নেরুদা কবিতার প্রখ্যাত অনুবাদক সেল্ডেন রডম্যান (Selden Rodman) বলেছিলেন পাবলো নেরুদার কবিতার প্রতি উচ্ছ্রিত আবেগ বিষয়ে স্প্যানিশভাষী মানুষের মধ্যে মতবিরোধ নেই। গার্সিয়া মার্কেজ বলেছিলেন—নেরুদা বিংশ শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ কবি। তার আগে লোরকার মন্তব্য ছিল—নেরুদা একজন অথেন্টিক কবি যাঁর শরীরী সংবেদন এমন এক পৃথিবীর যা আমাদের নয়। ইলান স্ট্যাভান্স-এর (Ilan Stavans) ভাষায় নেরুদার ব্যক্তিময়তা প্রবাদপ্রতিম। বিচার করে বলতে গেলে তিনি একজন 'আল্টিমেট পোয়েট'--চূড়ান্ত কবি। মনোযোগী পাঠক জানেন নেরুদা একপ্রকার নন, বহুপ্রকার। একজন স্পষ্টভাষী, চিৎকৃত, দায়বদ্ধ আর একজন ব্যক্তিগত, নিভৃতমনা, পরাবাস্তবী। আমি গত ত্রিশ চল্লিশ বছর ধরে নেরুদা-সাহিত্যের এই দুই দিকেই সমর্পিত। একথা অস্বীকার করার নয় যে তাঁর ওডেসী হল অন্যন্যসাধারণ। নাম না-জানা গ্রামের ছেলে থেকে নোবেল-পাওয়া কবিমানুষটি কতো যে দেশে গিয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। কখনও পর্যটক, কখনও পলাতক, কখনও সম্ভ্রান্ত নাগরিকতায় কখনও মজুর ঘরে নেরুদা খুঁজে নিয়েছেন কবিতার প্রেরণা ও উপকরণ। ওয়াকিবহাল পাঠক জানেন ভান গার্দিস্তাস হিসেবে পরিচিত হুইদোব্রো, নেরুদা এবং পাররা্ তাঁদের কাব্য পরিক্রমার নিজস্ব পরিবহন খুঁজতে আলোড়িত হয়েছেন ভবিষ্যবাদ, প্রকাশবাদ, দাদাবাদ, উল্ট্রাইজম ও পরাবাস্তববাদের দ্বারা। কিন্তু নেরুদার কাব্যভুবনকে, পিকাসোর ভুবনের মতই, কোনো একটা ইজম্ এর সীমারেখা দ্বারা চিহ্নিত করা যায় না। তিনি পূর্বোক্ত তিনজনের মধ্যে সর্বাধিক নিন্দিত ও নন্দিত। স্টাভান্স বলেছেন বিংশ শতাব্দীর প্রতিটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা নেরুদার কবিতায় স্পন্দিত হয়েছে। সে সব হল— সোভিয়েত বিপ্লব, স্পেনের গৃহযুদ্ধ, নাৎসীবাদ ও স্তালিনবাদ; দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীভৎস নিধনযজ্ঞ, সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশকতাবাদ; পরবর্তীকালের ঠাণ্ডাযুদ্ধ, লাতিন আমেরিকার দেউলে রাজনীতি ও অর্থনীতি; ভিয়েতনাম...কিউবার বিপ্লব...১৯৬৮'র ছাত্রসংগ্রাম, ও নিজদেশে সমাজতন্ত্রের আগমন। এইসব বিক্ষোভের সঙ্গে সঙ্গে অন্তরঙ্গ সাধারণ জীবনের দিনলিপিতেও নেরুদা এই সময়কালকে ধরে রেখেছেন।
পৃথিবীতে নেরুদার সর্বাধিক বিক্রিত বই হল—কুড়িটি প্রেমের কবিতা ও একটি হতাশার গান। ৯৬-পৃষ্ঠার এই বইটি রচিত হয়েছিল ১৯২৩, ১৯২৪-এ; প্রকাশিত হয় ১৯২৪-এ। এ বইটির কেন্দ্রীয়তা প্রেমের, তরুণ প্রেমের আর্তিতে ভূষিত। প্রেমের প্রসঙ্গ তাঁর কবিতায় এসেছে বহুবার, কবি প্রেমের 'গান' করেন বাঁচতে, আচ্ছন্ন মনের কষ্ট অতিক্রম করতে। শেষ কবিতাটি লেখা হয় এক জাহাজডুবির পর একটি লাইফ বোট দেখে। এ সময় তিনি পড়ছিলেন রোমা রোলাঁর 'জাঁ ক্রিস্তফ' উপন্যাসটি। রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতার গদ্যরূপ আছে এ বইতে, কিছু বিতর্কও গড়ে উঠেছিল। বাঙালি পাঠকও এ বইটিকে গ্রহণ করেছে অনন্য প্রিয় সম্ভাষণ হিসেবে। ১৯২৫ থেকে ১৯৩১ র মধ্যে ভুবন পরিক্রমা কালে বিষাদ ভুলতে চাওয়া কবিমনের প্রকাশ পাব 'রেসিডেন্স অন আর্থ' বইটির প্রথম পর্বে। এ বইয়ের আর্স পোয়েটিকা, ওড টু ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা, 'স্পেন ইন আওয়ার হার্ট' অংশের অনেকগুলি কবিতা আজও প্রিয়তা বজায় রেখেছে। স্পেন গৃহযুদ্ধ নেরুদাকে বদলাতে শুরু করে ক্রমান্বয়ে। মজুররা স্পেন নিয়ে কবিতা প্রকাশের জন্য কাগজ বানায়, যুদ্ধক্ষেত্রে ট্রেঞ্চে ছাপার কাজ চলে, পোস্টারে চলে আসে দীর্ঘ কবিতা। বিষাদ-আচ্ছন্ন কবি যুগের অভিঘাতে হয়ে পড়লেন যুগপ্রকাশক কবি, উচ্চারণ ক্রমশঃ হয়ে ওঠে তীব্র, দায়বদ্ধ কণ্ঠস্বর ফুটে উঠতে থাকে। 'ক্যান্টো জেনারেল' এক বিচিত্র মহাকাব্য যাতে আছে ১৫টি পর্ব, প্রতিটি পর্বে আছে অনেকগুলি করে কবিতা। এ বইয়ের প্রথমাবধি পাঠক পাবেন কলম্বাসের আমেরিকা আগমন-প্রসঙ্গ, মধ্যে আছে মাচ্চু পিচ্চু পর্বত শিখরে সূর্যনগরী যাত্রা, ক্রমশঃ কবিতা চলে আসে চল্লিশের দশকে। কোনো কোনো আলোচক বইটিকে দান্তের 'ডিভাইন কমেডি'র সঙ্গে তুলনা করেছেন। নেরুদা কবিদৃষ্টিতে কল্পনা করেছেন স্পেনীয় এবং আদিমানুষদের সংশ্রব এবং এই পথেই কাব্যভাবনায় প্রবেশ করে যায় মার্কসীয় রাজনৈতিক ভাবনা। কবিতার ক্রমান্বয় উচ্চস্বর শাসকশ্রেণীকে ভীত করে তোলে, কবি আত্মগোপন করেন শহরে গ্রামে পার্বত্যভূমিতে, লেখা চলতে থাকে। চল্লিশের দশকের এই সময়টা স্পেনীয় বামপন্থার তীব্রতার সময়। এই তীব্রতা ছাপ ফেলে যায় এ মহাকাব্যে। এ মহাকাব্যের নানা অংশ পৃথক বই হিসাবে প্রকাশিত। বাঙালি কবিরাও এসব কবিতার দ্বারা আলোড়িত হতে থাকেন। মঙ্গলাচরণ, বিষ্ণু দে, সুভাষ মুখোপাধ্যায় প্রভৃতি বামপন্থী কবিরাও অনুবাদে হাত লাগান। Let the woodcutter awaken নামক ৯ম পর্বটি অনেক বাঙালি কবিই নানা সময় অনুবাদ করেছেন। ১৯৫০ সালে দুই বিখ্যাত স্পেনীয় চিত্রকরের (David Alfaro Siqueiros এবং Diego Rivera-র) আঁকা দিয়ে শোভিত হয়ে ছাপা হয়, এ সময়ই কবি প্রকাশ্যে এসে পড়লেন মহাসম্মেলনে প্যারিসে, পিকাসো, এলুয়ার প্রভৃতিরা তাঁকে বিপুল আনন্দে স্বাগত জানালেন। ১৯৫২-তে ছদ্মনামে বার হল 'দি ক্যাপ্টেনস ভার্সেস' নামের প্রেম-সনেটের সংকলন, ছদ্মনামের কারণ মাতিন্দা উররুতিয়ার সঙ্গে গোপন প্রেম। এর পরবর্তী পর্যায়ে