• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬১ | ডিসেম্বর ২০১৫ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • চিলিকার পাখি : ছন্দা চট্টোপাধ্যায় বিউট্রা

    পুরী যাত্রা তো বাঙালিদের কাছে একেবারেই জলভাত। অল্পবয়সে বন্ধুদের সঙ্গে হৈ চৈ, বিয়ের পর বীচে মধুচন্দ্রিমা ও বুড়ো বয়সে জগন্নাথ মন্দিরে পুজো দেওয়া—এ সবই আমাদের নিত্যকর্ম। তবুও দেখি বেশিরভাগ যাত্রীরা পুরী, ভুবনেশ্বর, কোনার্ক ও বড়জোর দুএকটা গুহা দেখেই ভ্রমণে ইতি দেন। অল্প দূরেই দক্ষিণে এই বিরাট সুন্দর চিলিকা হ্রদ, সেখানে কম লোকই যান।


    "... শ'খানেক ... গডউইট-এর দল সুদূর সাইবেরিয়া থেকে পৌঁছল ..."

    আমিও সবার মতই চিলিকা যাবার আগে পুরীতে এক বাঙালি হোটেলে দু'রাত কাটিয়েছিলাম। হোটেলটির নাম করব না, তবে বেশ মজার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সাধারণত ভারতে আমি যেখানেই বেড়াতে গেছি, সঙ্গে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন কেউ না কেউ গেছেন। এইবার আমি একদম একা বেরিয়ে পড়েছি। প্রথমেই হোটেল ম্যানেজারের কৌতূহল ও সন্দেহের পাল্লায় পড়লাম। শুরু হল যত ব্যক্তিগত প্রশ্ন—যা শুধু ভারতীয়রাই অনায়াসে ও অকুণ্ঠভাবে করতে পারে—আমি একা কেন, বিবাহিত কিনা, স্বামী কোথায়, কেন সঙ্গে আসেনি, ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি হাসিমুখেই জবাব দিচ্ছিলাম কিন্তু শুধু হ্যাঁ, না বলেই একটু দুষ্টুবুদ্ধি নিয়ে ঠিক করলাম কিছু খুলে বলব না। এর ফলে আমাকে নিয়ে হোটেল কর্মচারীদের মধ্যে বেশ গুজব শুরু হয়েছিল। আমার ড্রাইভার পরে বলেছিল যে ওরা ঠিক করতে পারছিল না আমি বাঙালি না অবাঙালি, ভারতবাসী না বিদেশী, বিবাহিত না ডিভোর্সী, আর ঐ যে বাইনকুলার চোখে, ক্যামেরা কাঁধে বেড়াই—পাখি একটা মিথ্যে ছল। আমি নিশ্চয়ই সি আই এ-র গুপ্তচর!


    "... পাখি দেখার সবথেকে ভালো জায়গা মঙ্গলজোড়ী ..."

    তবুও আমি এ-ও স্বীকার করব যে কোথাও কেউ আমার সঙ্গে কোনোরকম অশালীন আচরণ করেনি। আমার আত্মীয়রা অনেকেই ভয় পেয়েছিলেন। আমি কিন্তু শহরে, গ্রামে, বাজারে বা জঙ্গলে, সব জায়গায় বন্ধুত্ব ও সহযোগিতাই পেয়েছি। এই জন্যই ভারতে বেড়ানো আমার এত ভালো লাগে।


    মঙ্গলজোড়ীর প্রধান অফিস

    চিলিকা হ্রদের পুরনো নাম চিল্কা। সমুদ্রের খুব কাছেই এই হ্রদ। জোয়ারের সময় নোনাজল ঢুকে পড়ে। হ্রদটি জাতীয় হাইওয়ে ৫—চেন্নাই থেকে কলকাতার রাস্তার খুব কাছেই। ট্রেনে করেও যাওয়া যায়। তবে পুরী থেকে গাড়িতে যাওয়াই সহজ। খানাখন্দ ও ছোট ছোট গ্রাম পেরিয়ে প্রায় দু'তিন ঘন্টার রাস্তা।


    ব্রাহ্মণী চিল, মাছ খাচ্ছে

    হ্রদটি লম্বায় প্রায় ৪০ মাইল। আয়তনে ১১০০ বর্গ কি. মি.। অনেকগুলি ছোট বড় নদী এতে জল ঢালে। তারপর 'দয়া' বলে একটা সরু নদী দিয়ে হ্রদটা বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে যুক্ত হয়। সারা ভারতে সব থেকে বড় পরিযায়ী পাখিদের সমাবেশ এইখানে। তাই আন্তর্জাতিক সংস্থা এই হ্রদকে Ramsar (জলাভূমি সংরক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থা) এলাকাভুক্ত করেছেন। হ্রদটির চারদিকে অনেক ছোট বড় গ্রাম ও শহর। বেশিরভাগ অধিবাসীরা মাছ ধরার পেশায় যুক্ত। হ্রদে প্রচুর মাছ। জেলেরা সারি সারি বাঁশ পুঁতে তাতে জাল বেঁধে রাখে। মাছেরা সাঁতরাতে গিয়ে আটকে যায়। কাতলা থেকে পুঁটি পর্যন্ত সব সাইজের মাছ আছে। আরও আছে বড় বড় কাঁকড়া এবং পাঁচ ছয় রকমের চিংড়ি মাছ—বড় বড় গলদাচিংড়ি এত সুস্বাদু, বলার নয়।


    নলবনের ভিতর দিয়ে নৌকা করে যাওয়া

    আমি ছিলাম লেকের পূর্ব তীরে সাতপাড়া নামে একটি গ্রামে। লেকের আশেপাশে অনেক হোটেল আছে কিন্তু আমার মতে উড়িষ্যা সরকারের পান্থনিবাস বাংলোগুলো সবথেকে সুন্দর—প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে, খোলামেলা বিরাট ঘর, বারান্দা, চারিধারে বাগান ও হ্রদের দৃশ্য। খরচাও কম ও সঙ্গে উড়িয়াদের হাতে বাঙালি রান্না খুবই মুখরোচক। কাঁকড়ার ঝাল, চিংড়ির মালাইকারি ইত্যাদি দিয়ে গরম ভাত। অথবা সরষে দিয়ে পাবদার ঝোল। থাকা ও খাওয়া দুই-ই আরামের।


    তুষার-ধবল বক

    লম্বা-গলা আনহিংগা

    সাতপাড়ায় থাকার আরেক সুবিধা—নৌকা ভাড়া করে কাছেই ইরাবতী ডলফিনের দেখা পাওয়া যায়। এরা নাকি সংখ্যায় ভীষণ কমে গেছে। শুধু এই জায়গাতেই এখনো টিঁকে আছে। কিন্তু চারধারে এত মোটর বোটের ভিড় ও শব্দে পাখি খুব একটা দেখা যায় না। শুধু সাহসী বক, ঈগল ও পানকৌড়ি ছাড়া। আউটবোর্ড মোটর লাগানো নৌকাগুলির জরাজীর্ণ চেহারা, কিন্তু চলে গুটগুট করে সমুদ্রের মোহনা পর্যন্ত—দু তিন ঘন্টা লাগে। মোহনায় বীচের ওপর চায়ের দোকানও আছে। নৌকায় অবশ্য সাবধানে বসা উচিত—আরশোলায় ভর্তি।


    কালো-লেজওয়ালা 'গডউইট'

    চিলিকা হ্রদে পাখি দেখার সবথেকে ভালো জায়গা মঙ্গলজোড়ী—হ্রদের উত্তর কোণে একটি ছোট্ট গাঁ। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি সবথেকে ভাল সময়। তখন ঝাঁকে ঝাঁকে পরিযায়ী পাখিরা আসে দূরদূরান্ত থেকে। চীন, সাইবেরিয়া, মঙ্গোলিয়া, বৈকাল হ্রদ, ক্যাসপিয়ান সাগর, ইরান এমনকি আফগানিস্তান থেকেও। এই জন্যই চিলিকা ভারতে সর্ববিখ্যাত।


    ধ্যানমগ্ন 'পার্প্‌ল হেরন'

    এত পাখি সত্ত্বেও মঙ্গলজোড়ী একেবারে নির্জন, সুনশান জায়গা। শুধু একটা সাইনবোর্ড আর কয়েকটা ডিঙি নৌকা বাঁধা। ব্যাস! তবে নৌকার মাঝিরা সবাই পক্ষী বিশেষজ্ঞ ও পাখির বই ও বাইনকুলার সবার হাতে। নৌকায় মোটর এঞ্জিন নেই তাই পরিবেশদূষণ কম ও নিঃশব্দে দাঁড় বেয়ে জলচর পাখিদের অনেক কাছে পৌঁছনো যায়—ফোটো তোলার চমৎকার সুযোগ। ঘন নলবনের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় খোলা নৌকার মুখ চোখ বাঁচিয়ে চলতে হয়। আর পাখিই কতরকম। আমি যাবার দুদিন আগেই শ'খানেক গডউইট (Blacktailed godwit)-এর দল


    তিতি (ল্যাপ-উইং)

    ইরাবতী ডলফিন

    সুদূর সাইবেরিয়া থেকে পৌঁছল। তখনও কে কোন জায়গার দখল নেবে তাই নিয়ে জোর কলহ চলছে। পাখিদের সমবেত কলস্বরে কান পাতা দায়। একদল অসম্ভব সরু, গোলাপী ঠ্যাং-ওয়ালা স্টিল্‌ট্‌ (Black Winged Stilt) আর টি-টি পাখিও (Red Wattled Lapwing) ঐ দলে যোগ দিয়েছে। দুধসাদা বকেরা এখানে ওখানে ছড়িয়ে আছে, Great ও Purple heron একমনে মাছ ধরতে ব্যস্ত। সাপের মত লম্বা গলার Anhinga (অন্য নাম 'ডার্টার'- Darter) আর পানকৌড়িরা ডাঙায় বসে ডানা ছড়িয়ে রোদ্দুরে শুকিয়ে নিচ্ছে। ঝাঁক বেঁধে Gap-billed Stork-রা এসে গেল।


    গোলাপী ঠ্যাং-ওয়ালা 'স্টিল্‌ট'

    ফিঙে

    এরা মুখ বন্ধ করলেও চঞ্চুর মধ্যে একটা ফাঁক থেকে যায়। তাতে নাকি শক্ত খোল-ওয়ালা শামুক ধরতে সুবিধা। আরও আছে নীল বিদ্যুৎ ঝিলিকের মত ছোট্ট মাছরাঙা, Gadwall জাতীয় কয়েকটা হাঁস, উজ্জ্বল ডানার Glossy Ibis, লাল টুকটুকে ঠোঁটের নীল Moorhen এবং আরও কত পাখি। চারিদিকে শুধু পাখির কলরব ও ডানার ঝটপটানি। এছাড়া কোন যান্ত্রিক শব্দ নেই। নেই কোনো আধুনিক সভ্যতার আওয়াজ। কাকে রেখে কাকে দেখি! নলবনের মধ্যে সড়সড় শব্দের সঙ্গে পাখির কিচিরমিচির। ময়না জাতীয় Pied Starling, লেজ ঝোলানো ফিঙে (Drongo),


    "এমনই স্বর্গীয় জায়গা—চিলিকা!"

    সাদাকালো মাছরাঙা (Pied Kingfisher), চড়ুই জাতীয় Swamp Sparrow. এখানে ওখানে জেলেদের কাঠের পোঁতায় বসে মাছধরা ঈগল (Osprey) আর উজ্জ্বল রঙের চিল (Brahminy Kite) কেউ মাছ বা ব্যাঙ ধরে ঠুকরোচ্ছে, কিংবা সাপ ধরে সেটা ব্যাগে আনবার চেষ্টা করছে। ডাঙার কাছে অবশ্য মাছের লোভে কাকদের ভীড়, যেমন সারাদেশে দেখা যায়। দুপুরে সবার খাওয়ার দেরী হচ্ছিল বলে থামতে হল, নইলে আমি তো সারাদিন ঐ নৌকায় পাখীদের মধ্যে ভেসে থাকতে পারতাম। এমনই স্বর্গীয় জায়গা—চিলিকা!



    অলংকরণ (Artwork) : ছবিঃ লেখক
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments