• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬১ | ডিসেম্বর ২০১৫ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • করবেট ন্যাশনাল পার্ক : আদিত্য পাল

    ধানগাড়ি গেট ছাড়িয়ে আরো ঘন্টাখানেক পর আমাদের জিপসি এসে দাঁড়াল দুর্গাদেবী গেটের পাশে। চোখের সামনে বিশাল করবেট জাতীয় উদ্যান। আমরা থমকে দাঁড়ালাম। অনুমতিপত্র দেখিয়ে ঢুকে পড়লাম গভীর জঙ্গলে। সঙ্গে সঙ্গে যেন এক অদৃশ্য রহস্যময়তা আমাদের ঘিরে ধরল। শাল গাছে ঢাকা জঙ্গলপথ বেয়ে জিপসিও এগিয়ে গেল আরো ভিতরে। পথ চললাম অরণ্যের নিস্তব্ধতা আর সবুজের সমারোহ দেখতে দেখতে। জঙ্গল কোথাও খুব ঘন; আবার কখনো হালকা। ছোট, বড় অনেক নালা পেরোতে হয়। স্থানীয় ভাষায় নালাকে ‘সোত’ বলে।


    দাঁতাল রাস্তা পেরোচ্ছে
    এভাবে ঘন্টাখানেক যাওয়ার পর কয়েকটা হাতি দেখতে পেলাম। বরাত বেশ ভালোই মনে হল। আমরা গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে বসে রইলাম। প্রথমে তিন-চারটে হাতি, তারপর দুটো দাঁতাল ও কয়েকটা বাচ্চা—বেশ বড়সড় দল। অদ্ভুত ছন্দে ওরা এগিয়ে যায়। বেশ কিছুক্ষণ পর জিপসি আবার চালু করা হ’ল, আর আমরাও ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম। লোহাচর, মাইধাবন, মুণ্ডিয়াপানি, রথুয়াডাব পেরিয়ে জিপসি থামল ভাতন্‌ভাসা গেটের সামনে। ওটা সোনানাদি ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারীর গেট। আরো এক ঘন্টা ভিতরে গেলে ‘হলুদপরাও’ বাংলো আসবে—আমাদের প্রথমদিনের গন্তব্যস্থল।


    সোনানাদি ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারীর গেট

    আকাশ এতই মেঘলা যে মে-মাসের গরম টেরই পাইনি। ভাতনভাসাতে অনুমতিপত্র আবার চেক করিয়ে নিলাম, বনরক্ষীরা গেট খুলে দিল, আমরাও এগিয়ে গেলাম। আধঘন্টা যাওয়ার পর, আমরা যখন হলুদপরাও বাংলোর কাছাকাছি তখন হঠাৎ একটা ‘অ্যালার্ম কল’ শুনতে পেলাম। ভূপিন্দার সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে চাপা গলায় বলল—‘দাদা সম্বর কা কল্‌।’ জঙ্গলের নিয়মে বলে সম্বরের ডাকা ‘অ্যালার্ম কল’ অব্যর্থ হয়। বাঘ দেখতে পেলে একটা তীব্র কাশির মত শব্দই হল অ্যালার্ম কল। সেই কল দিয়ে সবাইকে সাবধান করে দেয়। আমরা চুপ করে বসে আছি আর ভয় চোখে চারদিক দেখছি, হয়ত বিপদ রয়েছে ধারে পাশে। কথা বলছি কেবলমাত্র দরকারে, তাও ফিস্‌ফিস্‌ করে। রোমাঞ্চকরভাবে প্রতিটি মিনিট কাটছে। চারপাশে বিশাল বিশাল গাছ, পাখিদের ঘরে ফেরার কলতান, ঝিঁঝিঁর ডাক, কখনো কখনো শুকনো পাতার ওপর সর্‌ সর্‌ আওয়াজ আর সেই সঙ্গে শালগাছের সারি থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে সন্ধ্যা নামছে—সব মিলিয়ে এক অতিনাটকীয় পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। হঠাৎই আমাদের ড্রাইভার ভূপিন্দারের গলা কানে আসে—‘দাদা আভি চল্‌তে হ্যায়। সম্বিৎ ফেরে, অস্ফুট স্বরে বললাম—‘চলো।’


    হলদুপরাও বনবাংলো

    হলদুপরাও বাংলোতে পৌঁছলাম। বিলাসবহুল বাংলো, পরতে পরতে সাহেবিয়ানার ছাপ, বিরাট বারান্দা, সরু বাঁশের তৈরি আরামকেদারা। আমরা সেই পুরোনো বাংলোতেই ছিলাম। এছাড়া নতুন বাংলো, স্টাফ কোয়ার্টার, রান্নাঘর, অফিস ইত্যাদি নিয়ে পুরো হলদুপরাও বাংলো চত্বর। চারপাশে হাই-ভোল্টেজ সৌর বেড়া বা সোলার ফেন্সিং দেওয়া আছে যাতে হিংস্র প্রাণী ভিতরে না ঢুকতে পারে। পাশে অনেকটা নিচে বয়ে চলেছে পালাইন নদী। দূরে দেখা যায় ল্যান্সডাউন পাহাড় শ্রেণী। ব্যাগপত্র রেখে রান্নার লোক খোঁজ করলাম। এখানে নিজেদের রেসন নিয়ে যেতে হয়, ক্যান্টিন নেই। রান্নার জন্য লোক আছে। সে ডিনারের তোড়জোড় শুরু করে দিল। বৃষ্টি শুরু হয়েছে, তবে যত না বৃষ্টি তার থেকে বেশি বাজ পড়ছে। আমরা স্নান সেরে বারান্দায় এসে চা খেতে খেতে গল্প জুড়লাম। সারাদিনের সফরে চার-পাঁচ জায়গায় হাতি, সম্বর, বার্কিং ডিয়ার, চিতল বা স্পটেড ডিয়ার, বন্যবরাহ (ওয়াইল্ড বোর), মনিটর লিজার্ড দেখেছি। আর পাখি দেখেছি প্রচুর।


    বী-ইটার
    করবেটের জঙ্গলে প্রায় ৫৮০ প্রজাতির পাখি আছে। তাদের মধ্যে দুর্লভ দুধরাজ (Paradise fly-catcher) অনেক দেখেছি। জঙ্গলের চিরকালীন নিয়মে পুরুষ পাখি দারুণ দেখতে হয় মহিলা পাখির থেকে। তার দুধ সাদা রং, পেটের দিকে কালো ও লম্বা ফিতের মত সাদা কালোয় ডোরা কাটা লেজ। দুধরাজ যখন উড়ে যায় তার লম্বা লেজ দুলতে দুলতে যায়। এছাড়া দেখেছি প্রচুর ওয়াগটেইল, ম্যাগপাই, নানান ধরনের মাছরাঙা, ঈগল ইত্যাদি। চারদিকের জমাট বাঁধা অন্ধকারের রহস্যময়তা যেন আরো বেড়ে চলে জঙ্গলের বিচিত্র শব্দে। চোখ বন্ধ করে শব্দগুলো অনুভব করি। মাটি থেকে, চারপাশের গাছ থেকে সোঁদা সোঁদা গন্ধ ওঠে। রোজকার চেনা পরিচিত জগতের থেকে আমূল বিচ্ছিন্ন হয়ে বৃষ্টির আওয়াজ, অরণ্যের ধ্বনি—সব মিলে মিশে গিয়ে সৃজন করে যেন এক অন্য ভুবন।


