স্টেশনের নাম তালবন্দ। নামটা অদ্ভুত। এককালে ব্রিটিশদের প্রিয় জায়গা ছিল। আশেপাশে উঁচু-নীচু পাহাড়, জঙ্গলের পথে বনবিবির মন্দির। হিল-স্টেশনের মত খানিক ঘাট-রাস্তা। সেখানে নানা প্রজাতির বন্যপ্রাণী, বৃষ্টিতে ক্ষয়প্রাপ্ত উইঢিবির কারুকার্য, আর অসংখ্য ময়ূর। সম্ভবত ময়ূরের প্রাচুর্যের জন্য রাজ্যের নাম ময়ূরভঞ্জ। কিন্তু বুনো হাতির আক্রমণে জেরবার হবার জোগাড়। তাই হাতির আক্রমণকে প্রতিহত করবার জন্য দেড়-দু'ফুট অন্তর সারি-সারি তালগাছের চারা রোপণ করেছিল ব্রিটিশরা। কালক্রমে সেই চারাগুলো মহীরুহের চেহারা নিল। তৈরি হল পাম ব্যারিকেড বা তালবন্দ।
উনিশশো চার সালের কথা। ব্রিটিশের তৈরি ব্রড-গেজের রেললাইন হাওড়া থেকে মাদ্রাজ পৌঁচেছে। ময়ূরভঞ্জের রাজা পূর্ণচন্দ্র ব্রিটিশদের গড়া রূপসা জংশন থেকে একটা ছোটো রেলপথ নিয়ে গেলেন রাজধানী বারিপদায়। সেখান থেকে বাংরিপোসি হয়ে তালবন্দ। রাজাদের ইচ্ছানুসারে, রেলগাড়ির ইঞ্জিনের সামনে থাকত একজোড়া ময়ূরের মূর্তি।
চৈত্র-সংক্রান্তিতে তিনদিন-ব্যাপী ওড়িশি ছৌ-নাচের আসর জমেছে বারিপদায়। ময়ূরভঞ্জ এখন ওড়িশার একটা জেলা। বারিপদা তার সদর শহর। সাবেক কালের কেল্লাটি যদিও লুপ্তশ্রী, তার পাথরের গাঁথুনিটা বেশ অটুট। তবে সে রাজাও নেই, রাজ্যও নেই, কিন্তু পরম্পরা আছে। এই রুটে ছোটো রেল চড়ার অভিজ্ঞতা দিবাকরের সেই প্রথম। রেললাইন স্থাপনের প্রায় নব্বই বছর পরে। লাইনের অবস্থা শোচনীয়। ইঞ্জিনের গতি ঘন্টায় দশ কিলোমিটার। কামরায় কোন আলোর ব্যবস্থা নেই। ছিল কোন দিন, চুরি হয়ে গেছে। পাখা ঘোরার কোন শব্দ নেই। মানে পাখাও নেই। বাথরুমের দরজা খোলা হলেই অ্যামোনিয়ার তীব্র গন্ধে নাক জ্বালা করে। তবু রেলগাড়ি চলেছে। গাড়ির গতি এত ধীর যে একটা ভ্যান-রিক্সাও হারিয়ে দেয় তাকে।
আদ্যিকালের হাতাওয়ালা সিগনাল। সেটা ঝুঁকে গেলে বাঁশি বাজে, গাড়ি ছাড়ে। রেলের ডানপাশে শালের জঙ্গল, বাঁদিকে তসরের চাষ। বিনা উর্দিতে দেখা মিলল টিকিটবাবুর। মেদিনীপুরের বাঙালি যুবক, সুবেশ বল। কথায় যেমন প্রত্যয়ী, তেমনই সপ্রতিভ। এই বলবাবুই আলাপচারিতায় রেলপথটি নিয়ে একটা প্রচলিত গল্প শোনায় দিবাকরকে।
এক ওড়িয়া আদিবাসী রমণী বিনা ভাড়ায় প্রায় প্রতিদিনই বারিপদা থেকে বাংরিপোসি যাতায়াত করে। আটত্রিশ কিলোমিটার পথ যেতে তিনঘন্টা। পথে পড়ে রাজালুকা, বুড়ামারা, কুচাই, ভঞ্জপুর আর বাঘরা রোড। আড়াই ফুটের ছোটো লাইন। প্রহরীবিহীন লেভেল ক্রসিংয়ে গাড়ি থামিয়ে গার্ড সাহেব নেমে যান গেট বন্ধ করতে। আবার ট্রেন পার করিয়ে গেট খুলে গাড়ি ছাড়ার সঙ্কেত দেন, এটাই দস্তুর। বিনা উর্দির টিকিটবাবুর সহায়তায়, বিনা ভাড়ায় আদিবাসী রমণীটির অবাধ যাতায়াত। একদিন সকালে এক রেলকর্মী দেখল আদিবাসী মহিলাটি ট্রেনে না চড়ে পায়ে হেঁটে বাংরিপোসি রওনা দিয়েছে। রেলকর্মী তাকে হেঁকে জিজ্ঞাসা করল,
'কন হেলা, আপনি আজি চালি চালি যাউচ-মামুর গাড়ি নাহি কি?' ('ব্যাপার কী? আপনি আজ পায়ে হেঁটে যাচ্ছ? মামার গাড়ি নাই কি?')
ওড়িয়া রমণীটিও হেঁকে জবাব দেয়,
'আজি টিকে শীঘ্র জিবার অছিতো; সেহি পাই চালি চালি যাউছি।' (আজ একটু যাওয়ার তাড়া আছে। তাই পায়ে হেঁটেই যাচ্ছি।)
বলবাবুর মুখে দ্বিতীয় গল্পটা দিবাকর শুনেছিল 'ফুলেশ্বরী' ছবির শ্যুটিং নিয়ে। সে এক মজার গল্প। তরুণ মজুমদার 'ফুলেশ্বরী' ছবির শ্যুটিং করছিলেন এই লাইনে। শ্যুটিংয়ের আগে দক্ষিণ-পূর্ব রেলের সদর দপ্তর থেকে তিনি একটা বাষ্পীয় ইঞ্জিন মঞ্জুর করিয়ে নেন। ইঞ্জিনচালক অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান সাহেব, সহচালক দেহাতী, ভারতীয়। এক নামগোত্রহীন লেভেল-ক্রসিং-এর লাগোয়া গাঁয়ের মুখরা মেয়ে ফুলেশ্বরী দাসী। ভারী ডাগর দুটি চোখ তার। সিনেমা তো নয়, সে যেন এক রূপকথা। গ্রাম্য জীবনের পটভূমিতে এক মর্মস্পর্শী প্রেমের গল্প জমে উঠেছে। এর সাথে মন কাড়া গান--ফুলেশ্বরী ফুলেশ্বরী ফুলের মত নাম।
শ্যুটিং চলছিল বেটনোটিতে। সাঁওতাল অধ্যুষিত গ্রাম। রূপসায় তেমন কোন থাকার জায়গা নেই বলে সমস্ত শ্যুটিং ইউনিটটা নিয়ে বারিপদায় উঠেছিলেন মজুমদার সাহেব। রেলপথটি তখন 'ওয়ান-ট্রেন ওনলি' সিস্টেমের অধীনে। অর্থাৎ একটা ট্রেন লাইনে প্রবেশ করলে অন্য ট্রেনের ছাড়পত্র মেলে না। অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান চালকের ভূমিকায় ছিলেন তরুণকুমার। নাবিক-নীল শার্ট আর প্যান্টুলুনের উর্দিধারী মানুষটিকে দুর্দান্ত মানিয়েছিল। মাথায় ছিল নীল রুমালের ফেট্টি। কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি ইঞ্জিন চালানোর খুঁটিনাটি আদব কায়দা পুরোপুরি রপ্ত করে নিলেন। এদিকে পুরোদস্তুর শ্যুটিং চলছিল, কিন্তু অসুবিধা ছিল অনেক। সেই নামগোত্রহীন লেভেল-ক্রসিংয়ে নাগরিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের বড়ই অভাব। কিছু একটা অসুবিধা হলেই কুড়ি কিলোমিটার দূরের বারিপদায় জীপ ছোটাও। একদিন দুপুরে এইরকমই একটা প্রয়োজনে তরুণকুমার জীপ চাইলেন মজুমদার সাহেবের কাছে। মজুমদার সাহেব বললেন, 'জীপ তো কিছুক্ষণ আগেই চলে গেছে বারিপদায়।' অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান সাহেব হেসে বললেন, 'কুছ পরোয়া নেহি, আমি ইঞ্জিনটা নিয়েই চলে যাচ্ছি।' ইউনিটের সবাইকে হতবাক করে তরুণকুমার হুইসিল বাজিয়ে বাষ্পীয় ইঞ্জিনটা চালিয়ে বারিপদা চলে গেলেন।
তালবন্দ দিয়ে শুরু করেছিলাম, তালবন্দ দিয়েই শেষ করব। একটিমাত্র লো-লেভেল প্লাটফর্ম নিয়ে বিষাদগ্রস্ত রেলস্টেশন তালবন্দ। রেলপথ রয়েছে যেন ট্রেন আসার প্রতীক্ষায়। বাংরিপোসি থেকে তালবন্দ মাঝে মাত্র তিনটে রেলস্টেশন। কাঠ-ব্যবসায়ীদের জন্য এ পথে যাওয়া আসা করে ওয়াগন নিয়ে মালগাড়ি। তার মধ্যেই একটা যাত্রীবাহী কোচ। সওয়ারি শতকরা নব্বইভাগ আদিবাসী--সাঁওতাল, মুণ্ডা, ভিল, লোধা। কিন্তু টিকিট চাওয়ার নিয়ম নেই। দুবেলা দক্ষিণ-পূর্ব রেল কিছু ক্ষতি স্বীকার করেও একটা আপ আর একটা ডাউন গাড়ি চালায়। দিবাকর বুকিং কাউন্টারের সামনে এসে দাঁড়াল। বুকিং ক্লার্কের খোঁজ পাওয়া গেল না--সেখানে চড়াই পাখি তার বাসা তৈরি করেছে ডিম পাড়বে বলে, মাকড়সা জাল বুনেছে, প্রজাপতি উড়ে এল নাকের ডগায়। মৌমাছিরা একটা মৌচাক সযত্নে রচনা করেছে কাউন্টারের ঠিক উপরে। জনমানবহীন টিকিট ঘরের ঘুলঘুলি। কিছুক্ষণ থাকার পর দিবাকরের ভূতের ভয় শুরু হল।
অনেক খোঁজার পর বুকিং ক্লার্ককে পাওয়া গেল আমগাছের ছায়ায় রেল-কোয়ার্টারে। সেখানে উঠোনে ময়ূর ঘুরে বেড়াচ্ছে অলস, মন্থর পায়ে। এখানে বুকিং ক্লার্ক, স্টেশন-মাস্টার, পয়েন্টম্যান, পোর্টার একজনই। তবু ক্লার্কবাবুটি অবসরে দুপুরের ভাতঘুমটি সেরে নিচ্ছিল। দিবাকরের চোখে সানগ্লাস, হাতে ফোলিও-ব্যাগ, কেতাদুরস্ত জামা-প্যান্ট—এত ভাল দেখাচ্ছিল যে বুকিং ক্লার্কটি ধড়মড় করে উঠে বসল। দিবাকরকে সে ভেবেছে রেলের বড়বাবু। কৈফিয়তের সুরে বলে,
'আজি টিকে দেহ ভাল নাহি'। (আজ শরীরটা তেমন ভাল নেই)।
দিবাকর আশ্বস্ত করে বলে,
'আমি রেলের কেউ নই। আমি একজন সখের ভ্রমণবিলাসী। তবে ভিন্ন ধরনের।'
এর পরই বন্ধুত্ব জমে ওঠে। মানুষ মানুষের সঙ্গ চায়। ক্লার্কবাবুর নাম মিহির দাস। বাড়ি খুর্দা। শান্তিনিকেতনে পড়াশুনো। স্নাতকোত্তর পড়াশুনো করেও রেলের বুকিং ক্লার্ক। কিন্তু সেও এক মজার মানুষ। বলে, এ লাইনের বুকিং ক্লার্করা প্রায় সবাই হাই তুলে তুলে 'পাখির ডাকে ঘুমিয়ে পড়ে, পাখির ডাকে জেগে।' প্রসঙ্গক্রমে এসে গেল তালবন্দে ভঞ্জরাজাদের শিকার খেলার গল্প। অরণ্য যেখানে গভীর হয়েছে সেখানে কেওনঝাড়ের পথে খৈরী নদী আর ঘাঘরা জলপ্রপাত। সেখানে মহারাজারা পারিষদ নিয়ে যেতেন হান্টিং-এ। মহারাজা পূর্ণচন্দ্র ভঞ্জ, প্রতাপচন্দ্র ভঞ্জ, কৃষ্ণচন্দ্র ভঞ্জ, রামচন্দ্র ভঞ্জ। মহারাজা রামচন্দ্রের কর্মস্থলে অর্থাৎ মহাকরণের বেশিরভাগ কর্মীই ছিলেন বাঙালি। এর মধ্যে একজন ছিলেন ভূ-বিদ্যায় পণ্ডিত। এমনকি রাজা রামচন্দ্র বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হয়েছিলেন কোলকাতার সঙ্গে।
ডিসেম্বরের প্রচণ্ড শীতে কোলকাতা থেকে এলেন রাজার শালা ও শালার বন্ধুরা। শিকারের তোড়জোড় শুরু হল। তালবন্দের গভীর অরণ্যে দুটো মাচা বাঁধা হল। একটা ছাগলকে বেট বানিয়ে গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে দুপুর থেকে। মাথার উপরকার স্তব্ধ আকাশের বুকে কালো রেখা কেটে প্যাঁচার ঝাঁক যখন ঝটপট করে উড়ে গেল, যখন জঙ্গলে সন্ধ্যার অন্ধকার জেগে উঠল, রাজা তখন মাচায় উঠে বসলেন। অপর মাচাটিতে সবান্ধব শালারা। সঙ্গে বাঘমারা বন্দুক আর বিলাইতি দাওয়াই। এ অঞ্চলে শিমলিপালের অভয়ারণ্য থেকে বাঘের আসা-যাওয়া। রাত গভীর হল। এসময় সাধুর বিশ্রামের সময়, শয়তানের জাগরণের লগ্ন। রাত ঘনিয়ে আসতেই রাজার লোকেরা ছাগলের কান দুটো বেশ করে মুড়ে পেঁচিয়ে দিয়েছে। বেচারা তারস্বরে চিৎকার শুরু করে দিয়েছে। রাজার গায়ে কালো অলেস্টার। নিকষ কালো অন্ধকারে কাউকে দেখার উপায় নেই। প্রায় দু-আড়াই ঘন্টা চুপচাপ বসে থাকার পরও বাঘের টিকি দেখতে পাওয়া গেল না—গর্জন তো দূরের কথা। রাজার শালারা অধৈর্য হয়ে উঠেছে। চারিদিকে নিস্তব্ধতা, হঠাৎই জঙ্গলে খসখস পাতার আওয়াজ। বড় জন্তুর কাছে আসার স্পষ্ট লক্ষণ। পরমুহূর্তে বিশাল এক ভাল্লুক গাছের অন্ধকার ফুঁড়ে বেরিয়ে এল। একবার ঘাড় ঘুরিয়ে বাঁধা ছাগলটার দিকে তাকিয়ে ঠিক মানুষের মত পায়ে হেঁটে রাজার মাচাটার দিকে এগিয়ে গেল। রাজার শালার কাছে টার্গেট করার জন্য এই কটা মুহূর্তই যথেষ্ট। সঙ্গে সঙ্গে রাইফেলের কান-ফাটানো দু-দুটো আওয়াজ রাজার নিতম্ব ফুঁড়ে দিল।
গল্পের খেই হারিয়ে দিবাকর জিজ্ঞাসা করল,
'ওটা ভাল্লুক ছিল না?'
'না বন্ধু, ভালুক নয়, ছিলেন রাজা নিজে।'
'কী করে হল?'
মিহিরবাবু একটা গুঠ্কা পান মুখে পুরে বলল,
'প্রায় ঘন্টা দুয়েক মাচায় বসে থাকার পর রাজার শু শু পেয়ে যায়। আগেই সাবধান করা ছিল যে রাতবিরেতে বাথরুম করতে কেউ যেন মাচা থেকে না নামে—কারণ, যখন তখন তালবন্দের বুনো হাতি তাড়া করতে পারে। রাজা সেকথায় মোটেই আমল দেননি। ফলে যা হওয়ার তাই হল। শিকার করতে এসে রাজা নিজেই শিকার হয়ে গেলেন।'
দিবাকর বলল, 'তারপর?'
মিহিরবাবু বলল,
'তারপর থেকে তালবন্দের জঙ্গলে শিকার বন্ধ হয়ে গেল।'
(ক্রমশ)