• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬১ | ডিসেম্বর ২০১৫ | উপন্যাস
    Share
  • অন্য কোনখানে : দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য


    প্রথম অধ্যায়

    পূর্বকথা


    “হে দেবর্ষি হবিষ্ট, আপনি ঈশ্বরের প্রিয়পাত্র। মানুষের রক্ষাকর্তা। পূর্বপুরুষরা বলে গেছেন, বহুদিন আগে প্রলয়সমুদ্রে ভাসমান ধরিত্রীর বুকে আপনি এক অতিকায় নৌকায় সমগ্র জীবজগতের বীজ নিয়ে স্বর্গ হতে আগমন করেন ও পৃথিবীর বুকে প্রাণের বীজ বপন করেন। আপনার কৃপাতেই প্রথম আগুন জ্বালাবার কৌশল জেনেছিল মানুষ। সেই অগ্নিশিখায় শ্যামধাতুকে উত্তপ্ত করে তা থেকে তীক্ষ্ণাগ্র শস্ত্র নির্মাণের তত্ত্বও আপনারই দান। আপনি আমাদের উন্নতি চান। অথচ—”

    হাতে ধরে থাকা দণ্ডটার ওপরে ভর দিয়ে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়েছিলেন হবিষ্ট। আকারপ্রকারে এই নরগোষ্ঠীর মানুষের সঙ্গে বিশেষ কোন পার্থক্য নেই। গৌরবর্ণ দীর্ঘ দেহ। টিকলো নাক। তবে মাথায় দীর্ঘ জটাজুট রয়েছে। পরনে বল্কল। তা ছাড়া, টানাটানা চোখদুটির গভীর দৃষ্টি তাঁকে স্থানীয় মানুষজনের থেকে একেবারেই আলাদা হিসেবে চিহ্নিত করে দেয়।

    কুলপতির কথা শুনে সেই শান্ত চোখদুটিতে একটা ঝিলিক দিয়েই মিলিয়ে গেল, “হ্যাঁ কুলপতি নেক্কা। আমি আপনাদের উন্নতি চাই। তবে তা এই পথে নয়। স্বজাতীয়ের রক্তপাতের পথ—”

    “স্বজাতীয়? কী বলছেন আপনি, দেবর্ষী? আমরা, ইউটুপা গোষ্ঠীর মানুষেরা, ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ সন্তান। ওই কৃষ্ণাঙ্গ স্বেনর দস্যুরা আমাদের স্বজাতীয় এ কথা আপনি উচ্চারণ করলেন কীভাবে? দাস ও দস্যুদের ভূমি ও নারীতে মানুষের ঈশ্বরদত্ত অধিকার। তাছাড়া রাজপুরোহিতের গতকালের গণনাতেও ঈশ্বরের নির্দেশ পরিষ্কার। তিনি স্বেনর মনুষ্যেতরদের বলি চান আর্যের তলোয়ারে। আপনি সর্বজ্ঞ। তবু, ঈশ্বরের সেই নির্দেশের বিরুদ্ধে কথা বলছেন, সে বড়ো দুঃখের ব্যাপার। চিন্তারও বটে।”

    হবিষ্ট একবার চারদিকে নজর চালিয়ে দেখে নিলেন। বাঁশ ও কাঠের খুঁটির মাথায় শুকনো ঘাসের ছাউনি দেয়া প্রশস্ত সভাঘর লোকে লোকারণ্য হয়ে আছে। নারীপুরুষ নির্বিশেষে গোটা বসতিটিই রণসজ্জায় সেজে এইখানে উপস্থিত। অর্থহীন, তবুও ফের একবারে চেষ্টা করলেন তিনি, “আবারও ভেবে দেখুন গোষ্ঠীপতি। যুদ্ধ মানেই বেশ কিছু মূল্যবান মানুষের অপচয়। মানুষের প্রাণহানি ঈশ্বরের অভিপ্রায় হতে পারে না।”

    “দেবর্ষী হবিষ্ট সঠিক কথা বলেছেন রাজা। মানুষের প্রাণহানি ঈশ্বরের ইচ্ছা নয়--”

    একটা তীক্ষ্ণ কন্ঠস্বর ভেসে এল সভার অন্যপ্রান্ত থেকে। হবিষ্ট একটু অবাক হচ্ছিলেন। রাজপুরোহিত চীমুক-এর গলা! অথচ এই মানুষটিই ইউটুপাদের যুদ্ধোদ্যমের প্রধান উৎসাহদাতা। যুদ্ধজয়ের পর কুলপতির ভাগের একটা বড়ো অংশ তার বিনাশ্রমে দক্ষিণা হিসাবে মেলে। অথচ সে—

    পরক্ষণেই অবশ্য ভুল ভাঙল তাঁর। চতুরচূড়ামণি চীমুক সম্পূর্ণ অন্যপথে আক্রমণ শানাচ্ছেন দেখা গেল, “সেইজন্যেই এই ধর্মযুদ্ধে মনুষ্যেতর স্বেনরদের আদিম অস্ত্রের আঘাত থেকে ঈশ্বর আমাদের প্রাণরক্ষা করবেন। তাদের উর্বর ভূমি, নারী ও পশুকুলের ওপর কেবল ইউটুপাদের অধিকার। এইভাবে একে একে সমস্ত দস্যুজাতিকে ইউটুপার অধীনে এনে ঐক্যবদ্ধ আর্যাবর্তের সৃজনই ঈশ্বরের অভিপ্রায়--”

    গোটা সভা জুড়ে একটা হইহইয়ের শব্দ উঠল। পুরোহিতের কথায় তাদের মনে নতুন করে উৎসাহ এসেছে। সেইদিকে তাকিয়ে হাত তুলে থামবার নির্দেশ দিলেন হবিষ্ট। তারপর ফের কুলপতির দিকে ফিরে বললেন, “সুবিশাল আর্যাবর্তে উর্বর জমির অভাব নেই মহামান্য নেক্কা। তার জন্য অন্যের রক্তপাতের প্রয়োজন কোথায়? এখনো সময় আছে। অভিযান বন্ধ করুন। এই দস্যুজাতির মানুষেরা পরিশ্রমী। কৃষিকর্মে তাদের দক্ষতা আপনাদের চেয়েও উন্নত। তবে যন্ত্র ও অস্ত্রবিজ্ঞানে তারা আপনাদের চেয়ে পিছিয়ে। অস্ত্রবলে ঐক্যসাধন নয়, তাদের সঙ্গে সখ্য স্থাপন করুন। আপনাদের অস্ত্রবিদ্যা ও স্বেনরদের উন্নততর কৃষিবিদ্যা একত্রে মিললে আপনারা দুই গোষ্ঠীতে মিলে আরো সুখী জীবন কাটাতে পারবেন। যুদ্ধঘোষণার মতন মূর্খামি করবেন না--”

    “আপনি অধিকারের সীমা ছাড়াচ্ছেন দেবর্ষী,” রাগে কাঁপতে কাঁপতে আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন নেক্কা। প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই ছোটো একটা সশস্ত্র দল এগিয়ে এসে সন্ন্যাসীকে ঘিরে দাঁড়াল।

    “আপনি বোধ হয় ভুলে গেছেন, আমি এই গোষ্ঠীর কুলপতি, আর আপনি একজন অরণ্যচারী সন্ন্যাসীমাত্র। কুলপতিকে ঈশ্বর স্বয়ং নির্বাচিত করেন। আজ প্রকাশ্য সভায় আপনি আমাকে মূর্খ বলে ঈশ্বরের অপমান করেছেন। তাছাড়া, স্বেনরদের পল্লীতে আপনার যে নিয়মিত যাতায়াত আছে সে সংবাদও আমার চরেরা আমাকে দিয়েছে দেবর্ষী। কার শেখানো জাদুশক্তির বলে তাদের জমি সর্বদা অধিক উর্বর থাকে তা-ও আমার অজানা নয়। আপনি কোন সর্বশক্তিমান দেবর্ষী নন হবিষ্ট। সাধারণ মানুষের বিশ্বাসকে ব্যবহার করে পূর্বপুরুষের সৃষ্ট কল্পকাহিনির অপব্যবহারকারী একজন বিশ্বাসঘাতক ভণ্ড। এ কাহিনির সত্যতার পরীক্ষা নেবে আজ আমার তলোয়ার---”


    ********

    “সাহায্যের প্রয়োজন আছে কী হবিষ্ট?” হঠাৎ মাথার মধ্যে মৃদু গুঞ্জন উঠল সন্ন্যাসীর।

    “নাঃ নেরা। এবারেও তোমার গণনা নির্ভুল। পরীক্ষা ব্যর্থ হয়েছে। যা করতে চায় এরা করুক। বাধা দিও না।” ঊর্ধ্বাকাশের দিকে একটি নিঃশব্দ প্রত্যুত্তর ভেসে গেল তাঁর দিক থেকে--

    “এই পাষণ্ডের শাস্তিবিধান করুন রাজা—” সশস্ত্র, উন্মত্ত মানুষের গর্জন ভেসে আসে চারপাশ থেকে। নেক্কা হাতে তলোয়ার তুলে নিলেন—

    ********

    সারা সভায় একটা অদ্ভুত নৈঃশব্দ নেমে এসেছিল। দেবর্ষি হবিষ্টের ছিন্নভিন্ন শরীরটি পড়ে আছে সভার মাঝখানে। বাইরে তখন বাতাস কাঁপিয়ে জয়ধ্বনি উঠছিল নেক্কার নামে। রণবাদ্য বেজে উঠেছে। রক্তে দোলা দেয় সেই কর্কশ অথচ ছন্দোবদ্ধ সুর। খোলা তলোয়ার হাতে হবিষ্টের রক্তে ভেজা মাটির ওপর পা ফেলে নেক্কা এগিয়ে গেলেন।

    নির্জন সভাঘরটিকে ঘিরে এখন শরতের হাওয়া পাক খেয়ে যায়। গোটা জনপদটি নিঃশব্দ হয়ে গেছে। শেষ ঘোড়াটির ক্ষুরের শব্দও দিগন্তে মিলিয়ে গেছে বহুক্ষণ আগে। ইউটুপারা যুদ্ধে গেছে। তাদের নারীরাও সমান রণদক্ষ। সন্তানগুলিকে পিঠে বেঁধে হাতে খোলা তলোয়ার বা ধনুর্বাণ নিয়ে বলগাহীন ঘোড়ার পিঠে তারাও ছুটে চলেছে এখন তাদের পুরুষদের পাশাপাশি।

    নির্জনতার সুযোগে মাংসভূক কুকুরের একটি দল সেইখানে এসে একেএকে জড়ো হচ্ছিল। এরা সাবধানী জীব। মানুষের হিংস্রতাকে সমীহ করে চলে। মৃতদেহটিকে ঘিরে একটি বৃত্ত রচনা করে খানিকক্ষণ অপেক্ষা করল তারা। তারপর তাদের দলপতি সাবধানে এগিয়ে এসে একটি ছিন্ন হাতকে শুঁকে দেখল একবার। সুস্বাদু মাংস ও রক্তের ঘ্রাণ লেগে আছে তাতে। দলের বাকি সদস্যরা তখন অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় আছে দলপতির প্রথম গ্রাসটির জন্য।

    কিন্তু সে গ্রাসটি আর মুখে তোলা হল না তার। ছিন্ন হাতটির গায়ে তার দাঁতের স্পর্শ লাগতেই হঠাৎ একটু নড়ে উঠল তা। সভয়ে কয়েকপা পিছিয়ে এল দলপতি। তাদের ভীত ও সতর্ক দৃষ্টির সামনে তখন এক আশ্চর্য জাদু ঘটে চলেছে। ছিন্নবিচ্ছিন্ন শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি যেন কোন জাদুবলে নড়ে উঠে ফের একে অন্যের সঙ্গে জুড়ে যাচ্ছিল—

    মাত্রই কয়েকটি মুহূর্ত। তারপর ফের একবার ভূমিশয্যা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন দেবর্ষি হবিষ্ট। তাঁর দেহে রক্তপাত বা অস্ত্রাঘাতের কোন চিহ্ন ছিল না। ক্ষুধার্ত জীবগুলি তখন ফিরে যাচ্ছে। তাদের কয়েকজন অসহায় ভঙ্গিতে খানিকক্ষণ আগেও রক্তে ভিজে থাকা ভূমির আস্বাদ নেবার ব্যর্থ চেষ্টা করছিল।

    তাদের উপেক্ষা করে ফাঁকা সভাগৃহটির দিকে হতাশ চোখে একবার চেয়ে দেখলেন হবিষ্ট। আরও একটা ব্যর্থ পরীক্ষা। গত দু লক্ষ বছরে এই নিয়ে চারটে গ্রহে চারবার। অবশ্য নেরা কখনও হিসাবে ভুল করে না।

    একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পাশে পড়ে থাকা দণ্ডটি মাথার ওপর উঁচিয়ে ধরলেন তিনি। মৃদু গুঞ্জন উঠছিল সেটির থেকে। নৌকার সঙ্গে সংযোগ স্থাপিত হয়েছে। ধীরে ধীরে ভাস্বর ও জ্যোতির্ময় হয়ে উঠছিল দেবর্ষির শরীরটি। অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি গলেমিশে গিয়ে একটি অগ্নিপিণ্ডে পরিণত হচ্ছে দ্রুত। বস্তুর রূপধারী শক্তিপুঞ্জ তার আসল চেহারায় ফিরে চলেছে।

    মূক পশুগুলি নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখল একটুক্ষণ। তারপর সভয়ে চিৎকার করতে করতে ছুটে গেল সভাগৃহ ছাড়িয়ে অনেক দূরে। তাদের চিৎকারকে ছাপিয়ে উঠেছে তখন একটি গুরুগুরু শব্দ--

    বহুদূরে, যুদ্ধোন্মত্ত একদল মানুষের তলোয়ার শত্রুর রক্তপান করতে করতে হঠাৎই থেমে দাঁড়াল। পশ্চিমে ইউটুপাদের গ্রামটির দিক থেকে একটি গম্ভীর গুঞ্জনের শব্দ ভেসে আসছে। যেন অগণিত ভ্রমরের দল একসঙ্গে পাখায় সুর তুলেছে। আর তারপর সেখান থেকে একটি তীব্র বিদ্যুতের ফলা কানফাটানো গর্জন তুলে ছুটে গেল আকাশের দিকে। যুদ্ধরত মানুষগুলি সভয়ে দেখল, নীল আকাশের গায়ে একটি ঘূর্ণায়মান কালো গহ্বর দেখা দিয়েছে। বিদ্যুতের শিখা চোখের নিমেষে সেই গহ্বরের ভেতরে হারিয়ে গেল।

    নেক্কার বুকের ভেতরে একটা গভীর আশংকা কালো ছায়া ফেলেছিল—দৈব মানুষেরা এইভাবেই স্বর্গ ও মর্ত্যের মধ্যে যাতায়াত করেন বলে সে বৃদ্ধদের মুখে শুনেছে। তবে কি—

    তবে সে দ্বিধায় বেশিক্ষণ ভুগবার অবকাশ তার তখন ছিল না। খানিক দূরে, যুদ্ধরত সেনানির ভিড়ের ওপারে স্বেনর কুলপতির নিশানটি তখন তার চোখে পড়েছে। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দ্রুতবেগে বের হয়ে অরণ্যের দিকে ছুটছিল তা। দৈবী লীলাখেলার কথা ভুলে নেক্কা সেইদিকে ছুটে চলল খোলা কৃপাণ হাতে।

    ********

    নীল গ্রহটির কক্ষপথে অলস সঞ্চারে ভেসে চলেছিল অতিকায় নৌকাটি। তার মাথার উপর ঝলমল করে আকাশগঙ্গার তারকাপুঞ্জ। নৌকার পঞ্চাশ যোজন দীর্ঘ পাটাতনের বুকে এই গ্রহটির ভূপ্রকৃতির একটি নিখুঁত প্রতিকৃতি গড়ে তোলা হয়েছে। তবে এখনো তা আবহাওয়াশূন্য। সেইখানে, একটি সুবিশাল হ্রদের শূন্য খাতের পাশে হবিষ্ট সমাধিস্থ ছিলেন। তাঁর দেহবিচ্ছিন্ন চেতনাটি স্থানকালের সীমা অতিক্রম করে বিশ্বব্যাপী অগণিত শক্তিপ্রবাহের মধ্যে থেকে একটি সুনির্দিষ্ট শক্তিসংকেতকে খুঁজে নিয়ে সংযোগ স্থাপন করল--

    “নিবেদন আছে হে মহানায়ক ব্রহ্মণ।”

    “বলুন দেবর্ষি হবিষ্ট।”

    “আরো একটি পরীক্ষার প্রয়োজন হবে আমাদের।”

    “এটিও ব্যর্থ হল তাহলে?”

    “ব্যর্থ নয় মহানায়ক। আরো এক ধাপ এগোতে পেরেছি আমরা। গ্রিশকার, রাইকিত, দীর্ঘবন, অবশেষে এই আকাশগঙ্গা নক্ষত্রপুঞ্জে চতুর্থ পরীক্ষায় উত্তরসূরী প্রজাতির জিনসংস্থানকে ঈশ্বরজাতির অনেকটাই কাছাকাছি নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু--”

    “কিন্তু—কী দেবর্ষী?”

    “দুটি বিশেষ লক্ষণ দেখা দিয়েছে শেষতম পরীক্ষাটিতে। প্রথমটি অপ্রত্যাশিত হলেও কাম্য। এদের মেধাবৃদ্ধির হার আমাদের গাণিতিক পূর্বাভাষের তুলনায় বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয়টি গুরুতর চিন্তার বিষয়। এরা স্বজাতিহন্তা হয়ে উঠছে। এটি একেবারেই--”

    “--চিরশত্রু দানবকুলের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। কিন্তু ঈশ্বরপ্রজাতির উত্তরসূরী জাতির চরিত্রে তা কী করে আসবে?”

    “জিনসংস্থানের পরিবর্তন ঘটানো এক জটিল বিজ্ঞান মহানায়ক। তাতে অপ্রত্যাশিত ফলাফলের সম্ভাবনা থেকেই যায়। সম্ভবত পৃথিবীগ্রহের এই পরীক্ষাটিতেও কোন কারণে সেটি ঘটে গেছে।”

    “সে কারণটির অনুসন্ধান করেছেন কি?”

    “এখনও তা অজ্ঞাত। তবে দায়ী জিনসংকেতটির নির্ণয় ও তাকে নির্মূল করা সম্ভব। তা আমরা করবও। সেইজন্যই পঞ্চম তথা শেষ পরীক্ষাটির প্রস্তাব রাখছি আমি।”

    “আমার সম্মতি আছে। কিন্তু তবু, আরো একবার একই প্রশ্ন করতে চাই দেবর্ষী। ঈশ্বরজাতির শ্রেষ্ঠতম বিজ্ঞানসাধকের হাতে এমন ভয়ংকর ভুল কোন কারণে ঘটল?”

    “বিজ্ঞানের পথে এর ব্যাখ্যা আমি দিতে অক্ষম মহানায়ক ব্রহ্মণ, তবে ইতিহাসের শিক্ষা থেকে এর একটি কারণ আমি অনুমান করতে পারি। বর্তমান ঈশ্বর ও দানবজাতির আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে আসছে। প্রাকৃতিক নিয়মেই এইবার তাদের উত্তরসূরীজাতিদের আবির্ভাব ঘটবার কথা। ব্রহ্মাণ্ডের ভারসাম্য রক্ষার এ এক বিচিত্র প্রাকৃতিক কৌশল। কার মাধ্যমে কোন পথে তিনি তা সৃজন করবেন তা বোঝা আমাদের সাধ্যের বাইরে। হয়ত আমাদের হাতেই—”

    খানিকক্ষণ দুটি চিন্তাস্রোতই নীরব রইল। তারপর মহানায়কের চিন্তাস্রোতটি যখন জেগে উঠল তখন তাতে গভীর বেদনার স্পর্শ ছিল, “আরো একটি রক্তাক্ত ও যুদ্ধদীর্ণ কল্পের সূচনা হতে চলেছে হবিষ্ট। শার্ঙ্গরব তারকামণ্ডলের মহাযুদ্ধে দানবজাতিকে নির্মূল করবার পর ভেবেছিলাম, উত্তরসূরী ঈশ্বরপ্রজাতির হাতে একটি শান্তিময় বিশ্বের ভার দিয়ে মহাউদ্বর্তনের পথে যাবে বর্তমান ঈশ্বরপ্রজাতি। কিন্তু প্রকৃতির বোধ হয় সে অভিপ্রায় নয়। থাক সে কথা। পরবর্তী পরীক্ষাস্থল স্থির হয়েছে কি?”