    কান্ডা থেকে ঢিকালা যাবার পথে

    পরদিন ভোর পাঁচটার মধ্যে আমরা সবাই তৈরি। চা খেয়ে আধঘন্টার মধ্যে বেড়িয়ে পড়ব জঙ্গল ঘুরতে। তারপর ফিরে এসে মালপত্র গুটিয়ে অন্য জায়গায়। আমাদের গাইডও লুঙ্গি ছেড়ে খাকি পোশাক পরে নেয় যাবার জন্য। কিন্তু আকাশের মুখ ভার, গুমোট হয়ে আছে। রওনা তো দিলাম কিন্তু দশ মিনিটের মধ্যেই বৃষ্টি নামল। ব্যাস্‌ মাথায় উঠল জঙ্গল সাফারি। খোলা জিপসি, ঢাকতে হ’ল হুড দিয়ে। অগত্যা গাড়ি ঘুরিয়ে বাংলো। মনমরা হয়ে বারান্দায় বসে বসে জঙ্গলকে স্নাত হতে দেখি। পাতার ওপর বৃষ্টির শব্দ যেন কোনো এক দক্ষ শিল্পীর তালবাদ্যের অপূর্ব ধ্বনিমাধুর্যে ভরে উঠল। ঝমঝমিয়ে যখন বৃষ্টি নামল, তখন চারদিক আবছা হয়ে এল। এরই মধ্যে আমরা জোরালো প্রাতরাশ সেরে গোছগাছ করে নিলাম, একেবারে বেরিয়ে পড়ব বলে। ভূপিন্দার বলল—‘দাদা আপকো কান্ডা দিখাকে ফির ঢিকালা নিকলেঙ্গে’। মনে বেশ উত্তেজনা হয়—এটাই কি জিম করবেটের সেই প্রিয় জায়গা 'কান্ডা'? তাঁর একটা কাহিনিও তো আছে—‘দ্য কান্ডা ম্যানইটার’! আরো একটা নতুন জায়গা দেখা হবে; খুব আনন্দ হ’ল। কিন্তু যা মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে তাতে ওই শটকার্ট রুট ধরে কান্ডা যাবো কি করে? আমাদের চলে আসতে হ’ল ভাতন্‌ভাসা গেট। কিন্তু ভয়ানক দুর্যোগ দেখা দিল। গাড়ি ঠিকমত চালানো যাচ্ছে না। দেখলাম, ভূপিন্দারের বয়স কম হ’লে কি হবে অভিজ্ঞ চালকের মতই সতর্ক হাতে গাড়ি চালাতে জানে। বহু কসরত করে রত্থুয়াভাব ছাড়িয়ে আমরা পৌঁছলাম এমন একটা জায়গায় যেখান থেকে ডানহাতে একটা রাস্তা উঠে যাচ্ছে কান্ডার দিকে। আর মাত্র কিলোমিটার ছয়েক গেলেই পৌঁছানো যাবে করবেট জাতীয় উদ্যানের উচ্চতম জায়গায়। করবেট পার্কের উত্তর দিকে ঢিকালো রেঞ্জে অবস্থিত কান্ডা—১১০০ মিটার বা ৩৫০০ ফিট উঁচু। গাছপালা, আবহাওয়ার ধরনটা হিমালয়েরই মতন। তাই কান্ডার জঙ্গলে হিমালয়ান ব্ল্যাক বিয়ার, লেপার্ড ও প্রচুর পাখি দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ঝিরঝিরে বৃষ্টি আর প্রবল ঝোড়ো হাওয়া সঙ্গে নিয়ে আমরা কান্ডার বনবাংলো চত্বরে ঢুকলাম। ত্রিসীমানায় কিছু নেই। ওই ঠাণ্ডা ঝোড়ো হাওয়া আমাদের দাঁতকপাটি খটখটিয়ে দিল। বৃষ্টিতে চারদিক আবছা হয়ে গেলেও সেখান থেকে দেখতে পেলাম বিশাল বিস্তৃত রামগঙ্গা উপত্যকা অঞ্চলটি।


    খিননৌলি থেকে ঢিকালার পথে
    ওখানে আরো কিছুটা সময় কাটিয়ে আমরা রওনা দিলাম ঢিকালার পথে। আরো ২১ কিমি দূর। চলতে চলতে মনে পড়ে যায়—কোলকাতা থেকে ট্রেনে মোরাদাবাদ এসে তারপর বাসে করে পৌঁছেছিলাম রামনগর। রামনগর উত্তরাঞ্চলের নৈনিতাল জেলায়। ওখান থেকে জিম করবেট জাতীয় উদ্যানে থাকার যাবতীয় অনুমতিপত্র বানিয়ে নিয়েছিলাম। তারপর পাঁচদিনের জন্য জিপসি ঠিক করে যাত্রা করেছিলাম করবেট-এর স্মৃতি মাখা জঙ্গলে। তবে করবেট স্বয়ং কিন্তু এই জঙ্গলে বেশি বিচরণ করেননি। ১৯৩৬ সালে হেইলি সাহেবের নামে এই পার্কের নাম হয় হেইলি'স পার্ক। পরে ১৯৫২ সালে জিম করবেট-এর সম্মানে এই জাতীয় উদ্যানের নাম হয় করবেট ন্যাশনাল পার্ক। ভারতের এই প্রথম জাতীয় উদ্যানের আয়তন প্রায় ১৩১৮.৫৪ বর্গ কিমি; তার মধ্যে কোর এরিয়া হ’ল ৫২০.৮২ বর্গ কিমি আর বাফার জোন হ’ল ৭৯৭.৭২ বর্গ কিমি। জিম করবেট নামটি শুনলেই শ্রদ্ধায় আমাদের মাথা নুইয়ে আসে, ভারতবর্ষে বনসংরক্ষণ ও প্রাণী সংরক্ষণের সঠিক ধারণা ও প্রয়োজনীয়তা তিনিই বুঝিয়ে দেন। শুধু বুঝিয়ে দিয়েই তাঁর কাজ শেষ নয়, তিনি বন্যভূমি ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কিভাবে বা কি আদর্শে করতে হয় সেটাও দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। করবেটের আরো কত কীর্তি-কাহিনি মনে ভিড় করে আসে। উৎরাই পথ বেয়ে আমাদের জিপসি মন্থর গতিতে এগিয়ে চলে ঢিকালার দিকে।


    সম্বর

    শালগাছের পাতাগুলো শুকিয়ে গিয়ে লালচে রং ধরেছে। আর রাস্তার দুই পাশ সেই ঝরে পড়া শালপাতার লাল রং-এ রঙিন হয়ে গেছে। দারুণ লাগছিল সেই দৃশ্য। তাই বৃষ্টির মধ্যেই জিপসির হুডটাকে কোনোমতে হাত দিয়ে উঁচু করে ধরে রেখেছিলাম যাতে কিছুটা দেখা যায়। হঠাৎই চোখে পড়ল বেশ বড় চেহারার একটা সম্বর—বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতেই মনের আনন্দে পা উঁচু করে গাছের পাতা খাচ্ছে। আমরা সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি। সম্বরও একটু চমকে তাকিয়ে নিল, তারপর তাচ্ছিল্যভরে আবার খেতে লাগল। সাধ মিটিয়ে ছবি তুলে রাখি। আবার এগোতে থাকি, চারপাশের কত শোভা—সেখানেই থেমে যাওয়ার জন্য লোভ দেখায়, কিন্তু ক্যামেরাবন্দী করে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় কি!


    ‘খিননৌলি’র চর
    এক জায়গায় রামগঙ্গার শাখানদী গুলো পেরোতে পেরোতে ‘খিননৌলি’র চর দেখতে পেলাম। ঘাসজমিকে ওখানে চর বলা হয়। ওই চরের মধ্যেই কিছুটা জায়গা জুড়ে বনবাংলো। আমরা বাংলো চত্বরে নামলাম। খিননৌলির বনবাংলো (১৯৭৪-সালে নির্মিত) একেবারেই ভি.আই.পি.-দের জন্য। শুনি, খিনখৌলির মত চরেই নাকি জঙ্গলের সব রহস্য লুকিয়ে থাকে, বাঘ বা জঙ্গলের অন্য জন্তু দেখার আদর্শ জায়গা। আমি ভাবতে থাকি—আমরা কি বাঘ দেখতে পাবো? জঙ্গলে বাঘ দেখাকে ওরা টাইগার সাইটিং বলে থাকে। ওদের মত আমরাও শিখে নিয়ে কথা বলতে থাকি। খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার চলতে লাগলাম ঢিকালার দিকে। শালের ফাঁক দিয়ে ছুটে গেছে ঢিকালার রাস্তা।


    ঢিকালার চর

    করবেট টাইগার রিজার্ভের প্রধান রামগঙ্গার বাঁধ, পাতলি দুন, ফুলিয়ার চর আর ঢিকালার চর। করবেট জাতীয় উদ্যান আসলে তরাই—ভাবর অঞ্চল। ফলে প্রচুর চর বা ঘাসজমি দেখতে পাওয়া যায়। আর ঢিকালার চরকে সামনে রেখেই বনবাংলো চত্বর গড়ে উঠেছে। প্রচুর থাকার জায়গা, বিভিন্ন প্রকারের ফরেষ্ট রেস্ট হাউস— পুরোনো, নতুন, লগ-হাট, ডর্মিটারি ইত্যাদি। এছাড়াও লাইব্রেরি, অ্যাম্ফিথিয়েটার, ক্যান্টিন, অফিস, স্টাফ কোয়ার্টার—রীতিমত একটা জঙ্গল শহর। ঢিকালা ছাড়াও গৈরাল ও বিজরানিতে ক্যান্টিন আছে। ফলে এসব জায়গায় খাবারদাবার, রেশন নিয়ে যাওয়ার কোনো দরকার নেই। হাটমেন্ট বাংলোতে আমাদের দুটো ঘরে বুকিং দিয়েছিল। দু রাত থাকব ওখানে। মালপত্র ঢুকিয়ে দিয়ে বারান্দার চেয়ারে আরাম করে বসলাম। সারাদিন খুবই ধকল গেছে। বাইরে মেঘের পরে মেঘ সেজে রয়েছে আকাশ, মাঝেমধ্যে ঝির-ঝির বৃষ্টি, সামনে আবছা হয়ে যাওয়া বিস্তীর্ণ ঢিকালার চর, রামগঙ্গা নদী—সব মিলিয়ে আমাদের একটা ভীষণ ভালো লাগা তৈরি হয়ে গেল। বারান্দায় বসে বসেই নানান দৃশ্যপট চোখে পড়ে। ঘুঘু পাখিদের বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে খুঁটে খাওয়ার অক্লান্ত প্রয়াস, মা-হনুমান তার শিশুকে মাতৃত্বের পরম স্নেহে আগলে রাখছে বৃষ্টি থেকে, দূরের ঘাসজমিতে কি যেন নড়ছে—দূরবীন চোখে দিয়ে দেখি কি আছে। সময় কেটে যেতে লাগল নীরবেই। তবে বৃষ্টির জন্য বিকেলবেলায় জঙ্গল সাফারিতে বেরোতে পারব কিনা বুঝতে পারছি না। প্রায় চারটের সময় বৃষ্টি থামল। রেডি হয়ে নিলাম, তারপর ভূপিন্দারকে খোঁজ করে গাড়ির কাছে গেলাম। নিয়ম অনুযায়ী প্রতি জঙ্গল সাফারিতে সঙ্গে গাইড নিতে হবে—তাই আমাদেরও গাইড ঠিক করা হ’ল। ছেলেটার নাম যোশী। আমরা বেরিয়ে পড়লাম বিকেলের সাফারিতে। ইতিমধ্যে তো রোদ্দুর বেরিয়ে পড়েছে, গাছের পাতার ওপর রোদ ঝিকমিক করছে, আলোছায়ার মধ্যে দিয়ে আমরা একটা ফাঁকা জায়গায় গিয়ে পড়লাম। অনেকগুলো গাড়ি সার দিয়ে দাঁড়িয়ে। কাছেই একটা বিশাল দাঁতাল হাতি দেখা দিল। অদ্ভুত দুলকি ছন্দে এগিয়ে আসছে। আমাদের দিকে দৃকপাত না করেই সে ধীরে ধীরে চলে গেল।


    হাতির পাল
    তারপর আমরাও রামগঙ্গা রিজার্ভয়ারের দিকে ছুটে চললাম। কিছুদূর যাওয়ার পর ধু-ধু সবুজ তৃণভূমি চোখে পড়ল। আরে ওগুলো কি? এ তো প্রচুর হাতি। প্রায় শ’খানেক হবে। পশ্চিমী সূর্যের প্রখর আলোয় তৃণভূমির সবুজ রংটা যেন জ্বলজ্বল করছে—আর তারই মাঝে হাতির পাল এগিয়ে চলেছে। বিস্মিত হয়ে আমরা দাঁড়িয়ে পড়ি। দূরবীন চোখে, ক্যামেরার লেন্সে চোখ রেখে, কখনো বা খালি চোখেই দেখতে লাগলাম ওদের কাণ্ডকারখানা। শিশু, মা, দাঁতাল হাতি—সবাই আছে সেই দলে, চলেছে মহানন্দে। শিশু-হাতিদের, মানুষের মতই, আগলে আগলে নিয়ে চলেছে বড়রা, দলের পাণ্ডারা। কি অপূর্ব তার ছন্দ! আমরাও যেন নির্বাকভাবে ওদের দুলকি ছন্দে দুলতে দুলতে ভেসে চলে যাই গহনে, আরো ঘন অরণ্যে। সেই হাতির পাল থেকে একটু দূরেই চিতলের ঝাঁক। খালি চোখেই ঘাসের ফাঁকে ওদের নড়াচড়া দেখতে পাচ্ছি। চোখে দূরবীন দিই—কি অপূর্ব দৃশ্য!

    চিতল হরিণ
    জঙ্গলের শোভা বাড়ানোর জন্যেই বোধহয় প্রকৃতি এই চিতল সৃষ্টি করেছে। প্রকৃতি যেন প্রাণ ঢেলে সাজিয়ে দিয়েছে বাদামী রঙের ওপর সাদা ফুট ফুট দাগ দিয়ে। আরে, ওদের পাশে তো আরো এক দল দেখছি। গাইড যোশী ঠাহর করে বলল, ওগুলো হগ্ ডিয়ার। অনেকটা সময় কাটালাম, এবার গাড়ি নিয়ে এগিয়ে চললাম রামগঙ্গা রিজার্ভয়ার-এর দিকে। দারুণ সুন্দর জায়গা। কিছুক্ষণ দাঁড়াই ওখানে। সামনে হরিণের ছোট একটা দল। হরিণের চকিতে পালানো, কখনো বা থমকে দাঁড়ানো এক অনুপম শোভা বিস্তার করে। যোশী আলতো স্বরে বলে চলে ঢিকালার নানান গল্প। তারপর ওখান থেকে শের্‌ভোজী (স্থানীয় নাম) বলে একটা জায়গায় চলে গেলাম। ওখানে বাঘ দেখার খুব সুযোগ আছে, আর সন্ধ্যার মুখে বাঘ জল খেতে আসে নদীতে। কিন্তু ভাগ্য অতটা সুপ্রসন্ন ছিল না ফলে আমরা বাঘ দেখতে পেলাম না। ফিরে এলাম ঢিকালো বাংলো চত্বরে। যে যেখানেই থাক তাকে ফিরতে হবে সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে।

    ঢিকালার হাটমেন্ট বাংলো

    পরদিন ভোরে লেগে গেল গাড়ির মেলা। লাইন দিয়ে গাড়ি বেরোতে লাগল সাফারিতে। শুরুতেই একটা অ্যালার্ম কল শুনে সব কটা গাড়ি দৌড়ালো একটা ওয়াচ্ টাওয়ারের কাছে। উঠে পড়লাম একদম ওপরে। ঢিকালার চরটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, অন্যদিকটাও দেখা যাচ্ছে। কিছুই চোখে পড়ল না। আগের দিনের মত যোশীই আমাদের গাইড। ওয়াচ টাওয়ার থেকে নেমে গাড়ি নিয়ে চলল সম্বর রোডের দিকে। ওদের ওখানে সব জায়গারই একটা স্থানীয় নাম আছে। সম্বর রোডে পৌছে, গাড়ি চলল ধীরে ধীরে। বাঁ পাশে ‘খব্রি নালা’ চলেছে আমাদের সাথে সাথে।


    কি রাজকীয় তার হাঁটার ভঙ্গী!!
    তখন সকাল ৬-১৫, হঠাৎই যোশী অস্ফুট স্বরে বলে উঠল—‘টাইগার স্পট’ করেছে। আমরা সবাই হতবাক। বাঘটা ঝোপের পাশ থেকে বেরিয়ে এল রাজার মত। ধীরে ধীরে এগিয়ে নালায় এসে দাঁড়াল। আমরা বেশ খানিকটা দূরে আছি, তাও আমাদের দেখল তাচ্ছিল্যভাবে, তারপর জল খেতে শুরু করল। এবার নালা পেরিয়ে পাশের ঝোপে ঢুকে গেল। কি রাজকীয় তার হাঁটার ভঙ্গী। আমরা সেখানেই চুপ করে অপেক্ষা করে বসে থাকি কখন সে বেরোবে ঝোপ থেকে। কারণ আমরা যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি ওটা পেরিয়েই বাঘটা ফের জঙ্গলে ঢুকবে। প্রায় মিনিট দশেক পর আমাদের চমকে দিয়ে গাড়ির থেকে ২০০ মিটার পিছন থেকে বাঘটা বেরিয়ে এল। বিশাল দেহের পুরুষ বাঘটা তারপর রাস্তা পেরিয়ে জঙ্গলে ঢুকে গেল। পনেরো বিশ মিনিট সময় ধরে আমরা ঘুরপথে চললাম, যাতে আবার বাঘটাকে দেখতে পাওয়া যায়। ভূপিন্দার চষে ফেলল জায়গাটা, তারপর একটা সম্ভাব্য জায়গায় চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম, কিন্তু বাঘের দেখা আর মিলল না। তবে এক জায়গায় টাটকা পায়ের ছাপ দেখলাম। যোশী বলল ওই বাঘটাই পেরিয়ে গেছে। সেদিন অন্য কোনো ট্যুরিস্টদের সাইটিং হয়নি। আমরাই সেদিন একমাত্র ভাগ্যবান যারা বাঘ দেখতে পেয়েছে। সেদিন বিকেলেও সাফারিতে বেরোলাম কিন্তু টাইগার সাইটিং আর হ’ল না। বাঘ দেখার দৌড়াদৌড়ির মধ্যে একটা কথা মনে হ’ল। জঙ্গলভ্রমণে বাঘের রাজকীয় উপস্থিতির উত্তেজনায় অনেক সময় অন্যান্য বন্যপ্রাণী আমাদের নজর এড়িয়ে যায়। আর দুদণ্ড দাঁড়িয়ে আদিম আরণ্যক নিবিড়তাকেও অনুভব করা যায়।

    সম্বর

    পরদিন সকালে আমরা টিকিট কেটে নিয়ে হাতিতে চড়ে ঘন্টা দুয়েক সময় দুলকি চালে ভ্রমণ করলাম। অবলীলায় চারজন এবং মাহুতকে নিয়ে চলল হাতি। ওর পিঠে বসে ওরই খাওয়া লক্ষ্য করছিলাম। শুঁড় দিয়ে চরের মধ্যে বড় বড় এলিফ্যান্টা ঘাস মাটি শুদ্ধ উপড়ে নিচ্ছে তারপর সেই ঘাসগুলো নিজের পায়ে ঝাপটা মেরে মেরে মাটি ছাড়িয়ে নিয়ে তবে মুখে তুলছে। নিপুণ পদ্ধতিতে এভাবে ঘাস খেয়েই চলল। জল খাওয়াও দেখবার মত। নদী-নালার জল প্রথমেই শুঁড়ে না নিয়ে আগে কিছুটা জল সরিয়ে সরিয়ে নিয়ে পরিষ্কার করে তারপর জল খেল। ঠিক আমরা যেমন হাত দিয়ে পুকুরের জল সরিয়ে নিয়ে তারপর ডুব দিই। এলিফ্যান্ট রাইড করে এসে আমরা মালপত্র গুছিয়ে নিলাম।


    গৈরাল যাওয়ার রাস্তায় বিশাল একটা মদ্দা হাতি
    তারপর সইসাবুদ সেরে বেরিয়ে পড়লাম ঢিকালা ছেড়ে। পথে গৈরাল যাওয়ার রাস্তায় বিশাল একটা মদ্দা হাতি দেখলাম। সে রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে রইল, কিছুতেই সরলো না। ফলে আমাদেরই গাড়ি পিছনে নিয়ে ফিরতে হ’ল। আর গৈরাল বেড়িয়ে আসা হ’ল না। তবে ওখানে একটা ‘ক্রোকোডাইল পয়েন্ট’ আছে। সেখানে ঘড়িয়াল দেখব বলে গেলাম। একটাই নাকি ঘড়িয়াল দেখতে পাওয়া যায়, কিন্তু দেখবার জায়গাটা এত উঁচুতে যে নিচে নদীর মধ্যে ঘড়িয়ালটাকে ভালো মত ঠাহর করা যায় না। আমাদের ভাগ্য ভালো যে আমরা সহজেই দেখতে পেলাম। তারপর আবার ভালো করে দেখার সুযোগ এসে গেল যখন সে ডাঙায় উঠল। ক্যামেরায় বন্দী করে রাখলাম যতটা পারা যায়। ফিরে চললাম ঢিকালা রেঞ্জের বাইরে। যাওয়ার পথে সর্পদুলির বনবাংলো চত্বর ঘুরে এলাম। আসলে ঢিকালা থাকলে সর্পদুলিতে থাকার আর দরকার হয় না। ওই অঞ্চলটায় অনেক পাখি দেখা যায়। ওখানে দেবেন্দ্র বলে যে ছেলেটা গাইড হয়, তার সাহায্যে অনেক পাখি চিনলাম। বিভিন্ন প্রজাতির ঈগল, পেঁচা, ম্যাগপাই ইত্যাদি দেখলাম।

    লাপউইং পাখি

    তারপর আমরা ধানগাড়ি গেটে চলে এলাম। ঢিকালা রেঞ্জের মূল প্রবেশদ্বার এই ধানগাড়ি গেট। চা পানের ছোট্ট বিরতি নিয়ে আমরা ছুটে চললাম রামনগরের দিকে। ওখানে রামনগর থেকে ২ কিমি আগে আমডাণ্ডা গেট। আমরা ওই গেটে অনুমতিপত্র দেখিয়ে ঢুকে পড়লাম বিজরানি রেঞ্জে। অল্প পথ পেরিয়েই বিজরানি পৌঁছে গেলাম। পুরো রাস্তাটা প্রচণ্ড শুকনো, খাঁ খাঁ করছে আর তীব্র রোদের তাপ ঝলসে দিচ্ছে আমাদের। ঢিকালা অঞ্চলটা অত শুকনো জঙ্গল নয় ফলে আমাদের গরম লাগেনি বললেই চলে।


    বিজরানি বাংলো
    বিজরানিতে খাওয়ার জন্য ক্যান্টিন আছে। সেখানেই দুপুরের খাওয়া সেরে নিলাম। এরপর আমরা যাব মালানি। বিজরানি রেঞ্জের শেষ প্রান্তে মালানি বনবাংলো। ঘন্টা দেড়েক সময় লাগল। প্রচণ্ড লু বইছে, আমরা শুধু চোখ দুটো খোলা রেখে মাথা, মুখ, নাক, কান সব ঢেকে ফেললাম কাপড় দিয়ে। ওইরকম ধু-ধু করা রুক্ষতা থেকে এসে এত সবুজ দেখে মনটা জুড়িয়ে গেল। অবশ্য ওখানেও লু বইছে। মালানির পিছনেই দেখা যাচ্ছে রহস্যে মোড়া করবেট জাতীয় উদ্যানের ‘কোর জোন’। তবে ওদিকটায় ট্যুরিস্টদের যাওয়ার কোনো অনুমতি নেই। বাংলোতে দুটো মাত্র ঘর। আমরা মালপত্র ঘরে ঢুকিয়ে ফ্রুট জুস্‌ খেয়ে শরীরটাকে ঠাণ্ডা করে নিলাম। তারপর বারান্দার চেয়ারে গা এলিয়ে কিছুটা বিশ্রাম। বিকেলের পর সাফারিতে বেরোলাম। ঘুরতে লাগলাম চারিদিক। এটা খুব আদর্শ জায়গা বাঘ দেখার জন্য। সেই বিজরানি বাংলো অবধি গেলাম।

