স্লাভদের Narodne Pesmeএর সঙ্গে। এর পাশে অপেক্ষাকৃত আধুনিককালে আসে literary epic. মৌখিক মহাকাব্যের ধারাটি প্রাচ্যে, পাশ্চাত্যে দু জায়গাতেই আজও বহমান। স্বভাবতই সৃজনশিল্পীর কাছে—কথাসাহিত্যিক বা কবি, নাট্যকার বা গায়ক, চিত্রী বা স্থপতি সবার কাছে অন্য অনেক বিষয়ের মতো প্রাচীন মহাকাব্যও প্রেরণা স্থল—স্রষ্টা হয় পুরাণ কাহিনীতে মাহাত্ম্যকথা হিসেবে নবভাষায় হাজির করছেন, অথবা সেইসব কাহিনীর বা চরিত্রের স্রষ্টার সমকালীন প্রসঙ্গ দ্বারা নতুন ভাষ্য আবিষ্কার করতে সচেষ্ট হচ্ছেন। এই বিষয়ক তালিকা করা আমার পক্ষে অসাধ্য। তবে এ-প্রসঙ্গে Kazantzakis-এর Odyssey, Vasco Papa-র Secondary Heaven (১৯৬৮), জয়েসের ইউলিসিস প্রভৃতির নাম করতে পারি। এ ধরনের রচনায় আধুনিক স্রষ্টা আত্মজৈবনিকতাকে ঢুকিয়ে দেন, আধুনিক আবহ নির্মাণ করেন যদিও অনিবার্য আভা থাকে প্রাচীন কাব্যের বা কাহিনীর। এ প্রয়াস একালের পাঠককে বিস্মিত করে, আবার বিতর্কও গড়ে ওঠে। যেমন ধরা যাক কাজান্টজাকিস রচিত 'The Last Temptations of Christ,' (১৯৫৫) যাতে দেখানো হয় অনুভবক্লিষ্ট যীশুকে, যিনি তাঁর দৈবত্ব বর্জন করে একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে জীবন কাটাতে চান। উপন্যাসটি গোঁড়া গ্রীক ও রোমান ক্যাথলিক গির্জা সংলগ্ন পুরোহিতদের তীব্র বিরাগ তৈরি করে, তাঁরা তাঁকে হত্যার হুমকি দেয়। ইনি পরেও লিখেছেনো—Saint Francis (১৯৫৬)। তাছাড়া সারামাগো লেখেন The Gospel According to Jesus Christ (১৯৯১) যাতে দেখানো হয় ভগবান ও শয়তান পাপ বিষয়ে সমঝোতায় আসে আর যীশু তাঁর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলে, চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বসে খোদ ভগবানকেই। পর্তুগালে এ নিয়ে বিরাট হৈ চৈ হয়, একটি ইউরোপীয় পুরস্কারের জন্য নাম তালিকাভুক্ত হয়েছিল, তা খারিজ হয়ে যায়।
শিশির কুমার দাশ বলেন প্রাচীন ঐতিহ্য অনুগামী হিসেবে মিথলজিক্যাল থীম বহমান, আবার নবতর ভাবনায় উনবিংশ শতাব্দী থেকে। আধুনিক লেখক ও পাঠককুলের একাংশ ইতিহাস ও মিথলজিকে পৃথক রাখতে চান, এবং কল্পনা ব্যবহার করেন, এভাবে আধুনিক মনোভাব গুরুত্ব পায়। শিশিরবাবুর একটি কথা তাৎপর্যপূর্ণ। তা হল রামায়ণ মহাভারত অনুসারী রচনা প্রয়াস Pan-Indian character of the myths গড়ে তোলে। তা প্রধানতঃ সংস্কৃত মহাকাব্য অনুসারী। আধুনিক রচনায় কাঠামোগত গভীর স্তরে এক শিক্ষিত সম্প্রদায়ের উপযোগী রচনা নির্মাণে নতুন ইমেজ, রূপক, নীতিকথা, প্যারাব্ল প্রভৃতি যে কাজ করে, মিহির সেনগুপ্তও সেই পথে গেছেন। পূর্বোক্ত সম্প্রদায়ের অবচেতন ও অচেতন স্তরে প্রবচন, ইডিয়ম, কিছু শব্দার্থ যা প্রাচীন মহাকাব্যসম্ভুত নতুনভাবে কাজ করে যায়। 'বিদুর' উপন্যাসেও এমন কিছু উদাহরণ আছে। এক্ষেত্রে প্রচল ধারণার লঙ্ঘন আসতে পারে। তবে নাটকে, কবিতায় যতটা উপন্যাসে তুলনায় তা কম। গ্রীক নাটকে লেজেণ্ডের সংখ্যা তুলনায় কম, কিন্তু ভারতীয় মহাকাব্যে লেজেণ্ড বহুবিধ, অঞ্চল-ভেদে আরো অনেক প্রকার। শিশিরবাবু দেখান চিত্রাঙ্গদা, নল-দময়ন্তী দ্রৌপদী প্রভৃতি নারী, অভিমন্যু, কর্ণ, কৃষ্ণ, দুর্যোধন, ভীষ্ম, অশ্বথামা, যযাতি প্রভৃতি পুরুষকে নিয়ে যে উপাখ্যান তা সর্বভারতীয় স্তরে সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় বেশি গৃহীত হয়েছে। দ্রৌপদী প্রসঙ্গে তাঁর যে মন্তব্য (Each age has discovered a contemporary meaning in the Draupadi theme) তা মহাভারতের গৃহীত অন্যান্য চরিত্র সম্পর্কেও প্রযোজ্য। এখানে লক্ষণীয়, বিদুর চরিত্র কিন্তু উপেক্ষিতই থেকে গেছে। মিহির সেনগুপ্ত বিদুর উপাখ্যানকে উপন্যাসের অবলম্বন করে সম্ভাবনার সদ্ব্যবহার করেছেন। তিনিও বিদুরকে দেখতে চেয়েছেন একালের চোখে। পাঠকের আলোচনার্থে মহাভারত অবলম্বনে কয়েকটি বাংলা উপন্যাসের উল্লেখ করি। কর্ণকে নিয়ে উপন্যাস লিখেছেন প্রভাত ঘোষ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, (সুনীলের 'অর্জুন' অবশ্য মিথলজিক্যাল নয়), এই সঙ্গে উল্লেখ করতে পারি পাঞ্চজন্য (গজেন্দ্র কুমার মিত্র), শাম্ব (কালকূট), দ্বৈপায়নে দুর্যোধন (দীপকচন্দ্র), কৃষ্ণস্তু ভগবান (দীপকচন্দ্র), অরণ্যপর্ব (শচীন দাস), যযাতির মহাপ্রস্থান (চিত্তরঞ্জন সেনগুপ্ত), অভিমন্যু (আশুতোষ ভট্টাচার্য) প্রভৃতির কথা।
মিহির সেনগুপ্তের 'বিদুর' বইটির পরিচিতিতে বলা হয়েছে—A novel based on Mahabharata. লেখক নিজেই বলেছেন এ রচনা 'উপন্যাস' তবে মহাভারতের একটি চরিত্র অবলম্বনে উপন্যাস রচনা প্রয়াসকে বিনয়বশত 'ধৃষ্টতা' বলতে চেয়েছেন। অন্যত্র এ রচনাকে বলেছেন—'আলেখ্য'। অতএব, বইটিকে আমরা উপন্যাস হিসেবেই পাঠ করলে লেখকের প্রতি সুবিচার করা হবে বলে মনে হয়। বিদুর যেহেতু মহাকাব্যের চরিত্র তাই প্রথমে তাঁর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, যা মহাভারতে প্রাপ্তব্য, দেওয়া যাক। বিদুর হল ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুর ছোট ভাই, শূদ্রা দাসী অম্বালিকা ও অত্রির ছেলে সে। এরা তিনভাই হস্তিনাপুরে ভীষ্মের কাছে পালিত হন। ভীষ্মের উদ্যোগে শাস্ত্রজ্ঞ শস্ত্রবিদ্যা পারদর্শী বিদুর-এর বিয়ে জনৈকা শূদ্রার কন্যার সঙ্গে; তাদের অনেক সন্ততি। দুর্যোধনের হালচাল দেখে বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে বলেছিলেন দুর্যোধনকে ত্যাগ করতে, যা করা হয়নি। প্রথমদিকে কৌরব ও পাণ্ডব উভয়ের প্রতি সম-স্নেহ থাকলেও পিতার মৃত্যু এবং ধর্মপরায়ণতার জন্য পাণ্ডবদের প্রতি স্নেহের আধিক্য। দুর্যোধনের মন্ত্রী হয়েও পাণ্ডবদের প্রতি তার পক্ষপাতিত্ব। জতুগৃহ ষড়যন্ত্র ভীষ্মের কাছে ফাঁস, সুড়ঙ্গ কাটতে সহায়তা, বিদুরের চাপে পাণ্ডবদের অর্ধরাজ্য দানের কথা, পাশাখেলায় বাধা দান, কপট পাশায় বিপন্ন পাণ্ডবদের রক্ষামনস্কতায় দুর্যোধন কর্তৃক অপমানিত হওয়া, দ্রৌপদীকে পণ রাখায় প্রতিবাদ, পাণ্ডবদের বনগমন কালে কুন্তীকে আশ্রয় দান, বিচলিত ধৃতরাষ্ট্রকে উপদেশ, ধৃতরাষ্ট্রের নির্দেশে বিদুরের রাজপ্রাসাদ ত্যাগ ও কাম্যক বনে বাস তার জীবনের কয়েকটি ঘটনা। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ-নিবৃত্তিতে তিনি ব্যর্থ, কৃষ্ণকে আতিথ্যদান, কৃষ্ণবন্দীত্বে প্রতিবাদ, যুদ্ধশেষে ধৃতরাষ্ট্রকে সান্ত্বনা, যুদ্ধান্তে পাণ্ডবদের ধর্ম ও আইনমন্ত্রীত্ব, শেষে ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণপ্রস্থ, একক বস্ত্রবিরহিত তপস্যা, মৃত্যু ইত্যাদিও মহাভারতে আছে। ভাগবতে আছে সামান্য গল্পান্তর। মিহিরবাবু লক্ষ্য করেছেন বিদুর চরিত্রটি উদ্যোগপর্বের অনেক পরে, শল্যপর্বে মাত্র একস্থানে ধৃতরাষ্ট্রকে সান্ত্বনা দেবার প্রসঙ্গে বিদুর-এর উল্লেখ আছে।
উপন্যাসটিতে অধ্যায় ভাগ আছে যদিও অধ্যায় সংখ্যা নেই, আমার হিসেব মত ১১-নং অধ্যায়টি অন্যগুলির তুলনায় অত্যন্ত দীর্ঘ। উপন্যাস শুরু হয় বিদুরের এককোক্তি দিয়ে—'অবশেষে আমি হস্তিনার রাজপ্রাসাদ থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসন নিলাম।' যদিও মহাভারত বলছে ধৃতরাষ্ট্রের নির্দেশে বিদুরের রাজপ্রাসাদ ত্যাগ। বিদুরজীবনের আনুপূর্বিকতা নয়, শেষাংশ অবলম্বিত, সেখান থেকে পিছনযাত্রা। এই নির্বাচনের স্বাধীনতা অবশ্যই আছে ঔপন্যাসিকের। প্রজ্ঞাবান বিদুর আত্মবিশ্লেষণ করছেন। যুগ ও পরিস্থিতির বিচার করছেন। বিদুরের এই উক্তিসমূহ কোনো ব্যক্তিচরিত্রের উদ্দেশে নয়, বরং বলা যায় স্বগতোক্তি অথবা পাঠক-উদ্দেশে বলা। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পরবর্তীকালে প্রব্রজ্যারত বিদুর ফিরে আসেন রাজ আবহে, তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ এবং অনুত্তেজিত মানসিকতায় যুগ, সমাজ ও ব্যক্তির বিশ্লেষণে প্রবৃত্ত হন। সঞ্জয়কে অবলম্বন করে বিদুর তাঁর পরবর্তী কার্যকলাপ শুরু করবেন স্থির করেন (পৃ. ১২৯)। জীবন পর্যবেক্ষণের উত্তরোত্তর নৈপুণ্যে বিদুর চরিত্রটি পাঠকের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে থাকে। অন্যান্য পাত্রপাত্রীর কথা, সংলাপ যে নেই তা নয়, কিন্তু লেখক বিদুরকেই যথাসম্ভব প্রাধান্য দেন। বিদুর পূর্বজীবন ও বর্তমান জীবন এই দুয়ের বিচার করেই চলে। দীর্ঘ ১১-নং অধ্যায়ে কাহিনীর অগ্রগতি যে একেবারে ঘটে না তা নয়। যুধিষ্ঠিরের অশ্বমেধ যজ্ঞ (পৃ. ১৪০), সংকট মোচনে ব্যথিত উদ্যোগের (পৃ. ১৮৬) কথা আছে। কিন্তু ঘটনাগত অগ্রগতি অপেক্ষা পূর্ব ঘটনার, চরিত্রের বিশ্লেষণই বেশি। এই সবের ফাঁক ফোকর দিয়ে লেখকের রচনাকালীন যুগ বা চরিত্র সাদৃশ্যের কিছু অনুমান পাঠক করতেই পারেন। উপন্যাস যদি বইটিকে বলতেই হয় তাহলে বলা চলে—এটি ঘটনাপ্রবাহের জঙ্গমতাময় ধাঁচ নয়, বরং স্মৃতি রোমন্থনমূলক, যদিও বর্ণনামুখ্য নয়, আর সেক্ষেত্রে বিচারমনস্কতা, বিশ্লেষণ, ব্যক্তি ও সমাজের বড়ো হয়ে ওঠে। নানা কারণেই এটি ব্যতিক্রমী ধাঁচের উপন্যাস।
যে-কোনো রচনা পাঠের সময়ে লেখকের রচনাকালীন মানসিকতার অভিঘাত জানাটা জরুরী বলে মনে হয়। পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, আজ ২০১২ (প্রকাশকাল) বিদুর ও তাঁর চিন্তা পাঠ কেন তাঁর কাছে জরুরী বলে মনে হয়েছে। বইটির প্রায় শেষদিকে বিদুর সভাসমক্ষে বলছেন—'বরঞ্চ বর্তমান সমস্যার আলোচনায় প্রত্যাবর্তন করা এখন সর্বতোভাবে কাম্য। এতদ্বৃত্তান্তের হেতু এই যে পশ্চাৎ না জানলে কেউই অগ্রবিবেচনার প্রকৃতি নির্ণয়ে সক্ষম হয় না। .... সমাজ এখন যে পরিবস্থার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত, সেই পরিবস্থার নূতনত্ব বিষয়ে তাঁরা