এয়ারপোর্টে বসে আছি। বিমান-বন্দর আমার বরাবরই এক পছন্দের জায়গা। কত গল্প লেখার প্লট আমাকে খুঁজে দিয়েছে এয়ারপোর্ট, তার ইয়ত্তা নেই। গল্পে সব সময় কোন কাহিনী থাকা জরুরী এমন নয় বলেই, চলতে চলতে দেশে দশে মানুষের জীবনের মুহূর্তগুলোই গল্প হয়ে যায়। এ-বারের যাত্রায় এয়ারপোর্ট আমাকে তেমনি একটা নতুন প্লটের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। বড়ই সাদামাটা এই আয়োজন। একটা জার্নি কেবল গন্তব্যেই তো শেষ নয়, অতীত থেকে বর্তমানে তার চলন নতুন নতুন শাখায় বিস্তারিত হতে থাকে। এয়ারপোর্টে এলে যাবতীয় পরিচয় গুটিয়ে শুধু পাসপোর্ট নং হয়ে যেতে হয়। নিরাপত্তার বেড়ি পেরিয়ে কোন একটা সুবিধেজনক জায়গা বেছে নেওয়া, যেখানে বসা যায়। ফোনের দিকে তাকিয়ে শেষ মুহূর্তের আপডেট দেখে নিচ্ছি। নতুন শহর ডেনভার আমার গন্তব্য। চারিদিকে পর্বত আর আকাশ ছোঁয়া শীতল ঋতুর দেশ এই কলোরাডো। তারই ছবি দেখছি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। উৎসাহ ও কৌতূহল দুই মিলেমিশে আছে। বরাবরের মত এয়ারপোর্টে বসে মানুষের ঠাসবুনোটে চোখ রাখছি, আর মনের মধ্যে নানা গল্প জমাট বেঁধে উঠছে। শয়ে শয়ে মানুষ বসে আছে, চলাচল করছে, ছুটছে কোথাও যাবে বলে। ছোটার তো শেষ নেই। হাজার লোকের হাজার ব্যতিক্রমী জীবন। কেউ যাচ্ছে বেড়াতে, কেউ বা কাজের খোঁজে, কেউ বা হয়ত নিয়মিত প্যাসেঞ্জার হয়ে। এদের দেখে দেখে মনের মধ্যে নানান ছবি মনের মাধুরী মিশিয়ে ভেসে উঠছে।
সামনে বিশাল কাঁচের দেয়াল, যেন পেরোলেই ওপাশে কিছু একটা দেখতে পাবো। ওদিকে ওরা কি নিয়ে কথা বলছে? কি সুন্দর আঁটসাট পোশাকে নিজেকে ধরে রেখেছেন ভদ্রমহিলা... একেই বলে প্রপার সাজ, বয়েস কিন্তু কোনভাবেই আশির বেশি ছাড়া কম হবে না। অনেকটা পরের যাত্রায় নিজের কল্পনার নাক গলে সামিল হয়ে যাওয়ার উপক্রম বোধ করছি! বাধ সাধলো এনাউন্সমেন্ট। আমার ফ্লাইট আরো দুঘন্টা বাকি। লাউঞ্জে বসে সবার ছুটে চলা দেখছি। এখানে এলেই মনের মধ্যে হাজার কথার কলকব্জা একসঙ্গে নড়ে ওঠে। ডিউটি ফ্রি দোকানগুলোতে বিভিন্ন সামগ্রী ছুঁতে ছুঁতে মানুষের চেহারার নানান বদল দেখি। যেকোনো দেশের স্মৃতি, উপহার সামগ্রী কেনা বা সংগ্রহের জন্য এয়ারপোর্টই একমাত্র লাস্ট মিনিট সাজেশন। আমিও কিনলাম। অবশেষে এসে বসলাম, না জানি কতক্ষণ আরো বসে থাকতে হবে! প্লেনের রানওয়ে দেখতে দেখতে হঠাৎ উড়ে যাওয়ার অবস্থাটা বড় ভালো লাগে।
বাস্তবিক জীবনে এমন উড়ান সম্ভবপর নয়। আমরা প্রতিদিন এমনি একটা উড়ানের অপেক্ষা করি, যেখানে খারাপ থেকে ভালোর দিকে, বিচ্ছিন্নতা থেকে একাত্মতায়, বিপদ থেকে নিরাপত্তায়, জাগতিক অন্ধকার থেকে আলোর দিকে আমাদের প্রবৃত্তির উত্তরণ ঘটে। উড়ান যেন সেই ব্যাপারটাকে খানিকটা বুঝিয়ে দেয়। ভূমি থেকে সহসাই আকাশে, বিশাল এক ব্যাপ্তিতে পৌঁছে যাওয়া। যেখানে ভেসে থাকাটাই বড় কথা! যেমন আমরা আমাদের জীবনে সমস্ত অনুকূল প্রতিকুল পরিস্থিতির অস্থায়ী আকাশে ভেসে থাকি, থাকতে হয়, এ অবস্থা বদলায় না।...
অনেকক্ষণ হলো দেখছি, আমার পাশেই বসে আছেন একজন যাত্রী। পিটার নামক কাউকে ফোন করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু সম্ভবত নট রিচেবেল হচ্ছে! আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে আমিও হাসিই বিনিময় করলাম। এই মুহূর্তে আমার কিছু কেনার নেই, নেই কাউকে ফোন করারও। একমাত্র উপায় কফি হতে পারে, যা আমাকে কাচঘেরা সুদৃশ্য বসার জায়গাটিতে একলা বসার রসদ যোগাবে। খোলা এক টুকরো আকাশ দেখছি। আমার সামনে এসে বসলেন অনাম্নী একজন। কোথাও যাবেন বোধহয়। প্রায় আধঘন্টা পর প্রথম কথা বললেন। নাম লিওনার্ড, বয়েস ৬৫ থেকে ৭০-এর মাঝামাঝি। কখনো-সখনো দূরপাল্লার ট্রেনে যেমন হয়, “কোথায় যাচ্ছেন দিদিভাই? এনজিপি?” ঠিক তেমন না-হলেও তিনি জানালেন, তিনি আমার টেবিলে বসেছেন, কোন আপত্তি আছে কিনা জানতে চাইলেন! তারপর বললেন, আমার টি-শার্টটা বেশ পছন্দ হয়েছে ওনার। এইরকম অনেকবার হয়েছে। কোথাও হয়ত শাড়ি পরে বেরিয়েছি বা কুর্তি, একসময় খেয়াল করেছি কেউ দেখছে ভীষণভাবে। পরে অবাক হয়ে জানতে চেয়েছে, শাড়ি আবার কেমন পোশাক, এত লেয়ার্স, কিন্তু খুলে যাচ্ছে না! বা কুর্তির নকশাটা এতই সুন্দর যে তাকিয়ে থাকতে বাধ্য হয়েছে। বিদেশে এগুলো বেশ মজার, বিশেষ করে পাবলিক ট্রান্সপোর্টে তো কথাই নেই।
সুতরাং আমার এই টি-শার্টে নৌকার ছবি আবিষ্কার করতে করতে লিওনার্ড যখন বললেন, এরকম বোট ইন্ডিয়াতে পাওয়া যায়, তাই না, আমি অবাক হইনি।
“তুমি কি ইন্ডিয়ান?” বললাম বাংলাদেশী।
“ব্যাংলাঢেশ?! এখন তো ওদেশে নানান কিছু হচ্ছে, ওখানে “মুকটিযুদ্ধ” হয়েছিল না?”
বেশ লাগলো তার আলাপ করার প্রকৃতি দেখে। দেশ কাল সংস্কৃতির পাশাপাশি কথা শুরু হলো যুদ্ধ নিয়ে। এদেশীয়দের আলাপ করার রীতি, সম্মান দিতে শেখা, কিছু জানতে চাওয়ার আগ্রহ সবটাই বেশ ব্যতিক্রমী। সহযাত্রী বন্ধুটি আমার দেশ সম্পর্কে বেশ আগ্রহী, রবীন্দ্রনাথ, অরবিন্দের কথা পড়েছেন। এটুকুই বা কম কী! দু'বার দিল্লি গেছেন, বিরিয়ানি টেস্ট করেছেন। মহাভারত সম্পর্কে পড়ালেখা করতে চান, বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন বিষয়ে জানেন, আমার তো শুনে মুখে এক গাল মাছি! মুখ থেকে বেরোতে গিয়েও বেরোলো না, বলেন কী মশায়! আমরা আর আমেরিকা সম্পর্কে কতটা জানি! যতটা জানি তার থেকে বেশি জানার ভান করি। আমাদের জীবন, কর্মক্ষেত্র সবেতেই সীমিত জ্ঞানের চর্চা করি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই সবজান্তা ভাব দেশী মানুষের মুখ থেকেই শুনেছি! ভালো লাগছে মানুষটিকে, কোন অহংকার ছাড়া, নাম-পরিচয় ছাড়া দিব্যি কথা বলছেন।
আমাদের সামনের স্ক্রিনে হাজার প্লেনের নির্ধারিত সময়সূচি, একেবেঁকে চলে যাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমার দেশের কথা বল, ক্যারি অন, উই হ্যাভ লট অফ টাইম!”
আজকাল বলতে চাইলেও নক্ষত্রের মত শ্রোতা পাওয়া মুশকিল। প্রত্যেকের জীবনের সাংবাৎসরিক ব্যস্ততা, নিজেকে যেখানে খোঁজার সময় নেই, সেখানে অন্য মানুষের জীবন সম্পর্কে আগ্রহ থাকবে না এটাই স্বাভাবিক। উনি বলছিলেন আমেরিকার কথা, এদেশের বিপ্লবের কথা। উল্লেখ করলেন এদেশে সারা পৃথিবীর মানুষের বসবাস করার সহিষ্ণুতা, সম্মিলনের কথা। এরা আর কিছু না করুক দেশকে ভালবাসে। এদেশে নিয়মকানুন মানার যে সংস্কৃতি তা মানুষ তার পরিবার আর সমাজ থেকে শেখে। বাধ্যতার মূল্যবোধ এদের দেখে শিখতে হয়। এদেশে ছোট, বড় মাঝারি, যেকোন মানুষমাত্রেই তার সম্মান! এমনকি জন্তুও সেই একই সম্মানের অংশীদার। সুতরাং একে বোঝানো যাবে না কেন আমাদের দেশে মানুষের মূল্যায়ন নেই, কেন স্বাধীনতা নেই, কেন সবকিছুই-ই আছে অথচ কিছুই নেই। কথায় কথায় এগিয়ে চললাম। দেশভাগ ও সাম্প্রদায়িকতা বিষয়ে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ এবং সীমানাকেন্দ্রিক টিপিকাল বিষয় নিয়েও একপ্রস্থ আলোচনা করে গেলাম। পৃথিবীর বড় বড় যুদ্ধ আর তার প্রতিক্রিয়া নিয়ে জানালেন অনেক কিছু। প্রথম ও তৃতীয় বিশ্বের মানুষের আলোচনা, স্বাভাবিকভাবেই আমাদের দৃষ্টিকোণ, ধ্যানধারণা সব কিছুই দুজনের থেকে আলাদা। জানালেন, ওনার ঐতিহাসিক টপিক, যুদ্ধের সিনেমা, বিভিন্ন দেশের রেভলিউশন জানতে ভালো লাগে। সিনেমার কথা বলতে গিয়ে বললেন, পার্ল হারবার, ব্যালে অফ সোলজার, আর্মি অফ শ্যাডোস, স্পার্টাকাস, আমেরিকান স্নাইপার কিই না দেখেছেন তিনি!
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে চাইলে ৭০-এর দশক হয়ে একাত্তরে ফিরলাম। আমাদের বাংলাদেশী মানুষের চোখে যুদ্ধ মানেই একাত্তর। পৃথিবীর অনেক বড় বড় দেশের যুদ্ধাস্ত্রের ঝনঝনানির পাশে আমাদের ছোট্ট দেশের যুদ্ধের গল্প অনেকটাই ব্যতিক্রম। আমাদের না ছিল অস্ত্র শিক্ষা, না ছিল অস্ত্র! আমাদের বুকের মধ্যে স্বাধীনতার বারুদ ছিল। ৭ই মার্চ যেমন আমাদের যুদ্ধাস্ত্র, ১৯৬৯ তেমনি আমাদের যুদ্ধ জয়ের ইতিহাসের যুগান্তকারী ঘটনা। আমাদের দেশের যুদ্ধের বীজ দেশভাগের ইতিহাসে নিহিত ছিল। শুধুমাত্র একধরনের সাম্প্রদায়িক মানসিকতা, সেটাকে দিনের পর দিন, যুগের পর যুগ টেনে হেঁচড়ে চলা, এত মৃত্যু, এত হত্যার রাজনীতিকে জন্ম দিয়ে চলা, এটাই যেন নিয়ম হয়ে উঠেছিল সেই কবেই! কেউ জানে না এতে কোন ধরনের “স্যাটিস্ফ্যাক্শন” কাজ করে। যারা করে তারাও কি জানে? আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বিশ্বাসঘাতকতা মিশে আছে। ২৫শে মার্চ কালো রাতে ঘুমন্ত শহরবাসীর উপরে হামলা, হত্যা দিয়ে যাত্রার সূচনা, সে তো রাতের আঁধারেই সম্ভব হয়েছিল। সেই ঘাতকদের কালো চোখ শহর থেকে গ্রামে গিয়ে পৌঁছেছিল একদিন। অবাঙালিদের সাথে বাঙালি কিছু ধর্মব্যবসায়ী মিলে প্রত্যন্ত গ্রামেগঞ্জে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে অবাধে। নইলে যারা প্লেনে, ট্যাংকে করে শহরময় টহল দিয়েছে, তারা গ্রামের রাস্তা চিনেছিল কীভাবে? কারা চেনালো বিদেশীদের খাল বিল জলের রাস্তা? এত বিশ্বাসঘাতকতা, নয় তো কি? তাই ৭১ শুধুমাত্র বইয়ের ইতিহাসে সীমাবদ্ধ নয়।
যে ইতিহাস আমরা জানি আর যার চর্চা করি তার বিপ্রতীপে ভিন্ন ভিন্ন অকথিত কাহিনী যুদ্ধের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে মিশে আছে। মৃত আর জীবন্মৃতর ভিড়ে লক্ষ লক্ষ মা, বোন, ভাই, শিশু বৃদ্ধের সেই পড়ে পাওয়া চোদ্দো-আনা জীবনের খোঁজ উইকিপিডিয়ায় পাওয়া যায় না। বাংলাভাষা, বাংলাদেশ বানানোর জন্য যুদ্ধের প্রাত্যহিককে কি আমরা সবাই মনে রেখেছি? সারাদেশ খুঁজলে মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি এমন অসংখ্য যুদ্ধকালীন মানুষদের জীবনের গল্প পাওয়া যাবে, যা কোন অংশেই কম গৌরবের নয়। আমাদের যাপিত জীবনে সাম্প্রতিক সময়ে এত ঘটনা, এত যুদ্ধের ভীড়, যে নিজেদের দেশে, নিজেদের ঘরের কাহিনীকে আর খুঁজে দেখা হয় না।
লিওনার্ড আমার সঙ্গে একমত হলো। কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল, এদের তো আবার সব বিষয়ে বলা না-বলার মাঝামাঝি থাকা। জোর করা যায় না। আমাকে জিজ্ঞেস করল, বললাম, আমার পরিবারের দুই অংশে ৭১-এর যুদ্ধ নিয়ে কিছু অভিজ্ঞতার গল্প আছে। সে এমন বিশেষ কিছু নয়, আমাদের দেশে খুব কমন! ওর আন্তরিক আগ্রহ দেখে বিনিময় করতে শুরু করলাম।
আমার দাদু সুরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। অনুশীলন সমিতি করতেন, ব্রিটিশদের রাজবন্দী হয়েছিলেন। চোখের সামনে ৪৭-এর দাঙ্গা দেখেছেন। তাঁর দাদা ক্ষিতিশ ভট্টাচার্যও স্বদেশী করতেন, বিপ্লবী ছিলেন। দেশভাগের পর তাঁদের জীবনের আসল যুদ্ধ শুরু হয়। পরিবারের বড় সন্তান প্রত্যক্ষ ভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ায়, আজ এখানে কাল সেখানে। বিশাল বড় পরিবারের চাপ এসে পড়ে আমার দাদুর কাঁধে। তখন তিনি ছাত্র। একদিকে সংস্কৃত কলেজে পড়ছেন, আদ্য, মধ্য যাবতীয় স্তর পেরোতে পেরোতে অন্যদিকে পরিবারের অন্ন-সংস্থান করছেন। কলকাতা দাঙ্গা শুরু হলে তিনি ফরিদপুরের কোটালি পাড়ার বাড়িতে চলে যান। পড়াশুনো বন্ধ, একের পর এক বাধা নেমে আসতে থাকে সেদিনের সেই যুবকের জীবনে। এর সঙ্গে জুড়েছিল তাঁর পারিবারিক নানা বিপর্যয়।
কিন্তু সেই পরিস্থিতিগুলো কোন বিদেশীর পক্ষে এয়ারপোর্টের কফি টেবিলে বসে ক্ষণিকের গালগল্পে বোঝা সম্ভব নয়। সহজ কথায়, তার চিড়ে ভেজানোর জন্য সরাসরি ক্লাইমেক্স-এ চলে এলাম।
১৯৭১ সাল। আমাদের পরিবারের অনেকের জীবনে স্বাধীনতার যুদ্ধ একেবারে ভিডিও গেমের মত প্রাণবন্ত। বরিশালে আমার দাদুর বেশ নামডাক ছিল। তাঁকে ভালোবেসে অনেক গুণীজন আমাদের মামাবাড়িতে এসেছে। তিনি শিল্পী সাহিত্যিক রাজনৈতিক সব শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে মিশেছেন। “সুরেশবাবুর” পরিসর বরিশাল থেকে ঢাকা, সেখান থেকে অন্যত্র বিস্তৃত হয়েছে। পরোপকারী, অকুতোভয় মানুষটি নিজের পরিবারের তুলনায় সমাজের জন্য নিজেকে বিলিয়েছেন বেশি। ঘরের তুলনায় পরের মানুষ হওয়ায়, এই আন্তরিকতা তাঁকে অনেক দূর পৌঁছিয়েছিল। পাকিস্তানি আমলে শহীদুল্লাহ কায়সার এসেছিলেন বরিশালের বাড়িতে। এমনকী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের পরিবারের আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের সঙ্গে আমার দাদুর ঘনিষ্ঠতা ছিল দীর্ঘ দিনের। সেরনিয়াবাতের মেয়েরা ছিলেন আমার মা-মাসিদের সহপাঠী। সেই মেলামেশায় কোন রাজনীতি ছিল না সেদিন। এত প্রভাবশালী ছিলেন তাঁরা, তবু কখনো তাঁদের কোন অহংকার প্রকাশিত হতে দেখা যায়নি। আলতাফ মাহমুদ, “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানোর” মত বিখ্যাত গানের সুরকার এসেছেন এই বাড়িতে। আমার মাসি প্রমীলা চক্রবর্তী বাংলাদেশের একজন গুণী শিল্পী ও প্রাক্তন অধ্যাপিকা। তাঁর গানের সুখ্যাতির জন্য অনেক দূরকেও তিনি নিকট করেছেন। পরবর্তী কালে দাদুর সাথে সাথে তাঁর গানের আকর্ষণে, তাঁকে ভালোবেসে এগিয়ে এসেছেন যাঁরা, তাঁরা আমাদের পরিবারের সবার হয়ে গেছেন। পূর্ণেন্দু পত্রী থেকে শামসুর রহমান (দ্রঃ (১); (২); (৩); (৪)) মোস্তফা জামান আব্বাসী (আব্বাসউদ্দিনের পুত্র) থেকে সানজিদা খাতুন, রফিকুল ইসলাম, হাসান আজিজুল হক, খান সরোয়ার মুর্শিদ, ধানমণ্ডির ৫নং-এর চৌধুরী পরিবার, কার কথা বলব আর বাদ দেব! এদের সঙ্গে আমাদের সবার নিখাদ পারিবারিক সম্পর্ক, কোন সীমানা ছাড়াই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সম্প্রসারিত হয়েছে। এই সম্পর্কগুলোর অকৃত্রিম ভালবাসা, তাদের সাথে কেটে চলা জীবনের গল্প নতুন কোন প্রবন্ধের জন্ম দিতে পারত নিঃসন্দেহে। কিন্তু অপ্রতিরোধ্য সেই গতিকে বাড়তে না দিয়ে প্রসঙ্গে ফিরে আসছি। দেশ স্বাধীন হবার অনেক পরে বাংলাদেশের বহু নামী দামী ব্যক্তিবর্গ, এমনকী বিদেশী বহু বিখ্যাত মানুষেরা আমাদের মত সাধারণ মানুষের বাড়িতে এসেছেন আমার সৌজন্যে। তাদের জীবনের নানা ওঠাপড়ার সঙ্গী হয়েছেন। নানা বিপদে, প্রতিকূলতায় সহৃদয় এই মানুষদের সাথে পাওয়া এই পরিবারের অন্যতম অর্জন।
১৯৪৭ থেকে ৭১-এর টালমাটাল সময় সুরেশচন্দ্র নিজের জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন। ১৯৭১-এর মাঝামাঝিতে ঢাকার আগুনের তীব্রতা যখন দেশের কোণে কোণে পৌঁছে যাচ্ছে, তেমনি এক বিপর্যয়ের দিন এসে উপস্থিত হয় বরিশালবাসীর জীবনে। পাকিস্তানি সেনার জলে স্থলে আক্রমণ শুরু হয়ে যায়। সুরেশচন্দ্র লোকমুখে শুনছিলেন, দেশছাড়ার কথা। কোন এক সকালে তিনি বাড়ি ফিরছিলেন, এমন সময় হঠাৎ বাজারে আগুন লেগে যায়, বোম পড়তে শুরু করে। তাঁর স্ত্রী (নীলিমা ভট্টাচার্য) খুদে ছেলেমেয়েদের স্নান করাচ্ছিলেন, এমন সময় বোমাবাজি শুরু হয়ে যায়। জানলা দিয়ে দেখলেন লোক ছুটছে উর্ধ্বমুখে, লাকোটিয়ার জমিদার বাড়িতে নাকি প্যারাসুট-এ নামছে পাকিস্তানি সেনারা। চারদিকে তোলপাড়। কে কোথায় যাবেন তার ইয়ত্তা নেই। স্থানীয় দোকানবাজার পুড়ছে আগুনে। সেই মুহূর্তে ভট্টাচার্য পরিবার সাজানো সংসারের চৌকাঠ ছেড়ে এক বস্ত্রে বেরিয়ে পড়েছিলেন। তারপর যা হয়, সদ্য যুদ্ধ সামলে ওঠা ভাঙা দেশ ও দেশের মানুষেরা একটু একটু করে মাথা উচু করে দাঁড়াতে সচেষ্ট হয়।
এ নিছক গল্প নয়, সাত মেয়ে দুই ছেলে নিয়ে যুদ্ধের বাজারে টিঁকে থাকা নেহাৎ কম গৌরবের নয়। পালিয়ে বাঁচার জন্য অন্তত কোন পরিকল্পনা তো চাই! কিছুই হলো না। উনোনে দুপুরের যে খাবার তৈরি হচ্ছিল, তা জ্বলতে জ্বলতে নিভে গেল। গৃহস্থ বাড়ির সাজানো ঘরদোর, নিকোনো উঠোন, তুলসী গাছ, আর নীরব ঈশ্বরের মূর্তিরা স্বাক্ষী রইলো সেই মুহূর্তের। যেমন ঘর তেমন রইলো, বিছানাপাট, আসবাব, দেয়ালে দেয়ালে গার্হস্থ্যের ছাপ অনির্দিষ্টকালের মত থমকে গেল। ঘরের দরজা জানলাও বন্ধ করার অবকাশ পাওয়া গেল না, রাস্তায় নেমে যেতে হলো তাদের।
বরিশাল থেকে নৌপথে খুলনা, সুন্দরবনের জঙ্গল দিয়ে হাসনাবাদ, এই ছিল রাস্তা। পথে রাজাকারের বাজপাখির চোখ, পাকিস্তানির ভয়, সবাইকে বাঁচিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় রীতিমত দমবন্ধ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল তারা। মাইলের পর মাইল হেঁটে, বনেজঙ্গলে খালের ধারে লুকিয়ে সন্তানসন্ততি নিয়ে প্রাণ বাঁচানোর সেই কঠিন সময় আজ ভাবতে গেলেও শিউরে যেতে হয়। সুন্দরবনের জঙ্গলে মুক্তিযোদ্ধাদের দল, পথ দেখিয়ে নিয়ে গেছিল দাদুর পরিবারের মত আরো কয়েকটি পরিবারকে। লতাপাতা ঘেরা লঞ্চে, বিনা আওয়াজে একটু একটু করে এগোতে হচ্ছিল ঝুঁকি নিয়ে। একদিকে সুন্দরবনে বাঘের ভয়, উপরন্তু মিলিটারী! সুন্দরবনের গহীনে, মনুষ্য চলাচলের এলাকার বাইরে থেমে থেমে যেতে হচ্ছিল তাদের। কোন একদিন হঠাৎ বিরাট এক বাঘ এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে লঞ্চে! দুঘন্টা মৃতবৎ থাকতে হয় তাঁদের, এদিকে না এগুলেও বিপদ। একসময় জলে কুমির ছিল কিনা তা ভাবার মত অবস্থা ছিল না সেই যাত্রীদলের, কিন্তু ডাঙায় রাজাকার আর পাকিস্তানি মিলিটারির দল খুঁজে বেড়াচ্ছিল শরণার্থীদের। মুক্তিযোদ্ধা আর মহিলা--এই ছিল তাদের লক্ষ্য।
বরিশাল ছেড়ে বেরোবার সময় অনেকেই খালি হাতে বেরিয়েছেন। অভুক্ত শিশু বৃদ্ধ, নারী পুরুষেরা ক্ষুধা, তৃষ্ণা, কান্না ভুলে গিয়ে মুহূর্তের দিন গুনছিল, ঈশ্বর এই যাত্রা শেষ করুক! ক্লান্ত সেই নৌযাত্রীরা ভারতের মাটিতে নেমে প্রথম বুঝতে পেরেছিল বেঁচে থাকা কাকে বলে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছিল সবাই হাসনাবাদ থেকে। দাদুর পরিবার ঢাকুরিয়ার ২নং-এর শহীদ নগরে আশ্রয় নিয়েছিল। যাদবপুরের এই কলোনি দেশভাগ পরবতী সময়ে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে শহীদদের স্মৃতিতে গড়ে উঠেছিল। সুরেশচন্দ্রের অগ্রজ ক্ষিতিশচন্দ্র এই কলোনি গড়ে ওঠার ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য ভুমিকা রেখেছেন। যুদ্ধ থামতে তখনো কয়েক মাস বাকি। এতগুলো পেট, অফুরন্ত খিদে, আর মৌলিক চাহিদার টানাপোড়েনে সুরেশচন্দ্র কিছুদিন হিন্দুস্থান মোটরে, পরে ইনকামট্যাক্স-এ, বলা যায় পরিযায়ী শ্রমিকের মত অস্থায়ী কাজ করে বিশাল পরিবারের ব্যয়ভার বহন করেছেন। পূর্ববাংলার যুদ্ধাক্রান্ত দেশের মানুষ হিসেবে সহানুভূতি যতটা পেয়েছেন সেই তুলনায় পাশে দাঁড়ানোর মত শক্ত কোন কাঁধ বা ভরসা পাননি তিনি। শরণার্থী মানুষের জীবন যেভাবে শতছিন্ন কাটে, তেমনি পরিচয়হীন এই পরিবার কলকাতার বুকে শুধু বেঁচে থাকার চেষ্টা করেছে।
যুদ্ধ শেষ হতেই ৭২-সালে সপরিবার দেশে ফিরে যান তাঁরা। নানা চড়াই উতরাই পেরিয়ে তিনি যখন সপরিবার বরিশাল এসে পৌছলেন, তখন তাঁদের সেই ঘরবাড়ি দেখলেন আর তাঁদের নেই। ফেলে যাওয়া সংসারের স্মৃতিচিহ্নও কারা মুছে দিয়েছে। ঘরের আসবাবপত্র থেকে শুরু করে তৈজস পাশের বাড়ির মানুষেরা ব্যবহার করছে নিজের মনে করে। একটা দুটো কুকুর ঘুরে বেড়াচ্ছে উঠোন জুড়ে। অনেকটা যেন ওয়ালিউল্লাহর “একটি তুলসী গাছের কাহিনী”র পটভূমি। শূন্য উদ্যান, অথচ চারদিকে ফেলে যাওয়া জীবনের হারানো প্রতিধ্বনি। অনেকেই আশা করেননি ভট্টাচার্য-পরিবার কখনো ফিরে যাবেন। কপাল ভালো, ফেলে যাওয়া সংসারের দেয়ালগুলো এই পরিবার ফিরে পেয়েছে! সেখান থেকে আবার নতুন জীবনযুদ্ধ, আবার নতুন প্রস্তুতির জন্য এগিয়ে যাওয়া। সেই যুদ্ধ আর থামে না।...
কিন্তু আমাকে থামতে হলো। আমার সহযাত্রী বন্ধুর মুখ দেখে মনে হলো যেন উনি বলছেন, 'এহো বাহ্য, আগে কহ আর!' “আমেজিং! উনি এখনো বেঁচে আছেন? এ তো পুরো সিনেমা!”
বললাম উনি জীবিত নেই। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের জীবনে কোন না কোনোভাবে যুদ্ধের একটা গল্প আছে। বেশিরভাগ গল্পেরই কোনো হ্যাপি এন্ডিং নেই । ভগ্ন নীড়ের বেদনা, দেশ ছেড়ে যাওয়া, এমনকি অনস্তিত্ব হয়ে ওঠা, মৃত্যু, দুঃখ, হাহাকারের মত বিষয় ছাড়া যুদ্ধের কাহিনী সবসময় অসমাপ্ত। সুতরাং আরো একবার কফি ব্রেক ও তারপর নেক্সট এপিসোডে এগিয়ে চলা। যাই বলি না কেন, এত স্বল্প সময়ে অপরিচিত মানুষের সাথে প্রাণ খুলে কথা বলছি সেটা বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠছে।
যুদ্ধের অপর অধ্যায় ছিল আমার বাবার জীবনে। যশোরের ঠাকুরবাড়িতে আমার বাবা তখন কলেজে পড়া যুবক। পিতৃহীন এই যুবা সেদিন রাজাকারের দৌরাত্ম্য বুঝতে পারেনি। আমার ঠাকুমা, (লীলাবতী চক্রবর্তী) লোকমুখে শুনছিলেন কেউ নজর রাখছে তাঁর বাড়িতে। একদিন ট্রাক বোঝাই মিলিটারী ছেয়ে গেল আমাদের ঠাকুরবাড়িতে। বৃদ্ধা ঠাকুমাকে ছেড়ে মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে গোটা বাড়ি তোলপাড় হলো। লুট হলো মূল্যবান জিনিস। পেতলের থালা বাসন, ট্রাঙ্ক-ভরা লেপ তোষক, গহনা ইত্যাদি। ছত্রাকার হলো সাংবাত্সরিক শস্য। আমার বাবা (সমরনাথ চক্রবর্তী) তখন কোনমতে হলুদের বনে লুকিয়ে। পিঁপড়ে, নানা পোকামাকড় কেটেই চলেছে তাঁকে। রক্তাক্ত হচ্ছেন ক্রমশ। সন্ধের পর তখন যেকোনো গ্রাম বা মহল্লায় অল্পবয়সী যুবক দেখামাত্রেই তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হত ক্যাম্পে। হাতের আঙ্গুল কেটে, চোখ উপড়ে, গুলিবিদ্ধ করে মুক্তিযোদ্ধাদের খবর জানতে চাওয়া হত, অগত্যা গুলি করে দিত পাক মিলিটারীরা। যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবার পর বাবাদের অনেকেই মাঝেমধ্যে রাতে সোরগোলে ঘুম ভেঙ্গে দেখেছেন দাউদাউ করে পুড়ছে কোন গ্রাম। একেকটি এলাকা ক্রমে মানুষহীন হয়ে পড়ছে। আকার ইঙ্গিত ছাড়া বাঙালি ছেলেদের মুখে তখন ভাষা নেই। ওৎ পেতে শিকারী আছে বসে। খবর পেলেন সেদিন মাঝরাতেই তাকে ধরতে রাজাকার আসবে। খবর নির্ভুল, সন্ধের কিছু পরে বাবা কোনমতে বাড়ি ছেড়ে বেরোতেই কেউ তাঁকে অনুসরণ শুরু করে। একসময় বুঝলেন, চারদিকে অনেক লোক তাঁর পিছনে পিছনে। কোনরকমে জীবন বাঁচাতে বাবা ঝাঁপ দিলেন নবগঙ্গায়। মাছ ধরার কোঁচ সমানে এলোপাথাড়ি ভাবে জলে এসে পড়তে থাকলো। মিলিটারির টর্চ তখন শিকারীর খোঁজে ব্যস্ত। ডুব সাঁতার দিয়ে যতটা পেরেছেন এগোচ্ছিলেন, বাঁচার সুযোগ হলো মাঝনদীতে ভাসমান থাকা কোন নৌকোর কারণে। সেবার বেঁচে ফিরলেও গ্রামে থাকা নিরাপদ ছিল না। এক মধ্যরাতে বাড়ির আরো এক-দুজন সদস্য ও আমাদের কুলদেবতা কেশবরায়কে কোলে করে বেরিয়ে পড়লেন পশ্চিমের পথে। অনেকটা যেন দিনেশচন্দ্রের ছোটগল্প কুলদেবতার কাহিনী। বাবার সঙ্গে কয়েকজন আমাদের বাড়ির বউঝিরা ছিলেন। সে যাত্রায় আমাদের কুলদেবতা কেশবরায় বাড়ির কাকিমা জ্যাঠিমাদের কোলের সন্তানের ভূমিকা পালন করেছেন। রাস্তায় অসুস্থ প্রসূতি সেজে তাঁরা লুকিয়ে মাইলের পর মাইল হেঁটেছেন, পাছে না মিলিটারী এসে ধরে। একবার ধরা পড়েই গেলেন। সংক্রামক রোগের বাহানায় একটুর জন্য রক্ষাও পেলেন। আমাদের ঠাকুরবাড়ি থেকে কলকাতা পর্যন্ত একটানা হেঁটে, শরণার্থী ক্যাম্পে থেকে অবশেষে পৌঁছলেন কলকাতায়।
দমদম জংশন ১৯৪৭ থেকেই পূর্ব বাংলার কলোনির ইতিহাসের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। ১৯৭১ পরবর্তীকালে সেই দমদম ভরে উঠেছিল বাংলাদেশী শরণার্থীতে। বড় পিসেমশায় (বলরাম ভট্টাচার্য), দমদমের শীল কলোনির দোতলা বাড়িটির নাম রেখেছিলেন 'যশোহর ভবন'। কাকতালীয়ভাবে যশোহর ভবন যশোরের শরণার্থীদের কাজে এল; আশ্রয় নিয়েছিলেন অনেক মানুষ এই বাড়িতে। আমার বাবা তাঁর শরণার্থী কার্ড নিয়ে ক্যাম্প থেকে চিঁড়ে মুড়ি অন্যান্য শুকনো খাবার নিয়ে আসতেন অভুক্ত শরণার্থীদের জন্য। শুনেছি বড়পিসেমশায় দীর্ঘদিন খাবারের অনিঃসীম জোগান দিয়েছেন, নিজের খাওয়া ভুলে গিয়ে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া চেনা অচেনা মানুষের জন্য তিনি প্রাণপাত করেছেন। কিছু না জুটলে কাশির সিরাপ দিয়ে রুটি খেয়ে দিন কাটিয়েছেন। বাবা তাঁর সঙ্গীদের বাঁচানোর জন্য দিনের পর দিন ক্যাম্প থেকে ডৌল সংগ্রহ করতেন। স্বাধীনতার পর তিনিও দেশে ফিরে গেলেন। সেখানে তাঁর জন্য এক সাহসী মা অপেক্ষা করছিলেন দিনের পর দিন--সন্তানের ঘরে ফেরার জন্যে। যে বৃদ্ধা নারী নিজে না গিয়ে পরিবারের জীবন বাঁচাতে সবাইকে দূরে পাঠিয়েছেন, যুদ্ধের দিনে নিজেকে সামলেছেন, তাঁর সেই অসীম মনোবল ও সাহসকে স্যালুট জানাতেই হয়। দেশে ফিরে সবার মত আমার বাবাও নিজ কাজে মন দেন। সদ্য যুদ্ধ সামলে ওঠা ভাঙ্গা দেশ একটু একটু করে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শুরু করে। ...
বলতে বলতে আমাদের দুজনের মধ্যেই অদ্ভুত এক নীরবতা। অথচ চারদিকে এত লোকের আনাগোনা, এনাউন্সমেন্ট। এবার লিওনার্ডের যাবার সময় হলো। কখনো আবার দেখা হবার সৌজন্য জানিয়ে এতক্ষণের শ্রোতা বিদায় নিলেন। আমার সামনে পড়ে রইলো এতক্ষণের স্মৃতিচারণ, আমার পরিবার, আমাদের বাংলাদেশ। জীবনে সবার জন্য কিছু নির্দিষ্ট জিনিস বাধা থাকে। তার বাইরে এগোনো কিংবা পিছনো যায় না। দেশ বিষয়টি বোধহয় এমনি। আমাদের যাপিত জীবনে যেমন ভালো লাগা, ভালোবাসা, স্মৃতি, স্নেহ, দয়া, ক্ষোভ একটা মাপ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ হতে পারে। দেশের জন্য এই অনুভব অনিঃশেষ।
এই যে এখানে বসে আছি, এটুকু সময়ে আমার সঙ্গে যা যা হবার ছিল, তার বাইরে কিছুই হচ্ছে না। আর নতুন কারো আগ্রহ দেখাবার প্রশ্নই নেই। কিন্তু কথোপকথনের রেশ এখনো আমার সময়কে থামিয়ে দিচ্ছে। কত কিছুর মধ্যে দিয়ে দেশান্তরকে উপলব্ধি করছি। আমার চারদিকে বহুভাষিক, বহু দেশের মানুষের নিরন্তর চলাচল। যেখান থেকে প্লেন দেখা যাচ্ছে, সেখানে গিয়ে বসি। ওই প্লেনটা কি বাংলাদেশে রোজ যায়? অথবা কাছাকাছি? মাত্র তিরিশ ঘন্টা এদিক ওদিক পেরোলেই আমার বাড়ি। যুদ্ধ ও এত স্মৃতিকথা যে বাড়ি থেকে।
মনে আছে, আমাদের বাংলা বই খুললেই বীরশ্রেষ্ঠদের ইতিহাস জানা যেত। কটা সেক্টর, ব্যাচ নম্বর, ব্যাটেলিয়ান সব মিলিয়ে শ্বাসরুদ্ধকর এক-একটি জীবনী পড়তাম আমরা। তখন বুঝতাম না, যে বয়েস নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার, এগিয়ে যাবার জন্য নির্ধারিত, আমাদের দেশে ১৯৫২-পরবর্তী প্রজন্ম, শুধু মাত্র দেশের জন্য সেই পার্থিব চাহিদার বয়েস গুলোকে উত্সর্গিত করে গেল। আজ আমরা পৃথিবীর কোন প্রান্তে কোন বিপর্যয় দেখলে, সামাজিক মাধ্যমে পছন্দ করে অথবা না করে, মন্তব্য করে অথবা না করে শৈল্পিক কুশলতায় সব এড়িয়ে যেতে পারি। কিন্তু আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা সেদিন কিছুর পরোয়া না করে রাস্তায় নেমে গেছিল। এরাই আমাদের রূপকথার হার-না-মানা সুপারম্যান।
ছোটবেলা থেকেই আমাদের দেশের প্রজন্মের কাছে ৭১ এক বিশেষ ঘটনা, আর কিছু জানুক বা না জানুক স্বাধীনতা বিষয়ে তারা অনর্গল বলে যেতে পারে। এজন্য দেশের ইতিহাস, পাঠ্যের বাইরেও মানুষের সঙ্গে সঙ্গে চলে। বাবর, আকবর, অশোক, কিংবা আলেকজান্ডার, নেপলিওনের তুলনায় রফিক, বরকত, শফিক জব্বরের মত শহীদেরা আমাদের ঘরের অনেক কাছের মানুষ। আজ আমাদের দেশে যতই বর্গী নেমে আসুক, স্বাধীনতা বাংলাদেশী মানুষের হৃদয়ে কখনো হারিয়ে যায় না। আর তা হারিয়ে যায় না বলেই আজও হাটে মাঠে ঘাটে সর্বত্র গর্বের সঙ্গে সেই কাহিনী ব্যক্ত করা যায়।
২০১৬ সালের বর্তমান পৃথিবীতে অনেক দেশই এখন বারুদের স্তূপে ঢেকে আছে। আধুনিক জমানার বাসিন্দা হয়েও লক্ষ লক্ষ যুদ্ধমানুষ আজও অসহায়, তাদের না আছে দেশ, না আছে ভবিষ্যৎ। বিপদ-আকীর্ণ তারা প্রতিমুহূর্তে। সেই জীবনগুলো ইতিহাস হতে হতে ফসিল হবার পথে। আমরা খুঁজতে চাই না, তাদের পরিবারের গল্পগুলো হারিয়ে যাচ্ছে কিনা কোথাও? স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে কিনা কোনো বোবা পাহাড়ে? ...
জানি এয়ারপোর্টে এই সংবেদন হয়ত অবান্তর! কিন্তু লিওনার্ডের মত বন্ধুর সৌজন্য কোথাও ভেতরের নির্বাক সত্তাকে স্ববাক হবার আহ্বান জানিয়ে গেল। ঘড়িতে কটা বাজে খেয়াল নেই। আমার শহর এখন নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে। এই মুহূর্তে রাশি রাশি মেঘ ভেসে আবার উড়ে যাচ্ছে সবেগে। সে যাক। এয়ারপোর্ট থেকে বিদায় নেবার সময় হয়ে এলো। শহর থেকে শহরে, হাজার হাজার মাইল পেড়িয়ে এই গল্পেরা থাকুক অব্যাহত। একটুকু ছোঁয়া লাগুক...
লেবু পাতার গন্ধে মাখা সেই দেশ চিরতরে আমার সঙ্গী হোক।