    “এখনো নয় মহানায়ক। উপযুক্ত তারকামণ্ডলের সন্ধান করতে হবে সেজন্য। দেবর্ষী ক্ষিতিজ সে কাজটির দায়িত্বে আছেন। নেরার যন্ত্রমস্তিষ্ককেও ব্যবহার করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে আমি এই গ্রহের সম্পূর্ণ বাস্তুতন্ত্রের জিনসংকেতগুলি সংগ্রহ ও পরের পরীক্ষার জন্য সংরক্ষণের আদেশ দিয়েছি। তাতে কিছু সময় লাগবে। তবে সেই বীজ সংগ্রহের কাজ শেষ হতে হতে আশা করি গন্তব্য তারকামণ্ডলের সন্ধান মিলবে।”


    || ২ ||

    আজ সকালটি বড়ো প্রসন্ন। শীতের শেষ। বাতাসে বসন্তের স্পর্শ লেগেছে। দিগন্ত অবধি প্রসারিত ঘাসবন হাওয়ায় মৃদুমন্দ দুলছে। কোরাগ সতর্কভাবে সেইদিকে নজর রেখে এগোচ্ছিল। কাছাকাছি একটা বড়ো দিঘী রয়েছে। সেইখানে একটা বুনো শুয়োরের পরিবারকে এই সময়টা মাঝেই মাঝেই সে আসতে লক্ষ করেছে। তার লক্ষ তাদের মধ্যে স্ত্রী শুয়োরটি। সেটি গর্ভবতী। জীবন্ত ধরতে পারলে পশুটিকে নিজের গুহায় এনে পালন করা যায়। সেক্ষেত্রে বেশ কিছুদিনের খাদ্যের সংস্থান হতে পারবে তার ও তার বাচ্চাগুলির মাংস দিয়ে।

    কোরাগের ছেলেটি তার পেছন পেছন আসছিল। হঠাৎ নিচু হয়ে বসে পড়ে সে শিশুটিকে বুকের কাছে টেনে নিল। তারপর তার মুখটা চেপে ধরে সামনে দুলন্ত ঘাসবনের একটা অংশের দিকে দেখিয়ে ফিসফিস করে বলল, “সাবধান--”

    আমুকের এই প্রথম মায়ের সঙ্গে শিকারে আসা। নিচু গলায় একটু অবাক হয়েই সে প্রশ্ন করল, “হাওয়া বইছে তো-–”

    “না। খেয়াল করে দেখো আমুক, ওই জায়গায় ঘাসবনের দুলুনি অন্যজায়গার সঙ্গে এক তালে হচ্ছে না। ওখানে—”

    বলতে বলতেই হঠাৎ হাওয়ার অভিমুখ বদলে গিয়ে তা বয়ে এল সরাসরি তাদের দুজনের দিকে। তীব্র জান্তব গন্ধটা নাকে যেতেই কোরাগ আমুককে পিঠে তুলে নিয়ে ছুটে পালাবার চেষ্টায় ছিল, কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। ঘাসবনে আত্মগোপন করে থাকা জন্তুটি অনেকক্ষণ ধরেই অনুকূল হাওয়ায় তাদের গন্ধ পেয়ে তাদের কাছে আসবার অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু হাওয়ার দিক বদলে যেতেই শিকার হাতছাড়া হবার ভয়ে সে একটা গম্ভীর গর্জন করে বড়ো বড়ো লাফে এগিয়ে এল ঘাসবন মথিত করে।

    “পিঠে সাবধানে ধরে থাকো আমুক। এটা সিংহ,” বলতেবলতেই যুদ্ধের জন্য তৈরি হল কোরাগ। তার হাতে ধরা বল্লমের মাথায় পাথরের বিরাট ও তীক্ষ্ণধার ফলাটি এর আগে অনেক বন্যপশু এবং শত্রু মানুষের রক্তপান করেছে। এ যুদ্ধ তার জীবনে নতুন কিছু নয়।

    পশুরাজের আক্রমণের পদ্ধতি কোরাগের পরিচিত। পা দুটি সামনে পেছনে করে নিজেকে দৃঢ়ভাবে দাঁড় করিয়েছে সে। শরীর ঈষৎ পেছনদিকে ঝোঁকানো। হাতের বল্লমের নীচের দিকটা মাটিতে ঠেকিয়ে ফলাটি উঁচু করে ধরে সে পশুরাজের আক্রমণের প্রতীক্ষা করছিল।

    ঘাসবন থেকে বের হয়েই সিংহটি পূর্ণগতি বজায় রেখে শরীরটাকে ভাসিয়ে তুলল বাতাসে। তার লক্ষ কোরাগের মাথাটা। মুহূর্তের ভগ্নাংশের মধ্যে কোরাগ তার লাফের পথটা দেখে নিয়ে সামান্য পিছিয়ে গিয়ে বল্লমের মাথাটা একটু ঘুরিয়ে ধরল। এবং প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই পশুরাজ এসে সটান আছড়ে পড়ল বল্লমটার তীক্ষ্ণধার ফলায়।

    সংঘর্ষের মুহূর্তে বল্লমটি থেকে হাত সরিয়ে নিয়েছিল কোরাগ। তবু তীব্র ঝাঁকুনিতে কয়েকহাত দূরে ছিটকে পড়েছিল সে। বল্লমটির ফলা সিংহের বুক দিয়ে ঢুকে পিঠ দিয়ে বের হয়ে এসেছে। দৈর্ঘের মাঝামাঝি ভেঙে দুটুকরো হয়ে গেছে তা। ফলাসহ দীর্ঘতর অংশটা সিংহের শরীরে গাঁথা। অপ্রত্যাশিত আঘাতটা প্রথমে হতচকিত করে দিয়েছিল পশুরাজকে। কিন্তু শরীরের মধ্যে ভলকে ভলকে বেড়ে ওঠা যন্ত্রণা তাকে স্থির থাকতে দিল না। বুকে গাঁথা বল্লমটির অংশ নিয়েই সে এবার ফের একবার ছুটে এল শরীরের শেষ শক্তিটুকু সঞ্চয় করে। কোরাগ ততক্ষণে পিঠ থেকে আমুককে দূরে ছুঁড়ে দিয়ে কোমর থেকে ছুরিদুটি খুলে নিয়ে তৈরি হয়েছে। নিপুণ দক্ষতায় সিংহের থাবার প্রতিটি আঘাতকে এড়িয়ে যেতেযেতেই তার গায়ে বারংবার গেঁথে যাচ্ছিল পাথরের ছুরিদুটি--

    ********

    অস্তিত্বের সংগ্রামে লিপ্ত জীবদুটির অগোচরে, গ্রহটির আবহমণ্ডলে তখন ভেসে আসছিল ছোটো ছোটো গোলকের একটি দীর্ঘ মালা। পৃথিবীর আয়নমণ্ডলে ঢুকে এসে পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল তারা। তারপর একেকটি গোলক পূর্বনির্ধারিত নির্দেশ অনুসারে ছুটে গেল পৃথিবীর একেকটি এলাকার আকাশের দিকে--

    মাথার ওপর বেশ খানিকটা উঁচুতে ভাসমান গোলকটির দিকে চোখ পড়তে আমুক তার মাকে একবার ডেকেছিল, কিন্তু সে ডাক কোরাগের কানে যায়নি। তারপর হঠাৎ সেই গোলকটি নিঃশব্দ বিস্ফোরণে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেল। হাওয়ায় ভর করে ধুলিকণাগুলি ঝরে পড়ছিল বিরাট একটা অঞ্চল জুড়ে। কিছু কণা কোরাগ এবং পশুরাজের গায়েও এসে পড়েছিল বটে, কিন্তু তারা তখন জীবনমরণ সংগ্রামেই ব্যস্ত। সামান্য ধুলিকণার দিকে তাদের মন ছিল না।

    আদিগন্ত প্রসারিত সেই ঘাসজমির প্রতিটি জীবন্ত বস্তুর গায়ে গিয়ে তখন স্পর্শ করছিল স্বয়ংক্রিয় ধুলিকণাগুলি। সেই মুহূর্তে গ্রহটির গভীর মহাসাগর থেকে শুরু করে সমতলভূমি কিংবা উত্তুঙ্গ পর্বতের বিভিন্ন অঞ্চলে সেই একই কাজ করে চলেছে এক একটি গোলক থেকে নিঃসৃত বুদ্ধিমান ধুলিকণার দল। উদ্দিষ্ট জীবদেহের একটি করে দেহকোষকে বেছে নিয়ে তাকে সঞ্চয় করে রাখছে নিজেদের ভেতরে রাখা অতিশীতল আধারে। তারপর লক্ষ্যবস্তুকে ছেড়ে ফের বাতাসে ভেসে উঠে উড়ে যাচ্ছে তাদের বিস্ফোরণবিন্দুতে। সেখানে পূর্বনির্ধারিত জ্যামিতিক নকশায় একে অন্যের সঙ্গে জুড়ে গিয়ে ফের পুনর্গঠিত হচ্ছিল খানিক আগে বিস্ফোরিত হয়ে যাওয়া বীজসংগ্রাহক গোলকগুলি--


    || ৩ ||



    “নেরা?”

    ডাক দেবার প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই একটি সূক্ষ্ম ধুলিকণার স্রোত এসে হবিষ্টর শয়নকক্ষে ঢুকল। ধীরে ধীরে সেগুলি জুড়ে গড়ে উঠতে থাকা তরুণীটির দিকে একনজর দেখে উঠে বসলেন হবিষ্ট। আজ নেরা ঈশ্বরমানবীর রূপ ধরেছে। ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত বুদ্ধিধর জীবরূপের মধ্যে এইটিই তার সবচেয়ে পছন্দের চেহারা।

    “বীজ সংগ্রাহকদের কাজ শেষ হয়েছে কি?”

    “হ্যাঁ। কাজটি সুদীর্ঘ ছিল। তব এই মুহূর্তে শেষ দলটি ফিরে আসছে।” বলতে বলতেই নেরার হাতের ইশারায় ঘরের মাঝখানে একটি প্রদর্শনক্ষেত্র ভেসে উঠল। পৃথিবীর আবহমণ্ডল থেকে সার বেঁধে একটি দীর্ঘ মালার মতন উঠে আসতে থাকা গোলকগুলির ছবি পড়ছিল সেখানে।

    “বেশ। এবারে এখানকার খবর বল। তোমার কাজগুলি শেষ হয়েছে কি? নৌকার ওপরের সুরক্ষা আচ্ছাদন?”

    “চালু হয়েছে।”

    “আবহমণ্ডল?”

    “স্থিতাবস্থায়।”

    “দিনরাত্রির পর্যায়কাল?”

    “পার্থিব হিসাবে নির্ধারিত।”

    “জলমণ্ডল?”

    “এককোষী প্রাণসঞ্চারের জন্য প্রস্তুত।”

    “ধন্যবাদ নেরা।”

    “আর কোন নির্দেশ?”

    “ক্ষিতিজের কাজ শেষ হয়েছে কি?”

    “হ্যাঁ দেবর্ষী। বৃহশির তারকাপুঞ্জটিকে প্রাথমিকভাবে পরবর্তী পরীক্ষাক্ষেত্র হিসাবে নির্বাচন করা হয়েছে।”

    “জায়গাটা একবার দেখাবে?”

    প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই হবিষ্টকে ঘিরে বর্তমান তারকাপুঞ্জের একটি বাহুর ত্রিমাত্রিক প্রতিবিম্ব ভেসে উঠল। তার নক্ষত্রগুলি দ্রুত ধেয়ে যাচ্ছে সামনে থেকে পেছনের দিকে। অতিদূরে একটি বিন্দু দপদপ করে জ্বলছিল। এইবারে তা ক্রমশ বিবর্ধিত হয়ে একটি ক্ষুদ্র তারকামণ্ডলের ছবিতে পরিণত হচ্ছে। তার পাশাপাশি কিছু সংখ্যাও ভেসে উঠছিল বাতাসে—

    “দূরত্ব সাতাশ হাজার আলোকবর্ষ। তারার সংখ্যা একশো কোটি। লালাভ দানব তারার প্রাচুর্য রয়েছে। বুদ্ধিধর জীবের সৃষ্ট কোন শক্তিবিচ্ছুরণের চিহ্ন নেই--ধন্যবাদ নেরা। এর মধ্যে থেকে আদর্শ গ্রহটির সন্ধান পেতে তুমি কত সময় নেবে?”

    “অন্তত পৃথিবী গ্রহটির একটি পূর্ণ আবর্তনকাল তো বটেই।”

    “অর্থাৎ আরো এক বছর। কিন্তু এত দীর্ঘ সময় কেন?”

    “লাগবার কথা নয় হবিষ্ট। তবে উদ্দিষ্ট নক্ষত্রপুঞ্জের নিকটতম বিন্দুটি এখান থেকে সাতাশ হাজার আলোকবর্ষ দূরে। দূরতম বিন্দুটির দূরত্ব প্রায় পঞ্চাশ হাজার আলোকবর্ষ। এত দূর থেকে অনুসন্ধান চালিয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে আসা সময়সাপেক্ষ কাজ। তবে হ্যাঁ, যদি ওই নক্ষত্রমণ্ডলে পৌঁছে গিয়ে যদি অনুসন্ধানটি চালাই তাহলে কাজটি আমি মাত্র কয়েক ঘন্টাতেই সম্পন্ন করতে পারি—”

    বলতে বলতেই তার গলাটি ভারী আদুরে হয়ে উঠল। পঞ্চম স্তরের এই নেরা শ্রেণীর যন্ত্রজীবেরা ঈশ্বরজীবদের মতই অনুভূতিপ্রবণ হয়ে থাকে। হঠাৎই হবিষ্টর একেবারে কাছে ঘেঁষে এসে তাঁর হাতটি ধরে সে বলে, “শুধু,আপনি দেবর্ষী ক্ষিতিজকে একবার অনুরোধ করুন। তিনি আপনার কথা শুনবেন।”

    হবিষ্টর ঠোঁটের কোণায় মৃদু হাসির একটা রেখা দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল। অনুরোধটি কী তা তিনি জানেন। অতিমহাকাশীয় পথে নৌকাটিকে নক্ষত্রান্তরে চালিয়ে নেয়া নেরার প্রিয় কাজ। কেবল এই একটি কাজের সময়েই সে সম্পূর্ণ স্বাধীনতার স্বাদ পায়। নেরা এই স্বাধীনতাটুকু বড়ো ভালোবাসে। তবে সে সুযোগ তার খুব বেশি জোটেনি গত দুই শতসহস্রাব্দে।

    নেরা আগ্রহী চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিল। হবিষ্ট মাথা নাড়লেন, “না। তোমাকে কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। এখনই তোমার ইচ্ছা পূরণ হওয়া সম্ভব নয়।”

    “কেন সম্ভব নয়? আদেশ পেলে আমি তো অনায়াসে ঝাঁপগুলির হিসাব করে নৌকাটিকে সেইমত—”

    “আমি জানি তুমি তা পার। কিন্তু অপেক্ষার অন্য কারণ আছে।”

    “কী কারণ?”

    অবাধ্য কিশোরীমূর্তিটির রাগ রাগ মুখের দিকে তাকিয়ে একটু স্নেহই হল হবিষ্টর। বুদ্ধিধর অগণিত যন্ত্রাণুর সমষ্টি এই যন্ত্রটি। আণবিক সজ্জায় বদল ঘটিয়ে যেকোন রূপও ধারণ করতে পারে। কর্মক্ষমতায় তার কোন তুলনা হয় না। অথচ এই শিশুসুলভ ভাবটিই বুঝি তার স্রষ্টা প্রযুক্তিবিদের শ্রেষ্ঠ অবদান।

    নরম গলায় তিনি বললেন, "বীজসংগ্রাহক গোলকেরা এই যে এই গ্রহের সমস্ত জীবের জিনসংকেত সংগ্রহ করে নিয়ে আসছে,তাদের প্রথমে একে একে পরিস্ফূট করতে হবে যে। পরিস্ফূট হবার পর, এই ভেলার উপরিভাগে যে পার্থিব পরিবেশের সৃষ্টি করেছ তুমি, সেইখানে তারাই গড়ে তুলবে উপযুক্ত বাস্তুতন্ত্র। গন্তব্য গ্রহে পৌঁছে সেইখানে এই বাস্তুতন্ত্রটিকে স্থাপন না করলে ঈশ্বরগ্রহের পরিবেশ কী করে গড়ে উঠবে সেখানে?”

    “কিন্তু পরিস্ফূটনের কাজ তো ওই নক্ষত্রমণ্ডলে পৌঁছেও করা যেতে পারে?”

    “পারে নেরা। কিন্তু ধরো, সে কাজ চলতে চলতে কোন দুর্ঘটনায় যদি এদের মধ্যে কিছু জীব নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে বাস্তুতন্ত্রটি পরবর্তী পরীক্ষার সময় সঠিক কাজ করবে না! ছোটোবড়ো প্রতিটি জীবেরই বাস্তুতন্ত্রে একটা ভূমিকা থাকে যে! তেমন কিছু ঘটলে আমাদের ফের এই গ্রহেই ফিরে আসতে হবে নমুনা সংগ্রহের জন্য। তাই যতদিন না এ কাজ শেষ হয় ততদিন আমরা এই গ্রহের কাছাকাছি অন্য একটি উপযুক্ত জায়গায় অপেক্ষা করব। তারপর সেই কাজ শেষ হয়ে গেলে পরে তুমি ভেলাকে এক সুন্দর উল্লম্ফনে ওই তারকামণ্ডলে পৌঁছে দেবে।”

    তাঁর স্নেহভরা গলার স্বরটি নেহার মুখের ওপর জমে ওঠা অন্ধকারকে সরিয়ে দিয়ে গেল এক লহমায়। একটুক্ষণ চুপ থেকে সে বলল, “এখন তবে আমাদের গন্তব্য কোথায় হবে হবিষ্ট?”

    “এই গ্রহমণ্ডলের ষষ্ঠ গ্রহটির কাছে।”

    “ষষ্ঠ-মানে শনিগ্রহ? কিন্তু কেন?”

    “কারণ আছে নেরা। এসো আমি তোমায় দেখিয়ে দিচ্ছি। গ্রহটিকে দেখাও একবার--”

    হঠাৎ করেই চারপাশের দৃশ্যপট একেবারে বদলে গেল। অন্ধকার মহাকাশে অতিকায় গ্রহটি তার বহুবর্ণ বলয়গুলি নিয়ে রাজকীয় ভঙ্গিমায় ভেসে আছে। তাকে ঘিরে ঘূর্ণায়মান উপগ্রহগুলির মধ্যে থেকে একটিকে বেছে নিয়ে হবিষ্ট তার দিকে নির্দেশ করতে সেটি সামনে এগিয়ে এল। মূল গ্রহটি বাঁপাশে দৃষ্টিসীমার বাইরে সরে গেছে। আকাশের অর্ধেকটা জুড়ে তার প্রসারিত বলয়ের প্রান্তটি দেখা যায়। তার থেকে সামান্য দূরে, প্রক্ষেপণক্ষেত্রের ঠিক মাঝখানে উপগ্রহটি ভাসছিল। হঠাৎ তার বুক থেকে একটি অতিকায় জলস্তম্ভ ছুটে এল মহাকাশে। তার খানিকটা বরফ হয়ে ঝরে পড়ল উপগ্রহের বুকে, আর বাকি অংশটি তীব্রবেগে ভেসে এসে মিশে গেল গ্রহটির বলয়ে।

    “জলকণাগুলির বর্ণালি বিশ্লেষণ করে দেখ—”

    কয়েক মুহূর্ত নিশ্চুপ হয়ে রইল নেরা। তারপর বিস্মিত গলায় বলল, “আশ্চর্য। একেবারে এই পৃথিবীগ্রহের আদিসমুদ্রের জলের রাসায়নিক গঠন! যে অবস্থায় তাকে আমরা প্রথম দেখেছিলাম এখানে আসবার পর—”

    “প্রাণের প্রথম পরিস্ফূটনে এই জলের ভূমিকা তুমি জান নেরা। ওইখানে আমরা প্রকৃতির থেকেই তার নিয়মিত সরবরাহ পেতে থাকব। কৃত্রিমভাবে সংশ্লেষণের চেয়ে তা অনেক সহজসাধ্য।

    “আরো একটি সুবিধা আছে হবিষ্ট--”

    দৃশ্যপট বদলে ফের ঘরটি তার পুরোনো চেহারাতেই ফিরে গেছে তখন। হবিষ্ট কৌতুহলী দৃষ্টিতে নেরার দিকে ফিরে তাকালেন।

    “প্রয়োজন হলে ওই গ্রহরাজের অতিকায় বলয়ের মধ্যে আত্মগোপনও করা যাবে। সেখানকার গ্রহাণুগুলির সঙ্গে মিশে থাকলে দূর থেকে--”

    “কার থেকে আত্মগোপন করবার কথা ভাবছ নেরা?” হবিষ্ট একটু অবাক হয়েই তাকিয়ে দেখলেন একবার নেরার দিকে, “এই নক্ষত্রমণ্ডলে তো দ্বিতীয় কোন বুদ্ধিধর জীব নেই! এই গ্রহের আদিম জীবেরা--”

    নেরা ভ্রুদুটি কুঁচকে কী ভাবছিল। একটু বাদে ইতস্তত করে বলল, “এদের মেধাস্তর সম্পর্কিত তথ্যগুলো ব্যবহার করে এদের প্রযুক্তির উন্নতির হারের একটা হিসেব করেছিলাম। ফলাফলগুলি দেখুন দেবর্ষী। আমার হিসাব যদি ভুল না হয় তাহলে এই গ্রহের গণ্ডি ছাড়াতে এদের খুব বেশিদিন সময় লাগবে না।”

    সামনে ফুটে ওঠা সংখ্যার ধারাটির দিকে খানিক মনোযোগ দিয়ে দেখে মাথা নাড়লেন দেবর্ষী হবিষ্ট, “অঙ্কে কোথাও গুরুতর ভুল হচ্ছে নেরা। সেটি ফের একবার খুঁটিয়ে দেখ। এখন অবধি প্রকৃতিতে ঈশ্বরপ্রজাতির প্রযুক্তিবিকাশের গতিকে ছাড়িয়ে যেতে পারে তেমন জীবের সৃষ্টি হয়নি। মহাকাশচারণবিদ্যা অর্জন করতে আমাদের প্রায় পঞ্চাশ হাজার মহাবর্ষ সময় লেগেছিল। অন্য কোন প্রজাতির পক্ষে তাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা যে কতটা ক্ষীণ তা তুমি জান।”

    নেরা মাথা নীচু করে ঘাড় নাড়ল একবার। গণনাগুলির ফল এতই অবিশ্বাস্য যে সে নিজেও তার উপরে খুব একটা ভরসা রাখতে পারছে না।

    হঠাৎ মৃদু একটা সুরেলা শব্দ বেজে উঠতে চমক ভাঙল তার। তার পরেই হঠাৎ সামান্য কেঁপে উঠে একেবারে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। সমগ্র যানময় ছড়িয়ে থাকা তার অস্তিত্বটি জানান দিয়েছে, বীজসংগ্রাহক গোলকদের শেষ দলটি এইবার এসে পৌঁছে গেছে নৌকার নির্ধারিত কক্ষে। হবিষ্টর দিকে একঝলক মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে দিয়ে ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে একটি ধুলিকণার স্রোত হয়ে তাঁর কক্ষ থেকে বের হয়ে গেল সে।


    ********

    এখন সন্ধ্যা। পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝর্ণাটি কুলকুল করে তাঁর পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে। হবিষ্ট হাত দিয়ে তার জল স্পর্শ করে দেখলেন একবার। বরফগলা জল। তবে এখনও তাতে প্রাণের স্পর্শ নেই। সান্ধ্য প্রকৃতিতে পৃথিবীগ্রহের জীবজগতের যে মিলিত শব্দ ওঠে তারও কোন অস্তিত্ব নেই এখনো এই পঞ্চাশ যোজনব্যাপী উদ্যানে।

    গিরিচূড়াটির পেছন দিক থেকে আরো উঁচুতে উঠে গেছে দ্বিতীয় একটি পর্বতের দেয়াল। তার মাথায় তুষারমুকুট তখনও শেষ সূর্যের আলোয় চিকমিক করছিল। তাঁর সামনের আকাশে তখন চন্দ্রোদয় হচ্ছে। নৌকার কৃত্রিম শক্তি-আবরণের গায়ে এ গ্রহের আকাশের একটি নকল প্রতিচ্ছবি এগুলি, কিন্তু তবু তা দেখতে বড়ো ভালো লাগছিল হবিষ্টর। দীর্ঘদিনের অভ্যাস। এরপর আর একে কখনো দেখা যাবে না হয়ত। খানিক নীচে পায়ের শব্দ হতে হবিষ্ট উৎকর্ণ হলেন। ক্ষিতিজ আসছেন। অনেকক্ষণ ধরেই এইখানে তিনি তাঁর অপেক্ষায় আছেন। যাত্রামুহূর্তের দেরি নেই আর। নিজের অবস্থান থেকে একটু ঝুঁকে নিচের দিকে একবার দেখলেন হবিষ্ট। পাহাড়ের খাড়াই দেয়াল ধরে হাতপায়ের বল প্রয়োগ করে দ্রুতবেগে ওপরের দিকে উঠে আসছেন ক্ষিতিজ। পায়ের ধাক্কায় রাশ রাশ নুড়িপাথর খসে পড়ছিল অনেক নীচে। মৃদুকন্ঠে একটি সুর ভাঁজতে ভাঁজতে উঠে আসছিলেন তিনি। কোন প্রয়োজন নেই যদিও, তবু জড়দেহ অবলম্বন করে থাকার সময় পর্বতারোহণের এই শ্রমসাধ্য খেলাটি খেলতে তিনি বড়ো ভালোবাসেন।

    “দেরি হল যে?”

    “আণুবীক্ষণিক জীবগুলির পরিস্ফূটন শুরু হচ্ছে। তাতেই ব্যস্ত ছিলাম।”

    “কাজ শেষ হয়েছে?”

    “হ্যাঁ। এই গ্রহের কক্ষপথ ছাড়বার সঙ্গেসঙ্গেই সেগুলিকে পরিবেশে স্থাপন করবার কাজ শুরু হয়ে যাবে। শনিগ্রহের কক্ষপথে পৌঁছাবার আগেই কাজটা শেষ করতে--”

    “যাত্রাপথ নির্ধারিত হয়েছে। অনুমতির অপেক্ষায়।” হঠাৎ বাতাসে নেরার কন্ঠস্বর ভেসে আসতে কথাটি সম্পূর্ণ না করে উঠে দাঁড়ালেন ক্ষিতিজ। নিচুগলায় বললেন, “কক্ষপথ থেকে নির্গমনের সময়টুকু যানের নিয়ন্ত্রণ আমি নিচ্ছি নেরা। তুমি কেবল আদেশ পালন কর। আকাশের আবরণ সরিয়ে নাও।”

    হবিষ্টর চাইতে ক্ষিতিজকে একটু বেশিই সমীহ করে নেরা। কোন প্রশ্ন করল না সে। শুধু মাথার ওপরের আকাশটি মুহূর্তে মিলিয়ে গিয়ে পায়ের নীচে ভাসমান পৃথিবী ও দূরে তার কেন্দ্রীয় নক্ষত্রের পরিচিত দৃশ্যটি ফিরে এল।

    “পরবর্তী আদেশের অপেক্ষায় দেবর্ষী ক্ষিতিজ।”

    সাধারণত এ নৌকাটির চালনা করাকে নেরা তার অধিকার বলেই মনে করে থাকে। তবে কোনও গ্রহের কক্ষপথে প্রবেশ ও প্রস্থানের কাজটি দেবর্ষী ক্ষিতিজ কখনোই বিশ্বাস করে তার হাতে ছেড়ে দেন না। সে ব্যাপারে আড়ালে নেরা তার ক্ষোভের কথা জানিয়েওছে হবিষ্টকে। তবে ক্ষিতিজের উপস্থিতিতে সে যে সেই ক্ষোভ প্রকাশ করবে না তা বলাই বাহুল্য।

    ক্ষিতিজ সেই গিরিচূড়ার ওপরে উঠে দাঁড়ালেন এইবারে। দীর্ঘ সাদা চুলদাড়িগুলি হাওয়ায় উড়ছে তাঁর। সামনের আকাশে ঝুলন্ত নীল গ্রহটির দিকে একনজর দেখে নিয়ে হাতের দণ্ডটি তুলে ধরে একবার ইশারা করলেন তিনি। প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই পায়ের বহু নীচে ছড়িয়ে থাকা পঞ্চাশ যোজন প্রান্তরটির দৈর্ঘ বরাবর একসার সুদীর্ঘ মাস্তুলদণ্ড জেগে উঠে সটান উঠে গেল শক্তি আবরণকে ভেদ করে। তাদের গায়ে একে একে খুলে যাচ্ছিল স্ফটিকতন্তু দিয়ে বোনা অতিকায় একএকটি পাল। দেখতে দেখতে নৌকাটি একটি সহস্রদল পদ্মপুষ্পের রূপ নিচ্ছিল। তার দলগুলির ওপর সূর্যের রশ্মি এসে পড়ে ঝলমল করে উঠল একবার--

    একটি রত্নপদ্মের মতই নির্জন আকাশে ঝিকমিক করতে থাকা সেই অতিকায় নৌকা কারও চোখে পড়ল না। নিচে ঘূর্ণায়মান গ্রহটির জীবদের মহাকাশে চোখ রাখবার এখনও ঢের দেরি। সৌরপালগুলির গায়ে আছড়ে পড়া নক্ষত্রবাত্যার চাপে ধীরে ধীরে নৌযানের আবর্তনের গতি বেড়ে উঠছিল।

    গ্রহটিকে তিনচারটি পাক দেবার মধ্যেই তার অভিকর্ষ ও সৌরপালে নক্ষত্রশক্তির দুর্বার চাপ এই দুই মিলে নৌকার গতি যথেষ্ট তীব্র হয়ে উঠল। সহসা ঘুরতে ঘরতেই একটি ঝটকায় সামান্য অভিমুখ পরিবর্তন করল তা, আর তারপর গ্রহগোলকের আকর্ষণ থেকে মুক্ত হয়ে একটি জ্যামুক্ত তীরের মতই গ্রহমণ্ডলটির ঘূর্ণনতল বরাবর ছুটে গেল গভীর মহাশূন্যের দিকে।

    একটি রাজকীয় নৌকার মতই সগর্বে সৌরপালগুলি তুলে ধরে তা এগিয়ে চলেছিল গভীর থেকে গভীরতর মহাকাশের দিকে। নৌকার আকাশে তখন ফের ফিরে এসেছে পৃথিবীগ্রহের আকাশের কৃত্রিম ছবিটি। পরবর্তি তারকাপুঞ্জের গন্তব্যগ্রহ নির্ধারিত হবার পর আকাশের এই ছবি বদলে যাবে নতুন গ্রহের নভোমণ্ডলের প্রতিচ্ছবিতে। তবে তার এখনো দেরি আছে।

    গিরিচূড়াটি নির্জনে একা একা জেগে থাকে। যানের পরিচালনার দায়িত্ব যন্ত্রমস্তিষ্কের বিশ্বস্ত হাতে তুলে দিয়ে ঈশ্বরজীবদুজন ফিরে গিয়েছেন তাঁদের গবেষণাগারে। সামনে সুদীর্ঘ কর্মসাধনা। সঙ্গে করে আনা প্রাণকণাগুলিকে বাড়িয়ে তুলে তারপর সযত্নে রোপণ করতে হবে এই নৌকার ভূমিতে। ক্ষুদ্রতম জলজ প্রাণকণাগুলির স্থাপনার কাজ শুরু হয়ে গেছে এরই মধ্যে। এইবারে ধাপে ধাপে বৃহত্তর ও উন্নততর জীবদের সৃষ্টি হবে। সম্পূর্ণ বাস্তুতন্ত্রটি গড়ে তুলতে এই গ্রহের হিসাবে বড়োজোর চারপাঁচটি সহস্রাব্দ বেশি সময় লাগবে না।

    মহাকাশের অখণ্ড নৈঃশব্দ ও অন্ধকারের মধ্যে একটি রত্নপুষ্পের মত ধীরে ধীরে ভেসে চলল অতিকায় নৌকাটি। যন্ত্রমস্তিষ্কের সতর্ক নিয়ন্ত্রণে তার গতি ধীরে ধীরে বাড়ছিল। একসময় তা এসে স্থির হল মুহূর্তে দশ যোজনে। তার গন্তব্য এই গ্রহমণ্ডলের অতিকায় ষষ্ঠ গ্রহটির কক্ষপথ।



    (চলবে)



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ 'শ্রীশাম্ব'
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments