• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬১ | ডিসেম্বর ২০১৫ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • ২১-তম কোলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের ছবি : তাপস চক্রবর্তী

    || ম্যানুয়েল ডে অলিভিয়েরার 'দি স্ট্রেঞ্জ কেস অফ এঞ্জেলিকা' ও 'একসেন্ট্রিসিটিজ অফ এ ব্লন্ড হেয়ারড গার্ল'||

    বছর কোলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব হয়ে গেল গত নভেম্বর। বহু দেশি ও বিদেশি ছবি এই চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হল। এই বছর পর্তুগীজ পরিচালক ম্যানুয়েল ডে অলিভিয়েরার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ হিসেবে ওর বেশ কতগুলি ছবি এই উৎসবে দেখানো হল। তার মধ্যে আমার পছন্দের দুটি ছবি নিয়ে দু-এক কথা আলোচনা করব।

    ২০১০ সালে উনি তৈরি করেছিলেন দি স্ট্রেঞ্জ কেস অফ এঞ্জেলিকা। অলিভিয়েরা বাস্তবের সঙ্গে অবাস্তব, বাস্তবের সঙ্গে স্বপ্ন মায়া বিভ্রম এমনভাবে মেশান যে আজকের ছবি যে কোন কাল সময়ের গণ্ডি পেরিয়ে যায়। এই ছবিতে এক যুবক ফটোগ্রাফার আইজাক এক মধ্যরাতে বৃষ্টির ভেতর হঠাৎ ডাক পেয়ে এক বর্ধিষ্ণু পরিবারের বাড়িতে একজন সদ্য মৃত মহিলার ছবি তুলতে যান। শোকস্তব্ধ বাড়িতে অতি সুন্দরী একটি মেয়েকে ডিভানে শোয়া অবস্থায় দেখে আইজাক। তার মৃতমুখে অদ্ভুত এক মায়ামাখানো হাসি। বিভিন্ন দিক থেকে ছবি তুলতে তুলতে একটা ক্লোজ আপ নিতে যখন আইজাক তার ক্যামেরার লেন্সে ফোকাস ঠিক করছেন, হঠাৎ তার ক্যামেরার দিকে সেই মৃত সুন্দরী এঞ্জেলিকা চোখ খুলে তাকিয়ে সুন্দর একটা হাসি দেন আইজাককে। চমকে উঠে সে লক্ষ্য করে ঘরের কেউ সেটা দেখতে পায়নি। একমাত্র সেই এটা দেখেছে। এরপর আইজাকের জীবনটাই পাল্টাতে শুরু করে। তার রাতের ঘুমে এঞ্জেলিকা এসে বারান্দায় দাঁড়ায়। তার সঙ্গে আইজাক উড়ে চলে যায় শহরের ওপর দিয়ে। নদীকে ছুঁয়ে মেঘের ভেতর যেতে যেতে হঠাৎ এঞ্জেলিকার হাত ফস্কে সে নীচে পড়ে যেতে যেতে চমকে উঠে দেখে সে বিছানায় শুয়ে ঘামছে। শহরের যা কিছু পুরনো চালচলন জীবনযাত্রা তার দিকেই আইজাকের ছবি তোলার ঝোঁক বেশি। হাতে কুড়ুল নিয়ে যারা আঙুর ক্ষেতে চাষ করছে তাদের ছবি তুলতে যায়, সেখানে ট্রাক্টর দিয়ে চাষ হচ্ছে, তার দিকে সে কোন নজর দেয় না। তার ঘরের সামনে দিয়ে প্রচণ্ড শব্দে গতিতে বড় বড় ট্রাক পেট্রলট্যাঙ্কার গাড়ি চলে যায়। সে তার সমস্ত ঘরে এক অদ্ভুত নিঃস্তব্ধতার মধ্যে নিজেকে খুঁজে পায়। এঞ্জেলিকার হাসি মুখ তাকে দিনরাত তাড়া করে বেড়ায় এবং অসুস্থ অবস্থায় একদিন সে এঞ্জেলিকার ছায়ার পেছনে দৌড়তে থাকে এবং সংজ্ঞাহীন অবস্থায় মাঠে পড়ে যায়। সে সুস্থ হওয়ার আগেই এঞ্জেলিকা তার বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। তার অসুস্থ শরীর বিছানা থেকে উঠতে গিয়ে মাটিতে আছাড় খায়। আর তার আত্মা দেহ থেকে বেরিয়ে এঞ্জেলিকার সঙ্গে অবশেষে মিলিত হয়ে আকাশের দিকে উড়ে যায়।

    অলিভিয়েরা আইজাকের বারান্দা থেকে দূরের পাহাড়ে ছবির মত একটা হ্রদকে বার বার দেখান। সেই সঙ্গে শহরের তীব্র যান্ত্রিক গাড়ির শব্দে কান ঝালাপালা করে দেন। তিনি কি পরিবেশ সচেতনতার কথা বললেন? ট্র্যাক্টর নয় মানুষের ঘাম ফেলে যে চাষ হয় তাকেই রাখতে বলছেন? আধুনিক শহুরে জীবনের প্রতি কেন অনীহা বোঝা গেল না। তিনি ছবিতে জানিয়ে দেন সরকার টাকার অভাবে ব্রিজ বানাতে পারছে না। চার্চের সামনে ভিখিরিকে পয়সা ভিক্ষে করতে দেখান। অতীতের পুরনো ব্যাপার-স্যাপার গুলোর মধ্যে সবই খাঁটি ছিল। মানুষ এবং প্রকৃতি। আর আজকের শহরে এঞ্জেলিকার হাসি মুখ আর সুন্দরীত্বের মধ্যে সবই মায়া বিভ্রম এবং অবজ্ঞতা—সেটাই বোধহয় অলিভিয়েরা আমাদের এই ছবিতে দেখাতে চেয়েছেন। সবার ভাল নাও লাগতে পারে ছবিটা।

    * * * *

    লিভিয়েরার অন্য ছবিটি একসেন্ট্রিসিটিজ অফ এ ব্লন্ড হেয়ারড গার্ল। ২০০৯ সালের ছবি। এটি একটি চমৎকার প্রেমের গল্প। খুব স্বাভাবিক ভাবে ফ্ল্যাশব্যাকে গল্পটা দেখিয়েছেন। ম্যাকারিও তার দাপুটে বড়লোক কাকার অফিসে কেরানীর চাকরি করেন। অফিসের পাশের বাড়ির দোতলায় সুন্দরী স্বর্ণকেশী একটি যুবতীকে চমৎকার একটা হাত-পাখা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে দেখতে তার প্রেমে পড়ে যায়। আলাপও হয়ে যায়। ম্যাকারিও বিয়ে করবে বলে স্থির করে এবং কাকাকে বলে মাইনে বাড়িয়ে দিন, আমি বিয়ে করতে চাই। কাকা তাকে চাকরি থেকে ছাড়িয়ে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেন। ম্যাকারিও চাকরি খুঁজতে বেরোয়। মেয়েটিকে অপেক্ষা করতে বলে। অনেক দূরের শহরে চাকরি একটা পেয়েও যায়। কিছুদিন বাদে অনেক টাকা জমিয়ে সে ফিরে আসে। কাকার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে এখন আমি ভাল চাকরি করছি, অনেক টাকা জমিয়েছি, এবার আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি। আপনি আশীর্বাদ করুন। কাকা তার দিকে তাকিয়ে বলেন—এটাই আমি চেয়েছিলাম। তুমি নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে সাবলম্বী হয়ে বিয়ে করো। তুমি সত্যি খুব ভালো ছেলে। তোমার চারিত্রিক দৃঢ়তা দেখে আমি খুশি হয়েছি। চাকরিটা ছেড়ে দাও, আজ থেকে তুমি আমার ব্যবসার পার্টনার। আমার এই বাড়িতেই থাকবে। যাও, বউ নিয়ে এসো। ম্যাকারিওর কাছে সবকিছু যেন গল্পের মত মনে হয়। সে ছুটে চলে গিয়ে বান্ধবীকে সব বলে। তক্ষুনি বেরিয়ে পড়ে বিয়ের আংটি কিনতে। দামী গয়নার দোকানে গিয়ে একটা আংটি পছন্দ করে ফেলে। একটু সাইজে বড় বলে সেটাকে ছোট করতে বলে। দোকান থেকে বেরোবার সময় দোকানদার বলে অন্য আংটির দাম দিন। আপনার হবু স্ত্রী অন্য আংটি আঙুলে পরে নিয়েছেন। ম্যাকারিও স্তম্ভিত হয়। হাতে পরে ফেলা আংটির দাম চুকিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে এসে স্বর্ণকেশী হবু বৌকে বলে; ছিঃ তুমি একটা চোর! একটা চোর! আর কক্ষনো আমার মুখ দেখবে না। সে আবার সেই দূরের শহরের দিকে যাবার জন্য ট্রেনে উঠে পড়ে। ট্রেনে পাশে বসা মহিলাকে পুরো গল্পটা ফ্ল্যাশব্যাকে বলতে বলতে যায়। ছবি শেষ।

    শহরের যেসব যুবকেরা আজও বিদ্যাশিক্ষার দাম জানে, নিজের চরিত্রের শুদ্ধতা জানে; যারা আত্মবিশ্বাসী, কর্মঠ এবং সৎ—তারা তাদের ভালবাসাও বিসর্জন দিয়ে দিতে পারে। কোন গভীর ভালবাসার সম্বন্ধও ঠুনকো হয়ে যায়। অলিভিয়েরা চমৎকার ভাবে সেটা এই ছবিতে তুলে ধরেছেন। এখানেও বড় অদ্ভুতভাবে শহরের যান্ত্রিক গাড়ির আওয়াজ পেছনে রেখে উনি শব্দ দূষণের দিকে ইঙ্গিত করেন। ২০০৯ সালে চাকরির জন্য দরজায় দরজায় ঘুরে বেড়ানো অনেকেরই কপালে ছিল পর্তুগালে। অন্যদিকে, বিশেষ বড়লোকদের দৃঢ়তা রুক্ষতার ভেতরেও যে মনুষ্যত্ব আছে কাকার চরিত্রের ভেতর দিয়ে তা বলবার চেষ্টা করেছেন। মাত্র এক ঘন্টার ছবি, এবং শেষ মোচড়টা একেবারেই তাজ্জব বানিয়ে দেয় দর্শককে। বেশ ভাল ছবি।

    || ইরানের ছবি—জাফর পানাহির 'ট্যাক্সি' ||

    ছবি ২০১৫ সালের আধুনিকতম ইরানের ছবি। ছবির পরিচালক, প্রযোজক, চিত্রনাট্য, ক্যামেরা, এডিটিং এবং নায়কও তিনি নিজেই। একদিনের ট্যাক্সি ড্রাইভারের অভিজ্ঞতা নিয়ে ছবি করবেন বলে নিজেই একটা ট্যাক্সি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন, তার সারা দিনের অভিজ্ঞতা এ ছবির বিষয়বস্তু।

