• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৫৯ | এপ্রিল ২০১৫ | নাটক
    Share
  • রূপকথার সাঁকো : কৌশিক সেন


    পাত্রপাত্রী

    ঋতমা চ্যাটার্জি (তরুণী)
    ঋতমা চ্যাটার্জি (বয়স্কা)
    পিউ আগরওয়াল
    মৃণাল চ্যাটার্জি
    অঞ্জনা চ্যাটার্জি
    নীরজ আগরওয়ালা
    আনোয়ার জামাল
    মহম্মদ আজিজ
    অ্যালিশা থমাস
    অফিসার ব্র্যাডলি

    (মঞ্চ মাঝখান দিয়ে দুভাগে ভাগ করা থাকবে। মঞ্চের বাঁদিকে সাম্প্রতিক কালের ঘটনা, ডানদিকে আমরা এগিয়ে গেছি আজ থেকে কুড়ি বছর, অর্থাৎ কিনা ২০৩৫ সালে। ঘটনাস্থল ধরে নিন ডিউক ইউনিভার্সিটি, ডারহাম, নর্থ ক্যারোলাইনা। ডানদিকে আপনারা যাঁকে দেখতে পাচ্ছেন উনি ডঃ ঋতমা চ্যাটার্জি এই নাটকের প্রধান চরিত্র, মঞ্চের বাঁদিকের অর্থাৎ সাম্প্রতিক কালের ঘটনা তাঁর ফ্ল্যাশব্যাক। মঞ্চের আলো পরিবর্তনের মাধ্যমে, বর্তমান ও ভবিষ্যতের ঘটনার দিকে দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হবে। যেহেতু অতীত ও ভষ্যৎ একসাথে থাকতে পারেনা তাই মঞ্চটির দুই এলাকায় কখনোই একসাথে আলো থাকবে না, একদিকে আলো পড়লে অন্যদিক অন্ধকার হয়ে যাবে।)

    (আলো মঞ্চের ডানদিকে। পিউ ও ঋতমা)

    পিউ: ও মাই গড মা শুনেছো? লন্ডনে আবার বম্বিং হয়েছে। ওদিকে মিডল ইস্টের ওয়ার থামার কোনো সাইন নেই, এবার হয়তো নিউক্লিয়ার হলোকস্ট হয়ে যাবে!

    ঋতমা (উদ্বিগ্ন স্বরে): আজিজ ঠিক আছে তো?

    পিউ: হ্যাঁ, আজিজ আঙ্কলই তো ঘণ্টায় ঘণ্টায় মেসেজ পাঠাচ্ছে।

    ঋতমা: পাজি ছেলে, দিদিকে একটা ফোন করতে পারেনা। গলার আওয়াজটা শোনাতে কি হয় তোদের?

    পিউ: মা, বুড়োদের মত কথা বোলোনা। দেখো তো বাবা কেমন টেক স্যাভি।

    ঋতমা: তোর বাবা সবকিছুতেই স্যাভি। জানিসই তো আমি একটু সেকেলে, এখনও দ্যাখ কাগজে ছাপা বই নিয়ে বসে থাকি।

    পিউ: তাই দেখছি, ওই তোমার ফেভারিট বইটা নিয়ে বসেছো আবার। তোমার বন্ধুর লেখা বাংলা বই। কি যেন নামটা?

    ঋতমা: (একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বইটা বন্ধ করে) ‘অশ্রু নদীর সেতু’ বাই মহম্মদ আনোয়ার জামাল।

    পিউ: ব্রিজ অন দা রিভার অফ টিয়ার। ইস, ইংলিশে লেখা হলে পড়তে পারতাম।

    ঋতমা: বলেছিলাম। জামাল বলতো ও ইংরাজিতে ভাবতে পারেনা, তাই লিখতেও পারবেনা। ওই গানটা গাইত (উঠে গিয়ে গুনগুন করে--আমি বাংলায় গান গাই, আমি বাংলার গান গাই)

    পিউ: কিন্তু তুমি তো পারো। তোমার এত ফেভারিট বই তুমি ট্রানসলেট করো না কেন। তাহলে আমিও পড়তে পারবো। ও নো আই অ্যাম লেট। বাই মামি (ব্যাগটা নিয়ে উঠে দাঁড়ায়)

    ঋতমা: আবার এক্ষুনি কোথায় চললি। খেয়ে যা।

    পিউ: বাবার সঙ্গে টেনিস খেলতে। তুমি চলো না।

    ঋতমা: না রে আমি বরং বসে বইটা পড়ি। সত্যিই তো বইটা ট্রানসলেট করলে। কিন্তু--

    পিউ: থিঙ্ক অ্যাবাউট ইট। (পিউ বেরিয়ে যায়)

    ঋতমা: আমি ভালো আছি। দেখতে দেখতে ২০৩৫ সাল হয়ে গেল। জামাল – এখনো চোখ বুজলেই সেই ছেলেটাকে স্পষ্ট দেখতে পাই। আমার বয়েস বেড়ে গেছে ছবিটার বয়েস তো একটুও বাড়েনি। রোজ সকালবেলায় ল্যাবে ঢোকবার সময় নিয়ম করে এক সেকেন্ডের জন্যে ছেলেটার সাথে আমার দেখা হতো। ঠিক আটটার সময় ও দরজার দিকে তাকিয়ে বসে থাকবে কিন্তু চোখাচোখি হলেই আবার ঘাড় গুঁজে কাজের মধ্যে ডুবে যাবে। আমারও ওইসময় তাড়া থাকে, রাউন্ডের হাজারটা কাজ বাকি তার মধ্যে এক্সপেরিমেন্টটার অবস্থা কি হলো দেখে যেতে হবে। ঘন্টাখানেক বাদে বেরিয়ে যাবার সময় আমি আবার একঝলক ওদিকে তাকিয়ে যাই। দেখি ও ঠিক ওইরকম অবাক চোখে তাকিয়ে বসে আছে। সারাদিন দমফাটা ব্যস্ততার মধ্যে এই ব্যাপারটায় আমার বেশ মজা লাগত। ভাবতাম একদিন নিজেই গায়ে পড়ে আলাপ করে নেবো।

    (মঞ্চের ডানদিক অন্ধকার হয়ে বাঁদিকে আলো পড়বে। ঋতমা কাজ করছে, অ্যালিশাকে নিয়ে নীরজ ঢোকে।)

    নীরজ: হাই ঋতু। খুব ব্যস্ত নাকি? দেখো কে এসেছে তোমার সঙ্গে দেখা করতে।

    অ্যালিশা: থ্যাংক্স নীরজ। ঋতু তুই কেমন আছিস? ও মা, তুই আরও রোগা হয়েছিস, তোর নতুন হেয়ার স্টাইলটা কি সুন্দর দেখাচ্ছে। লুকিং রিয়েলি গর্জাস।

    নীরজ: আই এগ্রি। দুঃখের বিষয় এই ড্রপ ডেড গর্জাস মেয়েটি ডেড সিরিয়াস। কাউকে বিশেষ পাত্তা দেয়না, এমনকি সিনিয়র রেসিডেন্টকেও নয়।

    ঋতমা: অ্যালিশা, কবে ফিরলি ইউরোপ থেকে?

    অ্যালিশা: লাস্ট উইক। ও মাই গড কত যে গল্প আছে তোর সাথে।

    ঋতমা: নীরজ একটা রিকোয়েস্ট আছে, অবশ্য যদি খুব অসুবিধা না হয়?

    নীরজ: প্রশ্নই ওঠে না। বলো কি রিকোয়েস্ট?

    ঋতমা: আমার বন্ধু এসেছে, যদি আর বিকেলের রাউন্ডটা অফ নিই। অনেক কিছু ক্যাচ আপ করার আছে। মানে, আমি পরে কমপেনসেট করে দেবো। এই উইকএন্ডেই।

    নীরজ: ঋতু জিন্দেগিতে একবার তুমি আমার কাছ একটা ফেভার চাইলে। আমি এমন কামিনা যে তার জন্যে দরাদরি করতে বসবো। আরে ম্যাডাম দিল্লীতে এর পাঁচগুণ পেশেন্ট আমি একা সামলাতাম। কতদিন বলেছি অ্যাটলিস্ট নাইট কলের পরে একটু টাইম অফ নাহলে মাথা গরম হয়ে যাবে। এনিওয়ে তুমি একদম কাল সকালে মর্নিং রিপোর্টে এসো, ইউ টু হ্যাভ ফান, পারলে আমিও জয়েন করতাম, মে বি অ্যানাদার ডে।

    ঋতমা: না মানে, মানে থ্যাংক্স।

    (নীরজ একটা বাও করে বেরিয়ে যায়)

    অ্যালিশা: তারপর? সিনিয়র রেসিডেন্টের সঙ্গে প্রেম করছিস বুঝি? বেশ দেখতে না ছেলেটা।

    ঋতমা: ধ্যুৎ, ওর সঙ্গে প্রেম করতে বয়ে গেছে।

    অ্যালিশা: আমার বেশ মজা লাগলো বুঝলি। আমরা মেয়েরা সারাদিন হ্যারাসমেন্ট আর ডিসক্রিমিনেশন নিয়ে চেঁচামেচি করি আর সত্যিই ওগুলো খুব বড়ো প্রবলেম। কিন্তু মাঝে মাঝে ঠিক সময়ে একটু হেসে, একটু আড়চোখে তাকিয়ে ছোটোখাটো সুবিধা নিয়ে নিতেও ছাড়িনা। অবশ্য ছেলেদের চোখে যারা তোর মতো টিপিক্যাল সুন্দরী শুধু তারাই এসব সুবিধা পায়।

    ঋতমা: আমার ওসব নিয়ে ভাবার সময় নেই। রেসিডেনসি, রিসার্চ, পরীক্ষার প্রিপারেশন। একেবারে মাথা খারাপ অবস্থা।

    অ্যালিশা: সখী তোমার শরীরের ঘড়িটা কিন্তু টিকটিক করেই চলেছে। এতগুলো বছর তো বাবা-মা’র ভালো মেয়ে হয়ে পড়াশোনা করে কাটালে, এবার একটু রক্তের স্বাদ নাও। শিকার তো হাতের কাছেই আছে।

    ঋতমা: আমাকে নিয়ে চিন্তা করিস না, তোর কথা বল। লন্ডনে কি করলি?

    অ্যালিশা: (উঠে জানালার কাছে যায়) কিছুই না। ব্রিটস আর বোরিং। প্যারিসে আর মিলানে খুব মজা করেছি। এই ঋতু জানলার কাছে আয়, দ্যাখ ওইখানে বাগানের মধ্যে একটা বিয়ের আসর বসেছে।

    ঋতমা: ও মা তাইতো, কি সুন্দর দেখাচ্ছে ওদের।

    অ্যালিশা: কেন যে এখনো মানুষ এইসব তামাশা করে সময় নষ্ট করে বুঝিনা।

    ঋতমা: তার মানে? এই তো বলছিলি--

    অ্যালিশা: দুজন মানুষ পুরো স্বাধীনভাবে, বিনা আপশোষে, কেউ কারোর ওপর খবরদারি না করে, একসঙ্গে সারাটা জীবন কাটিয়ে দেবে, এটা আবার হয় নাকি? সবটাই একটা গেম অফ ডিসেপ্‌শন অ্যান্ড কম্প্রোমাইজ।

    ঋতমা: আমার বাবা-মা’র কথা বলতে পারি। দুটো মোটামুটি উলটো স্বভাবের লোক তিরিশ বছর হলো দিব্যি একসাথে চালিয়ে যাচ্ছে। আপোস, আক্ষেপ, খবরদারি সবই আছে বোধহয়, তাতে তো কিচ্ছু আটকাচ্ছে না।

    অ্যালিশা: আমার আটকাবে। তাইজন্যেই বোধহয় আমার সম্পর্কগুলো টেঁকেনা রে। আমি বিশ্বাস করিনা যে সুখের চেয়ে স্বস্তি ভালো। যাগগে চল একটা ওয়াইন খেয়ে তারপর বাড়ি যাবি।

    ঋতমা: না রে আমাকে আরেকবার ল্যাব-এ ফিরতে হবে। টিসু কালচার কি জিনিস জানিস নাতো, টিনএজারদের চেয়েও মুডি।

    অ্যালিশা: বাজে বকিস না। আসলে আমার সঙ্গে ওয়াইন খেতে আপত্তি। এখন ভালো মেয়ে হয়ে গেছিস কিনা। ভুলেই গেছিস একঘরে আমরা চার বছর কাটিয়েছি। (গাল টিপে দিয়ে) উই ওয়্যার প্র্যাকটিক্যালি ম্যারেড।

    (মঞ্চের বাঁদিক অন্ধকার হয়ে দিয়ে ডানদিকে আলো ফুটবে। ঋতমা একা বসে আছে)

    ঋতমা: ল্যাবে ফিরতে ফিরতে প্রায় রাত আটটা বেজে গেছিল। ওই সময় সব শুনশান ফাঁকা, শুধু একধারে আবছা আলোয় একটা কমপিউটার স্ক্রীনের সামনে একজন লোক ঘাড় গুঁজে কাজ করে যাচ্ছে। লোকটা শুধু কাজই করছেনা গুনগুন করে গানও করছে। আমার চেনা সুর, মা’কে অনেকবার গাইতে শুনেছি। আমাকে দিয়েও গাইয়েছিল আএবার আমাদের বাঙালি ক্লাবের দুর্গাপুজোর অনুষ্ঠানে। যন্ত্রপাতি ভরা, অ্যাসিডের গন্ধ মাখানো ল্যাবরেটরির মধ্যে গানের সুরটা ঠিক যেন জানালা দিয়ে ঢুকে পড়া নার্ভাস পাখির মতন ঘুরপাক খাচ্ছিল।

    (গান--আমি চিনি গো চিনি তোমারে। মঞ্চের আলো আবার বাঁদিকে ঘুরে যাবে। জামাল ও ঋতমা। )

    ঋতমা: হাই। আপনি এত রাত্তির অবধি কাজ করছেন। বাই দা ওয়ে আমি ঋতমা, ফ্রেন্ডস কল মি ঋতু।

    জামাল: আমার নাম আনোয়ার জামাল। আপনার টিসু কালচারটা বহাল তবিয়তে আছে, আমি দেখে দিয়েছি।

    ঋতমা: ও আপনি তাহলে কিছুদিন ধরেই আমার কাজটা দেখাশোনা করছেন। তাই ভাবি আনাড়ি হাতে এত ভালো কাজ কি করে হচ্ছে।

    জামাল: ওটা কিছু নয়, আপনি হাসপাতালে এত কাজে ব্যস্ত থাকেন--

    ঋতমা: তাই নিঃশব্দে আমাকে হেল্প করে যাচ্ছিলেন। এদিকে আমি তো ভেবেই নিয়েছিলাম আপনি বোবা।

    জামাল: যাক ভুলটা ভাঙলো, আমিও দুটো বাংলা কথা বলে বাঁচলাম। আসলে আপনি এমন জুতো খটখটিয়ে আসেন যান, গম্ভীর মুখ, সাদা কোট, ভীষণ ব্যস্ত চেহারা, আমি নিজে ডেকে আলাপ করার সাহসই পেতাম না।

    ঋতমা: শুধু দিনে দুবার করে বোকার মত তাকিয়ে দেখতেন রোজ?

    জামাল: এই বিদেশে রোজ সকালবেলায় আপনার মতো সুন্দরী বাঙালি মেয়ের মুখ দেখতে পাওয়া কি কম কথা নাকি?

    ঋতমা: তাই বুঝি? তা আমি বাঙালি জানলেন কি করে শুনি? মারাঠি, গুজরাতি, বা অন্ধ্রের মেয়েও তো হতে পারতাম।

    জামাল: না পারতেন না। আমি শুনে ফেলেছিলাম, একদিন কি একটা নিয়ে বিরক্ত হয়ে আপনমনেই বলে উঠেছিলেন, ‘কোনো শান্তি নেই’।

    ঋতমা: (হাসছে) মা খুব ফ্রাস্ট্রেটেড হয়ে গেলে ওই কথাটা বলেন, আমার ছোটবেলা থেকে শুনে শুনে অভ্যাস হয়ে গেছে। কিন্তু এদেশে এরকম লাজুক হলে খুব বিপদ জামাল।

    জামাল: কি রকম বিপদ?

    ঋতমা: ওপরে উঠতে পারবেন না। আমি আপনার কাজ দেখেছি, ইট ইজ সিম্পলি ব্রিলিয়ান্ট। একটু নিজের ঢাক নিজে পেটান, আপনি গ্রান্ট পেয়ে যাবেন, পার্মানেন্ট ফ্যাকালটি পজিশনও পাবেন। সারা জীবন তো আর রিসার্চ অ্যাসিসট্যান্ট হয়ে অন্যের পেপার লিখে কাটবেনা।

    জামাল: ঋতু, আমি যেখান থেকে আসছি সেখানে ঢাক পেটালে পুলিশ ধরে আর বেশি আশা করলে পস্তাতে হয়। তাছাড়া অনেক সময় না চাইতেও ভালো জিনিসটা নিজে থেকেই মেলে।

    (গান--না চাহিলে যারে পাওয়া যায়। মঞ্চের বাঁদিক অন্ধকার হয়ে ডানদিক আলো ফুটে উঠবে। ঋতমা, পিউ আর আজিজ)

    ঋতমা: ভালো করে খা আজিজ। কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াস, চেহারার কি হাল করেছিস। এদিকে আমি চিন্তায় মরি। যেমন দাদা ছিল, তেমনি ভাই হয়েছে।

    আজিজ: তুমি এই কয়েকদিন আমার ক’পাউন্ড ওজন বাড়ানোর প্ল্যান করছো দিদিভাই।

    পিউ: জানো আজিজ আঙ্কল মা তোমার দাদার লেখা বইটা ইংলিশে ট্রানসলেট করছে।

    আজিজ: সে কি? দিদিভাই!

    ঋতমা: হ্যাঁ রে তোর সাথে ওই নিয়েই কথা আছে আমার।

    আজিজ: তুমি সত্যি বলছো? তুমি না বলেছিলে--

    ঋতমা: বলেছিলাম মনের মধ্যে রেখে দেবো। বাংলা পড়তে শেখা বাবা আর জামালের কাছে। আজকে আমার যারা প্রিয়জন তারা ওই বইটা কোনদিন পড়তে পারবেনা, ভেবেছিলাম সেটাই হয়ত সবদিক দিয়ে ভালো। কিন্তু মেয়ে বড়ো হবার সঙ্গে সঙ্গে আমার মতটাও বদলাচ্ছে। যে পৃথিবীতে ওরা বড়ো হবে সেটা যে দিনকে দিন আরো হিংস্র, আরো অসহিষ্ণু হয়ে যাচ্ছে। সেদিন হঠাৎ আমার মনে হল বইটার আরো পাঠক হওয়া দরকার।

    আজিজ: কিন্তু

    ঋতমা: নীরজ কি মনে করবে? বইটার অর্ধেক জুড়েই তো আমার প্রতি জামালের প্রেম নিবেদন, যার পাঁচ পার্সেন্টও ওর মুখে আসেনি কোনদিন। কি জানি? আশা করি এতদিনে আমাদের মধ্যে সেটুকু বিশ্বাস, ভরসা আর বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছে যে ও আমাকে ভুল বুঝবেনা।

    পিউ: বাবা লাভস ইউ মা। তাছাড়া বাবা খুব ব্রড মাইন্ডেড জেন্টলম্যান অ্যান্ড হি নো’স অ্যাবাউট ইয়োর রিলেশনশিপ উইথ জামাল আঙ্কল।

    ঋতমা: সবটা জানেনা। জানলে হয়ত ক্ষুন্ন হবে।

    পিউ: ওকে ইট ওয়াজ আ ট্র্যাঙ্গেল, ইউ আলটিমেটলি চোজ বাবা। বিগ ডিল। এ নিয়ে এতদিন পরে আপসেট হবার কি আছে।

    আজিজ: পিউ তুই জানিস বিবিসি-তে চাকরি নেবার আগে আই ওয়াজ ইন সিরিয়া। আমি আসলে ফ্রিল্যান্সিং করতে গিয়েছিলাম। ইউরোপের মুসলিম ছেলেমেয়েরা কিভাবে ব্রেন ওয়াশড হয়ে মার্ডারার বনে যাচ্ছে সেটা ভেতর থেকে বুঝতে চেয়েছিলাম। আই ওয়াজ ক্যাপচারড বাই দি একস্ট্রিমিস্টস। ভাইয়া না থাকলে প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারতাম না, আর তোর মা না থাকলে সি-আই-এ হয়তো আমাকে গুয়ান্টানামোয় পাঠিয়ে দিত।

    পিউ: জানি, তোমরা দুজনেই ইনজিওরড হয়েছিলে।

    ঋতমা: একটা কথা না বলে চলে গেল। কিন্তু আই শুড হ্যাভ নোন বেটার। (গলা ধরে আসে)

    পিউ: (মা কে জড়িয়ে ধরে) মা দেয়ার ইজ নাথিং রং ইন লাভিং সামওয়ান। আমি জানি তুমি বাবাকেও ভালোবাসো, ঠিক বাবার মতো করে। বলো না কলেজে বাবা কেমন ছিল। খুব অ্যানয়িং তাইনা?

    ঋতমা: কেমন ছিল নীরজ? হ্যান্ডসাম, এক্সট্রোভার্ট আর মেয়েদের ব্যাপারে দারুণ কনফিডেন্ট। একশো বার না বললেও প্রতি শুক্রবার আমাকে নিয়ে বাইরে কোথাও খেতে যেতে চাইবে। মাসখানেক আগে আমাকে খোলাখুলিভাবেই বলে দিয়েছে যে আমাকে নাকি রাণী মুখার্জির মতো দেখতে তাই প্রথম দিন থেকেই আমার সঙ্গে ওর পেয়ার হয়ে গেছে, এখন আর কিছু করার নেই। তা বলে ও বং বিউটিকে কোনো চাপ দিতে চায় না, অপেক্ষা করতে করতে দেবদাস বনে সেও ভি আচ্ছা। ছেলেটা হিন্দী সিনেমার পোকা, গানের গলাটাও বেশ ভালো, যখন আইফোনে ট্র্যাক চালিয়ে হাত পা ছুঁড়ে গান ধরে, পুরো ইউনিট হাততালি দিতে লেগে যায়।

    (আস্তে আস্তে মঞ্চের বাঁদিকে আলো ফুটে উঠবে, ডানদিকে আলো কমে আসবে। নীরজ ও ঋতমা।)

    নীরজ: হেই বেবি, এখনো কাজ করছো। চলো না একটা সিনেমা দেখে আসি। দেশে খুব হিট হয়েছে জমে যাবে। চলো, চলো সারাদিন ধরে কেন যে ওই ল্যাবে ঘাড় গুঁজে বসে থাকো। কাজ যদি কিছু বাকি থাকে তোমার পাকিস্তানি বন্ধু তো আছেই, ও সামলে দেবে এখন।

    ঋতমা: নীরজ, ও বাংলাদেশি, পাকিস্তানি না।

    নীরজ: ওই একই হলো।

    ঋতমা: ও শুধু আমাকে রিসার্চে হেল্প করে না, বাংলাও শেখায়।

    নীরজ: ওয়ান্ডারফুল। আমাকেও শেখাবে? আমিও বাংলা শিখবো ঠিক করেছি।

    ঋতমা: তুমি বাংলা শিখতে যাবে কেন?

    নীরজ: বাঙালি মেয়ে পটাতে গেলে একটু বাংলা শিখতে হয়, দু একটা টেগোর সং গাইতে হয়। বাবা বলেছে। কলকাতার মারু ছেলেরা সবাই জানে।

    ঋতমা: কীপ ড্রিমিং, নীরজ।

    নীরজ: প্লীজ চলো, আজকের মতো তোমার পাকিস্তানি পথ চেয়ে বসে থাকুক, আমারা মুভি দেখার পর একসাথে ফাটাফাটি একটা ডিনার খাই। আই হ্যাভ সাম গুড নিউজ টু সেলিব্রেট।

    ঋতমা: আগে শুনি কি নিউজ। (নীরজ একটা খাম এগিয়ে দেয়, ঋতমা খুলে দেখে) ওয়াও, ওয়াও নীরজ, কনগ্রাচুলেশনস!

    নীরজ: থ্যাঙ্কস মেরি জান।

    ঋতমা: তুমি কার্ডিওভ্যাসকুলার সার্জারি ফেলোশিপ পেয়েছো অ্যাট মাস জেনারেল। দিস ইস আনথিঙ্কেবল। এটা তো সেলিব্রেট করতেই হয়। একটু সময় দাও রেডি হয়ে নিই।

    নীরজ: না না এক্ষুনি চলো। আর কিচ্ছু লাগবেনা শুধু তোমার হোয়াইট কোটটা খুলে ফেললেই হবে। ইউ লুক রেডিয়েন্ট জাস্ট লাইক দ্যাট। দোজ আইজ টায়ার্ড ফ্রম স্লীপলেস নাইটস, দে স্টিল লুক সো বিউটিফুল। আইজ লাইক বার্ড’স নেস্ট।

    ঋতমা: (হাসতে হাসতে কোট খুলে ফেলে) এদেশে বার্ডস নেস্ট মানে হেয়ার নীরজ। আমাকে ইমপ্রেস করতে গিয়ে বাংলা কবিতার পিণ্ডি চটকে রাখলে একেবারে। ঠিক আছে, চলো কোথায় নিয়ে যাবে। বাবা ঠিকই বলে সেতার, সাপুড়ে আর সাধুবাবাদের পর ভারতীয় সংস্কৃতি বলতে এখন বলিউড।

    (দুজনে বেরিয়ে যায়। এবার স্টেজের ডানদিকে আলো ফুটে উঠবে। ঋতমা, পিউ আর আজিজ বসে বই পড়ছে, খাতায় লিখছে)

    আজিজ: সেই শুরু হল তোমার দুই নৌকায় পা দিয়ে চলা।

    ঋতমা: জামাল আর আমি তখন একই প্রজেক্টে কাজ করতাম, সন্ধেবেলা প্রায়ই একসাথে কারপার্কে ফিরতে হতো। ও কোনদিন আমার সঙ্গে একটা মামুলি ডেট করতেও চায়নি কিন্তু স্পষ্ট বোঝা যায় যে ওইটুকু কথা বলা সময়ের জন্যে ও সারাদিন মুখিয়ে থাকে। ওর সাহায্যে আমার প্রজেক্টের কাজ জলের মত সোজা হয়ে গেল। জামাল মুক্তমনা বলে একটা ফোরামে ধর্ম, সমাজ আর রাজনীতি নিয়ে লিখত, এই বইটাও ওইসময়েই লেখা শুরু করেছিল বোধহয়। সব বিষয়েই ওর অভিজ্ঞতা এত অন্যরকম আর মতামত এত র‍্যাডিক্যাল ছিল যে এক এক সময় আমার ভয় করতো, আবার ভালোও লাগতো।

    আজিজ: তোমার সেই অ্যাম্বিভ্যালেন্স নিয়েই আমি এখন একটা কাজ করছি – ডাইলেমাস অফ দি সেকুলার মুসলিম ইন দি ওয়েস্ট।

    ঋতমা: আশ্চর্যের কথাটা হচ্ছে যে ল্যাব থেকে বেরিয়ে ক্লিনিকে ঢুকে গেলেই আমি কেমন যেন বদলে যেতাম। সেটা ছিল আমার চেনা জগৎ, সেখানে একঝাঁক উজ্জ্বল আত্মবিশ্বাসী ছেলেমেয়েদের ভিড়। জীবনটা এদের কাছে যেন বুনো ঘোড়া, তাকে লাগাম পরিয়ে বশে আনার চেষ্টায় আছে সবাই। সেখানে নীরজ যেন বলিউডের মেকবিলিভ দুনিয়া থেকে উঠে আসা রাজপুত্তুর। এইরকম দোটানার মধ্যেই এসে গেল জন্মদিনের পার্টি, বন্ধুদের সবাইকে বাড়িতে ডেকেছিলাম সেবার। ওই দেখুন আমার বাবা-মা, মেয়েকে নিয়ে দুজনেই বেশ চিন্তিত আজকাল।

    (মঞ্চের ডানদিক অন্ধকার হয়ে বাঁদিকে আলো ফুটবে। মৃণাল ও অঞ্জনা চ্যাটার্জি বসে চা খাচ্ছেন। )

    অঞ্জনা: শুনছো। মেয়ের সাথে কথা বললে নাকি?

    মৃণাল: মেয়ে বড়ো হয়েছে, ডাক্তার হয়েছে। ও নিজে না চাইলে ব্যক্তিগত কথা নিয়ে আলোচনা করতে বসা একটু মুশকিল। বরং তুমিই কথা বলে দেখোনা।

    অঞ্জনা: ওকে আমি কিছু বলতে গেলে হয় হেসে উড়িয়ে দেবে নয়ত বাঁকা বাঁকা কথা বলবে। বলি ওর মতলবটা কি? নীরজ ছেলেটার এমন ব্রিলিয়ান্ট কেরিয়ার, সবচেয়ে বড়ো কথা ঋতুকে সত্যিই ভালোবাসে, আমাদেরও কতো শ্রদ্ধা করে। কথাটা পাকা করে ফেললেই তো চুকে যায়।

    মৃণাল: সেটা ওরাই ঠিক করবে অঞ্জু, আমাদের কিছু করার নেই।

    অঞ্জনা: ওই মুসলিম ছেলেটাই যতো নষ্টের গোড়া। কেন নিজের ধর্মের কাউকে বিয়ে করলেই তো পারে। খালি হিন্দু মেয়েদের দিকে নজর।

    মৃণাল: উলটোটাও হয়। এই তো আমাদের জর্জ ক্লুনি এক লেবানিজ ভদ্রমহিলাকে বিয়ে করলো, কমল দাশগুপ্ত ফিরোজা বেগমকে নিয়ে পালিয়েছিলেন।

    অঞ্জনা: চুপ করো তুমি, কুতার্কিক কোথাকার। ওদের আবার বিয়ে। আমি বাপু ভালো বুঝছিনা। রোজ খবরের কাগজে একটা করে হামলার খবর বেরোচ্ছে। অল্পবয়েসী ছেলেমেয়েগুলো বাড়ি থেকে পালিয়ে সিরিয়াতে ইসলামিক স্টেটের ওই বদমাইশগুলোর দলে ভিড়ে জেহাদ লড়তে যাচ্ছে। ইংল্যান্ড আর ফ্রান্স কয়েক হাজার অলরেডি গেছে, এখান থেকেও কয়েকটা ছেলেমেয়ে মিসিং হয়েছিল, তারা নাকি টার্কিতে ধরা পড়েছে। আচ্ছা নিজের বাড়িতে বসে যদি ইন্টারনেটে মগজ ধোলাই হয়ে যায়, তবে বাপ-মা কি করবে বল?

    মৃণাল: হামলা ওদের ওপরও হচ্ছে অঞ্জু।

    অঞ্জনা: তুমি যাই বলো বাপু ওই নীরজ ছেলেটা খুব ভালো। যেমন সুন্দর চেহারা তেমন ভদ্র ব্যবহার, পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে। কেমন বাংলা শেখার চেষ্টা করছে, আমার কাছে বাংলা সিনেমার ডিভিডি চেয়ে নিল।

    মৃণাল: তোমাকে বেশ ইমপ্রেস করেছে দেখছি। আমার কিন্তু জামাল ছেলেটিকে খারাপ লাগেনা। খুব আদর্শবাদী ছেলে, বাংলাদেশে অনেকগুলো প্রগতিশীল গ্রুপের সাথে ওর যোগাযোগ আছে, হি ইজ ট্রুলি আ সেকুলার অ্যাক্টিভিস্ট। জামাই হিসাবে অবশ্য নীরজের কাছে ও দাঁড়ায় না, বেচারি এখনো পোস্ট ডক করছে, এই বাজারে চাকরি পাবার সম্ভাবনাও কম।

    অঞ্জনা: জানিনা বাপু। আমি কিছু বললেই তো তোমরা বাপ-মেয়েতে মিলে হই হই করে ওঠো। একটা অঘটন ঘটলে তখন বুঝবে।

    মৃণাল: ছাড়ো না অঞ্জু। আজ মেয়েটার জন্মদিন, সবাই আসবে, আজকে আর এসব কথা তুলো না। আমার বিশ্বাস ও নিজে যা করবে ভালোই করবে। তুমি তো ওর বন্ধু অ্যালিশা মেয়েটাকে নিয়েও কিসব বলতে।

    অঞ্জনা: যা মনে হতো তাই বলতাম। তুমি আর বেশি ভালোমানুষ সেজো না। একেই তো মা মনসা তায় আবার ধুনোর গন্ধ।

    (অঞ্জনা বেরিয়ে যান। জামাল ঢোকে।)

    জামাল: কাকাবাবু, নমস্কার। বইটা ফেরৎ দিতে এলাম।

    মৃণাল: এসো জামাল। তোমার লেখাগুলো পড়ে দেখলাম। টু নেশন থিওরী নিয়ে তোমার অ্যানালিসিস খুব সঠিক মনে হলো। এই বইটা পড়েছো--ইন্ডিয়া আফটার গান্ধী? কাশ্মীর নিয়ে খুব অবজেক্টিভ আলোচনা আছে। শুনবে একটু--

    জামাল: দেখি বইটা

    (নেপথ্যে অঞ্জনা): শুনছো? নীরজ গাড়ি থেকে খাবার নামাচ্ছে, ওকে একটু হেল্প করো না।

    মৃণাল: তুমি বসো, আমি আসছি।

    (জামাল বসে বসে বই পড়ছে আর একটা সুর গুনগুন করছে--না চাহিলে যারে পাওয়া যায়। ঋতমা ঢোকে। জামাল মুখ তুলে তাকায়।)

    ঋতমা: এই জামাল। একা একা বসে বই পড়ছো কেন। চলো চলো কেক কাটা হবে।

    জামাল: এক মিনিট দাঁড়াবে ঋতু। তোমায় এইরকম সাজে কখনও দেখিনি। একটা ছবি তুলবো। (জামাল সেলফোনটা বার করে। ঋতমা হঠাৎ ওর পাশে চলে যায়, সেলফোনটা কেড়ে নিয়ে জামালের গালে গাল ঠেকিয়ে একটা সেলফি তুলে ফেলে। জামাল হতভম্ভ )

    ঋতমা: না চাহিলে সবসময় পাওয়া যায়না। বুঝেছ?

    (মঞ্চের বাঁদিক অন্ধকার হয়ে ডানদিকে আলো ফুটবে। ঋতমা আর আজিজ বসে কথা বলছে। )

    আজিজ: দিদিভাই এইখানটায় ও লিখেছে যে তুমি অ্যালিশার সাথে সব কথা বলতে। তোমাদের রিলেশনশিপটা খুব জেনুইন ছিল। ভাইয়ার সঙ্গেও অ্যালিশার বেশ একটা বন্ধুত্ব হয়ে গেছিল।

    ঋতমা: হ্যাঁ ও ওর সব কথাও আমাকে বলতো। শুধু একটা কথা লুকিয়ে রেখেছিল অনেকদিন। (টেবিল ছেড়ে সামনে এগিয়ে আসে) আমাদের পুরনো ডর্মিটরি থেকে আধমাইল দূরে আদ্যিকালের বিরাট সব গাছের ছায়ায় একটা পুরনো কবরখানা আছে। দুই বন্ধুতে মিলে প্রায়ই ওখানে বসে গুলতানি করতাম, মাটির তলার লোকজনের সঙ্গেও মাঝে মাঝে আষাঢ়ে আলাপ চলতো। আমরা দুই সদ্যযুবতী টের পেতাম চারদিকের অরণ্যমর্মর আমাদের বুকের মধ্যেও গুঞ্জরিত হচ্ছে। কলেজের দিনগুলো কেটে গেছে প্রায় পাঁচ বছর হতে চললো, আমরাও আর সদ্যযুবতী নই। সেদিন ঠিক আগের মতো এক বসন্তের বিকেলে আমরা দুই সখীতে আমাদের প্রিয় চেরিগাছটার তলায় বসে মনের কথা বলছি। আমাদের অশরীরী শ্রোতারা আশেপাশে থাকলেও তারা নিঃশব্দ, তাই এখানে সবসময় থাকে এক অদ্ভুতরকম শান্তি।

    (মঞ্চের ডানদিক অন্ধকার হয়ে বাঁদিকে আলো ফুটে উঠবে। অ্যালিশা ও ঋতমা পাশাপাশি বসে আছে। )

    অ্যালিশা: ঋতু, এতদিন নিজেকে ধোঁকা দিয়ে বেশ ছিলাম জানিস।

    ঋতমা: কি ধোঁকা? হতেই পারে যে তুই বাইসেক্সুয়াল। দিব্যি তো ছিলি বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে।

    অ্যালিশা: পুরোপুরি মিথ্যে, এবং এটা বেছে নেবার, বানিয়ে তোলার জিনিস নয়। ছেলেদের সঙ্গে আমি কোনদিন ভালো থাকিনি, ওরাও ঠিক বুঝতে পারেনি গোলমালটা কোথায়? আমি প্রাণপণে আশা করতাম একসময় আমি ঠিক সেরে যাবো, আর সবার মতন হয়ে যাবো, একসময় বিয়ে হবে, সংসার হবে। এইবার আর পালাবার পথ নেই। আমি লেসবিয়ান, মেইনস্ট্রীমের বাইরে, সারাজীবন আমাকে যুদ্ধ করে কাটাতে হবে।

    ঋতমা: তুই শিওর ওই অ্যাফেয়ারটার জন্যই--

    অ্যালিশা: চাকরি গেছে? অফ কোর্স। আমি একজন বিবাহিত মহিলার সাথে মুভ-ইন করেছি, এটা যথেষ্ট কেলেঙ্কারি। যদিও ওরা কিছুতেই স্বীকার করবেনা, কত কারণেই তো লে-অফ হয় আজকাল।

    ঋতমা: কি বলছিস তুই। এই যুগেও এতো প্রেজুডিস--

    অ্যালিশা: প্রেজুডিস জিনিস্টা মানুষের সাবকনশাসে কাজ করে, তাকে দিয়ে যা করবার করিয়ে নেয়। আমি এখন পাঁচিলের ওপাশে, আউটসাইডার।

    ঋতমা: অ্যালি আমরা বন্ধুরা তোর সাথে আছি।জামাল বলে এমন একটা সমাজ তৈরি করতে হবে যেখানে মেইনস্ট্রীম বলে কিছু নেই। একটা সত্যিকারের রেইনবো সোসাইটি।

    অ্যালিশা: তুই এটা ঠিক বুঝবিনা রে ঋতু। তোর জীবনটা যে প্রথম থেকেই মেইনস্ট্রীমে, একটা কপিবুক আমেরিকান সাকসেস স্টোরি। সাবার্বান ফ্যামিলি, সুন্দরী মেয়ে, স্কুল কলেজে দারুণ গ্রেড, ডাক্তারি পড়ছিস। ইমিগ্র্যান্ট হলেও আমেরিকান সোসাইটি তোদের আদর করে কোলে বসিয়েছে। ওই জীবনটার প্রতি তো আমারও লোভ ছিল। কিন্তু যা নয় তা হয়না, আমাকে আমার মতই চলতে হবে।

    ঋতমা: সফল হওয়া, সকলের সাথে মানিয়ে চলা কি অপরাধ? সংঘাত কি হতেই হবে, লিভ অ্যান্ড লেট লিভ তাহলে একটা কথার কথা।

    অ্যালিশা: মানিয়ে চলার পেছনে একটা ন্যারেটিভ আছে। কতগুলো জিনিস তোরা মেনে নিয়েছিস--যেমন ধর গরীব আর কালোদের দুর্দশার জন্য আসলে ওরাই দায়ী, মার্কেট ক্যাপিটালিজম মানে ইতিহাসের শেষ পাতা, বিয়ে কেবল ছেলে আর মেয়েদের মধ্যেই হতে পারে, এইসব আরকি।

    ঋতমা: আমরা মোটেই এইগুলো মেনে নিইনি। আমাকে দেখে তোর ওইরকম কনফর্মিস্ট মনে হয়?

    অ্যালিশা: পেটে পেটে মেনে নিয়েছিস, বাইরে নিয়ম করে প্রতিবাদ জানাস।

    ঋতমা: অ্যালি তুই জানিস না আমি কতটা কনফিউজড, কি মারাত্মক দোটানার মধ্যে আছি। তাহলে এসব কথা বলতিস না।

    অ্যালিশা: সরি ঋতু, তোর কথা তো শোনাই হয়নি। খালি নিজের কথাই বলে যাচ্ছি। তারপর, দুই প্রেমিকের মধ্যে কাকে শেষ অবধি মনে ধরলো। আগে বল আসল জিনিসটা পরখ করে দেখেছিস কিনা?

    ঋতমা: একটু বেশিই পরখ করে ফেলেছি রে। এখন কি করব বুঝতে পারছিনা। তুই যে পাঁচিলের বাইরে থাকার কথা বললি জামাল সারাজীবন সেখানে থেকেই কাজ করতে চায়। ও রিফিউজি সেন্টারে গিয়ে অরফ্যান বাচ্চাদের ইংরেজি শেখায়, টিনএজারদের ইন্টারনেটের জেহাদি প্রপাগ্রান্ডা থেকে বাঁচাবার চেষ্টা করে রাখে। ওর লেখা পড়তে আমার দারুণ লাগে। হিজ আইডিয়াস আরে ডিফারেন্ট আর ফ্যাসিনেটিং কিন্তু বড্ড সিরিয়াস, মাঝে মাঝে না দম আটকে আসে।

    অ্যালিশা: তখন?

    ঋতমা: তখন আমার ভালো লাগে নীরজের পাগলামি, বলিউডি নাচগান, হুইস্কি আর স্পোর্টস কার। ভালো লাগে অপারেটিং রুমের সামনে ওর লম্বা নীল স্ক্রাব পরা কনফিডেন্ট চেহারাটা, আমাকে দেখে একগাল হাসি আর ঋতু ডার্লিং বলে ডাকা। ভালো লাগে ওর শক্ত হাতের মুঠো। আমি চোখ বুজে মায়ের হাসিমুখটা দেখতে পাই আর ওখানে জামালের কথা ভাবতে গেলেই একগাদা প্রশ্ন আমাকে ভয় পাইয়ে দেয়।

    অ্যালিশা: তাই যদি হয় তো তোকে খুব তাড়াতাড়ি বেছে নিতে হবে। অনেক সময় আমাদের মন একজনকে ভালোবাসে আর শরীর আরেকজনকে। কাল জামালের ল্যাবে তোর শেষ দিন, নীরজও কিছুদিনের মধ্যে বস্টন চলে যাবে, তুই আর দেরি করিস না। শুধু মনে রাখিস বয়েস হলে শরীর পালটে যায়, মন কিন্তু পালটায় না।

    (জামাল ঢোকে)

    জামাল: হ্যালো অ্যালিশা। কেমন আছো ঋতু?

    অ্যালিশা: এই যে বলতে বলতেই। আবার হাতে দেখছি ফুলের বোকে। ঋতুকে প্রপোজ করবে নাকি?

    জামাল: না না ওকে কনগ্রাচুলেশন জানাতে এসেছি। রেসিডেনসি শেষ, কাল ব্যস্ত থাকবে, হয়ত দেখাই হবে না।

    ঋতমা: তাই নাকি? তা শুধু ফুল এনেছো? আর কিছু দেবার নেই তোমার?

    জামাল: এই দুটো বই আছে। নেরুদা আর অক্তেভিও পাজের বাইলিঙ্গুয়াল এডিশন। তুমি তো কিছুটা স্প্যানিশ জানো।

    ঋতমা: দেখি (বইটা নিয়ে খুলে দেখে )

    Tonight I can write the saddest lines.
    To think that I do not have her. To feel that I have lost her.
    Love is so short, forgetting is so long.

    ঋতমা: ইনকরিজিবল। অ্যালিশা তুই বাড়ি যা। জামাল চলো আমার সঙ্গে, কথা আছে।

    অ্যালিশা: জামাল, দিস ইজ ইয়োর ডে। ডোন্ট স্ক্রু ইট আপ।

    (অ্যালিশা বেরিয়ে যায়)

    জামাল: আমারও আজকে ছুটি। সত্যি কথা বলতে কি একেবারেই ছুটি।

    ঋতমা: তার মানে?

    জামাল: আমি ভেবেছিলাম ইন্টারভিউ ভালোই হয়েছে কিন্তু ফ্যাকাল্টি পজিশনটা আমি পেলাম না। ওরা রবার্ট লিং বলে এক চাইনিজ ভদ্রলোককে সিলেক্ট করেছে। আমার অ্যাডভাইসর ডঃ অরোরাও কিছু বললেন না, ভাব দেখে মনে হল এইরকম আশা করেছিলেন।

    ঋতমা: তাহলে তোমার ভিসার কি হবে?

