|| এক ||
রোমে যখন, তখন রোমানদের মতন কর। প্রবাদ এতটা বলেই থেমে যায়, কি করা উচিত তা বলে দেয় না। এমন অসম্পূর্ণ উপদেশ মাথায় নিয়েই রোমে গিয়েছিলাম। আমাদের চারজনের বয়সের গড় গনগনে মধ্য তিরিশে হলেও, ভ্যারিয়েন্সটা বেশ বেশি। তার প্রধান কারণ, একজন আড়াই বছর ছিলেন সাথে, আরেকজন ছেষট্টি। এই দুজনের উৎসাহে বাকি দুজন শুধু হাইফেন মাত্র।
রোম গমনের উপলক্ষ্য আমার একটা কন্ফারেন্সে পেপার পরিতোষণ, লক্ষ্য ভ্রমণ। কন্ফারেন্স নিয়ে বেশি কিছু বলার নেই। যাঁরা এযুগের রিসার্চ-পেশী, তাঁরা এই অনন্ত পেপার প্রসব এবং অনন্ততর প্রসব বেদনার ব্যাপারটা জানেন। আর এও জানেন যে মাঝে মাঝেই হাঁপাতে হাঁপাতে বিশ্বের এ কোণে ও কোণে রিসার্চারদের সংঘারামে প্রেজেন্ট প্লিজ না বললে কি হয়। সারাক্ষণই কোথাও না কোথাও এ ধরনের সম্মেলন লেগেই আছে। সমবেত গল্পগাছা, প্রচুর পরচর্চা, অনাবিল আমড়াগাছি, একটু-আধটু জ্ঞান-অজ্ঞানের কচকচি। তবে এমন একটা সুযোগ না হলে, রোমে আসা হত না।
বেড়ানো নিয়ে দেখার কাহিনি যেমন অনেক, না দেখার কাহিনিও কম নয়। থ্রী মেন্ ইন অ্য বোট (সারমেয় সংবাদ বাদই থাক) আর থ্রী মেন অন দ্য বামেলে তো কিছুই প্রায় দেখা হয়ে ওঠে না। এমনকি সরোজিনী প্রয়াণেও প্রবল প্রস্তুতিতে যে জাহাজ যাত্রা, তেমন গন্তব্যে পৌঁছয় না। তাই প্রথমেই দায়মোচন দিয়ে রাখি। এ লেখায় ট্রিপ-অ্যাডভাইজার জাতীয় উপদেশ পাবেন না, রোমের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মেপে এক থেকে পাঁচের ভিতর কোনো তারা চিহ্ন দেওয়ারও চেষ্টা করব না। খাবার সময় কোনো পিৎজার ছবিও তুলিনি মনে করে, তাই ইন্স্টা বা অন্য কোনো গ্রামে পোস্ট করা হয় নি। যা দেখেছি তা বলব কিছু, যা ভেবেছি তা আসবে বেশি। এর কোনোটাই ফেসবুকে পাবেন না।
সোমবার কাকভোরে যাত্রা। আমরা প্রায় বিনিদ্র সারারাত। বেরোনোর সময় বালক দেখি গভীর নিদ্রায়। জাগাও পথিকে, ও যে ঘুমে অচেতন। তবে এক্ষেত্রে জাগানোর পরে কি হতে পারে, সে চিন্তায় ওপথে যাওয়া হল না আর। বেলচে দিয়ে বরফ তোলার মত বালককে স্ক্যুপ করে নেওয়া হল। সামান্য বিরক্ত মুখে বললেন, আমি রোমে যাব। যাত্রার এই প্রধান রূপরেখা এঁকে দিয়েই আবার ঘুম, আমরা বললাম যাক্। ট্যাক্সি চড়ে নিজেদের অভয় দিতে মনে করলাম, এখনো মোদের শরীরে রক্ত/ রয়েছে গরম মেটেনি সখ তো, ইত্যাদি। আর বেশি এগোলাম না, কারণ তার পরের লাইনের ঐ হাড় শক্ত থাকার ব্যাপারটা নিয়ে অত শিওর ছিলাম না নিজে। আমি এমনিতে হার্ড ডিস্ক সম্বন্ধে খুব সচেতন, রাত তিনটেয় ঘুম ভাঙলেও ব্যাক্ আপ্ করে নি। এই করতে গিয়ে শিরদাঁড়ার সফট ডিস্কের ব্যাপারে একটু অচেতন হয়ে গিয়েছিলাম। স্লিপ ডিস্কের শরশয্যায় বেশ ক’মাস শুয়ে শিক্ষা হয়েছে। সে স্মৃতি এখনো তাজা। তারপর থেকেই পিঠের ব্যাপারে আমি একটু টেন্টেটিভ।
|| দুই ||
রোমে নামলাম সোমবার সন্ধ্যায়। সাড়ে আট্টা নাগাদ প্লেনের অবতরণের শুরুতেও দিব্যি আলো। যে সাত পর্বত শুনেছি রোমের প্রহরী, তার সবকটা গুনে উঠতে পারলাম না। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি-ফ্যুমিচিনো এয়ারপোর্ট শহরের বাইরে, ভূমধ্য সাগরের চিক্চিকে জলের পাশেই। প্লেন থেকে নামার সময় বালক বললেন বিমানসেবিকাদের, স্যি য়ু এগেন, নেক্সট টাইম! যেটুকু সামান্য যাতায়াত করেছি এ জীবনে, আকাশের একই অপ্সরীর সাথে দুবার দেখা হয়নি কখনও। সাবালক কেউ এমন সম্ভাবনা প্রকাশ করলে অপ্সরীরা কুপিত হতেন হয়ত, অন্তত মুখে। নাবালক পার পেয়ে গেলেন, এমনকি বালকের গালে লিপস্টিক এঁকে দেওয়া হল, লিপ দিয়েই। দ্য ভিঞ্চির নামে এয়ারপোর্ট হলেও তেমন কুশল ব্যবস্থা নয়। ট্রলি নিতে দুই ইওরো খটাং করে ফেলতে হল, বালকের প্র্যাম এল আমাদের মালপত্তর থেকে আরেক প্রান্তে।
হোটেলের ব্যবস্থায় গাড়ি এসেছিল নিতে, চালক সুন্দর যুবক, স্যুট-টাইয়ে ফিট্ফাট। বললেন ফ্লোরেন্স শহরে বাড়ি। আমি বললাম, আরেব্বাস ইটালিয়ান রেনেসাঁসের জন্মস্থান। চালক অতটা দুললেন না, মনে হল সেই শাঁস তেমন বাকি নেই আর, বললেন আজকাল কাজকর্মের বড়ই আকাল, তাই বৃদ্ধ বাবা-মা'কে ফ্লোরেন্সে রেখে, চলে আসতে হয়েছে রোমে, ড্রাইভারি করতে। প্রায় চল্লিশ মিনিট চলল গাড়ি, সূর্যাস্তের রেশ নিয়ে। এ দেশেও গাড়ি চলে রাস্তার ডানদিক ঘেঁষে, স্পিড লিমিট বেশ বেশির দিকেই মনে হল। রাত্তির সাড়ে ন'টার কাছাকাছি রোমে রাস্তা দেখি শুনশান, বিনিদ্র শহর বলে যে রোমের নাম আছে, তার সঙ্গে মিলছে না যেন। ভাবলাম এ হয়ত তেমন সব রাস্তা নয়।
হোটেলে পৌঁছে সই সাবুদ করে ঘরে ঢোকা। আমি কাউন্টারের সুন্দরীকে জিজ্ঞাসা করলাম, ঘরে ইন্টারনেটের স্পিড ভালো তো? সমান সুন্দর থেকেই উনি বললেন, ঘরে কোনো নেট নেই, জালিয়াতি করতে হলে লবিতে নামতে হবে, প্রত্যেকটা জালিক যন্ত্রের জন্য আলাদা লগ-ইন-পাস্ওয়ার্ড। আমি বললাম, কিন্তু এর থেকে কম তারা-মারা হোটেলেও তো ইন্টারনেট পেয়েছি কলকল করে ঘরের কলে, এই তো সেদিন ... । সুন্দরী বললেন, কোথায়? আমি বললাম, কেন কাম্বোডিয়ায়। হাসিতে আর দুচামচ চিনি ঢেলে বললেন, এটা রোম। বুঝলাম, ঐসব প্রান্তিক দেশের ব্যাপার তেমন জানেন না, এবং জানেন না বলে তেমন কোন পরিতাপও নেই। শেষে বলে দিলেন, রোমে এটাই ওয়াস্তা। গুড নাইট, এনজয় ইয়োর স্তে। রোমের সত্যিই কি ওয়াস্তা, তা বুঝলাম পরদিন সকালে, সম্মেলনে গিয়ে। পেল্লায় হোটেল, একাধিক কন্ফারেন্স চলছে একসাথে। পইপই করে বলে দেওয়া হোলো ওয়াই-ফাই’-এর যেন অপচয় না হয়, প্রত্যেকে শুধু একটিই ডিভাইস লাগাতে পারবেন। বেশি ব্যান্ডউইড্থ খেলে অপরাধী আইপিকে তৎক্ষণাৎ বের করে দেওয়া হবে, নেটওয়ার্ক থেকে। কন্ফারেন্সের প্রধান কাণ্ডারী, আমাদের সবার হোস্ট, বক্তৃতার শুরুতেই বললেন, সালটা ২০১৪, কিন্তু স্থানটা রোম, তাই নেট নিয়ে এত টানাটানি। ইটালিয়ান অধ্যাপকের এমন আত্মবিদ্রূপে সবাই বললাম, হে: হে:।
মঙ্গলবার দুপুরে বেরোনো হল, হোটেল থেকে নানা ম্যাপ-ট্যাপ নিয়ে। ইয়োরোপের অন্যান্য শহরের মত রোমেও সাধারণ যান প্রায় সর্বত্র চলে—ট্রাম-বাস-মেট্রো। তবে বাসে উঠে টিকিট কাটা ঝকমারি, একদম সঠিক খুচরো দিতে হবে। তাই হোটেল থেকে পরামর্শ পেলাম একদিন বা তিনদিনের পাস কিনে নিতে, পাওয়া যায় নাকি যেকোনো তামাকের দোকানেই। তামাকের দোকান বা টোব্যাকো শপ ব্যাপারটা রোমের সর্বত্র, শুধু তামাকই বিক্রী হয় তা নয়। প্রথম দিনেই আমরা সেখান থেকে রোমের সচিত্র গাইড কিনলাম, বাস পাস’এর পাশাপাশি। অন্যান্য জিনিসও পাওয়া যায়, ছোট মনিহারি দোকানের মত, গল্পগুজবের জায়গাও বটে। সিগারেট সেবন বেশ প্রচলিত দেখলাম রোমে, প্রকাশ্য রাজপথে অনেকেই ধুম্রসেবী, রাখঢাক না রেখেই। হোটেল থেকে বলে দিলেন নিকটতম স্টপে থেকে আটানব্বই নম্বর বাসে চড়ে যেন সটান টার্মিনাসে গিয়ে নেমে পড়ি, সেখান থেকে পায়ে হেঁটেই যাওয়া যাবে ট্রেভি ফাউন্টেনে।
মানুষের মত, শহরের সাথেও প্রথম সাক্ষাৎ মনে থাকে, তেমন মনে রাখার মত হলে। বাসে চড়ে এদিক ওদিক তাকাতে থাকলাম, প্রথম জরিপের চেষ্টায়। যেটা শুরুতেই চোখে পড়ে, যা চোখে পড়ে না। উঁচু বাড়ি। রোমের রাস্তায় ও দুপাশে আধুনিক দুনিয়ার সভ্য শহরে যা যা থাকার সবই আছে; নেই শুধু গগনচুম্বী অট্টালিকার সারি। সে জন্য শহরের সবই আঁখিরেখার থেকে খুব উপরে নয়। পরে জেনেছিলাম যে রোমের কোনো কোনো অংশে উঁচু বাড়ি নিষিদ্ধ আইন মোতাবেক। ভাবতে অবাক লাগে কেমন করে বর্তমানের ব্যবস্থা সব বলবৎ হয়েছে, অতীত বিলোপ না করেই। ম্যাকডোনাল্ড ব্যবসা ফেঁদে বসেছেন, তবে দোকানের সামনে আকাশছোঁওয়া 'এম'-এর খিলান নেই। দোকানের বাইরের রঙও আশপাশের বাড়ির থেকে উচ্চণ্ড নয়। কলকাতার রাস্তায় বেরোতে তো আজকাল বাড়িতে আয়না না থাকলেও চলে, যেমন সব বাড়িতে ছয়লাপ, দেওয়াল না সার্সি বোঝা দায়। কোনো পুরোনো দালানকে থেঁতো করে জেগে উঠেছে হয়ত রাতারাতি, এমন একটাও বাড়ি দেখলাম না, যেকটা রাস্তায় ঘুরেছি রোমে। ঐতিহ্যের কথা উঠলে আমরা বাঙালিরা উদ্বেল হয়ে উঠি। তাই কলকাতার কিছু রাস্তা কয়েক দশকের ব্যবধানে আজকাল আর চিনতে পারা যায় না।
রোমের সাধারণ রাস্তাতেও রঙ, রেখা, রুচির এক সুঠাম সামঞ্জস্য। সব বাড়িই এক ধাঁচের নয়, সব রঙই এক রঙ নয়, সব আঙ্গিকই সমান নয়, তবু কোথায় যেন এক সমতা। তাকালে মনে হয় নিতান্ত আলগোছে এই মিল সাধিত হয়েছে। হয়ত তাই, বা হয়ত এর পিছনে আছে অক্লান্ত চিন্তা আর চেষ্টা। কোনো একটি বিশেষ স্থাপত্যে এই আর্কিটেক্চারাল ইন্টেগ্রিটি আশ্চর্যের নয়। কিন্তু আড়াই হাজারেরও বেশি পুরোনো একটা গোটা শহরে এই ঐকতান ধরে রাখতে পারা, বিস্ময়ের।
প্রথম সাক্ষাতে ইয়োরোপীয় শহরের যে প্রধান ফ্লেভার ফুটে ওঠে তা রোমেও পাওয়া যায়। রাজপথ তেমন বিরাট চওড়া নয়, আশপাশে গলি চলে গেছে তীব্র কৌণিকতায়, সার সার গাড়ি দাঁড়িয়ে, তার মধ্যেই বাস চলেছে অপার নিপুণতায়। বেশিরভাগ বাড়ি রাস্তা থেকেই খাড়া উঠে গেছে, উপরতলার জানালায় কাঠের খড়খড়ির ফাঁকে সুচারু পর্দা। বাস এগোচ্ছে বেশ জোরেই, একটু বাদে বাদেই স্টপে দাঁড়াচ্ছে। যাত্রীরা সৌজন্যময়, আমরা বালক ও আনুষঙ্গিক প্র্যাম-ট্যাম নিয়ে উঠেছি দেখে অনেকেই বসার জায়গা ছাড়তে তৎপর হলেন। হঠাৎ দেখি পাশে একটা লম্বা পাঁচিল, এবং তা শেষ হতে দূর থেকে চেনা চেনা কিছু স্তম্ভ-দালান হুশ করে বেরিয়ে গেল। সাইনবোর্ড পড়ে তেমন সুবিধা হবার নয়, সবই ইটালিয়নে, ইংরেজি প্রায় কোথাওই নেই। কিছু তার দেখি আভাস, কিছু পাই অনুমানে, কিছু তার বুঝি না বা। যেটুকু বুঝলাম তাতে মনে হল এই তো ভ্যাটিকান সিটি পাশ দিয়ে বয়ে গেল--পৃথিবীর সবথেকে ছোট দেশ, জমির পরিমাপে। আজ এ্যজেন্ডায় ভ্যাটিকান নেই, তাই নামলাম না, বাস ততক্ষণে টাইবার নদী পেরিয়েছে।
টাইবার ক্ষীণতোয়া। রঙে ঈষৎ সবুজ, কিংবদন্তীতে টৈটম্বুর। শোনা যায় খ্রীষ্টপূর্ব সাতশো তিপ্পান্ন সালে এই নদীর ধারেই রোমের পত্তন। টাইবার নদীতেই নাকি রোমের প্রতিষ্ঠাতা রেমাস ও রোমিউলাসকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়, নাবালক বয়সে। রোমের ফাউন্ডিং ব্রাদারদের এমন বিপদে আমাদের সাথের বালক তেমন বিচলিত মনে হল না; বাসের জানালা দিয়ে একটা স্কুটার দেখে বললেন, মোটরসাইকেল। রোমে স্কুটারের বেশ বহর, বেশিরভাগই এঁদের জাতীয় বাহন ভেসপা। বিচিত্রবর্ণের ভেসপা সারা শহরে চরে বেড়াচ্ছে, চড়ে বেড়াচ্ছেন মনে হল বিচিত্রবীর্য সব টুরিষ্টরা। টাইবার পেরোনোর পরে পুরোনো রোমে ঢুকলাম। প্রত্যেকটা বাড়ি, প্রত্যেকটা গলি, প্রত্যেকটা গম্বুজেই বোধহয় কোন ইতিহাস আছে। বাসটা বাঁক নিয়ে একটা বেড়া দেওয়া চতুর্ভুজ জায়গার ধারে এসে পড়ল। রাস্তা থেকে একটু নীচু জমিতে ভাঙাচোরা কিছু দালান সিঁড়ি ঘর, তার মাঝে একটা সামান্য উঁচু বেদী ঘিরে অর্ধচন্দ্রাকৃতি কয়েকটা আধভাঙা থাম। জায়গাটার দুই ধার ঘুরে বাস অন্য রাস্তায় গিয়ে পড়ল। চৌহদ্দির কোণে দেখলাম লেখা, এখানে বিড়ালদের বিরক্ত করা যাবে না। ধ্বংসস্তূপের সাথে মার্জারের এমন সমাপতন বেশ অবাকই লাগল, মজারও। হোটেলে ফিরে গাইড বুক ঘেঁটে চমকে উঠেছিলাম—জায়গাটার নাম লার্গো দি তোরে আরজেনটিনা। চারটি রোমক মন্দিরের ভগ্নস্তূপ আর তার মাঝে পম্পেই থিয়েটার। এই পম্পেই থিয়েটারেই জুলিয়াস সীজার ঘাতকের হাতে নিহত হন, ঠোঁটে সেই চিরপ্রশ্ন —ব্রুটাস, তুমিও? তারপর রোজই ঐ রাস্তায় গেছি বাসে করে। সীজার সেক্সপীয়র এক হয়ে গেছেন কল্পনা আর বাস্তবে, ইতিহাস আর ভূগোল বিভিন্ন নেই। চারপাশ দিয়ে ট্রাম বাস চলছে, একবিংশ-চোদ্দর চরৈবেতিতে, শুধু ইঁটগুলোর মধ্যেই যেন একটি নিমেষ দাঁড়ালো সরণি জুড়ে। বিড়ালরহস্যও পরে ভেদ হয়েছে, ঐ চৌহদ্দিতে রোমের বাড়িহীন বিড়ালদের অভয়াশ্রম, দেশ-বিদেশের স্বেচ্ছাসেবীদের পরিচালনায় চলছে।
বাস গিয়ে থামল টার্মিনাসে। সামনে এক পেল্লায় প্রাসাদ, তবে দেখে বোঝা যায়, তেমন পুরোনো নয়। ধবধবে সাদা বাড়িটা যেন সিমেট্রির প্রতিমূর্তি, প্রত্যেকটা ইঁট মনে হয় স্থাপিত হয়েছে একটা বিরাট ভারসাম্য মাথায় রেখে। প্রাসাদটির পোশাকি নাম অলতারে দেলা পাত্রিয়া, বা পিতৃভূমির মন্দির। সম্মিলিত ইটালির প্রথম রাজা ভিক্টর এম্যানুয়েলের সম্মানার্থে প্রতিষ্ঠিত, ১৮৮৫ সাল থেকে পাঁয়তাড়া কষে ১৯২৫-এ সম্পূর্ণ হয় শেষে। বেশ তাক লাগানো ইমারত, ওপরের দিকে ঘোড়ার পিঠে সব জাঁদরেল বীরেদের মূর্তি, সাথে পরী-টরীরাও আছেন, উদ্বুদ্ধ করার জন্য, বীরদের। তবে স্থানীয়দের ভিতর তেমন সমীহ জাগায় না বোধহয় বাড়িটা। রোম ভ্রমণের অল্প কদিন পরে একজন ইটালীয়র সাথে দেখা হয়েছিল ভারতে। রোমের দ্রষ্টব্যের শুরুর দিকে এই প্রাসাদের কথা বলাতে খিঁচিয়ে উঠে বললেন, ওহ ওটাতো রোমের কলঙ্ক, ট্যাক্সপেয়ারদের টাকায় একটা টাইপরাইটার বসিয়েছে পথিমধ্যে। আমি বললাম, তবে আর্কিটেক্চারটা সুন্দর। উনি বললেন, ওটা রোমান আর্কিটেক্চারই নয়, গ্রীক আর জার্মানদের থেকে চোলাই করা একটা জগাখিচুড়ি। আর বেশি মুখ খুললে নিজের আর্কিটেক্চারাল অজ্ঞতাটা পুরোই বেরিয়ে পড়বে আমার। বলেছিলাম, ও: তাই নাকি, ভারি অন্যায়।
এই অলতারে দেলা পাত্রিয়া বসে আছে একটা বিরাট মোড়ের মাথায়--ছোট বড় নানা রাস্তার সম্মিলনে। যান চলাচল গাঢ়, পায়ে হাঁটছেন বহু মানুষ, অনেকেরই হাতে ম্যাপ, চোখ ক্যামেরায়। সেদিন বেশ শনশনে হাওয়া দিচ্ছিল রোমে। রোম যদিও ঝকঝকে, আমরা জ্যাকেট টুপিতে রীতিমত সাহেব। জিজ্ঞাসা করতে করতে এগোতে লাগলাম, গন্তব্য ট্রেভি ফাউন্টেন। কিংবদন্তী আছে, উনিশ বি.সি.-তে তৃষ্ণার্ত রোমের সৈন্যদের একজন যুবতী জলের সন্ধান দেন। তবে ভাগ্য ভাল এঁদের সেই যক্ষের হাতে যুধিষ্ঠিরের অবস্থা হয়নি, জল খাওয়াতে এনে সুখী কে, পথ কি ইত্যাদি বর-ঠকানো প্রশ্নে জেরবার হওয়া। যুবতী জল খাওয়াবেন বলে, খাওয়ানও। সেই উৎস থেকে প্রাচীন রোমে জল সরবরাহ হত, আজ সেখানে ট্রেভি ফাউন্টেন। সকলেই বলছেন ট্রেভি ফাউন্টেন বিলক্ষণ চেনেন, ঐ সামনের দিকেই, তবে আমরা চলছি তো চলছিই। রাস্তা ক্রমে সরু হয়ে আসছে, দুপাশে প্রাচীরের মত খাড়া দেওয়াল, পায়ের নীচে ঠাস গাঁথা চৌকো পাথর, যেরকম কবলড্ স্ট্রীট ইয়োরোপের একচেটিয়া। লোক চলাচল প্রচুর। ছোট ছোট দোকানে ঠাসা, রোমের মেমেন্টো বিকিকিনি হচ্ছে জোরদার। দোকানিদের পথ জিজ্ঞেস করলে বাৎলে দিচ্ছেন কেউ সহাস্যে, কেউ অহাস্যে। একটা দোকানে দেখি ছাপা নোটিস টাঙানো ইংরেজিতে এবং তার তলায় ইতালিয়ানে, যার মর্মার্থ—শুধু খদ্দেরকেই খবর দেওয়া হবে। বক্তব্যটা আরো জোরদার করতে তলায় সেনেকা’র নাম দিয়ে কোটেশন—অ্যদিয়াতুর এৎ আলতেরা পার্স, মানে, অন্য পক্ষের কথাটাও শোনো। ভিতরের গম্ভীর দোকানিকে দেখে মনে হল টুরিষ্টদের পথ দেখিয়ে অতিষ্ঠ। কয়েকটা বাড়ির গায়ে বিশেষ কিছু কারুকৃতি। দুই পরী পরিবৃত ওভাল ফ্রেমে বাঁধানো মা’র কোলে শিশু। তলায় লেখা আভে মারিয়া। চিরমাতৃত্বের বন্দনা। রাস্তা আরো ক্ষীণ হয়ে আসছে, এমন আঁকা বাঁকা পথ কোনো মহতী ফোয়ারায় নিয়ে যাবে এমন মনে হচ্ছিল না। হঠাৎই একটা মোড়ে এসে চমকে গেলাম। সামনেই ট্রেভি ফাউন্টেন। একটা দোতলা বাড়ির দেওয়ালে নানা ভাস্কর্য—বোধহয় সেই অবাক জলপানের গল্প গাঁথা—সামনেই কয়েক ধাপে গড়িয়ে পড়ছে জল। দৈর্ঘ্যে বা প্রস্থে তেমন বড় নয় ফোয়ারা। তবে ঐতিহ্যে তো বটেই, তা না হলে দেশ বিদেশের বেজায় লোক দেখি হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন জলের বাঁধানো ধারটায়। অত কাছে গিয়ে কি দেখা যায় ঐটুকু জলের, ভাবছি অবাক হয়ে, এমন সময় জানলাম গাইড বইয়ের সৌজন্যে, ট্রেভি ফাউন্টেনে পয়সা ফেললে নাকি আবার রোমে আসা যায়। আবার রোমে আসার থেকে মুদ্রা নিক্ষেপের জন্য ট্রেভির কাছে পৌঁছনো আরও কঠিন বলে মনে হল। তবে বালক ঠিক ফেলে এসেছেন জলে সিকি, আগামীবারও আমাদের সাথে আনবেন এমন প্রতিশ্রুতি দিয়েই। ফোয়ারার পাশের ভিড়ের একটু তফাতে দেখি এক তরুণী তন্ময় হয়ে আঁকছেন, রাস্তায় চেয়ার পেতে বসে। সামনে সাজানো ছবি, বিক্রয়ের আশায়। রোমের রাজপথে বাজনাও শুনেছি বিস্তর—ভায়োলিন বা অ্যাকর্ডিয়ান বাজাচ্ছেন কোনো বৃদ্ধ, বিভোর হয়ে, সামনে পাত্র, পারিশ্রমিকের প্রত্যাশা। চোখাচোখি হলে মাথা নুইয়ে হেসেছেন। শিল্পকে পণ্য করেছেন নেহাৎ প্রয়োজনেই, সহবৎ অটুট।
ট্রেভি থেকে ফিরে আসার সময়ও প্রচুর লোক, সন্ধে যত বাড়ছে ভিড়ও তত। সবাই বোধহয় সিকি খরচায় রোমে ফেরার পথ পাকা করতে চান। এ-গলি ও-গলি ঘুরে আবার সেই বড় মোড়ে এসে বাস ধরে হোটেলের কাছাকাছি নামতে প্রায় পৌনে ন’টা। শেষ সূর্যের আলো বাড়ির মাথা ছুঁয়ে। আশপাশের রেস্তোরাঁ প্রায় সবই ঝাঁপ ফেলেছে। খেতে হবে কিছু। এদিক ওদিক তাকিয়ে ম্যাকডোনাল্ডের দেখা মিলল, সাঁঝবাতিতে সরগরম। তবে রোমে এসে প্রথমেই ম্যাকডোনাল্ড খেয়েছি এ তেমন বলার বিষয় হবে না। তাই উদরকে প্রবোধ দিয়ে পা চালালাম। অদূরেই দেখি পিৎজেরিয়া। এমন সময়োচিত ব্যবস্থায় উৎফুল্ল হয়ে দৌড়ে পৌঁছলাম দরজায়। টুপি পরা কাউন্টারী পিৎজা কাটার সুদর্শন চক্র হাতে প্রস্তুত। আমরা আলোচনা শুরু করলাম কি খাব, কিন্তু তার থেকেও বেশি, কি খাব তা কি করে বোঝাব। ততক্ষণে রোমের রাস্তায় ইংরেজির চলতা সম্বন্ধে ধারণা হয়ে গেছে, এবং তা খুব উঁচু নয়। ফেরার পথে অন্য এক দোকানের সামনে এক প্রৌঢ় পড়েও যাচ্ছিলেন, তাঁকে সাহায্য করতে গিয়ে, এক কুচো সহানুভূতিও পৌঁছতে পারি নি ইংরেজিতে। এখানেও অন্যথা হবে না ধরে নিয়ে আমরা মুখ ও প্রত্যঙ্গের নানা কায়দায় ঠিক যেমন পিৎজা চাই তার জানকারি জানাতে লাগালাম। সব হয়ে গেলে আমি আবার ভাবলাম পেপেরনি যোগ না করলে কি করে হয়। আঙুলের মীড়ে পেপেরনির আকার ও স্বাদ যেই না বুঝিয়ে উঠেছি, কাউন্টারী বললেন, কবে আইলেন? পিৎজা সেবনের ফাঁকে জানা গেল, রোমে আছেন বাইশ বছর, পরিবার বরিশালে। পিৎজেরিয়া পনেরো বছরের।
ট্রেভি থেকে ফেরার পথে সেই বিরাট মোড়টার মাথায়, বাঁদিকে তাকিয়ে একটা ভাঙা ভাঙা ইমারত চোখে পড়েছিল, ছবিতে খুবই চেনা রোমের অনুষঙ্গে। ঠিক হল কাল কলসিয়াম।
|| তিন ||
আসার আগে এক বিশ্ববিহারী বন্ধু বলে দিয়েছিলেন, রোমের যে-সব জায়গায় টিকিট কাটতে হয়, সেখানে যাবার আগেই যেন টিকিট কেটে নিই, ইন্টারনেটে, না হলে সর্পিল সারণিতেই বেলা বয়ে যাবে। গভীর রাত্রে হোটেলের লবিতে ইন্টারনেটে টিকিট কাটতে গিয়ে পরিশ্রম কম হল না, একে নেট বাড়ন্ত, তায় প্রায় সব অতিথিই উজ্জ্বল মুখে বসে গেছেন সার্ফ করতে। তবে পরদিন সকালে বুঝলাম সে পরিশ্রম কমই; কলসিয়ামকে প্রায় বার কয়েক প্যাঁচ খেয়ে ঘিরে রয়েছে টিকিটের লাইন। আমরা গটগট করে ইন্টারনেটের রসিদ দেখাতেই দ্বার খুলে গেল।
রোমের সবথেকে পরিচিত প্রতীক এই কলসিয়াম। পরম কুশলতায় রক্ষিত এক বিশাল ধ্বংসস্তূপ। পরিচর্যার কাজ চলছে অবিরাম; বাইরের একদিকের অংশে লোহার মাচা বাঁধা। কলসিয়ামের ইতিহাস হয়ত সবারই জানা, সহজেই উইকিপিডিয়ালভ্যও। প্রাচীন রোমের ক্রীড়াভূমি, মানুষ ও পশুর নানা রোমহর্ষক খেলার সাক্ষী। ভিতরে থাকে থাকে গ্যালারির মত বসার জায়গা, নীচের মাঝখানে ক্রীড়াঙ্গন। তারও নীচে পরিখার মত সুড়ঙ্গ, মনুষ্যেতরদের জন্য—পশু ও মানুষদের। ট্যুরিস্টের ঠাসাঠাসি, সবাই তুলছেন ক্যামেরায় ছবি। বেশিরভাগই নিলীন নিজস্বীতে; বহু জনতার মাঝে অপূর্ব একা, প্রমাণ করতে হবে তো ফেসবুকে। এত লোক, কিন্তু তৎসত্ত্বেও নৈঃশব্দ্যে চিড় নেই বিশেষ। সমবেত ক্রীড়াদর্শন মানবসভ্যতার আদি রসের একটা। যেকোনো খেলার ভিতরেও জেতা হারা আছে, তবে কলসিয়ামের খেলায় জেতার বিপরীত শুধু হারাই নয়, জানে মরা। থাক থাক উঠতে থাকা দর্শকাসনের মাঝে মাঝেই কুঠুরী—হয়ত স্পেশাল দর্শকদের বসার বাক্স ছিল । কলসিয়ামের মধ্যে একটা হিংস্রতা আছে, আর পাঁচটা ঐতিহাসিক ইমারতের মত শুধু সমীহ জাগায় না, সাথে ভয়ও। এদেশে জন্মালে সেকালে, কলসিয়ামের কোনখানটায় স্থান হত আমার সে নিয়ে তেমন কোন সংশয় নেই। কলসিয়ামের একটি ইঁটেও এ যুগের কোনো চিহ্ন নেই। আমাদের ওদিকে যেমন পাথুরে মনুমেন্টে অমুক তমুককে ভালবাসে জাতীয় বাণী, বা বাণবিদ্ধ হৃদয়, বা আরও অপাঠ্য সব চিত্রকল্প থাকে, তা একেবারেই নেই দেখলাম।
কলসিয়ামের বাইরে গ্ল্যাডিয়েটর সেজে পালোয়ানরা পোজ বিকোচ্ছেন ট্যুরিস্টদের সাথে, হাতে জমকালো অস্ত্র সব, তেমন ধারালো নয়। বালককে আমরা বললাম গিয়ে দাঁড়াতে, শৈশবীয় বীরত্ব অমর হয়ে থাকত ক্যামেরায়। কিছুতেই রাজি করানো গেল না। কলসিয়ামের রুক্ষ মায়ায় জল তেষ্টা পেয়েছিল বেশ। সামনেই দেখি জেলাটোর হাট। খেতে শুরু করলাম একেক-জনে এক-একটা। জেলাটো রোমের এক আকর্ষণ, বিস্কুটীয় কোনের মাথায় বিচিত্র স্বাদ-বর্ণের আইসক্রীম। আইসক্রীমের ব্যাপারে আমি আবার ভ্যানিলার বাইরে যেতে সাহস করি না। কিন্তু কলসিয়ামে কাপুরুষ হব না বলে, চেয়ে বসলাম একটা গাঢ় সবুজ রঙের স্বাদ। পরিমাণে প্রচুর, জমাট বাঁধা তুষার কামড়ে খেতে হয়। পেট ভরা খাবার। সারা সকাল এতটা ইতিহাস আর এতখানি জেলাটো খেয়ে ক্লান্ত লাগছিল, বালকের দুপুরে ঘুমোনোর সময়ও বয়ে যাচ্ছে। অবশ্য তা নিয়ে বালকের তেমন কোন পরিতাপ নেই। রথারোহী অর্জুনের মত, প্র্যামটাকে আবার যুদ্ধের গভীরে নিয়ে যাওয়ার জন্য কলসিয়ামের দিকে হাত বাড়িয়ে চল চল, যাচ্ছ না কেন শুরু হতেই আমরা তাড়াতাড়ি হোটেলের বাস ধরে ফেললাম। কথিত আছে, কলসিয়ামের অনুপ্রেরণাতেই গিবন লিখেছিলেন তাঁর আত্মজীবনী। আর আজ, জেটযাত্রার দৌলতে, আমরাও এসে হাজির হয়েছি সেই কলসিয়ামের ধারে, যাদের জীবনটা আছে, জীবনীর উপাদান নেই। গিবন এখন এখানে বসে লেখালেখি করতে গেলে হয়ত বার্বারিয়ানদের এই বাড়ন্ত দেখে ক্ষুদ্ধ হতেন ।
বাকিরা ঘরে জিরোতে গেলেন। আমি গেলাম কন্ফারেন্সে মুখ দেখাতে। পরিচিত কয়েকজনের সাথে দেখা। একজন বললেন, কেমন লাগল আমার বক্তৃতা, কালকে? আমি বললাম, ও: যা বলেছেন, আমি তো সারারাত ঘুমোতে পারিনি আপনার ভাষণ শুনে। সময় মত হোটেলে ফিরে বেরোনো আবার, এবার গন্তব্য ফোরাম। ভারতের অনেক শহরেই আজকাল ফোরাম আছে, সাধারণ মলময়তার প্রতীক। তবে রোমের ফোরাম সে ফোরাম নয়। শহরের একদম ভিতরে, কলসিয়ামের কাছেই রাস্তা থেকে খানিক নীচুতে কিছু স্তম্ভ খিলান গম্বুজের সন্নিবেশ। সিঁড়ি দিয়ে নেমে দাঁড়ালাম। খানিক বাঁধানো মাটি, এখানে ওখানে ঘাস। ভাঙা পাথরের টুকরো ছড়ানো; যে সব স্ট্রাক্চার দাঁড়িয়ে আছে সেগুলোও কালধ্বস্ত। ফোরাম রোমানাম—ফোরামের আদি ল্যাটিন নাম—প্রাচীন রোমের মুখ্য বাজার। ফোরামের একদিকে প্যালাটাইন হিল, রোমের সাতটি পাহাড়ের কেন্দ্রে। অন্যদিকে ক্যাপিটোলিন হিল। এই দুই টিলার মধ্যের ছোট্ট উপত্যকায় ফোরাম। চারপাশে নানা ঐতিহাসিক দালান। প্রাচীন রোমের ফোরামে শুধুই বিকিকিনি হত না, নাগরিক জীবনের নানা ঘটনার সাক্ষী থাকত ফোরাম—নির্বাচন, বক্তৃতা, বিজয়োৎসব, কুচকাওয়াজ। খ্রীষ্টপূর্ব পাঁচ থেকে এক শতকের ভিতরের ফোরামের মাঝখানটা প্রায় খালিই ছিল জনতার জমায়েতের জন্য। তারপর নানা দালান উঠেছে, আজ যেগুলোর অবশিষ্ট আমাদের সামনে। আস্ত বাড়ি একটা নেই, স্তম্ভও আস্ত না একটাও, কিন্তু তবু তাকিয়ে কখনই মনে হয় না ধ্বংসাবশেষ দেখছি।
এদিক ওদিক ঘোরা হচ্ছিল। জায়গাটায় একটা অদ্ভুত নৈ:শব্দ। সময় যেন থেমে আছে জমাট বেঁধে। আরও অদ্ভুত কারণ অদূরেই আজকের রোম শহর। চোখ তুলে তাকালেই রেলিঙের ওধারে আধুনিকতার কিছু কমতি নেই—হুড খোলা বাসে টুরিস্ট, ঝিংচ্যাক ক্যামেরা হাতে। আজকাল ইন্টারনেটের দৌলতে টাইম ক্যাপসুল কথাটা প্রায়ই শোনা যায়। তবে আন্তর্জালের যুগে ইত্যবধি ক্যাপসুলে ভরে রাখা গেছে দশ বিশ বছরই। ফোরামে দাঁড়িয়ে টাইম ক্যাপসুল ব্যাপারটা ভীষণ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য মনে হল, এবং ক্যাপসুলের ভিতরের মশলাটা বেশ বেশিই। খানিক বাদে বাদেই সাইনবোর্ড, ইটালীয়ন ও ইংরেজিতে বিশেষ স্থান মাহাত্ম্যের বর্ণনা। দেখি কয়েকটা স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে আছে উঁচু উঁচু থাম, বেশির ভাগই ভাঙা, কোনোমতে ধরে রেখেছে ওপরের ছাদ। পাশেই লেখা টেম্প্ল অফ ভেস্টা। এখানেই জ্বলত অখণ্ড পূতাগ্নি—রোমের প্রাণশক্তির প্রতীক, অতন্দ্র প্রহরায় চিরকুমারীরা, একমাত্র প্রধান পূজারী ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ। ১৯১ খ্রীষ্টাব্দে একবার আগুনে পুড়েছিল এই মন্দির, তখন সংস্কার হয় একবার, তারপরে আবার আংশিক পুনর্গঠিত হয়েছিল বিংশ শতকে, আজও তাই দাঁড়িয়ে আছে আংশিক। শিখা আজ কত শতাব্দী হল নিভে গেছে, তবে রোমের প্রাণশক্তির টান আজও অটুট।
মনে হল মাটি থেকে একটা ঢিল তুলে নিলে বোধহয় ইতিহাস চুঁয়ে পড়বে। বালকেরও বোধহয় তেমন কিছুই মনে হচ্ছিল—কুড়িয়ে নিয়ে হঠাৎ যত্রতত্র ঢিল ছোঁড়া শুরু হল। আমরা শশব্যস্ত হয়ে নিবারণ করতে গেলাম। তার আগেই একটা ঐতিহাসিক ঢিল গিয়ে পড়েছে একটা কালচে সবুজ রঙের দরজার পায়ে। বাড়িটার নাম রোমিউলাসের মন্দির—৩০৭ খ্রীষ্টাব্দে রাজা ম্যাক্সেনটিয়াস শৈশব-প্রয়াত পুত্র রোমিউলাসের স্মৃতিতে নির্মাণ করেন। একটা মুদ্রার উপর এই বাড়ির ছবি দেখে একে শনাক্ত করা হয়। পাশেই বিবরণ পড়ে চমকে উঠতে হয়, দরজাটার বয়স প্রায় দুহাজার বছর, আজও দিব্যি খোলে বন্ধ হয়, এখনও অর্গল কাজ করে। সামান্য একটা দরজা আর তার আগল, আজও তা কর্মক্ষম দুহাজার বছর পরে! ভাবলাম ২০০০ সালে দিবারাত্র আয়ুক্ষয় করে যে-সব প্রোগ্রাম লিখেছিলাম, সেগুলোও আজও চলছে কি পনেরো বছর পরে? তৎকালীন ক্লায়েন্টদের জিজ্ঞাসা করতে হবে। তাঁরাও হয়ত ভুলে গেছেন।
ইতিহাসের সাধারণ বিবরণী গড়ে ওঠে রাজারাজড়াদের ঘিরে, অন্তত ঐতিহাসিক স্থানে টুরিষ্টদের তাই পরিবেশন করা হয়। এখানে এর ব্যত্যয় দেখে আশ্চর্য লাগল। প্রায় মাটির সাথে মেশানো কয়েকটা কুঠুরী। পাশের বোর্ডে লেখা পড়ে জানলাম এগুলোকে সাধারণ ভাবে মনে করা হয় কার্সার বা জেলখানা। শব্দটি ইংরেজির ইনকারাসেরেটেড শব্দের প্রপিতামহ হয়ত। তবে প্রাচীন রোমে মাত্র একটি জেলখানার অস্তিত্বই ইতিহাস সিদ্ধ; ক্যাপিটোলিন পাহাড়ের গায়ে টুলিয়ানাম। তবে এই ঘর কয়েকটার তাৎপর্য কি? হয়ত নিছকই ভাঁড়ারঘর ছিল, বা হয় ক্রীতদাসদের ঘুমোনোর জায়গা, সঠিক জানা যায় না। বোর্ডের বিবরণের মধ্যে এই ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বের উল্লেখ দেখে বোঝা যায় ইতিহাস শুধুই লিনিয়ার ন্যারেটিভ'এর রাজপথ নয়; সেখানেও অনেক গলির আনাচ কানাচ, সিদ্ধান্ত আর সন্দেহের টানাপোড়েন। উৎস থেকে মোহনা অবধি যে-সব গল্প আমরা শুনতে অভ্যস্ত, তা অনেকটাই তৈরি হয় বহু তথ্য, ইঙ্গিত, প্রবাদ, গুজবের নক্সিকাঁথায়। খাতায় আঁকতে সরলরেখাই সোজা, কিন্তু ইতিহাস চলে কম্বুরেখায়।
সন্ধে এগিয়ে আসছে। লম্বা খিলানের ছায়া লম্বাতর। আজ থেকে দুহাজার বছর পরে, রেলিঙের ওধারের রোম দেখতে আসবে লোকে, নাকি তখনও এধারটাই থাকবে দ্রষ্টব্য? উত্তরটা সহজ নয়। আমরা আস্তে আস্তে বাড়ির পথ ধরলাম। এদিনের রোমের মাঝে সেদিনের ফোরাম বুঝিয়ে দিল ঐতিহ্যের সাথে প্রগতির কোনো বিরোধ নেই। কাল সকালে আরেক নতুন দেশ।
|| চার ||
পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম দেশ, পরিধি ও জনসংখ্যা দুইয়ের নিরিখেই—মাত্র একশ দশ একর নিয়ে, উইকিপিডিয়া অনুযায়ী মাত্র ৮৪২ জন বসবাস করেন। ১৯২৯ সালের ল্যাটেরান চুক্তি অনুযায়ী জন্ম হয়েছিল এই দেশের—ভ্যাটিকান সিটি। রোমের মধ্যে সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকা, অ্যাপোস্টোলিক প্যালেস, সিস্টিন চ্যাপেল ও সন্নিহিত আরো কিছু বাড়ি নিয়ে পোপের সার্বভৌম রাষ্ট্র। কলসিয়ামে ঢোকার লাইন দেখে সেই বিশ্ববন্ধুর পরামর্শ ফেলার নয় তা বুঝেছি। তাই রাত থাকতে থাকতেই ইন্টারনেট টিকিট কাটতে বসলাম ভ্যাটিকান মিউজিয়াম এবং সিস্টিন চ্যাপেলের। টিকিট কাটলেও যখন তখন ঢোকার ব্যবস্থা নেই। প্রতি টিকিটেই ঢোকার সময় নির্দিষ্ট। এদেশের ইন্টারনেট ওয়াস্তা অনুযায়ী টিকিট কাটাটা বেশ ধকলের, বেশ ক'বার নাস্তানুবাদ হয়ে ক্রেডিট কার্ড উৎরোলো শেষ অবধি, ঢোকার অনুমতি পাওয়া গেল, সকালে সাড়ে এগারোটা থেকে বারোটার ভিতর। সাথে পাসপোর্ট আনার নির্দেশ, দেখা হতে পারে প্রয়োজনে।
বাসে করে ভ্যাটিকানের কাছে এসেই প্রথম নজর পড়ল এক ঝলক সেই থামে ঘেরা চত্বর—টিভিতে যেখানে দেখেছি বড়দিনে বা শুভ-শুক্রবারে, মানুষের সমুদ্র, প্রার্থনায় শান্ত। আমরা বলে উঠলাম ঐ তো সেন্ট পিটার্স স্কোয়ার। ভ্যাটিকান রাষ্ট্রের ঠিক মাঝখানে এই প্রাঙ্গণ, এক মাথায় দাঁড়িয়ে সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকা, দুপাশে পরপর শ্বেত পাথরের থাম অর্ধবৃত্তাকারে—ক্যাথলিক চার্চের উন্মুক্ত আলিঙ্গনের প্রতীক। মাঝখানে একদিকে এক ওবেলিস্ক, আরেকদিকে ফোয়ারা। শান বাঁধানো মাটির মাঝে মাঝে ট্র্যাভারটাইন পাথরের রেখা ব্যাসার্ধের মত বাইরের দিকে বেরিয়ে গেছে। এটি একটি বিশেষ প্রকৃতির লাইমস্টোন, উষ্ণ ফোয়ারার কাছে পাওয়া যায়। বাস থেকে নেমে সুড়ঙ্গপথে রাস্তা পেরিয়ে ভ্যাটিকানে ঢুকে পড়লাম। প্রাঙ্গণের এক পাশে লম্বা সারিতে দাঁড়িয়ে বহু মানুষ, ব্যাসিলিকায় ঢোকার অপেক্ষায়। আমরা ভাবলাম প্রথমে মিউজেই ভ্যাটিকানি বা ভ্যাটিকান মিউজিয়ামস দেখে নেওয়া যাক, তারপর এদিকে ফিরে আসব। যেদিক দিয়ে ঢুকেছিলাম সেন্ট পিটার্স স্কোয়ারে, তার ঠিক উল্টো দিক দিয়ে বেরিয়ে খাড়া প্রাচীরের গা ধরে হাঁটতে হাঁটতে পিছনের দিকে চললাম, প্র্যামে বালক গভীর ঘুমন্ত। এদিকের রাস্তায় বিস্তর মানুষ বেশিরভাগই চলছেন আমাদেরই দিকে, কেউ কেউ ফিরে আসছেন। রোম ভ্যাটিকানের নানান প্রতীকী টুকিটাকি বিক্রী হচ্ছে রাস্তায় ঢেলে। বিরাট বিরাট রঙিন পোস্টারও ফুটপাথের ধারে মাটিতে বেছানো, না হয় দেওয়ালে টাঙানো। সেখানে বর্তমান পোপ, স্বেচ্ছাবসরী পোপ এমেরিটাস, পোপ জন পল দ্বিতীয় সবাই আছেন, তার সাথে আছেন মাইকেল জ্যাকসন, এমনকী এযুগের ম্যাডোনা ও লেডি গাগা’ও। শেষের দুজন তাঁদের চিরন্তন পোশাকি হ্রস্বতায়। আধ্যাত্মিক অলীকতায় যে ভারত কম যায় না, তারও নিদর্শন দেখলাম। গেরুয়াধারী বাজিকর পদ্মাসনে বসে আছেন ফুটপাথ থেকে চারহাত শূন্যে, মর্ত্যের সাথে একমাত্র যোগ ডান হাতে তর্জনী ছোঁওয়া যষ্ঠী। পাশে সাকরেদ চোখ রাখছেন কেউ যেন খুব কাছে না এসে পড়ে, আর প্রণামী ঠিকঠাক জমছে কিনা সামনের ভিক্ষাপাত্রে, তাঁর আলখাল্লাও গেরুয়া। ভারতের সাথেই গৈরিক আর তার সাথেই ম্যাজিক, ব্যাপারটা ভালই চলছে বিশ্ববাজারে, আজ এক শতকেরও বেশি।
ভ্যাটিকান মিউজিয়ামের দরজায় পৌঁছনোর আগে, ভ্যাটিকানের যেসব অঞ্চল পোপ এবং তাঁর পারিষদদের জন্য সংরক্ষিত, সেগুলোর তোরণ পেরোলাম পাশ দিয়ে। অ্যাটেন্শনে টানটান ভ্যাটিকানের রক্ষীদের পোশাক দেখে তাক লেগে যায়। এঁদের পোশাকি নাম পন্টিফিকাল স্যুইস গার্ড। গত সহস্রাব্দের মাঝের কয়েক শতকে স্যুইৎজারল্যান্ড থেকে ভাড়াটে সৈন্য সরবরাহ হত ইয়োরোপের নানা দেশে। পনেরোশো শতক নাগাদ থেকে এঁরা পোপের সুরক্ষার দায়িত্বে। নানা কোন্দল বিগ্রহের গনগনে যুগে এঁরা আসল ফাইটিং’এ অংশগ্রহণ করেছেন সোৎসাহে, আধুনিক কালে এঁদের উপস্থিতি হয়ে গেছে অনেকটাই আনুষ্ঠানিক। কিন্তু ১৯৮১ সালে পোপ দ্বিতীয় জন পলের প্রাণনাশের চেষ্টার পরে এই প্রহরীদের প্রশিক্ষণ কড়া করা হয়েছে। সেইসব নিদর্শন না দেখলেও পন্টিফিকাল স্যুইস গার্ডদের লাল-নীল-কমলা-হলুদ ইউনিফর্ম চোখ টানে। পোশাকের আকৃতিও অনেকটাই রেনেসাঁস ছন্দের; পৃথিবীর অন্য কোনো শহরেই হয়ত এমন বসন কার্টুন বলে গণ্য হত আজকের দিনে; কিন্তু আজকের রোমেও যেন কি একটা আছে। ১৯১৮ সালে এই পোশাক সৃজিত হয়, শোনা যায় মাইকেঞ্জেলো ও রাফায়েলের এঁকে যাওয়া নক্সার অনুপ্রেরণায়। মিউজিয়াম থেকে কয়েকশো মিটার দূর থেকে টিকিট কাটার লম্বা লাইন চোখে পড়তে লাগল। এজেন্টরাও ঘুরে বেড়াচ্ছেন যত্রতত্র, লাইন কেটে সটান ভিতরে ঢুকিয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার, সামান্য কমিশনেই। আমরা ওসবে কান দিলাম না, ইন্টারনেট টিকিট আঁকড়ে সোজা ঢোকার মুখে। তোরণের উল্টো দিকেই দেখলাম নানা সরাইখানা, একটায় লেখা ব্রেকফাস্ট অ্যান্ড বার। বেশ অবাক লাগল, বেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্ট ব্যাপারটা চলে সারা পৃথিবীতে, এখানে দেখছি প্রাতরাশের পরেই পানের আহ্বান। ইন্টারনেটে কাটা টিকিট খুঁটিয়ে দেখে এবং মাথা গুনে ঢোকানো হল ভ্যাটিকান মিউজিয়ামের ভিতরে। বালক তখন ঘুম শেষে তরতাজা, নানা প্রশ্নে ফুটন্ত।
ষোড়শ শতকের গোড়ায় একগুচ্ছ ভাস্কর্য একত্র করে পোপ দ্বিতীয় জুলিয়াস শুরু করেন এই সংগ্রহশালা। তারপর পরবর্তী অনেক পোপদের পৃষ্ঠপোষকতায় সম্প্রসারিত ও সমৃদ্ধ হয়েছে এই ভ্যাটিকান মিউজিয়ামস। নামের মধ্যে বহুবচন লক্ষণীয়—বহু প্রদর্শনী ও সংগ্রহের সমষ্টি এটা, যেমন পিও-ক্লেমেণ্টিন মিউজিয়াম—পোপ চতুর্দশ ক্লেমেন্ট ও ষষ্ঠ পিউসের নামাঙ্কিত—এই দুই পোপের উদ্যোগে সংগ্রহ বহুগুন বর্ধিত হয়। অন্যান্য অংশের নাম এট্রাস্কান মিউজিয়াম, ইজিপ্সিয়ান মিউজিয়াম, গ্যালেরি অফ্ ট্যাপেস্ট্রিস, গ্যালেরি অফ্ ম্যাপস, সবিয়েস্কি রুম, রাফায়েল স্টান্জে, রুম অফ্ ইম্যাক্যুলেট কন্সেপসন ইত্যাদি; এবং সিস্টিন চ্যাপেল। রেনেসাঁস আর্টের কুলীনতম কালেকসন মনে করা হয় আছে এই ভ্যাটিকান মিউজিয়ামস্এ। শুধু রেনেসাঁসেই থেমে থাকেনি ভ্যাটিকান মিউজিয়ামস, ১৯৭৩ সালে পোপ দ্বিতীয় জন পল উদ্বোধন করেন কালেকসন অফ্ মডার্ন অ্যান্ড কন্টেমপরারি রিলিজিয়াস আর্টের। আর্ট ছাড়াও আছে অতীতে ব্যবহৃত নানা সামগ্রীর সম্ভার। ভ্যাটিকান মিউজিয়ামস-এর সূচনা হয়েছিল শিল্প, শিল্পের ইতিহাস এবং কৃষ্টির সাধারণ্যে পরিবেশন, এবং সাধারণের সংস্কৃত্যায়নের উদ্দেশ্য নিয়ে।
ভ্যাটিকান মিউজিয়ামস্এ ঢুকে পড়ার পর চলমান স্রোতের সাথে চলতে থাকতে হয়। চলার পথ কখনও এসে পড়ছে প্রশস্ত ঘরের ভিতর, কখনও তুলনায় অপরিসর প্যাসেজের মধ্যে, কখনও কয়েক ধাপ সিঁড়ি ওঠা নামা। প্রত্যেক দরজার পাশেই ম্যাপ দেওয়া, এখন কোথায় আছি, আর সামনে পেছনে কি। সীলিং দেওয়াল মেঝের ইঞ্চি বিশেষেও বোধহয় ফাঁক নেই—এত দেখার জিনিসে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। কত রঙ, কত রেখা, কত ভাবনা, কত ভাষা। যেকোনো একটি ছবির একটি কোণেই তাকিয়ে থাকা যায় কতক্ষণ। কোনো ছবিতে ফুটে উঠেছে বাইবেলীয় কোনো অনুষঙ্গ, কোনো ছবিতে ইতিহাসের কোনো ঘটনা। রেখার প্রতিটি মীড়, রঙের প্রতিটি প্রলেপ জীবন্ত, এই মাত্র আঁকা শেষ হল যেন। আজকের এই সেলফোনের সেল্ফিময় যুগে ছবি আমাদের জীবন জুড়ে। অষ্টপ্রহরের কোনো ভঙ্গিই বাদ যায়না ফোনবন্দী হতে। কিন্তু ছবি বলতে কি বোঝায় তা খানিক বুঝতে পারলাম এইখানে এসে। কোনো ছবিই অ্যাবস্ট্র্যাক্ট আর্ট নয়, ফটোগ্রাফের মত নিপুণ সঠিকতায় তুলে ধরা হয়েছে দৃশ্যপট—আকাশ, আলো, মাটি, মানুষ সবই নিখুঁত। কিন্তু দেখে মনে হয় না শুধুই একটি মুহূর্তের প্রতিকৃতি দেখছি। যা দেখছি তার আরো অনেক গভীরে পৌঁছে যাচ্ছে মন। যাঁরা এঁকেছেন এই সব ছবি, অনেকেই তাঁরা সভ্যতার প্রাত:স্মরণীয় নাম। কিন্তু যাঁদের অক্লান্ত চেষ্টায় সংরক্ষিত হচ্ছে এই সম্পদ, ভাবীকালের জন্যে, তাঁরাও স্মরণার্হ। এক একটি ঘরে, এক একটি দালানে কাটিয়ে দেওয়া যায় বোধহয় এক বছর; কিন্তু আমাদের হাতে সময় কয়েক ঘন্টা মাত্র। তাছাড়া ভিড়ও বাড়ছে বেলা বাড়ার সাথে সাথেই। স্রোতের মাঝে দাঁড়িয়ে পড়া দায়। চারপাশের মানুষের সাথে একহাত তফাৎই হয়ত মাত্র, তবু কোনো ঠেলাঠেলি, ধাক্কাধাক্কি নেই, হাতে পায়ে ঠোকা লেগে গেলেও কেউ বিরক্তি প্রকাশ করছেন না। এর থেকে অনেক কম ঘেঁষাঘেঁষিতে আমরা কলকাতার বাসে-টাসে সুন্দর সব বিশেষণ প্রয়োগ করতে অভ্যস্ত। এখানে সবাই যেন কেমন বুঁদ।
কোনটা কোন ঘর, কোন ঘরে কি দেখলাম সব আলাদা করে মনে রাখার চেষ্টা থামিয়ে দিয়েছি শুরুতেই, ক্যামেরাও কয়েকবার টিপে বন্ধ। এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার জিনিস মেমারি কার্ডে নয়, মনে। সামান্য মানচিত্রকেও কি অসামান্য শিল্পে নিয়ে যাওয়া যায়, মনে হয় বর্ণিত জায়গা সব প্রাণ পেয়েছে। স্টানজে অফ্ রাফায়েল, চারটি কামরার অ্যাপার্টমেন্ট, দ্বিতীয় জুলিয়াস দেলা রোভেরের সময় থেকে পোপের বাসস্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে—১৫০৮ এবং ১৫২৪-এর ভিতর রাফায়েল এবং তাঁর ছাত্রদের আঁকা ছবিতে সমৃদ্ধ। শুধু ছবি বললে কিছুই বলা হয় না। ইতিহাস, রাজনীতি, দর্শন, আধ্যাত্মিকতার এক অনাহত ভাষ্য ঘিরে ধরে মন ও মনন। কত যুদ্ধ বিপদ-বিসংবাদের পথ খৃষ্টধর্ম পেরিয়ে পেয়েছে ঐশী আশ্রয়, মনে হয় যেন তার সিনেমা দেখছি। চারটি ঘরের ভিতর রুম অফ্ সেগনাচ্যুরা রাফায়েলের সবথেকে বিখ্যাত কয়েকটি ফ্রেসকো’র পটভূমি। ভ্যাটিকান-এর চৌহদ্দির ভিতর এই ফ্রেসকোগুলিই রাফায়েলের প্রথম সৃষ্টি, এবং রেনেসাঁসের আর্টের উচ্চ উত্তরণের সেই শুরু। এই ঘরেই বসত পোপের সর্ব্বোচ্চ বিচারসভা, ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি থেকে, সেই থেকেই ঘরের নামকরণ। ১৫০৮ থেকে ১৫১১-র ভিতর আঁকা এই ছবিসমষ্টি মানব মননের সর্ব্বোচ্চ ত্রিধারাকে বর্ণনা করে—ট্রুথ-জাস্টিস-বিউটি; সত্য-ন্যায়-সৌন্দর্য। দৈব সত্য ও দার্শনিক সত্যের বর্ণনা ভিন্ন ছবিতে। ডিস্প্যুটেশন্স অফ্ দ্য হোলি স্যাক্রামেন্ট ছবিতে সমান্তরাল আধাআধি স্বর্গ ও মর্ত্য—উপরে যীশুকে ঘিরে আছেন মেরি মাতা, এবং আদম, জেকব, মোসেস এবং বাইবেলীয় আরো অনেকে, তারও উপরে ঈশ্বর স্বয়ং, স্বর্গীয় মহিমায়। নীচে পৃথিবীর কুশীলবরা অধ্যাত্ম আলোচনায় মশগুল, আছেন পোপ এবং চার্চের অন্য সদস্যরা, আছেন দান্তে, এবং দিকপাল রেনেসাঁস স্থপতি ব্রামান্টে—এঁর প্রাথমিক ভাবনার ভিত্তিতেই মাইকেলেঞ্জেলো আঁকেন সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার নকসা। ছবির নামের মধ্যে ডিস্প্যুটেশন্স শব্দের ভিতরে যে তর্কের ইঙ্গিত তা মানবসভ্যতায় চিরকালের, আমাদের কান্তকবির কথায়, না রাখি জটিল ন্যায়ের বারতা/ বিচারে বিচারে বাড়ে অসারতা। এর পরের ছবিই দার্শনিক সত্যের দিকে মানুষের আগ্রহ—স্কুল অফ্ অ্যাথেন্স। মনে করা হয় রাফায়েলের শ্রেষ্ঠ ছবি এবং আর্টের ইতিহাসের হাই রেনেসাঁস যুগের সর্বোত্তম সৃষ্টির একটি। এই ছবির মূল মন্ত্র কসেরাম কগ্নিটিও—কার্য-কারণের জ্ঞান। ছবির সামনে খানিক উঠোন, তার পরের কয়েক ধাপ সিঁড়ি, পিছনে কারুখচিত দালান। এবং এইসব পরিব্যাপ্ত করে দার্শনিকরা, বিভিন্ন বিভঙ্গে। কেউ বই পড়ছেন, কেউ আলোচনায় বিভোর, কেউ চিন্তিত মুখে বসে আছেন, কেউ পায়চারিতে ডুবে, দুয়েকজনকে তো মনে হল বেশ তর্কে তপ্ত, সেই আবোলতাবলীয় নারদ-নারদ ভঙ্গিতে একে অপরের দিকে চেয়ে বা ধেয়ে। বিশেষজ্ঞরা বলেন এই ছবিতে প্রাচীন যুগের প্রায় সব দার্শনিকই বর্তমান, যদিও সবাইকে শনাক্ত করা সোজা নয়। প্ল্যাটো এবং অ্যারিস্টট্ল ছবির কেন্দ্রস্থানে। বয়স ও বিদ্যার ভারে খানিক ন্যুব্জ প্ল্যাটো, বাঁহাতে বই, ডান হাতের তর্জনী আকাশের দিকে। পাশে ছাত্র অ্যারিস্টট্ল, মেধা মননে গনগনে তরুণ, তিনিও বাঁহাতে কেতাব ধরে, তবে ডান হাত এগিয়ে দিয়েছেন সামনে। প্ল্যাটোর ডানপাশে খানিক দূরে তাঁর শিক্ষক সক্রেটিস। এছাড়া খানিক নিশ্চিতভাবে যাদের চেনা যায়, তাঁদের মধ্যে পাইথাগোরাস, ইউক্লিড, টলেমি, ডাওজেনিস প্রভৃতিরা। আমাদের আজকের সভ্যতা যাঁদের কাঁধে দাঁড়িয়ে দূরান্তরে পৌঁছচ্ছে, তাঁরা দেশকালের ব্যবধান ঘুচিয়ে একই ক্যানভাসে সন্নিবিষ্ট। এই ছবিতে কুড়িজনেরও বেশি দার্শনিক আছেন, এঁদের মত ও পথ হয়ত বিভিন্ন, কিন্তু ছবির সামনে কয়েক নিমেষ দাঁড়িয়ে মনে হল রাফায়েলের রেখায় তাঁরা একত্রে সেই মানুষ, যাঁদের আবির্ভাবে সুরলোকে বেজে ওঠে শঙ্খ। আর ভাবলাম, আজকে যদি রাফায়েলকে আঁকতে দেওয়া হত এই ছবি, কাদের আঁকতেন এ যুগের, যাঁদের বহু পৃথিবী পরের পথিকও হাঁ করে দেখবেন। সত্যের দুই প্রকাশ—দৈব ও দার্শনিক—নিয়ে নিয়েছে ঘরের দুই দেওয়াল। তৃতীয় দেওয়ালে ন্যায়ের বর্ণনা কার্ডিনাল অ্যান্ড থিওলজিক্যাল ভার্চ্যুজ অ্যান্ড দ্য ল’ ছবিতে এবং চতুর্থ দেওয়ালে সুন্দরের মহিমায় দ্য পার্নাস্যুস। দৈব ও দার্শনিক সত্য এতক্ষণ ধরে দেখছি, যে ন্যায় আর সৌন্দর্যকে অতটা সময় দেওয়া গেল না। বেলা গড়াচ্ছে, চার দেওয়ালে অতক্ষণ আটকে থেকে বালক ব্যস্ত হয়ে উঠছেন। বোঝানো যাচ্ছে না এ হয়ত পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর চার দেওয়াল। থেকে থেকে বলছেন, এবার কোথায় যাব? আমি বললাম সিস্টিন চ্যাপেল, বালক এবার আওড়ে নিলেন, সিস্স্টিং চ্যাপেল, তারপরেই সিস্স্টিং সিস্স্টিং সিস্স্টিং বলে যেতে লাগলেন বেশ অবিরাম। সিস্টিন চ্যাপেল তখনও দেখিনি, যেটুকু জানতাম ঐ মহতী উপাসনালয় স্বান্তন অন্তবিহীন, সেখানে স্টিং-এর ব্যাপার কিছুই নেই, তাও কথা বাড়বে বলে উচ্চারণের কোনো শোধনে জড়ালাম না, বললাম হ্যাঁ হ্যাঁ, এক্ষুনি যাচ্ছি, এখন একদম চুপ।
|| পাঁচ ||
সিস্টিন চ্যাপেল ঢোকার পথটা সরু হয়ে এসেছে। বেশ কয়েক ধাপ উঠতেও হয়। কয়েকজন অশক্ত পর্যটককে চেয়ার লিফটে তোলা হয়। আমরা প্র্যাম গুটিয়ে নিয়ে বালককে কোলে তুলে পায়ে পায়ে এগোলাম। ঠিক ঢোকবার দরজায় দশাসই প্রহরী একজন বলে দিলেন, প্রায় কানে কানে, ফোটোগ্রাফি নয়, জোরে শব্দ নয়, অন্য কোনো রকম বেয়াদবি নয়; মুখ দেখে মনে হল—এই ক’টি কথা জেনো মনে সার, ভুলিলে বিপদ হবে। সিস্টিন চ্যাপেলের মাথার দিক থেকে সর্পিল লাইন ঢুকছে, যেদিকে উপাসনার বেদী। ভিতরে গিয়ে লাইন ভেঙে যাচ্ছে, আবার বেরিয়ে যেতে হচ্ছে লাইন করে উল্টো দিকের দেওয়ালের দরজা দিয়ে। কম করে কয়েকশ' মানুষ একই সঙ্গে অল্প পরিসর জায়গায়, ঢুকেই চমকে উঠলাম নৈ:শব্দ্যে। অনেকে তাকিয়ে আছেন অপলক, দেওয়াল ও সীলিং’এর দিকে, অনেকে চাপা স্বরে কথা বলছেন পাশের কারুর সাথে। অনেকেই চোখ বন্ধ প্রার্থনায় বিলীন, জীবনের পরম তীর্থে এসেছেন হয়ত, এক আয়ুর পাথেয় নিয়ে যেতে।
পোপ চতুর্থ সিক্সটাসের নামাঙ্কিত সিস্টিন চ্যাপেল। ইনিই ১৪৭৭ এবং ১৪৮০-র মাঝে পুরোনো উপাসনালয় সংস্কার করে আজকের চ্যাপেল নির্মাণের নির্দেশ দেন। প্রাথমিক ভাবে দেওয়ালের ফ্রেসকো আঁকার দায়িত্বে ছিলেন পেরুজিনো, বতিচেল্লি, ঘিরলান্ডিও, রোজেল্লি এবং তাঁদের সহকারীরা। সিক্সটাসে ভাইপো, পোপ দ্বিতীয় জুলিয়াস ১৫০৮ সালে মাইকেলেঞ্জেলোকে দায়িত্ব দেন সীলিং এবং দেওয়ালের উপরে অংশ ছবিতে ভরাট করবার। কাজ শেষ হয় ১৫১২-এর অক্টোবরে, এবং সে বছরের পয়লা নভেম্বর দ্বিতীয় জুলিয়াস প্রার্থনার মধ্য দিয়ে উদ্বোধন করেন সিস্টিন চ্যাপেল। ক্যথলিক খৃষ্টধর্মের পরিচালন ব্যবস্থায় সিস্টিন চ্যাপেল স্থান-মাহাত্ম্যে ভারি, এইখানেই বসে প্যাপাল কন্ক্লেভ — পোপের আসন শূন্য হলে নতুন পোপ নির্বাচনের প্রক্রিয়া। সারা পৃথিবীর কার্ডিনালরা একত্র হন নতুন নেতা বেছে নিতে। শোনা যায়, নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় নেতা নির্বাচিত না হওয়া অবধি নির্বাচকদের বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ। যতবার ব্যালটে নিষ্পত্তি না হয়, সিস্টিন চ্যাপেল-এর চিমনি দিয়ে কালো ধোঁওয়া ওঠে। নতুন পোপ নির্ধারিত হয়ে গেলে, ধোঁওয়ার রং বদলে যায় সাদায়। ফেসবুক-ট্যুইটার-হোয়াট্সঅ্যাপ এর যুগে আজকাল ইঙ্গিতের নানা বিভঙ্গ বেরিয়েছে, তার মাঝেও এই ধোঁওয়ার সংকেত চলছে।
সিস্টিন চ্যাপেলের দেওয়াল ও ছাদের ছবির মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে খ্রিস্টীয় জীবনবীক্ষা ও জীবনোত্তর বীক্ষণ। যে অসংখ্য স্পর্শী কাহিনির সন্নিবেশে বাইবেলীয় জগৎ, সেই কাহিনিমালার বিশেষ বিশেষ ক্লাইম্যাক্স প্রাণ পেয়েছে রঙে ও রেখায়। বিশ্বাসীদের আপ্লুত করে, অবিশ্বাসীদেরও উদ্বেল। রীডার্স ডাইজেস্ট পত্রিকায় পড়েছিলাম একবার এক তরুণীর কথা। দুরারোগ্য কর্কট রোগে আক্রান্ত হয়ে দয়িতের সাথে এসেছিলেন সিস্টিন চ্যাপেল দেখতে। মনে হয়েছিল জীবন সার্থক—মরণ হতে যেন জাগি গানের সুরে। ফিরে গিয়ে কয়েক মাস পরে ... না কোনো মিরাক্ল হয়নি। তাঁর রোগের যে পরিণতি আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রে নির্দিষ্ট হয়, যথাসময় তাই এসেছিল। তবে সিস্টিন চ্যাপেল দেখার পরে যে ক’দিন বেঁচেছিলেন, বেঁচে ছিলেন। রীডার্স ডাইজেস্টে সেই লেখাটা পড়া আর আজকের ভিতর কেটে গেছে প্রায় দুই দশক। জীবনের পাটিগণিতে যোগের থেকে বিয়োগের পাল্লা ভারি হয়েছে। সেই ধরনের সমীকরণ মেলানোর চেষ্টা বোধহয় এই সিস্টিন চ্যাপেলের দেওয়াল আঁকনে।
যে দিক দিয়ে ঢুকেছিলাম সিস্টিন চ্যাপেলে, উপাসনা মঞ্চের পিছনে, দেওয়াল জোড়া ফ্রেসকো, মাইকেলেঞ্জেলোর দ্য লাস্ট জাজমেন্ট। খৃষ্টের দ্বিতীয় আগমন এবং ঈশ্বরের কাছে মানুষের শেষ বিচারের দিন এই ছবির বিষয়। চার বছর লেগেছিল শেষ করতে, সিস্টিন চ্যাপেলের ছাদের ছবি শেষ করার পঁচিশ বছর বাদে এই কাজে হাত দেন আরো পরিণত মাইকেলেঞ্জেলো। মাইকেলেঞ্জেলো চেয়েছিলেন যুগান্তকারী কীর্তি রেখে যেতে; প্রচলিত প্রথা ভেঙে ছবির ফিগারদের করেছেন প্রায় বস্ত্রহীন, শেষের সে দিনে সবাই তো সমান, অর্থ-মান-অবস্থান নির্বিশেষে। ছবির বাঁদিক বেয়ে উঠছেন পরিত্রাত পুণ্যিকরা, ডান দিকে পতনের পথে, তুচ্ছ ভেবে এসব কথা করছে যারা হেলা। পুরো একটা জীবনবোধ ভরে দেওয়া হয়েছে একটা ছবির ক্যাপসুলে; কিন্তু এক বারও মনে হচ্ছেনা ওষুধ গিলছি; ছবির স্রষ্টার এমন অপার মুন্সীয়ানা। বিশ্ব তেমন দেখিনি, বিশ্বরূপ তো দুরস্থান, তবে বিশ্বরূপ দর্শন যে একটা মেটাফর, সেটা মনে পড়ে যায় এই ছবির সামনে দাঁড়িয়ে। ছবিটা এঁকে ফেলাতে সুবিধা হয়েছে যে, আমরা যারা দেরিতে উঠে, অর্জুনের জন্য স্পেশাল শো’টা মিস্ করেছি, তারাও আজকে দেখে নিজের জীবন ধন্য করতে পারছি। এই ছবি সম্বন্ধে এক মজার তথ্য পরে জেনেছি উইকিপিডিয়া পড়ে। নগ্নতায় সবাইকে সমান করে দেওয়ার ব্যাপারটা ভালো চোখে দেখেননি তৎকালীন কিছু কর্তাব্যক্তিরা। রীতিমত কাউন্সিল বসিয়ে ধর্মীয় আর্টে অশালীনতা বর্জনের সুপারিশ করা হয়। ১৫৬৪-তে মাইকেলেঞ্জেলোর মৃত্যুর পরে ছবিতে চিত্রিত কিছু শারীরিক প্রত্যঙ্গ শাল-টাল জাতীয় জিনিস আঁকিয়ে দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। মজাটা এইখানেই যে এ শুধুই কোনও যুগ বা গোষ্ঠীর গোঁড়ামি নয়। খ্যাতির মধ্যগগনেও রবীন্দ্রনাথের গানের লাইনে বুকের আঁচলখানিকে সুখের আঁচলখানি হতে হত বাঙালির রুচিকে শুদ্ধ রাখতে। সে গল্প আগে বলেছি, পরবাসের পাতাতেই।
দেওয়াল থেকে পঁচিশ বছর ফিরে যাই এবার সিস্টিন চ্যাপেলের ছাদে। ছাদের সংস্কারের সিদ্ধান্ত পোপ দ্বিতীয় জুলিয়াসকে নিতে হয় সম্ভবত এই কারণে যে আশপাশের বাড়ি তৈরির কাজে সিস্টিন চ্যাপেলের ছাদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, এবং তাৎক্ষণিক তাপ্পি দিয়ে সুরাহা হয়নি। ভাগ্যিস। ছাদ সারানোর পর মাইকেলেঞ্জেলোকে বরাত দেওয়া হয় সেখানে প্রাসঙ্গিক কিছু আঁকার। সিস্টিন চ্যাপেলের ছাদ কোনো একটা ছবি নয়, সুঠাম জ্যামিতিক নক্সায় সাজানো অনেক ছবির নকসিকাঁথা। ওপরে তাকিয়ে খানিক্ষণ হতভম্ব হয়ে ভাবতে হয় কোনটায় চোখ ও মন ফেলা উচিত। এবং এটাও বোঝা যায় যে যতই দেখি না কেন, বেরিয়ে এসে মনে হবেই আহা এই ছবিটায় তো তেমন তাকানো হল না। সীলিং-এর মাঝের প্যানেলের ছবির সারণির নাম সেন্ট্রাল স্টোরিজ্। বাইবেলের প্রথম টেস্টামেন্টের প্রথম অধ্যায় বুক অফ্ জেনেসিস। জেনেসিসের ন’টা গল্প নিয়ে ছবির সারি—তিনটি ভাগে বিভক্ত তিনটি সূত্রে—ব্রহ্মাণ্ডের উৎপত্তি, মানুষের জন্ম, ও অশুভের আগমন। কিংবদন্তীয় সব দৃশ্য, যা অনেকটাই আমাদের ভাষা ও ভাবনার সাথে একাকার হয়ে আছে, চোখের সামনে দেখে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। ঈশ্বর আলো থেকে আঁধার আলাদা করলেন, তৈরি হল একে একে আকাশের জ্যোতিষ্ক-মণ্ডলী, পৃথিবী বিভক্ত হল জলে আর স্থলে। তারপর দ্য ক্রিয়েশন অফ্ অ্যাডাম,—সদ্যসৃষ্ট মানবপুত্রের প্রাণ প্রতিষ্ঠার মুহূর্ত, অ্যাডাম আর ঈশ্বর তর্জনী বাড়িয়ে দিয়েছেন একে অপরের দিকে, প্রাণ ছুঁয়ে ফেলেছেন—এল মহা জন্মের লগ্ন। জন্মেই অ্যাডাম সুপুরুষ—সুঠাম, দেখলেই বোঝা যায় কেন পরবর্তী ফ্রেস্কোয় তৈরি হয়েই ঈভ বলে উঠবেন—ওগো কিশোর আজি, তোমার দ্বারে পরাণ মম জাগে। অ্যাডামকে তৈরি করছেন যে ঈশ্বর, মাইকেলেঞ্জেলো তাঁকে এঁকেছেন শুভ্র কেশ-শ্নশ্রু-গুম্ফোয় আকীর্ণ পিতা নোহসি। সাদা চল-দাড়ি-গোঁফের এই ঐশ্বরিক ইমেজ বোধহয় বেশ চিরন্তন। এই অনুষঙ্গে দুটো ঘটনার কথা মনে পড়ছে, দুটোই বইতে পড়া।
তপনমোহন চট্টোপাধ্যায় অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৌহিত্র, অন্যান্য বইয়ের সাথে স্মৃতিরঙ্গ নামের এক সরস স্মৃতিচারণের প্রণেতা। স্মৃতিরঙ্গে লিখেছেন, লন্ডনের রাস্তায় একবার হাঁটছেন গভীর রাতে, সঙ্গে দেশ থেকে আগত এক আত্মীয়। উদ্দেশ্য দু’জনে যাবেন রাস্তাধারের জন-এর দোকান থেকে কিছু খাবেন বলে। জন এককালের ঘোড়ার গাড়ির চালক। তারপরে কলের গাড়ি এসে যাওয়াতে গাড়োয়ানি ছেড়ে ফীস্ অ্যান্ড চিপ্স্ এর দোকান দিয়েছে। আইনের ছাত্র তপনমোহন দু কদম এগিয়ে গেলেন, জনকে জানাতে কে আসছেন। হঠাৎ দেখেন জন হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়ল, দুহাত জোড়। সঙ্গী অপ্রস্তুত হয়ে তাড়াতাড়ি সেখানে থেকে সরে গেলেন। কোনোমতে তাঁর নাগাল পেয়ে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে তপনমোহন যখন জন-এর স্টলে ফিরে এলেন—খেতে তো হবে--দেখেন তখনও জন বিহ্বল। বলল, “চ্যাটার্জি, আমার জীবন ধন্য। করুণাময় লর্ড যীজস ক্রাইস্ট দূর থেকে আজ আমাকে দর্শন দিয়ে গেছেন।”
পরের গল্পটি অন্নদাশঙ্কর রায়-এর লেখায় পড়েছি। তাঁর আইসিএস চাকরি জীবনে পূর্ববঙ্গের প্রত্যন্ত গ্রামে গেছেন শাসন কাজে। সেটা তাঁর এক পরিচিত মানুষের এককালে জমিদারি। বহুদিন বাদে জমিদার এসেছেন, বয়সের ভারে ন্যুব্জ। আত্রাই নদীর ধারে, শ’খানেক প্রজা অপেক্ষমান, অনেকেরই মুখে পাকা দাড়ি। এই হয়ত শেষ দেখা জমিদারের সাথে। অন্নদাশঙ্করকে বললেন তাঁর পরিচিত মানুষটি, “জানো, ওরা কি বলছে? পয়গম্বরকে আমরা চোখে দেখতে পাইনি, হুজুরকে দেখলুম।” লন্ডনের জন আর পূর্ববঙ্গের প্রজা দুই বিভিন্ন ধর্মীয় মোটিফ খুঁজে পেয়েছিলেন একই মানুষের ভিতরে। একটু হিন্ট দিয়ে বলতে পারি এই মানুষটির শ্নশ্রু-গুম্ফ বাঙালির খুব পরিচিত--এবং তিনি কার্ল মার্ক্স বা হো চি মিন নন। ফেরা যাক সিস্টিন চ্যাপেলের সেন্ট্রাল স্টোরিজ্-এ।
অ্যাডামের পরে ঈভের সৃষ্টি। দ্য ক্রিয়েশন অফ্ ঈভ ছবিতে ঘুনন্ত অ্যাডামের পাঁজর থেকে উৎপন্ন হচ্ছেন ঈভ্। ব্যাপারটা একটু শভিনিস্টিক তো বটেই। আজকে এমন ছবি বেরোলে ব্লগোস্ফিয়ারে বান বইত। দুই আদিম মানব মানবী তৈরি হয়েই সেই পরের ব্যাপারটায় নেমে পড়লেন। মাইকেলেঞ্জেলো এঁকেছেন দ্য ফল অফ্ ম্যান অ্যান্ড দ্য এক্সপাল্সন ফ্রম প্যারাডাইজ। একই ছবির ডানদিকে নিষিদ্ধ ফল সেবন, এবং বাঁদিকে স্বর্গ থেকে মর্ত্যে নির্বাসন। শুধু একটা ফলের জন্যই কত বড় ফল। ফলের ব্যাপারে চিরকালই সাবধান থাকতে হয়, ফলের আশা শিকল হয়ে জড়িয়ে ধরে জটিল ফাঁদে। অ্যাডাম ও ঈভ না হয় ছিলেন সাবালক, কনসেন্টিং অ্যাডাল্টস; কিন্তু নিরীহ স্নো হোয়াইটও উটকো আপেল খেয়ে বিপাকে পড়েছিলেন সৎ-মা’র কৌটিল্যে, রাজপুত্র না এসে পড়লে আরো বড় বিপদ হত। ছবির সারণিকাহিনি এগিয়ে চলে। আসন্ন বন্যা থেকে বাঁচার প্রস্তুতি শুরু করেন নোওয়া ও তাঁর পরিবার। তারপরের ছবি দ্য গ্রেট ফ্লাড--ভীষণ প্লাবনে সৃষ্টি আর প্রলয়ের মোহনা, যেটুকু সম্বল আঁকড়ে ধরে মানুষের ভাসার চেষ্টা। মাকে জাপটে ধরে শিশু, শক্ত যুবকের পিঠে অশক্ত আত্মীয়। কেউ ডুবে যাচ্ছেন, কেউ কোনোমতে জল থেকে আশ্রয় নিয়েছেন অপেক্ষাকৃত উঁচু জমিতে, কেউ হেলে পড়া গাছের ডাল আঁকড়েছেন। জল কিন্তু আগুয়ান। ছবির প্রত্যেকটি মানুষের মুখে যে শঙ্কা তা হয়ত বড় আধুনিক। এ দৃশ্য আমাদের সামনের দিনেরও নয়ত? শক্তিধর সরকার সমূহ যখন দর কষাকষিতে ব্যস্ত, কিয়োটো বা বালি বা লিমায়, সমুদ্রের জল বাড়ছে আস্তে আস্তে, ইতিমধ্যেই বয়ে যেতে শুরু করেছে প্যাসিফিক সাগরের অসহায় কিছু দ্বীপের উপর দিয়ে। মাইকেলেঞ্জেলোর ছবিতে নোওয়ার নৌকা খানিক শান্ত জলে দাঁড়িয়ে দূরে, ত্রাণের আশা নিয়ে। এ যুগে আমাদের নেওয়ার নৌকা আছে কি? থাকলেও জায়গা পাবে কারা? বন্যার পর আবার জীবন জেগে ওঠে, ছবিতে। কিন্তু সেখানে কি মঙ্গলে সুন্দরে সর্বচরাচর লীন? বোধহয় নয়, সিরিজের শেষ ছবি ড্রাঙ্কেন্নেস অফ্ নোওয়া— প্লাবনোত্তর পৃথিবীতে নোওয়া চাষী হয়েছেন; আঙুর ফলিয়ে সেই আঙুরের মদিরায় বুঁদ নোওয়াকে আবিষ্কার করছেন তাঁরই পুত্ররা। পৃথিবী আবার পূর্ববৎ - বিজনেস অ্যাজ ইউসুয়াল। এই পৃথিবীকে পরিত্রাণের জন্য চাই হয়ত নব পথিকেরে গানে, নূতনের বাণী। সিস্টিন চ্যাপেলে কেটে গেছে আমাদের বেশ খানিকক্ষণ। পেয়াদারা মসৃণ দার্ঢ্যে ভিড় ঠেলে চলেছেন আগমন থেকে নিষ্ক্রমণের দিকে; বেশিক্ষণ দাঁড়ানো দায়। পিছন দিকে মাথা ঘুরিয়ে সামনে হোঁচট খেতে খেতে বেরিয়ে এলাম। মনে হল এই ঘরটার বাতাসেতেও মাইকেলেঞ্জেলো তুলি বুলিয়েছেন।
সমীর সেনগুপ্ত লিখেছেন তাঁর নিকট বন্ধু শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের গাওয়া গান শোনার অভিঘাত—বার বার ফিরে ফিরে গেয়েছে ‘হৃদয়ে তোমার দয়া যেন পাই— হৃদয়ে তোমার দয়া যেন পাই— সংসারে যা দিবে মানিবে তাই, হৃদয়ে তোমার দয়া যেন পাই’— শুনতে শুনতে বুঝতে পারি শক্তি কত বড় বিশ্বাসী ছিল: আমার মতো পাথুরে নাস্তিকের বুকেও জাগিয়ে তুলতে পেরেছিল অমৃতের জন্য আকুতি ... । অসামান্য বাক্য ক’টি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সার্থক শিল্পের সাথে এমন বিরল সাক্ষাতের মুহূর্তে, আস্তিক্য আর নাস্তিক্য অত দূরে থাকে না। বৃহতের সামনে দাঁড়ালে বাঙালির রবীন্দ্রনাথকে মনে পড়ে। অন্তত আমাদের সময় তো তাই হত। সিস্টিন চ্যাপেলের ফ্রেসকো দেখে মনে হয়, বিষয়বিন্যাস ছেড়ে দিয়ে, শুধু রূপবৈচিত্র্যের দিকে তাকালে, যেন সমগ্র গীতবিতানের কথা ও সুর আঁকা হয়েছে তুলিতে। গীতবিতানের সাহিত্যবৈচিত্র্য অনেকটাই আপেক্ষিক। আমাদের মন ও মজ্জায় ঢুকে আছে যে সব বোধি, তার উপর বেশ ভর করে থাকে বিচিত্রের অনুভব, অনেকটাই অজান্তে। নিত্যপ্রিয় ঘোষের রবীন্দ্র-বিষয়ক কড়চা বইতে একটা ঘটনার উল্লেখ আছে। আশি-নব্বই দশকের ময়দান কাঁপানো নাইজেরিয়ান ফুটবলার চিমাকে কলকাতা ভালবেসেছিল। চিমাও বেসেছিলেন ভাল, বাংলাকে। শোনা যেত রবীন্দ্রসঙ্গীত নাকি ওঁর ভীষণ প্রিয়। বাঙালিত্বের স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় ওঁকে এক সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেন, আচ্ছা, আপনার রবীন্দ্রনাথের কোন গানটা সব থেকে ভাল লাগে। চিমা বলেছিলেন, কোনটা মানে? রবীন্দ্রসঙ্গীত কি একটার বেশি আছে নাকি? সিস্টিন চ্যাপেল ও ভ্যাটিকান মিউজিয়ামস্ দেখার আগে রেনেসাঁস আর্ট সম্বন্ধে আমার ধারণাটাও ছিল অনেকটাই চিমার মত, পুরোটাকেই একই ব্যাপার বলে মনে হত। বহু শতকের সাধনা কয়েক ঘন্টায় কিছুই বোঝা যায় না। তবু শুধুই তাকিয়ে থেকে যে আশ্লেষ পেয়েছি, তা আমায় তাড়া করে ফিরেছে রোম থেকে ফেরার পর বেশ কিছুদিন।
সিস্টিন চ্যাপেল থেকে বেরিয়ে নিকটতম শৌচাগারে গেছি, শুনলাম দুজন কৃত্যরত কথা বলছেন, পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। উচ্চারণে মনে হল মার্কিনি—একজন বললেন, সাম্ অফ্ দিস স্টাফ ইজ রিয়েলী ওল্ড। অন্যজন বললেন, ইয়াহ, লুকস লাইক ইট। দুশো বছরে অনেক কিছুই অর্জন করা যায়, কিন্তু ইতিহাস গজাতে আরো সময় নেয়। সিস্টিন চ্যাপেল থেকে বেরিয়ে ঘড়ি দেখে চমকে উঠতে হল; বেলা বয়েছে অনেক, এখনও সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকা বাকি, আজ আর দুপুরে হোটেলে ফেরার জো নেই। তড়িঘড়ি ভ্যাটিকান মিউজিয়াম্স-এর শেষ কয়েকটা গ্যালারিতে চোখ বুলিয়ে বেরোনোর দিকে এগোলাম। বালকের দ্বিপ্রাহরিক ঘুমের সময় হয়েছে অনেক্ষণ, স্থানমাহাত্ম্য বুঝেই বোধহয় বেশি আন্দোলন না করে প্র্যামেই দুমড়ে শুয়ে ঘুমে অচেতন। আমরা মিউজিয়ামের নীচের তলার কাফেতে চটজলদি লাঞ্চ সেরে নিলাম। বেরোনোর পথে মিউজিয়াম প্রাঙ্গণ বেলভেডিয়র কোটইয়ার্ডে সেই বিখ্যাত ভাস্কর্য দেখলাম, স্ফীয়র উইদিন স্ফীয়র। গোলকের ভিতর গোলক--বিংশ শতকের ইটালীয়ন ভাস্কর আরনাল্ডো পোমোডোরোর কীর্তি। ভ্যাটিকান মিউজিয়ামের চত্বরে ছাড়াও এই ভাস্কর্যের বিভিন্ন সংস্করণ আছে, যেমন নিউ ইয়র্কের রাষ্ট্রপুঞ্জের মুখ্য কার্যালয়, তেহেরানের মিউজিয়াম অফ্ কনটেম্পোরারি আর্ট, ইজরায়েলের তেল-অ্যাভিভ ইউনিভার্সিটি ইত্যাদি। বাইরের গোলকের খানিক অংশ ভাঙা, সেখান দিয়ে দেখা যাচ্ছে আরেকটি গোলক, সেটিরও খানিক অংশ ভাঙা। বাইরের এবং ভিতরের গোলকের দুইয়ের মধ্যেই গিয়ারের দাঁতের মতন আভাস, দম দেওয়া ঘড়ির আভ্যন্তরীণ যন্ত্রপাতিরও খানিক আভাস পাওয়া যায় যেন। আমাদের পৃথিবীর জটিলতা ও ভঙ্গুরতার প্রতীক মনে করা হয় এই ভাস্কর্য। খানিক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখতে হয়। ইংরেজি প্রবচন হুইল্স উইদিন হুইল্স, বা চাকার ভিতর চাকা-র এই ত্রৈমাত্রিক ভাবনা বেশ ভাবায়। ভ্যাটিকান মিউজিয়াম থেকে বেরোনোর পথের আরেক বিস্ময় ব্রামান্টে স্টেয়ারকেস। ব্রামান্টের প্রাথমিক নক্সার ভিত্তিতে ১৯৩২ সালে গিউসেপে মোমো এই অভিনব সিঁড়ির ডিজাইন করেন। অভিনবত্ব এইখানেই সে সিঁড়ির আকৃতি ডাবল্ হেলিক্সের মত--যাঁরা উঠছেন এবং যাঁরা নামছেন তাঁরা কখনই মুখোমুখি হচ্ছেন না। ডাবল্ হেলিক্সের ব্যাপারটা আজ ডিএনএ’ এর অনুষঙ্গে স্কুলপাঠ্য বইতেও এসে গেছে; ব্রামান্টের নক্সা কিন্তু ১৫১২ সালের। এই সিঁড়িতে প্রায় মসৃণ, খুবই স্বল্প উচ্চতার ধাপগুলি, চওড়াও। আসল ব্রামান্টে সিঁড়ি আছে নিকটবর্তী পিও-ক্লেমেন্টিন মিউজিয়ামে, সাধারণের প্রবেশের বাইরে। যখন তৈরি হয় সেই আসল সিঁড়ি, একটি উদ্দেশ্য ছিল পোপ দ্বিতীয় জুলিয়াসকে গাড়ি করেই পৌঁছে দেওয়ার, পোপের পোশাকের ভার নিয়ে যাতে সিঁড়ি না ভাঙতে হয়।
ব্রামান্টে সিঁড়ি দিয়ে নেমে ভ্যাটিকান মিউজিয়ামস্-এর বাইরে এসে পাঁচিল ধরে হেঁটে আবার ফিরে চললাম সেন্ট পিটার্স স্কোয়ারের দিকে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল প্রায়, তখনও ভ্যাটিকান মিউজিয়ামস্’এ ঢোকার জন্য আকুল লাইন। পাশেই আবর্জনা ফেলার বীনে উপচে পড়া কোকের ক্যান, কাছের একজন দোকানি ফ্রী বিলোচ্ছেন কোক। পৃথিবীর সর্বত্র তো বিবিধ তৃষ্ণা হরণে এই তরলের জুড়ি নেই। সেন্ট পিটারস্ স্কোয়ারে পৌঁছে দেখি তেরচা রোদ ছেয়ে যাচ্ছে। সকালের রুপো বিকেলের সোনার দিকে এগিয়েছে। চট করে রোদ দেখে নিয়ে আমরা দাঁড়িয়ে পড়লাম সেন্ট পিটারস্ ব্যাসিলিকায় ঢোকার লাইনে। এইখানে প্রবেশ অবাধ, কোনো টিকিট লাগে না, কিন্তু তল্লাশি হয়। এয়ারপোর্টে ঢোকার মত ব্যবস্থা, ধাতব-বোধক তোরণ, পকেট উপুড় করে খোঁজাখুঁজিও। কাউকে কাউকে তো সর্বাঙ্গে থাবড়েও দেখা হল। বালক তখন ঘুমিয়ে চাঙ্গা। এই সব তোরণ পেরোচ্ছি দেখে মনে হল হয়ত আবার প্লেনে চড়ব। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে গম্ভীর রক্ষীদের দিকে টা-টা’র মুদ্রায় বললেন, আই গো রোম। মুখে এক চিলতে হাসি ফুটল রক্ষীদের। বালকের কাছ থেকে তেমন বিপদ নেই ভেবে আমাদের ব্যাগের ডায়পারের প্যাকেট আর সেরেল্যাকের কৌটো তাড়াতাড়ি পাস করিয়ে দিলেন। আমরাও খানিক কম তল্লাশিতে পার পেলাম। তবে এই প্রহরার নিশ্চয় দরকার আছে। যা রক্ষা করা হচ্ছে তা একালের নয়, আমরা শুধু তাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারি ভাবীকালের জন্য। এ যুগে সব থেকে বড় গৌরব তো ধ্বংস। তা না হলে কি আর বামিয়ান বুদ্ধ ভাঙা হয় মিসাইল মেরে; সেই ঐতিহ্য আজও অব্যাহত পালমিরায়। তল্লাশি পেরিয়েও বেশ খানিকক্ষণ চলল লাইন। তারপর ঢুকলাম সেন্ট পিটারস্ ব্যাসিলিকায়।