গণ্ডক নদী গ্রীষ্মে ধীরে হাঁটি হাঁটি পা পা।
অরহর ডালের খেতের পাশ দিয়ে, কুল আর আমড়া জঙ্গলের ছায়াকে নিবিড় থেকে স্ফটিক করে দিয়ে, মহাশির
আর মাগুর মাছের হাল্কা খেলনার বোঝা নিয়ে চলতে থাকে।
কিন্তু শ্রাবণ ভাদ্র বর্ষা মাসে নদীমাতৃকা পূর্ণ-ঊর্মিজোয়ার-গর্ভিণী, উন্মাদিনী, চন্দ্রাকর্ষে বাউরিনী।
বন্যায় ভাসিয়ে দেয় পূর্ণিয়া, মাধেপুরা, কাটিহার, দ্বারভাঙ্গা, ভাগলপুর।
নীলগাই, বুনো শুয়োর, হরিণ ভয়ে উঁচু টিলায় আশ্রয় খোঁজে।
কুমীররাও আবহাওয়ায় টের পায় আসন্ন বানের আভাস। নদীর পারে তাদের ডিমের প্রসূতিসময় জৈষ্ঠ-আষাঢ় মাস।
যে-বছর বৃষ্টি তাড়াতাড়ি আসে কিছু ডিম অতর্কিতে নষ্ট হয়।
এই বহুরূপা গণ্ডক নদীর গা ঘেঁষে ঘুমন্ত মেয়ের মত শুয়ে আছে ছোট শহর ফুলঝরিয়া।
এর শান্ত পরিবেশকে আটকে রাখতে অন্য পাশে আম লিচু জামের জঙ্গল শহরটাকে চিক-পর্দার মত
আব্রু দিয়ে আছে।
আবার এই মফঃস্বলকে একটা রূপকথা-ঐতিহাসিকতার গল্পময়তা দিতে – এখানে আছে এক অতি
পুরনো রাজবাড়ি।
এখন তার হাতিশালে হাতি নেই। ঘোড়াশালে ঘোড়া নেই, তবে ভাঙাচোরা দেয়ালের পিছনে এখনও
ঐতিহ্য আছে, এককালের প্রতিপত্তির পর্ণমোচীপ্রায় ইঙ্গিত আছে।
এখানে আমার বড় হওয়া।
প্রবাসে থাকলে বাঙালি পরিবারেরা হয়তো তাদের মেয়েদের সম্বন্ধে এক-আধ দাগ আরো সতর্কিত ও
সাবধানী হয়ে যায়।
সেটা চুরি-ডাকাতি শ্লীলতাহানির ভয়, না বাংলা ভাষা, কৃষ্টি হারিয়ে ফেলার ভয়, না বাঙালি পরিবারের
বিয়ে না দিতে পারার ভয় – সেই কৈশোরে তখনও আমি সঠিক বোঝার চেষ্টা করছি।
যে মফস্বলে বড় শহরের মত বেপরোয়া খুনখারাবি ক্রাইম নেই, সেখানে আমাদের বাড়ির এত
নিয়মানুবর্তিতা কেন, সেই নিয়ে আমার কৌতুহল ও ছোটখাটো বিদ্রোহ সবে শুরু হয়েছে।
তখন ও ভাবিনি যে শান্ত পরিবেশও ভোল বদলে নদীর মত অন্যরূপা হয়ে যেতে পারে।
এই রকম এক প্রবাসী পর্দানসীন বাড়ির মেয়ে আমি, হঠাৎ মনে হল যে একটা বহুরাস্তার মোড় আমার সামনে। নিরাপত্তা, আশ্রয়ের দোরগোড়া থেকে নেমে একটা পথ বাছতে হবে। এই জেদের ভুত আমায় চেপে বসেছে।
বাড়ির রক্ষণশীলতার নিয়ম ভেঙ্গে কো-এড মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছি।
মিথিলারাজ মেডিকেল কলেজ।
ফুলঝরিয়া রাজবাড়ির পরে বাইরে থেকে বেড়াতে আসা অতিথিদের জন্যে অন্যতম দ্রষ্টব্য স্থানীয় আকর্ষণ।
ব্রিটিশরাজের পোলো খেলার ময়দান ছিল এক সময়ে শহরের এক প্রান্তে। পাটনার বৃটিশ কনসালের পোলো খেলার
ঘোড়ার ব্যবস্থা করে দিতেন তখন এই মহারাজকুমারের প্রপিতামহ চৌধুরি বজরং বলি নারায়ণ। রাজবাড়ি ও
বৃটিশরাজের অধস্তনে ভাল দহরম মহরম ছিল।
পোলো ময়দানের পাশে ছিল ছোট এক সিপাহী ব্যারাক।
বৃটিশরা চলে গেলে সেই অবশিষ্ট বাস্তুস্থানের উপরেই মেডিকেল কলেজের নির্মাণ – এই রাজবাড়ির তখনও রমরমা
অর্থসাচ্ছল্য ও দাক্ষিণ্যে।
মেডিকেল কলেজের ফার্স্ট ও সেকেন্ড-ইয়ারের পাঠ্য অ্যানাটমি ও ফিজিওলজি।
অ্যানাটমি মানে মড়া কাটা।
এর প্রথম কদিন মানসিক স্থৈর্যের অগ্নিপরীক্ষা।
অ্যানাটমি ডিশেকশন হলে কুড়িটা লম্বাটে টেবিল।
এক একটি টেবিলের চারপাশে আটটি করে ফার্স্টইয়ার মেডিকেল স্টুডেন্ট তিন ঘণ্টা করে দাঁড়ান, ছেলে ও
মেয়ের মিশ্রিত স্তবক, নিচু গলায় গুঞ্জন চলছে।
প্রত্যেকটি টেবিলে নগ্ন মৃত পুরুষ শোয়ানো। কোন নারীমূর্তি নেই।
একটি স্ক্যালপেল এক একটি টেবিলে, পালা করে স্টুডেন্টদের হাতে ঘুরছে। দূরে রাখা চামড়ার বেলটের মত একটি
টুকরোতে স্ক্যালপেল উলটে পালটে শাণ দেওয়ার মত করে টেনে, ধারাল করা হচ্ছে।
--এটাই কি ল্যাটেরাল কিউটেনাস নার্ভ? পাতলা সুতোর মত। কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।
--নাকি এটা ফেমোরাল আর্টারি? সবই তো একরকম দেখতে লাগে প্রথম প্রথম।
মৃতদেহ ও ফর্মালিনের উগ্র গন্ধে আমার মাথা ঝিমঝিম করছে। বমি পাচ্ছে।
অ্যানাটমির ক্লাস নিয়ে হিমশিম খেতে থাকলাম।
আনাড়ি হাতে স্ক্যালপেল দিয়ে পাকানো দড়ির মত পেশী-মাস-স্নায়ু কাটার চেষ্টা করা।
একটা যেন অন্য জগৎ। কিছুতেই পেরে উঠলাম না।
তারপর একটার পর একটা মাসিক অ্যানাটমি টিউটোরিয়াল পরীক্ষায় ফেল করতে থাকলাম।
কিন্তু অন্য স্টুডেন্টরা হোঁচট খেতে খেতেও মোটামুটি পাস মার্কস পেল।
আমার বাড়ির সবাই বেশ অবাক হল আমার এই দুর্গতি দেখে।
সারা জীবন যে পড়াশোনায় ভালো তার কি কারণে এত খারাপ রেজাল্ট হতে পারে – কারো বোধগম্য হল
না।
তবে কারণটা আমি বেশ ভালই বুঝতে পারলাম - আর কেউ বুঝুক আর না বুঝুক।
সন্ধ্যা সাতটার পরে বাড়ির বাইরে থাকার অনুমতি নেই।
হস্টেলে বন্ধুদের সাথে থেকে ওদের স্কেলিটন দেখে তাহলে পড়ব কি করে?
মাথার মধ্যে এসব ব্যর্থ চিন্তা নর্থ-বিহারের লু-এর মত বয়ে যাচ্ছিল।
খুব মনমরা হয়ে পড়লাম প্রথম কয়েকমাস সেই ফার্স্টইয়ারে।
পর পর দুটো অ্যানাটমি টিউটোরিয়াল পরীক্ষায় ফেল করলাম।
হেড-নেক ডিশেকশনে অন্য স্টুডেন্টরা ফেশিয়াল নার্ভের পাঁচটা শাখাপ্রশাখা পরিষ্কার করে কেটে মুর্শিদাবাদের
তাঁতবোনার মত করে গোপাল মিশ্রা স্যারকে দেখাতে পেরেছিল।
আমি পারিনি।
হাতের ডিশেকশন পরীক্ষায় ট্রায়সেপস মাসলের লেজ কনুইয়ের কোথায় কোথায় আটকানো থাকে তার সঠিক
অ্যাটাচমেন্ট্স্ গুলো মুখস্ত বলতে পারিনি।
বেশিরভাগ স্টুডেন্ট বোর্ডিংএ থাকে--হস্টেলে রাত জেগে একসাথে পড়াশুনা করে।
আমি গ্রে’স অ্যানাটমির বইটা শত মুখস্ত করলেও, অস্থিমজ্জার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম গড়নপিটন, পাথুরে টিলার উপর
নদীর স্রোতের রেখাপাতের মত রক্তবাহী শিরা-ধমনীর বড় হাড়ের উপর স্পষ্ট বা অস্পষ্ট দাগ কেটে রাখা--এগুলি
কঙ্কালের গঠনের সাথে বইয়ের ছবি না মেলালেই নয়।
বাবাকে কেঁদে এসে বললাম যে একটা স্কেলিটন কিনতেই হবে।
মা বললেন--বাড়িতে ওসব আনা চলবে না, হস্টেলের মেয়েদের সাথের ওদের ঘরে হাড়গোড় নিয়ে যত খুশি পড়।
বাড়িতে আনার কি দরকার।
মাকে বললাম, বাঃ এদিকে সন্ধে সাতটার মধ্যে বাড়ি না ঢুকলে আমার রক্ষা নেই। হস্টেলে পড়ব কখন?
মা’র এক কথা, --তখনই বলেছিলাম ডাক্তারি না পড়তে দিতে, এখন বোঝো ঠেলা--এই শেষেরটা অবশ্য
বাবাকে উদ্দেশ্য করে।
মেডিকেল কলেজের অ্যাডমিশানের খবর শুনে দিদু বাবাকে বলেছিলেন--আ আমার পোড়া কপাল, খোকা, তুই এডা কেমনে করলি? অখন মাইয়ার বিইয়ার লইগ্যা আতান্তরে পইড়বা। ডাক্তার চাকুরে মাইয়া, পুরুষেরও ঘারে হাগে--কুন ভাল বংশে ইসব রে ঘরের বৌ কইরা আনবে, বল দেখি?
বাড়িতে অনেক তর্কবিতর্ক, ভুখ-হরতালের গোঁ, চুলে রোজ চপচপ করে ডাবর আমলা তেল মাখার প্রতিশ্রুতি ইত্যাদির পরে মাকে রাজি করানো গেল এই বাড়িতে পড়ার খাতিরে মানুষের ফুল অ্যানাটমিকাল স্কেলিটন ঢোকাতে।
এটা একটা পাটলিপুত্রে দাসীপুত্র চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের অসম্ভব যুদ্ধজয়ের মতই। যে-বাড়িতে মুর্গি, ডিম, পাঁঠার মাংস--কিছুই ঢোকেনা, ভালপিসি দিনে সাতবার চান করেন, ভাত-খাওয়া হাতে জলের গেলাশ ধরা যাদের খাবার-টেবিলে বারণ--সে-বাড়িতে একদিন জুটের ঝোলায় ভরে ট্যাক্সি করে বাবা ও আমি এই কঙ্কাল এনে ঢোকালাম।
উত্তেজনায় ভাবলাম আর কাউকে না-হোক বৌদিকে দেখাই। বৌদি খুব মাইডিয়ার। চোখ টিপে হাসতে ভালবাসে,
পায়ের নখে খুনখারাবি লাল নেলপালিশ লাগায় আলতার বদলে। হিন্দী সুরে বাংলা বলে আর তার জন্যে দাদা
ক্ষ্যাপালে একদম দমে না। রান্নাঘরে গিয়ে দেখি মা আর বৌদি মকর সংক্রান্তির জন্যে রসপুলি বানাচ্ছেন।
বললাম, ‘বৌদি, একটা জিনিস দেখবে এসো--
মা বললেন--‘বৌদিকে এখন বিরক্ত করিস না তো, অনেক কাজ আছে।’
আসলে মেঝেতে পা ছড়িয়ে মায়াদাই ওদের পোঙ্গলের তিল-গুড়ের নাড়ু বানাচ্ছে, আর শহরের যাবতীয় কেচ্ছা
গুজব রোমহর্ষক খবর শোনাচ্ছে। মা’র তখন এই যাত্রাভঙ্গে ভীষণ আপত্তি। বৌদিরও বলিহারি--ছয় মাস
অন্তঃসত্ত্বা, মুখে ম্যাডোনা ম্যাডোনা ভাব আসছে, এখন কোথায় শুদ্ধ-সাত্ত্বিক কথা শুনবে, তা না সব বদ গল্প গিলছে।
আমিও অবশ্য আর নড়লাম না।
মায়াদাইয়ের গেজেটে শহরের খবর গতমাসে গীতারানী সেলাইস্কুলের পাশে সুখিয়া তালাবের একটা মেয়ের বডি
পাওয়া গেছে। পায়ে লোহা বাঁধা যাতে ভেসে না ওঠে, গলায় দড়ি বাঁধা, আরা সারা দেহে নাকি পোড়া দাগ।
জেলেরা জানতেও পারতোনা--ওইখানে মাছেরা বুড়বুড়ি কেটে চক্কর দিচ্ছিল কদিন ধরে। জেলেদের সন্দেহ
হওয়াতে ওরা ডুবসাঁতার কেটে তুলে নিয়ে আসে। এর পরের ব্যাপার নাকি আরও ঘনীভূত। পুলিশ অনুসন্ধানী
চলছিল, কিন্তু করোনার চিড়ফাড় করে সব কিছু জানার আগেই তার আগেরদিন রাত্রে পুলিশের মর্গ থেকে বডি
হাপিশ।
মা ও বৌদির চোখ বড় বড়। --পুলিশ হেপাজতিসে এইসে কেইসে হো সকতা হ্যায়?
মায়াদাই এসব অভ্যন্তরীন খবর পেয়েছে কারণ তার বহনোই লখিন্দরওয়া ফরেনসিক আটপসি ডিপার্টমেন্টে
মেথরের কাজ করে।
ফুলঝরিয়ার মত নিরীহ শিষ্টতার পীঠস্থানে গত দুই তিন বছরে অনেক বিবর্তন ঘটেছে। গ্রামভাবের স্বস্তিময়তা আর
নেই।
এর পরে আরো আছে, গল্প চলল। দুই বছর আগে গণ্ডক নদী যেখানে কোসি থেকে ভাগ হয়েছে সেই ভীমনগর বাঁধের কাছে এইরকমই একটা বডি পাওয়া গিয়েছিল। আরেকটি বীস পচ্ছিস বছরের মেয়েকে ওভাবে গুমখুন করে ফেলে দিয়ে ছিল কে। সেই মেয়েটির পেটে বাচ্চা ছিল, গলায় দড়িবাঁধা, সারা গায়ে ছুরির আঘাত, একটা হাত ভাঙ্গা, কোমরে নাকি একটা অদ্ভুত আঘাত ছিল--তির বা বল্লম দিয়ে মারা ছুঁচলো দাগ, অনেক গভীর, হাড়ে গেঁথে ছিল। যে বা যারা মেরেছিল তারা ভেবেছিল যে নদীর জলে যেখানে স্রোত বেশি সেখানে ফেললে, বডি তোড়ে ভেসে ধুয়ে চলে যাবে। কিন্তু কি ভাগ্য--বডি ভাসতে ভাসতে বাঁধের পিলারে এসে লটকে যায়। দুটো ছৌকরা ঘড়িয়ালের অণ্ডা নদীর কিনারে চুরি করতে এসে লড়কির সাড়ির আঁচল লতপত করছে জলে দেখতে পায়। ওরা গাঁও-ওয়ালেদের খবর করলে ওরা পুলিশ ডাকে। পুলিশ-তল্লাশি জানল কি লড়কি ওখানকার নহি--এত্তো দুরের ফুলঝরিয়ার। ওর নাম চম্পা, ওর বাবা মা গরীব দুসাদ--কওনো নৌকরি টৌকরি নেই, কে ওদের কেস করতে পয়সা দেবে।
মায়াদাই নিঃশ্বাস ফেলতে থামল।
ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর মৃত্যু দুটোই। বল্লম জাতীয় অস্ত্র এই খুনে জড়িত থাকাতে--বৈদেহ রাজবাড়ির দুই রাজকুমারদের
সন্দেহ করা হয়েছিল, কারণ তারা নানান অস্ত্র হাতিয়ার যুদ্ধে পারদর্শী, নারী-সংক্রান্ত দোষও তাদের বিরল নয়।
তবে সেই সময়ই অটপসি রুম থেকে রাতারাতি বডি উধাও হয়ে যায়, আর মেয়েটির গরীব বাবা মা আর কুল
কিনারা পায়না এর কোন হেস্তনেস্ত করতে।
দুটো কেসের একরকম প্রায় আঘাত, দুটো কেসেরই একরকমের প্রায় রাহাজানি।
এই খবরের গুঞ্জন অবশ্য আমরা শুনেছিলাম, তবে বৌদির বিয়ের আগে বলে বৌদি শোনেনি।
মা তাড়াতাড়ি বললেন--যাও, যাও কমলপ্রিয়া, রুসি কি দেখাবে দেখে এসো।
আমার ঘরে এসে বৌদি কঙ্কালকে দেখল। মায়াদাইয়ের গল্প শুনে একটু অন্যমনস্ক ছিল যেন। -
--চার্লি চ্যাপলিনের মত নড়বড় করছে, বলে একটু হাসলো বৌদি।
পাশের আয়নায় নিজের ছায়ায় পাছে ভূতনাথের ছায়া দেখে একটু যেন চমকে গেল।
--খুব ছোটখাট ভদ্রলোক তো--আমারই সাইজ। বলে আরেকটু উঁকি মেরে দেখল।
তারপরে বলল--আয়নাটা রাখিস না এভাবে, মিস রুশতি!
ডোম বলেছিল এটা একটা ছোট রোগা লোকের কঙ্কাল। বেশি লম্বা নয়।
কঙ্কালকে এখন বিছানায় নামিয়ে পড়াশোনা করি।
হস্টেলের স্টুডেন্টরা যেমন অহোরাত্রি হাড়গোড় নিয়ে খাবার টেবিলে, পূজোর জায়গার পাশে, বিছানায়, বইয়ের
স্তূপের উপরে--সর্বত্র নিয়ে শুয়ে বসে পাগলের মত মুখস্ত করছে। স্মৃতিশক্তির এক চরম পরীক্ষা।
এই জ্ঞান লাগবে সমস্ত সার্জারিতে, রেডিওলজির ডায়াগনসিস করতে, নৃতত্ত্বে, আনথ্রপলজিকাল ফরেনসিকসে,
পুলিশ কেসে সনাক্ত করতে--তখন সবই ইন্টারেস্টিং, চমৎকারি। কিন্তু এখন--এখন ভীষণ বোরিং ধারাপাতহীন,
ছন্দহীন, আদি অন্তহীন মুখস্ত।
পরের দিন পেলভিক ক্যাভিটির পরীক্ষা।
রাত্রে পড়তে গিয়ে দেখি বালিশে রাখা সেক্রো-ইলিয়াক পেলভিক বোনের একটা পাশ দিয়ে কালো পিঁপড়ের এক
সারি আসছে যাচ্ছে।
কৌতুহল হল।
বেসিনের মত এই অংশটাকে উলটেপালটে দেখলাম। দুটি বড় পানপাতার মত পিছনের দুটি ইলিয়াক বোন।
বন্ধ দরোজার পাল্লার মত শিরদাঁড়ার নিচের শূলদণ্ডের মত হাড় দুটির সাথে যুক্ত--সেক্রাম ও গলদা চিংড়ির
লেজের মত শেষার্ধ কক্সিক্স।
দেখলাম বাঁ দিকের ইলিয়াক হাড়ে র উপরের কানাত থেকে সামান্য নিচে--একটি ক্ষুদ্র গর্ত--তার মধ্যে থেকে
পিঁপড়ের মিছিল যাতায়াত করছে।
হাসি পেল। সারাদিন ঘর খালি পড়ে থাকে--তাই এদের নিরবচ্ছিন্ন রাজত্ব।
একদানা চিনি বা গুড়ের কণা উঠোনের পাশের রান্নাঘর থেকে টেনে এনে বাসা বেঁধেছিল এরা। ভেবে ছিল আস্তানা। একটা ছোট তোয়ালি দিয়ে ওদের বাইরে ঝেড়ে ফেলে আসলাম।
আজ মায়া মমতার কোন অবকাশ নেই। আজ আমায় পড়তে হবে।
পড়তে গিয়ে একটু খটকা লাগল। আমার হাতে ধরা এই পেলভিসের গঠনের সাথে বইয়ের পুরুষ পেলভিসের কমই মিল। এর আন্টেরো পস্টিরিয়ার ডায়ামিটার বনাম সাইড টু সাইড ডায়ামিটার তুলনামুলক ভাবে যথেষ্ট বেশি যেটা মেয়েদের ক্ষেত্রেই হয় সন্তান ধারণের জন্যে। তবে যে কালুয়াডোম বলেছিল এটা একটা পুরুষের কঙ্কাল--ছোটখাটো চেহারার। অবশ্য তারই মধ্যে কি আর ব্যতিক্রম হয় না?
আর একটু ভাবলাম। স্যারদের জিজ্ঞেস করতে হবে--এরকম অ্যানাটমিকাল ব্যতিক্রম কতটা দেখা যায়? নাকি
এটা মায়ের কঙ্কাল--ডোম ভুল করে ছেলে বলেছে?
