সস্তার রানি-রঙ ছাতা হাতে ছেঁয়ালো চেহারার মেয়েটি ফেরীঘাটের দিকে হাঁটছিল। বৃষ্টি এসে পড়াতে একজোড়া অসুর-সিংহের মাঝখানে এসে দাঁড়ালো। সন্ধ্যা হবো হবো করছে। উঁচু ঘোড়ায় উঠে কেষ্টপাল মা-দুগ্গার হাতের আঙুল লাগাচ্ছিলেন। গম্ভীর হয়ে দেখলেন। কাদাহাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চশমাটা ঠিক করে নিতে নিতে ওপর থেকেই বললেন, ছাতিটা বন্ধ করো। মেয়ে করলও তাই, কিন্তু মুঠোফোন বন্ধ হল না তার।
কেষ্টপালের ভুরুটা কুঁচকেই থাকল। এমনিতেই গঙ্গার ধারে যুগলমিলন বড় কম নয়। তাদের নীলেখেলায় ভদ্দরলোকের আর চোখ তুলে চাইবার জো নাই। আসা-যাওয়ার পথে মেয়েটারে এখানে দেখে কেউ যদি কিছু ভাবে। নাঃ, পরাণ পাঁউরুটি ঘুগনি কিনে ফিরে আসার আগেই চলে গেলে হয় মেয়েটা।
তার টুকরো কথোপকথনের ভাঙা কাচের টুকরো না চাইলেও কানে আসছিল, তেরপলের ওপরে বৃষ্টির ঝুপঝুপ আওয়াজ ছাপিয়েও।
—ভাইটার ঘুসঘুসে জ্বর, বাবারও, আমি এখন গ্যালে রাঁধবে কে?
—কিন্তু আজই? এত তাড়া কেন?
—তোমার নিজের মাসী? তুমি সঙ্গে আসবা না?
—মাসীরে বল না, আর এক হপ্তা পরে...
—না, কিন্তু ...মানে বোম্বে মানে দুদিনের পথ ...আগে তো তুমি বেহালা-ই বলেছিলে। ভয় করতেছে। মেয়েটার গলা কাঁপছে। ফোনের ওপারে কেউ তুমুল চাপ দিচ্ছে তাকে।
কেষ্টপালের কান খাড়া। এই ব্যারাকপুর পেরোলেই শ্রীরামপুরের কুঠিঘাট। তারপর হাওড়া। তারপর পৃথিবীর কোথায় কে জানে। সময়টা খারাপ। পরাণটা এখনো আসছে না কেন? মেয়েটা খুচরো বৃষ্টির মধ্যেই আবার বুঝি বেরোলো।
এর মধ্যেই একটা ক্যারিয়ার-অলা সাইকেলের সামনেটা দেখেই চেঁচিয়ে উঠলেন কেষ্টপাল, একটু আগে আসতে হয়, ফেরিঘাটে পুলিশ ঘুরতেছে, কোন ভদ্দরঘরের মেয়ে পাইলেছে, ফেরিঘাট দিয়ে ... রানি-রঙ ছাতা কি থমকালো, মনে হয় উল্টোদিকে বারাকপুর শহরের দিকে ঘুরে গেল.... হতভম্ব পরাণের হাত থেকে খাবারের প্যাকেটটা নিয়ে, বললেন, যা, কোন পাড়ার মেয়ে দেখে আসবি, বলবি না কিচ্ছু।
হাতটা ধুয়ে এসে বিড়ি ধরালেন একটা। প্রতি বছর তিনচারশ প্রতিমা তার দোকানের সামনে দিয়েই বিসর্জনে যায়। এক আধটা না হলে ক্ষতি কি?
গরদের ধুতি পরা বয়স্ক মানুষটির সৌম্য মুখখানি পাথরের মত লাগছিল। সামনে দাঁড়ানো বছর তিরিশের কালো কিন্তু সুশ্রী মেয়েটির সস্তার ছাপা শাড়ি, কাঁচের চুড়ি এই মধ্যবিত্তের পাড়ায় একটু বেমানান লাগলেও সে যে এই পাড়ায় অচেনা নয়, পথচলতি কারো কারো উত্সুক দৃষ্টিতে তা বেশ বোঝা যায়।
বয়স্ক মানুষটি আবার মাথা নিচু করে থাকা মেয়েটিকে বললেন, আমাদের মুখ পুড়িয়েছ, জাত-ধর্মের পরোয়া না করে মেয়ের যোগ্য কাজই করেছ, কিন্তু আমাদের সঙ্গে আর যোগাযোগের চেষ্টা কোরো না। এখুনি ছুটকী আসবে, তার বাড়ির লোক যেন তোমায় না দেখে।
মেয়েটি রুদ্ধ গলায় বলবার চেষ্টা করল, মাকে একবার...
মানুষটি বললেন—তিনি লো-প্রেশারে বিছানায় পড়ে, আমি পূজা করে উঠে প্রসাদ দিলে তবে তিনি জল খাবেন, দোহাই তোমার, আর দেরি করিও না।
মেয়েটি কথা বাড়ায় না, উদ্ভ্রান্তের মত একবার অস্ফুটে বলে, মা, মা গো, আর হাঁটা দেয় উল্টো দিকে। বৃদ্ধ গেট বন্ধ করতে গিয়েও করেন না, থাক, ছোটমেয়ের আসার সময় হল।
মেয়েটি হনহন করে হাঁটে, যাতে পাড়ার কারো সঙ্গে তার চোখাচোখি না হয়, এ-কথা, সে-কথার মধ্যে জড়ানোয় তার ভয়, চোখদুটো জলে ঝাপসা, নইলে দেখতে পেত শ্রী-র গাড়ি পাড়ার গলির মধ্যে ঢুকছে। গাড়ি থেকে শ্রী দেখল দিদি হনহন করে হেঁটে চলেছে। ডাকতে যাচ্ছিল, অ্যাই দিদি, কিন্তু সামলে নিল। তার চোখ দেখলেই দিদি ঠিক জেনে যাবে কি অন্ধকার প্রদীপের নিচে। তার চেয়ে এই ভালো।
আকাশে ততক্ষণে কোজাগরির চাঁদ উঠছে।*
*(অনেক পরিবারে লক্ষ্মীপুজোয় প্রথমে অলক্ষ্মীকে বাইরে পুজো করে, কুলোর বাতাস দিয়ে বিদেয় করে ঘরে এসে লক্ষ্ণীকে আহ্বান ও পূজা করার আচার আছে। প্রথমে পূজিতা হবার জন্য অলক্ষ্মীকে জ্যেষ্ঠা বলা হয়ে থাকে।)
মহারানি ফুলেশ্বরীর নাসারন্ধ্র ক্রোধে স্ফুরিত হচ্ছিল, বললেন “মায়ামোরিয়ার মহন্ত কি বলেছিলেন, আবার বলো।"
সন্ত্রস্ত প্রতিহারী তোতার মত আওড়ায় করে, “এক দেব এক সেব, ..."
—আঃ থামলে কেন, পুরোটা বল৷
—আন সেবা ব্যভিচার৷"
রক্তজবার মত লাল চোখদুটি রাজা শিবসিঙ-এর দিকে ফেরে৷ রাজা ধন্দে পড়ে যান, কে মহাদেবী, এই মানবী মহারানি না ওই অদূরের ভীমকান্তরূপিণী রক্তবর্ণা অসুরবধরতা মৃন্ময়ী দশভূজা৷ রাজার আর মনে থাকে না, তিনিই তাঁর পরমাসুন্দরী পাটরানিকে রাজ্যের অধীশ্বর বড়-রাজা বলে ঘোষণা করেছেন, নিজের রাজছত্র তাঁকে সমর্পণ করেছেন, নতুন নাম দিয়েছেন প্রমথেশ্বরী, নিজে তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে রাজ্যপালন করছেন....দেব-দ্বিজে ভক্তির পরাকাষ্ঠা হিসেবে বঙ্গভূমি থেকে আনীত কেনারাম ভট্টাচার্যকে অধিষ্ঠিত করেছেন কামাখ্যার মহান্ত হিসেবে৷ সেটা অবশ্য তাঁর পিতার শেষ ইচ্ছাও ছিল। শাক্তমতে দীক্ষাও নিয়েছেন তাঁর কাছে৷ ভয়-ভক্তির মিলিত অভিঘাতে বাকরুদ্ধ হয়ে বসে থাকেন রাজা শিবসিংহ, সুতান ফা৷
রাজধানী রংপুরের পূজাবাসরে অস্বস্তিকর নীরবতা৷ বিভিন্ন বৈষ্ণবসত্রের আমন্ত্রিত অতিথি মহন্তরা পাথরের মূর্তির মত বসে৷ মায়ামোরিয়ার মহন্তও তাদের মধ্যে রয়েছেন....শ্রীমন্ত শঙ্করদেবের ওই নির্দেশবাক্য তো সব বৈষ্ণব একশরণীয়ারই পালনীয়৷ একা তিনি কেন মহারানির কোপে? শাক্ত-বৈষ্ণবের মিটিমিটি খুনসুটি এ উপত্যকায় অজানা নয়, অচেনা নয় রাজনীতির প্ররোচণাও। কিন্তু প্রকাশ্য সভায়, পূজাবাসরে, অন্যমতের প্রতি এমত অসহিষ্ণুতায় সকলেই হতবাক।
রানি এবার গলা তুললেন, নবমীপূজার বলি ও হোমের পর রাইজের সমস্ত রায়ত, বামুনিয়া, দেওধাই, সকল প্রজার দেবীপ্রণাম ও নির্মাল্য গ্রহণ অবশ্যকর্তব্য৷ আপোনালোক এজন এজনকৈ আগউয়াই আহক৷
প্রথমে উঠলেন কামাখ্যা-মহন্ত রাজগুরু পর্বতীয়া গোঁসাই, দেবীস্তুতি উচ্চৈঃস্বরে পাঠ করতে করতে অবনত হলেন প্রতিমার সামনে, প্রণাম সেরে কপালে এঁকে নিলেন বলির রক্ততিলক৷ তারপর উঠলেন রাজা, সম্মোহিতের মত প্রতিমার সামনে গিয়ে সাষ্টাঙ্গ হলেন, রানির ইঙ্গিতে পূজারী এঁকে দিল রক্ততিলক রাজার কপালে৷ তারপর মহারানির নির্দেশমত অন্যান্য প্রজারা একে একে আসতে থাকলেন৷ কারো কারো পশুবধে আপত্তি থাকলেও মণ্ডপের দ্বাররক্ষী হেংডাং-ধারীদের দেখে কে আর মুখ খুলবে৷ উঠতে হল সত্রধারী মহন্ত ও ভকতদেরও৷ জীবে দয়া যাঁদের পরম ধর্ম, তাঁদের একে একে রক্ততিলকের বিনিময়ে কিনতে হল জীবনের অধিকার৷ মায়ামোরিয়ার মহন্ত চোখের জলে প্রতিমার মুখ দেখতে পাচ্ছিলেন না৷
রানি প্রমথেশ্বরী জানতেও পারলেন না এই রক্তসিঞ্চনে কোন বিষবৃক্ষের মূল পুষ্ট হতে থাকল আজ থেকে৷ দ্রোহকাল সমাসন্ন৷ ১৭৬৯ খৃষ্টাব্দে সেই তুষের আগুন মায়ামোরিয়া বিদ্রোহের দাবানল হয়ে জ্বলে উঠবে। *
*(চৈতন্যদেবের প্রায় সমসাময়িক শঙ্করদেব (জঃ ১৪৪৯) অসম উপত্যকায় বৈষ্ণবীয় ভক্তি ও নামদানের মাধ্যমে চৈতন্যদেবের মতই ভক্তি আন্দোলনের সূচনা করেন। কালক্রমে সমাজের নিচুতলার হাজার হাজার মানুষ বৈষ্ণবধর্মের (নামান্তরে একশরণ ধর্ম) অনুগামী হয়ে ওঠেন ও বিভিন্ন বৈষ্ণবসত্রের ছত্রছায়ায় বাস করে জীবিকা নির্বাহ করতে থাকেন। কিন্তু তাতে সমাজের নিম্নস্তরের মানুষের থেকে প্রাপ্য রাজস্বে (যা প্রধানতঃ বেগার শ্রম হিসেবে আদায় হত) ভাঁটা পড়ায় রাজশক্তি আস্তে আস্তে নানারকম দমনমূলক নীতি গ্রহণ করে।
মায়ামোরিয়া বৈষ্ণবসত্রের প্রধান অনুগামীরা ছিল স্বাধীনচেতা মোরান উপজাতির সদস্য। রাজা শিবসিংহের (রাঃ ১৭১৪) রাজ্যারোহণের আগে থেকেই বেগার শ্রমদানের ব্যপারে রাজশক্তির প্রতি একশরণীয়া এই উপজাতির লোকেদের অসন্তোষ ছিল। তার ওপর রাজার খোলাখুলি বৈষ্ণবধর্মের বিরোধিতা, বিশেষভাবে এই সত্রের বিরোধিতা সেই আগুনে ইন্ধন সংযোগ করে। ১৭৬৯ খৃষ্টাব্দে তাদের বিদ্রোহ অনেক কষ্টে দমন করা গেলেও, রাজ্য জুড়ে বারে বারে গণ-অভ্যুত্থান দমনের চেষ্টায় অহোম রাজশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। সেই সুযোগে প্রথমে আরাকান ও পরে ব্রিটিশ রাজশক্তির অসম উপত্যকায় প্রবেশ।