কিছুমাত্র অবহিত নন। তাঁরা পূর্বতন সমাজের ধারা এবং বিন্যাসের অভ্যস্ততায় এখনও অনড়। কিন্তু আমি বলি, আপনারা যুগান্তের চিহ্ন সমূহ অবলোকন করুন, নতুনকে যুক্তি গ্রাহ্যতায় গ্রহণ করুন, পুরাতন লোক-অহিতকর অভ্যাস সমূহকে বর্জন করুন।' (পৃ. ২১৮) বিদুরের এই বিজ্ঞ পরামর্শে আমি implied author-কে যদি আবিষ্কার করি তাহলে আশা করি অসন্তোষ প্রকাশিত হবে না। সমগ্র ভারতবর্ষীয় সমাজ পরম্পরায় প্রাচীন ও নবীন মূল্যবোধের দ্বন্দ্বের দিকে সম্ভবতঃ লেখক আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন। এই প্রকৌশল ব্যবহারের পূর্বসূরীগত নানা দৃষ্টান্ত আছে। তারাশঙ্কর যখন 'রাধা' উপন্যাস লেখেন (প্রকাশ ১৯৫৯) তখন রচনাকালীন সংঘাতময়তা অভিঘাত সৃষ্টি করেছিল লেখক মনে। কালকূটের 'শাম্ব' রচনার ক্ষেত্রেও একথা প্রযোজ্য। শম্ভু মিত্রের 'চাঁদ বণিকের পালা' প্রসঙ্গেও এমন কথা প্রাজ্ঞেরা বলে থাকেন। 'বিদুর' নিয়ে মিহিরবাবু ভাবছেন ১৯৯৬-র কিছু আগে থেকে, ২০০২-তে সুবর্ণরেখা সংস্করণ, ২০১২-তে সাহিত্য সংসদ সংস্করণ—এই অব্যাহত আগ্রহের পিছনে অন্য কারণ যাই থাক, তিনি ভারতবর্ষীয় দুশ্চিন্তাময় প্রেক্ষিতটিকে বারংবার চিন্তার মধ্যে রেখেছিলেন। এ-বিষয়ে ওয়াকিবহাল পাঠক আমাকে সমর্থন করবেন যে মহাভারত ব্যাপ্তির এই গৌণ খণ্ডে তাঁর দীর্ঘ মনোযোগ এবং স্থিতধী প্রস্তুতি নিশ্চয়ই ধর্মকথা প্রচারে নয়। তিনি মহাভারতরূপ কষ্টিপাথরে পরিবর্তমান ভারতীয় আধুনিকতাকেই দেখতে চান। আমার এই মন্তব্যের প্রেরণা লেখকের স্বীকারোক্তি থেকে। মহাভারতের নানা 'অসঙ্গতি নিয়ে সাধারণের প্রশ্ন' (পৃ. ১০) তাঁকে ভাবিয়েছে। বিদুর ও যুধিষ্ঠিরের সম্পর্ক বিচার নিয়ে ব্রাহ্মণডিহি গ্রামের আশ্রয়দাতা কথকঠাকুরের সঙ্গে তাঁর তর্ক হয়, পুণ্যকথা ও সমাজকথার মধ্যে দ্বন্দ্ব ঘটে, এজন্য ইরাবতী কার্বের 'যুগান্ত' এবং আরও কিছু বই পড়ে মিহিরবাবু তাঁর আধুনিক ধর্ম-বিযুক্ত মন ও মননকে প্রস্তুত করেছেন। বহু ধ্যানপ্রিয় পাঠকের মতো মিহিরবাবুর কাছে মহাভারত 'রহস্যময়' এবং 'আকর্ষণীয়'। সুখময় ভট্টাচার্য বলেছিলেন মহাভারত 'নিত্যকালের ইতিহাস এবং ধর্মগ্রন্থ'। তবে ধর্মগ্রন্থ হিসেবে প্রতিষ্ঠাদানেই তাঁর পক্ষপাত। কিন্তু সুখময়বাবু রক্ষণশীল নন। তাই রবীন্দ্রনাথ উদ্ধৃত করে মহাভারত তাৎপর্য-কথা ব্যক্ত করেন। রবীন্দ্রনাথের কথা ছিল—মহাভারতের মুখ্য উদ্দেশ্য 'সকল বিষয়ে পথনির্দেশ এবং সত্যপ্রচার'। মহাভারত রচনার উদ্দেশ্য কালে কালোত্তরে 'সর্বজনীন চিত্তের উদ্দীপন, উদ্বোধন, চারিত্রসৃষ্টি'। আমার মনে হয় মিহিরবাবুর আলেখ্য ও চরিত্র নির্বাচনে রবীন্দ্রনাথের কথাই সমর্থিত হয়েছে। তিনি অত্যন্ত বিনয়ী লেখক তাই বারংবার বলেন—'এই গ্রন্থখানি আদৌ কোনো গবেষণা কর্মের ফল নয়' (পৃ. ১১), এবং 'মহাভারতের একটি চরিত্র অবলম্বনে উপন্যাস রচনার প্রচেষ্টা ধৃষ্টতা, সন্দেহ নেই' (পৃ. ১৭), অথবা 'এ পাঠ নিতান্ত দীন এক গ্রাম বালকের পাঠ' (পৃ. ২০) অথবা 'আমার এই আলেখ্য তাই বিদুরেরই কথকতা, এ কোনো তত্ত্বগত গবেষণা নয়।' (পৃ. ২৪) এখানে বলার কথা এই যে কোনো ভালো মিথ, পুরাণ, মহাকাব্য, ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাস লিখতে গেলে নানা সমর্থ আলোচনা পড়ার প্রয়োজন পড়ে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সফল ঔপন্যাসিকদের মধ্যে এর দৃষ্টান্ত তিনিও জানেন। কিন্তু নানা তর্ক প্রস্তাব পার হয়ে 'নিজস্ব প্রত্যয়ে স্থিত থাকা' কঠিন ব্যাপার—তার দৃষ্টান্ত কমই আছে। একথাও তাঁকে স্মরণে রাখতে বলি, সুস্থিত প্রত্যয়ী প্রাচীন আলেখ্যকে আধুনিক কালের পাঠকের কাছে উপস্থাপন কঠিন ব্যাপার, তা সফল হলে পাঠকের ইতিহাস পাঠের বন্ধুর পথ মসৃণ হয়ে ওঠে, বালজাকের রচনা পাঠ ফরাসী কাল-ইতিহাস পাঠের থেকেও আকর্ষণ বিস্তার—এই প্রাজ্ঞ অভিমত মনে পড়ে। বালজাক যে পুরাবৃত্ত অবলম্বন করেননি সেকথা স্মরণ রেখেই একথা বলছি। আমি শুধু উপন্যাসের সজীব হয়ে ওঠার কথা বলছি।
একটি ব্যাপারে আমার বিনীত দ্বিমত পোষণ করি। মিহিরবাবু দুটি ভূমিকায় 'কথকতা' বিষয়ে তাঁর রচনারীতিগত পক্ষপাতের কথা নিবেদন করেছেন। বলেছেন 'সে কারণেই এই কথকতা। .... আমার এই আলেখ্য তাই বিদুরেরই কথকতা।' (পৃ. ২৪) সুবলচন্দ্র মিত্র তাঁর অভিধানে লিখছেন, 'কথক' তিনিই যিনি 'সর্বজন সমক্ষে পুরাণ ব্যাখ্যাকারী'। আমার অবশ্য রাতের পর রাত জেগে কথকতা শোনার অভিজ্ঞতা নেই। আমি সামান্য যা শুনেছি তার সঙ্গে বঙ্কিমের সাহায্য নিই। বঙ্কিম বলছেন—'গ্রামে গ্রামে, নগরে নগরে, বেদী পিঁড়ির উপর বসিয়া, ছেঁড়া তুলট, না দেখিবার মানসে সম্মুখে পাতিয়া, সুগন্ধি মল্লিকামালা শিরোপরে বেষ্টিত করিয়া, নাদুস নুদুস কালো কথক ..... সুসংস্কৃত্যের সদ্ব্যাখ্যা সুকণ্ঠে সদলঙ্কার সংযুক্ত করিয়া আপামর সাধারণ সমক্ষে বিবৃত করিতেন।' (লোকশিক্ষা) বঙ্কিম 'সদ্ব্যাখ্যা' বলতে পুরাণাদির ধর্মীয় ব্যাখ্যাই বলতে চেয়েছেন। মিহিরবাবু তাঁর 'বিদুর' বইটিতে প্রচল ধর্মীয় ব্যাখ্যার প্রতি সামান্যতম ভক্তি দেখান নি, বরং তিনি আধুনিক দৃষ্টিতে মহাভারতীয় সমাজ ও চরিত্রকে উপস্থাপন করেছেন। দ্বিতীয়ত: এই বইয়ের উপস্থাপন-ভঙ্গি মোটেই 'আপামর' জনসাধারণ উপযোগী নয়। বরং বলা চলে যথেষ্ট শিক্ষিত অথচ ধর্মবিযুক্ত মন ও মননের পক্ষেই ভাবনার বিষয়। তৃতীয়ত: কথকরা চিরকাল ধর্মীয় ঐতিহ্যকেই অলঙ্কারমণ্ডিত ক'রে, কিঞ্চিৎ প্রশ্ন তুলে, রঙ্গরস যুক্ত ক'রে উপভোগ্য করে তুলতেন। মিহিরবাবুর রচনা একেবারেই তা নয়। তিনি একালের একজন 'সেকুলার' লেখক হিসেবে কিছু প্রশ্ন তুলেছেন, কখনও ফুটনোট দিয়েছেন। (যেমন - পৃ. ১৮, ১৫৯) আর অজস্র সংস্কৃত উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছেন, কখনও তার বাংলা বলে দিয়েছেন, কখনও বলেন নি। ফলে তা আপামর জনভোগ্য হয়নি। তাই কথকতার ভঙ্গি এ-বইয়ের নয়। তবে, মিহিরবাবুর অজস্র প্রামাণ্য গ্রন্থপাঠে একজন রচয়িতা, তাঁর তোলা প্রশ্নগুলি একেবারেই আধুনিক ও চিন্তাযোগ্য। কথকঠাকুর হতে গেলে তাঁর রচনাভঙ্গিকে করে তুলতে হত ভিন ধাঁচের।
সে যাই হোক, কি পাইনি তা নিয়ে মাতামাতি করাটা এক্ষেত্রে সুরুচির হবে না। কি পেয়েছি সেটাই বিচার্য। আমার খুব ভালো লেগেছে এ-বইয়ের ভাষা। তাঁর 'বিষাদবৃক্ষ' আমি পড়েছি, পুরস্কার পাবার আগেই। অন্য রচনা পড়ার সুযোগ হয়নি। কিন্তু ওই ঘরোয়া গল্প বলার ভঙ্গি এ-বইতে নেই। আশ্চর্যভাবে রক্ষিত হয়েছে ভাষাগত ধ্রুপদীয়ানা। আর এই ধ্রুপদীয়ানার ভাষা বিষয়ের প্রতি উপযুক্ত হয়েছে। উপযুক্ততা রচনায় সাহায্য করেছে বিশেষ বিশেষ শব্দ প্রয়োগ। যেমন—'স-লেখনী মসীভাণ্ড', গণবণিতা, পারশব, উদ্দণ্ডপনা, বীর্যশুল্কা, দগ্ধবীর্য, সহোঢ়, কক্ষ্যা, ক্ষত্তা, আদেশপরতন্ত্র ইত্যাদি। মাঝে মাঝে অবশ্য চলতি ধাঁচ ঝিলিক দিয়ে গেছে। যেমন—'আমি চলি পথে' (১), 'পুরুষ তো বটি' (১২৬) ইত্যাদি। ভাষাকে মনোগ্রাহী করার জন্য তিনি সার্থক উপমা লগ্ন হয়েছেন। যেমন—'অচ্যুত কেশবের মুখমণ্ডল শ্রাবণী আকাশের মতো ভ্রুকুটি কুটিল হল', (পৃ. ১০০) 'নিয়ত বিষন্ন অন্তঃকরণেও যেন আনন্দের জ্যোতিঃপ্রবাহ চঞ্চল সৌদামিনীর মতো বিচ্ছুরিত হতে লাগল' (পৃ. ১১৩), 'রাজন্যদের চিন্তন-বিশ্ব নিতান্ত নিঃস্রোতবাহী হ্রদের মতো।' (পৃ. ১৩১) ইত্যাদি। এই ভাষা প্রত্যাশিতভাবেই পাঠককে নিয়ে চলে অতি প্রাচীন এক ধ্রুপদী আবহে।
সুখময় ভট্টাচার্য জানান ব্যাসদেব লিখেছিলেন মহাভারত 'শান্তরসপ্রধান' এবং আনন্দবর্ধন থেকে রবীন্দ্রনাথ এ-কথাই বলেছেন। রবীন্দ্রনাথ স্পষ্টতঃ বলেন বিজয়ী পাণ্ডবরা যে বিপুল বৈরাগ্যের পথে শান্তিলোকের অভিমুখে প্রয়াণ করলেন 'এই কাব্যের এই চরম নির্দেশ'। এ-নির্দেশ সকল কালের সকল মানবের প্রতি। আমার বলার কথা এই যে মিহিরবাবুর বইটির একালীন পাঠকের প্রতিক্রিয়াও শান্তিপথ যাত্রা। একালীন রচনায় এই শান্তরস প্রস্ফুটন বিরলদৃষ্ট, এটা করতে পারলে একটা detached outlook গড়ে ওঠে। মিহিরবাবু তা এনে দিতে সক্ষম হয়েছেন, এজন্য তিনি অভিনন্দনীয়।
মিহিরবাবুর এ-বইটির আর একটি প্রশংসার্হ বৈশিষ্ট্য, শিকড়ে প্রত্যাবর্তন আশঙ্কা, যার ইঙ্গিত দিয়েছেন পৃ. ৬৪ ও অন্যত্র। বিষাদবৃক্ষের এই অনুসন্ধান আকাঙ্খাই তাঁকে মহাভারত পাঠে প্রণোদিত করেছে, আমাদেরকেও উদ্বুদ্ধ করেছে।
মহাভারতের কাল কবে চলে গেছে। সে-যুগের কালের ধ্যানধারণা মূল্যবোধ অনেক বদলে গেছে। কিন্তু এ-বইতে স্থানে স্থানে লেখক তাঁর মহনীয় শান্তরসাস্পদ দৃষ্টিতে এমন কিছু মূল্যবোধের কথা বলেছেন যা প্রাচীন হয়েও চিরকালীন। পুরাকালীনের থেকে সমকালীন সন্ধান বড়ো কঠিন কাজ, তাতে তাঁর সাফল্য তারিফযোগ্য। দু একটি উদাহরণ দিই। 'ক্ষমতার মোহ এমনই অদ্ভুত বটে। ক্ষমতা মানুষকে উন্নত করে, আবার ক্ষমতাই তাকে নিমজ্জিত করে।' (পৃ. ১) 'বিবাহ বা যৌন সম্পর্ককে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার' আমার অভিজ্ঞতায় এই প্রথম। (পৃ ১০) 'রাজাবরোধের খবর বাইরের মানুষ খুব কমই জানতে পারে'। (পৃ. ১৭) 'লোকাচার, দেশাচার অতিক্রম করা খুব সহজ কাজ নয়'। (পৃ. ৩০) ইত্যাদি। ভারতবর্ষীয় আধুনিক সমাজ, পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ পরিপ্রেক্ষিত স্মরণে রাখলে এ ধরনের কথার প্রাসঙ্গিকতা অনুধাবন করা যাবে বলে মনে হয়।
মহাভারত রচয়িতার মনে ছিল নির্লিপ্তি। কে যেন বলেছিলেন—বিষাদ এক আধুনিক ধারণা। মিহিরবাবু এ-বইতে একাধিক জায়গায় বিদুর-বৃত্তান্ত বলতে গিয়ে বিষাদ-আচ্ছন্ন হয়েছেন। এখানেই বইটির আধুনিকতা, দায়বোধ। আমার কোনো সন্দেহ নেই এ-বইটি অন্য বিচারে আর এক বিষাদ বৃক্ষ। সমগ্র সারস্বত সমাজের পক্ষ থেকে এ সব কিছুর জন্য লেখককে সাধুবাদ জানাই।