    জামাল: যতদিন পোস্ট-ডক ততদিনই ভিসা। দেখা যাক কি হয়।

    ঋতমা: দিস ইজ বুলশিট! ওই লিং কে আমি খুব ভালো করে চিনি। সেমিনারে একটা কথা বলতে পারেনা, তোমার অর্ধেক পাবলিকেশন ওর নেই, কাজের ডেস্কে খুঁজে পাওয়া যায়না সারাদিন শুধু বসের পিছনে ঘুরঘুর করছে। এই চাইনিজগুলো এক একটা--

    জামাল: ব্যস ব্যস আর বোলো না, তাহলেই রেসিয়াল হেট্রেড বেরিয়ে পড়বে। ইন্ডিয়ানরা চাইনিজদের পছন্দ করেনা, চিঙ্কু বলে হাসাহাসি করে। চাইনিজরা কি বলে কেউ জানে না বটে, কিন্তু আমি শিওর সেটাও রেসপেক্টেবল কিছু নয়। আমার পক্ষে এটা ভেবে নেওয়া খুব সোজা যে আমার মহম্মদ জামাল নামটা ওদের পছন্দ হয়নি। ওটা ভাবার জন্যে আমার চাকরিটা হবেনা কিন্তু রাগটা থেকে যাবে, তাতে আমার কাজের ক্ষতি বই লাভ কিছু নেই।

    ঋতমা: চুপ করো প্রফেসর, তোমার এইসব ঠাণ্ডা যুক্তি শুনলে আমার এক এক সময় গা জ্বালা করে। অ্যালি ঠিকই বলেছিলো, পাঁচিলটা কোথায় আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি। জামাল তোমার কাছে একটা দামী জিনিস চাইবো, দিতে পারবে?

    জামাল: কি দেবো বলো?

    ঋতমা: তোমার পুরো জীবনটা। (জামালের হাতটা টেনে নেয়।)

    (আলো আবার ডানদিক ঘুরে যাবে। ঋতমা, পিউ আর আজিজ)

    আজিজ: নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হয় আমার। আমার জন্যেই তো ভাইয়াকে সবকিছু ছেড়ে আসতে হলো।

    ঋতমা: তুই নয় আমি অপরাধী। একটা খোঁজ নিয়েও দেখলাম না

    আজিজ: তাই তো তারপর থেকে আমার সব ভার নিয়ে সারাজীবন ধরে খোঁজখবর নিয়ে চলেছ।

    পিউ: মা, আজিজ আঙ্কল এটা একদম ঠিক নয়। সেদিন যা হবার হয়েছিল, তাতে তোমাদের কারো কোনোরকম দোষ নেই। অল থ্রি অফ ইউ ওয়্যার ব্রেভ পিপল বাট হিজ সাইলেন্স অ্যান্ড স্যাক্রিফাইস ওয়ার হিজ চয়েস। তাছাড়া ভেবে দেখো, ইফ ইউ ডিডন্‌ট ম্যারি বাবা দেন হোয়ার উড আই বি?

    আজিজ: যা হয়েছে আমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে তাতে তোমার কিছু করার ছিল না দিদিভাই। ইউ আর অলসো আ ভিকটিম অফ সেন্সলেস ভায়োলেন্স লাইক মেনি আদার্স।

    ঋতমা: ওকে বাড়ি নিয়ে গেলাম। আকাশ জুড়ে তখন মেঘ করেছে বৃষ্টি নামলো বলে। থেকে থেকে আমার মাথার মধ্যে বিদ্যুৎচমকের মতো একটাই চিন্তা জেগে উঠছে। আমি একশোভাগ আমেরিকান, আমাকে বিয়ে করলে কেউ ওকে এদেশ থেকে তাড়াতে পারবেনা। আমি প্র্যাকটিস করবো, ও রিসার্চ আর পড়াশোনা নিয়ে থাকবে। বছর ঘুরবে শরীর পালটে যাবে, আরো কাছাকাছি আসবে মন। এইরকম ঝোঁকের মাথায় কিছু করার কি যে একটা অসহ্য ইনটক্সিকেশন আছে, জীবনে ওই একবারই টের পেয়েছিলাম।

    (আলো বাঁদিকে ঘুরে যাবে। মৃণাল চেয়ারে বসে আছেন। ঋতমা ও জামাল ঢুকছে)

    ঋতমা: হাই বাবা। এই দেখো কাকে নিয়ে এসেছি। তোমার দেশের ছেলে।

    অঞ্জনা: ইস কি বিচ্ছিরি ওয়েদার।

    মৃণাল: এসো জামাল। ঋতুর বন্ধুদের মধ্যে একমাত্র তোমার সঙ্গেই বাংলায় কথা বলা যায়। দেখো ভিজে মাটির গন্ধটা কিন্তু ঠিক বাংলাদেশরই মতো তাইনা? কিছু কিছু জিনিস সব দেশেই একরকম।

    জামাল: প্রথম বৃষ্টির গন্ধটা আমাকেও সবসময় দেশের কথা মনে করায়।

    ঋতমা: তোমরা একটু বসো আমি আসছি। চা খাবে তো? (ঋতমা ভেতরে চলে যায়, জামাল বসে। হঠাৎ ওর ফোন বেজে ওঠে। জামাল ফোনটা ধরে। ওর মুখের চেহারা বদলে যায় )

    জামাল: কাল থেকে পাওয়া যাচ্ছেনা? মেসেজ পাঠিয়েছে? কি বললে? ঠিক আছে আমি আসছি। (মৃণালকে) কাকাবাবু কিছু মনে করবেন না আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে ঋতুকে বলে দেবেন প্লীজ, ও যেন রাগ না করে। বাড়িতে একটা বিপদ হয়েছে। ফোন করবো। (বেরিয়ে যায়)

    মৃণাল: আরে আরে দাঁড়াও। কোথায় যাচ্ছো বলে যাবেতো। এই দেখো কি আবার হলো।

    অঞ্জনা: এই ছেলেমেয়েদের ব্যাপার কিছু বুঝি না বাপু। এই এলো, এই গেলো।

    (ঋতমা ঢোকে।)

    ঋতমা: বাবা, মা তোমাদের সঙ্গে কথা আছে, প্লীজ ডোন্ট ফ্রিক আউট! জামাল--একি জামাল কোথায়?

    অঞ্জনা: ফ্রিক আউট করে আর কি হবে, আমাদের কথা কি আর কানে নেবে তোমরা।

    মৃণাল: ও তো হঠাৎ করে চলে গেল। একটা ফোন এসেছিল, বোধহয় ওর বাড়ির লোকই হবে। খুব নাকি আর্জেন্ট, তোকে সরি বলতে বলে দিল, পরে ফোন করবে। বিপদ আপদ কিছু একটা হলো নাকি?

    (কয়েক মুহূর্ত কারো কথা নেই। ঋতমা ফোন করার চেষ্টা করছে, কেউ ধরছে না। ও বাইরে যাবার চেষ্টা করে, অঞ্জনা আটকে দেন)

    অঞ্জনা: এখন আবার ওকে খুঁজতে বেরোবি নাকি? দেখিস একটু বাদে ও নিজেই ফোন করবে। ঋতু প্লীজ এই ওয়েদারে এখন বেরোস না। মায়ের একটা কথা শোন।

    (ঋতমা হতাশ হয়ে মুখ ঢেকে বসে পড়ে। অঞ্জনা ওকে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন, মৃণাল মাথা নেড়ে ওদের পিছনে পিছনে বেরিয়ে যান।)

    (আলো ডানদিকে ঘুরে যায়। পিউ, আজিজ ও ঋতমা )

    আজিজ: গল্পের বাকিটা আমি খুব ভালো করে জানি। তুমি মাসখানেক বাদে সিকিউরিটি এজেনসি থেকে ফোনটা পেয়েছিলে।

    ঋতমা: ঠিক। রাগে, চিন্তায়, অপমানে তখন আমার পাগলের মতো অবস্থা। সেদিন সার্জিক্যাল ক্লিনিকে গেছিলাম একটা কাজে, এমন সময় ফোনটা এলো।

    (আলো বাঁদিকে ঘুরে যায়। কালো পোষাক পরে অফিসার ব্র্যাডলি ঢোকেন। )

    অফিসার: আপনি ডঃ ঋতমা চ্যাটার্জি?

    ঋতমা: হ্যাঁ, বলুন।

    অফিসার: আমি হোমল্যান্ড সিকিউরিটির অফিসার ব্র্যাডলি। আপনি মহম্মদ জামাল বলে কাউকে চিনতেন? আপনি যে ল্যাবে কাজ করতেন ওখানকার পোস্ট-ডক্টরাল ফেলো।

    ঋতমা: আমার বন্ধু। কি হয়েছে ওর?

    অফিসার: কিরকম বন্ধু? আপনার বয়ফ্রেন্ড?

    ঋতমা: কি বলতে চাইছেন?

    অফিসার: আপনি কি ইসলাম ধর্মে কনভার্ট করেছেন?

    ঋতমা: অবশ্যই না। জামাল কোনো ধর্মই মানতো না। কনভার্ট করার প্রশ্নই আসে না।

    অফিসার: মাপ করবেন ম্যাডাম কিন্তু ওর ফোন অ্যাকাউন্টে আপনার নম্বরের সাথে আপনার একটা ছবি আছে যেটা দেখে মনে হয় আপনারা খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুই ছিলেন। ধরে নিচ্ছি আপনি জানেন না যে উনি কোথায়।

    ঋতমা: আমরা খুব ভালো বন্ধু ছিলাম কিন্তু ও কাউকে কিছু না বলে উধাও হয়ে গেছে প্রায় দু’হপ্তা হতে চললো। দয়া করে বলুন উনি কোথায়?’ অফিসার: ডঃ জামালকে শেষবার দেখা গেছে ইস্তাম্বুলে। আমাদের ধারণা উনি ইসলামিক স্টেটের লোক, এখন জঙ্গিদের সাথে যোগ দিয়ে ইরাক এবং সিরিয়ার বর্ডারে কোনো এক জায়গায় আছেন। আশা করবো যে একজন রেসপনসিব্‌ল সিটিজেন হিসেবে আপনি আমাদের সঙ্গে কোঅপারেট করবেন এবং যেকোনো কমিউনিকেশন আমাদের সঙ্গে শেয়ার করবেন। আমরাও নজর রাখবো। ধন্যবাদ।

    ঋতমা: হোয়াট! (মাথা চেপে বসে পড়ে তারপর উদভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়ায়।) জামাল ইসলামি স্টেটের লোক, আমাকে আগাগোড়া ঠকিয়েছে। ওর ওই সুন্দর কথাগুলো সব মিথ্যে। আমার বমি পাচ্ছে! আঃ--

    (ঋতমা মাথা ঘুরে পড়ে যায়, নীরজ এসে ওকে ধরে ফেলে)

    নীরজ: ঋতু কি হয়েছে? আর ইউ ওকে?

    ঋতমা: আঃ নীরজ

    নীরজ: ঋতু ডার্লিং কি হয়েছে তোমার? কাঁদছো কেন?

    ঋতমা: নীরজ থ্যাঙ্ক ইউ! থ্যাঙ্ক ইউ!

    নীরজ: তোমায় ধরে ফেলার জন্য। ইউ আর ওয়েলকাম। এ তো একেবারে হিন্দী সিনেমার মতো হয়ে গেল। তা এত আপসেট কি নিয়ে সেটা তো বলবে। জামাল কোথায়?

    ঋতমা: সব বলবো নীরজ। একটু সময় দাও, সামলে নিই।

    নীরজ: আমি তো সবসময় তোমার জন্য ছিলাম ঋতু, তুমিই কেমন যেন সরে গেছিলে।

    ঋতমা: ভুল করেছিলাম নীরজ। আর সরে যাবোনা, দেখো।

    (আলো ডানদিকে সরে যায়। ঋতমা, আজিজ ও পিউ)

    পিউ: সত্যিই সিনেমার মতো। গল্পটা এখানে শেষ হলেই বেশ হতো। দেন দে লিভড হ্যাপিলি এভার আফটার। ওয়েল দে কাইন্ড অফ ডিড, কিন্তু লাইফ কাউকে পুরো সুখ দেয়না।

    আজিজ: সব কথা শোনার পর নীরজ তোমাকে একটা কোটেশন দেখিয়েছিল না। এই দেখো সেই কোটেশন। সারা ইউরোপ এখন এই মন্ত্র জপেছে যাএ ফল এই যুদ্ধ।

    যদি একটা সাপ দেখতে পাও,
    সাপের ওপর কোনো কমিটি বসিও না
    সাপের ইতিহাস নিয়ে মাথা ঘামিওনা
    সাপ বিষাক্ত কিনা জানতে চেয়োনা
    সর্পকল্যাণের জন্যে চাঁদা তুলতে যেওনা
    সাপটাকে পিটিয়ে মেরে নিজের কাজে চলে যাও।

    ঋতমা: দেখিয়েছিল। তখন মনে হয়েছিল কথাগুলো ঠিকই হয়ত। বুঝতে পারিনি এভাবেই ফলস আইডেন্টিটি আর রেসিজম মানুষের সমাজকে ছিঁড়ে ফালা ফালা করে দেয়। যাকগে অনেক রাত হলো তোরা এবার শুয়ে পড়।

    পিউ: অ্যালি আন্টি আসল ব্যাপারটা জানতো তাইনা?

    ঋতমা: হ্যাঁ বিয়ের ঠিক আগে আমি জানতে পেরেছিলাম। খুব জোর ধাক্কা খেয়েছিলাম রে, তোর বাবা না থাকলে আর উঠে দাঁড়াতে পারতাম না। হে হেল্পড মি ইন এভরি স্টেপ।

    পিউ: ইউ উইল অলওয়েক হ্যাভ ইচ আদার। আই অ্যাম প্রাউড অফ ইউ বোথ, মা।

    ঋতমা: আমি ভাবছি অইটা ট্রানস্‌লেট করলে শেষে এই ঘটনাটাও লিখে ফেলবো। একবার মনে হয় এ তো আমার গল্প, জামালের বইটার সঙ্গে এর সম্পর্ক কোথায়? আবার মনে হয় আছে, সম্পর্ক আছে। ওই রাতটা কুয়াশায় ঢাকা ডুবো পাহাড়ের মতো একদিন আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। অথচ তার মাত্র কয়েকঘন্টা আগেই তার কোনো চিহ্ন ছিলো না। রোদ্দুরে ভরা সেই বিকেলবেলায় আমি কি খুশি হয়েই না খবরটা দিয়েছিলাম।

    (আলো বাঁদিকে সরে যাবে। ঋতমা ও অ্যালিশা)

    ঋতমা: অ্যালি আজকে এক্ষুনি একটা সাংঘাতিক কাণ্ড হয়ে গেছে।

    অ্যালিশা: তোর গলা শুনে মনে হচ্ছে কাণ্ডটা খারাপ কিছু হয়নি। কি ব্যাপার?

    ঋতমা: নীরজ আমায় প্রপোজ করেছে, আমি হ্যাঁ বলেছি। আই অ্যাম গেটিং ম্যারেড !

    অ্যালিশা: কনগ্রাচুলেশনস ঋতু। রূপকথার বিয়ে সত্যি সত্যি হচ্ছে তাহলে?

    ঋতমা: অ্যালি তোরা দুজনেই আসবি কিন্তু অ্যাজ আ কাপল।

    অ্যালিশা: আমরা আর দুজনে নেই রে। তোকে বলা হয়নি উই ব্রোক আপ। কিন্তু আমি খুশি রে, ভীষণ খুশি, আমাকে মেড অফ অনার করবি তো?

    ঋতমা: ওঃ অ্যালি আই অ্যাম সরি। সত্যিই স্বার্থপর হয়ে গেছি কতদিন তোর খোঁজ নিইনি। বল আগে তোর কথা শুনবো।

    অ্যালিশা: মাথা খারাপ, আমার ওরকম কত হল, কত গেল। এখন ওসব কথা ছাড়, ডেট কবে, কতদিন সময় পাচ্ছি সেসব আগে বল। অনেক প্ল্যানিং করার আছে, উঃ আমি সো এক্সাইটেড।

    ঋতমা: কি হল রে? আমাকে বলবি না?

    অ্যালিশা: বাদ দে। জুলি সংসার করতে চায়, বাচ্চা অ্যাডপ্ট করতে চায়, ওসব আমার দ্বারা হবেনা। আমি অ্যাক্টিভিস্ট, গে রাইটস নিয়ে কাজ করছি, আমাকে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হয়। ও জেলাস হয়ে গেল, সন্দেহ করতে শুরু করলো। তারপর যা হয়। তোকে এইসব কথা বলতে চাইনি রে। তোর আর নীরজের মধ্যে ওরকম কিছু হবে না। তোদের কালচারটা অন্যরকম, তোরা পরস্পরকে ক্ষমা করতে পারিস অনেক বেশি। নীরজ কেমন করে তোকে প্রপোজ করলো সেটা বরং বল শুনি।

    ঋতমা: খাঁটি ভারতীয় পদ্ধতিতে, আমার বাড়িতে, বাবা-মার সামনে। নিজের বাবা মা’কেও ইন্ডিয়া থেকে তুলে এনেছে, এদিকে আমি কিচ্ছু জানিনা। আমার জন্মদিন, বাইরে খেতে বেরোনোর কথা ছিল। সিঁড়ি দিয়ে নামছি, দেখি বাবু দরজার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আছেন, দুই পক্ষের চারজন বাবা, মা নার্ভাস মুখে পিছনে দাঁড়িয়ে। পুরো বাংলায় টেগোরের কবিতা বলে প্রপোজ করলো।

    অ্যালিশা: ছেলেটার সাহস আছে বলতে হবে। তুই যদি না বলে দিতিস। বাবা, মা’র সামনে বেইজ্জত হতে হতো।

    ঋতমা: এতে আর সাহসের কি আছে। দুজনে মিলে গত কয়েকটা মাস যেমন যাচ্ছেতাই করছি, উত্তরটা তো জানাই আছে ওর।

    অ্যালিশা: তাহলে আর কি, লেটস সেলিব্রেট উইথ টেকিলা শটস লাইক ওল্‌ড ডেজ। (শটগ্লাস ও বোতল বের করে টেকিলা ঢালে) টু মাই বেস্ট ফ্রেন্ড।

    ঋতমা: বেস্ট ফ্রেন্ড। চিয়ার্স।

    অ্যালিশা: অ্যান্ড টু হার প্রিন্স চার্মিং; চিয়ার্স।

    ঋতমা: চিয়ার্স। বিয়ের পর আমরা বস্টনে মুভ করছি। আমরা এক হাসপাতালেই কাজ করবো।

    অ্যালিশা: হনিমুন কোথায় করছিস?

    ঋতমা: রাজস্থান। প্যালেস অন হুইল্‌স। অনেকদিনের শখ ছিল, সেদিন দেখি নীরজ বুকিং করে ফেলেছে। হি ইজ সো কেয়ারিং। টু আওয়ার ড্রিম হনিমুন। চিয়ার্স।

    অ্যালিশা: আত তাড়াতাড়ি খাস না, তোর একটাতেই নেশা হয়ে যায়।

    ঋতমা: (জড়ানো গলায়) আমি খুব হ্যাপি জানিস। জামাল কি ভেবেছিল, আমাকে ডাম্প করে চলে যাবে আর আমি সারাজীবন ওর জন্য বসে বসে কাঁদবো। হাউ কুড হি?

    অ্যালিশা: ওসব কথা ছাড় ঋতু। পাস্ট ইজ পাস্ট। তুই ঠিক ডিসিশন নিয়েছিস।

    ঋতমা: বাট হাউ কুড হি? (কেঁদে ফেলে) কেন আমাকে এভাবে ঠকালো। নাউ আই অ্যাম আ প্রেজুডিস্‌ড পার্সন; আমি আর কোনোদিন ওদের বিশ্বাস করতে পারবো না।

    অ্যালিশা: ওরকম বলিস না। জেনারালাইজ করা কি ঠিক? তাছাড়া হয়তো অন্য কোনো কারণ ছিল।

    ঋতমা: কারণ ছিল? এমন কি কারণ যে একটা ফোনও করতে পারলোনা? ও একটা ভায়োলেন্ট টেররিস্ট সেটাই কি সত্যি কথা? কিন্তু আমি কেন (হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলে) তাও কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না? কেন?

    অ্যালিশা: ওই চ্যাপ্টারটা বন্ধ করে দে ঋতু। ওই নিয়ে আর ভেবে লাভ নেই।

    ঋতমা: চেষ্টা করছি। তবু খালি প্রশ্নটা একটা ন্যাগিং মাথাধরার মতো ফিরে ফিরে আসছে। খালি মনে হচ্ছে কিছু একটা যেন মিসিং। আমি ওর চোখের মধ্যে তাকিয়ে দেখেছি, আমার গাট ফিলিংস বলছে কোথাও কিছু একটা গণ্ডগোল আছে। জামাল হোয়াই। জীবনে মাত্র একবার ভালোবাসলাম আর তাই নিয়ে তুমি এরকম করলে? নাকি আমারই ভুল? হোয়াই গেটিং ম্যারেড ইফ আই স্টিল লাভ দ্যাট বাস্টার্ড। (প্রায় হিস্টেরিক হয়ে যায় অ্যালিশা ওকে সামলাবার চেষ্টা করছে) অ্যাম আই এ ডিসেন্ট পার্সন?

    অ্যালিশা: যেতে দে ঋতু। ভগবানের দোহাই যেতে দে। চল তোকে শুইয়ে দি।

    ঋতমা: আমি কি নীরজকে ঠকাচ্ছি? অ্যাম আই বিয়িং আনফেথফুল? বল। বল তুই? তুইও তো আমায় ভালোবাসতিস তাই না? বাট আই অয়াজ অনেস্ট টু ইউ।

    অ্যালিশা: ঋতু শান্ত হ', তাহলে মন দিয়ে শোন। সত্যিটা তোর কাছ থেকে সারাজীবন গোপন রাখার কথা ছিল কিন্তু আজ মনে হচ্ছে তাতে তোর উপকারের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হবে। সিরিয়া-ইরাক বর্ডারে জামাল নিজে ইচ্ছেয় যায়নি।

    ঋতমা: হোয়াট?

    অ্যালিশা: এয়ারপোর্ট থেকে ফোন করে ও আমাকে সব কথা বলেছিল, তার সঙ্গে পই পই করে বারণ করেছিল তোকে ইনভল্‌ভ না করতে। হি মেড মি প্রমিস। তবে এখন আর কিছুই যায় আসে না।

    ঋতমা: কি যায় আসেনা, কি বলছিস তুই?

    অ্যালিশা: তুই তো জানিস রিসেন্টলি লন্ডন আর প্যারিস থেকে কয়েকহাজার মুসলিম ইউথ সিরিয়ায় লড়তে গেছে, প্রতিদিন আরো যাচ্ছে। জামালের ছোটভাই আজিজ তাদের সঙ্গে মিশে ফ্রিল্যান্স জার্নালিস্ট হিসাবে চলে গেছিল। লন্ডন পুলিশের ভুল ধারণা হয়েছিল যে ও র‍্যাডিকালাইজ্‌ড হয়ে জিহাদ লড়তে গেছে।

    ঋতমা: আজিজ, ওর ছোটোভাই, খুব ভালোবাসতো, ওর কথা কতবার শুনেছি। ওদের মা নেই, আজিজ দাদার কাছেই বলতে গেলে মানুষ।

    অ্যালিশা: ইট ওয়াজ আ মাইন্ড বগ্‌লিং এমার্জেন্সি। জামাল পুরোটা না জেনে তোকে কনট্যাক্ট করতে চায়নি। হি ওয়াজ ওয়রিড অ্যাবাউট ইয়োর সেফটি। একটা হিউম্যানেটেরিয়ান গ্রুপের সঙ্গে ও চলে গেছিল ইরাক আর সিরিয়ার বর্ডারে। সেখানে একদল রাফিয়ান ওদের কিডন্যাপ করে। তারপর ও আর কমিউনিকেট করতে পারেনি।

    ঋতমা: কিন্তু অফিসার ব্র্যাডলি...

    অ্যালিশা: অফিসার ব্র্যাডলি আমাকেও ফোন করেছিলেন অ্যান্ড আই কেপ্ট কলিং হিম ব্যাক। শেষ খবর হলো ইংল্যান্ড আর ফ্রান্স থেকে আসা কতগুলো ছেলেমেয়ের সঙ্গে ওরা পালাবার চেষ্টা করেছিল, রাস্তায় দে গট অ্যাম্‌বুশ্‌ড। জামাল আর আজিজ দুজনেই সাংঘাতিকভাবে জখম হয়, জামাল ফিলড হাসপাতালে মারা গেছে, আজিজ এখন আমেরিকান আর্মির কাস্টডিতে।

    ঋতমা: কি বললি? জামাল মারা গেছে? হি ডায়েড আ ভায়োলেন্ট ডেথ! আর তখনো তুই আমাকে কিছু জানাসনি?

    অ্যালিশা: প্লীজ বুঝতে চেষ্টা কর। তখন তুই নীরজের সঙ্গে ডেট করছিস, জামালের নাম শুনলেও রেগে উঠিস। আমি ভাবলাম যে গেছে সে তো গেছেই, তুই অন্তত সুখে থাক। আমি বুঝতে পারিনি যে তুই এতোটা ফিলিংস চেপে রেখেছিস।

    ঋতমা: বোধহয় আমিও বুঝতে পারিনি। (উঠে দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ পায়চারি করে) অ্যালি আমাদের বিয়ের প্ল্যানটা একটু বদলাতে হবে। ভালো কথা লন্ডনে ওর বাবার অ্যাড্রেস, ফোন নাম্বার সব দে।

    অ্যালিশা: রাগ করলি ঋতু? আমি তোর ভালোই তো চেয়েছিলাম...

    ঋতমা: জানিস অ্যালি সার্জারির পর বেশ কিছুক্ষণ কাটা জায়গাটা অসাড় হয়ে থাকে। এখন রাগ দুঃখ, অভিমান কিছু বুঝতে পারছিনা। একটু পরে হিট করবে।

    অ্যালিশা: ওঃ ঋতু (দুই বন্ধু পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে)

    (আলো ডানদিকে ঘুরে যাবে। ঋতমা একা বসে বইটা পড়ছে)

    ঋতমা: জামাল ওর জীবনের সঙ্গে আমাকে জড়াতে চায়নি। ও বুঝেছিল অ্যাক্টিভিস্টের জীবন আমার জন্য নয়, আমি পাঁচিলের ভেতরেই ভালো থাকবো। সত্যিই ভালো আছি জামাল। কিন্তু একটা দুঃখ প্রদীপের মতো জেগে না থাকলে, একঘেয়ে সুখে ঝিমিয়ে পড়ে জীবন। তাই সব কথা গুছিয়ে লিখবো। আমার আর তোমার পৃথিবীর মধ্যে সাঁকো হবে এই বইটা।

    সাঁকোটার কথা মনে আছে আনোয়ার
    এত কিছু গেলো সাঁকোটা এখনো আছে
    এপার ওপার কিনারায় একাকার
    সাঁকোটা দুলছে এই আমি তোর কাছে।

    (আবৃত্তির মধ্যে পর্দা নেমে আসবে)




    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments