অনভিজাতদের জন্য অপেরা; সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়; প্রথম প্রকাশ: ২০১৪, প্রতিভাস - কলকাতা, পৃষ্ঠাঃ ৪০০; ISBN: নেই
সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের অনুরাগী পাঠককুল (আর কে না জানে সেই মিছিল ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে) খুশি হবেন কারণ এক মলাটের মধ্যে তাঁর প্রায় চল্লিশ বছরের লেখালিখি পাওয়া গেল এই বইটিতে। এই সংকলন কালানুক্রমিক সাজানো না থাকার একটা রোমাঞ্চ আছে। যেহেতু তাঁর পরের দিকের লেখাগুলিই প্রথম দিকে রয়েছে আমরা তাঁর দর্শনের – তাঁর দেখার আর দেখার প্রক্রিয়াটি গঠিত হবার – একটা প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারে লিপ্ত হতে পারি। এই সময়ে তিনি সিনেমা এবং তার তত্ত্ব নিয়ে কী ভাবছেন সেটার থেকে যদি আমাদের খননকার্য শুরু করি এবং ক্রমশ ১৯৭৩-এর নবীনতম সন্দর্ভটিতে পৌঁছাই তাহলে একজন আগুনে তরুণের চলচ্চিত্রবিদ্যার অধ্যাপক হয়ে ওঠার পরিক্রমা পথটি ঘুরে নিতে পারি। পরিক্রমা ভিন্ন তীর্থদর্শন সম্পূর্ণ হয়না।
এমন কিন্তু মনে করার কারণ নেই যে তিনি এতটাই বদলে গেছেন যে তাঁর বাজ-ডাকানো গলা এখন চিঁ চিঁ করে বা ফুলকি ছেড়ে তিনি ফুল ধরেছেন। মুখবন্ধে তিনি মার্জনাপ্রার্থীর ভঙ্গিতে জানিয়েছেন নানা সময়ে লেখা নিবন্ধগুলির মধ্যে যে পুনরুক্তি রয়েছে সম্পাদনা করে তিনি তাদের কৌমার্য হানি করতে চাননি। এই পুনরক্তিগুলি কিছুটা দিকনির্দেশক স্তম্ভের মতও কাজ করে। তাঁর মতে যে একাডেমিয়ায় অধিরথ-পুত্রের মতো তাঁকে অনধিকারপ্রবেশ করতে হয়েছে সেখানে তিনি নিতান্ত অপ্রতিভ বাঙাল। আমরা কিন্তু একটি ভিন্ন আখ্যান দেখতে পাব। পুনরুক্তিগুলি আসলে তাঁর বিশ্বাসের অভিজ্ঞান। ভুক্তভোগী মাত্রেই জানেন একাডেমিয়ার অতিপ্রিয় উত্তরাধুনিক এবং উত্তরগঠনবাদী শিল্পতত্ত্ব এবং তার প্রহেলিকাসম বাক্যজাল কীরকম স্থিরতাবিরোধী, বদ্ধপাঠ-বিরোধী এবং প্রায় দর্শন-বিরোধী। সঞ্জয় তাঁর মসিচালনার হাত মকশো করেছেন সত্তরের দশকে। সেটা পক্ষাবলম্বনের যুগ। দুই শিবিরে বিভক্ত পৃথিবীতে শিল্পগুণের আলোচনা শুরু হত শিল্পীর ভাবাদর্শের আলোচনা থেকে। এমেচার সমালোচক থেকে চলচ্চিত্রবিদ্যার পেশাদার অধ্যাপক হয়ে ওঠার পথে এই উত্তরাধুনিক পৃথিবী আর উত্তরাধুনিক তত্ত্বের সংগে সঞ্জয়কে বোঝাপড়া করতে হয়েছে। কখনও কখনও মোকাবেলাও। আর এই বার্লিনের প্রাচীরপতন-পরবর্তী তাঁর সমস্ত অধ্যয়ন আর পর্যবেক্ষণ যে তাঁর পূর্বাশ্রমে অর্জিত কতগুলি বিশ্বাস থেকে তাঁকে চ্যুত করতে পারেনি পুনরুক্তিগুলি তার প্রমাণ।
আমাদের ছেলেবেলায় যেমন বইয়ের বুকের মধ্যে থেকে প্রেমপত্র বেরিয়ে পড়ত তেমনি সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় পড়ামাত্র বোঝা যায় তাঁর প্রথম প্রেম আসলে কবিতা। তাঁর শিল্পভাবনার একটা স্তম্ভ এই – অন্তত এই নিবন্ধসঙ্কলনে আমরা বার বার যেমন পড়ব – যে মহৎ শিল্পী আখ্যানের পরিধির বাইরে, অলঙ্কারশাস্ত্র নির্ধারিত সংজ্ঞার বাইরে, সাকার পৃথিবীর ঠিক করে দেওয়া সমস্ত গণ্ডির বাইরে উপচে পড়েন। অবধারিতভাবে।
দস্তয়েভস্কির ‘কারামাজভ পরিবার’ উপন্যাসটিতে যেসব ফাটল, তা দিয়ে আবির্ভূত হয় সন্দর্ভ। ঋত্বিকের রচনাকর্ম যেসব ত্রুটির জন্যে অতিখ্যাত, ছিন্নরেখ সেইসব পর্যায় আসলে একজন শিল্পীর আত্মার দার্শনিক অবস্থানকে মূর্ত করে। তাঁর পতন উপন্যাসটিতে কামু যেমন উপন্যাসের কাঠামোটিকেই ছলনা করে গেছেন, ঋত্বিক তেমনভাবেই তাঁর সংক্ষিপ্ত চলচ্চিত্রপঞ্জির সূত্রে পরিহাস করে গেছেন আখ্যান-আসক্তির রোজনামচা।
নানা ছলে সঞ্জয় এই কথাটা বারবার বলবেন। প্রতিভাপ্রমত্ততা আকারের বিশুদ্ধতা স্বীকার করে না। তাই গোদার সিনেমাকে প্রবন্ধ করে তুলতে পারেন। চিরন্তনের অপর মুখ যে ক্ষণস্থায়ী মুহূর্ত, সুসভ্য সুষম উনিশ-শতকীয় বর্ণনার রীতির বাইরে উন্মত্ত উদ্ভাস যাকে উজ্জ্বলতা দান করে – সঞ্জয়ের মতে – সেই শিল্পীর আরাধ্য। যেহেতু নিউটনের বাস্তব কোয়ান্টাম জিজ্ঞাসায় জর্জরিত, ইতিহাসের প্রগতি মার্ক্সের দ্বান্দ্বিক প্রশ্নের সম্মুখীন, যেহেতু মানুষের মনের আলোআঁধারির দিকে চোখ ফেরাচ্ছেন ফ্রয়েড, বিংশ-শতাব্দীর দ্বিতীয় পাদ থেকেই শিল্পীদের খুঁজতে হচ্ছে তির্যক বিচ্ছুরণ, ঠিকরে ওঠা নানা বাকবিধি, বিশৃঙ্খলার নানা স্বরলিপি। আধুনিকতা – বিংশ-শতাব্দীর বহু আলোচিত মর্ডানিজমকে – এভাবেই চিনে নিতে চান সঞ্জয়। স্বভাবতই তাঁর উপাসনাগৃহে যাঁদের প্রতিকৃতি টাঙানো তাঁরা হলেন বোদল্যের, পিকাসো, এলিয়ট, দস্তয়েভস্কি, কাফকা, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, গোদার, জীবনানন্দ, কমল মজুমদার এবং অবশ্যই ঋত্বিক ঘটক।
সঞ্জয় কিন্তু তাঁর অধ্যয়ন আর অনুভূতিমালা থেকে জানেন যে সমস্ত তুমুল বিশৃঙ্খলাই ইতিহাস থেকে উৎসারিত আলো। একাধিক নিবন্ধে তিনি বিশ্ব চলচ্চিত্র এবং ভারতীয়, বিশেষ করে বাংলা চলচ্চিত্রের জন্মবৃত্তান্ত থেকে প্রথম যৌবন-প্রাপ্তি বর্ণনা করেছেন। বলেছেন আলোকচিত্র যেমন, চলচ্ছবিও শিল্পমাধ্যম হিশেবে কেমন তাচ্ছিল্য পেয়েছে। কেননা অনেকেই ভুল করে ভেবেছিলেন ক্যামেরা কখনই বাস্তবকে অতিক্রম করতে পারবেনা। প্রাণহীন প্রতিধ্বনি করে যাওয়াই তার ভবিতব্য। আর এই দাসত্ব থেকে তাকে মুক্তি দিয়েছেন বলেই আইজেন্স্টাইন আমাদের উপাস্য, গোদার আমাদের উপাস্য, ঋত্বিক আমাদের উপাস্য। ঋত্বিক সঞ্জয় এই মন্ত্রই উচ্চারণ করেন বারবার।
তারপর সঞ্জয়কে আরেকটি ঐতিহাসিক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। সাহিত্য বা চিত্রকলা বা সংগীত সভ্যতার আদিকাল থেকে মানবসমাজের অংশ। যদিও যান্ত্রিকভাবে পুনরুৎপাদিত না হতে পারা পর্যন্ত শিল্পের ভোক্তা ছিল মুষ্টিমেয় অভিজাতবর্গ। কিন্তু এমনকি যখন ছাপাখানা বা গ্রামাফোন রেকর্ড শিল্পীকে সুলভ করে তুলল তখনও বাজার সম্পূর্ণভাবে না শিল্পীর সৃষ্টিকে না পাঠক বা শ্রোতার রুচিকে নির্ধারিত করে দিতে পারত বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারতো। কিন্তু সিনেমা প্রথম থেকেই বাজারের কব্জায়। একটা প্রধান কারণ শুধু ব্যক্তিগত প্রতিভায় সিনেমা তৈরি করা যায় না। তার জন্যে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের প্রয়োজন, ক্যামেরা প্রয়োজন, চিত্র প্রদর্শন ব্যবস্থা প্রয়োজন, অর্থাৎ বিপুল অর্থ ও সংগঠন প্রয়োজন। যেখানে সৃষ্টির প্রক্রিয়াটি অর্থলগ্নির ওপরে এতো বেশি নির্ভরশীল সেখানে বাঁধা পথের বাইরে হাঁটতে চাইবেন কতজন পরিচালক? আর এই নিরাপদ মধ্যবিত্ততাকে শিল্প হিশেবে মানতে সঞ্জয়ের মন বিদ্রোহ করে। ইতরজনকে আমোদ দিয়ে জনপ্রিয়তার সরণি তাঁকে শিহরিত করে। সংস্কৃতি কর্মী সঞ্জয় সত্তরের শেষাশেষি হলে হয়ত এই জনপ্রিয় দেবতাদের বিগ্রহগুলিতে অগ্নিসংযোগ করতেন। পাঠকদের – অবিশ্বাসী পাঠকদের – ১৯৭৩-এ লেখা “রোম্যান্টিক মন্বন্তর বনাম হাঘরে রোমান্টিকতা" আরেকবার পড়ে দেখতে অনুরোধ করি। সত্যজিৎ যদি ছাড় না পান অমিতাভ বচ্চন কতটা মার্জনা পেতে পারেন? কিন্তু ইতিমধ্যে সঞ্জয় শিল্পবস্তুকে–- যা একটি চিহ্ন মাত্র -- উলটোদিক থেকে পড়ে কীভাবে তার জন্মকুণ্ডলী শনাক্ত করতে হয় তার বিবিধ শুলুকসন্ধান আয়ত্ত্ব করেছেন। তাঁর বিশ্বাসের মূল স্তম্ভগুলি অটুট আছে। কিন্তু তিনি আরেকটু দ্রব হয়েছেন। এটাও তিনি বুঝেছেন যে আমাদের যৌবনে অপরকে যে একরোখা অবিশ্বাসের সংগে দেখা হত সেটাও প্রশ্নাতীত নয়। তাঁর এই পরিক্রমা বস্তুত আমাদের প্রজন্মের বিশ্ববীক্ষার ইতিহাস। এই ইতিহাস লিপিবদ্ধ করার জন্যে আমরা তাঁর কাছে ঋণী।
শেষে একটি অনুযোগ করি। পরিহাস করে তিনি বলেছেন বটে যে বীজগর্ভ সন্দর্ভ তিনি লিখে উঠতে পারেন না কিন্তু আমার মতো নাদান পাঠকের পক্ষে তিনি মাঝে মাঝে অকুল পাথার। তীব্র সংকেত তাঁর কবচকুণ্ডল। অনুরণনে ঠাসা থাকে তাঁর বাক্যগুলি। কবিতাকে এতো অনায়াসে, এতো ভালবেসে অথচ এতো সচকিত করে প্রবন্ধে ব্যবহার বাংলা ভাষায় কে করেছে আর? কত পঙ্ক্তিকে অসংখ্যবার পুনরাবিষ্কার করেছি সঞ্জয়ের লেখা পড়ে। কিন্তু তাঁর তত্ত্বভাবনা নির্মিত হওয়ার পথে যে অসংখ্য প্রাবন্ধিক এবং তাত্ত্বিকদের সংগে তাঁর মোলাকাত হয়েছে তাদের কুলপঞ্জি আরেকটু অকৃপণ ভাবে থাকলে আমাদের একটু সুবিধে হত। যে প্রবন্ধগুলির নাম দেওয়া আছে সেগুলি বাদেও বিভিন্ন সময়ে একটা চিন্তার উল্লম্ফন আছে। নির্দিষ্ট প্রবন্ধের সংগে মিলিয়ে পড়লে উল্লম্ফনটি অনুসরণ করাও সহজ হত আমাদের অশিক্ষা মেরামতিরও একটা সুযোগ পাওয়া যেত।