|| ছয় ||
যাঁর নামে ব্যাসিলিকা এবং তার সামনের প্রাঙ্গণ, সেই সেন্ট পিটার খৃষ্টের বারোজন প্রাথমিক শিষ্যের একজন, এবং মনে করা হয় খৃষ্ট-নির্দেশিত প্রথম পোপ। ইংরেজি ভাষায় ব্যাসিলিকা শব্দটির মানে সময়ের সাথে প্রসারিত হয়েছে। বর্তমানে সব থেকে বেশি প্রযুক্ত হয় কোনো বৃহৎ ও বিশেষ গির্জাকে চিহ্নিত করতে, যার বিশেষত্ব পোপ স্বয়ং নির্দিষ্ট করেছেন। সেন্ট পিটারস্ ব্যাসিলিকা ক্যাথলিক খৃষ্টধর্মের মাদার চার্চ নয়, বা রোমের বিশপ তথা পোপের মুখ্য গির্জাও নয়। তবুও এই ব্যাসিলিকা স্ব-মহিমায় একক, মনে করা হয় রেনেসাঁস স্থাপত্যের সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ, এবং পৃথিবীর বৃহত্তম গির্জার একটি। সেন্ট পিটার সমাহিত আছেন এই ব্যাসিলিকায়, এবং তারপরে আরো বহু পোপ এইখানে সমাহিত হয়েছেন; শেষ প্রয়াত পোপ দ্বিতীয় জন পল পর্যন্ত। সেন্ট পিটারস্ স্কোয়ার পেরিয়ে ব্যাসিলিকার দিকে আসতে অ্যাপোস্টোলিক প্যালেস দেখলাম এদিক থেকে। এই প্রাসাদের ভিতরেই পোপের প্রথাগত বাসস্থান, ভ্যাটিকান রাষ্ট্রের বিবিধ কার্যালয়, এবং ভ্যাটিকান মিউজিয়াম্স। ২০০৫ সালের মার্চের শেষে, দ্বিতীয় জন পল যখন মৃত্যুশয্যায়, তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী ভ্যাটিকানের ভিতরেই চিকিৎসা হচ্ছে, এই অ্যাপোস্টোলিক প্যালেস-এর একদম উপরতলায় পোপের ঘরের বাতি জ্বালিয়ে রাখা হয়েছিল প্রত্যেক রাত্রে, সারারাত, যতক্ষণ জীবিত ছিলেন, দোসরা এপ্রিল অবধি। সেন্ট পিটারস্ ব্যাসিলিকার বারান্দা থেকে ইষ্টার এবং খ্রীষ্টমাসে পোপ ভাষণ দেন, উর্বি এট অর্বি&mdash,টু দ্য সিটি অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ল্ড। ল্যাটিনের প্রতি ইংরেজির ঋণ লক্ষ্যণীয়, সম্ভবত আর্বান শব্দটির উৎস উর্বিতে, এবং অর্বি থেকে অর্ব, এবং তার থেকে বোধহয় অর্বিট।
সেন্ট পিটারস্ ব্যাসিলিকার আদি সংস্করণ তৈরি হয়েছিল তদীয় মহিমা সম্রাট কন্স্ট্যানটাইনের যুগে, চতুর্থ শতকের প্রথম দিকে। তার প্রায় হাজার বছর পরে, পোপ দ্বিতীয় জুলিয়াসের আমলে পুরোনো ব্যাসিলিকার আমূল সংস্কারের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। তারপর একশো কুড়ি বছর এবং কুড়ি জন পোপের শাসন পেরিয়ে চলে এই সংস্কারের কাজ। ঠিক হয়েছিল কাজ শুরু করার আগে পুরোনো ব্যাসিলিকা ভেঙে ফেলে তার জায়গায় উঠবে নতুন ব্যাসিলিকা। কেমন হবে নতুনের নক্সা, তা ঠিক করতে প্রতিযোগিতা হয়। সে যুগের বড় বড় আর্কিটেক্টরা প্ল্যান দিয়েছিলেন। তার মধ্যে থেকে ব্রামান্টের নক্সা নির্বাচিত হল, ব্যাসিলিকার শিলান্যাস ১৫০৬ খ্রীষ্টাব্দে। ১৫৪৭ খ্রীষ্টাব্দে বাহাত্তর বছরের বৃদ্ধ মাইকেলেঞ্জেলো হলেন ব্যাসিলিকা নির্মাণের সুপারিন্টেনডেন্ট। ব্রামান্টে যারা গেছেন ১৫১৪ সালে, ব্যাসিলিকার প্রধান নির্মাতার দায়িত্ব বদলেছে বার বার, একদা দায়িত্বে থাকা রাফায়েলও মারা গেছেন সাঁইত্রিশ বছর বয়সে। মাঝে পঞ্চম চার্লস রোমকে একপ্রস্ত গুঁড়িয়ে গেছেন ১৫২৭-এ। কারণটা বেশ জটিল, তৎকালীন ইয়োরোপে ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ মিলে যেমন পাঁচন তৈরি হত, সেইরকম কোনো কম্পাউন্ড কারণ। এইসব টানাপোড়েনের মাঝে, প্রত্যেক নির্মাতা প্ল্যান বদলেছেন খানিকটা করে, কিন্তু নির্মাণের কাজ বিশেষ এগোয়নি। তখনও সিস্টিন চ্যাপেলের লাস্ট জাজ্মেন্ট ছবিতে মগ্ন মাইকেলেঞ্জেলো, খানিক অনিচ্ছায় নিয়েছিলেন এই গুরু দায়িত্ব। তবে মাইকেলেঞ্জেলোরা ইচ্ছুক-অনিচ্ছুকে বিভেদ করতেন না। ঢেলে দিয়েছিলেন জীবনের শেষ দেড় শতক। আজ যে ব্যাসিলিকা আমরা দেখছি, তা প্রধানতই মাইকেলেঞ্জেলোর কীর্তি। কিন্তু তাঁর হাত দেওয়ার আগের প্রায় চল্লিশ বছর কাজ প্রায় কিছু না এগোলেও, আগের নক্সা বাতিল করে শুরু করেননি মাইকেলেঞ্জেলো। পূর্বসূরীরা যা ভেবেছেন, তাকে সংহত করে, সেই ভিত্তির উপর নিজের সৃষ্টিকে দাঁড় করিয়েছেন। যে স্রষ্টারা অতীতের ঋণে লজ্জিত হন না, ভবিষ্যতও তাঁদের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করে না। মাইকেলেঞ্জেলোর নির্দেশে যখন ব্যাসিলিকার কাজ শুরু হল পুরোদমে, ভাবনা ছিল, শেষ হবার আগে তিনি চলে যাবেন না তো। মাইকেলেঞ্জেলো মারা গেলেন ১৫৬৪তে, অষ্টাশি বছরের জীবন যেন কীর্তির কুচ্কাওয়াজ। সেন্ট পিটারস্ ব্যাসিলিকার নির্মাণ শেষ হল ১৫৯০ তে। নির্মাণকে এমন জায়গায় নিয়ে গিয়ে, তবেই গিয়েছিলেন মাইকেলেঞ্জেলো, শেষ হওয়া ছিল শুধুই সময়ের অপেক্ষা। ২০০৭ সালে অকস্মাৎ পাওয়া গেছে মাইকেলেঞ্জেলোর লাল চক দিয়ে আঁকা স্কেচ, সেন্ট পিটারস্ ব্যাসিলিকার অভ্রভেদী চূড়ো বা ডোমের নক্সা, সম্ভবত তাঁর আঁকা শেষ স্কেচ। আশ্চর্যের ব্যাপার কি করে এই স্কেচ রক্ষা পেয়েছে; মাইকেলেঞ্জেলো জীবনের শেষে নিজের সব ডিজাইনের স্কেচ নষ্ট করেছিলেন। হয়ত চেয়েছিলেন ভাবীকাল তাঁর কীর্তিকেই দেখুক, পিছনের কর্ষণ বিলীন হোক বিস্মৃতিতে। রক্তকরবীর বোধহয় উনিশটি খসড়া হয়েছিল। তার মধ্যে ক’টি পেয়েছি আমরা?
মার্কিন দার্শনিক র্যালফ ওয়াল্ডো এমার্সন উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি বলেছিলেন সেন্ট পিটারস্ ব্যাসিলিকা সম্বন্ধে, “An ornament of the earth ... the sublime of the beautiful.” শব্দ-প্রয়োগ অনন্য। এবং সে যুগের মার্কিনিরা যে এ যুগের মত অত সহজে বাহবা বিলোতেন না, তা ব্যাসিলিকায় ঢুকে নিমেষেই পরিষ্কার হয়। ভিতরটা যেন একটা বিস্তীর্ণ ক্যানভাস, স্থান আর কাল এক হয়ে গেছে, ভাস্কর্যে শিল্পে ছয়লাপ। দেবশিশু জল খাচ্ছেন, পিঠে পরীর পাখনা; খ্রিস্টীয় সন্তদের মর্মর মূর্তি, সাধনার বিভিন্ন মুদ্রায়। সেন্ট পিটার বসে আছেন ধ্যানমগ্ন, ডান হাতের তর্জনী আকাশের দিকে। কালো অ্যালাবাস্টারের মূর্তির মাথায় স্বর্ণালী চক্র। বহু পোপদের নামাঙ্কিত মনুমেন্টও। দেওয়ালে একটা আঙুল ছোঁয়ালেও মনে হয়, মানুষের প্রায় ঐশিক কীর্তিকে যেন স্পর্শ করলাম। এক একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে, সামনের ছবি বা মূর্তির সম্বন্ধে কিছুই না জেনেও, শুধু যে প্রতিভা আর পরিশ্রম এর ভিতরে নিহিত আছে, তার আন্দাজ বিহ্বল করে। আর এই সবই হয়েছে যে সময়, তখন থেকে মানুষের যন্ত্রসভ্যতার উত্থান আরও কয়েক শতক দেরি। ভিতরের কত সৃষ্টির তো নামই জানা হল না, শুধু চোখ আর মন সাক্ষী থাকল, সামনে একবার দাঁড়িয়ে ছিলাম। সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার মধ্যে, একাধিক ছোট ছোট চ্যাপেলে নিভৃত প্রার্থনার জায়গা। তেমনি একটি চ্যাপেলে রয়েছে মাইকেলেঞ্জেলোর পিয়েতা, হয়ত পৃথিবীর সব থেকে পরিচিত মূর্তির মধ্যে একটি। চব্বিশ বছর বয়েসী মাইকেলেঞ্জেলো কাজ শেষ করেন এই ভাস্কর্যে, তখন সেটি তাঁর মাত্র তৃতীয় সম্পূর্ণ কাজ। কারারা মার্বেলের মূর্তিতে মাতা মেরীর কোলে শুয়ে আছেন খ্রিস্ট। ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার পরে। প্রাণহীন। মূর্তির প্রতিটি মিড়, মর্মর নৈ:শব্দে খানখান করে দেয়। মেরীর মুখের দিকে তাকানো যায় না। ভেবে অবাক হতে হয়, কি অপার জীবনবীক্ষায় চব্বিশ বছরের টগবগে মাইকেলেঞ্জেলো, মেরীর মনটা বুঝতে পেরেছিলেন, খ্রিস্টের মত পুত্র যিনি পেয়েছিলেন। হারিয়েছিলেন। পিয়েতার সামনেই সব থেকে ভিড়; পিছনের সবাই দেখতে উন্মুখ, সামনে আসতে চান। কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে আমরা এগোলাম। সেই প্রায় দু হাজার বছর আগের ঘটনা‐একদিন যারা মেরেছিল তাঁরে গিয়ে/ রাজার দোহাই দিয়ে—হঠাৎ মনে হল কতটাই কাছের।
ব্যাসিলিকার ডোমের ঠিক নীচে এবং প্রধান বেদীর উপরে চাঁদোয়ার মত, বার্নিনি সৃষ্ট সেন্ট পিটারস্ বল্ডাচিন, আটানব্বই ফুট উঁচু, মনে করা হয় পৃথিবীর বৃহত্তম ব্রোঞ্জের স্ট্রাক্চার। এর কাছাকাছি গিয়ে বালকের জুতো খুলতে ইচ্ছা হল। ব্যাসিলিকায় জুতো খোলা আবশ্যিক এমন কোথাও লেখা নেই। আমরা বললাম, আহ জুতো খুলছো কেন? ততক্ষণে খোলা হয়ে গেছে। মেঝেতে পা দিয়েই শোনা গেল কি ঠাণ্ডা, এখানে বসব। আমরা বললাম, ঠিক আছে বোসো একটু। মেঝেতে বিবিধ ও অসাধারণ নক্সা সব; ব্যাসিলিকার প্রায় দশ হাজার বর্গ মিটারের মোজাইক, সবটাই অনন্য। তার উপরে বালক প্রায় শুয়ে, তারপর গড়াগড়ি। যেখানে যেটা করতে হয় না সেটাই করতে অবোধ ও সবোধ সব শিশুদেরই খুব উৎসাহ। আমরা ভাবলাম, ব্যাসিলিকায় বসে পড়া অবধি হয়ত অ্যালাওড হবে, বালক বলে। কিন্তু মেঝেতে গড়াগড়ি নিশ্চয় বেদম বেসহবৎ। তাড়াতাড়ি তুলতে গিয়ে ভাগ্য ভাল বালকের নজর পড়ল অন্য কিছুর দিকে। আরে, ঐ তো সূর্য, বলে সামনের দিকে ছোটা শুরু। সূর্যের কাছে পৌঁছানো মুস্কিল, পৌঁছলে আরো, ভাগ্য ভাল ওটা সুর্য ছিল না, তবে সূর্যের আলো বিলক্ষণ আসছিল। ক্যাথেড্রা পেত্রি বা সেন্ট পিটারের সিংহাসন, ব্যাসিলিকার এক প্রান্তে সযত্নে রক্ষিত একটি কাঠের চেয়ার, কারুকার্য করা গিল্ট ব্রোঞ্জের ফ্রেমের মাঝে বসানো। এককালে পোপরা ব্যবহার করতেন, শুরু সেন্ট পিটারের সময় থেকে। বালকের দৃষ্টি গিয়েছিল সিংহাসনে নয়, তার উপরে। বোহেমিয়ান কাঁচের এলিপ্টিক জানালা, বারোটি ভাগে বিভক্ত, খ্রিস্টের প্রথম বারোজন শিষ্যের স্মরণে। চারপাশে অসংখ্য দেবদূত আর ঘূর্ণায়মান মেঘের স্থাপত্য, আর মাঝখানে ডানা মেলা কবুতরের প্রতিকৃতি। চার্চের চিরজীবী সত্তার প্রতীক; সদা ভাস্বর। জানালার ওপারে সূর্যের উপস্থিতি, উজ্জ্বল, অথচ স্নিগ্ধ। ব্যাসিলিকার মধ্যমণি এই গ্লোরিয়া। বালক খুঁজছিলেন সিঁড়ি, বেয়ে ওঠার জন্য; নেই তেমন সোপান। গ্লোরিয়া শুধুই দৃষ্টিগোচর, আর অনুভবগম্য। গ্লোরিয়ায় পৌঁছতে না পারার দু:খ ভুলে হঠাৎ বালকের মুখে, ঐ তো: অনেক আলো! আমরা তাকিয়ে দেখি আকাশ থেকে যেন নেমে এসেছে তেরচা ভাবে। মাথা বলল নিশ্চয় অপ্টিক্সিয় ব্যাখ্যা আছে কিছু। মন বলল, ওসব ভুলে দেখে নাও এখন, মর্ত্য-কাছে স্বর্গ যা চায়। অবাক হতে হয় দেখে, আলোর প্রবাহ প্রায় স্বচ্ছ, ব্যাসিলিকায় বোধহয় ধূলাও লজ্জা পায়। পরে জেনেছিলাম এই হল ক্রেপাস্কুলার রে-স। ল্যাটিন ক্রেপাস্কুলাম বা গোধূলি থেকে এর নাম। মুখ্যত দিনরাত্রির সন্ধিতে, মেঘ বা অন্য কিছুর ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো বেরিয়ে আসে যখন, দৃষ্টিতে মনে হয় সব আলোর রেখাই শুরু হয়েছে আকাশের একটি বিন্দু থেকে। আসলে কিন্তু সবই সমান্তরাল রবিরশ্মি। এ সব তো পরের জ্ঞান। সেই সময়টা মনে হয়েছিল, সত্যি আজ আলোর দেখা মিলল। ক্রেপাস্কুলাম রে-স যখন এসে গেছে, ক্রেপাস্কুলামও আগত। আমরা পায়ে পায়ে বেরোলাম ব্যাসিলিকা থেকে। বাইরের আলোটাকে কেমন ফ্যাকাসে লাগল। অত: কিম?
|| সাত ||
সেই সকালে ভ্যাটিকান আসবার পথে বাস থেকে দেখেছিলাম, ভ্যাটিকানের চূড়ো জড়িয়ে এক সরু বারান্দায় উদ্বাহু হয়ে সেলফি নিচ্ছেন বহু প্রাণী। চড়া যায় তাহলে ঐ উঁচুতে। ভ্যাটিকান দেখা ফুরিয়ে যাওয়াকে আরেকটু আটকে রাখতে আমরা চললাম অমন উত্তরণের খোঁজে। শিগগিরিই জানা গেল, ওঠার উপায় দুরকম। সেন্ট পিটারস্ ব্যাসিলিকার ডোমের পোশাকি নাম ক্যুপোলা। মাটি থেকে ৫৫১টা ধাপের সিঁড়ি, ভ্যাটিকানের ছাদ অর্থাৎ ডোমের নীচ অবধি লিফট যায়, সেটা নিলে ৩২০টা ধাপ বাঁচবে, তার উপরে শুধুই সিঁড়ি যায়। স্পষ্ট সাবধানবাণী সাঁটা টিকিট কাউন্টারের দেওয়ালে; দুর্বল হৃদয়, উচ্চ রক্তচাপ বা মাথা ঘোরার বাই থাকলে চড়ার চেষ্টা বাঞ্ছনীয় নয়। কারোর বিপদ হলে কতৃপক্ষ দায়ী নয়। পেটে না খেলে পিঠে সয় না তা আমরা সেই গুগাবাবা’র যুগ থেকেই জানি। কিন্তু পেটে খেলেও যখন পিঠে সইব না, আমার সেই অবস্থা। অতএব আমাদের দলে আমিই সবথেকে অবল। আমার মান বাঁচাতেই ঠিক হল, আস্কিং রেট অন্তত ৩২০ কমিয়ে আনা যাক লিফট মারফৎ, তারপর না হয় দেখা যাবে। পায়ে পায়ে লিফ্টের দরজার কাছে গিয়ে দেখি বেশ ভিড়, অনেকেই তাহলে মাথায় চড়তে চান। পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেলেন গনগনে যৌবনী ক’জন, এঁরা প্রথম থেকেই সোপানগামী। আমাদের দিকে চাইলেন করুণায়, আহা সাধ আছে সাধ্য নেই।
লিফ্টের সার্ডিনিয় ভিড়ে চ্যাপটা হতে হতে পৌঁছে গেলাম একটা ব্যাসিলিকার ছাদে, এইখান থেকেই ডোমের সিঁড়ি শুরু। দুই-থাকে কিছু প্রাথমিক ধাপ মিলেছে গিয়ে একটা দরজায়, তার ভিতরে শুরু সুড়ঙ্গপথে সর্পিল সিঁড়ি। ঢোকার আগে সাইনবোর্ড, একবার চলতে শুরু করলে প্রথম মোড়ের পর কিন্তু এগোতেই হবে, যে পথে যাচ্ছে সে পথে ফেরা নয়। ব্যবস্থা দেখে আমি প্রথমেই বললাম, পারব না। আমাদের দলের জ্যেষ্ঠ ও কনিষ্ঠ বললেন, বিলক্ষণ পারবেন। বাকি একজন বললেন আড়াই বছর আগে নিশ্চয় পারতেন। রফা হল খানিকটা যাওয়া যাক, অন্তত প্রথম মোড়টা পর্যন্ত। দরজা পেরিয়ে যেই না গেছি কয়েক পা, বালকের বিস্কুট খেতে ইচ্ছা হল। এই জায়গায় ঐ জিনিস খাওয়া যায় কি না জানার উপায় নেই; তবে পাওয়া যায় অবশ্যই, কারণ ব্যাগেই আছে বিস্কুট। এই ধরনের পরিস্থতি চট করে মেটে, চাওয়া আর পাওয়া মিলে গেলে। বালকের হাতে বিস্কুট গুঁজে আমরা বললাম, চুপচাপ খেয়ে নাও। ব্যাসিলিকার ডোমে বিস্কুট খাওয়ার গ্র্যাভিটি বুঝে চট করে খেয়ে নিয়েই বালক বললেন, যাচ্ছি না কেন, আমরা। অতএব এগোতে থাকা আবার। সিঁড়ি ছোট হয়ে আসছে, আর চড়াইও বর্ধমান। আমার অবস্থা ক্রমশ: স্পিরিট ইজ্ উইলিং, বাট পিঠ ইজ্ উইক। ভাগ্য ভাল আরেকটু যেতেই মোড় মত এল একটা। বাঁদিকে একটা ছোট প্যাসেজ, তারপর দরজা, সামনে সিঁড়ি উত্তরিত। আরো উত্তরণ আটকাতে আমি তাড়াতাড়ি বললাম, চল চল দেখি কি আছে ওদিকে।
দরজা পেরিয়েই একটা বারান্দা, তবে বাইরে নয়, ভিতরে। ব্যাসিলিকার ডোমের প্রায় মাঝামাঝি, পুরো দেওয়ালের গা জুড়ে একটা বৃত্তাকার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছি, প্রায় হাতের নাগালে ডোমের একেবারে উপরের অংশ স্পষ্ট অক্ষরে লেখা, S. PETRI GLORIAE SIXTUS PP. V.A MDXC PONTIF. V.-- অর্থাৎ সেন্ট পিটারের মহিমায় উৎসর্গ, পঞ্চম পোপ সিক্সটাস, ১৫৯০ খ্রিস্টাব্দ, পোপের শাসনকালের পঞ্চমবর্ষ। নীচের দিকে তাকালে বিস্তীর্ণ ব্যাসিলিকা। সেই কোন সেকালে শেখা এবং বহুদিন বিস্মৃত এঞ্জিনিয়ারিং ড্রয়িং-এর প্ল্যান ভিউ মনে পড়ল; ব্যাসিলিকার সামনের দিকের পুরো নক্সাটা চোখের সামনে। বারান্দা বেয়ে হাঁটতে লাগলাম আমরা, আরো অনেক আছেন, গুঞ্জনও কম নয়। কিন্তু ক্যুপোলার বিশালত্ব যেন গিলে নিচ্ছে সবই। প্রায় পিন পড়লেও শোনা যায়। বালককে কোলে নিয়ে দেখাতে হচ্ছে নীচে। পড়ে যাবার ভয় নেই, বারান্দার রেলিঙ থেকে মিহি তারের চাদর মাথার উপরের দেওয়ালে গিয়ে থেমেছে। গ্লোরিয়া আমাদের নীচে, সামনেই, দেদীপ্যমান। ডোম যেখান থেকে ঢালু হতে শুরু করে চূড়ায় মিশেছে, সেখানেও অসংখ্য ছবি, এক ইঞ্চিও খালি নেই দেওয়ালে। আমাদের বারান্দার পিছনের দেওয়ালও ফ্রেসকোময়। হঠাৎ বেজে উঠল অর্গ্যান।
নীচের দিকে তাকিয়ে দেখি মোমবাতি হাতে সারি দিয়ে আসছেন গীর্জার সেবকরা, প্রথম জনের হাতে ক্রুশ। প্রত্যেকেই পরেছেন চার্চের আজানুলম্বিত জোব্বা। হয়ত শুরু হচ্ছে কোনো উপাসনা। কাছাকাছি কোনো লাউডস্পীকার চোখে পড়ল না, অথচ সুরের প্রতিটি মিড় শোনা যাচ্ছে স্পষ্ট। অসীম স্থাপত্যের সাথে মিলতে পারে কি অসাধারণ অ্যাকুস্টিক্স, এই অর্গ্যানবাণী না শুনলে বুঝতাম না। নীচের মিছিল শেষ হল, সবাই একে একে বসে পড়লেন নিজেদের জায়গায়। এখান থেকে জানার উপায় নেই কি অকেশনে উপাসনা। তবে অর্গ্যান বেজেই চলেছে। সুর ঘোরা ফেরা করছে এক বাঁধা পরিসরে; কিন্তু মূর্ছনা যেন নাড়িয়ে দিচ্ছে ব্যাসিলিকার প্রতিটি ছবির প্রতিটি রেখা। চারপাশে প্রায় সকলেই স্ট্যাচু। দয়িত-যুগল জড়িয়ে ধরে একে অপরকে, তোমার সেঙ্গে বেঁধেছি আমারও প্রাণ, সুরের বাঁধনে। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম জানি না, দু’মিনিট, দু’ঘন্টা, বা দু’দিন। ঘড়ির হিসেবে দু’মিনিটেরই সব থেকে কাছে হয়ত। কিন্তু এ সব জায়গায় ঘড়ি চলে না। আরো অনেকে ঢুকে এসেছেন ইতিমধ্যে বারান্দায়, জায়গা ভীষণ কম। তাই সহবতের তাড়নায় বেরোতে হল, আগে এসেছি যারা। তখনও বেজে চলেছে অর্গ্যান, পা এগোলেও মন রইল আকাশ ও মাটির মধ্যবর্তিনী ঐ একফালি বারান্দায়। মিটারের মাপে এর থেকে উঁচুতে উঠেছি অনেক। কিন্তু এই উচ্চতায়, বোধহয় নয়। বারান্দার দরজা বন্ধ হল। অর্গ্যানের রেশ নিয়ে। এমনই কোনো আবেশেই কি জীবনানন্দ লিখেছিলেন, শুনেছি কিন্নরকন্ঠ দেবদারু গাছে, দেখেছি অমৃতসূর্য আছে। বাইরের সিঁড়ির সুড়ঙ্গ এবার আর অত অন্ধকার লাগল না। বালকও বিস্কুট চাইলেন না। আরো ধাপ বেয়ে চূড়ায় ওঠা আর যাবে না ঠিক হল, মুখ্যত আমার পিঠের জন্য। ভিতরের দেখা অনেকটাই ভরিয়ে রেখেছে, তাই একদম উপর থেকে বাইরের দৃশ্য দেখা না হতে তেমন আর খেদ রইল না। আমরা নীচে পথ ধরলাম।
যেখান থেকে ওঠা শুরু হয়েছিল সেই ছাদে ফিরে এসে দেখি এটাও উঁচু বেশ, চারপাশে রোমের বিরাট বিস্তার। ব্যাসিলিকার মাথার যেসব মূর্তি দূর থেকে দেখেছিলাম, সেগুলো হাতের নাগালেই। এত কাছে পিছন দিক থেকে দেখলে বোঝা যায় কি অপার যত্নে এদের পালন করা হয়। একজন দাঁড়ানো বলীয়ান পুরুষের ডান হাতের বাইসেপ দেখানোর ভঙ্গিতে তোলা, আঙ্গুল অবশ্য মুষ্টিবদ্ধ নয়, নাচের মুদ্রায় বিস্তৃত। ডান হাত ধরে রেখেছে স্লিং। সময়ের সামান্য টোকায় ভেঙে গিয়েছিল হয়ত। দূর থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই, কাছ থেকেও রীতিমত খেয়াল করতে হয়। ইতিহাস বেঁচে থাকে বাঁচিয়ে রাখলে তবেই। মূর্তির মালা পেরিয়ে চোখ ছড়িয়ে যায় পাহাড় ঘেরা রোমে। কোনো বাড়িই অন্যের মত নয়, তবে মসৃণ সাদৃশ্য ছেয়ে আছে চারিদিকে। যেখানে দিয়ে নতুন কিছু গেছে, যেমন মেট্রো রেলের লাইন, সেখানেও চারপাশকে মাড়িয়ে যায়নি। একটাও আয়নাময় আকাশছেঁচা বাড়ি চোখে খোঁচা মারছে না। আকাশী নীল আর মেঘালী সাদা মিলে গেছে রোমের বাড়ি ঘরের সাথে, মনে হয় এই রোম তো ছিল আকাশ আর মেঘ যতদিন আছে। নীচে সেন্ট পিটার্স স্কোয়ারে ইতস্তত মানুষের ভিড়। এইখানেই বহু ভক্ত ভিড় করেন উৎসবের দিন, উপাসনার দিন। মনে পড়ল এক চতুর বাগ্মীর পাওয়ার পয়েন্ট স্লাইডে দেখেছিলাম পরপর দুটো ছবি, দুটোই এই সেন্ট পিটার্স স্কোয়ারের। একটি ২০০৫-এর এপ্রিল, আরেকটি ২০১৩-র মার্চ। দুটি ছবিতেই রাত্রের অন্ধকারে সেন্ট পিটার্স স্কোয়ার কানায় কানায় ভরা। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা দাঁড়িয়ে আছেন, নতুন পোপ কে সেই ঘোষণার প্রতীক্ষায়। দুটি ছবিতেই প্রত্যেকটি মানুষের মুখ উজ্জ্বল। প্রথম ছবিতে হাতে ধরা মোমবাতির আলোয়, দ্বিতীয়তে হাতে ধরা স্মার্টফোনের আভায়। মাত্র আট বছরেই পৃথিবী বদলেছে বিস্তর। ছাদ থেকে নামার সময় হল। রেলিঙের ওদিকে একবার তাকিয়ে মনে হল, রাফায়েল, মাইকেলেঞ্জেলো বা তস্য গুরু ব্রামান্টে কি নক্সা রেখেছিলেন আজকের রোম কেমন দেখাবে? মনে তো হয় না। তাও তাঁদের সৃষ্টির স্পিরিট কি আশ্চর্যভাবে আজও বেঁচে। সন্ধেবেলায় হোটেলে ফিরে ছাদে গিয়ে ব্যাসিলিকার চূড়া দেখতে পেলাম, কালো আকাশে দেদীপ্যমান। আশপাশের একটি বাড়িও নেই তার উচ্চতাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মত। মনে হল আজ উঠেছিলাম ঐ চূড়োতে অনেকখানি। নাই বা পারলাম শেষ ক’ধাপ, মন তো উঠে গিয়েছিল তার উপরে। আর মনে হল আজকের পৃথিবীর কোন হর্ম্য বাতি জেলে রাখবে পাঁচশো বছর, বা তারও পরের পৃথিবীর জন্য? বুর্জ দুবাই বা বোম্বাইয়ের অ্যান্টিলা নয়ত?
ব্যাসিলিকায় বুঁদ হয়ে ছাদ থেকে নামতে গিয়ে লিফটে এক অভিনব পোস্টার দেখে বেশ চমকে গেলাম, খানিক থমকেও। এতদ্বারা হোটেলের সব অতিথিদের জানানো হচ্ছে যে, আগামী কাল যানবাহনের সাধারণ ধর্মঘট, অতএব শহরে বেরোলে নিজের দায়িত্বে বেরোবেন, আপনাদের দায় কর্তৃপক্ষের নয়। আগামী কালই ফেরার আগের শেষ দিন আমাদের। ভাবছিলাম ভোর ভোর বেরিয়ে নেপল্স ছুঁয়ে পম্পেইটা দেখে ফিরে আসব রোমে। বিরাট সৃষ্টি দেখলাম রোমে, মানুষের; এত কাছে অত বিরাট ধ্বংসও বাদ যাবে কেন, প্রকৃতির? বন্ধ তো কলকাতার বান্দার কাছে বিন্দাস ব্যাপার; ছেলেবেলায় কত ক্রিকেট খেলেছি ট্রামলাইনে, এমনসব সত্যাগ্রহের দিনে। বাকি ভারতে বহুদিন অচল, কলকাতায় তো বন্ধ এখনও বেশ ভালই সচল। আজকাল আবার বন্ধকরা আগেই সাফাই গেয়ে রাখেন, মিডিয়া মারফৎ--ইতর সাধারণের অসুবিধার জন্য দু:খিত, কিন্তু মানুষের মুক্তির জন্য এই বন্ধ আবশ্যিক। তাই ভাবলাম আমরা এমন বাঁধন ছেঁড়ার সাধনে যারা অভ্যস্ত, এদের নিরামিষ স্তরাইক-এ আর এমন কি হবে। তবে ভিসুভিয়াসের আশা ছাড়তেই হল, স্টেশনে না পৌঁছতে পারলে তো যাওয়াই যাবে না, একে কাকসকালে ওঠাই সার হবে, বালককে তুলে টুলে। ঠিক হল, ধীরে সুস্থে সকালে উঠে, ব্রেকফাস্ট খেয়ে, ব্যবস্থা হবে অবস্থামাফিক। তবে এক্কেবারে ঘরে বসে রোমের শেষ দিন সম্পন্ন করব না, এমন সংকল্পই নেওয়া হল।
|| আট ||
পরদিন প্রস্তুত হয়ে অ্যাডভান্সড পার্টি হিসেবে আমি একটু দেখে আসতে গেলাম। রাস্তাঘাট একেবারেই শুনশান নয়। ঘোড়া না দেখলেও গাড়ি দেখলাম অনেকই, অন্য দিনের মতই। তবে বাস যেন কম খানিক। তাও দুটো একটা দেখে ঠিক করা গেল বেরিয়ে পড়াই যাক। ভ্যাটিকানের কাছ থেকে হুডখোলা দোতলা বাস রোম দর্শনে বেরোয়। কোনোক্রমে ভ্যাটিকান অবধি গিয়ে পড়তে পারলেই রোম দেখতে বেরিয়ে পড়া যাবে। হোটেলের কাউন্টারি মিষ্টি হেসে মনে করিয়ে দিলেন ভ্যাটিকান কিন্তু আধঘন্টার মত হাঁটা, সামান্য চড়াই পথে। আমরা বললাম এ আর এমন কি, বাস না পেলে হাঁটবই। ভাবলাম বেশ একটা মরুতীর্থ হিংলাজ ধরনের ব্যাপার হবে। বাস স্টপে পৌঁছে দাঁড়িয়ে খানিক্ষণ। আশপাশে বিরক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আরো অনেকে। মনে ভাবছি ভ্যাটিকান মুখো হন্টন চালু করা উচিত কিনা এবার। এমন সময় দূর থেকে বাসের আগমন। কাছে এলে বোঝা গেল খুব ঠাসা, পাদানিতেও পা রাখা দায়, দরজা বন্ধ হচ্ছে কোনো মতে। দুয়েকজন নামছেন দেখে আমরাও ওঠার উৎসাহ পেলাম। তাছাড়া, ভিড় বাস দেখে কলকাতীরা ভড়কে গিয়েছিলাম রোমে, এ ব্যাপারটা জানাজানি হলে যাচ্ছেতাই হবে, এটাও মনে ছিল। প্র্যামটা ভাঁজ করে খানিক ঠেলতেই জায়গা হল একটু। উঠে পড়ার একটু পরেই বালক ও মাতাকে বসতে দিতে উদ্যত হলেন অনেকেই। অভাবে পড়েও স্বভাব নষ্ট হয়নি রোমবাসীর, দেখে আমরা গদগদ। অচিরেই ভ্যাটিকানে নেমে পড়লাম। সেন্ট পিটার্স স্কোয়ার আজকেও বেশ জমজমাট। ঐশী বাসনায় স্ট্রাইক চলে না। স্কোয়ারকে কোনাকুনি কাটতে গিয়ে খেয়াল হল, সেন্ট পিটার্স স্কোয়ার তো চৌকো নয় আসলে। প্রাঙ্গণ পেরিয়ে পৌঁছলাম এক চৌমাথার মোড়ে, সেখান থেকেই মুহুর্মুহুঃ বাস ছাড়ছে বিচিত্র বর্ণের। বালক বলে উঠলেন ভাঙা বাস। খুব ভুল বলেননি। দোতলা বাসের উপরতলার ছাদ পিছন থেকে একটু এগিয়েই শেষ হয়ে গেছে। পরে উঠে দেখেছিলাম যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকে সমান্তরাল সাটারের ব্যবস্থা, বৃষ্টি বাদলায় টেনে দিলেই মাথা বাঁচবে। আমরা খানিক ভেবে লাল বাসে চড়লাম বালকের পছন্দ মত।
বাসটা বাঁধা পথে ঘুরতে থাকবে সন্ধ্যা আটটা পর্যন্ত, পথে নির্দিষ্ট দাঁড়ানোর জায়গা অনেক, একবার টিকিট কেটে উঠলেই যতবার ইচ্ছা নামা ওঠা করা যায় সারাদিন ধরে। সীটের ধারের হেডফোন পরে নিলেই ধারাবিবরণী শোনা যাবে, আশপাশের দৃষ্টি বা বোধিগম্য যা কিছু তা নিয়ে। পাঁচটা ভাষায়, ম্যান্ডারিন সহ। আমরা সটান উপরের ডেকে উঠে গেলাম। বাস চলছে ইতিহাসকীর্ণ পথে। প্রত্যেক অলিগলিতে কান পাতলে হেডফোনে, গভীর সব গল্প আশপাশের হর্ম্যকেন্দ্রিক। খানিক বাদে খুলে রাখলাম হেডফোন। তথ্য আর নিতে পারছে না মাথা। চোখ আর মনের উপরেই ছেড়ে দিলাম নিজেকে বাকি সময়টা। কখনও পার হচ্ছি ব্যাসিলিকার থেকেও প্রাচীন গির্জা, কখনও মাটি থেকেই উঠে গেছে বিরাট খিলান, কখনও ধাপ ধাপ সিঁড়ি পেরিয়ে কোন কালজয়ী বেদী। প্রত্যেকটি স্থাপত্য প্রাচীনতার প্রাচুর্যে ভরা, কোথাও কিন্তু মনে হচ্ছে না জোর করে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। কত অদৃশ্য যত্ন নিশ্চয়ই এর পিছনে কাজ করে চলেছে নিয়ত। টাইবার নদীর ধার দিয়ে পথের দুধারে উঁচু গাছের সারি, বাসের দোতলায় প্রায় ছুঁয়ে যাচ্ছিল আমাদের মাথা। রোমের প্রধান বইপাড়ার মধ্যে দিয়ে চলল একবার বাস। আমাদের কলেজ স্ট্রীটের মত ছোট ছোট দোকানের সামনের গ্রন্থকীটদের আনাগোনা, অবশ্য সংখ্যায় তেমন বেশি নয়, দোকান, বই এবং তদীয় পোকারা। বহু বাড়ির গায়েই ইংরেজি হরফে পাথরে খোদাই নানা বাণী। অত্যুৎসাহে পড়তে গিয়ে হোঁচট খেলাম। ভাষাটা ল্যাটিন। বুঝলাম রোমে চলে এলেই হয় না, আসার আগে শেখা উচিত, অন্তত ভাষাটা। একটা মোড়ের সাইন অবশ্য পড়তে পেরেছি, লাল টুকটুকে প্ল্যাকার্ডে লেখা, নিকটতম ম্যাক্ডোনাল্ড চারশো মিটারের ভিতরেই। পাথর ঠুকে ঠুকে ক্লান্ত হয়ে মাইকেলেঞ্জেলোরা হয়ত চট করে কোয়ার্টার পাউন্ডার মেরে আসতেন এসব জায়গাতেই।
বাসের পুরো পথটা চক্কর দিয়ে একবার বাসে বসেই ঠিক করা হল প্যান্থিয়নের কাছে নামা হবে। একসাথে অনেক দেবতা দেখে নিলে, আস্কিং রেট-টা বাগে আসবে খানিক। পরে জেনেছি, অনেক নয়, বোধহয় সবই। আক্ষরিক মানেতে প্যান্থিয়ন, সব দেবতারই সন্নিবেশ। প্যান্থিয়নের পিছন দিকটা গোলাকৃতি, সামনে করিন্থিয়ান থামের মাথায় ত্রিকোণাকৃতি পেডিমেন্ট, তার নীচে পোর্টিকো। প্রাচীন রোমের দালান বাড়ির ভিতর এটিই সবথেকে ভাল ভাবে সংরক্ষিত, সেই সপ্তম শতক থেকে ক্রমান্বয়ে ব্যবহৃত। এখনও এটা ক্যাথলিক গির্জা, প্রত্যেক রবিবার উপাসনা হয়, এবং উদ্বাহ প্রভৃতি অনুষ্ঠানও। ভিতরে ঢুকেই চোখ গেল উপরে। উচ্চ ডোমের খাঁজ কাটা গায়ের একদম মাথায় গোলাকৃতি জানলা। সেটাই একমাত্র বাইরের আলোর উৎস। মাটির কাছের পরিধি বরাবর দেওয়ালে বহু কারুকাজ, এবং খানিক বাদে বাদে ভাস্কর্য ও ছবি, বিশেষ বিশেষ জায়গায়, বা নিশে-তে। তৃতীয় নিশে-তে লেখা রয়েছে, এখানেই সমাহিত রাফায়েলের অস্থি। তার পাশেই সমাধি হয় মারিয়া বিবিয়েনার, রাফায়েলের প্রণয়িনী। পরিণয়ের আগে মারা যান মারিয়া। প্যান্থিয়নের ভিতরে তখন হয়ত কয়েকশো লোক। কিন্তু কোলাহল নেই। বেরোনোর সময় মনে হল, সব দেবতাকে দেখলাম না তো। দেখিনি কারণ, ছিলেন না সকলে। দেবতারা যে যার নিজের জায়গা চান, মানুষের মতই। সকলে একসাথে ঘেঁষাঘেঁষি পছন্দ নয় কারোরই। মনে করা হয় প্যান্থিয়ন নামটির আক্ষরিক মানে প্রতিফলিত হয়নি বাড়িটার বাসিন্দাদের মধ্যে। বাড়ির আশপাশের বহু দেব মূর্তির কথা মনে করে, অথবা হয়ত, স্বর্গ ছোঁওয়া ডোমের কল্যাণে, নাম রাখা হয়েছিল প্যান্থিয়ন। প্যান্থিয়নের সামনেই উঠোন পিয়াজা দেলা রোটোন্ডা। উঠোনের নাম প্যান্থিয়নের আরেক নাম থেকে—সান্তা মারিয়ে রোটোন্ডা। মাঝখানে ওবেলিস্কিয় ধাঁচে লম্বা সৌধ, তার গায়ে ফাউন্টেন। ফাউন্টেনের ধারে একটু দাঁড়িয়ে আমরা এগিয়ে চললাম কয়েকটা বাড়ি পেরিয়ে পাশের উঠোনে। পিয়াজা নাভোনা। আরেকটা প্রশস্ত চতুষ্কোণ জায়গা, মাঝে ফন্টানা দেই কুয়াত্রো ফিউমি, বা চার নদীর ফোয়ারা, ১৬৫১ সালে নির্মিত। ফোয়ারার মাঝে ওবেলিস্ক অফ ডোমেশিয়ান। ফোয়ারার ধারে দাঁড়িয়ে মনে হল, রোম তো প্রায় ফুরিয়ে এল—আমাদের সকলের একসাথে ছবি নেওয়া হয়নি যে। জনৈক টুরিষ্টকে বলতেই, হাসি মুখে বললেন নিশ্চয়ই। দিলেন তুলে ছবি। ফোর রিভারের ফোয়ারার সামনে, আমরা ফোর রোমন্থক। এই উঠোনটায় দেখলাম আরেক অভিনব ব্যাপার। গায়ে চকচকে সব রঙ মেখে, ইটালিয় মাফিয়ার বেশে দাঁড়িয়ে আছেন পথশিল্পীরা, ছবি তুলছেন পর্যটকরা, দক্ষিণার বিনিময়ে। অধুনা নিউ ইয়র্কের টাইম্স স্কোয়ারে এই রঙ মেখে দাঁড়ানো নিয়ে যে সব হলচল শুরু হয়েছে, তেমন নজির দেখলাম না, ভাগ্য ভাল। এঁরা বিভঙ্গের বশে বেশটা ছাড়েননি। রোম যেমন পিজার শহর, পিয়াজারও। এদিক ওদিক ছড়িয়ে আছে বহু উঠোন, মাঝে কোনো স্থাপত্য। মলের আগে এইসব জায়গাতেই মানুষ মিলতে আসত। একটা শহরের চরিত্র নির্মিত হয় অনেকটা তার পাব্লিক স্পেস দিয়ে। নাগর বা নাগরিকরা কোথায় যাবেন দুদণ্ড হাঁটতে বা বসতে, তাই অনেকটাই ঠিক করে দেয় তাঁরা কেমন নাগর বা নাগরিক হবেন। আজকাল অবশ্য বিশ্বব্যাপী মল-এর যুগে যাবার জায়গা সবই একইরকম। গেলেই মনে হয়, কত কিছু কেনার আছে, আমার হয়নি তারে পাওয়া। পিয়াজা নোভেনার ধারে ছোট্ট দোকানে যে ল্যাজানিয়া খেয়েছিলাম, তার স্বাদ বোধহয় রেকর্ড হয়ে থাকল বাকি জীবনটার জন্য। যদি না ট্রেভি ফাউন্টেনে কড়ি ফেলার পুণ্যে আবার আসা হয় রোমে।
বেলা গড়াচ্ছে। বন্ধের বাজার, বেশি বিকেলে যান হয়ত একেবারেই থামবে। বালকের ব্যস্ততা নেই। মনে হল আরো খানিক ফাউন্টেনের জল ঘাঁটা খুব দরকার। বালকের চাকা চলবেই, বাস না হলে প্র্যাম তো আছেই। কিন্তু আমরা যারা ঠেলব, তাদের চিন্তা আছে। ঠিক হল, ভাঙা বাসে চড়ে ফিরে যাওয়া যাক ভ্যাটিকানে। সেখানে অপেক্ষা করলে ঠিক মত, মোক্ষ না হলেও, বাস মিলবে হয়ত। সেই মত ফেরা হল। খানিক দাঁড়িয়ে বাস পেয়েছিলাম, সকালের মতই ভিড়। এবং বিদেশীদের প্রতি সৌজন্য সকালের মতই। বাড়ির কাছে স্টপে নেমে ভাবা হল, অদ্য শেষ রজনী, অতএব স্মরণীয় কিছু খাওয়া যাক। গলির মুখে ছোট্ট দোকান। পারিবারিক মনে হয়। মা ও দুই ছেলে কাণ্ডারী। ভাষার দিকে না গিয়ে এবার প্রথমেই ভাব দিয়ে শুরু করলাম। রোমে পিজার কন্সেপ্টটা এতই অনুভূতিগম্য যে, দিব্যি আদান প্রদান এগিয়ে চলল। সাধারণত যে সব পিজা হাটে বিকোয়, সে সব ফ্লেভার এরা বোধহয় ছেড়ে এসেছেন সেই মাইকেলেঞ্জেলোর যুগেই। এমন বর্ণ ও স্বাদের বৈচিত্র্য, পিজার সম্বন্ধে ধারণা বদলে দিল। এ সেই গভীর রাতের অফিস মিটিঙের মাঝে অম্বলীয় পিজা নয়। এর ভিতর ফাস্ট নেই কিছুই, অনেকদিনের মনন ও পরিশ্রম। হোটেলে ফিরে এসে খেয়েছিলাম পরম তৃপ্তিতে, শুধু বাক্সগুলো বাকি ছিল। রোম থেকে ফিরেই আরেকটা অধিবেশনে গিয়েছিলাম হায়দ্রাবাদে। ইটালীয় গবেষককে পাশে পেয়ে সদর্পে ঐ পিজার গল্প করতেই বললেন, রোমে আবার পিজা পাওয়া যায় নাকি। পিজা খেতে হলে এস আমার শহরে, নেপল্স। মনে হল, ইস্ এবার ধর্মঘটের জন্য পম্পেই শুধু মিস হল না, পিজাও। রোমের শেষ সন্ধেতে হোটেলে দেখা করতে এসেছিলেন একজন পুরোনো পরিচিত। বৃহৎ বহুজাতিকের রিসার্চ ডিভিসন থেকে রিটায়ার্ড এখন, রোমের ল্যুইস বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। পরিবারকে রাখতে হয়েছে প্রান্তিক এক শহরে। খরচে বললেন কুলোনো কঠিন। দেশের অর্থনীতি সম্বন্ধে বেশ ম্রিয়মাণ লাগল প্রৌঢ়কে। আমি বললাম, মেড ইন ইটালি তো অনেক জিনিসই দেখছি দোকানে। সে সব জিনিসে দেশের জিডিপি তেমন বাড়ে না বললেন। রোমের ঐতিহ্য রেস্টোরেশন কাজও নাকি চলছে প্রাইভেট ধনকুবেরদের দাক্ষিণ্যে। এই নিয়ে জনমানসে ক্ষোভও আছে। কিন্তু সরকারি কোষাগারে টান, তাই মেনে নিতে হচ্ছে।
রোমের রাস্তায় ইটালিয়ান নারী পুরুষদের যেটুকু দেখেছি, অনেকেরই স্বতন্ত্র সৌন্দর্য্য চোখ টানে। ব্যবহারও মসৃণ। রাস্তার মোড়ে দুই গাড়ির ঠোকাঠুকি লাগল দেখলাম একবার। এক গাড়ি থেকে চালক নেমে অন্য গাড়ির সামনে গিয়ে হাততালি দিলেন, সেই চালকের ড্রাইভিং-এর কপট বাহবায়। এমন বিদ্রূপেও বারুদ জ্বলল না। ফোন করে পুলিশ ডেকে, দেখিয়ে টেখিয়ে নিয়ে যে যার পথে গেলেন। যাওয়ার সময় দুই ড্রাইভার একে অপরকে বাই না বললেও, ভস্মও করলেন না।
রোমের শেষ সন্ধ্যা রাত্রে মিশল। পরের দিন দুপুরে নিষ্ক্রমণ।
|| নয় ||
সকালে একবার হোটেলে ছাদে গিয়ে দেখে এলাম ব্যাসিলিকার চূড়ো। গত দিন থেকে তেমন বদলায়নি মনে হল। ট্যাক্সিতে ওঠার আগে কাউন্টারের সুন্দরীদের বালক কথা দিলেন আবার আসবেন রোমে, এই হোটেলেই। এবারে প্লেন উড়ল খটখটে আলোয়। নীচে বিস্তীর্ণ রোম বিকীর্ণ হচ্ছে এক মহানদীর মত। দুবাই’এ প্লেন বদল, মাঝে দুঘন্টা বসে থাকা। বালক ঘুমে ডুবে। খানিক ঝিমুনি আসছিল বাকিদের, তবে দোকানের দ্যূতিতে তন্দ্রা ছুটে গেল। মনে হচ্ছিল আঁতোয়া দ্য সেন্ট-এক্সুপ্যারির কথা—“If you want to build a ship, don’t drum up the men to gather wood, divide the work and give orders. Instead, teach them to yearn for the vast and endless sea.” রোম একদিনের সৃষ্টি নয়, একজনের সৃষ্টিও নয়, সে মানুষ ব্রামান্টে, রাফায়েল, বা মাইকেলেঞ্জেলো হলেও। সমুদ্রের স্বপ্ন দেখাতে পেরেছিলেন মাইকেলেঞ্জেলোরা তাঁদের অনুচরদের, শুধুই আদেশ বা আউটেসার্স করেননি।
রোম ভ্রমণ সব থেকে কার ভাল লেগেছে সে বিষয়ে তেমন সন্দেহের অবকাশ নেই। যেদিন ভোরে কলকাতা ফিরলাম, সে দিনই কোনো জেটল্যাগীয় অবেলায় হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে আমাদের আড়াই বছর জিজ্ঞেস করলেন, আমরা কি আবার রোমে যাব আজ? আমরা তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম, না না একদিনে দুবার রোমে যায় না, আরেকটু ঘুমিয়ে নাও এখন।