    সাম্প্রতিক ইরানের সামাজিক অবস্থা এবং নিরপেক্ষভাবে তাকে অবলোকন করে যাওয়া এক অদ্ভুত নৈরাশ্যের জন্ম দেয়। সিডি ডিভিডি বিক্রেতা প্রথমে তার গাড়িতে ওঠে যাকে প্রথমে দেখাই যায় না। একজন স্কুল শিক্ষয়িত্রী এবং একজন লোক উঠে কথোপকথন শুরু করে। কথায় কথায় লোকটি বলে সেদিন একদল লোক আমার বন্ধুর গাড়ির চারটে চাকা চুরি করে চলে গেছে। এই চোরগুলোকে ধরে ধরে ফাঁসি দিতে হয়। শিক্ষয়িত্রী মহিলা বলেন--তারা কোন অভাব থেকে কাজটা করল সেই অভাবটাকে দূর করার চেষ্টা করুন। ফাঁসি দিয়ে এর কোনদিন সুরাহা হবে না। লোকটি নামবার সময় মেয়েটি জিজ্ঞেস করল আপনি কি কাজ করেন? লোকটি বলে আমি একজন ছিনতাইবাজ। মোটর সাইকেল অ্যাক্সিডেন্টে মর মর একটি রক্তাক্ত লোক ওঠে। ক্রন্দনরত স্ত্রীকে সে বলে মোবাইলে ভিডিও কর শিগগির, আমার শেষ উইল বলছি। সে লোকটি তার সমস্ত সম্পত্তি তার স্ত্রীকে দিয়ে যান এবং বলেন আমার ভাইবোন অন্য কেউ যেন আমার স্ত্রীকে সম্পত্তি থেকে বেহাত না করে। পানাহি বলে দেন ইরানের আইন বিরুদ্ধ এটা। স্ত্রীর কোন অধিকার নেই স্বামীর সম্পত্তিতে। দুজন মহিলা একটা গোল্ড ফিশ নিয়ে রাখতে চলেছেন একটি ঝরনার কাছে, যেটাকে ছোট্ট বাচ্ছা অবস্থায় নিয়ে এসেছিলেন। এখন সেখানে ফেরত দিয়ে নতুন একটা বাচ্ছা গোল্ড ফিশ নিয়ে আসবেন। শেষ দৃশ্যে দুজন ছিনতাইকারী মোটর সাইকেলে করে ওর গাড়ি থেকে মোবাইল ফোনটা চুরি করতে আসে যাতে মৃতপ্রায় লোকটির উইল বলা আছে। এর পর সমস্ত স্ক্রিনটাই কালো হয়ে যায়। ছবি শেষ হয়।

    এই ছবিতে পানাহি তার ছোট্ট স্কুলপড়ুয়া ভাগ্নীকে স্কুল থেকে তুলে সঙ্গে নিয়ে ঘুরছেন, সে তার ক্যামেরা দিয়ে মামাকে এবং তেহরান শহরকে ছবিতে তুলছে যে ভিডিওটা তার স্কুলের প্রতিযোগিতায় দেখাবে। তার সঙ্গে কথায় কথায় তিনি আমাদের জানিয়ে দেন যা বাস্তব যা সত্যি যা মানুষের মনের কথা সেটাই বলা শিল্পের কাজ। সেটা আইন অমান্য করল কিনা, কোন রাজনৈতিক মতবাদের বিপক্ষে গেল কিনা কোন পুরনো ঐতিহ্যকে আঘাত করল—এটা শিল্পীর বিচার্য নয়।

    এই ছবিতে ক্যামেরা কখনো ট্যাক্সি ছেড়ে বাইরে এক পা-ও বাড়ায়নি। অথচ কি আশ্চর্যভাবে ঐ ট্যাক্সির ভেতর থেকে ইরানের মানুষের সুখ, দুঃখ, ভয়, আশা, হতাশা, আবেগ, তাদের মনের বহিঃপ্রকাশ তুলে ধরেছেন নির্বিকারভাবে। তিনি নিজে তার মিষ্টি হাসি দিয়ে সব শুনছেন কিন্তু কোন ভাষণ চাপিয়ে দেননি। প্রতিবাদের ছবি, উত্তরণের ছবি যে এত নিরুচ্চারভাবে সোচ্চার হয়ে উঠতে পারে পানাহির এ ছবিটা দেখার আগে জানতাম না।

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)