    বন্য বরাহ
    পথে যেতে যেতে চিতল, বার্কিং ডিয়ার, সম্বর, বন্যবরাহ ও ময়ূর দেখলাম। ময়ূরের সৌন্দর্যে আমরা বিস্মিত হই কিন্তু এত সুন্দর, এত রঙিন, এত বাহারে পাখির ডাক যে ওইরকম কর্কশ হ’তে পারে তা না শুনলে বিশ্বাস হবে না। সন্ধেবেলায় ৭-টা নাগাদ ফিরলাম বাংলোতে, তখন আবহাওয়া অনেক ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে। আমরা হাতমুখ ধুয়ে ছোট্ট বারান্দায় এসে বসলাম। ধরম সিং, আমাদের গাইড ফিরে এসে রান্না শুরু করে দিল। সন্ধ্যার অন্ধকারে ‘নাইট জার’ পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। আনমনা থাকলে ওই ডাককে ‘কল’ বলে ভুল হতে পারে। আরো কত যে আওয়াজ পাচ্ছিলাম তা বলার নয়। অন্ধকারের নিস্তব্ধ জঙ্গল থেকে ওঠা বিভিন্ন আওয়াজ, বন্যপ্রাণীর ডাক শোনা এক আলাদা অভিজ্ঞতা। চার পাঁচদিনের বিভিন্ন দৃশ্যের কোলাজে মনটা ভরে রয়েছে।

    মালানি বনবাংলো
    সবার থেকে আলাদা করে অন্ধকার কোণে একলা চুপ করে বসে থাকি আমি, যতক্ষণ না খাওয়ার ডাক এলো। মালানি জায়গাটা ভীষণ ভালো লেগে গেছে আমাদের।

    পরদিন সকালবেলা ঘুরে এলাম ‘নাকা তাল’—ছোট একটা জলাশয়ে। অন্যান্য অনেক জঙ্গলের মত করবেট পার্কেও প্রচুর উইঢিপি দেখলাম। এক একটা বিমূর্ত বিভঙ্গ সৃষ্টি করেছে প্রকৃতি। মানুষের দল বা পরিবারের আদলে তাদের বিভিন্ন আকৃতি যেন মনে করিয়ে দেয় রামকিঙ্কর বেইজ-এর সৃষ্টি, কখনো বা সোমনাথ হোড়ের ভাস্কর্যকে।


    উইঢিপি -- যেন রামকিঙ্কর বেইজ-এর সৃষ্টি!
    মনের ভাণ্ডার পূর্ণ করে আমরা অবশেষে ফিরে চললাম রামনগরের দিকে। ওখানে পৌঁছে গাড়ির টাকাপয়সা মিটিয়ে মোরাদাবাদের গাড়ি ধরলাম। সেদিনই দুপুরে তিনটে নাগাদ ট্রেন। এত গরম যে কিছুই খেতে ইচ্ছা করছে না কারুরই। বনানীর স্নিগ্ধতা থেকে এসেই শহরের এই অসহ্য উত্তাপ আমাদের নাজেহাল করে দিল। মোরাদাবাদ থেকে যথাসময়ে পরদিন চেনা শহর কোলকাতা। ফিরে এলাম বহু বিচিত্র শব্দ সম্ভার ও অনুপম দৃশ্যের অমূল্য সম্পদ নিয়ে। কত জানা-অজানা পাখির কাকলি—সুন্দর হরিণের চকিত গতি—হাতির পাল—বনের রাজা বাঘ—জঙ্গলের রহস্যময়তার আস্বাদ—সঙ্গী হয়ে রইল। ভ্রমণ শেষ হ’ল বটে; কিন্তু গহন অরণ্যের ডাকে আবারও যাত্রা করার ইচ্ছা মনে আরো প্রবল হয়ে রইল।





    অলংকরণ (Artwork) : ছবিঃ লেখক
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments