• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬১ | ডিসেম্বর ২০১৫ | কবিতা
    Share
  • কবিতাগুচ্ছ : নিরুপম চক্রবর্তী


    ওরোপ্রেতো: ব্রাসিল

    আমি তো ডাকিনি তবু স্বপ্নে কেন বারবার ফেরো?
    পাহাড় চূড়ার যীশু মেঘের মতোন কেশ ভাসিয়েছো বৃষ্টির আকাশে
    আমাদের হৃৎপিণ্ড হাতে তুমি তিনশো বসন্ত ধরে স্মিত হেসে দাঁড়িয়ে রয়েছো।

    জলপ্রপাতের মতো বৃষ্টি ঝরে – ব্রাসিলের দুরন্ত শ্রাবণ।
    ওরোপ্রেতো নগরীতে পিছল পাহাড়ি পথে হেঁটে যাই আমি আর পাওলো আসিস;
    ঘড়ির কাঁটারা ঘোরে: অতিদ্রুত অ্যান্টিক্লক গতি,
    তিনশো বছর আগে স্বর্ণময় স্বপ্নদেশে
    পৌঁছে গেছি আজ আচম্বিতে।
    পাথরে ম্যাজিক গড়ে দ্যাখো কেউ
    অসাড় হয়েছে হাত, তাতে বাঁধা হাতুড়ি ও ছেনি:
    যীশুর নির্মাণে রত কুষ্ঠরোগী বারোক ভাস্কর
    অ্যালিজাদিনের গড়া যীশু তুমি হোহো করে কেন হেসে ওঠো?

    চাবুকে রক্তাক্ত পিঠ, সোনার খনির এক উদ্ধত কৃষ্ণ ক্রীতদাস;
    আমি আর পাওলো আসিস তার বিচারক হবো প্রভু,
    যীশু তুমি সহসা আবার
    শ্রবণে বুলিয়ে দিও স্মিত হাসি
    যাতে তার নির্মম ফাঁসির দড়ি অমোঘ বিশ্বাসে যেন
    নিজেরাই পরে নিতে পারি!

    বিদায় বলেছে কেউ
    সমস্ত শহর ঘিরে গির্জা জুড়ে ঘণ্টাধ্বনি বাজে;
    ওরোপ্রেতো শহরেতে বৃষ্টি ঝরে
    নিবিড় পাহাড় জুড়ে সবুজ প্লাবন।
    তিনশো বছর ধরে ফাঁসির দড়িতে দ্যাখো ঝুলে আছে আমাদের
    ফেলে যাওয়া টুপি আর চোগা চাপকান,
    আমাদের ছায়ার শরীর এই দুরন্ত অতীত থেকে বর্তমানে হেঁটে ফিরে যাবে।।


    পারাচী

    ব্রাসিল নামক এক মনোরম দেশ আছে সুদক্ষিণ দিগন্ত সকাশে
    তাহারে সমুদ্র এক চারুকৃত নীবীবন্ধে বাঁধে।
    সে সমুদ্রপারে আছে মনোরমা পারাচী নগরী
    জোয়ারে প্লাবিত হয় প্রতিদিন – সেই বারি মুকুর সদৃশ;
    সুরম্য হর্মরাজি আর এক চপলা বালিকা
    প্রতিদিন সেইস্থানে আপনার প্রতিবিম্ব দ্যাখে।

    ট্যুরিস্ট তুমি কি কভু হারায়েছো পথ হেথা? মোর নাম কপালকুণ্ডলা,
    মোর নাম চম্পাকলি, এইস্থানে আমি ইসাবেলা
    রাজার নন্দিনী আমি, পিতা মগ্ন ফুটবল ক্রীড়ায়
    পারাচী নগরে বাস, জলমগ্ন মায়ামুকুরেতে
    ফুটিছে আমার ছবি (হৃদ্‌পদ্মে পারিলে রাখিও!)
    ক্লান্ত আমি, ভগ্ন আমি,
    ফুটিছে আমার ছবি, ফুটিতেছে আমার অতীত –
    অষ্টাদশ শতাব্দীতে এ পারাচী যেইরূপ ছিলো।

    অষ্টাদশ শতাব্দীতে পারাচীর বাণিজ্য বাতাস
    যুদ্ধের সন্দেশ বহে – আসিতেছে রণতরী
    রণমত্ত ফরাসী নাবিকবৃন্দ তরবারে পথ কাটি
    হারাইবে পর্তুগীজে, স্বর্ণের রাজস্ব নিয়া তুলিবে নোঙর।
    বিভোর বালুকাবেলা, ঊর্মিভঙ্গে বিহ্বলা নগরী,
    কাহারে খুঁজিয়াছিলে ইসাবেলা সেইদিন? কার তরে আজও দাঁড়ায়েছো?

    জোয়ারে প্লাবিত হয় এ পারাচী, সে মায়ামুকুরে আজও
    বিম্বিত হয় কারা? দেখিয়াছো ইসাবেলা: রক্তাক্ত বিক্ষত মুখ,
    মৃত চক্ষু এখনও তাকায়,
    সমুদ্র-জোয়ারে দ্যাখো ফেরে মৃত নাবিকেরা,
    অবয়বহীন তবু ভালোবাসা চায়!


    সূর্যক্ষত

    তার কোনো নাম নেই ভুল শহরে
    একা একা ছিলো শালা প্রান্তে পড়ে।

    একা একা ছিলো তাই মুদ্রাদোষে
    কিছু লজ্জাবিহীন সুর শিখেছিলো সে।

    কিছু স্পর্ধিত গান ছিলো হিংস্র স্তবে
    তারা কান্না জড়ানো রাতে মরেছে কবে!

    কিছু স্তম্ভিত নীরবতা, তীব্র ব্যথা
    কিছুটা বিষাদ ছিলো আকুতি ঠাসা।

    তার কেবলই নিজের স্বর বেজেছে ঘুরে
    নিজেকেই কুরে খেয়ে রাত দুপুরে।

    (সে তো স্বপ্ন সেলাই করে
    রেখেছে জীবন ভরে
    নিজেকে খুঁজতে চেয়ে
    আলোতে ফিরে!)

    তবু আহত আকাশে শুধু স্তব্ধ হাওয়া
    (একাই এসেছে শালা, একাই যাওয়া!)

    তবু জেনেছে যাওয়ার আগে সে অন্তত:
    মৃত দিনগুলো ছিলো বেদনাহত!

    তাই হয়েছে নিজেরই কাছে সে আজ নত,
    তার অন্ধকারের গানে
    সূর্যক্ষত।।


    মুখ

    স্বর্গীয় আননে সুখস্মৃতি।

    সেই মুখ অন্ধকার,
    জটিল কুটিল কিছু বলিরেখা
    জীবনের নীরবতা নিয়ে
    পলিভরা নদী হয়ে বয়ে যায়:

    সেই মুখ একান্ত তোমার।

    সেই মুখ দ্যাখো আজ নির্মোকের মতো সেজে উঠে
    চলে যায় আলোকবেলায়।
    তাকে ফিরিওনা।
    যদিবা যন্ত্রণাগুলো কণ্ঠস্বরে এঁটে বসে ফাঁসের মতোন
    তবু ফিরিওনা।
    একদিন আলোর শহরে
    আলোকিত আনন্দেতে নিজেকে রিক্ত করে, নিঃস্ব করে
    নিজেই উঠবে হেসে সেই মুখ, পরিচিত তমিস্রার স্বরে।
    অজস্র আলোর দেশে নির্বাসিত দুঃখী মুখ
    আলোকিত কৃতান্ত নগরে।


    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)