আমরা পাব একাধিক 'ওড' কবিতার সংকলন, যা 'ওড' সম্পর্কে বিশ্ববাসীর প্রচলিত ধারণাকে উলটেপালটে দেয়। কবি এসব কবিতা সম্পর্কে বলেন—'My intention was to start like the boy chewing on his pencil, setting to work on his composition assignment about the sun, the blackboard, the clock, or the family. Nothing was to be omitted from my field of action; walking or flying, I had to touch on everything, expressing myself as clearly and freshly as possible.' ষাটের দশকের স্মরণীয় কাব্যসংকলন—'ইসলা নেগ্রা'—কতকটা ডায়েরি ভঙ্গিতে, কাব্যিকতা বজায় রেখে এ কবিতাগুলি রচিত। নানাসময়ে তিনি গদ্যও কম লেখেননি, যা সংকলিত হয়েছে Passions and Impressions নামের বইতে। এখানে আছে কিছু ভারতস্মৃতি, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ, কালীঘাট দর্শন প্রভৃতি। কিছু গদ্য অনুবাদ পাঠকের জন্য হাজির করা গেছে। রোগাক্রান্ত কবির জীবনসায়াহ্নেও কবিতা-রচনা চলে অবিরাম, প্রয়াণ ২৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৩। পিনোশে সরকার প্রতিহিংসা বশতঃ তাঁর ভাল পারাইসো, সান্তিয়াগো, ইসলা নেগ্রার বাড়ি লুঠপাঠ করে, ধ্বংস করা হয় বিপুল সংগ্রহ।
মহাকবিদের, তাঁদের রচনাবলী নিশ্চিহ্ন করা অসম্ভব। যদিও অনেককাল নেরুদা রচনাবলী প্রকাশ সরকারিভাবে চিলিতে নিষিদ্ধ ছিল, তথাপি শেষপর্যন্ত Hernan Loyola নেরুদা রচনাবলীর পাঁচ খণ্ডের এক রচনাবলী বার করেছে সাম্প্রতিক কালে (১৯৯৯)। এ বইয়ের প্রথম তিনখণ্ড কবিতা সম্ভার। তাঁর কবিতা পৃথিবীর সমস্ত অগ্রগণ্য ভাষায় অনুবাদ হয়েছে অল্পবিস্তর। বেশিরভাগই এখন পাওয়া যায় ইংরেজিতে। বেশ কয়েকটি ভালো bibliography তৈরি হয়েছে। যেমন—Pablo Neruda: An Annotated Bibliography of Biographical and Critical Studies সম্পাদনা করেছেন Hensley C. Woodbridge ও David S. Zubatsky ১৯৮৮-এ। অনেক ধরনের আলোচনার ও সংকলনের সাক্ষাৎ মেলে স্প্যানিশ বা ইংরেজিতে। তাঁর জীবনী সমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য—Volodia Teitelboim-এর Neruda: An Intimate Biography যার ইংরেজি সংস্করণ বেরিয়েছে ১৯৯১-তে। নেরুদার সর্বশেষ স্ত্রী মাতিলদে উররুটিয়া একটি আত্মজীবনী লেখেন—Mi Vida junto a Pablo Neruda: Memorias (১৯৮৬), চিঠিপত্রের সংকলনও তৈরি হয়েছে।
নেরুদার জীবন উপন্যাসের বিষয় হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখ্য—Antonio Skármeta-র লেখা Burning Patience, যার বাংলাও পাঠক এখন পড়তে পাবেন। Isabel Allende রচিত The House of the Spirits উপন্যাসে, André Maurois-র Les roses de septembre উপন্যাসেও নেরুদা প্রসঙ্গ যথেষ্ট। নেরুদা জীবন নিয়ে চলচ্চিত্র হল Il postino, তাছাড়া আছে ডকুমেন্টারি। কবিতা আবৃত্তির রেকর্ডও আছে একাধিক। নেরুদার কবিতা নিয়ে মিউজিকাল কম্পোজিশন অনেক হয়েছে, তার মধ্যে ক্যান্টো জেনারেল প্রাসঙ্গিক রচনাটি উল্লেখ্য। কেউ কেউ জীবন ও কবিতা নিয়ে গানও বেঁধেছেন। এইসব মিলিয়ে বহুমাত্রিক আগ্রহ সঞ্চারের, একজন আধুনিক কবিকে নিয়ে এই বিশ্বব্যাপী সমারোহের আর কোনো তুলনীয় দৃষ্টান্ত নেই।
সত্তর দশকের শেষ, সম্ভবতঃ যুগের প্রভাবেই, রেজি দ্রেবের একটি মন্তব্য মনে ধরেছিল। মন্তব্যটি হল—য়ুরোপীয় সাহিত্যের অনুপ্রেরণা দেবার ক্ষমতা নিঃশেষ হয়ে গেছে। এবার তাকাতে হবে লাতিন আমেরিকার দিকে। কথাটা সত্য কি না জানি না, ঝুঁকে পড়েছিলাম স্প্যানিশ সাহিত্যের দিকে। একাধিক স্পেনীয় সাহিত্যিকদের নোবেল পাওয়া, খেলার জগতের রথী মহারথীরা, গান নাচের বর্ণোজ্জ্বলতা ক্রমান্বয়ে মাথা ঘুরিয়ে দিচ্ছিল, ভাষাটা শেখার ব্যর্থ চেষ্টাতেও মেতে উঠেছিলাম। নানা এলোমেলোমির ফাঁক ফোকর দিয়ে গত তিনদশকে গড়ে উঠল পাবলো নেরুদা বিষয়ে একটা বই। আগ্রহী পাঠককে জানানো যাক—এ বইয়ের প্রথমে থাকছে নেরুদার রাজনৈতিক কবিতা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা। কারণ, এই বিষয়টি হয়তো কিঞ্চিৎ উপেক্ষিত। তারপর এল—নেরুদার সম্পর্কে বাঙালির আগ্রহের ইতিবৃত্ত অনুবাদের মূল্যায়ন যা ইতিপূর্বে আর কেউ চর্চা করেননি। নেরুদার বঙ্গদেশে আগমন, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎকার, নেরুদার লেখার বাংলা অনুবাদ, রবীন্দ্র কবিতা/গানকে নেরুদার গ্রহণ, তাঁর পুরস্কার প্রাপ্তিতে, প্রয়াণে বাঙালির ভাবোদ্বেলতা—এসব খোঁজা নেশার মতো পেয়ে বসেছিল বছরের পর বছর। তার ফাঁকে ফাঁকে অনুবাদ&mdashকবিতার ও গদ্যের—চলতেই থাকল। বার্লিনে ঘুরতে ঘুরতে পেয়ে গেলাম নিকানোর পাররার স্বাগত ভাষণটি। অনূদিত হল। জানা গেল ১৯৫৭তে নেরুদার কলকাতা আগমন, গ্র্যাণ্ড হোটেলে বাস, ও বিষ্ণু দের বাড়িতে দু'দিন যাওয়ার কথা। খুঁজতে খুঁজতে হাতে এল নেরুদাকে নিয়ে কিছু কবিতা, তার অনুবাদও করা হল। রিতা গুইবার্ত একটা সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন, এক পত্রিকার তাগিদে, সেটাও বাংলাতে আনা গেল। পত্রপত্রিকা শিক্ষায়তনের অনুরোধে কয়েকটি প্রবন্ধও লিখেছিলাম। এবার—সব মিলিয়ে—যে দীর্ঘ সংকলনটি গড়ে উঠল তার নাম—'পাবলো নেরুদা: গদ্য, পদ্য ও অনন্ত অনুষঙ্গ'। আসলে আমার আস্বাদনকে আমি ভাগ করে নিতে চাই পাঠকের সঙ্গে। নেরুদা-ভক্ত যদি বাড়ানো যায় এ গোপন অভিপ্রায়ও থাকল এখানে। আমার মতো ভক্তরা এ-কাজে সক্রিয় থাকবেন আরও বহুকাল, এতে আমার অন্ততঃ অবিশ্বাস নেই।