হঠাৎ জমাট অন্ধকারের মধ্যে ধড়মড় করে জেগে উঠলো সে। এরকম দুঃস্বপ্ন সে আগেও দেখেছে। কিন্তু সেসব স্বপ্নে আততায়ীর একজোড়া চোখ, তাক করা বন্দুকের নল, এইসব আসে, মিলিয়েও যায় যখন ভয়ংকর-সুন্দর পৃথিবীর শব্দ-গন্ধ-স্পর্শে, ক্ষুধার্ত বাছাদের আওয়াজে তার সংবিৎ ফিরে আসে...কিন্তু কই, আজ সে-সব মিলিয়ে গেল না তো! হায় হায়, সেই কাল সকালের পর থেকে বাছারা একদানি খাবার পায়নি আর।
সকালে বেরিয়েই সে বাটিতে রাখা খুদের টুকরো দেখেছিল... টালির চালওয়ালা বাড়ির উঠোনে। বৃষ্টিশেষের লাল-ফড়িং উড়ছিল তার আশেপাশে। কাছে যেতেই অন্ধকার। তারপর কেউ তাকে শক্তহাতে ধরে বার করল, একটা গরাদঘেরা ছোটো কুঠরিতে রেখে দিল। গরাদে মাথা ঠুকে ঠুকে তার রক্ত বেরিয়ে গেল, তবুও সে বেরোতে পারল না। তারপর আবার অন্ধকার।
এখন সেই জমাট অন্ধকারে নীলের ছোপ। অনেক উঁচু টালির চাল চুঁইয়ে আসছে দিন। পাশে রাখা আংরার আগুন নিবু-নিবু। শেষ চেষ্টায় মরিয়া হয়ে সে ধাক্কা দিতে থাকে গরাদে, সে ধাক্কায় কাত হয়ে পড়া তার কারাগারের আংটার দরজা খুলে যায়, সে বেরিয়ে আসে, দুর্বল পাখা আর অজেয় মনোবলের ভরসায় উড়াল দেয় ঘরের চাল আর দেওয়ালের মাঝের ফাঁকটুকু দিয়ে। আঃ।
গড়িয়ে পড়া খাঁচার ধাক্কায় আংরার তাওয়াটা উল্টে পড়ে ডাঁই করা রাখা শুকনো কাঠ-পাতার ওপর। গ্রামের নাম দুহাক, হিমাচলপ্রদেশ। গ্রামের প্রান্তে, বিয়াস নদীর পাকদণ্ডী পথের রাস্তায় মা আর ছেলের আস্তানা। নদী থেকে জল আনতে যাওয়ার পথে মা ভাবছে, ছেলেটা ঘুম থেকে উঠলে তাকে আজ বুঝিয়ে-সুঝিয়ে পাখিটাকে ছেড়ে দিতে বলবে। এখানে চিতার খুব উপদ্রব, তাই ঘরের দোর বাইরে থেকে বন্ধ করে এসেছে সে।
--তোকে ত বন্নু, সোয়ামী থাগলে অমন একটু মারধোর খেতিই হয়।
--ক্যানে, ভাত দেবে ভাতার নয়, নাথ মারবার গোঁসাই। গতর খেটে খাই, নেশাভাঙ-এর খরচা যোগাই... বে দিতে গে মা বলেছিল শওরে বে দিলাম, কপালে থাগলে ফেনের হাওয়া খাবি, ছাপরখাটে শুবি। গাঁ গেরাম নয়, যে ঘুঁটে দিতে হবে, ধান রুইতে, ঝাড়তে হবে। আজরানির মতোন থাগবি। তা রেকেছে বৈকি, বিরিজের তলায়, পাটির বেড়া, ইঁটের রুনুন, এই বাদলার দিনে কি দে যে তিনজনার মুকে রন্ন যোগাই... । তা বাদে রাত-বিরেতে কে বা এসে পাতর দে মাথা ছেঁচে দেয় বা।
--তা তোর তো পাকা ঘর তো ছেল, রাকতে পারলিনি। পাকা ইটের ঘর বলে কতা। একটা বাড়ি ছেল না, পায়রাড্যাঙায়...
--অমুন দিনেরাতে পাতা খেলে কি রাখতে পারে মাসি... এই তো পাঁচ টাকা দিই নি বলে মারধোর, দেকলে তো স-অব।
আজকাল এই ডাকটায় সৌরভীকে বড় ধন্দে ফেলে দেয়--তাকে মাসি বলে আরেকজন কে ডাকত... তার পা-টা খুঁতো, বসে বসে খেত বলে সৌরভীর সোয়ামীর ঠেস দেওয়া আর ফুরোতো না, তিনদিনের জ্বরে সে চলে গেল, সেও সব টান মেরে ফেলে একবস্ত্রে... তারপর এই বিরিজের নিচে, ভিক্ষে, এটাসেটা, দিনান্তে দোকানদারদের কাছে রেজকী বেচে পাঁউরুটি-ঘুঘনী... না পেলে হত্তুকি, আইনরক্ষকরা নিয়মিতা হাত পেতে দাঁড়াবেই...যখন বয়স ছিল সেসব হাত আরো কাছ ঘেঁষে আসত... এখন লক্ষ্মীর ভোগেই খুশি।
মুশকিলে ফেলছে ডাকটা। আবার একটা দুধের বাছা, সিকনি মাখা গালের ওপর ভাসাভাসা চোখদুটো দে পুটপুট চায়। মা রোজগারের ধান্দায় গেলে কখনো সখনো তার কাছে এসে নির্বিবাদে ঘুম যায়। অপদার্থ বাপটা যখন তার মাকে মারধোর করে, মাতাল হয়ে এসে বিষ উগরে দেয়, তখন ছেঁড়া কাপড়ের দোলার খুঁট বিরিজের দুই থামের পেরেকে ফাঁসিয়ে, শিশুর শোবার ব্যবস্থা করে ফেলে সৌরভী। ভুলে যাওয়া ঘুমপাড়ানি গান মনে করবার চেষ্টা করে।
রাত বারোটা নাগাদ যানজট মিলিয়ে আসে... শুধু কখনো সাইরেন, কখনো বা অ্যাম্বুলেন্সের হুই-হুই করে চলে যাওয়াটুকু ভুলে ব্রিজ ও তার আশ্রিতজন স্বপ্ন দেখতে থাকে। ছেঁড়া মাদুর, তেলচিটে বালিশ, গিঁঠ দেওয়া মশারির মধ্যে। কিন্তু আজকাল মাঝে মাঝে এক অজানা আশংকায় সৌরভীর ঘুম ছুটে যায়। ওই বুঝি সে এলো, উদ্যত দু'হাতে পাথর... কিন্তু চোখ খুলে চারপাশের শান্তির ছবি দেখতে দেখতে আবার ঢলে পড়ে ঘুমে।
আজও হলো তাই। স্বামী-স্ত্রীর মারপিট, চিল-চিৎকার আর্তনাদ সব শেষ করে সবে শুয়েছে আধঘন্টাটাক, তার ঘুম পাতলা হয়ে এল। আধো-জড়ানো চোখে খসখস-খসখস শব্দের উৎস খুঁজতে খুঁজতে আটকে গেল চোখ, কাটা পাথরের স্তূপের ওখানে মেয়েটা কি খোঁজে! মাতালটার নাক সমানে ডাকছে গাঁ-গাঁ করে। মেয়েটা উঠে দাঁড়াল। টলতে টলতে তার শিয়রে এসে দাঁড়ায়, দুহাতে ভারি পাথরটাকে সে ঠিক করে তুলতেও পারছে না।
সৌরভীর গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। মাগি শেষে কি ম্যাদ খাটবে!
পরক্ষণেই মনে হল, জেল হলে তো ভাতটা পাকা। ম্যাদ খাটলে দুধের বাচ্ছাটাকেও নিয়ে যেতেই দেবে নিশ্চয়। বাদলার দিনে আশ্রয়, মাতাল-দাঁতালের হাত থেকে মুক্তি।
সৌরভী চোখ বন্ধ করে, মটকা মেরে অপেক্ষা করে থাকে একটি ভোঁতা আওয়াজের।