• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬১ | ডিসেম্বর ২০১৫ | উপন্যাস
    Share
  • সন্ধ্যাবেলা : সাবর্ণি চক্রবর্তী



    রমা তার জন্যে রান্না করছে—এতক্ষণে হয়তো করেও ফেলেছে। মহেশ এক হিসেবে ভাগ্যবান—সরমার হাতের রান্না রোজ খেতে পায়। সরমার রান্নার হাত অসাধারণ। ওর রান্না গাছপাঁঠা গেলে কেউ আর কোনদিন চারপেয়ে পাঁঠা খেতে চাইবে না। ওর তৈরী মোচার ঘণ্ট, লাউ চিংড়ি, ভাপা ইলিশ—সে সব খাওয়া একটা স্বর্গীয় অনুভূতি। একমাত্র কাশী খানিকটা ওর কাছাকাছি যায়—তাও সব রান্নাতে নয়।

    সরমা তার জন্যে অপেক্ষা করে আছে। মহেশ বলেছে। অবশ্য সোজাসুজি বলে নি—একটু ঘুরিয়ে বলেছে। সূর্যশেখর সরমাকে খুব ভালই জানেন—তিনি আজ রাতে না গেলে সরমা দু:খিত হবে—কিন্তু চিরকাল বুকের ভেতর ব্যথাটা চেপে রাখবে—মুখ ফুটে কোনদিন বলবে না। বহুদিন আগেই সরমা সূর্যশেখরকে নিজের স্বামীর জায়গায় বসিয়ে নিয়েছে—মহেশ কোনদিনই সে জায়গায় ছিল না, থাকার যোগ্যও নয় দেবীপূজার মন্ত্রপড়া লোকটা। সরমাকে মনে করার চেষ্টা করলেন সূর্যশেখর। আশ্চর্য – এত চেনা মুখটা মনে পড়ছে না। অথচ গত কালীপূজোর সময়েই তো ওর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাটা আবার চাগিয়ে দিয়ে গেছেন সূর্যশেখর। সরমার মুখ মনে করতে না পারায় নিজের ওপর রেগে যেতে লাগলেন সূর্যশেখর। তারপরই ঠিক করে ফেললেন মহেশের বাড়ি যাবেন – এখনই। এ ঘরের দেওয়ালেও টাঙানো পরলোকগতা স্ত্রীর একটা বড় ছবি – বিশু একটা রজনীগন্ধার মালা এনে তাতে পরিয়ে দিয়েছে – গন্ধে ভুরভুর করছে সারা ঘর। সেদিক তাকিয়ে সূর্যশেখর বিড়বিড় করলেন, মাপ করো সুনয়নী, আমাকে মহেশের বাড়ি যেতে হবে। এখন—এখনই। চাকরদের ডাকার জন্যে হাতের কাছেই ঘন্টি রয়েছে। তাতে অধৈর্য হাতের চাপ দিলেন। বিশু দৌড়ে এল। হুকুম হল মহেশের বাড়ি যেতে হবে—তুরন্ত তার ব্যবস্থা করতে।

    গাড়ি ঘোড়ার বড় রাস্তা থেকে এই গ্রাম আর তার ভেতরের জমিদারবাড়ি আসার জন্যে মোটর গাড়ির পিচ ঢালা রাস্তা রয়েছে। কিন্তু গ্রামের ভেতর যাওয়া আসার জন্যে বা আশেপাশে কোথাও যাবার জন্যে মোটরের পক্ষে সেরকম সুবিধেজনক রাস্তা নেই। কাজেই এখানে আসবার পর প্রভুদয়াল একরকম বেকারই বসে থাকে—রমার কথা ভেবে উষ্ণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে—গ্রামের কয়েকটি বিধবা বা স্বামী পরিত্যক্তা প্রগলভা মধ্যবয়স্কা নারীর কাছে গিয়ে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটায়। সুর্যশেখর তার সাবেকি ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহার করে থাকেন। জমিদারবাড়ি থেকে বিধূভূষণ আর মহেশের বাড়ি পর্যন্ত চওড়া এবং ভাল করে দুরমুশ করা লাল মোরামের রাস্তা রয়েছে—জমিদারি সেরেস্তার টাকায় বানানো। কর্তার হুকুম পেয়ে কোচম্যান রামদীন পত্রপাঠ গাড়িতে দুই ঘোড়া জুতে ফেলল—গাড়িতে উঠলেন সূর্যশেখর। গাড়ির পেছনের পাদানিতে উঠল বিশু। রাস্তা অন্ধকার বলে চারজন চাকর দুসারিতে দুজন করে দুহাতে দুটো বড় টর্চ বাতি নিয়ে হাঁক দিতে দিতে গাড়ির সামনে সামনে ছুটে চলল। রামদীন, বিশু – দুজনের কাছেই টোটা ভরা দুনলা বন্দুক—আরও টোটা সঙ্গে আছে। গাড়ির ভেতর সূর্যশেখরের কাছেও রয়েছে টোটা ভরা ছ ঘরা বিলিতি পিস্তল। অবশ্য কর্তাবাবুর গাড়িতে ডাকাত পড়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে—এত সাহস এ তল্লাটের কোন ডাকাতের হবে না। তবুও—সাবধানের মার নেই। এ সব আগ্নেয়াস্ত্রের জন্য সূর্যশেখরের লাইসেন্স নেয়া আছে—সেই ইংরেজ আমল থেকেই। এ সব ব্যাপারে বেআইনি কিছু করে কোনও বদমাসকে নালিশ করতে দেবার সুযোগ করে দিতে রাজী নন সূর্যশেখর।

    মহেশের বাড়ি বিশেষ দূরে নয়—পাঁচ সাত মিনিটে পৌঁছে গেল গাড়ি। আওয়াজ শুনে বাড়ির ভেতর থেকেই মহেশ বুঝেছিল কর্তা আসছেন। হাতজোড় করে গাড়ি থেকে নামিয়ে সূর্যশেখরকে বাড়ির মধ্যে নিয়ে গেল মহেশ। গাড়ি নিয়ে লোকলস্কর গেটের বাইরে বসে গুলতানি করতে লাগল। কর্তার বেরোতে রাত হতে পারে। সারা রাতও এখানেই থাকতে পারেন কর্তা। অবশ্য সেরকম হলে ওদের কাছে নির্দেশ আসবে ফেরৎ যাবার জন্যে। আবার সকালে এখানে আসতে হবে। তবে বন্দুকধারিরা মোতায়েন থাকবে মহেশের বাড়ির বাইরে—কাঁধে বন্দুক আর হাতে টর্চ নিয়ে সারা রাত বাড়ির চারপাশে ঘুরে ঘুরে পাহারা দেবে। রামদীনের কাছে বন্দুক আছে বলে সে থাকবে। রামদীনের সাকরেদ হারাণ—ঘোড়াগুলোর সঙ্গে পরিচিত—কাজেই সে গাড়িটা ফেরৎ নিয়ে যাবে—পরের দিন সকালে আবার নিয়ে আসবে। ঘোড়াগুলোকে দানাপানি দিতে হবে। মহেশের বাড়িতে ঘোড়াকে খাওয়াবার মত কোন ব্যবস্থা নেই। তবে কর্তা রাতে এখানে খাবেন সেটা সবাই জানে। এটা একটা বাঁধাধরা নিয়ম। ওরা এটাও জানে যে কর্তা এখানে খেলে এখানে আরও দশজনের রান্না হয়—ওরাও আজ রাতে খেতে পাবে এখানে।

    বাড়িতে ঢুকতেই একটি বছর সতের আঠেরোর মেয়ে সূর্যশেখরের পায়ের ধূলো নিয়ে প্রণাম করল। মহেশের মেয়ে শ্রীময়ী। সূর্যশেখর দু হাত দিয়ে ধরে ওকে ওঠালেন, ওর চিবুক ধরে মুখটা তুলে ধরে দেখলেন। সরমার মত ফর্সা রঙ পায় নি ঠিকই কিন্তু মেয়েটিকে যথেষ্ট উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ বলা চলে। টানা টানা দুই চোখ, ঘন চুল, মুখে একটা শান্ত লক্ষ্মীশ্রী রয়েছে—যেটা ওর মায়ের থেকে পেয়েছে। গড়ন ছিপছিপে হলেও যৌবন এর মধ্যেই ভাল করে বাসা বাঁধছে শরীরে। মহেশ – সরমার আর কোন ছেলেমেয়ে নেই—আসলে হতে দেওয়া হয়নি। বার দুই সরমার গর্ভ হয়েছিল। সূর্যশেখরের কাছে ঐ খবর আসার সঙ্গে সঙ্গে তিনি মহেশকে হুকুম দিয়েছিলেন কলকাতায় নিয়ে এসে সরমার গর্ভপাত করাতে। বলা তো যায় না—যদি গর্ভস্থ ভ্রূণটির জনক সূর্যশেখরের হয়ে থাকেন? সেক্ষেত্রে সূর্যশেখরের ঔরসজাত সন্তান মহেশ ভটচাযের পিত্বপরিচয় নিয়ে বেঁচে থাকবে—তা বিলকুল নামঞ্জুর। তবে সূর্যশেখর এই মেয়েটিকে অত্যন্ত স্নেহ করেন—শ্রীময়ী যখন ছোট ছিল সেই সময় থেকেই।

    সন্তান যেহেতু মেয়ে তাকে লেখাপড়া শেখাবার গরজ মহেশের একেবারেই ছিল না। সূর্যশেখর মহেশকে চাপ দিয়ে শ্রীময়ীকে লেখাপড়া শেখাবার ব্যবস্থা করেছেন। মেয়েটি মেধাবী এবং বুদ্ধিমতী—ম্যাট্রিক পাশ করেছে—এখন আই এ পড়ছে। ওর পড়াশোনার সব খরচ দিয়েছে জমিদারি সেরেস্তা—অবশ্য মহেশকে ধার হিসেবে। তবে মহেশকে দেওয়া অন্যান্য ধারের মত এই ধারও শোধ হয়নি। সুদের ওপর সুদ জমা পড়ে সেরেস্তার খাতায় মোটা—আরও মোটা হয়েছে। সাবেকি পড়াশোনা ছাড়াও মেয়েটিকে আলাদা করে ইংরেজী শেখানো হয়েছে—আর শেখানো হয়েছে জমিদারি সেরেস্তার হিসেব। এই সেরেস্তার হিসেব মহেশের মেয়েকে শেখানো নিয়ে বিধুভূষণ একটু মাথা চুলকে মৃদু আপত্তি জানাবার চেষ্টায় ছিল। সূর্যশেখরের ভ্রূকুটি দেখে একেবারে চুপ করে গিয়েছিল। মেয়েটিকে এত লেখাপড়া শেখাবার আসল কারণটা জানেন সূর্যশেখর নিজে। বিধুভূষণ আর মহেশও হয়তো তাদের ধূর্ত বুদ্ধি দিয়ে কারণটা আন্দাজ করতে পেরেছে। হয়তো সরমাও। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলা তো দূরে থাক, একটা ইঙ্গিত করার সাহসও বিধু বা মহেশের নেই। সরমার কথা আলাদা। ওর মুখ দিয়ে কখনো এসব কোন কথা বেরোবে না। সূর্যশেখর ঠিক করে রেখেছেন এই মেয়েটিকে ছেলের বৌ করবেন। খালি চন্দনের একটু সুস্থ হয়ে ওঠার অপেক্ষা। মহেশ আর সরমা অত্যন্ত খুশি হয়ে রাজি হবে। সরমা তো কোন প্রতিবাদ করবেই না, মহেশও নয়। তাছাড়া মহেশ সূর্যশেখরের হাতের মুঠোর মধ্যে। পুরুৎটা বিন্দুমাত্র ট্যাঁ ফোঁ করলেও একটা পিঁপড়ের মত তিনি ওকে টিপে মেরে দেবেন—সেটা মহেশ জানে। আর শ্রীময়ীও খুশিমনে রাজি হবে সেটা সূর্যশেখর জানেন। ও তাকে বাবার মত ভালবাসে আর ভক্তি করে—ওর টানা টানা দুচোখের চাউনিতে সূর্যশেখর তা পরিষ্কার দেখতে পান। শ্রীময়ী যে ধাতের মেয়ে তাতে তাকে বিয়ে করলে চন্দনের অসুস্থতা আর ফিরবে না বলেই সূর্যশেখরের বিশ্বাস। পরে দরকার পড়লে শ্রীময়ীও চন্দনের সঙ্গে জমিদারি চালাতে পারবে। মহেশ এক লম্বা গোল করে গোটানো কাগজে কলকাতা থেকে শ্রীময়ীর কোষ্ঠী করিয়েছে। সূর্যশেখরকেও দেখিয়েছে। অনেক কিছু হিজিবিজবিজ লেখা আছে। সূর্যশেখর খালি কোষ্ঠির ফলে যা লেখা আছে সেটুকু পড়ে বুঝতে পেরেছেন। এক জায়গায় রয়েছে—জাতিকা অসীম সৌভাগ্যবতী—গুরু ও চন্দ্র রাজরানি হইবার যোগ করিয়াছে। সূর্যশেখর এ সবে খুব একটা বিশ্বাস করেন না। কিন্তু শ্রীময়ীর বেলায় এই ফলাদেশটা তার বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয়েছিল।

    সূর্যশেখর আরও একটা কথা ভেবেছেন। এই বিয়ে হলে চন্দন সরমাকে পাবে মা হিসেবে—ওর মায়ের ঘাটতি আর থাকবে না। সরমা বুক দিয়ে আগলে রাখবে চন্দনকে।

    দুটো প্যাকেট সূর্যশেখরের সঙ্গে থাকার কথা ছিল। যতবার তিনি মহেশের বাড়ি এসেছেন দুটো উপহারের প্যাকেট মা আর মেয়ের জন্যে থাকে। শাড়ি, সোনার গয়না। শ্রীময়ীর মাথায় হাত রেখেই খেয়াল হল যে এবার সে দুটো নেই। তার সঙ্গে কলকাতা থেকে এসেছে ঠিকই, কিন্তু জমিদারবাড়িতেই থেকে গিয়েছে। অত্যন্ত অপ্রস্তুতভাবে শ্রীময়ীকে বললেন সূর্যশেখর, এহে হে, একটা ভুল হয়ে গিয়েছে। তোমার উপহারটা বাড়িতে ফেলে এসেছি। কাল সকালে পাঠিয়ে দেব – কেমন?

    শান্ত হাসিতে শ্রীময়ীর মুখ ভরে গেল। ও বলল, না পাঠালেও কোন ক্ষতি নেই, জেঠু। প্রত্যেকবারেই তো আপনার কাছ থেকে উপহার পাই। আপনার দেওয়া সব শাড়ি তো আমি এখনও পরেই উঠতে পারি নি।

    কিন্তু সূর্যশেখর বিরক্ত হয়েছেন চাকরদের ওপর। এতগুলো লোক রয়েছে কোন একজনের তো উচিৎ ছিল মনে করে প্যাকেট দুটো ঘোড়ার গাড়িতে তুলে দেওয়া। সব অপদার্থের দল—খালি খানাপিনায় ওস্তাদ। সূর্যশেখর ভাবতে শুরু করেছিলেন কাকে বরখাস্ত করা উচিত এমন সময় শ্রীময়ী আবার অল্প হেসে বলল, ঐ দেখুন, বিশুর হাতে কি !

    সূর্যশেখর ঘুরে তাকিয়ে দেখলেন বিশু ঘরে ঢুকে এসেছে। ওর দু হাতের তালুর ওপর দুটো প্যাকেট—একটার ওপর আর একটা সাজানো। সূর্যশেখর ওগুলো সঙ্গেই এনেছিলেন—তারপর সরমার কথা ভাবতে ভাবতে চাকরদের ওগুলো নামাতে বলতে ভুলে গিয়েছিলেন। মুহূর্তে সূর্যশেখর খুশি হয়ে উঠলেন। বিশেষ করে বিশুর ওপর। চন্দনের বিয়েটা হয়ে গেলেই ওর মাইনে ডবল করে দেবেন তিনি। আশা করা যাচ্ছে মোটামুটি সুস্থ হতে চন্দনের আর বেশীদিন লাগবে না। ছেলের অবস্থা সম্পর্কে নিয়মিত খবর আসছে তার কাছে। নীলমাধব খবর পাঠাচ্ছে—রামুর থেকে জেনে নিয়ে। চন্দনের ব্যবহার অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে। মনে হয় আর কিছুদিন এভাবে চললে চন্দনকে লোকজনের সামনে বার করা যাবে।

    মহেশের বাড়িটা মোটামুটি বড়। মহেশ আর সরমার একটা শোবার ঘর, শ্রীময়ীর একটা শোবার আর একটা পড়ার ঘর। বড়গোছের একটা বসার ঘর—রান্নাঘরের পাশে আলাদা খাওয়ার ঘর। মহেশের শোবার ঘরের লাগোয়া একটা ছোট কিন্তু গোছানো বাথরুম—কলকাতার ইঞ্জিনিয়ারের প্ল্যান করা আর বানানো। সূর্যশেখর এখানে এলে এই ঘরে রাত কাটিয়ে যাবেন—আর মহেশ বসার ঘরটায় শোবে—একথা মাথায় রেখেই এই অতিরিক্ত বাথরুমটা বানানো হয়েছিল। অবশ্য সবই সেরেস্তার টাকায়। নামে ধার—ধার শোধবার কোন ব্যাপার নেই।

    রাতে খাওয়ার পর সূর্যশেখর শোবার ঘরে এলেন। মহেশের বিছানায় শুয়ে পড়ে একটা সিগারেট ধরালেন, কিন্তু তাতে কোন টান দিলেন না। সরমার রান্নার অপূর্ব স্বাদ এখনও মুখে লেগে আছে—এঁচোড়ের ডালনা, নারকোল দিয়ে মোচার ঘন্ট, চিংড়িমাছের মালাইকারি—সিগারেটের ধোঁয়ায় ঐ স্বাদ নষ্ট হোক সেটা চাইছিলেন না তিনি। রাত হয়েছে—এই রাত আর একটু ঘন হলে—চারপাশের নিস্তব্ধতার ভেতর ঝোপ ঝাড়, গাছপালাতে ঝিঁঝিঁর ডাক আরও ঘোরালো হলে সরমা এসে ঘরে ঢুকবে। শ্রীময়ী নিজের ঘর থেকে মায়ের এই নৈশ অভিসার দেখতে পাবে না। ওর ঘরটা সেরকমভাবেই তৈরী। কিন্তু ও সব কিছুই জানে। ও ছোটবেলা থেকে এই ব্যাপারটা দেখে এসেছে—এটা এখন ওর কাছে কোন অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। বরং কোনদিন যদি এমন হয় যে মা জেঠুর কাছে না গিয়ে বসার ঘরে শুতে গেল তাহলেই ও অবাক হবে—এই অঘটনের জন্যে হয়তো একটু ভয়ও পাবে। ছাইদানিতে রাখা সিগারেটের ধোঁয়া একটা মোটা আধা স্বচ্ছ সূতোর মত ওপরের দিকে উঠছিল—খাটের ছত্রির সঙ্গে লাগানো মশারিতে আটকে যাচ্ছিল। যদিও ঘরে ধূনো দেওয়া হয়েছে মশা অল্প অল্প আছে—সেজন্যে মশারির ব্যবস্থা। সূর্যশেখরের ঘুমোবার আগে এই মশারি ফেলে খাটের পাশে গুঁজে দেওয়া হবে। সে কাজটা সরমাই করবে কারণ তখন ও ঘরে সরমা ছাড়া সূর্যশেখরের সঙ্গী হিসেবে আর কেউ থাকবে না।

    মহেশ ঘরে ঢুকল। রান্নাঘর গুছিয়ে তুলে এদিকে আসতে সরমার এখনও একটু দেরী আছে—মহেশ সেটুকু সময়ের পুরো ফায়দা তুলতে চায়। সে খাটের পাশে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে নানা নালিশ ফরিয়াদ করতে লাগল - মন্দিরের খরচা বেড়েছে, বিধুভূষণের থেকে খরচা আদায় করা কঠিন কাজ, কয়েকটা অল্পবয়েসী ছেলে বদমায়েসী করে মন্দিরের পেছন দিকটার ঝোপে হিসি করে দিয়েছে, একজন পূজারী মন দিয়ে কাজ করছে না, বারবার বলাতেও বিধুভূষণ তাকে বরখাস্ত করছে না, সেই পূজারীর বিধবা বোনটা আসলে বিধুর সঙ্গে -। সূর্যশেখর ওর কথা এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বার করে দিচ্ছিলেন। এ বাড়িতে তিনি মহেশের সঙ্গে কথা বলতে আসেন না—আসেন সরমার টানে। হঠাৎ তিনি ধৈর্য হারিয়ে ফেললেন। সিগারেটটা ছাইদানিতে ঘষে নিভিয়ে দিয়ে বললেন—আচ্ছা, আচ্ছা, সব শুনেছি। এখন আপনি যান, পরে আবার কথা হবে। তারপর মহেশের দিকে হাত নেড়ে তাকে বিদায় হতে বললেন। মহেশ কপালে জোড়হাত ঠেকিয়ে কর্তাকে প্রণাম করল, তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সূর্যশেখর একটা নি:শ্বাস ফেললেন। এইবার সরমা আসবে। খাওয়ার সময় ও পরিবেশন করছিল। তখন থেকেই তিনি ওকে কাছে পাওয়ার তাগিদ অনুভব করছিলেন। সূর্যশেখর হাতের ঘড়ি দেখলেন। আর কতক্ষণ? দশ মিনিট? দশ মিনিটের ভেতর আসবে কি সরমা?

    সরমা এল। দশ মিনিট পার হয়ে যাবার আগেই এসেছে। ও ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে খিল লাগিয়ে দিল, তারপর পায়ে পায়ে খাটের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। সূর্যশেখর সরমাকে দেখছিলেন। অল্প একটু সেজেছে সরমা—চোখে কাজল, কপালে দেশলাই কাঠির ডগায় করে দেয়া খুব ছোট একটা সিঁদুরের টিপ। যদিও সরমা এমনিতে পান খায় না, ঠোঁট রাঙাবার জন্যে একটুখানি পান চিবিয়ে নিয়েছে। ফর্সা, সুন্দর মুখটা—এই সামান্য সাজটুকুর জন্যে আরও সুন্দর লাগছে। সূর্যশেখর একই সঙ্গে সরমার জন্যে তীব্র মায়া আর ভালবাসা অনুভব করলেন। কতই বা বয়েস ওর, জোর বছর পঁয়ত্রিশ। ওরও তো একটু সাজ গোজ করার ইচ্ছে হয়, আর একমাত্র সূর্যশেখর এখানে এলেই ও একটু সাজে। সাধারণ একটা লাল পাড় আর তাঁতের শাড়ি পড়ে আছে সরমা—ব্লাউজের বদলে আঁচলটা দু বার করে বুকের ওপর সাজানো। সূর্যশেখর ওর সৌন্দর্য এবং আকর্ষণীয় যৌবন দু চোখ ভরে দেখছিলেন। সরমা যে সূর্যশেখরের প্রেমিকা হয়ে পড়েছে সেটাই হওয়া উচিৎ ছিল। মহেশ কোনভাবেই এই মহিলার উপযুক্ত নয়—হতে পারে না—

    খাট থেকে নেমে পড়ে সরমাকে কাছে টেনে নিলেন সূর্যশেখর। ওর নরম এবং পরিপূর্ণ যৌবনের শরীরটাকে নিজের বুকে শক্ত করে চেপে ধরে মৃদু অথচ গভীর গলায় ডাকলেন, সরমা।

    সরমা সূর্যশেখরের দিকে মুখ তুলে ধরল। ওর প্রেমিকের আদর আগ্নেয়গিরি থেকে ছুটে বেরোল লাভার মত—ও এখন তার অপেক্ষায় আছে। ওর মুখ থেকে শীৎকারের মত আওয়াজ। বেরোল, বলুন।

    কিন্তু সূর্যশেখর সরমার মুখ আর দেখতে পেলেন না। সে জায়গায় একটি শ্যামাঙ্গী যুবতী, তার যৌবন উদ্ধত এবং সুগঠিত, মদের নেশায় দুটো বড় বড় টানা টানা চোখ ঈষৎ লালচে, আর সেই চোখে আমি তোমাকে থোড়াই পরোয়া করি—এই ভাষাটা পরিষ্কার। সরমাকে ছেড়ে দিলেন সূর্যশেখর—এক পা পিছু হটে গেলেন। সামনে পরিষ্কার সরমা দাঁড়ানো—আর কোন নারী সেখানে নেই—থাকার প্রশ্নই ওঠে না—সরমা মুখে চুপ কিন্তু তার চোখে জিজ্ঞাসা—কি হল?

    সূর্যশেখর মাথা নিচু করলেন। বললেন, সরমা আজ আমি বাড়ি ফিরে যাচ্ছি। শরীরটা কেন জানি না একটু খারাপ লাগছে—এখানে গরমও লাগছে খুব। আমি মহেশকে বলে যাচ্ছি—কাল সন্ধ্যেবেলা ও তোমাকে আমার ওখানে নিয়ে যাবে।

    সরমা সূর্যশেখরকে খুব ভালই চেনে। সূর্যশেখর মিথ্যে কথা বললে ওর তা ধরে ফেলতে কোন অসুবিধে হয় না। বিশেষ করে ঐ গরম লাগার কথাটা। ঘরে এসি নেই ঠিকই, কিন্তু জানালায় জানালায় খসখস লাগানো রয়েছে—সারাদিন ধরে সেই খসখস জলে ভিজিয়ে ঘর ঠান্ডা করা হয়েছে। কিন্তু কথা বাড়ানো সরমার স্বভাব নয়। ও খালি নিজের চোখের কোণে জমা জল শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে নিল—ঘাড় কাৎ করে মাথা হেলিয়ে দিয়ে বলল, আচ্ছা।

    সূর্যশেখর পালালেন মহেশের বাড়ি থেকে। তিনি একা থেকে নিজের মনে চিন্তা করতে চাইছিলেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন যে ঐ মেয়েটা—বাজারের মেয়েটা—তার মনের ভেতর একেবারে চেপে বসে যাচ্ছে। একা একা চিন্তা করে নিজের মানসিক শান্তির উপায় বার করতে হবে। আর তা করতে হবে আজ—এক্ষুণি। নিজের ঘরে আলো জ্বেলে বিছানায় শুয়ে সূর্যশেখর মশারির সূক্ষ্ম জালির ভেতর দিয়ে কড়ি কাঠের দিকে তাকিয়ে রইলেন—তার মন চলতে লাগল রেলইঞ্জিনের চাইতেও দ্রুত। তিনি বুঝলেন যে ঐ মেয়েটাকে নিয়ে তার ভেতর একটা প্রবল ইচ্ছে জেগে উঠেছে আর সেই ইচ্ছেটা তার যা চাই তা পাওয়ার পথ খুঁজছে। তিনি কি ঐ মেয়েটাকে ভালবেসে ফেলেছেন? না—তা হতেই পারে না। তিনি নিজেকে বোঝাতে লাগলেন কেন ঐ মেয়েকে ভালবাসার কোন প্রশ্নই ওঠে না। যে মেয়ে যে কোন পুরুষকে শরীর দিয়ে থাকে, তাকে ভালবাসবেন সূর্যশেখর? এই ভাবনাটাই তো সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য এবং অবাস্তব। সামাজিক প্রতিষ্ঠার হিসেবে কি সূর্যশেখরের সঙ্গে ঐ মেয়েটার কোন তুলনা চলে? আর মেয়েমানুষ তো সূর্যশেখরের কাছে নতুন কিছু নয়। প্রচুর মেয়েমানুষ নিয়ে খেলা করেছেন তিনি। এ মেয়েটা তো তাদের থেকে আলাদা কিছু হবে না। আসলে ঐ দুর্বিনীত মেয়েটা তাকে বিভিন্ন ভাবে অপমান করেছে—তার মন বদলা নেবার উপায় খুঁজছে। একটা মোক্ষম উপায় আছে। মেয়েটাকে সূর্যশেখরের পৌরুষের সামনে নতজানু করে বসানো—ওকে সেই পৌরুষের চাবুক মারা। ওকে পীড়ন করা—শরীরের আর মনের কষ্ট দেওয়া। মাঝে মাঝে সূর্যশেখর নিজেকে নিজের কামনার মওতার কাছে ছেড়ে দিয়েছেন—তার ধাক্কা সইতে হয়েছে তার রক্ষিতাদের—মার্গারেটকে—সরমাকে। ডুকরে ডুকরে কেঁদেছে মার্গারেট। সরমার দৈহিক কষ্ট সহ্য করবার ক্ষমতা বেশী—ও বালিশে মুখ গুঁজে দিয়েছে যাতে মুখ দিয়ে আওয়াজ না বেরোয়। এখন সূর্যশেখর চাইছেন ওই শ্যামলা মেয়েটাকে—ও সূর্যশেখরের আদর আর অত্যাচার দুইই হজম করবে—তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে তার পায়ে চুমু খাবে। হ্যাঁ তাই করবেন সূর্যশেখর। একটু সময় ভাবলেন তিনি—তারপর একটা পরিকল্পনা তার মাথায় তৈরী হয়ে গেল। মৃদু হাসি ফুটে উঠল তার মুখে—তিনি বেড সুইচ টিপে আলো নিভিয়ে দিলেন। এবার তিনি ঘুমোতে পারবেন।

    || সন্ধ্যা – ৬ ||

    দী এখানে খুব চওড়া। অন্য পাড়, তার গাছপালা দেখা যায় বটে কিন্তু তা আবছা—ঝাপসা ঝাপসা। নদীর পূব পাড়ের খানিকটা অংশ সূর্যশেখরের দক্ষিণের জমিদারিতে পড়েছে। পাড়ের এই অংশটুকু প্রায় আধমাইলটাক লম্বা। মোটামুটি সমতল এবং একটা প্রকাণ্ড, বহুদূর বিস্তৃত মাঠের লাগোয়া। পাড়ের একদিকে সূর্যশেখরের স্থানীয় বাড়ি—অন্যদিকে একটা খুব বড় বাগান। নানা ফল পাকুড়ের গাছ আছে সেখানে। এই বাগানের থেকে রোজগারে এই বাড়ির আর জমিদারি সেরেস্তার খরচা উঠে যায়। জমিদারি থেকে বাকি সব রোজগার যায় জমিদারির খাস তহবিলে।

    সন্ধ্যা আর চন্দন নদীর তীরে হেঁটে বেড়াচ্ছিল। সন্ধ্যা গাছকোমর করে শাড়ি পরেছে—আঁচল কোমরে গোঁজা। চন্দনের পরণে শর্টস—দুজনেরই পায়ে স্পোর্টস জুতো। ওরা এরকম পোষাক পরেছে যাতে ওরা হাঁটাচলার সঙ্গে সঙ্গে দৌড়াদৌড়ি ছুটোছুটিও করতে পারে। এখন বিকেলের শুরু—নদীর বুক থেকে উঠে আসা বাঁধনহীন ঠাণ্ডা হাওয়া চৈত্রের উষ্ণ দিনটাকে রমণীয় করে তুলেছে। পশ্চিমের আকাশে অনেকটা হেলে পড়া সূর্য তার ঝাঁঝ হারিয়েছে—টুকরো টুকরো এলোমেলো চেহারার সাদা সাদা মেঘ সূর্যের থেকে ধার করে লালচে কমলা রঙ গায়ে মেখে নিচ্ছে—নদীর ছোট ছোট ঢেউগুলোও হাল্কা সোনালি রঙ দেখিয়েই আবার সাদাটে হয়ে যাচ্ছে। একটা যাত্রীবোঝাই লঞ্চ নদীর বুকে একটা গভীর দাগ কেটে কেটে উত্তর পূব থেকে দক্ষিণ পশ্চিমে যাচ্ছিল। লঞ্চের ধারে দাঁড়ানো যাত্রীরা তাকিয়ে তাকিয়ে সন্ধ্যা আর চন্দনকে দেখছিল—নদীর তীরে এজাতীয় যুগলমূর্ত্তির দৃশ্য তো খুব একটা সুলভ নয়। একটু আগেই ওরা দুজনে নদীর পাড়ে একটা দৌড়ের পাল্লা দিয়েছিল। তাতে চন্দন সন্ধ্যাকে হারিয়ে দিয়েছে আর জয়ের আনন্দে খুব হেসেছে। সন্ধ্যাও হেসেছে—কিন্তু অন্য কারণে। চন্দনের মনটা পরিষ্কার হয়ে আসছে—কালো ছায়াগুলো সরে যাচ্ছে—সেটাই সন্ধ্যার আনন্দ।

    ওরা এখানে এসেছে দিন সাতেক হল। তারও বেশ কয়েকদিন আগে সন্ধ্যা নীলমাধবের মারফত সূর্যশেখরের কাছে খবর পাঠিয়েছিল যে ও চন্দনকে নিয়ে এখানে আসতে চায়। ওর মাথায় একটা ধারণা এসেছিল যে প্রকৃতি উদার এবং উন্মুক্ত—এরকম জায়গায় গেলে চন্দনের অবস্থার তাড়াতাড়ি উন্নতি হবে। ও রমার কাছে শুনেছিল যে দক্ষিণের জমিদারিতে নদীর ধার ঘেঁষে সূর্যশেখরের বাড়ি আছে। সেজন্যে এখানেই আসতে চেয়েছিল। ট্রাঙ্ক টেলিফোনে নীলমাধব মালিকের সাথে কথা বলছিল। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মালিককে বোঝাবার চেষ্টা করেছিল যে এই অনুমতি দিলে অনেক অসুবিধে হতে পারে—এমনকি দাদাবাবুর কোন বিপদও হতে পারে। কর্তা ওর কথায় কান দেন নি। অনুমতি তো দিয়েইছিলেন, তার ওপরে নীলমাধবকে দিয়েছিলেন একগাদা শক্ত শক্ত কাজের ভার। কাজগুলো যত তাড়াতাড়ি হয় শেষ করতে হবে। তারপরেই চন্দন ও বাড়িতে যাবে।

    অতএব নীলমাধব সঙ্গে সঙ্গে এখানে চলে এসেছিল, আর লোক – লস্কর পাইক – পেয়াদা নিয়ে কাজে লেগে পড়েছিল। ধারে কাছে যত সাপুড়ে – বেদে ছিল তাদের টাকা দিয়ে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল সাপ ধরার কাজে। দু দিনের মধ্যে বাগান, জমিদারবাড়ির আশপাশ, নদীর পাড়, তার লাগোয়া মাঠ—সব কিছুর থেকে সব সাপ উধাও হয়ে গেল। হয় ধরা পড়ল, নয়তো নতুন জায়গার খোঁজে পালিয়ে গেল। সাপুড়েরা এই দুদিনে ধরেছিল দুশো বাহাত্তরটা সাপ—বেশীর ভাগই নির্বিষ—অল্প কিছু গোখরো, কেউটে, জাতীয় বিষের সাপ। সাপুড়েরা খুশি—টাকা তো পেলই, তার ওপরে সাপের চামড়া বা বিষ থেকে যা রোজগার। বাগানের, নদীর পাড়ের, মাঠের, জমিদার বাড়ির পাশের জমিতে যত পারা যায় গর্ত বুজিয়ে দেওয়া হল—কলকাতা থেকে আনিয়ে পিপে পিপে কার্বলিক অ্যাসিড ছড়ানো এবং ছেটান হল এ সব জায়গায়। খালি সাপ তাড়ালেই হবে না—বিষাক্ত পোকামাকড়ও থাকতে পারে—বাগানে, মাঠের ঘাস, জমিদারবাড়ির গায়ের জমির ঝোপঝাড়ে। এ সব জায়গায় ঘাস, ঝোপ কেটে সাফ করে দেওয়া হল—বার বার ডি ডি টি স্প্রে করা হল—বিষাক্ত বিছে আর পিঁপড়েরা এই আকস্মিক বিপৎপাতে অসহায়ভাবে মারা গেল। নদীর পাড়টা পাহারা দেবার জন্য একটা ছোট অথচ দ্রুতগামী লঞ্চের ব্যবস্থা করা হল। তাতে মোতায়েন হল কয়েকজন বলবান এবং দক্ষ সাঁতারু। যদি কোনভাবে চন্দন বা সন্ধ্যা—বিশেষ করে চন্দন—জলে পড়ে যায় তাহলে সঙ্গে সঙ্গে এই সাঁতারুরা জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে লঞ্চে তুলে নেবে। লোক লস্কর পাহারার জন্য চারপাশে মোতায়েন হল। তারা একটু দূরে থেকে এই জুড়ির ওপর নজর রাখবে—কিন্তু ওরা কোন বিপদে বা অসুবিধায় না পড়লে কাছে যাবে না। সমস্ত সূর্যশেখরের নির্দেশ—এতে কোথাও কোন ফাঁক নেই। নীলমাধব কর্তার হুকুম তামিল করছিল আর মনে মনে ঐ মেয়েছেলেটার চোদ্দপুরুষের বাপান্ত করছিল। ও তো ওর মতো যথাসাধ্য ব্যবস্থা করছে। কিন্তু কোন ফাঁক দিয়ে জমিদারবাড়ির এই লখীন্দরটির যদি কিছু হয় তাহলে আর রক্ষা নেই। কর্তা নীলমাধবকে শিকে গেঁথে উনুনের ওপর ঝলসে শিককাবাব বানাবেন। নীলমাধব ভেবেচিন্তে হুকুম জারি করল—যতদিন দাদাবাবু এখানে থাকবে ততদিন সাপুড়েরা ফিরে যাবে না—জমিদারবাড়ির কাছেই তাঁবু খাটিয়ে থাকবে। রোজ সকালে আর সন্ধ্যায়—যখন দাদাবাবু বাড়ির ভেতরে থাকবে—ওরা সব জায়গায় সাপ খুঁজে ধরবে, আর পোকা মারার জন্যে ওষুধ ছেটাবে। সন্ধেবেলায় এই কাজের জন্যে ওদের জমিদারবাড়ির থেকে হ্যারিকেন লন্ঠন দেওয়া হবে। সেজন্যে শ'খানেক হ্যারিকেন কিনে ফেলল নীলমাধব। জমিদারবাড়ির জন্যে হ্যারিকেনের দরকার নেই অন্যান্য জায়গার বাড়িগুলোর মত এখানেও জেনারেটর আছে।

    সন্ধ্যার আন্দাজে ভুল হয় নি। এখানে এসে চন্দনের আরও তাড়াতাড়ি উন্নতি হচ্ছে। তিন গাড়ি বোঝাই লোক এসেছে—রামু আর রমাও রয়েছে তাদের মধ্যে। রমার ওপর সন্ধ্যাকে রোজ বড়ি খাওয়াবার দায়িত্ব—ওকে তো আসতেই হবে সন্ধ্যার সঙ্গে। এখানে আসবার সময় সন্ধ্যা আর চন্দনকে রাখা হয়েছিল মাঝখানের গাড়িতে—আগে পিছে গাড়িতে ছিল বন্দুকধারী বরকন্দাজ। এ বাড়ি আসার রাস্তাতেই চন্দন প্রকৃতির উদার বিপুলতার সঙ্গে পরিচিত হতে শুরু করেছিল। রাস্তা সরলরেখার মত ঋজু এবং ফাঁকা—গাড়ি ঘোড়া বিশেষ নেই। সে রাস্তায় হু হু করে ছুটছিল চন্দনের গাড়ি—রাস্তাটা যেন দ্রুতগতিতে এগিয়ে আসছিল ওর গাড়ির দিকে। এদিককার জমি বেশীর ভাগই একফসলী, ফসল কেটে নেবার পর রাস্তার দুধারে সে ফসলের মাঠ পড়ে আছে। বা ঠিক পড়ে নেই—এগিয়ে চলে গিয়েছে দুধারে—কতদূরে—চন্দনের এতদিন বাড়ির ভেতর বন্দী থাকা চোখ তার হদিশ পায়নি। পথের দুধারে আরও কত কি দেখছিল চন্দন। খালি গা লুঙি পরা সাদা দাড়ি এক বুড়ো - মাথার ঝাঁকায় করে লাউটা, কুমড়োটা নিয়ে সে চলেছে হাটে বিক্রী করার জন্যে। উল্টোদিক থেকে রাস্তার পাশের এক ফালি জমির ওপর দিয়ে হেঁটে আসছে এক চাষী বৌ—তার হাতে ধরা দড়িতে সে টেনে আনছে তার সঙ্গে যেতে অনিচ্ছুক একটি গরুকে—সেই গরুর পালটা টানে তার পরণের কাপড় অবিন্যস্ত হয়ে পড়েছে—বেআব্রু হয়ে পড়েছে তার একটি স্তন—রাস্তার কাদার ছিটে লেগে নোংরা, কিন্তু বৃহৎ এবং সুডোল। বাড়ি পৌঁছে চন্দন দোতলার বারান্দা থেকে দেখল বাড়ির পাশে নদী। নদী এত চওড়া? চন্দন কলকাতায় তো এতবড় নদী কখনো দেখে নি? সন্ধ্যা তাকে এই নদীর গল্প শোনায়—মহাভারতের কথা থেকে। চন্দনের সে সব গল্প ছোটবেলায় শোনা ছিল—এখন সন্ধ্যার মুখে শুনে সব আবার মনে পড়ে। এই নদী কত শত লোক বসতির বুক চিরে এখানে এসেছে—কত অগুনতি মানুষ বাসা বেঁধেছে এর দুই তীরে, তার বুকে হঠাৎ জেগে ওঠা চরে। তাদের কত সুখ দু:খের সাক্ষী এই নদী। সে সবের স্মৃতি নদীর বুকে বাসা বেঁধে আছে। চারপাশের এই বিশাল ব্যপ্তির তুলনায় কতটুকু ছিল কলকাতায় চন্দনের সেই ঘরটা যেখানে রাজত্ব করত ঐ রহস্যময় গলার মালিক? আকাশে বিচিত্র সব চেহারার সাদা সাদা মেঘের দল—তারা পড়ন্ত সূর্যের আলোয় রঙীন হয়ে ওঠে। রাতে চাঁদ তার স্নিগ্ধ আলো নদীর জলের সঙ্গে মিশিয়ে দেয়। কলকাতার বাড়িতে মেঝে ছিল শক্ত—মার্বেল পাথরের তৈরী। এখানে মাঠের মাটি তার রূপ বদলায়—কখনো শুকনো রুক্ষ্ম—আবার ছোট এক পশলা চৈত্র মাসের ঝড় বৃষ্টির জল পেলে হয়ে ওঠে মোলায়েম আর নরম—তখন তাতে পা দিলে সে বড় আদর করে পা ভেতরে টেনে নিতে চায়। নদীর বুক থেকে যে বাতাস ওঠে—তা নদীর তীর পার হয়ে মাঠের ভেতর দিয়ে ছোটে—যেন চন্দনের ছোটবেলায় পড়া রূপকথার সেই তেপান্তরের মাঠ—সেই হাওয়া চলে যায় দূরে, আরও দূরে—যেখানে ব্যঙ্গমা ব্যাঙ্গমীকে বলে দিচ্ছে রাক্ষসেরা রাজকন্যাকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছে—সেইখানে। চন্দনের মন দোল খায় ওর ভেতর জেগে ওঠা এক অপূর্ব অনুভূতিতে—ভেতরে যেন কিছু আটকে ছিল—এইবার খুলে যাবে—আর তখন দুনিয়াটা একটা অন্য চেহারা নিয়ে ওর কাছে এসে ধরা দেবে।

    সন্ধ্যা চন্দনের এই পরিবর্তন খুঁটিয়ে দেখে আর মনে মনে খুশি হয়ে ওঠে। তবে ও জানে যে খালি এই পারিপার্শ্বিকের বদল চন্দনের অবস্থার কোন উন্নতি করতে পারত না যদি সন্ধ্যা ওর পাশে পাশে না থাকত। সন্ধ্যার চন্দনকে সঙ্গ দেওয়াটা হচ্ছে একটা আপাত অনুর্বর জমিকে চাষের জন্যে তৈরী করা—সেই জমিতে হাল চালানো। মাটিতে জল সেচ করে সেই মাটি রসস্থ করা। তারপর বীজ রুইলে ফসল ফলবে। ও চন্দনকে খেলাধূলায় ব্যস্ত রাখে—ওর ধারণা তাতেও চন্দনের মানসিক অবস্থার উন্নতি হবে। সেজন্যেই ও কখনো চন্দনের সঙ্গে দৌড়ের পাল্লা দেয়—কখনো বাগানের ভেতরে খেলে চোর পুলিস। চন্দন পুরুষ মানুষ—ও সহজেই সন্ধ্যাকে এসব খেলায় হারিয়ে দেয়। আবার দু এক সময় সন্ধ্যা ইচ্ছে করেও খেলায় হারে—যাতে চন্দন খুশি হয়। তবে খেলতে গিয়ে বাগানের খুব ভেতরে যায় না সন্ধ্যা। প্রচুর গাছ সেখানে—ছায়াভরা সব সুঁড়িপথের ভেতর হারিয়ে যাবার ভয় আছে। অবশ্য ও জানে যে জমিদারের লোকজন সহস্রচোখ হয়ে ওদের পাহারা দিচ্ছে—কোন বড় রকম বিপদে পড়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই হয়। তবে সন্ধ্যা সেরকম কোন পরিস্থিতি হতে দিতে চায় না—কি দরকার এসব ঝামেলা তৈরী করার?

    সন্ধ্যা চন্দনের হাত ছেড়ে দিয়ে কয়েক পা এগিয়ে গেল। চন্দনকে বলল, আমি ঐ বাগানের ভেতর ঢুকব—আমাকে ধর দেখি। বলে সামনের বাগানটার দিকে টেনে মারল দৌড়। ও বাগানের ভেতর ঢুকল—পেছনে চন্দন ছুটল ওকে ধরবে বলে। বাগানের ভেতর গাছের ডালে, তাদের পাতায় আলোছায়ার খেলা। সন্ধ্যা গাছগাছালির ফাঁকে লুকোচুরি খেলে—চন্দন ওকে খোঁজে—ওর চোখে পড়ে সন্ধ্যার শাড়ির এক ঝলক—ও সেই দিকে ছোটে। সন্ধ্যা নিজের পেছনে ওর ছুটে আসার আওয়াজ পেয়ে অন্যদিকে গাছের ফাঁকে লুকোয়—চন্দন আবার ওকে খুঁজতে থাকে। কিন্তু সন্ধ্যা টের পায় যে ওরা বাগানের বেশী ভেতরে ঢুকে পড়েছে—সেজন্যে ও হাঁপিয়ে পড়ার ভান করে—চন্দন ছুটে আসে—ওকে ধরে ফেলে—দুজনেই হাসতে থাকে। সন্ধ্যা তার ব্যবসার সময় পুরুষের স্পর্শে প্রায় সময়ই নির্বিকার থাকে। কিন্তু চন্দনের বেলায় সন্ধ্যা একটা নিষ্পাপ তারুণ্যের অনুভূতি পায়—

    সন্ধ্যার মত মেয়ের পক্ষেও এটা একটা নতুন অভিজ্ঞতা—সন্ধ্যা সেটা অনুভব করে, কিন্তু এই অনুভূতিটা কিরকম ঠিক বুঝে উঠতে পারে না।

    হঠাৎ সন্ধ্যার মনে হল বাগানটায় যেন আলো কমে গিয়েছে। এখন বিকেলবেলা ঠিকই কিন্তু সূর্য ডুবে যাবার পরও তো খানিকক্ষণ গোধূলির আলো থাকার কথা। ও ওপর দিকে তাকাল। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে যেটুকু আকাশ দেখা যায় তা একেবারে অন্ধকার—ঠান্ডা ঠান্ডা জোরালো হাওয়া দিতে শুরু করেছে—গাছগুলোর ডালপালা দুলতে শুরু করেছে—পাতায় পাতায় শনশন আওয়াজ আরম্ভ হয়ে গেছে। এখন চৈত্র মাসের প্রায় শেষ—বিকেল সন্ধের দিকে ঝড় হওয়া তো স্বাভাবিক। ও একটু উদ্বিগ্ন গলায় চন্দনকে বলল, জোর ঝড় আসছে—চলো আমরা তাড়াতাড়ি বাগানের ভেতর থেকে বেরিয়ে যাই।

    কিন্তু ওরা দুপাও যায় নি—প্রচন্ড ঝড় শুরু হয়ে গেল। পাগলা হাওয়ার শোঁ শোঁ গোঁ গোঁ আওয়াজ—গাছগুলোতে, তাদের ডালে, পাতায় বাধা পেয়ে তারা ক্রদ্ধ গর্জন—চারপাশ একেবারে অন্ধকার হয়ে গিয়েছে—মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ আকাশকে চিরে ফেঁড়ে দিচ্ছে - সেই আলোতে এক নিমেষের মধ্যে সন্ধ্যাকে দেখে নিতে হচ্ছে ওরা কোথায় আছে—তারপরই আসছে বাজ পড়ার বিকট শব্দ। সন্ধ্যা এবার সত্যি সত্যিই ভয় পেয়ে গেল। ওরা এখানে আসার পর ছোটখাট দু একটা ঝড়বৃষ্টি হয়েছে—কিন্তু ওগুলো এই ঝড়টার মত এত জোরালো ছিল না। ঘন ঘন বাজ পড়ছে—এদিকে ওদিকে পাতাসুদ্ধ গাছের ডাল ভেঙে পড়ছে—কমজোরি গাছগুলো উদ্দাম নাচ দেখানো বাইজির মত এপাশে ওপাশে নুয়ে নুয়ে পড়ছে। ওদের মাথায়ও তো বাজ পড়তে পারে—গাছ বা গাছের ডাল ভেঙে পড়তে পারে। সন্ধ্যা চন্দনের দুই কাঁধে হাতের চাপ দিয়ে ওকে হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসিয়ে দিল—দুহাত দিয়ে ওর মাথা জড়িয়ে ধরে ঝুঁকে পড়ে নিজের বুক দিয়ে ওর মাথা ঢাকল। তারপরের বাজটা পড়তেই ওপরের দিকে মুখ তুলে সন্ধ্যা কর্কশ গলায় চেঁচিয়ে উঠল, শোন্‌, শালা শুয়ারের বাচ্চা—আমার মাথায় গাছে ফেলে দে—বাজ ফেলে আমাকে মার। কিন্তু এই ছেলেটার গায়ে যেন আঁচড় না লাগে।

    চন্দন কখনো সন্ধ্যার মুখে গালাগাল শোনে নি—ওর এরকম কর্কশ গলাও নয়। ও সন্ধ্যার হাত ছাড়িয়ে মুখ তুলে অবাক হয়ে সন্ধ্যার মুখের দিকে তাকাল। কোন কথা না বলে সন্ধ্যা আবার চন্দনের শরীর একইভাবে নিজের শরীর দিয়ে ঢেকে ফেলল। আর তারপরেই নামল মুষলধারে বৃষ্টি।

    এই ঝড়বৃষ্টি ছিল প্রায় আধঘণ্টা। তারপর বাগানের ভেতর থেকে দুই মূর্ত্তি বেরিয়ে এল—সাবধানে হেঁটে হেঁটে জমিদারবাড়ির দিকে চলল। সাবধানে কারণ ওরকম তুমুল বৃষ্টি হয়ে মাটি ভালরকম নরম হয়ে গিয়েছে—জোরে হাঁটতে গেলে পা বসে যায়—পিছলেও যায়। ততক্ষণে সন্ধে হয়ে গিয়েছে। পুষ্টাঙ্গ চাঁদ দেখা দিয়েছে—নির্মেঘ পরিষ্কার আকাশে ছড়িয়ে দিয়েছে উজ্জ্বল, স্নিগ্ধ সাদা আলো। নদীর বুকে এখন গলানো রূপা—ভাটার টানে মোলায়েম হাওয়ায় ছোট ছোট ঢেউ তুলে সেই তরল রুপো দক্ষিণে সমুদ্রের দিকে বয়ে চলেছে। একটা নৌকা বেরিয়ে পড়েছে— যাচ্ছে দক্ষিণ দিকে—পাড়ের কাছাকাছি থেকেই চলেছে সেটা—মাঝি একটা ছোট পালও তুলে দিয়েছে দ্রুত এগিয়ে যাবার জন্যে। সন্ধ্যা আর চন্দন দুজনেই চুপচুপে ভেজা—ভিজে জামা গায়ে লেপটে আছে—পায়ের সাদা রঙের স্পোর্টস জুতো কাদায় মাখামাখি—সারা গায়েও কাদার ছোপ লেগে আছে। চন্দনের জন্যে সন্ধ্যার একটু চিন্তা হচ্ছিল। এভাবে ভিজেছে—ছেলেটা আবার অসুখে না পড়ে যায়। বাড়ি গিয়ে প্রথমেই ওর ভিজে জামা কাপড় ছাড়িয়ে গা মাথা মুছে শুকনো জামা পরাতে হবে। তারপর খুব গরম চা বা কফি খাইয়ে দিতে হবে—কফি হলেই ভাল। জলখাবার আসবে তার পরে। বাড়ি পৌঁছেই সন্ধ্যা রামুর জন্যে হাঁক দিল। রামু চন্দনের শুকনো জামা বার করে দেবে—আর গরম কফিও তৈরী করে আনবে।

    এই ঝড়বৃষ্টির সময়টা নীলমাধবের ভাল কাটে নি। এ সময়টাতে সন্ধ্যা আর চন্দন পাহারাদারদের নজরের বাইরে চলে গিয়েছিল। ঝড়বৃষ্টির মধ্যে বাগানের ভেতর ঢুকে ওদের খুঁজে বার করা জমিদারবাড়ির লোক লস্করের পক্ষে সম্ভব হয়নি। লঞ্চের থেকে সাঁতারুরা পর্যন্ত বেশ কয়েকবার নদীতে নেমেছে—যদি সেখানে কিছু পাওয়া যায়। নীলমাধব আত্মহত্যা করার সবচেয়ে সহজ এবং যন্ত্রনাহীন উপায় কি তা চিন্তা করছিল। আবার তার সাথে সাথে স্থানীয় কালীবাড়িতে জোড়া পাঁঠা মানৎ করেছিল—দাদাবাবু যাতে নিরাপদে বাড়ি ফিরে আসে। মেয়েমানুষটার জন্যে নীলমাধবের কম মাথাব্যথা নেই। ও মরলেই বরঞ্চ আপদ চোকে। ঝড়বৃষ্টি থামলে ওদের যখন বাগান থেকে বেরোতে দেখা গেল তখন নীলমাধব ধনু সর্দারকে ডেকে হুকুম দিল যত তাড়াতাড়ি হয় জোড়া পাঁঠার ব্যবস্থা করতে। এই খরচটা ওরই হবে। কারণ সেরেস্তার টাকায় জোড়া পাঁঠার খরচা সেরে দিলে ওর মানৎরক্ষার ফল হবে না—তাতে দেবী চটে যেতে পারেন। তারপর নীলমাধব ট্রাঙ্ক টেলিফোন বুক করল। ঐ ছেলেমেয়েটার জন্যে দাদাবাবুর ওরকম ঝড়বৃষ্টির মধ্যে পড়ে ভিজে যাওয়ার ঘটনাটা কর্তার কানে তোলা দরকার।

    পরের দিন সকালে চন্দন সন্ধ্যাকে একটা ছবি দেখাল। আগের রাতে সন্ধ্যা খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। যত না শরীরের তার চাইতে বেশী ছিল মনের শ্রান্তি—প্রচন্ড দুশ্চিন্তা চলে যাবার পর যে ক্লান্তিটা আসে। সেজন্যে ও চন্দনের অনেক আগেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। ছবিটা তখন চন্দন এঁকেছে। বড় সাদা কাগজের ওপর পেন্সিলের স্কেচ—এখনো কোন রঙ নেই। গত সন্ধ্যার সেই নদীর পাড়—দূরে নদীর ওপাশে ঝাপসা গাছপালা—আকাশে এক ফালি মোটা একটা কুমড়োর মত চাঁদ—এপাড়ের কাছ দিয়ে পাল তুলে দিয়ে চলা নৌকা—আর পাড়ের ওপর পুতুল পুতুল চেহারার দুটি মানুষ—একটি পুরুষ আর একটি স্ত্রীলোক। সন্ধ্যা চন্দনের চোখে চোখ রেখে তাকাল। একটু লাজুক হাসি মুখে মেখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে চন্দন—সন্ধ্যা ওর আঁকা ছবির প্রশংসা করবে তার অপেক্ষায় আছে। আনন্দের একটা জোয়ার সন্ধ্যার সারা শরীরে বয়ে গেল। এখন অন্ত:ত এই মুহূর্ত্তে চন্দন সুস্থ। সন্ধ্যা পেরেছে—ওর ওপর যে কাজের দায়িত্ব ছিল তা আজ পুরো হয়েছে। চন্দনের মুখ নিজের দুহাতের মধ্যের টেনে নিল সন্ধ্যা—ওকে অনেক আদর দিল—কপালে, গালে, ঠোঁটে।

    আর একটি ঘটনাও সেই দিনই ঘটল। ঝড়বৃষ্টির জন্যে নীলমাধব আগের রাতে মনিবের টেলিফোনের লাইন পায় নি। পরের দিন কথা বলল। সূর্যশেখর সব শুনলেন। তারপর রামুকে টেলিফোনে ডাকিয়ে চন্দনের অবস্থা সম্বন্ধে ওর থেকে রিপোর্ট নিলেন। দাদাবাবু খুব ভাল আছে—রামুর মুখ থেকে একথা শোনার পর সূর্যশেখর নীলমাধবকে হুকুম দিলেন সবাইকে নিয়ে কলকাতা ফিরে যেতে। তিনি নিজেও সেদিনই কলকাতা ফেরা ঠিক করলেন। অনিরুদ্ধ একবার চন্দনকে দেখুক—ওর সঙ্গে কথাবার্তা বলে ওর সুস্থতাটা আন্দাজ করুক। অনিরুদ্ধ কি বলে তা শুনে নেবার পরেই তিনি পরের কাজগুলোতে হাত দিতে পারবেন।



    (ক্রমশ)



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • প্রথম পর্ব | দ্বিতীয় পর্ব | তৃতীয় পর্ব | চতুর্থ পর্ব | পঞ্চম পর্ব | ষষ্ঠ পর্ব | সপ্তম পর্ব | অষ্টম পর্ব | নবম পর্ব
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments