ট্রেনে উঠেই জানলার ধারের সিটটা নিয়ে নিল দীপ্ত। আজ দীপ্তর ভারি মজা। নতুন এক জায়গায় বেড়াতে যাচ্ছে। বাড়ি থেকে খুব দূরে নয়। কিন্তু নামটা শুনলেই মনে হয় কতদূর! কি গা ছম্ছম্, বুক ধড়ফড় ভয়! হালুম। রয়েল বেঙ্গল টাইগার! নদীতে ভাসছে ধারালো দাঁতের ভয়ঙ্কর সব কুমীর। কামঠ। গভীর জঙ্গলে লুকিয়ে আছে হরিণ। বনমোরগ। আর ভয়ংকর সব বিষধর সাপ। এই জঙ্গলকে বলে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। সারা পৃথিবীর মানুষ জানে এ আমাদের ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ—সুন্দরবন। দীপ্ত এইসব কিছু বইতে পড়েছে। বাবার কাছে গল্পও শুনেছে অনেক।
বাবা কিন্তু বারবার বলেছে, আমরা ঠিক বেড়াতে যাচ্ছি না। আমরা যাচ্ছি একটা কাজে। কাজটাই প্রধান। সঙ্গে একটু বেড়ানোও হয়ে যাবে।
দীপ্ত জানে না কাজটা ঠিক কি? এটা তো অফিসের কাজ নয়। অন্য কাজ। বাবার সঙ্গে অবশ্য অফিসেরই তিনবন্ধু যাচ্ছে। বিনয়কাকু, তুহিনা আন্টি আর শুভ্র জ্যেঠু। তিনজনেরই হাতে বড় বড় ব্যাগ। ব্যাগ ভর্তি নতুন-পুরনো অনেক জামাকাপড়, বিস্কুট, লজেন্স, সাবান, ওষুধ, খাতা-পেন্সিল। বাবা একিদন অফিস থেকে এসে বলল, সামনের রোববার ভোরে আমরা যাব সুন্দরবনের এক অনাথ আশ্রমে। দিনে যাব, রাতেই ফিরে আসব। সেখানে কিছু জিনিস দিতে যাব। তুই যাবি নাকি দীপ্ত?
—বাবা 'অনাথ শ্রম' কি? দীপ্ত ছটফটিয়ে উঠে বলেছিল।
—অনাথ আশ্রম মানে যেখানে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা থাকে। পড়াশুনা করে। যাদের ঠিকমত গার্জিয়ান নেই।
—গার্জিয়ান নেই? দীপ্ত অবাক হয়ে বলেছিল।
—একদম নেই ঠিক নয়। বাবা বুঝিয়ে বলেছিল, কারও হয়তো বাবা আছে, মা নেই। মা আছে তো বাবা নেই। আবার কারও মা-বাবা কেউই নেই। গরীব মানুষ। আত্মীয়রা এসে আশ্রমে রেখে চলে যায়।
—আমি যাব বাবা। অনাথ আশ্রম আমিও দেখব। দীপ্ত বায়না জুড়ে দিয়েছিল।
আজ সেই অনাথ আশ্রম দেখতেই যাচ্ছে দীপ্ত। বালিগঞ্জ থেকে ট্রেনে উঠেছে। নামবে ক্যানিং। তারপর দুটো নদী মাতলা ও হোগল পেরিয়ে যেতে হবে সেই ঝড়খালি জঙ্গলের দিকে। সেখানেই এক গ্রামে একজন মাস্টারমশাই ছোট ছোট ছেলেদের নিয়ে এই অনাথ আশ্রম গড়েছেন।
—আচ্ছা বাবা, ওখানে তো খুব ভয়। বাঘ আছে। সাপ আছে। কুমীর আছে। জঙ্গল থেকে বেরিয়ে বাঘ যদি আশ্রমে চলে আসে!
—আসতেই পারে। সেই ভয় নিয়েই তো ওরা থাকে। ইস্কুলে যায়। বই পড়ে। ফুটবল খেলে।
দীপ্ত অবাক হয়েছিল এসব কথা শুনে। মনে মনে সেইদিন থেকেই ছটফট করছিল, কবে যাব? দীপ্ত আজ সেই অনাথ আশ্রম দেখতেই যাচ্ছে। দেখবে সেই সব অনাথ ছেলেদের। ওর আজ অনেক নতুন বন্ধু হবে!
ট্রেনে জানলার ধারে বসে বাইরের দিকে দু'চোখ মেলে দীপ্ত সব দেখতে দেখতে যাচ্ছে। কত গাছ। ছোট ছোট পুকুর। ডোবা। সেখানে ভাসছে শালুক ফুল। উড়ছে জলফড়িং। মাটির ছোট ছোট বাড়ি। কত পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে। আকাশ এখানে কত বড়। সবুজে সবুজ হয়ে আছে ধানক্ষেত। সাদা সাদা রাজহাঁস ঘুরে বেড়াচ্ছে। ডানামেলা সাদা বকের ঝাঁক উড়ে বেড়াচ্ছে। দীপ্ত মনের সুখে সব দেখছে।
তুহিনা আন্টি বলল, কেমন লাগছে দীপ্ত?
দীপ্ত একগাল হেসে বলল, খুব ভালো।
শুভ্র জ্যেঠু বলল, খুব ভালো! কতটা ভালো?
—অনেক। দীপ্ত হাসতে হাসতে দু'হাত দুদিকে ছড়িয়ে দিয়ে বলল, এই অ্যাত্তো ভালো.....
বিনয়কাকু হঠাৎ জানলার ফাঁক দিয়ে আঙুল উঁচিয়ে একটা গাছ দেখিয়ে বলল, ওটা কি গাছ বল তো?
দীপ্ত একবারেই বলে দিল, তালগাছ। তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে .....
তুহিনা আন্টি হাসতে হাসতে বলল, সব গাছ ছাড়িয়ে ..... দীপ্ত বাকিটা বলল, উঁকি মারে আকাশে, মনে সাধ কালো মেঘ উড়ে যায়....
—ভেরি গুড। সবাই হাততালি দিল। ট্রেন ছুটছে। সোঁ সোঁ করে চোখের সামনে থেকে সব সরে সরে যাচ্ছে। তুহিনা আন্টি এবার বলল, আজ তুই নতুন পাঁচটা গাছ চিনে নিবি। আচ্ছা বল তো ওটা কি গাছ?
—পেঁপে গাছ। দীপ্ত এবারও সহজেই পারল। বলল, আমাদের বাড়িতে তো ছিল। একদিন ঝড়ে ভেঙে গেল।
—ভেঙে গেল? কেন! শুভ্রজ্যেঠু চোখ বড় বড় করে বলল, তার মানে গাছটাকে ঠিকমত খেতে দিস নি।
—কি খেতে দেব? দীপ্ত অবাক হেসে জানতে চায়।
—কেন হরলিক্স দিবি। বোর্নভিটা দিবি। তবে তো গাছ শক্ত হবে। মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকবে।
—হা-হা-হা। দীপ্ত খুব হেসে বলল, গাছ হরলিক্স খাবে? বোর্নভিটা খাবে?
—খাবে তো। শুভ্র জ্যেঠু হেসেই বলল, দিলেই খাবে।
শুভ্র জ্যেঠু না সব সময় এমন মজার মজার কথা বলে!
দীপ্ত আবার একমনে জানলার বাইরে চেয়ে দেখছে। একে একে চলে যাচ্ছে সব স্টেশন। গড়িয়া, সোনারপুর, পিয়ালি, ঘুটিয়ারীশরিফ। সামনেই আসছে একটা স্টেশন তালদি। ট্রেনটা স্লো হয়ে গেল। দীপ্ত বলল, আন্টি এখানে অনেক গ্রাম তাই না? কি সুন্দর সুন্দর গ্রাম .....
তুহিনা আন্টি খুব হাসছে। তোর ভালো লাগছে বুঝি? গুনেছিস কতগুলো গ্রাম দেখলি?
—না তো! দীপ্ত জিভ কেটে বলল, আন্টি এবার থেকে গুনব?
—হ্যাঁ গোন। বিনয়কাকু বলল, তোর পুঁচকে ভাইটাকে গিয়ে গল্প করবি না? স্কুলের বন্ধুদের বলবি তো সব।
—বাবা, আমাদের বালিগঞ্জে কোনও গ্রাম নেই কেন? দীপ্ত আদরে-আবদারে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বলল।
—ওরে চুপ! চুপ! বাবা ঠোঁটে আঙুল ছুঁয়ে বলল, এসব কথা আর বলিস না। লোকে শুনলে তোকে সবাই বোকা বলবে। বলবে হাঁদারাম! ....
দীপ্ত বাবার কথায় মোটেই খুশি হতে পারল না। ও তখন শুভ্রজ্যেঠুর দিকে চেয়ে থাকে। শুভ্র জ্যেঠু মিটিমিটি হাসছে। নিশ্চয়ই আবার কোনও এক মজার কথা বলবে শুভ্রজ্যেঠু।
'হরিণডাঙ্গা নেপালচন্দ্র সেবাশ্রম'—অনাথ আশ্রম-এর গেটের মুখে ছোট্ট একটা সাইনবোর্ড। গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই ফেলু, কালো, পথিক, রাহুল, দিগন্ত, বিশ্বজিৎ, অশোক, ফাল্গুনীরা সব ছুটে ছুটে এল। ওদের কি আনন্দ। ভারি মজা। মাস্টারমশাই হাসতে হাসতে বললেন, আপনারা আসতে দেরি করছিলেন দেখে ওরা ছটফট করছিল। এখন দেখলেন তো কি আনন্দ ওদের!....
দীপ্ত বাবার পাশে লাজুক হেসে চুপ করে দাঁড়িয়েছিল। তুহিনা আন্টি ওর হাত ধরে আশ্রম বালকদের সামনে নিয়ে গিয়ে বলল, ওর নাম দীপ্ত। তোমাদের নতুন বন্ধু। ওকে নিয়ে তোমরা খেলতে যাও।
সবাই খুশিতে হৈ হৈ করে উঠল। কি মজা! কি মজা!
বিনয়কাকু ওর ব্যাগ থেকে নতুন একটা ফুটবল বের করে বলল, এটা তোমাদের। যাও খেলতে যাও।
ছেলেপুলের দল নতুন বন্ধু দীপ্ত আর নতুন পাওয়া ফুটবল নিয়ে এক ছুটে সটান মাঠে।
আজ সারাদিন দীপ্ত ওদের সঙ্গেই থাকল। ফুটবল খেলল। আমগাছে চড়ল। গাছ থেকে পেয়ারা পেড়ে খেল। পুকুরে জাল ফেলে মাছ ধরা দেখল। রাজহাঁসকে কোলে তুলে আদরও করতে যাচ্ছিল দীপ্ত কিন্তু এমন খ্যাঁক খ্যাঁক করে তেড়ে এল যে সেটা আর হোল না। দুপুরে ওদের সঙ্গে মাটিতে বসে ভাত খেল। মোটা মোটা চালের ভাত, এমনকী তেতো নিম-বেগুন ভাজা তাও বেশ মজা করেই খেল। আজ আবার প্রথম নতুন দুটো জিনিস খেল—কাঁকড়ার তরকারি ও চালতার টক।
সারাদিন কি আনন্দই না হল। মনে হচ্ছে আরও থাকি। আরও খেলি। যেতে একদম ইচ্ছে করছে না। নতুন বন্ধুরাও বলল, আজকে থাক। কাল আমরা জঙ্গলে বেড়াতে যাব। নৌকো চড়ব। কিন্তু ফিরে যে যেতেই হবে। কাল বাবার অফিস। মায়ের বুটিক সেন্টার। ওর স্কুল। হোম টিউটরের পড়া। সুইমিং ক্লাস। লাইব্রেরির বই পালটানো।
দুপুরের চড়া রোদ একটু নরম হতেই ফেরার আয়োজন শুরু হল। মাস্টারমশাই সবার জন্য গাছের নারকোল, বাগানের পেঁপে, কুমড়ো দিলেন। প্রতিবারই কিছু না কিছু দেবেন। কিন্তু এই প্রথম দীপ্ত এসেছে। দীপ্তকে তো মাস্টারমশাই কি দেবেন ভেবেই পাচ্ছেন না। তাই ওকে কাছে টেনে আদর করে বললেন, দীপ্ত তুমি কি নেবে বল? তোমাকে কি দিই বল তো?
দীপ্ত চুপ করে থাকে। কিচ্ছু বলে না। তুহিনা আন্টি হাসছে। বিনয়কাকু হাসছে। বাবাও মিটিমিটি হাসছে। শুভ্রজ্যেঠু বলল, আমি জানি দীপ্ত কি চাইবে?
মাস্টারমশাই হাসতে হাসতে বললেন, তাই! কি চাইবে তুমি? জঙ্গলের রয়েল বেঙ্গল টাইগার নাকি?
—না। না। শুভ্রজ্যেঠু মাথা নাড়লেন।
—তবে কি বনের হরিণ? মাস্টারমশাই এবারও হাসছেন।
—না। হল না। শুভ্র জ্যেঠু, যেন সব জানেন!
মাস্টারমশাই চোখ গোল গোল করে বললেন, তবে কি জঙ্গলের অজগর সাপ নাকি! .....
—হা-হা-হা। শুভ্রজ্যেঠুর কি হাসি।
আশ্রমের ছেলেরা গোল হয়ে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। দীপ্ত মাস্টারমশাইয়ের কোলে। সারা মুখে হাসি ছড়ানো। লাজুক হাসি। ও কিছু বলতে চায়। কিন্তু পারছে না। বাবা বলল, অ্যাই তোর কি কিচ্ছু বলার আছে? থাকে তো বল। নয় তো চল। দেরি হয়ে যাচ্ছে।
তুহিনা আন্টি বলল, বল না দীপু কি চাস?
বিনয়কাকু বলল, রেডি ওয়ান টু থ্রি .....
দীপ্ত এবার মাস্টারমশাইয়ের গলা জড়িয়ে ধরে আবদার করে বলল, স্যার আমাকে একটা গ্রাম দেবেন?
—গ্রাম! মাস্টারমশাই তো আকাশ থেকে পড়লেন, একটা গোটা গ্রাম?
দীপ্ত আর কিছু বলে না। চুপ করে থাকে। মাস্টারমশাই এবার জানতে চাইলেন, তুমি গ্রাম নিয়ে কি করবে?
—আমার ভাইকে দেখাব। ভাই তো ছোট। ও আসতে পারে নি। ভাই গ্রাম দেখলে খুব মজা পাবে। আমাদের বালিগঞ্জে তো কোনও গ্রাম নেই!....
—হো হো হো। বালিগঞ্জ কোনও গ্রাম নেই! মাস্টারমশাই হাসতে হাসতে বললেন, তাই তুমি ভাইকে গ্রাম দেখাবে। ভাইয়ের জন্য নিয়ে যাবে এই উপহার!...
মাস্টারমশাই আদরে-আনন্দে দীপ্তকে এবার বুকের কাছে টেনে নেন। ছাড়তে আর পারেন না। দীপ্তও ওঁর আশ্রয়ে নিশ্চুপ হয়ে যায়। ছোট ছোট ছেলেরাও কেমন অবাক হয়েছে ওদের নতুন বন্ধু দীপ্তর কথা শুনে। তাই ওরাও মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকে দীপ্তর দিকে।
বাবা, তুহিনা আন্টি, বিনয় কাকুও চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। শুধু শুভ্রজ্যেঠুকেই আর দেখা যাচ্ছে না। দীপ্ত এদিক, ওদিক চায়। শুভ্র জ্যেঠুকে খোঁজে। কিন্তু কোথাও দেখতে পায় না। শুভ্রজ্যেঠু যে হঠাৎ কোথায় উধাও হয়ে গেল? শুভ্রজ্যেঠু, ও শুভ্রজ্যেঠু তুমি কি আমার জন্য গ্রাম আনতে চলে গেলে নাকি?