সম্পাদকের বৈঠকে; সাগরময় ঘোষ; আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা-৯. প্রথম প্রকাশ আষাঢ় ১৩৬৯; তৃতীয় সংস্করণ ১৪১৭; ISBN: 978-81-7756-721-2
এই বইয়ের কথা আর কাকেই বা লেখা যেত?
এই বইয়ের কথা? হঠাৎ এতো বিখ্যাত একটি বইয়ের কথা ‘পরবাস’-এর ‘গ্রন্থ-সমালোচনা’-র, থুড়ি, ‘গ্রন্থ-পরিচয়’-এর পৃষ্ঠায় কেন? না এ’ কোনো নবীন লেখকের নতুন এক বই, না প্রতিষ্ঠিতের অচেনা কোনো। তবু আজ এ’কলমে একমেবদ্বিতীয়ম্ সাগরময়ের এই বইটি সম্বন্ধে দু’-কথা না লিখে থাকতে পারলুম না।
সম্পাদকের ভ্রূকুঞ্চন? “কী মশায়? এদ্দিন সমালোচনা-টনা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছেন আর এই ক্লাসিকটিই এখন ও.....”। নির্দ্বিধায় দোষস্বীকার, হ্যাঁ, এই বুড়োবয়সে এসেই বহুচর্চিত বইটি পড়লুম। শুধু পড়লুম বলা ভুল হল, রসে হাবুডুবু খেলুম। যেকোনো লেখকই তাঁর লেখা ছাপা না হলে, বা দেরিতে হলে, অখুশি হন। কিন্তু সেটা টেবিলের ওপারে বসে কী-চোখে দেখা যায়---সেটা জানা গেলে ক্ষোভ-প্রশমন। ঝানু সম্পাদক সাগরময় সেটিই করেছেন এই পুস্তকে, এবং করে গেছেন কী সাহিত্যরসে সিঞ্চিত করে.......না-পড়লে কী করে বুঝতুম?
ছুট্কাহিনি (anecdote), নদীয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সভায় গোপাল ভাঁড় নাকি ভারতচন্দ্রের ‘বিদ্যাসুন্দর’-কাব্য কাৎ করে ধরতে মানা করেছিলেন, রস গড়িয়ে পড়তে পারে বলে। রসটা অন্য হলেও, আজকের এই গ্রন্থটিকে কীভাবে ধরি? ছুট্কাহানির মহাভোজ যে এর পাতায় পাতায়ঃ
তখনই অতি-প্রতিষ্ঠিত লেখক সৌরীন্দ্রমোহন ভূঁইয়ে যষ্টি ঠুকে ‘ভারতবর্ষ’-সম্পাদকের কাছে জবাবদিহি চান, “কী জলধরদা? এ’সংখ্যায়ও আমার গল্পটা ছাপা হল না? এবার তো আর অশ্লীল কিছু ছিলনা?”“তা নেই বাপু। তবে তোমরা এই আধুনিক লেখকরা ওই অত ডট্ডট্ ফুট্কি দিয়ে দিয়ে যে কী বোঝাতে চাও বুঝিনে বাপু”---নাকে নস্য ঠুকে দুঁদে সম্পাদকের জবাব।
থতমত সৌরীন্দ্রমোহনঃ “এঁ? তাতে কী?” “আরে, প্রিন্টার এসে খবর দিলো তার প্রেসে অত ফুটকি নেই। আদ্পো ফুটকি কেনার অর্ডার গেছে ফাউন্ড্রিতে। এলে আসছে সংখ্যায় তোমার গপ্প ছাপা হবে!”
বা, রবীন্দ্রনাথ ‘কলিকাতা পৌরসভা’ আয়োজিত তাঁর সত্তর বৎসর পূর্তির সম্বর্ধনা নিতে কলকাতায় আসতে বড় রাজি নন। মেয়র বিধানচন্দ্র স্বয়ং গেছেন কবিকে রাজি করাতে, সঙ্গে সচিব অমল হোম। বহু অনুনয়ে শেষপর্যন্ত রাজি হন কবি, ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে বিধানচন্দ্রেরঃ
“বুঝলে অমল, আমি তো বড় দুশ্চিন্তায় ছিলাম। কবির সঙ্গে প্রথম কথা.....”“হ্যাঁ স্যর, আমিও বড্ড দুশ্চিন্তায় ছিলাম.....”
“কেন? তোমার দুশ্চিন্তা কেন? তুমি তো বহুকাল থেকেই কবির স্নেহধন্য...”
“আজ্ঞে, আমার ভয় হচ্ছিল, আপনি না আবার রবীন্দ্রনাথকেও ‘তুমি’ বলে বসেন!!!”
হ্যাঁ, এমন হাজারো গল্প উঠে এসেছে সাগরময়ের সম্পাদকীয় আড্ডা থেকে, যা ছিল আসলে লেখকদের মনকর্ষণ ভূমি, যা থেকে পুষ্ট হয়ে উঠত তাঁদের লেখনী। উপরি পাওনা সাগরময়ের শান্তিনিকেতনের স্কুলজীবনের গল্প, দুষ্টুমি, সাথী অমর্ত্যের মাতুল কঙ্কর সেনঃ পেয়ারা চুরি করে ধরা পড়েছেন আশ্রমের প্রধান ট্রাস্টি রাশভারি দীপেন্দ্রনাথের (বড়দা দ্বিজেন্দ্রনাথের পুত্র) হাতে। ধমক খেলেন, “তোমাদের গাছে থেকে যদি এমন কাঁচা পেয়ারা আমি ভেঙে আনতাম, কেমন লাগত?”
“আজ্ঞে, আমাদের বাগানে আপনি পেয়ারা পাড়তে যাবেন, এমন সৌভাগ্য কি আমাদের কখনও হবে?” কঙ্করের জলদি জবাব!!!
সম্পাদক মহাশয়, এ’বইয়ের সমালোচনা দূরস্থান, পরিচয়ই বা কী লিখব? বরঞ্চ গঙ্গাজলেই গঙ্গাপূজা করিঃ
বাঙলাভাষার দুই প্রধান পত্রিকা ‘ভারতবর্ষ’ (সম্পা. জলধর সেন) ও ‘প্রবাসী’ (সম্পা. রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়)। সমসাময়িক। বয়সে জলধরবাবু বছর চারেকের বড়। কিন্তু স্বভাবে কী ফারাক! জলধরবাবুকে যে-কেহ নিমন্ত্রণ করলেই যান, পাতপেড়ে ভোজন করেন। আর রামানন্দবাবু পারতপক্ষে কোনো সভা-সমিতি বিয়ে-পৈতেতে যেতে চান না। কারোর পিতৃশ্রাদ্ধের মধ্যাহ্নাহারের পর বসেই আছেন জলধর, “কৈ ? দিলে না তো এখনও.... ?” থতমত গৃহকর্তা, ব্রাহ্মণবিদায় তো কেবল...। “না, মানে নেমন্তন্ন করে ডেকে এনে খাইয়ে-দাইয়ে সকলেই তো শেষে হাতে একটা কবিতা বা গল্প ধরিয়ে দেয় পত্রিকায় ছাপানোর জন্যে, তাই...”। অবশ্য, সে-সব কবিতা কখনই কোটের পকেটে ধোবাবাড়ি চলে যেত!সম্পূর্ণ উল্টো ছিল রামানন্দের স্বভাব। মণিকর্নিকা ঘাটে এক যুবক তাঁকে একবার নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচায়। পরে সে তার কবিতা ছাপাতে রামানন্দের কাছে এলে উনি নির্দ্বিধায় বলে দেন, “তুমি বরং ঐ ঘাটের জলেই ফের আমাকে ডুবিয়ে দিয়ে এসো বাপু, তবু এ’কবিতা আমি ছাপাতে পারবো না!”
বঙ্গদর্শন থেকে ভারতবর্ষ, প্রবাসী, ভারতী, বিচিত্রা, সবুজপত্র, সাওগাত, কবিতা পরিচয় থেকে কৃত্তিবাস--বাঙলাভাষায় উল্লেখযোগ্য পত্রিকার সংখ্যা নেহাৎ নগণ্য নয়--তার সাথে সাথেই বঙ্কিমচন্দ্র থেকে সুনীল গঙ্গো.---সম্পাদকের লিস্টিটাও লম্বা। তবু সাগরময় একমেবদ্বিতীয়ম্ কেন? একমেব সময়ের দৈর্ঘ্যে। ‘দেশ’ পত্রিকার মত এত দীর্ঘকাল রমরম করে তো কৈ আর কোনো বাঙলা পত্রিকাকে চলতে দেখা যায়নি। এর ব্যবসায়িক দিকটির কথাও উনি অকপট আলোচনা করেছেন এখানে। ব্যবসায়িক সাফল্যই কোনো পত্রিকাকে নিজপায়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতা জোগায়। এটা ছাড়া, বাইরে থেকে ঠেক্নো দিয়ে পত্রিকা চালানো সম্ভব নয়, তা সে সম্পাদক যতই দড় হোন্না কেন। বঙ্কিমও পারেননি বেশিদিন ‘বঙ্গদর্শন’ টানতে। এইটে বড্ড কাজের কথা---সাগরময়ের পঞ্চাশ বছরের অভিজ্ঞতার ফসল। এইদিক দিয়ে সাগরময়ের তুলনা কিংবদন্তী উইলিয়াম শনের সঙ্গে করা চলে, যিনিও তাঁর পাঁচ দশকের সম্পাদকীয়তায় ‘নিউ ইয়র্কার ম্যাগাজিন’-কে বিশ্বখ্যাতি এনে দিয়েছিলেন। হায়রে ভেতো বাঙালী!
এ’বই সদ্য পড়া শেষে এমন রসে মজে আছি, আরেকটা গল্প না-বলে কলম থামানো নেই।
বীমাকোম্পানির বড়কর্তা সাহিত্যিক হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় লক্ষ্মৌর এক হোটেলে এসে উঠেছেন । তখন সেখানে এক মস্ত ‘মিউজিক কনফারেন্স’ চলছে, তাবড় তাবড় সব গাইয়ে-বাজিয়েরা এসেছেন। জেনেছেন, যদিও মোলাকাৎ কারও সঙ্গে হয়নি, কারণ সকালে উঠে আপিসের কাজে বেরিয়ে যান, ফিরতে রাত হয়ে যায়। হঠাৎ এক মাঝদুপুরে ফিরে দেখেন এক পেল্লায় গুঁপো বুড়ো নেংটি পরে তাঁর কমন-বাথরুমে তৈলমর্দন করছেন। হরিনারায়ণকে দেখেই হা হা করে ধমকে উঠলেন। উনি পালাতে পথ পান না। ম্যানেজারের কাছে অভিযোগ জানাতে উনি এক হাত জিভ কেটে বললেন, ‘ওমা তাও জানেন না? উনি হলেন ভারতবিখ্যাত গাইয়ে ওস্তাদ ফৈয়জ খাঁ!’“তা হোন্। কিন্তু উনি আমায় অমন ধমক দিলেন কেন?”
“আ হা হা! ওটা ধমক হবে কেন, ওটা হল গমক। গানের গমক। উনি গোসলখানাতেই রেওয়াজ করেন কিনা!”
প্রায় সওয়া দু’-শ’ পৃষ্ঠার বই। আরও কত গল্প তো শোনানোই হল না---বিভূতিভূষণের কাঁকড়া খাওয়া, নকল নয় আসল শরৎচন্দ্র, সুবোধ ঘোষের থিরবিজুরি। পাঠক পড়ে আনন্দ পেলে আনন্দটা বেড়ে যাবে---ভাগ হবে যে। লিখে জানাবেন তো কেমন লাগল। দেখি, আমারটার সঙ্গে মেলে কিনা?
Coolie Woman: The Odyssey of Indenture—Gaiutra Bahadur; Publisher: Hachett India Pvt Ltd, Gurgaon; ISBN 978-93-5009-635-2
বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে আলেক্স হেলি (১৯২১-৯২)-র ‘রুট্স্’ (১৯৭৬) এক অসামান্য পথফলক--এ’তথ্য সর্ববিদিত ও স্বীকৃত। নিজের শেকড় খোঁজার তাগিদে এক লেখক যে কী অভূতপূর্ব পরিশ্রম (গবেষণা) করতে পারেন , এবং কী সাহিত্যরস মিশিয়ে এক বিশ্বমানের উপন্যাস লিখতে পারেন---রুট্সের আগে পৃথিবী তার সন্ধান পায়নি।
আমাদের আজকের আলোচ্য গ্রন্থের লেখিকা নবীনা, বয়স তিরিশের কোঠায়। তাঁর বইখানি হাতে নিলে অবশ্যম্ভাবীভাবে হেলিসাহেবের ‘রুট্স্’ মনে পড়বেই। মানে-ধারে ‘কুলি ওম্যান’ রুট্সের গা-ঘেঁষে চলে, কোথাও ছাড়িয়েও। হাল আমলে কোনো তরুণ ভারতীয় বা ভারতোদ্ভুতের কলম দিয়ে এ’মানের লেখা পাইনি, এক পঙ্কজ মিশ্র ছাড়া।
পাচারের উদ্দেশ্যে ১৯০৩-এ’ বিহারের ছাপরা থেকে ফুসলে আনা একদল দেহাতি নারী-পুরুষের মধ্যে লেখিকার ঠাকুর্দার মা (মানে, great grandmother)-ও ছিলেন। ১৮৩৩ খৃঃ বিশ্বব্যাপী সূর্য-অনস্তের বৃটিশ সাম্রাজ্যে দাসব্যবসা বন্ধ হয়ে গেল আইন করে। এবার কলোনির চিনিব্যবসা চলে কী করে---ফিজি, মরিশাস, গায়ানায়? শ্রমিক কোথায় পাওয়া যায়? তৈরি হয়ে পড়ল ঠারেঠোরে নতুন দাসব্যবসা---দাসখৎ শ্রমিকপ্রথা—Indenture labour. আইনতঃ তারা তো ‘স্বেচ্ছায়’ চুক্তিবদ্ধ---সেখানেই আইনের ফাঁক। বস্তুতঃ, এদের অবস্থা কুন্তাকিন্তেদের চেয়ে কোনো অংশে উন্নততর ছিল না। ঔপনিবেশিক প্রভুদের নজর পড়ল জনসংখ্যায় বিপুল ভারতবর্ষের ওপর। নিম্নবর্গীয়দের হাল কোনো দেশেকালেই তোফা ছিল না (তাই না ‘নিম্ন’)। অতএব তাদের দারিদ্র-অশিক্ষা-হতাশার সুযোগ নিয়ে, মিথ্যে লোভ দেখিয়ে সাদাদের দিশি-ফড়েরা ভোজপুর-অবধ থেকে শিকার ধরা শুরু করল।
১৯০৩-এর ২৯ জুলাই গার্ডেনরিচ থেকে ছাড়লো ‘দ্য ক্লাইড’ জাহাজ ভূগোলকের অপরপারে দক্ষিণ আমেরিকার গায়ানার উদ্দেশ্যে। তিনমাসের সফর। বিশবছরের বট্ঠাকুমা শিউজারির জাহাজি-কুলুজিতে তিনটি লক্ষ্যণীয় তথ্য পাওয়া গিয়েছিলঃ (১) ইনি গোত্রে ব্রাহ্মণ ছিলেন, (২) জাহাজে চড়াকালে ছিলেন চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা! এবং, (৩) সাথি কেউ ছিল না---উনি এক! তিনটেই নাড়িয়ে দেবার মত তথ্য। কালাপানি পারের মত হীন কাজ কোনো ব্রাহ্মণসন্তান করতে পারে? তার ওপর একা মহিলাস? তাও চার মাসের পোয়াতি? স্বামী তাঁর কোথায় গেলেন? নাকি কোনো জারজ সন্তান গর্ভে নিয়ে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন তিনি? এ’হেন সোজাসাপ্টা ও ধারালো প্রশ্নের জবাব পেতেই শুরু গায়াট্রার শিকড়খোঁজার। আর কী তার ব্যাপ্তি ও গভীরতা! কোনো বিষয়ই হাল্কা হাওয়ায়-হাওয়ায় আলোচনা নেই। ফড়েদের কদর্যতার পাশাপাশি অভিভাবকস্বরূপ কিছু ইয়ুরোপীয় রাজকর্মচারীর কথাও এসেছে। জাহাজের ভয়ঙ্কর পরিবেশ, নারীদের পক্ষে আরও বিপদসঙ্কুল। ভয়াবহ যাত্রার বিবরণী, রোগ, মৃত্যু থেকে সেদেশে, মানে ওয়েস্ট ইন্ডিজে, পৌঁছে কঠিনতর পরিস্থিতি থেকে দেশে ফিরে আসার ঐকান্তিক কাতরতা---প্রতিটি বিষয়েই যথাযথ ফুটনোট সহ প্রামাণ্য আলোচনা। পরিশিষ্টের নোট্স্ ও গ্রন্থপঞ্জীই যেন এক গ্রন্থাগার। কী অসাধারণ নিবেদিতপ্রাণতা, গবেষণা ও নির্মাণ---পাঁচটি দেশ ঘুরে, তাদের লাইব্রেরি-আর্কাইভ ঢুঁড়ে ঢুঁড়ে, ওরাল-হিস্ট্রির সন্ধান করে লেখা এই অশ্রুর ইতিহাস। আভূমি প্রণিপাত করি। অমিতাভবাবুর ‘সি অব্ পপিজ’ উপন্যাস এই বিষয়টির ওপরেই। গায়াট্রা কিন্তু উপন্যাস নয়, ইতিহাস লিখেছেন। এবং গতি ও পঠনসুখে তা পপিজকে ছাড়িয়ে গেছে। ভাবা যায়, এই কলকাতা-শহরকে ঘাঁটি করে যখন এই ভয়ঙ্কর ব্যবসা চলছে, সে-সময়েরই আগেপিছে এখানে বসেই আমাদের উচ্চবর্ণীয় পূর্বপুরুষগণ ‘বাঙলার মাটি বাঙলার জল’-করছেন, মঞ্চে দানিবাবু গলা কাঁপাচ্ছেন এবং আর কয়েক বছরের মধ্যে মোহনবাগান শিল্ড জিতবে।
কোনো কলোনিতেই ভারতীয়দের অবস্থা ভালো ছিল না। এইসময় নাগাদই তরুণ ব্যারিস্টার মোহনদাস দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে এসে সেদেশের ভারতীয় কুলিদের প্রতি অন্যায়ের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। হায় রে, গায়ানার জন্যে কোনো মোহনদাস ছিলেন না।
এ’তো গেল বইটির অন্তঃস্থলের কথা। বহিরাঙ্গও সেই মেগদারের। যেমন মুদ্রণ, বাঁধাই, তেমনি মানানসই প্রচ্ছদ। পৌনে দুশ’ বছরের প্রাচীন ফরাসি প্রকাশন হ্যাশেট হালে ইংরেজি বইয়ের জগতে এসেছে। প্রকাশনার এই মান চলতে থাকলে প্যান-পেঙ্গুইনকে ঘোল খেতে হবে।
দশে সাড়ে নয় দিই বইটিকে।
দুশো বছরের বাংলা নথিপত্র, ত্রিপুরা বসু; আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা-৯; প্রথম প্রকাশ ডিসেম্বর ২০০৯; দ্বিতীয় মুদ্রণ নভেম্বর ২০১১; ISBN 978-81-7756-890-5
‘দাসখৎ’ একটি মিশ্রশব্দ। তৎসম দাস ও ফার্সি খৎ (লিখন) মিশে ‘দাসখৎ’। বাঙলায় এটি একটি প্রচলিত শব্দ, নানাভাবে শব্দটির ব্যবহার হয় (উদা. দাসখৎ লিখে দেওয়া)। Indenture labour-এর ওপর আগের বইখানি পড়তে পড়তে বর্তমানটি হাতে এসে যাওয়ায় এই শব্দটিই তাই সর্বপ্রথম মনে এলো। খুঁজছিলুম। প্রশ্ন, বাঙলায় শব্দটি এলো কী করে? ‘তমসুক’ (promissory note) জানিঃ টাকা ধার নিয়ে হাতচিট লিখে দেওয়া। বেশ। কিন্তু কলোনিয়াল আমেরিকা যেমন দাসেদের শ্রমেই গড়া (কেবল কালো নয়, সাদা-ও) indenture labor bond (দাসখৎ) তাই সেখানকার আর্কাইভে-মিউজিয়মে ভুরিভুরি দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু এই বাঙলায় তো তেমন ঘটেনি? যদিও বাঙলার এক মহান নবাব মুর্শিদকুলি নিজেই বাল্যকালে দাস ছিলেন। তবু, কোনো নথি হিসেবে বাঙলায় দাসখৎ দেখতে পাওয়া গেছে---শুনিনি। না, ত্রিপুরাবাবুর এই চমৎকার বইখানিতেও এর উল্লেখ নেই, যদিও পাট্টাপত্র, একরারনামা, কবালাপত্র, সনন্দপত্র---এইরকম বহু দলিল বা নথির উল্লেখ আছে এতে, বানান অপরিবর্তিত, বহু ফোটোকপি সহ। বস্তুতঃ, শুধু নথিপত্র নিয়ে যে বাঙলায় দুইশ’ পৃষ্ঠার একখানি বই করা যায়, এই ভাবনাটিই আকর্ষণীয়। কারণ, দলিল, নথি---এ’গুলো তো আকর, যার ভিত্তিতে ইতিহাস লেখা হয়। আর সেই আকরগুলিই তাদের মূল আকারে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে দুই মলাটের মধ্যে,---বেশ, না?
এ’বইয়ের মূল আকর্ষণটা কী? ১৮৩৫ খৃঃ মেকলে সাহেব এসে ইংরিজিকে আদালতের ভাষা সব্যস্ত না করা পর্যন্ত ফার্সিই তার আগের আধা-মিলেনিয়াম ছিল উত্তরভারতের রাজভাষা। তাই এ’সব কোবালা-পাট্টা-একরারনামার সিংহভাগই ফার্সিতে লেখা হত। কিছু কিছু দলিল বাঙলাতেও হত। তেমন কিছু দলিলই ঠাঁই পেয়েছে এই কেতাবে। বেশ।
গোড়ায় যে কথা হচ্ছিল, ‘দাসখৎ’ নেই বটে, যদিও ‘নরবিক্রয়পত্র’ ও ‘কন্যাবিক্রয়পত্র’-এর উল্লেখ আছে (ফোটোকপি নেই) এই বইতে। বেশিদিন আগের কথা নয়, ১৮২৫ খৃঃ (তদ্দিনে কলকেতায় হিন্দু কালেজ প্রতিষ্ঠিত হয়ে রীতিমত ইংরিজি শিক্ষে শুরু হয়ে গেছে) বর্ধমানের এক বৈষ্ণবী কলকাতার ধনীশ্রেষ্ঠ রামদুলাল সরকারের শ্রাদ্ধে দান-ভোজের আগ্রহে আসতে আসতে পথে শোনে সে-সব ভোজের পাট চুকে গেছে। ক্ষোভে-দারিদ্রে সে বেচারি দেড়শত টঙ্কায় নিজ দ্বাদশবর্ষীয়া সুন্দরী কন্যাকে রাজা কিষণচাঁদ রায় বাহাদুরের কাছে বেচে ‘কন্যাদানপত্র’ লিখে দেয়! ভাবো! অবশ্য, এ’হেন নথির আইনি মান্যতা কী ছিল, মনে প্রশ্ন জাগে। আর, তা যদি না-ই থাকবে তো নথির মানে টা কী?
একটা নমুনা পড়িঃ
৩২ সেমি X ১৫.৫ সেমির তুলট কাগজের এক দলিল। নবাবের ফার্সি মোহর এমবস করা। শ্রীশ্রীহরিঃ নাম নিয়ে দলিলের শুরুয়াৎ, তাং সন ১২১৫ বঙ্গাব্দ (খৃঃ ১৮০৮)........ “ইয়াদিকির্দ্দ শ্রীরামপ্রসাদ শর্ম্মণঃ সদুদারচরিতেষু/ লিখনং কাযনঞ্চাগে আমার পত্তনি তালুক লাট প্রতাপপুর/ ওগয়রহর মর্দ্দে মৌজে খাঞ্জাপুর দিগর মহলাতের কাতজমা/ সালিস্বী এগারহ টাকা মবলগে তালুক করিয়া দেওয়া গেল ......পোণের টাকা বেবাক পাইলাম......”সুধী পাঠিকা, আজকের জমি-বিক্রির টাইট্ল ডিড পড়ে দেখুন, ভাষা কম দাঁতভাঙা নয়।
সেই ট্রাডিশন সমানে চলছে।
বৃটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরির তাক হাঁটকাতে হাঁটকাতে একটা বই একবার উল্টে পাল্টে দেখেছিলামঃ Documents of the Christian Church. লেখকের নাম মনে নেই কিন্তু বিষয়সূচীটা আবছা মনে আছে। তাতে রিফর্মেশন থেকে এবরশন---চার্চে রক্ষিত কোন্ বিষয়ের নথির উল্লেখ নেই?! লেখকের গবেষণার পরিধি ও গভীরতা দেখে স্তম্ভিত হতে হয়। বাঙলাদেশেও প্রথম চার্চ তিনশ’ বছরের পুরনো। ঐতিহাসকভাবেই চার্চ বা মসজিদের মত ধর্মস্থানগুলি ছিল জন্মমৃত্যুবিবাহ সংক্রান্ত নানা তথ্য ও নথির আকর, দক্ষিণভারতের মন্দিরের মত। ত্রিপুরাবাবুর এই বইয়ে কিন্তু ব্যবসায়িক নথিই মাত্র স্থান পেয়েছে, অন্যান্যগুলি নয়। যেমন, জাহাজের যাত্রিতালিকা এক মস্ত গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দলিল---www.ancestery.com ঘেঁটে দেখুন কী অসাধারণ কাজ করছেন ওঁরা। না, এই বইয়ের কাছে সে-মানের আশা অবশ্য করিনি। কিন্তু ষোড়শ শতাব্দী থেকে বাঙলায় ইয়ুরোপীয় জাহাজ আসছে। তারও বহু আগে থেকে হজযাত্রি জাহাজের আনাগোনা। সেইসব নথিতে কত ইতিহাস লুকিয়ে আছে! গায়ট্রা বাহাদুরের ঐ বইটিই তো তার নিদর্শন বহন করে। ত্রিপুরাবাবু কিন্তু ব্যবসায়িক নথি ছাড়া অন্য কোনো নথির দিকে যাননি।
প্রচ্ছদটিকে চমৎকার সার্টিফিকেট দেওয়া যেত যদি আসল যে ‘নথিপত্র’ শব্দটিই রঙের ভুল ব্যবহারে মার না খেয়ে যেত। ছাপাই-বাঁধাই চমৎকার। মোটের ওপর, মনে রাখার মত বই, কিনে ঘরে রাখার মতও।
বাজার সরকারের ডায়েরি—বিজনকুমার ঘোষ; লালমাটি প্রকাশনি; প্রথম প্রকাশঃ বইমেলা ২০১২; ISBN 978-93-81174-17-3
আলু-পটল-বেগুনে তো পেট ভরে, জানতাম। মনও ভরে? ভরে। ভাগ্যিস পড়লুম এ’-বইটা, নৈলে জানতুম কী করে?
প্রচ্ছদ, ঐ দেখুন, চাকচিক্যহীন। কোনো ইলাস্ট্রেশন নেই---না ভেতরে না বাইরে। কলেবর ও দামে একশত ছোঁয় নি। কিন্তু মনভরাতে এক শত শত! এ’বইয়ের কথা বলতে পেয়ে শতমুখ!
বিজনবাবু ‘বাজার সরকার’-নামে দেড়যুগ ধরে কলকাতার খবরের কাগজে প্রায় প্রতি সপ্তায় লিখে চলেছিলেন আলু-পটলের দর। তারই বাছাই করা সংকলন। আচ্ছা, সে-সব লেখা টেঁকে নাকি? মানে, ফের ফিরে পড়া যায়? যায়, যায়। যদি সেই আনাজের পেছনের মানুষগুলোকে ধরা যায়। যেমন, কোনো তোফাজ্জেল হোসেন, বীণাপাণি মান্না, সহদেব ঘোড়ুই---যাঁরা বারবার ঘুরেফিরে এসেছেন এই লেখায় আর যাঁদের হাত ধরে লেখক কখনও পৌঁছে যান শক্তি চাটুজ্জ্যের গ্রাম বহড়ু, তো কখনও তারকেশ্বরের পাশের বৌদ্ধ মন্দিরে বা কখনও সোঁদরবনের প্রত্যন্ত গ্রামে।
আর কী কী সব গল্প, কোন্ অনায়াসে উঠে আসা! পড়িঃ
নকশালবাড়ি গিয়ে আলাপ গুপি মাস্টারের সঙ্গে, কানু সান্যালের সাথি। খড়ের ঘরে পার্টি অফিস হাতিঘিষা গ্রামে। সেখানেই নিবাস। উঠল চারুবাবু, অসীম চ্যাটার্জির সঙ্গে তাঁর মতবিরোধের বিষয়টা---বিদ্যাসাগরের মূর্তিভাঙার বিরোধিতা নিয়ে। আরও কত প্রসঙ্গ। কথায় কথায় সাঁঝ হয়ে যায়। "ঘরের বাইরে এলাম। ধু-ধু রুক্ষ প্রান্তর। হতদরিদ্র ভারতের এক টুকরো রুমালের মতো হাতিঘিষা। ওই তো জঙ্গল সাঁওতালের বাড়ি। মাটির রঙ ঈষৎ লাল। উঁচু-নিচু হয়ে চলে গেছে দিগন্তে। ধূসর তরুশ্রেণী। মান ঝার বুকে তখন শেষ-বিকেলের উদাসী হাওয়া। বাজার সরকার এক পাথরের ওপর বসে পড়লেন। আসলে, তিনি ইন্দ্র দুগারের ছবির মধ্যেই চলে গেলেন।” [“বিপ্লবের স্বপ্ন টিঁকে আছে নকশালবাড়িতে”]বা, অগ্রজপ্রতিম সহকর্মী নরেন্দ্রনাথ মিত্রের স্মৃতিকথায় লেখেন, “১৯৭৫ এর ১৩ই সেপ্টেম্বর। শিয়ালদায় ট্রেন থেকে নামতেই এক সহকর্মীর সঙ্গে দেখা। বললেন, জানেন দাদা, নরেনদা আর নেই। বুকের মাঝখানে হঠাৎ ঠাস্করে শব্দ। রসের হাঁড়িটা যেন এইমাত্র ভেঙে গেল।” কবিতা নয়?
আর কেমন কেমন সব মনউদাসী শিরোনাম লেখাগুলোরঃ ‘বেঁচে থাকার বিষণ্ণ স্বাদ সবাই পায়’, বা, ‘হেডিং বেরিয়েছিল, বনফুল ঝরে গেলেন’ বা ‘নয়ন যদিন রইবে বেঁচে তোমার পানে চাইব গো’ বা ‘পেট জ্বলে,অরণ্য ডাকে আয়,ওরা যায়’....এই কি বাজারদরের কথামালা? কবিতা নয়?
দু’-একটি লেখা পড়ে তো সত্যি সত্যি চোখে জল এলো। যেমন, কীর্তনিয়া রাধারাণী দেবীর কথা। মহালয়ার প্রাতেঃ ‘বাজল তোমার আলোর বেণু’ গেয়ে সুপ্রীতি ঘোষ তো মাতিয়ে দিয়ে গেছেন। কিন্তু তাঁরও আগে প্রথম এই গানটি অনবদ্য গাইতেন রাধারাণী, সুপ্রীতি তাঁর পরে আসেন। আবার ইনিই হিট ছবি ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’-এ সমান টক্কর দিয়ে অভিনয় করে গেছেন কাননবালার সঙ্গে, সই-ও ছিলেন। বাজারের পেছনের মানুষ খুঁজতে খুঁজতে সরকার-মশায় যখন মুর্শিদাবাদ গেছেন মাঝ-‘৯০এ’, অশীতিপর গায়িকা প্রায়ান্ধ। কে বলবে,’৪০-এর দশকে জনপ্রিয়তায় ইনি পঙ্কজকুমার মল্লিককেও পেছনে ফেলে দিতেন? আমরা ভুলে গেছি।
‘পঁচিশে বৈশাখের অপ্রিয় প্রশ্নমালা’ লিখতে বুকের পাটা থাকা চাই। জীবনীকার কৃষ্ণ কৃপালনি হা-হুতাশ করেছেন বটে, এখানে বাজার সরকার মশায় তো চাঁচাছোলা ভাষায় প্রশ্ন তুলেছেন যে প্রিন্স দ্বারকানাথের উত্তরপুরুষগণ তাঁর উপার্জিত দৌলত ভোগ করে গেছেন, কিন্তু কোন্ স্বদেশীয়ানার তাগিদে তাঁকে অবহেলাও করে চলে গেছেন। আধুনিকভারতের শিল্প-বাণিজ্যের এই প্রাণপুরুষের সমাধিতে (কেনসেল গ্রিন, লন্ডন) আজ একটা ফুলও পড়ে না।
এ’বই পড়তে পড়েতে মন বড় উদাস হয়ে যায়। স্বল্পবাক জীবনানন্দকে একবার “কবিতা কী?” জিজ্ঞেস করাতে উনি বলেছিলেন, “কবিতা? সে তো অনেক রকম!” বাজার সরকারের এই বইয়ে বালক ঈশ্বরচন্দ্রের কলকাতা আগমন প্রসঙ্গে পড়িঃ “একরাত পিসির বাড়িতে কাটিয়ে, ইংরিজিতে এক থেকে কুড়ি সংখ্যা চিনতে চিনতে, কাগজ-কুড়োনির মত অন্ধকারগুলিকে বস্তায় ভরতে ভরতে কলকাতায় চলে গিয়েছিলেন ওই মহামানব।”
সত্যি, বিজনবাবুর হাতটি কবির, পাক্কা কবির। ব্যথিত হই, পেটের তাগিদে ইনি সারাজীবন কাগজে গদ্যই লিখে গেছেন। এই যাঁর চোখ ও কলম, তিনি তো সত্যদ্রষ্টা। ‘লালমাটি’ নতুন প্রকাশনী। সযত্নতর কাজের আশা ছিল। অজস্র বানান ভুল।