এ যে দৃশ্য, দেখি অন্যবস্টন শহর এখন অনেকটা এই ছবিকেই প্রতিদিন নতুন করে ক্যানভাস করে তুলছে। গ্রীষ্মের তীব্র সবুজ, তারপরেই ফল কালারের হাজারও রঙ এবং সবশেষে শীতের প্রাদুর্ভাবে বস্টন নিজেই এখন ভিন্ন রূপের ছবি। সেপ্টেম্বর থেকেই প্রকৃতির রূপবদল বস্টনের মানচিত্রকে পুরোপুরিই বদলে দিয়েছে বলা যায়। ফোনের স্ক্রিনে ভেসে ওঠা ওয়েদার ফোরকাস্ট-এ চোখ রাখলেই মাইনাসে চলে যাওয়া শীতের আবাহন দেখে ভূত দেখার মতই বিস্মিত হয়েছিলাম! দুপুর ২টো বাজলেই যেন যবনিকা পতন। চারদিক কেমন বিষন্ন, মরা গাছগুলোর ডালপালায় ঝুপ করে নেমে পড়ছে কুয়াশা কুয়াশা অন্ধকার। কতো রকমের আয়োজন শীতের, মাইনাসের তীব্রতা অনুযায়ী জ্যাকেট, বরফের জুতো, হাত মোজা, টুপি ইত্যাদিতে এখানে শীতকাল নেমে আসে যেন রাজার বেশে। প্রথম বিশ্বের দেশ বলে কথা! এখানকার “উইন্টার” বা হিমেল দিন রাজার মত হবে এটাই স্বাভাবিক।
এ যে বন্য, হে অরণ্য
হেথা দিনেতে অন্ধকার
হেথা নিঝ্ঝুম চারিধার ...
এসব ভেবেই জানলার পর্দা সরাই। দেখি, রাস্তা ঢেকে আছে বরফে, কেমন যেন আকাশটা মেঘগুলোকে বুকে চেপে ধরে আছে। আচ্ছা, আকাশেরও কষ্ট থাকে? মেঘ চরিত্র হয়ে উঠেছিল কোনো কবির কল্পনায় কি এভাবেই? জানি না। আপাতত সান্তুর-এ মন ভাসিয়ে রেখেছি। বরফ পড়ছে একটানা, আর আমি ভিজছি আমার সেই চেনা জীবনের স্মৃতির ফ্লারিশে। শীত মানেই তো আমার চোখে ভাসে সাদা রঙের এক পাতলা চাদর, যা আমাদের সেই উঠোন জুড়ে ভেসে থাকতো। ভেজা ভেজা একটা গন্ধ চারদিকে। সেই ঘুম না ভাঙতে চাওয়া, ঘুম নিয়ে স্কুল বাসে উঠে যাওয়া! এখন কতো রাত কাটে ঘুম ছাড়াই। সেই শীত আর কাঁপুনি প্রবাসে নতুন কোনো মানে তৈরি করুক কিংবা না করুক, আমার মনে মনে তো শীত মানেই শান্তিপিসির ছাদ থেকে সদ্য নামানো লেপের উত্তাপ, এর বিকল্প নেই। শীত পড়ে যাওয়া মানেই তো, মটরশুঁটি দিয়ে বাঁধাকপি আর ফুলকপির নরম গন্ধ। কখনো গ্রামের বাড়ি বেড়াতে চলে যাওয়া। প্রবাসের শীতের সঙ্গে আমাদের গ্রামের “রাস্টিক” শীতের বড্ড বেশি তফাৎ!! কিন্তু প্রবাসে আছি বলেই হয়ত পার্থক্যটা এভাবে বুঝতে পারি। প্রবাসে শীতকাল নানা অনুষঙ্গে ভরা। এখানে শীতকালের সঙ্গে জুড়ে আছে বরফের বিষয়টি। কখনো নিরেট, কখনো চিনির মত, কখনো বা পাথরের মতো এই বরফ মনের জমিনকে আর্দ্র করে রাখে। শীতের সঙ্গে নিঃসঙ্গ মনের সম্পর্ক পারস্পরিক বলেই হয়ত অনুভূতিগুলোও খুব তাড়াতাড়ি তত্পর হয়ে যায়। বাফারিং ছাড়াই অতীত ও বর্তমানে অনায়াসে ঘুরে আসি সামান্য শীতকালের আতিশয্যে। ভ্রমণে ক্লান্ত এই পৈত্রিক প্রাণ, পাহাড় পর্বত, জঙ্গল, সমুদ্র ঠেঙিয়ে পৌঁছে যাই নদীনালার দেশে। আমাদের শীতকালের সেই গাঁয়ে।
চোখ মেললেই দেখতে পাচ্ছি, ভোর হচ্ছে আমাদের ঠাকুরবাড়িতে। এই শীতেও দিব্যি তেল মেখে স্নান করছেন আমাদের কুলদেবতা কেশব রায়। তাঁর হাতের বাঁশি, পায়ের নূপুর, আর চন্দনে সেজে ওঠা সেই মূর্তি পুরোহিতের মন্ত্রে, আবাহনে অদ্ভুত এক ঘোর তৈরি করেছে। আমাদের মণ্ডপঘর, আর কেশব রায়ের ঠাকু্রদালানে ধূপের গন্ধভরা সেই সকাল আর কোনোদিন পাওয়া যাবে কিনা কে জানে! হয়ত যাবে না। রবিকাকা বেরোচ্ছে, গোয়াল থেকে তার সঙ্গী প্রায় “এক ডজন” গরু। কাজলি, বাঘা, কালী, শ্যামলী, রাধে কতো সব নাম ছিল তাদের। বিশেকাকা মাছ ধরে এনেছে পুকুর থেকে, তা দেখে কতোই না লাফালাফি ছিল আমার! “মনি, হাত দিও না, কাইমড়ে দেবেনে,” বলত বিশেকাকা। বড়োদের নিষেধ মেনে কাছে যাবার সাহস হত না। শীতকালীন ছুটি বহু কষ্টে মিলত। গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার সেই দিনগুলো কিভাবে একটা ক্যালেন্ডার হয়ে গেল! এখন চাইলেও আর যেতে পারব না সেই দিনগুলোতে, ভাবলেই বুকের ভেতর মুচড়ে ওঠে। আমাদের ঠাকুরবাড়ি থেকে মিনিট-দশ হাঁটাপথ নবগঙ্গা নদীর। বাড়ির ভেতর থেকে হেঁটে নবগঙ্গার কনকনে ঠাণ্ডায় স্নান করতে যেত গ্রামের গৃহিণী মহিলারা। তাদের দেখে আমার শীত করত। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম! নদীতে স্বাধীনভাবে কখনো স্নান করা হয়নি। বহু অনুরোধে কারো সঙ্গে গিয়ে চারদিকে জল ছিটিয়ে চলে আসতাম।
“ভেজালের মা” নামে পরিচিত আমাদের সবার এক দিদা ছিল। বিরাট দেহ তার, ভয়ঙ্কর তার চোখ! আমরা তাকে ভয় পেতাম যমের মত। সেই পুতনা-দিদা, দানবের মত শরীর নিয়ে যখন দলবল সমেত স্নান সেরে ফিরত, তখন আমাকে শুনিয়ে যেতে যেতে বলত, ‘আমার শীত তোর গায়ে, যেই না ভয় পাওয়া অমনি বদলে থুক্কু বাঘের গায়ে” এভাবে শীত তাড়াতো তারা। এতে নাকি ঠাণ্ডার বোধ কম হয়, অনেকটা যেন সান্ত্বনা-পুরস্কার। তাদের সেই দাঁতকপাটি লেগে যাওয়া ভেজা শরীর নিয়ে নদী থেকে বাড়ি পর্যন্ত হেঁটে যাওয়া প্রায় দু'মাইল, এদেশী কোনো মানুষের এরকম করা তো দূর, ভাবতেই পারবে না। অথচ আমার গ্রামের কাকিমা জ্যাঠাইমারা অনায়াসে পারতেন। তাদের কাকভোরে ঘুম থেকে উঠে উঠোন লেপা, পুকুর থেকে বাসন মেজে আনার টুংটাং শব্দ আর উনুন ধরানোর সেই কাঁচা কাঠের আধপোড়া ধোঁয়া আমাদের জানালা দিয়ে সহজেই ঢুকে যেত। যতই ঠাণ্ডা হোক তাদের জীবন থামবে না, এ যেন কারো প্রতিবিধান! আগে থেকেই নির্বাচন করে রাখা।
আমাদের ঠাকুরবাড়িতে সেই খিল দেওয়া কাঠের জানালা খুলে বাইরেটা দেখতে হত। সাদা কুয়াশায় ঢেকে থাকত খড়ের গাদাগুলো। যেন কোনো শীতকাতুরে বুড়ি ছাই রঙের চাদর গায়ে লাঠিতে ভর করে দাঁড়িয়ে আছে! রোদ আসতেই উঠোনে আমাদের জন্য কাঠের চৌকি পেতে দিত রবিকাকা। শান্তিপিসির ঢাউস এলুমিনিয়ামের কেটলিতে ধোঁয়া-ওঠা চা, চিনেমাটির কাপ সেজে ওঠা মানেই সকাল হয়ে যাওয়া। ঠাকুরদালানের গায়ে-পড়া রোদে সদ্যভাজা গরম মুড়ির সঙ্গে পিঠ ভাসিয়ে থাকা সেই দিনগুলো এখানে ‘স্টারবাক্স ক্যাফের’ বদ্ধ ঘরে কিভাবে যেন আঁচড়ে কামড়ে মনে পড়ে যায়। একদিকে চোখে পড়ছে সাদা বরফের গাছ, অন্যদিকে দেখতে পাচ্ছি, খেজুর গাছে হাঁড়ি বাঁধতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে ভীম আর বিষ্ণু। বিপ্রতীপে খেলা করছে কেউ বর্তমান থেকে অতীতে। যেন চোখ মেললেই দেখতে পাচ্ছি, মলন দেবার জন্য ধান বিছোনো হচ্ছে বিস্তৃত উঠোনে। গলায় ঘন্টাবাঁধা গরুদের নিয়ে এখন ধান মাড়ানো হবে। গরুর গাড়ি থেকে ফৈজো খুড়ো আমাদের ভেতর-বাড়িতে সদ্য ক্ষেত থেকে তুলে কপি, মুলো, সিম, ইত্যাদি সবজি নিয়ে যাবে। বাবার সঙ্গে গল্প করতে আসা চেনা চাচা অথবা কাকা, দাদাজান আরো অনেকে ঘিরে আছে তাকে।
ছবিগুলো একের পর বদলে যাচ্ছে যেন। আমি ধরে রাখতে পারছি না কিছুকে। মা-র আচার শুকোতে দেওয়া, বিশেখুড়োর জাল ফেলে মাছ ধরা, আর এদিক ওদিক দেখে পালিয়ে গিয়ে পাট বনের গহীন সবুজে সবুজ হয়ে যাওয়া, দুপুর বেলায় আমাদের পুকুর পাড়ের নৈঃশব্দ্য, সব মিলিয়েই শীতকাল, যেন বাক্সে তুলে রাখা কোন এলবাম হয়ে গেছে। বস্টন শহরে শীতের তীব্রতা বুঝতে বুঝতে সেই সব হারানো সময়ের আঁকিবুকি স্মৃতি সহসাই ছেঁকে ধরছে। এখানে মানুষের জীবন ভীষণভাবে ফ্রেমে বাঁধা। আবহাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঋতু বদলায়, সেভাবেই স্থানীয়রা নিজেদের পিছুটানহীন জীবনে পরিস্থিতিগুলোকে বদলায় ফ্রেম-এ থেকেই। শীত পড়তেই উইকেন্ডগুলো স্থানীয়রা কাটিয়ে দেয় ঘুরেফিরে। স্কি করার প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নিয়ে, পিঠে আধুনিক ব্যবস্থাপনায় কোলের শিশুকে বেঁধে নেমে পড়ে বরফের গায়ে। দূর থেকে দেখলে মনে হয়, ছোটো কোনো রোবট যেন। যাদের শিশু নেই তারা এখানে নানা প্রজাতির কুকুর কিংবা বিড়াল পোষে। জাত নামে ডেকে ফেললে হয়তো শাস্তিও হতে পারে! এদেশে মানুষের মতো সম্মান ও মূল্য পায় এরা। বিউটিপার্লার থেকে শুরু করে এদের জামাকাপড়ের, খাবারের দোকান থাকে আলাদা করে। ইন্সুরেন্সও থাকে, থাকে ঘরবাড়ির মালিকানাও! একদিন একটি শপিং মলে কারো ভ্যানিটি ব্যাগের থেকে কিছু একটা হঠাৎ মুখ বের করলেও বুঝতে পারিনি আসল, নাকি খেলনা! কুকুর বিড়ালদের মতো ইঁদুর, খরগোশ, এরাও মানুষের পারিবারিক সদস্য। তাই শীতকালে দেখা যায়, সোয়েটার মোজা পরে মালিকের সঙ্গে ভ্রমণে সামিল হয় তারা। এটা বড় ভালো লাগে আমার। ছোটোরা রীতিমতো ছোটবেলা থেকেই বড়দের মতো ম্যাচুরিটি নিয়ে বড়ো হয়। ঠাকুরমার ঝুলির রাক্ষস খোক্কস-এর গল্পগুলো পড়ে আমরা যখন শিহরিত হই, তখন এরা লাইভ ডেভিল নিয়ে খেলতে শেখে। জন্তুদের ভালবাসার শিক্ষা এদের দেখে শিখতে হয়। এটাই মজার তফাৎ। এইতো সামনে দিয়ে হেলতে দুলতে হেঁটে যাচ্ছে টুপি পরা উত্তর চায়নার “চাউ চাউ”। আর যাই হোক একে কুকুর বলা যায় না, তার দম্ভই আলাদা! রাস্তায় সারি বেঁধে যাওয়া গাড়ির লাইন, কাউকে বিরক্ত না করে এগিয়ে চলেছে। স্বপ্ন কল্পনার জগৎ এই শীতে বড়োই কুয়াশাময়।
রাস্তা দিয়ে হাঁটছি আর ভাবছি এই ঠাণ্ডায় কোথায় একটা কিছু ফেলে যাচ্ছি, ভুলে যাচ্ছি। আজকাল ভুলে যেতে পারা খুব কঠিন। যে-কোনো পরিস্থিতিতে যে-কোনো কিছু সহজেই মনে পড়ে যাচ্ছে দেখছি। মানচিত্রের রেখাগুলোকে উল্টেপাল্টে পৌঁছে যাচ্ছি হেথায় সেথায়। কফির দোকানে উষ্ণতার পারদ চড়ছে। বিয়ার কিংবা পাব হাবও বাড়িয়ে চলেছে উষ্ণতা। সংস্কৃতি অথবা ঐতিহ্য অনুযায়ী অনায়াসে আধা-কাঁচা মাংসের বার্গার, অথবা চিজে মুখে কুলুপ এঁটে যাওয়া পিৎজা দিয়ে কাটিয়ে দিচ্ছে তারা শীতকাল বা গরমকাল। কাল কাটিয়ে দেওয়াই বড়ো কথা এখানে। সঞ্চয়ী হতে হয় না বলেই জীবনের সুবর্ণ সুযোগগুলো এরা হাতছাড়া করে না। পিছুটানহীন সব বয়সী মানুষেরা ঘুরেফিরে জীবনের নির্যাস লুটেপুটে নেয়। পাহাড় থেকে বা আকাশ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়া, বরফের মধ্যে এডভেঞ্চার, সমুদ্রের তলায় পৌঁছে যাওয়া কোনো ব্যাপারই নয়। গাড়ির উপরে সাইকেল বা স্পিডবোট বেঁধে ইচ্ছেমতো বেরিয়ে পড়া। কব্জি ডুবিয়ে রসনাতৃপ্তির চাপ নেই বলে দিব্যি এদের জীবন কেটে যায় শুকনো অথবা কাঁচা সহজলভ্য খাবার দিয়ে। শীত কিংবা গরম একই রকম একই নিয়ম। কোনো এক দোকানের কেক মাফিনের গন্ধ নিয়ে আমি বাড়ির দিকে পা বাড়াই। পৌষ সংক্রান্তি কবে চলে গেছে মনে নেই। সেই যে লক্ষ্মীদেবীর সামনে মা-র পাঁচ রকমের পিঠে পায়েস বানিয়ে দেবার তোড়জোড়, দেবীকে সন্তুষ্ট রাখার প্রক্রিয়ায় সকাল সন্ধে কাঠের উনোনে আগুন, সেইসব হঠাৎ হঠাৎ মনের উপরে আঁচল ফেলে যায়। পদ্যময় জীবনে গদ্যহীন বেঁচে থাকার মতো সেই মনে পড়াগুলোকে আঁকড়ে ধরি। সেই ধরে থাকার মধ্যে একটা কষ্ট আছে, দূর থেকে দেশকে খুঁজে ফেরার আনন্দ আছে। এখন চাইলেই দুপুর রোদে সোয়েটারে সেঁধিয়ে ধান খেতের আলে পৌঁছনো সম্ভব নয়। ফেসবুক থাকলেও খুঁজে পাওয়া যায় না, রকেট, তপন, লিপি, সাথির মতো বন্ধুদের। মিন্টুদের দলে ভিড়ে ধাক্কা খেতে খেতে, দুহাত ভরে মাছ ধরতে যাওয়ার বৃথা চেষ্টার মায়া আমাকে এখনো ভোগায়। এখনকার ক্যান্ডি ক্রাশ খেলার চাইতেও কতো ইভেন্টফুল ছিল সেইসব মায়াময় শীতকালের দিন । সেদিন এক স্বদেশী বন্ধুর বাড়িতে ফায়ারপ্লেসের আগুনে নিজেকে সেঁকে নিতে নিতে পৌঁছে যাচ্ছিলাম আমাদের পিছন বাড়ির খোলা উঠোনে। যেখানে জড়ো করা থাকে শুকনো পাতা, খড়। কতো উষ্ণতা ছিল সেই কুড়োনো খড়ের বুকে, মরা গাছের ডালে! তারা যতোই পোড়ে, গ্রামের মানুষের ফসিল হাড়ে, ততোই উত্তাপ নিভন্ত ছাই হয়ে জমা হয়! বরফের নৈরাশ্যের চাদর আর হিমেল হাওয়ার তীব্রতা বস্টন থেকে ধলোহরা গ্রামে ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করে। আরো অনেক অণুগল্প, মেজো, সেজ গল্পেরা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। মনের জমিনকেও শাদা করে তোলে নিঃসন্দেহে। এখন দুহাত বাড়ালেও মন আর এগোতে পারে কই, বরফ ঠেলে ঠেলে? এই শুভ্রতার উজ্জ্বলতা আমার সহ্য হয় না। সেই কুয়াশা কুয়াশা ধোঁওয়াময় ঘোরেই আমি ভিজতে থাকি। তখন আমার পায়ের নিচে সুড়সুড়ি দেয় সর্ষে খেত। ডিসেম্বরের কাকভোরে কলকাতার সেন্ট পল্স ক্যাথিড্রাল, ময়দানের একলা করে দেওয়া ট্রামের নিঃসঙ্গ কামরা আমার শরীর বেয়ে ওঠানামা করতে চায়। কখনো নেপালদার চায়ের দোকান, এমনকী রাধামাসির ঝাঁকা থেকে পড়া গাঁদাফুলের বুনো গন্ধেরা চোরকাটা হয়ে গেঁথে যেতে চায়।
পেডিস্ট্রিয়ান সিগনাল দেখে রাস্তার ওপারে যাই। আজ বরফময় দিন। ফোনের স্ক্রিনে নেমে যাচ্ছে পারদ তরতরিয়ে। দুর্নিবার সাদা ঝড় ঢেকে দিচ্ছে মনোকষ্টের উত্তাপগুলোকে, সারা রাস্তা ঢেকে যাচ্ছে অস্থির এক শুভ্রতায়। স্টেটপার্কগুলো দেখলে মনে হয় মরা গাছের মাতন লেগেছে যেন। তার মধ্যে জীবনের সাড়া দিচ্ছে কিছু বুনো ফুল। আমার সকল ব্যথা ধন্য করে ফুটে ওঠার মতো কোনো অবিনশ্বর অনুভূতি বস্টনের বুকে বরফ ভেদ করে উঠে আসতে চাইছে। বলছে, এখনি থেম না, ফুরিয়ে যাবার পরেও আছে পথ। শুধু বাঁচিয়ে রাখো, “এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা”।