আর একটু উলটেপালটে দেখলাম। যত দেখলাম তত আমার মনে হতে লাগল এটা নির্ঘাত একটি মেয়ের
পেলভিস। আন্টেরোপস্টিরিয়ার ডায়ামিটারটা তুলনামূলকভাবে এতটা চওড়া ও পেলভিসের বেসিনটা এত
গভীর যে একটি মেয়ের না হলে হত না।
ভূতনাথের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললাম,--তোর আবার নতুন নামকরণ হল--ভূতনি।
ভূতনির মাথাটা আলনার খুঁটে বাঁধা লটরপটর করে ঝুলে ছিল। দেরাজের মত আধা বের-করা চোয়ালে কায়েমী
দন্তহীন হাসি দিয়ে যেন সে আমার এই মেডিকেল গোয়েন্দাগিরি স্বীকার করে নিল। ওর পেলভিসটা আমি বালিশে
পেডেস্টালের মত বসিয়ে বইয়ের সাথে মিলিয়ে মিলিয়ে পড়তে থাকলাম।
পরের দিন দেখি আবার সেই পিঁপড়েদের প্যারেড। এবার বড়বড় ডেঁয়ো কালো পিঁপড়ে। আরও বড় খাবারের টুকরো টানা হ্যাঁচড়া করে কংকালের পেলভিস-এর গর্তটার মধ্যে নিয়ে যাচ্ছে। পাশের পড়শিনির বহেনজির বানানো নানখাটাইয়ের টুকরো মনে হল। আমার বিছানা ও বালিশের উপর দিয়ে লাইন দিয়ে চলেছে, যেন মরু উপত্যকার কোনো লিলিপুট উটের কারাভান।
আনাগোনার গর্ন্তব্যস্থলটা ভাল করে লক্ষ করলাম। গর্তটা ঠিক স্বাভাবিক বেকায়দায় চলতে খাওয়া হাল্কা ফুটো নয়। বেশ গভীর একটা গুহার মত গর্ত। একটা জ্যামিতিক ত্রিকোণের মত। পাশগুলো ধারালো, সরু মুখটা নিচের দিকে, যেন একটা ফলক ছিল পোঁতা কখনও, কেউ তুলে নিয়েছে।
যাই হোক, গ্লুটিয়াস ম্যাক্সিমাস মাসলের কোমরের হাড়ের সাথে এক অক্ষৌহিনি অ্যাটাচমেন্ট গুলো মুখস্থ করতে করতে আমার ঘুম এসে গেল।
ছোট শহরে আর আম্বুলেন্স কোথায়, কোন রকমে ধরাধরি করে একটা নেয়ারের খাটে তুলে ডাঃ মেনকা মিত্রের
নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়া হল। প্রজেস্টেরন ড্রিপ দিয়ে ইউটেরেস-এর স্প্যাজম বন্ধ করা হল, তবে এক্সরেতে দেখা গেল যে বাঁদিকের পেলভিসে উপরের দিকে ফ্র্যাকচার।
--একটু আনিউজুয়াল জায়গা, ডাঃ মিত্র মাথা নাড়লেন।--হিপটাই সাধারণত চোটটা খায়।
যাইহোক ব্যথার ওষুধের ঘোরে প্রায়-অজ্ঞান বৌদিকে বাড়ি নিয়ে আসা হল।
মা আর দিদু তো মর্মাহত। এত বাড়িতে দোয়ানো দুধ, মদনবাবুর গাওয়া ঘী বৌকে খাওয়ানো হচ্ছে--তার এত সহজে এত খারাপ ভাবে হাড় ভাঙ্গল কি করে? এখন বেয়াই দের কি বলা হবে?
বৌদি বেড-রেস্ট-এ রইল।
মায়াদাই এখন রাতদিন বৌদির তদারকে থাকে।
মা নিজে হাতে রোজ খাইয়ে দিয়ে যান। বসুমতি চুল আঁচড়ে দেয়। দিদু দুইবার করে পুজোর ফুলের আশির্বাদি
বৌদির বুকের ব্লাঊজে গুঁজে দিয়ে যান। দাদু হাঁপানি সত্বেও দুইবার করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে দেখে যান। বাবা
পাশের আরামকেদারায় বসে রেডিওতে সন্ধের গানের আসরগুলো শোনেন বৌদির সাথে। দাদা বাবার সামনে
ঠিক জুত করে বৌদির পাশে বসতে পারেনা বলে ঘর বার করে। বৌদি এত আদরে ব্যথাট্যথা ভুলে বাপের বাড়ি
যাওয়ার একবার নামও করে না।
এবার বৌদিকে মেডিকেল কলেজের ইমার্জেনসিতে নিয়ে যাওয়া হল। কি কষ্টে যে বৌদিকে তার ভাঙা হাত, ভাঙা কোমর, পেটে বাচ্চা নিয়ে বাবার ছোট মরিসগাড়িতে চড়ান হল--সেটা যারা ধরে চড়াচ্ছে তাদের করুণ ও ত্রস্ত মুখাবয়ব দেখে ও সেটাকে আরো হাজারখানেক দিয়ে গুণ করে আন্দাজ করতে পারছিলাম--বৌদির নিজের আরো কত দুঃসহ ব্যথা ও দুশ্চিন্তা সহ্য করতে হচ্ছে।
মা বৌদিকে বুকে জড়িয়ে বালিশ বালাপোশ দাদুর মাফলার দিদুর গরম আলোয়ান, মা’র নিজের প্রিয় পশমের শাল--সব দিয়ে ঢেকে একটু আরাম দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। আর দাদার গাড়ি চালানোতে মফস্বলের সেই বাতিহীন পীচ-না-দেওয়া রোড়া বিছানো রাস্তায় গাড়ির সামান্য ঝাঁকুনি হলেই বকে ভূত করে দিচ্ছিলেন। ‘ভূত’ কথাটা মাথায় আসতেই সেটা তাড়াতাড়ি অন্য দিকে বিতাড়িত করলাম। এসব আজেবাজে চিন্তার—
তিন ঘণ্টা ধরে সার্জারি হল বৌদির। সেই রাত্রেই। অর্থপেডিক ডাঃ কপিলদেও প্রসাদকে জরুরি কল দিয়ে সেই রাত্রে ডবল ভিজিট দিয়ে আনা হল। তাঁর সবচেয়ে ভাল হাত।
খুব খারাপ কম্পাউন্ড ফ্র্যাকচার ডান হাতের দুটো হাড়েরই, সার্জিকালি রিডিউস করতে হল। অ্যানিস্থিসিয়ার ডাক্তার দূরের বলভদ্রপুরে থাকেন। তার আসতে দেরি দেখে আমার হাতেই ইথারের শিশি ও মাস্ক ধরিয়ে দিলেন সার্জেন। মা’র কষ্টে বেবীর হার্টরেট বেড়ে যাচ্ছে, এক্ষুনি ফিটাল ডিস্ট্রেস শুরু হয়ে গেলে কেলেঙ্কারি--এক মিনিট সময় নষ্ট করা চলবে না।
বৌদির মুখে মাস্কের গজে একটু একটু করে ইথার ঢালছি আর যে যে পরিচিত দেবদেবীর যা যা অল্পস্বল্প মন্ত্র জানি সব অর্ধস্ফূটে বলে যাচ্ছি। আমার হাত কাঁপতে দিয়োনা, ঠাকুর, বেশি ইথার পড়ে বৌদির পিউপিল না ডায়ালেটেড হতে থাকে আমারই হাতে। বিনা কারণে অনেক কষ্ট পাচ্ছে বৌদি, ঠাকুর--কি যে অমঙ্গল যাচ্ছে-- সার্জারির শেষে লাইফবয় সাবান দিয়ে সিঙ্কে হাত ধুতে ধুতে ডাঃ প্রসাদ একটু যেন সন্দিগ্ধ সুরে বললেন-- বহুত তাজ্জব কি বাত, ঘরমেঁ বৈঠ বৈঠ্কে এয়সা টুটনা কৈসে হুয়া। লাগা কি লাঠি সে মারনে পে যৈসা হড্ডি চুরচুর হো যাতা হ্যায়, ঐসা বিলকুল। রায়ট কে সময় জোরদার হাতিয়ার মারনে সে ভি ইতনা খারাব কম্পাউন্ড ফ্র্যাকচার নঁহি দেখে--
বাবা এই শহরে সাধুব্যক্তি বলে স্বনামধন্য, তবে তার ছেলে-বৌকে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে হাত ভেঙেছে কিনা--এটা সম্বন্ধে ডাঃ প্রসাদের মনে একটা প্রশ্ন ঢুকেছে মনে হল। আমি এই মেডিকেল কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রী, আমি হয়তো তাই ফেলনা নই, কিন্তু আমার দাদা?--প্রশ্নসূচকভাবে আমার দিকে তাকালেন উনি।
আমরা তড়িঘড়ি করে ওনাকে হিন্দি ভোজপুরি মৈথিলি মিশিয়ে বোঝাতে গেলাম যে--বৌদির ব্যাপারটা আমাদের কাছেও অবোধ্য, কি করে এরকমভাবে কোমর ও হাত ভাঙল, অথচ বৌদিকে সবাই এ-বাড়িতে মাথায় করে রাখে, প্রেগনেন্ট হবার পর থেকে তা আরো আরো তোলা তোলা করে রাখা হয়। আমার বড়ে ভাইও খুব হোনেহার লড়কা, সিন্ধ্রির মাইকা মাইনসের মেটালার্জিস্ট, রাঁচির ইনস্টিটিউট থাকে পাশ করেছে, কষ্ট করে বাসে এসে মাসে মাসে বাবা মা দাদু দিদু বৌকে দেখে যায়।
যাইহোক, ওয়েটিং রুমে বেরিয়ে দাদাকে আপাদমস্তক দেখে হয়তো ওনার ভরসা হল। উনি বাবাকে বললেন যে
বৌদি এখন দুদিন ওয়ার্ডে অবসার্ভেশনে থাকবে। তার ও তার ভূমিষ্ট না-হওয়া শিশুর সুরক্ষার জন্য। ‘সুরক্ষা’
কথাটা আমার ঠিক পছন্দ হলনা--তবে হাত প্লাস্টার করা অজ্ঞান হওয়া ক্লিষ্ট মুখের বৌদিকে দুজন শাদা টুপি
শাদা জুতো পরা নার্স গার্ড দিয়ে ইন্টেন্সিভ কেয়ারে নিয়ে চলল।
সব মিলিয়ে কয়েকটা অদ্ভুত দুশ্চিন্তা ও অনিশ্চয়তার কালো ডানা মেলা চিল যেন চুলবুলিয়াপট্টির কসাইখানার
বাসি মাংস ও রক্তের গন্ধ ছেড়ে আমাদের সংসারের উপর চক্কর দিতে লাগল আগত কোনো দুর্ঘটনার পূর্বাভাসের
মত।
দাদু চিন্তায় ও বৃদ্ধবয়সের অর্ধবিস্মরণে বারবার একই কথা জিজ্ঞেস করতে রইলেন যশোরের বিশেষ ভাষ্যে--কি হল কি কমল ছেমরির? গেল কোথায়? ওরে কি খাতি দিবে সেহানে?
দিদু তার সেনহাটির বাঙাল বার্তায় সমান তালে দাদুকে বকে গেলেন--এক কথা কতবার জিগাইবা? কইছি না বৌরে হাসপাতালে ভর্তি করাইয়া আনছে ওরা। শরীরডা যুত নাই তার, এ-সময়ে আল্পতেই সাবধান হওনের লাইগ্যা ডাক্তার কইছে। তোমার এত চিন্তার কুনো কাম নাই। যাও, যাও--শুইয়া পড়।
অবশ্য মা’র বার বার আঁচলে চোখ মোছা, দিদুর থমথমে মুখ, দাদার উন্মনা পায়চারি দেখে দাদু যে আশ্বস্ত হবেন তার কোনো উপায় নেই।
মা আবার অত রাত্রে শিবজিকে দিকে চেনা-মুদির দোকান খুলিয়ে আড়াই কিলো ছাতু, পাঁচ কিলো বড় শাদা গোটা মাখনা আনালেন। তাছাড়া সুইট হোম সকালে খুললেই গরম ভাজা বেসনের জলেবি। কাল সকালেই ভেট যাবে ডাঃ কপিলদেও প্রসাদের বাড়ি, আমাদের বাড়ির বৌকে যত্ন করে দেখেছেন--তার কৃতজ্ঞতায়। আর যেন আরো অধিক দেখভাল করে বৌদিকে সম্পূর্ণ ও শীঘ্র সারিয়ে তোলেন--এই অনুচ্চারিত আপিলে।
যাই হোক, দুদিন খুব খারাপ কাটল। বৌদি হসপিটাল থেকে বাড়ি ফিরল, ডান হাতে বর্মের মত পুরু শাদা
প্লাস্টার। মুখটা ফোলা ফোলা--বাচ্চা হওয়ার জন্যে হরমোনের চাপানউতোর তো আছেই। তার উপরে
ইন্ট্রাভিনাস ফ্লুয়িড স্যালাইন পড়েছে, ব্যথার ওষুধ, স্টেরওয়েড ইত্যাদি। দৃষ্টিটা কাতর।
কি গো বোন ভাই, কি অবস্থা তোমার?--একট্ট করুণ হেসে জিজ্ঞেস করল আমি যখন ওকে বাড়ির একটা নরম
সুতির গাউন পরিয়ে দিচ্ছিলাম।--এমন চিন্তিত মুখ করে আছ কেন?
বলে একটা হিন্দি সিনেমার লাইন ভাঙা গলায় গাইল,--তুমনে মুঝকো হসনা সিখায়া, রোনে কহগে তো রো লেঙ্গে--। কোন সিনেমার গান, বল তো বোনভাই।
এটা আমাদের অন্তরাকছি খেলার মধুর খুনসুটি ছিল। ওর এত কষ্টের মধ্যেও বৌদি আমায় হাসাবার চেষ্টা করছে। মুখ ঘুরিয়ে বললাম--‘জংলি।’
অনেক পরে বৌদিকে গলাগলা সেদ্ধ ভাত গরাসে গরাসে খাইয়ে, মার বানানো দৈনিক বরাদ্দ ফুটানো দুধে সাগু আর আঁথি গুড়--বাচ্চার জন্যে ভাল দুধ হবে বলে--সেটাও খাইয়ে, বিছানায় বসিয়েই মুখ হাত ধুইয়ে, ওর মুখে বোরোলিন ক্রিম লাগিয়ে শুইয়ে আসলাম। মায়াদাই মেঝেতে খেস পেতে হনুমান চালিসা থেকে গুণগুণ করে লাইন ভাঁজতে লাগল। মা ঠাকুরঘর থেকে লক্ষ্মীর প্রদীপ একটা খুব বড় সলতে ডুবো ঘীতে ভাসিয়ে জ্বালিয়ে টেবিলে রেখে গেলেন।
ঠাকুরমার ঝুলির গল্পের সেই সুরেলা অথচ ভয়ের লাইন বুকের মধ্যে কেন যেন ধক, করে বেজে উঠল।
--লালকমলের আগে নীলকমল জাগে, আর জাগে তলোয়ার।
কেন জানি মনে হল দাদুর তিলের তেল পালিশ-করা গিঁঠ দেওয়া পাকানো বাঁশের লাঠিটা ওই ঘরে মায়াদাই নিয়ে শুলে যেন ভাল করত। তবে এই চিন্তার কোন যুক্তি নেই বলে আমি মুখে আর কিছু বললাম না।
অন্যমনস্কভাবে আমি পড়ার ঘরে গেলাম। পড়তে বসতে ইচ্ছা করছিল না। নানান চিন্তার টুকরো মাথার মধ্যে শুকনো পাতার মত খশ খশ করে উড়ে বেড়াচ্ছিল।
রাত প্রায় দশটা তখন। আসছে কাল অ্যানাটমির আরেকটা পরীক্ষা। শহরে লোডশেডিং সেদিন। মশা তাড়াতে রোজকার মত ছোট ধুনুচিতে নারকেল ছোবড়া আর কর্পূরের ধুঁয়ো জ্বালানির সাথে শিবজি আজ একটা হ্যারিকেন জ্বালিয়ে রেখে গেছে।
হঠাৎ কি মনে হতে ভূতনির কাছে হ্যারিকেনটা নিয়ে গিয়ে দেখলাম।
ডান হাত। উপর বাহুর লম্বা হাড় হিউমারেস। কাঁধ থেকে কনুই অবধি। এর ওপরের বায়সেপস পেশি ফুলিয়ে পাড়ার মুগুরভাঁজা মোটরসাইকেল চড়া মাস্তানরা চরাবড়া করে। আমাদের ব্লাউজ বানাবার সময় জামার হাতা কাঁধ থেকে এই হাড়-এর মাঝামাঝি অবধি পুট মাপ নেয় দর্জি গগনকাকা। শ্রীরামচন্দ্রের এই হাড়টি নাকি সাধারণ মানুষদের থেকে লম্বায় বেশি ছিল, তাই বর্নণায়--আজানুলম্বিত বাহু।
এসব নানা গৌরচন্দ্রিকা চিন্তা করতে করতে ধীরে হাড় নিরীক্ষণ করলাম। যে অযৌক্তিক ভয় মনের মধ্যে কাজ করছিল--তাকে অহেতুক প্রশ্রয় না দেবার চেষ্টায় এই অন্য চিন্তাগুলোকে দেয়াল করে দাঁড় করাচ্ছি।
নাঃ হিউমেরাস ঠিক আছে। একদম পোক্ত। ছেদবিভক্তি, তোবড়ানো ভাঙাচোরা--কোনো খুঁত নেই।
হাতের নিচের অংশের দুটি হাড়। রেডিয়াস ও আলনা। পাশাপাশি ঝুলে থাকে কনুই থেকে কব্জি অব্দি। চিমটের দুই
ডাঁটির মত। মাঝখানে একটু ফাঁক। উপরের হাড়ের মত অতটা শক্তিশালী নয়। তবে ক্ষিপ্রতা, বেগ উপর ও
নিচের জয়েন্ট ঘোরানোর সুবিধা করে দেওয়া, অনেক কাজ এই দুই অস্থির।
দুই হাড়ের পাশাপাশি বিছানোতে একটা পাটিভাব নিহিত। তাতে জীবতকালে শুয়ে থাকে সেই হাড়েরই নামে
নামাঙ্কিত দুটি মাঝারি মোটা নার্ভ--পুঁইশাকের ডাঁটার লতাগুল্মের মত। তাতে সুতোর মত বিস্তর প্রশাখা। তারই
মধ্যে বয়ে চলেছে শোণ ও গণ্ডকের মত দুটি নদী, রক্তবাহী শিরা--রেডিয়াল ও আলনার আর্টারি। শরীরের
সবচেয়ে বড় ও প্রধান নার্ভ বা শিরা না হলেও--এদের উপযোগিতা অনন্য।
আলোটা কব্জির কাছাকাছি আনতেই আমার হাত কেঁপে গেল। কব্জি থেকে ঠিক ইঞ্চি দেড়েক মত উপরে রেডিয়াস
হাড়ের উপরে বোঝা যাচ্ছে ফ্র্যাকচার লাইন। সাধারণ সরল রেখা নয়। কোন ছোট বাচ্চার অপক্ক হাতের আঁকা
পাহাড় পর্বতের মত ওঠানামা করতে করতে লাইনটা গেছে। সেই লাইনকে বিভক্ত করে আরো দুই তিনটি ছোট
লাইন। অর্থাৎ সিম্পল নয়, কম্পাউন্ড ফ্র্যাকচার। হাড় এবড়ো খেবড়ো ভাবে বেকায়দায় ভেঙেছে।
পাশের আলনার হাড়ের উপরেও ওইরকম ফ্র্যাকচারের দাগ। ওই সমান্তরালে। সাধারণতঃ পড়ে গেলে মানুষের
রেডিয়াস বোনই ভাঙে ওই অংশে। সেকেন্ড ইয়ার পরীক্ষার নামকরা প্রশ্ন--কোলেস, ফ্র্যাকচার। কিন্তু এক্ষেত্রে দুটো
হাড় ভেঙেছে। অর্থাৎ খুব বড় ধরনের আঘাত বা দুর্ঘটনা।
হয়তো পরে জোড়া লেগেছে, কিন্তু বড় কষ্ট পেয়েছে ভূতনি।
কিন্তু যে কারণে আমি লন্ঠন নিয়ে ভূতনির ডানহাতের খুঁটিনাটি দেখছি।
ঠিক এই ফ্র্যাকচার হয়েছে বৌদির। সেই একই হাত--ডান হাত। রেডিয়াস, আলনা--দুটো হাড়ের সেই একভাবে
ভাঙা। এক্স-রেতে বৌদির ভাঙা হাতের এক ছবি। পর্বতশৃঙ্গের সিলুয়েট।
এতটা কাকতালীয় কি করে হয়? এর মানে কি?
যবে থেকে কঙ্কাল বাড়িতে এসেছে--কি একটা দুর্ঘটনা পরম্পরা বাড়িতে চলছে। এরকম কথা তো মা বা দিদু বলতে পারেন। কিন্তু এমন কথা আমি ভাবছি কেন? আর শুধু বৌদির শরীরের উপর পরপর এই দুর্যোগ চলছে কেন? কী যোগ বৌদির সাথে এই কঙ্কালের?
কার কঙ্কাল এটি? কি এর পরিচয়?
বসুমতির দুই খরগোশ হুটোপাটি করে বাগানের সব পেঁয়াজকলি রশুনকলি মুড়িয়ে খেয়ে যাচ্ছে। বাবা বাড়ির সাতটা কুকুরকে মার পোষা মুর্গির খোঁয়াড়ের কাছে নিয়ে গিয়ে পাখিদের প্রতি বন্ধুবৎসল্যতা ও প্রেমময়তা শেখাচ্ছেন।
যেন কণ্ব মুনির আশ্রম।
এমন জীবপ্রেমী বাড়িতে একটা মৃত কঙ্কাল ঢোকানোটা আমার ভুল হয়েছিল। সাধে কি মার অত আপত্তি ছিল? কিন্তু এই কঙ্কাল কি সত্যিই মৃত। নাকি ওর একটা নিজস্ব অস্তিত্ব এখনও আছে যা নাকি কিছু ইঙ্গিত করছে--বৌদিকে এই কষ্ট দিয়ে?
আমার চিন্তার খেইহীন খড়বিচালিগুলি উদাম হয়ে এদিক ওদিক উড়তে লাগল।
থরাক্স ডিশেকশনের ভাইভা পরীক্ষায় খুব খারাপ করে বাড়ি ফিরলাম। অ্যানাটমির হেড ওব দ্য ডিপার্টমেন্ট, ডাঃ বৈজু শরণ একটু চিন্তিত হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। বোয়ামে ফর্মালিনে চোবানো হৃৎপিণ্ডের প্রধান ধমনী ভিনা কাভা চিনতে পারছিলাম না। একটা কাঠি দিয়ে উনি বারবার ইঙ্গিত করা সত্ত্বেও।
অন্য কথায় আমার মন উদভ্রান্ত হয়েছিল।
বাড়িতে এসে দেখি রান্না ঘরে মায়দাই তাওয়ায় খুব ঝাল দিয়ে ছাতুর লিট্টি বানাচ্ছে। আমাকে পিড়িতে বসতে দেখে আমাকে গরম গরম বেড়ে দিতে গেল। কিন্তু আমার ক্ষিদে ছিল না।
জিজ্ঞেস করলাম, মা কোথায়?
একটু ইতস্তত করে বলল, মা শুয়ে আছেন, সবেরে সে--
--কেন? মিগ্রেন নাকি?
মা’র মাঝে মাঝে আধকপালি ব্যথা হয়। সারাদিন ঘর অন্ধকার করে শুয়ে থাকতে হয়।
মায়াদাই বলল, --না
--তবে?
--সকালে উঠে দেখলেন গেহমান সাপ মুর্গির ঝুপড়িতে এসে বীরবলকে মেরে দিয়েছে--
চমকে উঠলাম। মার প্রাণপ্রিয় জীবজন্তুরা, মা তাদের সন্তানের মত করে যত্ন করেন।
নয়টা মুর্গির মধ্যে একমাত্র মোরগ বীরবল। উদ্ধত সম্রাটের উষ্ণীষ মত ঝুঁটি উচিয়ে, উদশঙ্করের মত নাচিয়ের
পা ফেলে ফেলে হেঁটে ছিল গতকাল অবধি।
শক্ত তারের সূক্ষ্ম নেটি-দিয়ে ঢাকা মুর্গির খাঁচা, গোখরো সাপ ঢুকলই বা কি করে!
মাকে হরলিক্স আর আধখানা ক্রসিন খাইয়ে কিছুক্ষণ পাশে বসে রইলাম। একটা না-বোঝা কারণে আমার কেমন অপরাধবোধ হতে লাগল। যেন বীরবলের অকালমৃত্যুর জন্যে আমি দায়ী। মা কিছু বললেন না, হাতটা ধরে রইলেন।
মা ঘুমিয়ে পড়লে নিচে রান্নাঘরে আবার মায়াদাইয়ের কাছে গেলাম।
মৈথিলিতে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, তালাবে ডোবা যে-দুটি মেয়ের কথা তুমি বলেছিলে, তারা কারা? তারা কি এই মোলাকার মেয়ে ছিল?
মায়া বলল, হ্যাঁ এই দুটি মেয়ে স্থানীয় দুসাদ জাতের মেয়ে। খুব গরীব।
ফুলঝরিয়ার রাজবাড়ির বড় মহারাজ অসুস্থ ও নিঃসন্তান। তার দুই পিতৃহারা ভাইপো, রঘুনন্দন ও শিউনন্দন তার কাছেই বড় হয়েছে--কিন্তু মানুষ হয়নি। হরিণ ও বরাহ শিকার চর্চায়, লাঠিখেলা, তরোয়াল খেলাতে তাদের কৈশোর কাটে। রাজবাড়িতে বৈঠকখানায় নানা অস্ত্র সাজানো, ও শিকার-করা পশুমুণ্ড দেওয়ালে টাঙ্গানো। পড়াশুনা বিশেষ হয়নি দুই ভাইয়ের। কিন্তু এরপর মদ্যপান, নারীদেহ ভোগ রাজবাড়িতে চলতে থাকে। দূরের গ্রাম থেকে এমনকি নেপাল থেকেও নারী পাচার করে আনা হয় তাদের জন্যে। কেউ পালাবার চেষ্টা করলে বা পুলিশে খবর দেওয়ার ভয় দেখালে হয় তার বডি গুমখুন হয় নয় জলে ডোবা পাওয়া যায়, শরীরে অত্যাচারের দাগ। কিন্তু হয় ঘুষ বা ভয় দেখিয়ে সাক্ষীদের মুখ বন্দ করে দেওয়া হয়, নয়তো সরাসরি খুন।
প্রমাণের অভাবে আর রাজপরিবারের প্রভাবশীলতার প্রতিপত্তির অভাবে পুলিশ চীফরাও কেউ ওয়ারেন্ট নিয়ে রাজবাড়ি সার্চ করার সাহস পায় না।
শিকারের অস্ত্র কথাটা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম।
ভূতনির পেলভিসের সেই ত্রিকোণ আকারের ক্ষত গর্তটার কথাটা মনে হল। কিসের আঘাতে হতে পারে সেটা? ত্রিকোণা ডগা কোন অস্ত্রের? তির? জ্যাভেলিন? বল্লম?
বল্লম দিয়ে বরাহ শিকার এক রাজকীয় প্রমোদ। মেয়েটিকে নিশ্চয় বল্লম দিয়ে আঘাত করা হয়েছিল।
বল্লম আর কজনের বাড়িতে থাকে আজকাল।
রাজবাড়ির অন্দরমহলে যাতায়াত আছে এমন কাউকে চেনে কিনা জিজ্ঞেস করলাম।
--কেউ কেউ নতুন কাজ নিয়ে ওই মহলে যেতে হিম্মত করেনা, বঢ়ি বৌয়া। সব পুরানা সিপাহি চাপরাশি যারা বহুত
দিন থেকে আছে, তার আছে।
--আমার শুধু একজনকে দরকার যে রাজ বৈঠকখানায় গিয়ে দেখে আসতে পারবে ওখানে কি কি অস্ত্র টাঙানো
আছে, আর তার মধ্যে বল্লম আছে কিনা। সবচেয়ে ভাল হয় যদি সে আমার থ্রো-অ্যাওয়ে ক্যামেরা দিয়ে তার একটা
ছবি তুলে নিয়ে আসতে পারে।
মায়ার কাছে রাজকুমারদের নারীগমন অত্যাচার ও হত্যার এই আমোদ-অভ্যাস ও বিশেষ শিকারাস্ত্রের অধিকারি হওয়া আমার মনের সন্দেহকে দৃঢ়তর করে দিল।
আমার মনের প্রশ্ন তখন--তবে কি আমার এই ভূতনির কঙ্কাল সেই আগের খুন হওয়া স্বল্পায়ু মেয়েটির কঙ্কাল? তাহলে কি করে এই ক্রিমিনাল আনসলভ্ড কেসের মেয়ের বডি একটা পুরুষের কঙ্কাল বলে অ্যানাটমির ডিশেকশনের স্টুডেন্টদের কাছে বিক্রি হল? কোন পথে তার এই গতি হল? খুনখারাবি লুকোবার এই অভিনব পদ্ধতিটি কি শুধু রাজকুমারদেরি নাকি এতে আরো কারো কিছু মোটিভ আছে? নারীচালানকারী আণ্ডারগ্রাউন্ড কোনো গ্রুপ?
সন্দেহ রহিত হওয়ার জন্যে বাড়িতে এসে ভূতনির গলার কাছটা দেখলাম। পড়েছি যে ফাঁসি হলে পিছনের শিরদাঁড়ার সারভাইকাল বোন ভাঙতে পারে, আর সামনের গলার হাইয়ড বোন ভেঙে যায়।
বিকেলের কনে-দেখা আলো তখন ছাঁকনির ফুটোর মত বিন্দু বিন্দু হয়ে হয়ে জানলার মশার নেটিং ভেদ করে
আসছে।
সেই অধরা আলোতেই দেখতে পেলাম আগে যা লক্ষ করিনি। এক শুঁয়োপোকার রোঁয়ার থেকেও পাতলা এক
রেখা যেন তৃতীয় সারভাইকাল বোনের সামনে দেখা যাচ্ছে।
তাহলে তো দেখা যাচ্ছে সেই মৃত মেয়েটির গায়ে যা যা আঘাত ছিল, প্রতিটি এই কঙ্কালের হাড়ে পরিলক্ষিত। আর ধাপে ধাপে একটা সিঁড়িতে চড়ার মত পর পর বৌদির শরীরেও সেই আঘাতগুলো ভৌতিকভাবে দেখা যাচ্ছে।
আর দেরি করা যাবেনা।
বৌদির শরীরে আর কোন আঘাত হওয়ার আগেই এটা বন্ধ করতে হবে।
বাড়িতে কাকে বলব?
কিংবা সকলে ভাববে আমি পাগল হয়ে গেছি পড়াশুনার চাপে।
একটি মানুষকেই শুধু বলা যায়।
বাবা।
সেই পাখির নীড়ের ঝাঁপ ফেলার সময়কার ঘন উদারার ঘুম ঘুম কুজন শুনতে শুনতে আমি আমার সেই একেবারে
বিপরীত ভয়ঙ্কর আতঙ্কের কথা গুলো বলতে থাকলাম।
ঘটনার পরম্পরা, আমার সন্দেহ, আমার হায়পোথেসিস, আমার ভয় যে বৌদিরও ওই মৃত মেয়েটির মত করে ঘাড়
মটকে, নয় ফাঁসি হয়ে, নয় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মৃত্য হতে পারে। হয়তো সে বৌদির বয়সী ছিল। হয়তো তার
বৌদির সুখী সংসার, দাম্পত্য দেখে সহ্য হচ্ছে না।
বাবা খুব মন দিয়ে শুনলেন। আমার কথার তোড়ে বাধা দিলেন না।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, --আত্মা বিচার চাইছে মনে হয়। কোনও প্রতিশোধ নয়। একটা ন্যায়বিহিত
বিচার।
আমি বললাম, আমরা সাধারণ মানুষ, আমরা এর কি বিচার করব, বাবা?
আরো কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বাবা বললেন,
ঋষি বিশ্বামিত্রের গুরুঋষি কৌশিকী। তার নামে এই নদী কৌশি। এই নদীর ধারে তিনি তপস্যা করেছিলেন শোনা
যায়। আবার এও শোনা যায় যে পৃথিবীতে কুমনা দুষ্কৃতিকারী মানুষদের আধিক্য অনেক হয়ে যায় এক সময়ে। তখন
স্বয়ং যম এক সুন্দরী নারীর রূপ ধরে এই নদীপ্রান্তে আসেন তাদের মোহিত করে মৃত্যপথগামী করতে। কিন্তু
দেখলেন যে মৃত্যুপথের চেয়ে সৎপথে তাদের আগুয়ান করে দেওয়া এই পৃথিবীর পক্ষে অনেক বেশি লাভদায়ক।
তাই যম তার সংহাররূপী কার্যকারণ বদলে কৌশি নদীর কূলে অন্যভাবে পৃথিবীকে পাপভারমুক্ত করলেন।
সব নদীর নামে গল্প থাকে। আবার কালানুযায়ী গল্প বদলে সময়োপযোগী লোকাচারের গল্প হয়ে যায়। গল্পের
কাজ হল সেই যুগের কোনও সহ্যাতীত ঘটনাকে সহানুভূতি দিয়ে ব্যক্ত করে সহনগ্রাহ্য করে তোলা--
বাবা যে কথাগুলো বলে কি বোঝাতে চাইলেন ঠিক বুঝলাম না, আবার যেন বুঝলাম।
দূরে বহু শতাব্দির কুয়াশায় কৌশি-গণ্ডক নদীর গল্পগুলোতে যেন চম্পা-কাঞ্চির অঘটনমৃত্যুর কঠিন নির্মম
স্ট্যাটিস্টিক্স ভোল বদলে একরকম রূপকথার বাঙ্ময় আলেখ্য হয়ে যোগ দিচ্ছে, কল্পনার চোখে দেখলাম।
ওদের বাবা মা ন্যায় পাবেন কি কি পাবেন না জানা নেই, কিন্তু আমি যদি কোন দিন তাদের সাথে তাদের ফাটলধরা
চাতালে তাদের সাথে বসতে পারি।
তারা যদি তাদের মেয়েদের ভয়াবহ ঘটনাকে বার বার বলতে বলতে সেটা কোনদিন ঠাকুরমার ঝুলির রাজকন্যা বা জলপরিদের গল্পের মত করে পালটিয়ে উদ্গার করতে পারে--তাকেই তো বলে সহনগ্রাহ্যতা-- সেই মেয়েদের পরের, পরের পরের প্রজন্ম যদি কালের আবর্তনে সব নদীর গল্পের মত সেই দুখি মেয়েদের স্মর্তির গল্পকে উজ্জ্বল প্রবাদ করে দেয়? বাবা কি তাই বলছেন--
এটাই কি শেষ পর্যন্ত আসল ন্যায়?
আধো অন্ধকারে বাড়ির উঠোনের দরজার দিকে হাঁটতে হাঁটতে বাবা বললেন--আবার ফুলঝরিয়ার নতুন ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট এসেছে, ম্যাথিউ কুরিয়াস, ম্যাড্রাসি। বিহার স্টেটের লোকাল পলিটিক্স-এর বাইরে এখনও। আমার স্কুলের বন্ধু। ওকে বলি। ও একটা নতুন ভাবে ঘটনাগুলোকে ভাবুক ও কোলড কেস আবার ওপেন করুক।
বাবার ধীর গলায় বলা কথাগুলোতে সেই অন্ধকারেও যেন দূরে গণ্ডকনদীতে নৌকায় লন্ঠনের আলোয় টিমটিমে আভাস পেলাম।
বাবা বলে চললেন--কঙ্কাল আর বাড়িতে রাখা চলবে না। তবে ইনভেস্টিগেশনের জন্য পুলিশের স্পেশাল ডিভিশনের জিম্মায় দিয়ে আসব আমি আর দাদা আজ রাত্রেই। পরীক্ষার সময় তুই হস্টেলে থেকে রাত এগারোটা অবধি পড়তে পারিস--তারপর আমি বা দাদা গিয়ে নিয়ে আসব।
কেমন একটা ভয় হতে লাগল, যেন একটা জ্যান্ত বিকৃত অশুভ আততায়ী জীব ওই হাড়গোড়ের স্তূপের মধ্যে লুক্কায়িত। কোন রকমে একটা চিমটি দিয়ে জুটের গানিস্যাকের মুখটা খুলে দাঁড়িয়ে রইলাম।
বাবা বললেন, তোর পরীক্ষা হয়ে গেলে আমরা গয়ায় গিয়ে ভূতনির নামে পিণ্ডি দিয়ে আসব। অনেক কষ্ট পেয়েছে সে তাই অনেক কষ্ট দিয়েছে।
দাদা ভুরু কুঁচকে ঝোলার মুখটা শক্ত করে বাঁধতে থাকল।
বৌদির কথা ভেবে আমার খুব কষ্ট হল, খুব কষ্ট।
অথচ ভূতনির জন্যও মনটা করুণ হয়ে গেল।